ম্যাজিক ল্যাম্প:: মার্চ ২০২৫

দশম বর্ষ।। প্রথম সংখ্যা।। মার্চ ২০২৫
ছুটি ছুটি সংখ্যা
--------------
 
প্রচ্ছদ: মৃণাল শীল
----------

সম্পাদকীয়:: মার্চ ২০২৫


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,
কেমন আছ সবাই? অনেকদিন তোমাদের সঙ্গে কথা হয়নি, তাই মনটা একটু খারাপ খারাপ লাগছিল কী করব বলো, জিনিরও তো অনেকরকম কাজ থাকে পৃথিবীতে যত এলোমেলো খারাপ খারাপ জিনিস, জিনিরও তত কাজ, তত দায়িত্ব তবে এই যে তোমাদের জন্য চলে এসেছি ম্যাজিক ল্যাম্পের নতুন ছুটি ছুটি সংখ্যা নিয়ে আমি নিশ্চিত যে এই সংখ্যাটা পড়লে তোমাদের মন ভালো হবেই তেমনই সব মনমাতানো গল্প ছড়ায় ভর্তি এই সংখ্যা
প্রচ্ছদের ছুটির গন্ধ মাখা ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী মৃণাল শীল এবং ম্যাজিক ল্যাম্প-কে সাজিয়ে গুছিয়ে তোমাদের সামনে এনেছেন তাপস মৌলিক
এবারে কলকাতা বইমেলায় আমাদের ম্যাজিক মিটের হই হই আড্ডার ঝলক- রয়েছে ম্যাজিক ল্যাম্পে
তাহলে তাড়াতাড়ি পড়তে বসে যাও বইয়ের সিলেবাসের পড়ার বাইরে যে বিরাট গল্প, ছড়ার অলীক জগৎ রয়েছে তা অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য
খুব ভালো থেকো আনন্দে থেকো
ইতি,
তোমাদের জিনি
----------
ছবি - আন্তর্জাল

গল্প:: টা টু - বিপুল দাস


টা টু
বিপুল দাস

তাতু সব সাবজেক্টে ফেল। বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানে বারো চোদ্দ, সতেরো – এরকম তার নম্বর। কিন্তু অঙ্কে আশি। মাস্টারমশাইরা আর অবাক হন না। বরাবর তাই হয়। ওভাবেই সে ক্লাস এইটে উঠে পড়েছে। অঙ্ক ছাড়া আর কোনো বিষয়েই তার কোনো আগ্রহ নেই। ক্লাসে বিমর্ষ হয়ে বসে থাকে। কোনো স্যার তাকে বিরক্ত করেন না, সেও কোনো স্যারকে বিরক্ত করে না। শুধু অঙ্কের বাঘা স্যার সুহৃদবাবু ক্লাসে এলে সে চনমন করে ওঠে। যেন তার নতুন রক্তপ্রবাহ বইতে শুরু করে। শরীরে বিদ্যুত্তরঙ্গ খেলে যায়। অঙ্কের স্যার কেমন করে চৌকিদার আর চোরের গতিবেগের অনুপাত বের করে ফেলেন, কীভাবে প্রমাণ হয়ে যায় ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি আসলে দুই সমকোণ, চৌবাচ্চায় জল ঢোকার আর বেরোনোর হিসেব কেমন করে স্যার বের করে ফেলেন – মুগ্ধ বিস্ময়ে তাতু সেটাই লক্ষ করে আর শিহরিত হয়। অঙ্কগুলো যেন এক একটা রহস্য, কিন্তু স্যারের কাছে ছাড়ান নেই। গলিঘুঁজি বেয়ে বেয়ে স্যার ঠিক কান ধরে উত্তরটা খুঁজে আনেন। সমাধান হয়ে যায় একটি জটিল দ্বিঘাত সমীকরণের। স্যারও তেমনি। বোর্ডে কঠিন অঙ্ক দিয়ে ক্লাসের ফার্স্ট বয় তমালকেও নয়, তাতুকেই বোর্ডে ডেকে কষে দিতে বলবেন। তারপর নিশ্চিন্তে চেয়ারে গিয়ে বসবেনজানা কথাই তাতু এখনই আঁক কষে সঠিক উত্তর বের করে আনবে, সব ছেলেও তাই জানেওর মাথায় যে কী আছে – ভগবান জানেন। অন্য ক্লাসগুলোয় সে যেন নির্জীব একটা মরামানুষ। বাংলা কবিতা, ইংরেজি ট্রান্সলেশন, সিপাহি বিদ্রোহ, জোয়ারভাটার কারণ – তার কোনো সাড়াশব্দ থাকে না। মরা মাছের মতো তার চোখে কোনো অভিব্যক্তি ফোটে না। নির্বিকল্প সমাধি অবস্থায় পিরিয়ড কাটিয়ে দেয়। স্যারেরা তার এই ভাব সমাধি বিলক্ষণ চেনেন। ভাঙানোর কোনো চেষ্টা করেন না। কানাঘুষো শোনা যায় তার ক্লাস এইটে উঠে পড়ার পেছনে অঙ্কের স্যার সুহৃদবাবুর গোপন হাত আছে।
একবার জীবনবিজ্ঞানের নতুন স্যার বুঝতে না পেরে তাতুকে জিজ্ঞেস করে বসলেন – কয়েকটা অমেরুদণ্ডী প্রাণীর উদাহরণ দে তো। নতুন স্যার জানতেন না তাতু মজুমদার অঙ্ক ছাড়া অন্য সব বিষয়ে অস্পৃশ্য প্রাণী। তাতু নিজে তো বটেই, ক্লাসের অন্য ছেলেরাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এরকম দৃশ্য তাদের কাছে অদৃষ্টপূর্ব। নতুন স্যারের এত সাহস, এত বুকের পাটা তাতুকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। উনি কি স্কুলের অলিখিত নিয়ম জানেন না। অঙ্ক ছাড়া অন্য বিষয়ে তাতুকে বিরক্ত করা শক মানা হ্যায়। নিষিদ্ধ ব্যাপার।
তাতু বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করল। এরকম দ’এ এর আগে কোনোদিন সে পড়েনি। আশপাশের বন্ধুদের দিকে তাকাল। সবাই গম্ভীর। স্যারও যেন নাছোড়বান্দার মতো তার দিকেই তাকিয়ে আছেনতাতুর একবার ইচ্ছে হল সেও উলটো তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কটা স্যারকে জিজ্ঞেস করে। যে অঙ্কটা ক্লাসের মধ্যে সে সবার আগে করে খাতা জমা দিয়েছিল। সুহৃদবাবু তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে সেই হাত আবার নিজের মাথায় বুলিয়ে নিয়েছিলেন। অনেকটা তেল তাতুর মাথা থেকে তাঁর মাথায় ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিল।
এই স্যার একটা লিকলিকে বেত নিয়ে ক্লাসে এসেছেন। কে জানে কোথায় পেলেন বেত। এসব তো কবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। বোধহয় বাড়ি থেকেই এনেছেন। খালি হাতে প্রথম দিন ক্লাসে আসতে হয়তো ভরসা পাননি। আক্রমণ নয়, প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবেই মনে হয়। তার সামনে এসে নতুন স্যার দু-বার লিকলিকে বেত নাচালেন। বল, কয়েকটা অমেরুদণ্ডী প্রাণীর নাম বল। অসহায় তাতু দেখল সে ফাঁদে পড়ে গেছে। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। কিছু একটা উত্তর দিতেই হবে, নইলে এই লোকটা আশকারা পেয়ে যাবে। আক্রমণ বাড়িয়েই যাবে।
“স্যার, অমেরুদণ্ডী প্রাণীর উদাহরণ উচ্ছে, বেগুন, পটল, মুলো।”
স্যারসহ পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে ফেলেছে। চোখকানমুখ অপমানে লাল হয়ে উঠল তাতুর। ‘বদলা’ – তার বুকের ভেতরে সুপ্ত সিংহ গর্জন করে উঠল। এই অপমানের শোধ সে ঠিক নেবে।
“বাকিটাও বলে ফেল, বেতের বোনা ধামাকুলো। কী করে এইটে উঠেছিস বল তো? আজ যে পড়া দেব, কাল যদি উত্তর দিতে না পারিস...
তবে কিনা নতুন স্যারকে বোধহয় অন্যান্য স্যারেরা সমঝে দিয়েছেন যে, অঙ্ক ছাড়া অন্য বিষয়ে তাতু অস্পৃশ্য। তারপর থেকে নতুন স্যার আর তাকে বিরক্ত করেননি। কিন্তু মাঝে মাঝে তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তাতুর খুব অস্বস্তি হয়। চোখ সরিয়ে বাইরে তাকায়। ইলেকট্রিকের খুঁটির উচ্চতা কত হতে পারে, তার ছায়ার দৈর্ঘ্য কত হতে পারে এবং খুঁটির শীর্ষবিন্দু থেকে ছায়ার শীর্ষবিন্দুর দূরত্ব কত হতে পারে, সেই হিসেবে মগ্ন হয়ে পড়ে।
আজকাল আবার তার নতুন শখ হয়েছে সন্ধের পর মনসাতলার মাঠে গিয়ে বসে থাকে। প্রকৃতির রাজ্যে গাছপালা, কীটপতঙ্গ নিয়ে গভীর ভাবনা ভাবে। সেদিনও সে নির্জন মন্দিরের পাশে তেপান্তরের মাঠের মতো দিগন্তবিস্তৃত খোলা জায়গায় বসে ছিল। হঠাৎ তার কানে একটা গুনগুন সুর কানে এল। মনে হচ্ছে একঝাঁক মৌমাছি এদিকেই আসছে। সর্বনাশ, মৌমাছিকে তার বড়ো ভয়। ছোটোবেলায় একবার গাছে উঠে আম পাড়তে গিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির আক্রমণের শিকার হয়েছিল। মুখচোখ ফুলে ঢোল, সমস্ত শরীরে যেন আগুনের স্রোত। মরতে মরতে বেঁচেছিল সেবার। প্রবল জ্বরের তাড়সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই মৌমাছিকে তার বড়ো ভয়। কিন্তু এখানে কীভাবে একপাল মৌমাছি আসবে? আশেপাশে নিশ্চয় কোনো বড়ো গাছ আছে। হয়তো ওদের কেউ বিরক্ত করে পালিয়ে গেছে, কেউ হয়তো মৌচাক কাটার জন্য ওদের উড়িয়ে দিয়েছে। আর ওরা ক্রুদ্ধ গর্জনে ছুটে আসছে সামনে যে আছে তার দিকে। দৌড়ে পালাবে বলে উঠে দাঁড়াতেই টের পেল তার মাথায় ঠিক ব্রহ্মতালুর ওপর কী যেন ফুটল। সামান্য চিনচিন ব্যথা করে উঠল। ব্যস, আর কিছু নয়একটু বাদেই তার মনে হল শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে লাফ দিলেই মাটির আকর্ষণ ছাড়িয়ে সে অনেকটা ওপরে উঠে যেতে পারবে।
“তাতু, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? ভয় পেয়ো না, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। তোমার শত্রু নই আমি।”
তাজ্জব হয়ে গেল তাতু। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই, তবে কে কথা বলল? আর ঠিক কান দিয়ে নয়, সে যেন কথাগুলো সোজা মাথার ভেতরে শুনতে পেল। মৌমাছির দলই বা কোথায় গেল? তাদের ভেতর থেকে একটা এসে কী তার মাথায় হুল ফুটিয়ে দিয়ে গেল? কিছুই বুঝতে পারল না তাতু।
“হ্যাঁ তাতু, তুমি ঠিকই শুনেছ। তবে কান দিয়ে নয়। ওটা আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ। আমি সরাসরি তোমার ভাবনার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে আমার তরঙ্গ মিলিয়ে নিয়ে তোমার কাছে কথাগুলো পাঠাচ্ছি। তোমার শরীরে আমি একরকম রাসায়নিক মিশিয়ে দিয়েছি। নইলে আগের তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে পারতাম না। এখন তোমার ভেতর দিয়েই আমি তোমাদের ভাষা, তোমাদের সমাজের রীতিনীতি সব বুঝে নিয়েছি।”
“তুমি কে?” অস্ফুটে ঠোঁট নড়ল তাতুর।
“তোমাদের হিসেবে আলোকবর্ষের যে মাপ, সেই মাপে, সেই দৈর্ঘ্যের এককে আমরা অনেক দূরের একটা ছায়াপথ থেকে এসেছি। তোমাদের যেমন সূর্যই কেন্দ্রে, তার চারপাশে তোমাদের এই সবুজ গ্রহ ঘুরছে, আমাদের সূর্যের নাম আমাদের ভাষায় ক্রোনো। তার চারপাশেও গ্রহ আছে। তেমনি একটি গ্রহ থেকে আমরা প্রায় আলোর গতিতেই একশ বছরের পথ পার হয়ে এসেছি, কিন্তু সেই হিসেবে আমাদের বয়স তেমন বাড়েনি। গতির জন্য আমাদের সময় সঙ্কোচন হয়েছে। তোমার তো অঙ্কে মাথা ভালো, বিজ্ঞানও জানো। সুতরাং ব্যাপারটা নিশ্চয় বুঝতে পারছ।”
“আমার মাথায়...”
“বলতে হবে না। এত পরিশ্রম করো কেন তোমরা? তোমার ভাবনার তরঙ্গ আমি পড়তে পারছি। যা ভাবছ, বুঝে নিচ্ছি। এখন ভাবছ মনে মনে অন্যায় কিছু ভাবলে, অন্যের ক্ষতি চাইলে, লোভ বা তোমাদের হিসেবে পাপের কথা ভাবলে তো অন্যরা বুঝে ফেলবে। তা হয় না আমাদের। তোমার চিন্তাতরঙ্গে ডুব দিয়ে আমি তোমাদের ক্ষতি, অন্যায়, লোভ, পাপ বুঝতে পারলাম। এগুলোর অর্থ কী? আমাদের গ্রহে এ শব্দগুলো অর্থাৎ ভাবনাগুলোই নেই। সুতরাং অন্যের বুঝে ফেলার কোনো আশঙ্কা নেই।”
“কেন এসেছেন আমাদের কাছে? আমার মাথাতেই কেন হুল ফুটিয়ে দিলেন?”
“আমরা ছড়িয়ে পড়েছি তোমাদের গ্রহজুড়ে। আমাদের ভাবনার তরঙ্গ ছুটে যাচ্ছে পাহাড়ে, সমুদ্রে, মরুভূমিতে, অরণ্যে, লোকালয়ে। হঠাৎ কখনও তরঙ্গ মিলে যাচ্ছে কারও ভাবনার সঙ্গে। তার কাছে পৌঁছে যাচ্ছি মুহূর্তে। তার মাথায় নির্দিষ্ট রাসায়নিক ঢুকিয়ে দিচ্ছি। তার শরীরমনের সব তথ্য এক নিমেষে আমাদের আয়ত্তে এসে যাচ্ছে। এভাবেই আমাদের দল এই গ্রহের সব তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে। বিশাল এক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলছি আমরা। শুধু এই গ্রহের নয়, মহাবিশ্বের সব জায়গায় আমরা পৌঁছোনোর চেষ্টা করছি। আসলে, প্রাণ আছে তেমন গ্রহ আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
এখন আর তাতু মুখ ফুটে কিছু বলছিল না। তার ভাবনার তরঙ্গ মুহূর্তেই মৌমাছির কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল। সেভাবেই যোগাযোগ হচ্ছিল। বুঝতে পারছিল সত্যি, কথা বলা বৃথা। ভাবনাতেই কাজ চলে যাচ্ছে। কিন্তু এরা কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তথ্য নিয়ে কী করবে?
“ভাবছ আমরা এসব কেন করছি? সবুজ গ্রহ দেখে আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে ছুটে এসেছিলাম। অগুন্তি, তোমাদের গ্রহের একতা শৃঙ্খলাপরায়ণ পতঙ্গের চেহারা নিয়েছি। মৌমাছি দেখলে সেটা সবার কাছে স্বাভাবিক। মৌমাছি সব জায়গায় উড়ে বেড়াতেই পারে। পরে জানলাম এটাকে তোমরা মৌমাছি বলো। আগ্রহ নিয়ে এখানে এসেছিলাম বটে, কিন্তু দেখলাম তোমরা আর বেশিদিন এখানে থাকতে পারবে না। তোমরা নিজেরাই সব ধ্বংস করে দিচ্ছ। তোমাদের এই মানুষ নামের প্রজাতি আর বেশিদিন এই গ্রহে থাকতে পারবে না। প্রয়োজন নেই, এমন জিনিস নিয়ে তোমরা বড়ো সময় নষ্ট করো। তোমরা গান গাও, ছবি আঁকো, কী সব ছাইভস্ম লিখে খাতার পাতা ভর্তি করো। শুধু শুধু সময় নষ্ট, কিন্তু শরীরে রোগের বীজাণু ঢুকলে তাকে হারাতে পারো না। নিজেরাই বেশির ভাগ সময় হেরে যাও। তোমাদের এই গ্রহের সভ্যতার ইতিহাস আমরা জেনে নিয়েছি। সব ভাষা শিখে নিয়েছি। সমস্ত মারণ রোগের প্রতিরোধ জেনে গেছি। শুধু অঙ্ক আর বিজ্ঞান চর্চা ছাড়া আর সব বৃথা। তোমাকে আমরা বেছে নিয়েছি এই তত্ত্বের প্রচারক হিসেবে। তোমার কোনো ভয় নেই, আমরা তোমাকে তৈরি করে দেব। কীভাবে তুমি প্রচার করবে, কোথায় কোথায় যাবে, কী বলবে – সব দায়িত্ব আমাদের। তুমি হবে এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ, সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরাজি আছ?”
“তার বদলে আমাকে ভুলে যেতে হবে গানের কথা, ছবির কথা, গল্পকবিতার কথা। রবিঠাকুরের কবিতার কোনো মূল্য থাকবে না?”
“না। বেঁচে থাকার জন্য এসবের কোনো মূল্য নেই।”
“শিশুদের হাসি, পাখির গান, ভোরবেলায় সূর্য ওঠার দৃশ্য, মায়া মমতা ভালোবাসা?”
“সব ভুলে যাবে তুমি। ওগুলোর অসারত্ব প্রচার করবে। সেসব আমরা শিখিয়ে দেব। বলো, রাজি থাকলে তুমিই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ অঙ্কবিদ। আমরা কিন্তু অনেক পরীক্ষা করে তোমাকেই বেছেছি। তুমি অঙ্কের দর্শন বুঝতে শিখেছ। অসম্ভব যুক্তিশীল তোমার চিন্তাভাবনা।”
“না, দরকার নেই আমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অঙ্কবিদ হওয়ার, বড়ো বিজ্ঞানী হওয়ার। আমার এক বছরের ছোটো ভাই যখন হাসে, আমি অবাক হয়ে দেখি। আমার পাখির গান শুনতে ভালো লাগে। আমি আমার মাকে ভালোবাসি। এসব তো কোনো পিথাগোরাসের উপপাদ্য দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। ওগুলো বীজগণিতের অজানা রাশির মতোআছে তবু নেই। আমি পারব না।”
তাতু দেখল ভোঁ করে মৌমাছিটা উড়ে যাচ্ছে। তার শরীরের হালকা ভাবটা কেটে গিয়ে আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। মনসাতলার মাঠে কোথাও কোনো গাছে একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠল – টা টু টা টু...।
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত

গল্প:: ফুলকি - ঋষভ চট্টোপাধ্যায়


ফুলকি
ঋষভ চট্টোপাধ্যায়

দৌড়োচ্ছে! অপলা দৌড়োচ্ছে!
সতেরো বছরের ফুসফুসের মধ্যে যতটা বাতাস ধরে, ততটা বাতাসকে প্রাণপনে টেনে নিয়ে পাগলের মতো দৌড়োচ্ছে অপলা

অপলা এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে এবারে মানে আর ঠিক দিন ছয়েক বাদে শিবপুর হিন্দু গার্লস হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সে অঙ্কে মাথা ছোটে রকেটের গতিতে, ফিজিক্সেও মোটামুটি সেরকমই অর্গানিকটা ভালো না লাগলেও ইনঅর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ওকে রোখা মুশকিল স্কুলের দিদিমণিরা বড়ো আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে টুয়েলভের ক্লাস টিচার শ্রীপর্ণা ম্যাডাম সেদিন তো বলেই ফেললেন বড়দি’কে, “ম্যাডাম, রাজ্যে প্রথম দশের মধ্যে ওর নাম না থাকলেই বরং হতাশ হব আমি বড়দি স্মিত হাসি মুখে মাথা নাড়েন তারপর একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “শোনো, এখন তো স্টাডি লিভ পড়ে গেল ওর সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখো ফোন আর হোয়াটস্যাপ- পড়াশুনোর জন্য যদি কখনও কিছু লাগে, আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে স্কুলের ফান্ড থেকে কতটা কী দিতে পারব জানি না; দরকার হলে আমি নিজে দেব
“অবশ্যই ম্যাম,” সম্মতি দেন শ্রীপর্ণা ম্যাডাম
“বুঝলে শ্রীপর্ণা, অপলা যদি সত্যিই আই.আই.টি পেয়ে যায় বা দেশের সেরা কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সুযোগ করে নিতে পারে, তাহলে সেটা শুধু ওর একার জয় হবে না জয় হবে এই ইছাপুরের মতো হাজারো মফস্বলের জয় হবে সরকারি স্কুলগুলোর মানুষ বুঝবে যে শহুরে জীবনের হাজারো সুবিধা ছাড়াও, সরকারি স্কুলে পড়েও দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে জায়গা করা সম্ভব

অপলা ছুটছে! বারবার এর তার সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতেও ছুটছে একবার মাটিতে হাঁটু মুড়ে পড়ে গেল, পাশের দেয়ালে ঝোলানো ত্রিপলটা খামচে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছোটা শুরু

অপলার বাবা হাওড়া স্টেশনে কুলির কাজ করেন মা বাড়ি বাড়ি রান্না করেন মোড়ের মাথায় যে দৈত্যের মতো উঁচু বিরাট এপার্টমেন্টখানা তৈরি হল ‘প্রিভিলেজ’ না কী যেন বেশ নাম দিয়েছে সেটার - ওই এপার্টমেন্টের দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ করেন মা রোজদিন ভোরে উঠে অপলাদের রান্না সেরেই দৌড়োতে হয় কাজে বিকেলের কাজ সেরে মা যখন ফেরেন, ততক্ষণে স্কুল থেকে ফিরে চলে আসে অপলা পেট খিদেয় ছিঁড়ে যাচ্ছে ততক্ষণে। মায়ের ফেরার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারে না সে নিভু নিভু হলদে আলোর তেলচিটে রান্নাঘরের তাক থেকে চিড়ে, মুড়ি, ছাতু যা পায় জলে গুলে, অল্প চিনি মিশিয়ে গলায় ঢেলে দেয় তবে একটু শান্তি! ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে বইখাতা গুছিয়ে টিউশন পড়তে বেরোয় সে সারাদিন কেমিস্ট্রির ফর্মুলা আর ফিজিক্সের থিওরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাঝেসাঝে একটু একঘেয়ে লাগলে গল্পের বই পড়েসেদিন লাইব্রেরি থেকে নেওয়া একটা লাতিন আমেরিকান উপন্যাস পড়তে গিয়ে এই দুপুরের ঘুমের একটা জব্বর স্প্যানিশ প্রতিশব্দ জানতে পেরেছে ‘সিয়েস্তা’! শব্দটা বেশ পছন্দ হয়েছে ওর
টিউশন শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায় ওদের বস্তিতে ঢোকার আলো-আঁধারি গলিটা দিয়ে এসে যখন বাড়িতে ঢোকে অপলা, ততক্ষণে বাবা ক্লান্ত দেহে খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন হাত মুখে ধুয়ে, বাইরের কাপড় ছেড়ে চা বানায় সে মা দুধ-চা খান, বাপ-মেয়েতে মজা করে সেটাকে পায়েস বলে ডাকে কড়া করে বানানো দু-কাপ চা খাটের পাশের পায়া-ভাঙা নড়বড়ে টেবিলটায় সাবধানে ব্যালান্স করে বসিয়ে, বাবাকে ডেকে তোলে অপলা ঘুম থেকে ওঠার মুহূর্তেই রোজ কাঁধে খিচ লেগে যায় বাবার অপলা দ্যাখে, সারাদিন মাথার উপর মোটের ওজন নিতে নিতে ফুলে দগদগে হয়ে উঠেছে বাবার কাঁধের শিরা যেন এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে এক একদিন মোড়ের হরিদার ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে চেয়ে-চিন্তে সাদা ন্যাকড়ায় মুড়ে কয়েক টুকরো বরফ নিয়ে আসে আলতো করে লাগিয়ে দেয় বাবার ব্যথার জায়গাগুলোয়

আরও দুটো বাঁক ঘোরার পর গলগলে ধোঁয়াটা কাছ থেকে দেখতে পেল প্রথমবার পাক খেতে খেতে নিকষ কালো ঘূর্ণিঝড়ের মতো আকাশ ফুঁড়ে উপরে উঠছে একটু দম নিয়েই আবার দৌড় শুরু করল অপলা

ওদের এই ছোট্ট দেড় কামরার ঝুপড়িটা কিন্তু খুব প্রিয় অপলার আপাতভাবে দেখলে ওরা আগে পদ্মপুকুরের যে বস্তিতে থাকত, তার সঙ্গে খুব একটা ফারাক নেই সেই করোগেটেড শিটের ছাদ, সেই ঘরের মধ্যে ডাঁই হয়ে থাকা পুরোনো লেপ তোশক, চোকলা ওঠা হলুদ দেয়াল, বর্ষাকালে ছাদের উপর অবিরাম পিট্ পিট্ শব্দসবকিছুই একই আছে ফারাকটা আসলে খুবই সূক্ষ্ম, হয়তো সেটা শুধু অপলার নজরেই পড়ে বাড়ির পিছন দিকে বাড়ির গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে একটা ড্রেন ড্রেন আর গেটের মাঝখানে একটা পাঁচ বাই চার ফুটের এক ফালি জমি সেই জমিতে ফোটা হাজারো আগাছার মাঝে টা লাল নীল হলুদ সবুজ ঘাসফুল রোজ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসে ওই ছোট্ট জমির ফালিটা, অপলার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দেয় মাঝে মাঝে যখন ছাদের শিটের ফুটো দিয়ে টপ টপ করে মেঝেতে জল পড়ে, একটা ছোটো বালতি নিচে রেখে দেন মা বেশ খানিকটা জল জমলে ঘাসফুলগুলোকে চান করিয়ে দেয় অপলা
আজকের মতোই সপ্তাহে তিনদিন বিকেলে বর্মন স্যারের কাছে ফিজিক্স পড়তে যায় সে বর্মন স্যার অপলাকে যেন নিজের মেয়ের মতোই দেখেন এক রকম বর্মন স্যারের কথাতেই তো অপলা আই.আই.টি- প্রস্তুতি নিচ্ছে নাহলে যে কোনো একটা মাঝারি গোছের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হলেই হয়তো খুশি হয়ে যেত কিন্তু বর্মন স্যার বলেন, “জানিস অপা, অনেক মানুষ জীবনে বড়ো কিছু অর্জন করতে পারে না তাদের প্রতিভা কম বলে নয়, স্রেফ বড়ো স্বপ্ন দেখার সাহস করতে পারে না বলে স্যারের এই মানসিকতাটা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েছে অপলার মধ্যেও এখন শুধু বুল আই-টাই দেখতে পায়, এক ইঞ্চিও এদিক ওদিক না স্যার আরও বলেন, “এই যে তোর জীবনে এত রকমের সমস্যা - দামি বই কেনার টাকা নেই, এক এক দিন ভর্তি পেট খাবার জোটে না, বড়ো ইনস্টিটিউট-এ জয়েন্টের প্রস্তুতি নেওয়ার মতো পয়সা নেই, একটা দমবন্ধকর ছোট্ট ঘরে থাকতে হয়, আশেপাশে প্রায়দিন অশান্তি লেগেই রয়েছে - এই সমস্যাগুলোকে জীবনের বাইরে ভাববি না এগুলোকে জয়েন্ট বা উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে একই রেখায় বসাবি এরা সবাই তোকে তোর লক্ষ্যে পৌঁছোনোর পথে বাধা দিচ্ছে যারা এই বাধাগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়, তারা সামনে এগোতে পারে না আর যারা জীবনযুদ্ধে জেতে, তারা ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মতো শুধু সামনেটা দেখতে পায়

বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমেই কমে আসছে বাড়তে থাকা ধোঁয়ার মধ্যে কাশতে শুরু করে অপলা সকলে উন্মাদের মতো পড়ি কি মরি করে দৌড়ে বেরিয়ে আসছে বস্তি ছেড়ে প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষের বাস এই ইছাপুর বস্তিতে নিজেদের সবটুকু সঞ্চয়কে পুড়ে খাক হয়ে যেতে দেখতে দেখতে অসহায়ের মতো প্রাণ বাঁচাতে দৌড়োচ্ছে তারা কিন্তু অপলা দৌড়োচ্ছে ঠিক উলটো মুখে, বস্তির দিকে মুখ করে ঠিক তখনই পলি দেখতে পেল ওকে দৌড়োতে দৌড়োতেই চিৎকার করে বলে উঠল, “ওদিকে যাস না অপা খুব বাজে অবস্থা দমকলের লোকগুলো কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না পলির গলার মধ্যে দমচাপা কান্নাটা বেরিয়ে আসে, “সব শেষ হয়ে গেল রে, অপা
কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে কিছুই শুনতে পায় না যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন সে শুধু সামনে ছুটতে থাকা ছাড়া আর কিছুই মাথায় নেই তার

সেবার যখন আমফন হল, ওদের বস্তির সব ক’টা ঘর জলে ডুবে গিয়েছিল এমনিতেই হাওড়া জেলার ইছাপুর থেকে বাকি অংশটুকু একটু নিচুতে, জল জমে খুব তাড়াতাড়ি সেবার সাত দিন অবধি জল নামেনিঝড় কেটে যাওয়ার পর হাওড়া জেলা স্কুলে রিলিফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওদের বর্মন স্যার জেলা স্কুলেরই ফিজিক্সের শিক্ষক নিজে এসে মা-বাবার সঙ্গে ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যাম্পে ঘর থেকে বেরোনোর আগে শেষ একবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল অপলা খাটের সামনে হাঁটুসমান জলের মধ্যে ভাসছে ওর বইগুলো, জ্যামিতি বক্স, আর তিনদিন আগে কষা অঙ্কের খাতাটা
রাতে ছেঁড়া পাউরুটি আর জল খেয়ে একবার কী মনে হতে ক্যাম্পের বাইরে এসে দাঁড়ায় অপলা জল পুরো নামতে এখনও দিন তিনেক লাগবে মাথায় একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে বর্মন স্যার
“কী ভাবছিস?
“বইগুলো সব নষ্ট হয়ে গেল, স্যার খাটের পায়াগুলো এমনিই পচে যাচ্ছিল, এতদিন জলে ডুবে থাকার পর তো আর... একটু থামে অপলা, তারপর বলে, “মাথার উপরের করোগেটেড চালটা অবধি উড়ে গিয়েছে স্যার
দুই আঙুলে অপলার চিবুকটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বর্মন স্যার বলেন, “ফিনিক্স পাখির কথা জানিস? যাকে আমরা আগুনপাখিও বলে থাকি অথচ জন্মায় কোথায় জানিস? ছাইয়ের মধ্যে সেই ছাই থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এমন উড়ান দেয়, যে আকাশকে মনে হয় দোতালা বাড়ি
স্যারের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে অপলা স্যারের ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি বলেন, “যা কিছু শিকল তোকে বেঁধে রেখেছে অপা, সবগুলোকে ছিঁড়ে বেরোনোর জন্য তোকে একটাই জিনিস দিয়েছে ঈশ্বরতোর ঝকঝকে মাথাটা ওটাই হচ্ছে ফিনিক্স পাখির ডানা এই ইছাপুরের বস্তি, এই জমা জল, এই আধপেটা খাওয়া, বড়োলোকের ছেলেপিলেদের হেয় করা - এই সবকিছুর থেকে তোকে টান মেরে ওই আকাশে নিয়ে যেতে পারে এই ডানাটা শুধু সামনের ক’বছরের পরীক্ষাগুলো জম্পেশ করে দে, ভেঙে ফ্যাল খাঁচার দরজাটা
একটু থেমে স্যার যোগ করেন, “তোদের এবারের বাংলা সিলেবাসে মতি নন্দীর ‘কোনি’ আছে না? তাহলে? কোনি যদি পারে, আমাদের অপা পারবে না কেন?
অবাধ্য জলের কণাটা টপ করে গাল বেয়ে নেমে আসে অপলার জোরে জোরে উপরে নীচে মাথা ঝাঁকায় সে

চারপাশের বাতাসের উত্তাপ ভয়ানক রকম বেড়ে গিয়েছে দম আটকে আসছে অপলার নাক মুখ দিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে শরীরে কোনোরকমে টলতে টলতে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে মা-বাবাকে দেখতে পায় আশেপাশের আরও অনেকের মতোই মা তারস্বরে বিলাপ করে চলেছেন চোখের সামনে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন একটা ঝুপড়ি থেকে আরেক ঝুপড়িতে যেন নরক থেকে আসা কোনো রাক্ষস গিলে খাবেই সব-হারানো মানুষগুলোর শেষ রেস্তটুকুও সেই নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলার দিকে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছে অপলা
বাবা এসে জাপটে ধরেন অপলাকে “তুই ঠিক আছিস তো মা? তুই এদিকে আসতে গেলি কেন? গোটা বস্তি পুড়ছে, তোর যদি কিছু... বাবা অনেক কিছু বলছেন, কিন্তু একটা শব্দও কানে ঢুকছে না অপলার সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে একটু একটু করে ঝলসে যেতে থাকা ওদের ঝুপড়িটার দিকে

বর্মন স্যারের ব্যাচে বসে ঘড়ি ধরে একমনে ফিজিক্সের একটা উত্তর লিখছিল অপলা, যখন প্রথম খবরটা ওর কানে পৌঁছয় বর্মন স্যারই হন্তদন্ত হয়ে এসে খবর দেন, “অপা, তোদের বস্তিতে যে আগুন লেগেছে রেপাশের বাড়ির প্রতিবেশী জানালেন খবরটা ঠিক বাড়ির ছাদ থেকে দেখে এলাম এখুনি
এক দৌড়ে স্যারের সঙ্গে ছাদে উঠে এসেছিল অপলা একটা বিরাট আকারের হেলে যাওয়া মিশমিশে কালো ধোঁয়ার স্তম্ভ আকাশের উপর অবধি উঠে গিয়েছে মানুষগুলোর চিৎকার এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে ফোন করেছিল কপাল ভালো, আগুন তাদের ঝুপড়ি অবধি আসার আগেই টের পেয়ে মা-বাবা দুজনেই বাইরে বেরিয়ে আসেন দমকলও এসে গিয়েছে, কিন্তু উত্তরের হাওয়ায় এত দ্রুত আগুন ছড়াচ্ছে, যে তাকে আয়ত্তে আনা সম্ভব হচ্ছে না নিজেকে প্রচণ্ড রকম অসহায় লাগতে থাকে অপলার এইভাবে তাদের সবটুকু এক নিমেষে স্রেফ ছাই হয়ে যাবে? কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না?
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে ওর অটো বা বাস পেতে অনেক সময় লাগবে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে স্যারের বাড়ির পিছনের শর্টকাট দিয়ে দৌড়োতে শুরু করে অপা

বাবার হাত ছাড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় অপলা ঝুপড়ির দিকে পেছন থেকে একজন দমকল কর্মী বলে ওঠে, “এই যে, এই মেয়ে, ওদিকে যেও না, বিপদ হতে পারে বাবা বলে উঠলেন, “এদিকে চলে আয় মা, আর দেখে কী করবি? অপলা যেন বধির হয়ে গিয়েছে একবার ডানদিকে, একবার সামনে আর একবার বাঁ পাশে দাঁড়ানো বাবার দিকে তাকায় যে কাজটা করতে যাচ্ছে, সেখানে ঠিক কোন কোন দিক থেকে বাধা আসতে পারে ঠান্ডা মাথায় সেটা হিসেব করার চেষ্টা করে দুজন দমকলকর্মী আর বাবা বাকিরা সবাই বেশ খানিকটা তফাতে আছে যেখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে ওদের ঝুপড়ির দূরত্ব ৩০০ মিটার মতো হবে
খুব দ্রুত হিসেবগুলো সেরে নিয়ে কাঁধের ব্যাগটা একপাশে ছুড়ে ফেলে অপলা বুক ভরে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে তিরবেগে দৌড়োতে শুরু করে তিন সেকেন্ডের মধ্যে পিছন থেকে লোকজনের তীব্র চিৎকার শুনতে পায় মা চিৎকার করে উঠছেন, “কেউ আমার মেয়েটাকে বাঁচাও, কি পাগল হয়ে গিয়েছে? বাবা একটা চিৎকার করে ওকে ধরার জন্য ছুটে আসেন ততক্ষণে অপলা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে বাঁদিক থেকে ছুটে আসে সেই প্রথম দমকলকর্মী অপলা তৈরিই ছিল, লোকটার হাতটা ধরে সজোরে একটা কামড় দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় তাকে লোকটা টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় তাকে ডিঙিয়ে ঝুপড়ির প্রায় কাছে চলে আসে অপলা এবার শেষ বাধা ডানদিক থেকে দ্বিতীয় লোকটা চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে নিচু হয়ে ঝুঁকে মাটি থেকে একটা ইটের টুকরো তুলে নিয়ে লোকটার গায়ে ছুড়ে মারে লোকটা সামলানোর আগেই এক লাফে আগুনে জ্বলতে থাকা ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে অপলা
ঢুকেই বুঝতে পারে ওড়নায় আগুন ধরে গিয়েছে এক ঝটকায় সেটা খুলে ফেলে মাটিতে এদিক ওদিক থেকে ভেঙে পড়ছে কাঠ, ইটের টুকরো কোনোমতে সেগুলো থেকে বেঁচে ভেতরের ঘরে ঢোকে পড়ার টেবিলের উপর নেচে চলেছে আগুনের শিখা ডানদিক থেকে লাল ফাইলটা তুলে নেয় অপলা ফাইলের কোনাটা পুড়ছে জলদি সেটা টেবিলে চাপড়ে নেভায় দ্রুত বের করে আনে কাঙ্খিত জিনিসটা ফাইল থেকে
ঠিক এই সময় গোড়ালির কাছটায় অসহ্য জ্বালা হতে শুরু করে ওর তাকিয়ে দ্যাখে কামিজে আগুন লেগে গিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে জুতো খুলে কামিজে চাপড় মেরে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে সেই মুহূর্তে ঘরের খোলা জানলা দিয়ে গলগল করে বিষাক্ত ধোয়া ঘরে ঢোকে মুহূর্তের মধ্যে মাথা ঘোরাতে শুরু করে ওর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, টলতে টলতে মাটিতে পড়ে যায় গোড়ালির কাছে জ্বালার যন্ত্রণাটা অসহ্য হয়ে উঠছে কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই আর ওর পুরো ঘরটা বনবন করে ঘুরছে চোখের সামনে
তারপর? অন্ধকার!

অল্প একটু যখন জ্ঞান ফেরে আবার, তখন ওর মনে হয় কোনো একটা চলমান বিছানাতে ওকে শুইয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চারপাশটা এখনও ঘুরে চলেছে, দম আটকে আসছে আর এই সবকিছুর মাঝে কে যেন চিৎকার করে বলে চলেছে, “ফাইট অপলা ফাইট, ফাইট অপলা ফাইট! দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারাতে হারাতে বিড়বিড় করে অপলা বলে ওঠে “পরীক্ষাটা দেব, পরীক্ষা...

ধীরে ধীরে চোখ খোলে অপলা শরীরের জায়গায় জায়গায় অসহ্য জ্বালা চোখ খুলেই পাশে মা’কে দেখতে পায় অন্য পাশে বাঁ হাতটা মুঠোয় ধরে বসে আছেন বাবা সামনে তাকিয়ে দেখে হাসপাতাল বেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বর্মন স্যার
“এই তো... মেয়ে আমাদের ঘুম থেকে উঠেছে,” বলে ওঠেন বর্মন স্যার “আচ্ছা, তুই কী রে? এমন ঘুম দিচ্ছিস কাল থেকে, একেবারে কি পরীক্ষার দিন সকালে উঠতিস নাকি? হেসে ওঠেন তিনি
“আর পরীক্ষা! যা গেল মেয়েটার উপর দিয়ে... এই অবস্থায় কী করে ...? বলে ওঠেন মা
“কী বলছেন বউদি? যে জিনিসটার জন্য মেয়ে আমাদের আগুনে ঝাঁপ দিল, সেই জিনিসটাই ওকে দিতে দেব না আমরা? আর তাছাড়া ডাক্তারবাবু তো বললেন, বিষাক্ত গ্যাস ঢুকে পড়েই আসল বিপত্তি হয়েছে তার ওষুধ পড়েছে, তিন-চার দিনে দিব্যি ঠিক হয়ে যাবে আর বার্নিং ইনজুরি তো শুধু পায়ে আমি হুইলচেয়ারে নিজে নিয়ে যাব পরীক্ষা দেওয়াতে আপনি চিন্তা করবেন না
বর্মন স্যারের কথায় নিশ্চিন্ত হয় অপলা কিন্তু পরমুহূর্তেই জিনিসটার কথা মনে পড়তেই ছটফট করে ওঠে
“মা মা... তোমরা কি ওটা পেয়েছ? ওটা কী পুড়ে গিয়েছে? বলো না মা...
“দাঁড়া বাবা, শান্ত হ,” বাবা মাথায় হাত রাখেন “যেটা বাঁচাতে তুই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লি, সেটা একদম ঠিক আছে আমি যত্ন করে ল্যামিনেশন করিয়ে ফাইলে রেখে দিয়েছি এই নে
ব্যাগ থেকে ফাইলটা বের করে, তার থেকে উচ্চমাধ্যমিকের ল্যামিনেটেড এডমিট কার্ডটা বের করে মেয়ের হাতে দিলেন বাবা
বুকের ভিতরের ধুকপুকানিটা এতক্ষণে শান্ত হল অপলার
“তুই এইটার জন্য আগুনে লাফিয়ে পড়লি রে মা? এইটা তো আবার সাইবার ক্যাফেতে গেলেই ডাউনলোড করা যেত
বর্মন স্যার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই অপলা বলে উঠল, “না মা, যেত না সেদিন এডমিটের কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই আমি স্যারের ল্যাপটপ থেকে ডাউনলোড করার চেষ্টা করেছিলাম এডমিট কার্ড নেওয়ার লাস্ট ডেট পেরিয়ে গিয়েছে তিনদিন আগে একটু থামে অপলা আবার বলে, “এটা পুড়ে গেলে আমার আর হয়তো পরীক্ষা দেওয়া হত না এবারের মতোএকটা গোটা বছর আমার... মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে অপলা
বর্মন স্যার এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন, “তোকে আমি বলেছিলাম বটে যে, ফিনিক্স পাখি ছাই থেকে জন্মায় তুই কথাটাকে এত সিরিয়াসলি নিয়ে নিবি জানলে আমি বলতাম না রে
স্যারের কথা শুনে দু-চোখ ভর্তি জল নিয়েও ফিক করে হেসে ফেলে শিবপুর হিন্দু গার্লস হাই স্কুলের ফার্স্ট গার্ল অপলা মাঝি
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী