
বন্ধু
পায়েল চট্টোপাধ্যায়
১
সবুজ রঙের মাঠটা যেন পাপাইয়ের গায়ের ওপর উঠে আসে।
কয়েকদিন ধরেই চা-বাগানের পাশের মাঠটা আরও ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাপাইয়ের ওপর। চা
বাগানটা স্পষ্ট দেখা যায় পাপাইয়ের স্কুল থেকে। চা-বাগানের পাশের মাঠটাও
দৃষ্টিসীমানার বাইরে নয়। তবে ইদানীং মাঠটার সঙ্গে একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠছে পাপাইয়ের।
উত্তরবঙ্গের এই বোর্ডিং স্কুলটায় মাত্র কয়েকদিন
হল এসেছে পাপাই। স্কুলের এই নির্দিষ্ট বেঞ্চটা পাপাইয়ের বরাদ্দ। জানালার পাশের
জায়গাটা ঠিক খালি থাকে। আশ্চর্য! কেউ কোনোদিন বসে না এখানে। এই স্কুলে এখনও
পর্যন্ত কোনো বন্ধু হয়নি পাপাইয়ের। হওয়ার সম্ভাবনাও কম। পাপাই বড়ো মুখচোরা। ও
কথা হারায়। শহরে যে স্কুলটাতে ও পড়াশোনা করত সেখানেও ওর কোনো বন্ধু
ছিল না। ওই স্কুলের পাশেই বড়ো রাস্তা। সারাদিন গাড়ির আওয়াজ পাপাইকে কষ্ট দিত।
স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা যখন ওকে পড়াত, মাথার ভেতর একটা কর্কশ শব্দ শুনতে পেত ও।
পড়ায় মন দিতে পারত না। মা যখন তারপর সন্ধেবেলায় পাপাইয়ের পড়াশোনার খোঁজ নিতে
আসত, ওর দু-চোখ ছাপিয়ে ঘুম নেমেছে। বাবা পড়াশোনার জন্য খুব
জোর করলে আবার পাপাই মাথার ভেতর সেই কোলাহলসমেত তেতো শব্দটা শুনতে পেত। তারপর দু-বছর ওই স্কুলে খুব
খারাপ ফল করেছিল পাপাই। তারপর বাবাই তো দাদুকে জানায় সব কথা। যদিও পাপাই ওর মাথার
ভেতরের কোলাহলের কথা সেভাবে কাউকে বোঝাতে পারেনি।
উত্তরবঙ্গের এই চা-বাগানটায় দাদুর অফিস। পাপাইয়ের
এখন ক্লাস নাইন। দাদু বাবার কথা শুনে পাপাইকে ফোনে বলেছিল, “পৃথিবীর বুকের সবচেয়ে নরম জায়গাটায় তুমি থাকবে দাদুভাই! তোমার আর কোনো
অসুবিধা হবে না।” দাদুর কথায় উত্তরবঙ্গের এই বোর্ডিং স্কুলে
পড়াশোনা করতে এসেছে পাপাই।
স্কুলটা একেবারে সবুজের ভেতর। সবুজের আভা গায়ে
মেখে ক’দিন ধরে স্কুলে যাতায়াত করছে ও। তবে পড়ায় এখনও মন বসাতে পারেনি। দাদু
বলেছে অপেক্ষা করতে। পাপাইয়ের স্কুল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা জায়গায়
থাকে দাদু। ছুটির দিনগুলোয় পাপাই দাদুর কাছে যায়। মা-বাবাও আসে মাঝে মাঝে।
ওই তো! ওই দিকে, সেই ছেলেটা। আজও একইভাবে মাঠে বসে রয়েছে।
মাঝে মাঝেই পাপাইয়ের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। পাপাই জানে ও নিজে একটা ধুলোমাখা শহর
থেকে এসেছে। স্কুলে আসার কয়েকদিন পর থেকেই ছেলেটাকে রোজ এই সময় দেখতে পায়
পাপাই। আচ্ছা ও কি স্কুল যায় না! ছেলেটাকে দেখলে মনে হয় ও যেন কবে থেকে এই
সবুজের সঙ্গে মিশে রয়েছে। যদিও দূর থেকে দেখা তবুও পাপাই বুঝতে পারে ওর ঝাঁকড়া
চুল, আশ্চর্য, মায়াবী তাকানো। অদ্ভুত
অথচ চমৎকার। দূর থেকে দেখে ছেলেটাকে নিজের থেকে খানিক ছোটো মনে হয় পাপাইয়ের।
“তৃণাঞ্জয়! তুমি অমনোযোগী হচ্ছ কেন! নতুন
এসেছ এখানে, এখন থেকেই পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ না থাকলে
অসুবিধা হবে তোমার!”
সবুজ রঙের ওভারকোট চাপানো এই শিক্ষিকার ক্লাস আগেও
কয়েকবার করেছে পাপাই। গম্ভীর। তবে পড়ান ভালো। একটু পরেই পাপাইকে বলবেন, “তৃণাঞ্জয়, তুমি অসুবিধা হলে আমার কাছে পড়া বুঝতে
এসো।” পাপাইয়ের ভালো লাগে। তবে খুব বেশিক্ষণ ও মাঠের দিকে
তাকিয়ে থাকলে উনি অসন্তুষ্ট হন।
“সরি ম্যাম, আসলে ওই
জানালার দিকে তাকালেই...”
পাপাইয়ের বলতে ইচ্ছে করছিল ছেলেটার দিকে তাকালেই
ওর মন বাইরে চলে যায়। তবুও শেষ কথাটুকু বলা হয়ে ওঠে না আর। উনি যদি না বুঝে
পাপাইকে বকাবকি করেন! অযথা অপছন্দের কথা শুনলে পাপাই ওর মাথার ভেতর আবার ওই কর্কশ শব্দটা
শুনতে পাবে। শহরের স্কুলেও যখন দিদিমণিরা অমনোযোগী হওয়ার জন্য পাপাইকে বকাবকি করত,
মাথার ভেতরটা ছিঁড়ে যেত ওর। এখানে এসে এখনও পর্যন্ত তেমন হয়নি।
তবে ও ভেবেছিল পড়াশোনায় যতটা মন বসাতে পারবে সেটাও সম্ভব হয়নি। এই স্কুলের
সকলেই ওকে ভালোবাসে। ক্লাসের বাইরেও সময় করে শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়া বুঝিয়ে দেন।
সবুজের মায়াভরা এই জায়গাটায় পাপাই স্বপ্ন দেখে। ভালো থাকার স্বপ্ন। শহরের
স্কুলে ওর ফলাফল খুব খারাপ দেখে বাবা একদিন জানতে চেয়েছিল, “কী হয়েছে পাপাই তোমার! তুমি তো পড়াশোনা করতে ভালোবাসতে! হঠাৎ করে এমন
হচ্ছে কেন?”
বাবার প্রশ্নে খানিক দ্বন্দ্বে ভুগে তারপর পাপাই
উত্তর দিয়েছিল, “আজকাল পড়তে বসলেই মাথার ভেতর একটা যন্ত্রণা অনুভব করি!”
“এ আবার কী অদ্ভুত কথা! তুই তো প্রাইভেট
টিউটরের কাছে পড়তে বসেও ঘুমিয়ে পড়ছিস!” বাবার গলার স্বরটা
দৃঢ়।
“জানি না বাবা কী হয়!”
বাবার কঠিন গলার স্বরের পর আর উত্তর দিতে পারেনি
পাপাই। পরে নরম হয়ে বাবা পাপাইয়ের মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল। তবে
পাপাইয়ের আর বলে ওঠা হয়নি যে, অনেকদিন ওর পড়ায় মন বসছে না। আর যে কাজে ওর মন বসে
না সেটা করতে গেলেই মাথার ভেতর একটা কর্কশ শব্দ শুনতে পায় পাপাই। এর কয়েকদিন
পরেই দাদুর সঙ্গে সবুজের সুড়ঙ্গ ভেদ করে আসা ট্রেনটায় চেপে এই বোর্ডিং স্কুলে
চলে আসে পাপাই।
২
“এই চিরকুটটা তুমি আমায় দেবে বলে রোজ এখানে
বসে থাকো?”
পাপাই-এর কথায় আলতো করে ঘাড় নাড়াল ছেলেটা। সেদিন
ওই শিক্ষিকার কাছে ছেলেটাকে দেখার জন্য বকুনি খাওয়ার পর পাপাই ঠিক করেছিল এবার
একদিন ছেলেটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে। রোজ টিফিনের পরের সময়টায় ছেলেটা এখানে বসে
থাকে কেন! একই জায়গায় বসে পাপাইয়ের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েই বা কেন থাকে! আজ স্কুল
ছুটির পর ওই শিক্ষিকাকে বলে পাপাই চা-বাগান পেরিয়ে মাঠের কাছে এসেছে। তবে
শুধুমাত্র আজকের জন্যেই এই অনুমতি পেয়েছে ও। স্কুল শেষের পর একটা প্রার্থনায়
অংশগ্রহণ করতে হয় ওদের। আজকের জন্য ঐ শিক্ষিকা পাপাইকে অনুমতি দিয়েছিল ওই
ছেলেটার সঙ্গে দেখা করার। ছেলেটা পাপাইয়ের থেকে খানিকটা ছোটো। ছেলেটাকে দেখে মনে হয় ওর
বয়স এগারো-বারো।
ছেলেটার থেকে চিরকুটটা হাতে নিয়ে পাপাই দেখল তাতে
লেখা রয়েছে, “আমাদের সবুজ গ্রামে যাবে তুমি?”
পাপাইয়ের খুব আশ্চর্য লাগল। ছেলেটা ওকে চেনে না।
জানে না। অথচ ওকে নিজের গ্রামে নিয়ে যেতে চায়! আর এটুকুর জন্যই ছেলেটা রোজ এভাবে
বসে থাকে! তবুও ছেলেটার দিকে তাকালেই ওর গ্রামে যেতে ইচ্ছে হয় পাপাইয়ের।
“এই তোমার বাড়ি কোথায়? তবে আমি কিন্তু আজ মোটেই যেতে পারব না। রবিবারের আগে যেতে পারব না।”
ছেলেটাকে উত্তর দেয় পাপাই। ছেলেটা আলতো করে আবার
ঘাড় নেড়ে পাপাইকে বিদায় জানিয়ে দূরে সবুজে মিলিয়ে যায়। ছেলেটার ঝাঁকড়া চুল
আর তাকানোটা আজও বড়ো আশ্চর্য লাগল পাপাইয়ের। ছেলেটা কি কথা বলতে পারে না! পাপাই
ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা চলে গেছে। দাদু বলে জীবনে ঝুঁকি না নিলে
নাকি জীবন থেকে বিস্ময় হারিয়ে যায়। আর বিস্ময় হারিয়ে গেলে নাকি এই জীবনে
কিছুই থাকে না। তাই কি পাপাই ছেলেটাকে কথা দিল যে ও রবিবার যাবে! কিন্তু দাদু যে
রবিবার পাপাইকে নিতে আসবে। দাদুকে কী বলবে ও!
এতসব ভাবনার মাঝেই বোর্ডিং-এ ফিরে এসে একটু
পড়াশোনার চেষ্টা করছিল পাপাই। এর মাঝেই সেই অদ্ভুত বিষয়টা হল। মাথার ভেতর একটা
কর্কশ আওয়াজ! মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে! উত্তরবঙ্গে আসার পর থেকে এমন
হয়নি আর। আজ কেন হচ্ছে! দাদুকে একটা ফোন করতে হবে! পাপাই জানে এখানেও ওর হয়তো কোনো
বন্ধু হবে না। শহরের স্কুলে এত বছর পড়াশোনা করেও ওর কোনো বন্ধু হয়নি। এখানেও সেই
সম্ভাবনা নেই। আচ্ছা ওই যে ছেলেটা রোজ পাপাইদের স্কুলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ও
কি পাপাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়! কিন্তু ছেলেটা তো বোধহয় কথা বলতে পারে
না! এসব কথা মনে হচ্ছে কেন ওর! ও কি বেশি ভাবছে! পাপাইয়ের মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে
যাচ্ছে! নাহ্! দাদুকে একবার ফোন করতেই হবে।
“তুমি কি মাঝে মাঝেই এমন শব্দ শুনতে পাও
দাদুভাই?” ফোনের ওপারে দাদু।
“সবসময় নয় দাদু, হঠাৎ
করে কোনো কাজে মনোযোগ না দিতে পারলেই সাধারণত এমনটা হয়,” খানিকক্ষণ
ভেবে পাপাই উত্তর দিল।
“শব্দটা কেমন তুমি বলতে পারবে পাপাই?”
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে দাদুর নরম, মিহি স্বর
ভেসে আসছে।
“মনে হয় মাথার ভেতর থেকে কেউ চিৎকার করছে,
অহেতুক কোলাহল শুনতে পাচ্ছি। কেউ যেন বলছে পাপাই এই কাজ নয়, তোর
অন্য দায়িত্ব আছে। এভাবে নয়, অন্যভাবে বাঁচতে হবে,”
বেশ অস্বস্তি মিশিয়ে কথাগুলো বলল পাপাই।
“তুমি কি আজকাল কোনো স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন
দেখছ দাদুভাই?”
“না।”
দাদু তার মানে পাপাইয়ের এই বিষয়টা স্বপ্ন বলে
ভাবছে। পাপাই লক্ষ করে ওপ্রান্ত থেকে দাদুর গলার স্বর আর শোনা যাচ্ছে না। অর্থাৎ
ফোনটা কেটে গেছে।
৩
সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে চলার সময় মচমচ শব্দ হচ্ছে।
ছেলেটাকে মাঠে গিয়ে পরের দিনই পাপাই জানিয়ে দিয়েছিল যে ও রবিবার আসবে। ছেলেটার
মুখে তখন ঝলমলে আলো। সেই প্রথম দিনের পর আরও দু-দিন পাপাই ছেলেটার সঙ্গে গ্রামটাতে
গিয়েছিল। চাংরিপোতা। সবুজ মলমলের চাদরের মতো গ্রাম। সেইদিনও ছেলেটা ওই চা-বাগানের
পাশের মাঠে বসে ছিল। স্কুল-ফেরত পাপাই নিজে গিয়েই ওর সঙ্গে কথা বলে গ্রামটাতে
গিয়েছিল। ছেলেটা কথা বলতে পারে না বলে পাপাইয়ের ওর নাম জানা হয়নি। মনে মনে ও
ছেলেটাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকে। পাপাই ওর
কাছে গেলেই ঝাঁকড়া চুল আর গভীর চোখ নিয়ে ও পাপাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার
এই তাকানোটা বড়ো চেনা মনে হয় পাপাইয়ের। সেদিনই ও বলে এসেছিল প্রতি রবিবার ও আসবে
এই গ্রামে।
রবিবার দিন বিকেলবেলায় বোর্ডিং-এর সামনে
দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। পাপাই যে সময় বলে দিয়েছিল হয়তো তার খানিক আগেই চলে
এসেছিল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নীচে নেমে এসে পাপাই দেখতে পায় অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে
রয়েছে ছেলেটা। পাপাইকে দেখেই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে। পাপাই ওকে অনুসরণ করে
এগিয়ে যেতে থাকে।
এই নিয়ে তিনদিন আসছে পাপাই। আগের দু-দিন ছেলেটা ওকে
ওদের গ্রাম ঘুরে দেখিয়েছে। সবই হাতের ইশারায়। গ্রামের রাস্তাটা এখনও পুরোপুরি
চিনে উঠতে পারেনি পাপাই। ছেলেটার হাতে আজও একটা চিরকুট। চিরকুটের তেকোনা পেছন
দিকটা ছেলেটার হাত থেকে লেজের মতো বেরিয়ে রয়েছে। পাপাই ছেলেটার উদ্দেশে বেশ চিৎকার করে বলে, “আজ আবার একটা কাগজ এনেছ?
কী লেখা ওতে? তুমি যে এই তিনদিন আমায় তোমার
গ্রামে নিয়ে যাচ্ছ, কই গ্রামের নাম তো বলোনি! আমি দাদুর কাছ থেকে জেনেছি গ্রামের
নামটা।”
ছেলেটা উত্তর দিতে পারবে না জেনেও পাপাই কথাগুলো
জিজ্ঞেস করে। ছেলেটা চিরকুটটা পাপাইয়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। তাতে লেখা ‘রামধনু’। ছেলেটার গ্রামের নাম কি
তবে রামধনু! কই এমন কোনো গ্রাম যে এখানে আছে তা তো পাপাই দাদুর মুখে একবারও
শোনেনি। এই ছেলেটাকে না জানি কেন খুব বন্ধু ভাবতে ইচ্ছে করছে পাপাইয়ের। ছেলেটাকে
একবার জিজ্ঞেস করবে যে ও পাপাইয়ের বন্ধু হবে কিনা!
ছেলেটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। পাপাই একটু জোরে
হাঁটার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল ওর পায়ের কাছে কেউ যেন আঁকড়ে ধরেছে। লম্বা সবুজ
ঘাসের মধ্যে থেকে দুটো সরু রোগা লিকলিকে হাত পাপাইয়ের পা দুটো চেপে ধরেছে। এই কে
ছাড়ো! ছাড়ো! কিছুতেই পাপাই ছাড়াতে পারছে না হাত দুটোকে। অবশেষে একটা বাচ্চা
ছেলে উঠে দাঁড়াল। তার হাতে পেনসিল। পাপাই আর কিছু বলার আগেই সে পাপাই কে
জড়িয়ে ধরল কোমরের কাছে।
“তুমি নাকি ওই বোর্ডিং স্কুলটায় পড়ো,
তুমি আমাদের পড়াবে?”
“তোমার নাম কী?” অবাক
হয়ে পাপাই জিজ্ঞেস করল ছেলেটাকে। তবে উত্তর পাওয়ার আগেই আরও কয়েকজন দৌড়ে এসে
মাঠে জড়ো হয়েছে ততক্ষণে। কারোর হাতে পেনসিল, কারোর হাতে
খাতা, কারোর হাতে আবার স্লেট।
ওই ছেলেটাকে তবে আর দেখতে পাচ্ছে না পাপাই।
পাপাইয়ের হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে ও চলে গেছে। সাতজন ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে পাপাইয়ের সামনে। প্রত্যেকেই পাপাইয়ের দিকে তাকিয়ে। ওদের মুখ
দেখে মনে হচ্ছে ওদের খুব খিদে পেয়েছে। ওরা পাপাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ওদের মধ্যেই একজন পাপাইয়ের দিকে আরেকটা ছোট্ট চিরকুট এগিয়ে দেয়। পাপাই খুলে
দেখে লেখা রয়েছে তাতে,
“প্রিয় বন্ধু,
আমি জানি তোমার কোনো বন্ধু নেই। আমারও নেই। আমাদের
বন্ধু না হলেও চলে যাবে। কিন্তু ওদের তোমার মতো একজন বন্ধু দরকার। ওরা পড়াশোনা
করতে খুব ভালোবাসে। তবে ওদের সেই সুযোগ নেই। তুমি যদি ওদের সেই ব্যবস্থা করে দাও!
তোমার স্কুলের পর ওদের পড়াশোনা শেখাবে তুমি? ওদের জীবনে কোনো রং নেই। ওদের সকলের
বাবা-মা দুজনেই চা-বাগানে কাজ করে। কেউ দেখার নেই ওদের। ওদের
জীবনে তুমি রামধনু হয়ে উঠবে?”
একফালি সাদা কাগজে শব্দগুলো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা।
বাচ্চাগুলো এই কারণেই পাপাইয়ের কাছে এসেছে। ওই ছেলেটা তার মানে এই কারণেই পাপাইকে
এই গ্রামের দিকে নিয়ে আসত। কিন্তু পাপাই কেন? নাকি ছেলেটা ওই
জানালার উলটোদিকে সব সময়ই বসে থাকত! কেউ যদি এই বাচ্চাগুলোর জীবনে রামধনু হয়ে
আসে তার অপেক্ষায়! পাপাই বুঝতে পারে না। ছেলেটার নামটা পর্যন্ত জানা হয়নি ওর।
“এটা কে দিয়েছে? তোমরা
কি তার নাম জানো?”
পাপাইয়ের বন্ধুর সাদা গেঞ্জিটা অল্প দেখা যাচ্ছিল
দূরে। একটা বাচ্চা মেয়ে ওই ছেলেটাকেই আঙুল দিয়ে দেখাল। পাপাই দূরে ডাকতে যায়
ছেলেটাকে। কিন্তু ছেলেটা অনেকটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো
আবার আঁকড়ে ধরেছে পাপাইকে।
৪
সবুজ চা বাগানের ভেতর দিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা
আছে। কাল দাদু বলেছে পাপাইকে। রাস্তাটা একেবারে চাংরিপোতা গ্রামে গেছে। ছেলেটা
সম্ভবত এখানেই কোথাও থাকে। ছেলেটা আর ওর মা এই গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকে
নাকি। ওই ছেলেটার কথা দাদু আর স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকেও জানিয়েছিল পাপাই। দাদুর
কাছেই ও শুনেছে এই গ্রামটার অবস্থা। পাপাইয়ের স্কুল থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে এই ছেলে-মেয়েগুলোকেও
স্কুলে ভরতি নেওয়ার। তবে পাপাই আজকাল মাঝে মাঝেই স্কুলের পর এই গ্রামে আসে। ওদের
পড়ানোর চেষ্টা করে। সন্ধেবেলায় পাপাই ওদের জন্যই রোজ পড়তে বসে। ওর মাথার ভেতরের
যন্ত্রণাটাও অনেক কম।
“ওই ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা কোথায় থাকে তোরা
কেউ জানিস?”
“ওই দাদা আর ওর মা তো কয়েকদিন আগে আমাদের
গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।”
একদম সামনে বসে থাকা বেণি-বাঁধা মেয়েটা উত্তর
দেয়। পাপাই ছেলে-মেয়েগুলোকে পড়াচ্ছে। পাপাইয়ের মনে হয় ওই ছেলেটাই আসলে সকলের
জীবনে রামধনু। ও মনে মনে ছেলেটাকে আজও বন্ধু বলে ডাকে।
পাপাই এখন প্রত্যেক রবিবার এখানে আসে। এই ছেলে-মেয়েগুলোর
স্কুলে ভরতির ব্যাপারেও পাপাইয়ের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা আর দাদু চেষ্টা
করছেন। ওই ছেলেটা যেদিন পাপাইকে এই গ্রামে নিয়ে আসে তারপর আরও দু-তিনটে রবিবার
ছেলেটার সঙ্গে পাপাই এসেছে। চাংরিপোতা একটা প্রান্তিক গ্রাম। গ্রামে কোনোমতে টিকে
থাকা কতগুলো মানুষ। সকলেই চা-বাগানের শ্রমিক। ছেলে-মেয়েগুলো পড়াশোনার জন্য
অপেক্ষা করত। একটা ছোট্ট স্কুল তৈরি করারও নাকি চেষ্টা হয়েছিল এখানে। তবে সে আর
হয়ে ওঠেনি। এসব পাপাই দাদুর কাছে শুনেছে। ওই আশ্চর্য ছেলেটা তবে কোথা থেকে এসেছিল
আর এখনই বা কোথায় চলে গেছে তা কেউ জানে না।
ওদের পড়ানোর জন্যই নিজের পড়াশোনায় মন বসানোর
চেষ্টা শুরু করেছিল পাপাই। পড়তে বসলেই যখন পাপাইয়ের মাথার ভেতর একটা কর্কশ
কোলাহল শুরু হত, ওই অসহায় ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলোর মুখ মনে করার চেষ্টা করত
পাপাই। অদ্ভুতভাবে কোলাহল থেমে যেত। যে কর্কশ শব্দটা ওকে এতদিন ধরে কষ্ট দিত, এমনকি এই সবুজ
রঙের জায়গাটায় ছবির মতো দেখতে স্কুলটাতেও ও কয়েকবার এই
কঠিন শব্দটা শুনেছে, সেই সব যন্ত্রণামাখানো শব্দের অবসান
হয়েছিল ওই ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য। যদিও পাপাইয়ের মনে হয় এইসব হয়েছে
ওর বন্ধুর জন্য।
দাদু সব জানে। দাদু বলে আসলে ওই ছেলেটাই ‘রামধনু’। ও হয়তো এভাবেই স্কুলের
বাইরে অপেক্ষা করত আরও কোনো রামধনুর। ঠিক যেভাবে চাংরিপোতা গ্রামের ছোটো ছোটো
বাচ্চাগুলোর কাছে পাপাই এখন রামধনু হয়ে উঠেছে।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে চুল আঁচড়াচ্ছিল পাপাই।
সামান্য ঠান্ডা লেগে ওর চোখের নীচেটা ফুলেছে। একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করে চমকে
ওঠে পাপাই। ওর মনে হয় ওর চোখ দুটো অবিকল ওর বন্ধুর মতো। ওই ছেলেটার মতো। বন্ধুর চোখগুলোকে এই
কারণেই এত চেনা লাগত পাপাইয়ের। ওর নিজের চোখদুটো এমন! ওই ছেলেটার চোখ দুটোর নীচের
দিকটাও এমন ফোলা-ফোলা। ওর মনটা হঠাৎ আনন্দে ভরে ওঠে। পাপাইয়ের বন্ধু তার মানে
হারায়নি। পাপাইয়ের ভেতরেই রয়েছে। রামধনুর সাত রঙের মতো ওর মনটা ঝিলমিল করে ওঠে।
----------
ছবি - শ্রীময়ী
Asadhran laglo.....mon bhalo kora lekha....
ReplyDelete