ফুলকি
ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
দৌড়োচ্ছে! অপলা দৌড়োচ্ছে!
সতেরো বছরের ফুসফুসের মধ্যে যতটা বাতাস ধরে, ততটা বাতাসকে প্রাণপনে টেনে নিয়ে পাগলের মতো দৌড়োচ্ছে অপলা।
অপলা এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। এবারে মানে আর ঠিক দিন ছয়েক বাদে। শিবপুর হিন্দু গার্লস হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সে। অঙ্কে মাথা ছোটে রকেটের গতিতে, ফিজিক্সেও মোটামুটি সেরকমই। অর্গানিকটা ভালো না লাগলেও ইনঅর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ওকে রোখা মুশকিল। স্কুলের দিদিমণিরা বড়ো আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। টুয়েলভের ক্লাস টিচার শ্রীপর্ণা ম্যাডাম সেদিন তো বলেই ফেললেন বড়দি’কে, “ম্যাডাম, রাজ্যে প্রথম দশের মধ্যে ওর নাম না থাকলেই বরং হতাশ হব আমি।” বড়দি স্মিত হাসি মুখে মাথা নাড়েন। তারপর একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “শোনো, এখন তো স্টাডি লিভ পড়ে গেল। ওর সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখো ফোন আর হোয়াটস্যাপ-এ। পড়াশুনোর জন্য যদি কখনও কিছু লাগে, আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। স্কুলের ফান্ড থেকে কতটা কী দিতে পারব জানি না; দরকার হলে আমি নিজে দেব।”
“অবশ্যই ম্যাম,” সম্মতি দেন শ্রীপর্ণা ম্যাডাম।
“বুঝলে শ্রীপর্ণা, অপলা যদি সত্যিই আই.আই.টি পেয়ে যায় বা দেশের সেরা কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সুযোগ করে নিতে পারে, তাহলে সেটা শুধু ওর একার জয় হবে না। জয় হবে এই ইছাপুরের মতো হাজারো মফস্বলের। জয় হবে সরকারি স্কুলগুলোর। মানুষ বুঝবে যে শহুরে জীবনের হাজারো সুবিধা ছাড়াও, সরকারি স্কুলে পড়েও দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে জায়গা করা সম্ভব।”
অপলা ছুটছে! বারবার এর তার সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতেও ছুটছে। একবার মাটিতে হাঁটু মুড়ে পড়ে গেল, পাশের দেয়ালে ঝোলানো ত্রিপলটা খামচে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছোটা শুরু।
অপলার বাবা হাওড়া স্টেশনে কুলির কাজ করেন। মা বাড়ি বাড়ি রান্না করেন। মোড়ের মাথায় যে দৈত্যের মতো উঁচু বিরাট এপার্টমেন্টখানা তৈরি হল – ‘প্রিভিলেজ’ না কী যেন বেশ নাম দিয়েছে সেটার - ওই এপার্টমেন্টের দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ করেন মা। রোজদিন ভোরে উঠে অপলাদের রান্না সেরেই দৌড়োতে হয় কাজে। বিকেলের কাজ সেরে মা যখন ফেরেন, ততক্ষণে স্কুল থেকে ফিরে চলে আসে অপলা। পেট খিদেয় ছিঁড়ে যাচ্ছে ততক্ষণে। মায়ের ফেরার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারে না সে। নিভু নিভু হলদে আলোর তেলচিটে রান্নাঘরের তাক থেকে চিড়ে, মুড়ি, ছাতু যা পায় জলে গুলে, অল্প চিনি মিশিয়ে গলায় ঢেলে দেয়। তবে একটু শান্তি! ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে বইখাতা গুছিয়ে টিউশন পড়তে বেরোয় সে। সারাদিন কেমিস্ট্রির ফর্মুলা আর ফিজিক্সের থিওরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাঝেসাঝে একটু একঘেয়ে লাগলে গল্পের বই পড়ে। সেদিন লাইব্রেরি থেকে নেওয়া একটা লাতিন আমেরিকান উপন্যাস পড়তে গিয়ে এই দুপুরের ঘুমের একটা জব্বর স্প্যানিশ প্রতিশব্দ জানতে পেরেছে। ‘সিয়েস্তা’! শব্দটা বেশ পছন্দ হয়েছে ওর।
টিউশন শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ওদের বস্তিতে ঢোকার আলো-আঁধারি গলিটা দিয়ে এসে যখন বাড়িতে ঢোকে অপলা, ততক্ষণে বাবা ক্লান্ত দেহে খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হাত মুখে ধুয়ে, বাইরের কাপড় ছেড়ে চা বানায় সে। মা দুধ-চা খান, বাপ-মেয়েতে মজা করে সেটাকে পায়েস বলে ডাকে। কড়া করে বানানো দু-কাপ চা খাটের পাশের পায়া-ভাঙা নড়বড়ে টেবিলটায় সাবধানে ব্যালান্স করে বসিয়ে, বাবাকে ডেকে তোলে অপলা। ঘুম থেকে ওঠার মুহূর্তেই রোজ কাঁধে খিচ লেগে যায় বাবার। অপলা দ্যাখে, সারাদিন মাথার উপর মোটের ওজন নিতে নিতে ফুলে দগদগে হয়ে উঠেছে বাবার কাঁধের শিরা। যেন এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে। এক একদিন মোড়ের হরিদার ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে চেয়ে-চিন্তে সাদা ন্যাকড়ায় মুড়ে কয়েক টুকরো বরফ নিয়ে আসে। আলতো করে লাগিয়ে দেয় বাবার ব্যথার জায়গাগুলোয়।
আরও দুটো বাঁক ঘোরার পর গলগলে ধোঁয়াটা কাছ থেকে দেখতে পেল প্রথমবার। পাক খেতে খেতে নিকষ কালো ঘূর্ণিঝড়ের মতো আকাশ ফুঁড়ে উপরে উঠছে। একটু দম নিয়েই আবার দৌড় শুরু করল অপলা।
ওদের এই ছোট্ট দেড় কামরার ঝুপড়িটা কিন্তু খুব প্রিয় অপলার। আপাতভাবে দেখলে ওরা আগে পদ্মপুকুরের যে বস্তিতে থাকত, তার সঙ্গে খুব একটা ফারাক নেই। সেই করোগেটেড শিটের ছাদ, সেই ঘরের মধ্যে ডাঁই হয়ে থাকা পুরোনো লেপ তোশক, চোকলা ওঠা হলুদ দেয়াল, বর্ষাকালে ছাদের উপর অবিরাম পিট্ পিট্ শব্দ। সবকিছুই একই আছে। ফারাকটা আসলে খুবই সূক্ষ্ম, হয়তো সেটা শুধু অপলার নজরেই পড়ে। বাড়ির পিছন দিকে বাড়ির গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে একটা ড্রেন। ড্রেন আর গেটের মাঝখানে একটা পাঁচ বাই চার ফুটের এক ফালি জমি। সেই জমিতে ফোটা হাজারো আগাছার মাঝে ক’টা লাল নীল হলুদ সবুজ ঘাসফুল রোজ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসে। ওই ছোট্ট জমির ফালিটা, অপলার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দেয়। মাঝে মাঝে যখন ছাদের শিটের ফুটো দিয়ে টপ টপ করে মেঝেতে জল পড়ে, একটা ছোটো বালতি নিচে রেখে দেন মা। বেশ খানিকটা জল জমলে ঘাসফুলগুলোকে চান করিয়ে দেয় অপলা।
আজকের মতোই সপ্তাহে তিনদিন বিকেলে বর্মন স্যারের কাছে ফিজিক্স পড়তে যায় সে। বর্মন স্যার অপলাকে যেন নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। এক রকম বর্মন স্যারের কথাতেই তো অপলা আই.আই.টি-র প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাহলে যে কোনো একটা মাঝারি গোছের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হলেই হয়তো খুশি হয়ে যেত ও। কিন্তু বর্মন স্যার বলেন, “জানিস অপা, অনেক মানুষ জীবনে বড়ো কিছু অর্জন করতে পারে না তাদের প্রতিভা কম বলে নয়, স্রেফ বড়ো স্বপ্ন দেখার সাহস করতে পারে না বলে।” স্যারের এই মানসিকতাটা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েছে অপলার মধ্যেও। ও এখন শুধু বুল’স আই-টাই দেখতে পায়, এক ইঞ্চিও এদিক ওদিক না। স্যার আরও বলেন, “এই যে তোর জীবনে এত রকমের সমস্যা - দামি বই কেনার টাকা নেই, এক এক দিন ভর্তি পেট খাবার জোটে না, বড়ো ইনস্টিটিউট-এ জয়েন্টের প্রস্তুতি নেওয়ার মতো পয়সা নেই, একটা দমবন্ধকর ছোট্ট ঘরে থাকতে হয়, আশেপাশে প্রায়দিন অশান্তি লেগেই রয়েছে - এই সমস্যাগুলোকে জীবনের বাইরে ভাববি না। এগুলোকে জয়েন্ট বা উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে একই রেখায় বসাবি। এরা সবাই তোকে তোর লক্ষ্যে পৌঁছোনোর পথে বাধা দিচ্ছে। যারা এই বাধাগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়, তারা সামনে এগোতে পারে না। আর যারা জীবনযুদ্ধে জেতে, তারা ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মতো শুধু সামনেটা দেখতে পায়।”
বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমেই কমে আসছে। বাড়তে থাকা ধোঁয়ার মধ্যে কাশতে শুরু করে অপলা। সকলে উন্মাদের মতো পড়ি কি মরি করে দৌড়ে বেরিয়ে আসছে বস্তি ছেড়ে। প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষের বাস এই ইছাপুর বস্তিতে। নিজেদের সবটুকু সঞ্চয়কে পুড়ে খাক হয়ে যেতে দেখতে দেখতে অসহায়ের মতো প্রাণ বাঁচাতে দৌড়োচ্ছে তারা। কিন্তু অপলা দৌড়োচ্ছে ঠিক উলটো মুখে, বস্তির দিকে মুখ করে। ঠিক তখনই পলি দেখতে পেল ওকে। দৌড়োতে দৌড়োতেই চিৎকার করে বলে উঠল, “ওদিকে যাস না অপা। খুব বাজে অবস্থা। দমকলের লোকগুলো কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না।” পলির গলার মধ্যে দমচাপা কান্নাটা বেরিয়ে আসে, “সব শেষ হয়ে গেল রে, অপা।”
কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে কিছুই শুনতে পায় না যেন। একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন সে। শুধু সামনে ছুটতে থাকা ছাড়া আর কিছুই মাথায় নেই তার।
সেবার যখন আমফন হল, ওদের বস্তির সব ক’টা ঘর জলে ডুবে গিয়েছিল। এমনিতেই হাওড়া জেলার ইছাপুর থেকে বাকি অংশটুকু একটু নিচুতে, জল জমে খুব তাড়াতাড়ি। সেবার সাত দিন অবধি জল নামেনি। ঝড় কেটে যাওয়ার পর হাওড়া জেলা স্কুলে রিলিফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওদের। বর্মন স্যার জেলা স্কুলেরই ফিজিক্সের শিক্ষক। নিজে এসে মা-বাবার সঙ্গে ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যাম্পে। ঘর থেকে বেরোনোর আগে শেষ একবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল অপলা। খাটের সামনে হাঁটুসমান জলের মধ্যে ভাসছে ওর বইগুলো, জ্যামিতি বক্স, আর তিনদিন আগে কষা অঙ্কের খাতাটা।
রাতে ছেঁড়া পাউরুটি আর জল খেয়ে একবার কী মনে হতে ক্যাম্পের বাইরে এসে দাঁড়ায় অপলা। জল পুরো নামতে এখনও দিন তিনেক লাগবে। মাথায় একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে। বর্মন স্যার।
“কী ভাবছিস?”
“বইগুলো সব নষ্ট হয়ে গেল, স্যার। খাটের পায়াগুলো এমনিই পচে যাচ্ছিল, এতদিন জলে ডুবে থাকার পর তো আর...।” একটু থামে অপলা, তারপর বলে, “মাথার উপরের করোগেটেড চালটা অবধি উড়ে গিয়েছে স্যার।”
দুই আঙুলে অপলার চিবুকটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বর্মন স্যার বলেন, “ফিনিক্স পাখির কথা জানিস? যাকে আমরা আগুনপাখিও বলে থাকি। অথচ জন্মায় কোথায় জানিস? ছাইয়ের মধ্যে। সেই ছাই থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এমন উড়ান দেয়, যে আকাশকে মনে হয় দোতালা বাড়ি।”
স্যারের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে অপলা। স্যারের ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি। বলেন, “যা কিছু শিকল তোকে বেঁধে রেখেছে অপা, সবগুলোকে ছিঁড়ে বেরোনোর জন্য তোকে একটাই জিনিস দিয়েছে ঈশ্বর। তোর ঝকঝকে মাথাটা। ওটাই হচ্ছে ফিনিক্স পাখির ডানা। এই ইছাপুরের বস্তি, এই জমা জল, এই আধপেটা খাওয়া, বড়োলোকের ছেলেপিলেদের হেয় করা - এই সবকিছুর থেকে তোকে টান মেরে ওই আকাশে নিয়ে যেতে পারে এই ডানাটা। শুধু সামনের ক’বছরের পরীক্ষাগুলো জম্পেশ করে দে, ভেঙে ফ্যাল খাঁচার দরজাটা।”
একটু থেমে স্যার যোগ করেন, “তোদের এবারের বাংলা সিলেবাসে মতি নন্দীর ‘কোনি’ আছে না? তাহলে? কোনি যদি পারে, আমাদের অপা পারবে না কেন?”
অবাধ্য জলের কণাটা টপ করে গাল বেয়ে নেমে আসে অপলার। জোরে জোরে উপরে নীচে মাথা ঝাঁকায় সে।
চারপাশের বাতাসের উত্তাপ ভয়ানক রকম বেড়ে গিয়েছে। দম আটকে আসছে অপলার। নাক মুখ দিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে শরীরে। কোনোরকমে টলতে টলতে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে মা-বাবাকে দেখতে পায় ও। আশেপাশের আরও অনেকের মতোই মা তারস্বরে বিলাপ করে চলেছেন। চোখের সামনে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন একটা ঝুপড়ি থেকে আরেক ঝুপড়িতে। যেন নরক থেকে আসা কোনো রাক্ষস গিলে খাবেই সব-হারানো মানুষগুলোর শেষ রেস্তটুকুও। সেই নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলার দিকে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছে অপলা।
বাবা এসে জাপটে ধরেন অপলাকে। “তুই ঠিক আছিস তো মা? তুই এদিকে আসতে গেলি কেন? গোটা বস্তি পুড়ছে, তোর যদি কিছু...।” বাবা অনেক কিছু বলছেন, কিন্তু একটা শব্দও কানে ঢুকছে না অপলার। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে একটু একটু করে ঝলসে যেতে থাকা ওদের ঝুপড়িটার দিকে।
বর্মন স্যারের ব্যাচে বসে ঘড়ি ধরে একমনে ফিজিক্সের একটা উত্তর লিখছিল অপলা, যখন প্রথম খবরটা ওর কানে পৌঁছয়। বর্মন স্যারই হন্তদন্ত হয়ে এসে খবর দেন, “অপা, তোদের বস্তিতে যে আগুন লেগেছে রে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী জানালেন। খবরটা ঠিক। বাড়ির ছাদ থেকে দেখে এলাম এখুনি।”
এক দৌড়ে স্যারের সঙ্গে ছাদে উঠে এসেছিল অপলা। একটা বিরাট আকারের হেলে যাওয়া মিশমিশে কালো ধোঁয়ার স্তম্ভ আকাশের উপর অবধি উঠে গিয়েছে। মানুষগুলোর চিৎকার এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে ফোন করেছিল। কপাল ভালো, আগুন তাদের ঝুপড়ি অবধি আসার আগেই টের পেয়ে মা-বাবা দুজনেই বাইরে বেরিয়ে আসেন। দমকলও এসে গিয়েছে, কিন্তু উত্তরের হাওয়ায় এত দ্রুত আগুন ছড়াচ্ছে, যে তাকে আয়ত্তে আনা সম্ভব হচ্ছে না। নিজেকে প্রচণ্ড রকম অসহায় লাগতে থাকে অপলার। এইভাবে তাদের সবটুকু এক নিমেষে স্রেফ ছাই হয়ে যাবে? কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না?
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে ওর। অটো বা বাস পেতে অনেক সময় লাগবে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে স্যারের বাড়ির পিছনের শর্টকাট দিয়ে দৌড়োতে শুরু করে অপা।
বাবার হাত ছাড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় অপলা ঝুপড়ির দিকে। পেছন থেকে একজন দমকল কর্মী বলে ওঠে, “এই যে, এই মেয়ে, ওদিকে যেও না, বিপদ হতে পারে।” বাবা বলে উঠলেন, “এদিকে চলে আয় মা, আর দেখে কী করবি?” অপলা যেন বধির হয়ে গিয়েছে। একবার ডানদিকে, একবার সামনে আর একবার বাঁ পাশে দাঁড়ানো বাবার দিকে তাকায়। যে কাজটা ও করতে যাচ্ছে, সেখানে ঠিক কোন কোন দিক থেকে বাধা আসতে পারে ঠান্ডা মাথায় সেটা হিসেব করার চেষ্টা করে ও। দুজন দমকলকর্মী আর বাবা। বাকিরা সবাই বেশ খানিকটা তফাতে আছে। ও যেখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে ওদের ঝুপড়ির দূরত্ব ৩০০ মিটার মতো হবে।
খুব দ্রুত হিসেবগুলো সেরে নিয়ে কাঁধের ব্যাগটা একপাশে ছুড়ে ফেলে অপলা। বুক ভরে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে তিরবেগে দৌড়োতে শুরু করে ও। তিন সেকেন্ডের মধ্যে পিছন থেকে লোকজনের তীব্র চিৎকার শুনতে পায়। মা চিৎকার করে উঠছেন, “কেউ আমার মেয়েটাকে বাঁচাও, ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে?” বাবা একটা চিৎকার করে ওকে ধরার জন্য ছুটে আসেন। ততক্ষণে অপলা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। বাঁদিক থেকে ছুটে আসে সেই প্রথম দমকলকর্মী। অপলা তৈরিই ছিল, লোকটার হাতটা ধরে সজোরে একটা কামড় দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় তাকে। লোকটা টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। তাকে ডিঙিয়ে ঝুপড়ির প্রায় কাছে চলে আসে অপলা। এবার শেষ বাধা। ডানদিক থেকে দ্বিতীয় লোকটা চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে। নিচু হয়ে ঝুঁকে মাটি থেকে একটা ইটের টুকরো তুলে নিয়ে লোকটার গায়ে ছুড়ে মারে। লোকটা সামলানোর আগেই এক লাফে আগুনে জ্বলতে থাকা ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে অপলা।
ঢুকেই বুঝতে পারে ওড়নায় আগুন ধরে গিয়েছে। এক ঝটকায় সেটা খুলে ফেলে মাটিতে। এদিক ওদিক থেকে ভেঙে পড়ছে কাঠ, ইটের টুকরো। কোনোমতে সেগুলো থেকে বেঁচে ভেতরের ঘরে ঢোকে ও। পড়ার টেবিলের উপর নেচে চলেছে আগুনের শিখা। ডানদিক থেকে লাল ফাইলটা তুলে নেয় অপলা। ফাইলের কোনাটা পুড়ছে। জলদি সেটা টেবিলে চাপড়ে নেভায়। দ্রুত বের করে আনে কাঙ্খিত জিনিসটা ফাইল থেকে।
ঠিক এই সময় গোড়ালির কাছটায় অসহ্য জ্বালা হতে শুরু করে ওর। তাকিয়ে দ্যাখে কামিজে আগুন লেগে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জুতো খুলে কামিজে চাপড় মেরে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। সেই মুহূর্তে ঘরের খোলা জানলা দিয়ে গলগল করে বিষাক্ত ধোয়া ঘরে ঢোকে। মুহূর্তের মধ্যে মাথা ঘোরাতে শুরু করে ওর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, টলতে টলতে মাটিতে পড়ে যায়। গোড়ালির কাছে জ্বালার যন্ত্রণাটা অসহ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই আর ওর। পুরো ঘরটা বনবন করে ঘুরছে চোখের সামনে।
তারপর? অন্ধকার!
অল্প একটু যখন জ্ঞান ফেরে আবার, তখন ওর মনে হয় কোনো একটা চলমান বিছানাতে ওকে শুইয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চারপাশটা এখনও ঘুরে চলেছে, দম আটকে আসছে। আর এই সবকিছুর মাঝে কে যেন চিৎকার করে বলে চলেছে, “ফাইট অপলা ফাইট, ফাইট অপলা ফাইট!” দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারাতে হারাতে বিড়বিড় করে অপলা বলে ওঠে – “পরীক্ষাটা দেব, পরীক্ষা...”
ধীরে ধীরে চোখ খোলে অপলা। শরীরের জায়গায় জায়গায় অসহ্য জ্বালা। চোখ খুলেই পাশে মা’কে দেখতে পায়। অন্য পাশে বাঁ হাতটা মুঠোয় ধরে বসে আছেন বাবা। সামনে তাকিয়ে দেখে হাসপাতাল বেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বর্মন স্যার।
“এই তো... মেয়ে আমাদের ঘুম থেকে উঠেছে,” বলে ওঠেন বর্মন স্যার। “আচ্ছা, তুই কী রে? এমন ঘুম দিচ্ছিস কাল থেকে, একেবারে কি পরীক্ষার দিন সকালে উঠতিস নাকি?” হেসে ওঠেন তিনি।
“আর পরীক্ষা! যা গেল মেয়েটার উপর দিয়ে... এই অবস্থায় কী করে ও...?” বলে ওঠেন মা।
“কী বলছেন বউদি? যে জিনিসটার জন্য মেয়ে আমাদের আগুনে ঝাঁপ দিল, সেই জিনিসটাই ওকে দিতে দেব না আমরা? আর তাছাড়া ডাক্তারবাবু তো বললেন, বিষাক্ত গ্যাস ঢুকে পড়েই আসল বিপত্তি হয়েছে। তার ওষুধ পড়েছে, তিন-চার দিনে দিব্যি ঠিক হয়ে যাবে। আর বার্নিং ইনজুরি তো শুধু পায়ে। ও আমি হুইলচেয়ারে নিজে নিয়ে যাব পরীক্ষা দেওয়াতে। আপনি চিন্তা করবেন না।”
বর্মন স্যারের কথায় নিশ্চিন্ত হয় অপলা। কিন্তু পরমুহূর্তেই জিনিসটার কথা মনে পড়তেই ছটফট করে ওঠে।
“মা মা... তোমরা কি ওটা পেয়েছ? ওটা কী পুড়ে গিয়েছে? বলো না মা...”
“দাঁড়া বাবা, শান্ত হ,” বাবা মাথায় হাত রাখেন। “যেটা বাঁচাতে তুই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লি, সেটা একদম ঠিক আছে। আমি যত্ন করে ল্যামিনেশন করিয়ে ফাইলে রেখে দিয়েছি। এই নে।”
ব্যাগ থেকে ফাইলটা বের করে, তার থেকে উচ্চমাধ্যমিকের ল্যামিনেটেড এডমিট কার্ডটা বের করে মেয়ের হাতে দিলেন বাবা।
বুকের ভিতরের ধুকপুকানিটা এতক্ষণে শান্ত হল অপলার।
“তুই এইটার জন্য আগুনে লাফিয়ে পড়লি রে মা? এইটা তো আবার সাইবার ক্যাফেতে গেলেই ডাউনলোড করা যেত।”
বর্মন স্যার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই অপলা বলে উঠল, “না মা, যেত না। সেদিন এডমিটের কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই আমি স্যারের ল্যাপটপ থেকে ডাউনলোড করার চেষ্টা করেছিলাম। এডমিট কার্ড নেওয়ার লাস্ট ডেট পেরিয়ে গিয়েছে তিনদিন আগে।” একটু থামে অপলা। আবার বলে, “এটা পুড়ে গেলে আমার আর হয়তো পরীক্ষা দেওয়া হত না এবারের মতো। একটা গোটা বছর আমার...” মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে অপলা।
বর্মন স্যার এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন, “তোকে আমি বলেছিলাম বটে যে, ফিনিক্স পাখি ছাই থেকে জন্মায়। তুই কথাটাকে এত সিরিয়াসলি নিয়ে নিবি জানলে আমি বলতাম না রে।”
স্যারের কথা শুনে দু-চোখ ভর্তি জল নিয়েও ফিক করে হেসে ফেলে শিবপুর হিন্দু গার্লস হাই স্কুলের ফার্স্ট গার্ল অপলা মাঝি।
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী