
ল্যাভেন্ডার মুন
ট্রুন হ্যারিসন
অনুবাদ – নূপুর রায়চৌধুরী
প্রতি সপ্তাহে তিনবার করে গভীর রাতের বাসটা নিউ মুন ক্যাফের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাই তুলতে তুলতে যাত্রীরা সব বাস থেকে নীচে নামে। একে একে সকলে ক্যাফের ভিতরে প্রবেশ করে আর ক্যাফের দরজার গায়ে লাগানো ঘণ্টাটা টিংটিং শব্দে বাজে।
এইটাই ল্যাভেন্ডার মুনের সারা দিনের ব্যস্ততম সময়। শীতকালে যাত্রীরা মিনেস্ত্রনে সুপ, আর গরমাগরম কফি চায়; গরমকালে তাদের পছন্দ চেরি-পাই আর ঠান্ডা ঠান্ডা ফলের রস। এই সারাটা সময় মুন তাড়াহুড়ো, ছুটাছুটি করে, তার ক্যাশবাক্সে পয়সা ঝমঝম করে।
ঠিক সাড়ে দশটার সময় ড্রাইভার টোবি লেমলি হাঁক পাড়ে, “সময় হয়ে গেছে।” যাত্রীরা সব হেলতে দুলতে, ক্যাফের টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে আসে, দরজার ঘণ্টিও আবার তখন টিংটিং করে ওঠে। মুন উঁকি মেরে দেখে, বাসটা কেমন গর্জন করতে করতে চলে যায়, বাসের আলো আস্তে আস্তে ফিকে হতে হতে শেষমেশ দূরের কোনো গ্রামের অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে যায়।
বিশ বছর কত না লম্বা সময়, চেরি-পাই কাটতে কাটতে আর স্যান্ডউইচ সেঁকতে সেঁকতেই কেটে গেল - দরজায় ‘বন্ধ’ সাইন ঝোলাতে ঝোলাতে আনমনে ভাবে মুন।
পরের বার বাসটা যখন আবার এল, ড্রাইভার টোবি-র কাপে কফি ঢালতে ঢালতে মুন বলল, “মিস্টার লেমলি, আমি স্থির করেছি, তোমার বাসে চড়ে দেখতে যাব এই বাস-রাস্তা কোথায় শেষ হয়েছে।”
টোবি বলে, “আরে মুন, তুমি শোনোনি - এই বাস তো আর চলবে না। আমারও তো বয়স হল, এবার একটা জায়গা দেখে থিতু হতে হবে।” টোবির কণ্ঠ কেমন শ্লথ শোনায়।
“সে কী, কী বলছ তুমি!” চিৎকার করে বলে ওঠে মুন।
মুনের এবার খুব ভয় করতে লাগল, তার হাতের সুপ আর পাই খেতে যাত্রীরা আর আসবে না, রাতের বাসে চড়ার সুযোগ আর মিলবে না, বাস-রাস্তাটা যে শেষমেশ কোথায় চলে গেছে, তাও আর কোনোদিন জানা যাবে না, সে যে বড্ড দেরি করে ফেলেছে।
নাহ্, আমি আর পাইয়ের ছাঁচ তৈরি করা আর এঁটো-কাঁটাচামচ ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারছি না, সেই একই সুপ-চামচ, টেবিল-ক্লথ আর ভালো লাগছে না - ক্যাশ কাউন্টারের দিকে আসতে আসতে মুনের মাথায় কী এক চিন্তা খেলে গেল। ক্যাফের দরজায় ‘বন্ধ’ সাইন ঝুলিয়ে দিতে দিতে তার মনটা খুশি হয়ে গেল, আর অজান্তেই একটা হাসিও এসে গেল ঠোঁটের কোণে।
তারপর এমন কিছু একটা ঘটে গেল, যা আগে কক্ষনো ঘটেনি।
গভীর রাতের বাস সেদিন ভোর ভোর ক্যাফের দরজায় এসে থামল। কোনো যাত্রী বাইরে নেমে এল না, এল শুধু টোবি লেমলি। সে বাসের চাবিটা মুনের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “মুন তোমার যাত্রা শুভ হোক।” মুনও টোবির হাতে ক্যাফের চাবি দিতে দিতে বলে, “মিস্টার লেমলি, আমি আশা করি তুমি এখানে খুশিই থাকবে।” টোবি সম্মতি জানিয়ে বলে, “ওহ্, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, আমি তো এখানে একটি হার্ডওয়্যারের দোকান খুলব, ঠিক করেছি। কতদিন ধরে যে এই স্বপ্নটা আমি দেখেছি!”
মুন চারটে ধাপ বেয়ে বাসে উঠল, গাড়ির ইঞ্জিনও গর্জন করে চলা শুরু করল। সেই বাস-রাস্তাটা ধরে মুন অজানা দেশের দিকে রওনা দিল।
কখনও সবুজ পাহাড় আর কর্মরত কৃষকদের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যায় মুন। কখনও বা ঝকঝকে নদীর ঢেউ পার করে, নৌকার মাঝিদের কাছে অপরিচিত শহরে লম্বা আইসক্রিম সানডে কেনে মুন। কখনও বা ব্যান্ড-এর বাজনার সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের উপর সে নেচে চলে। উষ্ণ গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় রঙিন আলপনা আঁকা ঘোড়ার পিঠে চড়ে দুলে দুলে গোল হয়ে চরকি কেটে চলে মুন। আকাশে তখন আতশবাজি ফুটছে।
কখনও-কখনও বাসটা চালিয়ে মুন একটা চকচকে লেকের পাশে এসে থামে, সেখানে ডাইভিং প্ল্যাটফর্ম থেকে ঝপাৎ করে আচমকা লেকের জলে ঝাঁপ দিয়ে ছোটো ছোটো মাছগুলোকে ভয় পাইয়ে দেয় সে, তারা সব খলবল খলবল করে গভীর জলে সেঁধিয়ে যায়। মুনের একটা কুমির আকৃতির ফ্লোট আছে, সেটার উপর সটান উপুড় হয়ে শুয়ে পা আর হাত দিয়ে দাঁড় বাওয়ার মতো জল কেটে কেটে ঘুরে বেড়ায় সে। আর তখনই কেমন তার মনে হয়, না জানি এমন আরও কত কত জায়গা আছে, কিন্তু সে তো এখনও এই রাস্তার শেষটাতেই পৌঁছতে পারল না। সুতরাং আবার চলা। চলতে চলতে মরুভূমিতে এসে তার মনে হল এই জায়গাটা ভারী শান্তিপূর্ণ। মুন সেখানে গুহায় গুহায় খোঁড়াখুঁড়ি করে ডাইনোসরের হাড় খুঁজে বেড়াল। তারপর গরম বাতাস-ভরা একটা বেলুনে চড়ে আকাশে খানিক ভেসে বেড়াল। তারপর অবশেষে, সে তার বাসে ফিরে এল।
মুন ভাবে, আমি তো জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি, কিন্তু সেখানে গেলে নিশ্চয়ই আমি জানতে পারব। এরপর পাহাড়ে গিয়ে মুন ভেলায় চেপে, পাহাড়ি ঝোরা বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামল। পাহাড়ি ছাগলের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়চুড়োয় আরোহণের জন্য সে নতুন বুটজুতো পড়ল। এইসবে তার এত মজা লাগছিল যে সে তার বাসের কথা প্রায় ভুলেই যাচ্ছিল। কিন্তু তখুনি তার মনে পড়ে গেল, এখনও সে তার যাত্রার শেষ পর্যন্ত পৌঁছোয়নি।
এক বিকেলে যখন সে তার ক্যাফে থেকে অনেক অনেক দূরে, তখন মুন সাগরে এসে পৌঁছোল। সেখানে সে উষ্ণ বালির উপর খালি পায়ে হাঁটল এবং ঢেউয়ের মাথার ওপরে একটি ঘুড়ি ওড়াল।
হঠাৎ তার মনে হল, এই বুঝি আমার রাস্তার শেষ। এটাই আমার জায়গা। মুন সেখানে একটি বাড়ি কিনল যেখানে গ্রাম এবং বালিয়াড়ি এসে মিশে গেছে। বাড়িটার চুড়োয় জাহাজের মতো দেখতে একটা বায়ুনির্দেশক আছে, আর রান্নাঘরের মেঝেময় বালি। মুন দেখে, একটি চর্মসার বিড়াল বারান্দার নীচে লুকিয়ে আছে। মুন তাকে বলে, “আমি বাড়িতে পৌঁছে গেছি আর এই বাড়ি আমরা দুজনে ভাগ করে নেব। তোমাকে আমি এখন থেকে ফিশ হুইস্কার বলে ডাকব।”
টোবি-র কাছে একদিন একটা পোস্টকার্ড এল। সে ডাকহরকরাকে বলল, “আমার বন্ধু মুন সমুদ্রের ধারে খুশিতে আছে, কিন্তু আমি এখানেই খুশি, এটা আমার জন্য ঠিক জায়গা।”
টোবি একটু বাদে সমুদ্র সম্পর্কে সব ভুলে যায় এবং নিজের যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করে।
ওদিকে মুন ছবি আঁকা শুরু করে। শিশুদের জল ছেটানোর এবং কুকুরের খেলার ছবি আঁকে সে। মুন একটি সার্ফবোর্ড কিনেছে। যখনই ভালো ঢেউ থাকে, তখনই উজ্জ্বল স্নান-পোশাক পরে সে তীরের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সমস্ত গ্রীষ্ম সে দারুণ খুশি থাকে। গ্রীষ্ম শেষ হলে, তখন আর সাগরপাড়ে আঁকা যায় না, সব জিনিসপত্র এক্কেবারে ভিজে যায় এবং সার্ফ করার জন্য সমুদ্দুরকে খুব রুক্ষ মনে হয়। মুন লক্ষ করে যে তার বাড়িটা কত্ত শান্ত। বাতাস সেখানে একাকী শব্দ করে। মুনের মনে পড়ে যায়, তার হাতের সুপ এবং পাই মানুষজনেরা কত না পছন্দ করত। তারা বলত মুন, তোমার মতো কেউ রান্না করতে পারে না।
অথচ এখন তার নিজের জন্য রান্না করারও কেউ নেই।
আচ্ছা, আমি কি আবার ফিরে যেতে পারি না? সে মনে মনে ভাবে।
পরক্ষণেই তার মনে পড়ে - নাহ্, আমার ক্যাফে তো এখন একটা হার্ডওয়্যারের দোকান।
যখন বৃষ্টি পড়ে এবং বাদল-হাওয়া তার চেয়ারকে দোলা দেয়, মুন তখন নতুন এক পরিকল্পনার কথা ভাবে।
মুন ছুতোর ফরেস্ট সিডার-কে ডাকে, সেও অমনি সঙ্গে সঙ্গে এসে তার কাজ শুরু করে দেয়। শীঘ্রই ফরেস্ট গভীর রাতের বাস থেকে সব সিটগুলো একটা একটা করে বের করে নেয়, তারপর সেগুলো দিয়ে সে কাউন্টার এবং টেবিল তৈরি করে। কাজ করতে করতে ফরেস্ট প্রায়ই শিস দিয়ে গান করে। আর ওদিকে মুন তখন ন্যাপকিন ভাঁজ করে, ছুরি, কাঁটা-চামচ গুনেগেঁথে রাখে, বাসের দেয়ালে পেইন্টিং ঝুলিয়ে রাখে।
এখন মুন কিছু কিছু দিন ছবি আঁকে। অন্য দিন, ঢেউ ঠিকঠাক থাকলে সে তার সার্ফবোর্ড নিয়ে সমুদ্র সৈকতে চলে যায়। বাকি সব দিন, মুন তার চলমান বাস-ক্যাফেকে সুমুদ্দুরের উপকূল বরাবর চালিয়ে নিয়ে যায়। চলতে চলতে যে জায়গার দৃশ্য সবচেয়ে ভালো লাগে, সেখানেই সে তার বাস থামায়। তারপর সে লোকেদের ক্ল্যাম চাউডার, ভাজা মাছ, ঝিনুক, চিপস এবং ঠান্ডা ঠান্ডা সোডা পপ পরিবেশন করে। সবাই বলে, মুন, তোমার মতো সামুদ্রিক খাবার কেউ রান্না করতে পারে না। আরেকবার করে চায় তারা ঐসব খাবার এবং কখনও-কখনও তারা মুনের আঁকা একটা পেইন্টিংও কিনে নেয়। ক্যাশবাক্স ঝমঝম করে, মুন আবার ছোটাছুটি, তাড়াহুড়ো করে। ওদিকে ফিশ হুইস্কারও বেশ নাদুসনুদুস হয়ে উঠেছে এবং সে প্রায়ই ভালো ভালো মাছের স্বপ্ন দেখে।

----------
ট্রুন হ্যারিসনের লেখা
Lavender Moon বই থেকে অনূদিত।
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment