
রাজবাড়ির ছোরা
বুমা ব্যানার্জী দাস
সন
১৯২৫। বছর
তিনেক আগে ইজিপ্টের ভ্যালি অফ কিংস থেকে গত শতাব্দীর সেরা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারটি
করেছেন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার। অবশেষে কিশোর ফারাও তুতানখামুনের প্রায়
অক্ষত সমাধির সন্ধান পেয়ে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিদের শিরোপা তখন তাঁর
মাথায়। সমাধির
সন্ধান পেয়েছেন ঠিকই,
তবে সেই অতুল সম্পদের ভান্ডারের সঠিক মূল্যায়ন ও নথিভুক্তিকরণ তখনও
শেষ হয়নি। এই সময়ে আরও এক আশ্চর্য আবিষ্কার করে বসলেন কার্টার। ফারাওয়ের মমিকৃত দেহে জড়ানো কাপড়ের
ফালির ভাঁজে তিনি খুঁজে পেলেন দুটি ছোরা। তাদের মধ্যে একটি সুবর্ণনির্মিত, কিশোর ফারাওয়ের পেটের
কাছে কাপড়ের ফালির মধ্যে সযত্নে রক্ষিত। অন্যটি ছিল ফারাওয়ের ডান উরুর কাছে। দ্বিতীয় ছোরাটি লোহার তৈরি, যদিও হাতলটি সোনার। হাতলের শেষ অংশে একটি গোলাকার স্ফটিক। ছোরার খাপটিও সোনার, খাপের উপর পালক,
লিলিফুল আর শেয়ালের মাথার অপূর্ব নকশা করা। তা প্রাচীন ইজিপ্টে সোনার উপর এহেন
কারুকাজের নমুনা একেবারেই দুর্লভ নয়। তাও এই দ্বিতীয় ছোরাটি যে গবেষকদের
মধ্যে সাড়া ফেলে দিল,
তার কারণ সম্পূর্ণ আলাদা। সেটি বুঝতে গেলে একটু টাইমলাইন বা
সময়রেখার দিকে তাকানো প্রয়োজন।
ইজিপ্টে
লৌহযুগ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১০০০-এর মাঝামাঝি কোনো সময়ে। যদিও সেই সময়ে ভারত ও মধ্য প্রাচ্যের
দেশ থেকে ইজিপ্ট লোহা পেত। ধাতু বিগলন পদ্ধতি মানে যাকে স্মেলটিং
বলে সে সব শুরু হয়েছিল আরও প্রায় পাঁচশো বছর পর। সোনা, তামা আর টিনের খনিতেই
মূলত খননকার্য চালানো হত তখন ইজিপ্টে। এবার তাকানো যাক ফারাও তুতানখামুনের
টাইমলাইনের দিকে। তিনি
জীবিত ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪১ থেকে ১৩২৩ পর্যন্ত, রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩২ থেকে ১৩২৩। অর্থাৎ ইজিপ্টে লৌহযুগ শুরু হতে তখনও
বহু দেরি। প্রতিবেশী
হিটাইটরা কিছু লোহার ছুরি এনেছিল বটে ইজিপ্টে, কিন্তু তাও সেই খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-এর আগে নয়। তাহলে কিশোর ফারাওয়ের কাছে ওই লোহার
ছোরা এল কোথা থেকে? ছোরাটি যে তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল, তাতেও কোনো সন্দেহ
নেই, ফারাওদের মমির সঙ্গে তাঁদের সমস্ত প্রিয় জিনিস সমাধিস্থ
করা হত।
স্বাভাবিকভাবেই
ফারাও তুতানখামুনের এই লোহার ছুরি প্রত্নতত্ত্ববিদ ও গবেষকদের কৌতূহলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রাচীন
ইজিপ্টের চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিফিক থেকে পাওয়া কিছু সূত্র এবার প্রাসঙ্গিক হয়ে
ওঠে। আনুমানিক
খ্রিস্টপূর্ব ২৩৭৫ সময়কালের পিরামিডের গায়ে লেখা হায়ারোগ্লিফিক্সে আকাশ থেকে আসা এক
ধাতুর কথা পাওয়া যায়। আরও পরে, খ্রিস্টপূর্ব ১২৯৫ নাগাদ দেখা যায় ইজিপশিয়ানরা লোহাকে
সরাসরি আকাশ থেকে আসা লোহা বলে উল্লেখ করতে শুরু করেছে। ঠিক কী কারণে এই সময় থেকে লোহার এই
নামকরণ হয় সেটা পরিষ্কার না হলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোহাকে এইভাবেই উল্লেখ করে এসেছে
প্রাচীন ইজিপশিয়ানরা। স্বাভাবিকভাবে একটাই সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে, পৃথিবীর বুকে এসে
পড়া এক বা একাধিক উল্কাপিন্ডই ছিল প্রাচীন ইজিপশিয়ানদের লোহার উৎস।
১৯৭০
থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত নানাভাবে চেষ্টা করেও গবেষকরা এই উল্কাপিন্ডের তত্ত্ব প্রমাণ করতে
অসমর্থ হন। তাঁদের
কাছে তখনও পর্যন্ত এমন কোনো উন্নত প্রযুক্তি ছিল না যার সাহায্যে ফারাওয়ের ছোরা অক্ষত
রেখে বিশ্লেষণ চালানো যেতে পারে। ফলে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে তাঁরা
আসতে পারেননি, বরং রহস্যময় ওই ছোরাকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল আরও বিভ্রান্তি। সাম্প্রতিক কালে, ২০১৬ নাগাদ XRF
Spectrometer বা এক্স রে ফ্লুওরেসেন্স স্পেক্ট্রমিটারের সাহায্যে গবেষকরা
অনেকটাই বিশ্লেষণ করতে পারেন। তাঁদের মতে ফারাওয়ের ছোরাতে আছে ৮৯% লোহা, ১১% নিকেল। উল্কাপিন্ডে সাধারণত যে লোহা পাওয়া
যায় তাতেও নিকেলের পরিমাণ বেশি হয়। কিন্তু উল্কাপিন্ড থেকে লোহার তৈরি
সূক্ষ্ম জিনিস বানাতে যে ধরণের উন্নত প্রযুক্তি থাকা প্রয়োজন, সেটা থাকার সম্ভাবনা
ফারাও তুতানখামুনের সময়ে একেবারেই নেই। তার উপর এই ছোরা বানানোর প্রক্রিয়াটিও
চমকপ্রদ। ছোরার
গায়ে কোনোরকম হাতুড়ির ঘা মারার চিহ্ন নেই, মসৃণ গা বরাবর ধারালো প্রান্তের রেখা। সেই সময়ে তৈরি হওয়া লোহার অন্যান্য
জিনিসের উপর যে ধরণের চিহ্ন দেখা যায়, তার কিছুই এই ছোরার উপর দেখা যায় না। তাহলে সত্যিই কী এই ছোরা ইজিপ্টে
তৈরি? ১৯১১ সালে অন্য একটি সমাধি থেকে কিছু ধাতব পুঁতি পাওয়া গেছিল। সেগুলোও এই XRF Spectrometer-এর
সাহায্যে পরীক্ষা করে গবেষকরা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে উল্কাপিন্ডস্থিত লোহাকে প্রথমে
হাতুড়ি দিয়ে পাতলা পাতে পরিবর্তিত করে তারপর তাকে টিউবের মতন পাকিয়ে পুঁতিগুলো তৈরি
করা হয়েছে। এমনকী
স্বয়ং ফারাও তুতানখামুনের সমাধিতে আরও যে কয়টি লৌহনির্মিত বস্তুর নিদর্শন পাওয়া যায়, সেগুলো সবই এই পদ্ধতিতেই
তৈরি। প্রাচীন
ইজিপ্টের সোনা দিয়ে তৈরি জিনিসের মধ্যে যে সূক্ষ্মতা, যে আভিজাত্য,
সে সব এই লোহা দিয়ে তৈরি জিনিসের মধ্যে নেই। বরং আনাড়ি হাতে তৈরি বললে মিথ্যা বলা
হয় না। শুধু
ওই ছোরার মধ্যে যে আশ্চর্য নৈপুণ্যের ছাপ পাওয়া যায় তার উৎস কোথায়?
এই
জিগ স পাজলের একটা অংশ এতদিন অন্য একদিকে পড়েছিল। সেটা বুঝতে গেলে ছোট্ট একটা গল্প বলতে
হয়, আবিষ্কারের
গল্প। ফারাও তুতানখামুনের পিতা ছিলেন ফারাও আখেনআটেন। তিনি নিজের রাজধানী প্রাচীন থীবস থেকে
সরিয়ে নিয়ে যান তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত শহর আমার্ণাতে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী অসামান্যা
নেফারতিতি সামান্য কিছু বছরের জন্য ফারাও হয়েছিলেন। তখনও আমার্ণাই রাজধানী ছিল। তাঁর রহস্যময় মৃত্যুর পর আমার্ণা
পরিত্যক্ত হয়, ফারাও তুতানখামুন রাজধানী ফিরিয়ে নিয়ে যান মেমফিস শহরে। আমার্ণার কথা বহু বহু বছরের জন্য ভুলে
যায় সবাই, ভুতুড়ে শহর হয়ে যায় আমার্ণা। মাঝে মাঝে ভবঘুরে বা এটা ওটার
সন্ধানে যাওয়া লোকজন ছাড়া কারুর পায়ের ছাপ পড়ে না আমার্ণায়। ১৮৮৭ সালে সেরকমই একজন গ্রাম্য মহিলা
মাটির তৈরি ইটের সন্ধানে আমার্ণায় হানা দেয়। খুঁজতে খুঁজতে আঁকিবুঁকি আঁকা মাটির
তৈরি চৌকো চৌকো বিস্কুটের মতো বেশ কিছু জিনিস পায়। বলা বাহুল্য প্রাচীন ভাষা সে পড়তে
জানত না। তাই
ওই আঁকিবুঁকির মর্মোদ্ধার করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। কিছু ওই চ্যাপটা বিস্কুটের মতো জিনিস
সে ভেঙেই ফেলে, বাকি সামান্য পয়সার বিনিময়ে এক প্রতিবেশীকে বিক্রি করে দেয়। সৌভাগ্যবশত এই প্রতিবেশী সেগুলো
পুরানো জিনিসের বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। তার বেশ কিছু বছর পরে নানা হাত ঘুরে
সেগুলো গিয়ে পৌঁছোয় ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটরের হাতে। জিনিসগুলোর সঠিক মূল্যায়ন
করতে তাঁর একেবারেই দেরি হয় না। খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ইজিপ্টের ফারাওয়ের
সঙ্গে আশপাশের নানা দেশের শাসকদের চিঠির আদানপ্রদানের আশ্চর্য দলিল রয়ে গেছে আমার্ণায়। বলাই বাহুল্য পৃথিবীর নানা
দেশের বিখ্যাত মিউজিয়াম থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক দল পাঠানো হয় সঙ্গে সঙ্গে। উদ্ধার হয় মোট ৩৮২টি চৌকো ট্যাবলেট। তবে এটা নেহাতই সরকারি হিসেব। হয়তো বেশ কিছু নষ্ট হয়ে গেছে, অথবা ব্যক্তিগত সংগ্রহে
থেকে গেছে। এগুলোই
হল আমার্ণা ট্যাবলেট। ব্যাবিলনীয় ভাষায় লেখা এই ট্যাবলেটগুলির বক্তব্য মূলতঃ দুই
ধরনের। এক,
ফারাও ও ব্যাবিলন, মিটানি, আর্জাওয়া, সাইপ্রাস, হিটাইটদের
দেশ ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশের শাসকদের সঙ্গে নানা বিষয়ে বাক্যালাপ ও দুই, ইজিপ্টের অভ্যন্তরীণ নানা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা। ইতিহাসের পুনঃনির্মাণে এই আমার্ণা
ট্যাবলেটের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
![]() |
একটি আমার্ণা ট্যাবলেট |
২০১৪
সালে একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্ডান ভ্যালির এক বিশেষ অংশে অদ্ভুত এক আবিষ্কার করেন। ধাতু বিগলন পদ্ধতিতে আকর থেকে ধাতু
নিষ্কাশনের সময় যে ধাতুমল বা স্ল্যাগ বের হয় তার বহু চিহ্ন ছড়িয়ে এই এলাকায়। খননকার্য চালিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা
খুঁজে পান প্রাচীন এক লোহার কারখানা। এই এলাকায় এক সময় মিটানিদের বাস
ছিল। তাহলে
কি এখানেই তৈরি করা হয়েছিল সেই কিংবদন্তী ছোরা? আকাশ থেকে দেবতার উপহার নয়,
নেহাৎই মাটির পৃথিবীর বুকেই সুনিপুণ কোনো কারিগরের হাতে তৈরি সেই আশ্চর্য
বস্তু? কিন্তু আবার ধাক্কা খেতে হয় গবেষকদের। প্রথমত তাঁদের হিসেবে ওই লোহার কারখানার
সময়রেখা দাঁড়ায় ফারাও তুতানখামুনের আরও তিনশো বছর পরে। দ্বিতীয়ত, এটা খেয়াল রাখতে হবে
যে ফারাওয়ের ছোরাতে জং ধরেনি আজও। অতটা উচ্চস্তরের আধুনিক পৃথিবীর সমগোত্রীয়
লোহা তৈরির কৌশল কোনোভাবেই সম্ভবপর ছিল না তখন। বাধ্য হয়েই তাঁরা উল্কাপিন্ডের যুক্তিতেই
ফিরে আসেন।
সম্প্রতি
জাপানের চিবা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বিশেষজ্ঞরা বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে ছোরার
দুই পিঠে নির্দিষ্ট এক প্যাটার্ন লক্ষ করেন। এরকম রসায়নিক গঠন পাওয়া যায় এক
বিশেষ ধরনের উল্কাপিন্ডে,
যার নাম অক্টাহেড্রাইট। এই ধরনের উল্কাপিন্ডের উৎপত্তিস্থল
মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যবর্তী অ্যাস্টারয়েড বা গ্রহাণু বেল্ট।
প্রাচীন
ইজিপ্টের সংস্কারে ও ধর্মাচরণে আকাশের দেবতাদের বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তাই আকাশ থেকে ছুটে আসা উল্কাপিন্ডকে
তারা দেবতার উপহার ভেবে থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ফারাও ছিল তাদের কাছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাই আকাশের দেবতারা
ফারাওয়ের জন্য উপহার পাঠিয়েছেন এরকমটা তারা ভেবে নিতেই পারে। সম্ভবত সেই কারণেই লোহাকে বার বার
আকাশের দান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সমস্ত উপসংহার টানা সহজ। এটাও ভেবে নেওয়া সহজ যে, কোনো একজন অসম্ভব
প্রতিভাধর কারিগর উল্কাপিন্ডের ভিতরের লোহার কার্যকারিতা আন্দাজ করতে পেরেছিল। কিন্তু সেই সূক্ষ্মতা? সেই হাতুড়ির দাগহীন
মসৃণ ধারালো রাজোচিত গঠন? ইতিহাস আর কিচ্ছুটি জানায় না,
বা জানাতে চায় না।
রাজবাড়ীর
ছোরা তাই আজও রহস্যাবৃত। তবে, কিছু কিছু রহস্য বোধহয় রহস্য হয়ে থাকাই ভালো।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment