
দৈত্যাকার কচ্ছপ – গল্প না সত্যি
দীপান ভট্টাচার্য
তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই সমুদ্র মন্থনের গল্পটা জানো
যার থেকে অমৃত পাওয়া গিয়েছিল। অমৃত হল
এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এনার্জি ড্রিঙ্ক, খেলে শক্তি তো
বাড়েই আবার মরতেও হয় না,
একদম অমর হয়ে যাওয়া বলতে পারো। তাই
অমৃত লাভের জন্যে দেবতারা ঠিক করে যে ক্ষীর সমুদ্রকে ঘেঁটেঘুঁটে তার
ভেতর থেকে অমৃত তুলে
আনবে। ওইটাই ‘মন্থন’, মিক্সিতে যেমন লস্যি বানায় অনেকটা সেই রকম বলতে পারো। তোমরা হয়তো ছোট্ট কৃষ্ণের ছবি দেখেছ যেখানে মা যশোদা একটা হাঁড়িতে একটা মোটা লাঠির মতো
দণ্ড রেখে সেটা দড়ি
দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুধ
থেকে মাখন বার করছেন। মন্থন হল সেই
কাজটাই। ঐ লাঠির মতো জিনিসটা হল মন্থন দণ্ড আর দড়িটা হল
মন্থন রজ্জু, আমরা একে দড়ি
বা রশিই বলব।
যাই হোক, অমৃত পাবার ভাবনাখানা তো খাসা, কিন্তু কী
দিয়ে ঘাঁটা বা মন্থন করা হবে, সমুদ্রকে মন্থন করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, যেমন বিশাল সমুদ্র, তাকে মন্থনের জন্যে দণ্ডও তো তেমনই জোরদার হওয়া দরকার। শেষে
ঠিক হল মন্দর পর্বতকে দিকে মন্থন করা হবে। বেশ, কিন্তু এবারে এল আরেক সমস্যা।
মন্দর পর্বতকে ঘোরাবার মতো
দড়ি কোথায় পাওয়া যাবে! ঠিক
হল সাপেদের রাজা বাসুকি নাগকে করা হবে মন্থনের রশি। কিন্তু এখানেও আরেক মমস্যা তৈরি হল, এত
বড়ো পর্বতকে ঘোরাতে দেবতারা যথেষ্ট নয়। তারা
না হয় একদিক ধরবে, কিন্তু অন্যদিকে তো সমান শক্তিশালী দল
চাই, তবে তো মন্থন দণ্ড ঘুরবে। তখন
ঠিক হল যে অসুরদেরও দলে নেওয়া হবে।
মন্থনের রশি মানে বাসুকিকে একদিকে ধরবে দেবতারা আর
অন্য দিকে অসুররা, কিন্তু তাহলে তো অসুরদেরও অমৃতের ভাগ দিতে হবে।
বিনা মজুরিতে তো আর
তারা বেগার খাটনি খাটবে না। বিষ্ণু সে
ভার নিলেন, বললেন যে তিনি
সেদিক ম্যানেজ করবেন।
ব্যস, যেমন ভাবা তেমন
কাজ শুরু। অসুররাজ বলি তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে
হাজির আর অন্যদিকে দেবতারা তো ছিলই। অসুররা ধরল সাপের মুখের দিক
আর দেবতারা ল্যাজের অংশ। ঘরর ঘরর, হাজার বছর
চলল মন্থন। এবারে এই টানাটানির চোটে
বাসুকির তো বিষম অবস্থা। তার মুখ থেকে
বেরোতে লাগল ভয়ঙ্কর বিষ। সেই বিষের জ্বালায় সবার তো নাজেহাল অবস্থা। তখনও তো আর
সবাই অমৃত খায়নি, তাই প্রাণ তাদের যায় যায়।
তখন এগিয়ে এলেন শিব। তিনি তো সুপার হিরো, তাই এক ঢোঁকে বিষ খেয়ে ফেললেন।
বিষের চোটে তাঁর গলা
নীল হয়ে গিয়েছিল, তাই দেখবে তাঁকে নীলকণ্ঠও বলা
হয়। বিষের ঝঞ্ঝাট মেটার পরে আবার মন্থন শুরু হল। এবারে এল আরেক সমস্যা, সমুদ্রের তলায়
মন্দর পর্বত ধীরে ধীরে
তলিয়ে যেতে শুরু করল। সবার তো মাথায় হাত, এত পরিশ্রম বিফলে যায় যে। তখন
উদ্ধার করতে এলেন বিষ্ণু। একটা কচ্ছপের আকার
নিয়ে তিনি সমুদ্রের তলায়
গিয়ে পিঠের ওপরে মন্দর পর্বতকে উঠিয়ে নিলেন।
নাও এবার চালাও মন্থন। উদ্দেশ্য সফলও
হয়েছিল। মন্থনে উঠে
এসেছিল অমৃত যা খেয়ে
দেবতারা হয়ে উঠেছিল শক্তিশালী আর অসুরদের ভাগ্যে জুটেছিল লবডঙ্কা। বিষ্ণু ভুলিয়ে ভালিয়ে অসুরদের অমৃত পেতে
দেয়নি।

-----
ব্যাংককের
এয়ারপোর্টে
সমুদ্র
মন্থনের
দৃশ্য - পর্বতের নিচে বিষ্ণুর কূর্ম অবতার (ছবি - আন্তর্জাল)
এই গল্প বলার
উদ্দেশ্য হচ্ছে কচ্ছপ।
বিষ্ণুর এই কচ্ছপ রূপ
ধারণকে বিষ্ণুর কূর্ম (মানে কচ্ছপ)
অবতার বলে। এখানে দেখ মানুষ এক বিশাল কচ্ছপ আর সাপের কল্পনা করেছে। এই রকম
দৈত্যাকার কচ্ছপের কল্পনা কিন্তু শুধু এখানেই যে আছে
তা নয়। পুরাণে আছে যে পৃথিবীকে ধরে
রেখেছে আটখানা হাতি, আট দিকে
দাঁড়িয়ে এক একটা দিক
তারা সামলাচ্ছে বলে এদের
দিগগজ বলে। পৃথিবীকে ধরে আছে মানে বুঝছ
তাদের কী শক্তি? তাই কোনো
বিষয়ে অনেক শক্তিশালী বা
জ্ঞানী মানুষকে দিগগজ বলা
হয়। আবার বিষয়ে ফিরে আসি। এই
আটখানা শক্তিশালী হাতি
আবার দাঁড়িয়ে আছে এক
মহা শক্তিশালী কচ্ছপের ওপরে। বোঝ কাণ্ড, পৃথিবীসহ আটখানা হাতিও যখন সেই কচ্ছপের ওপরে তাহলে সে কচ্ছপ কেমন হতে পারে।
কবি জয়দেব আবার তাঁর
গীতগোবিন্দ কাব্যে বিষ্ণুর দশ
অবতার বর্ণনা করতে গিয়ে
বলেছেন যে পৃথিবীটাই কচ্ছপের ওপরে রয়েছে। মানে
হাতি বাদ গেলেও কচ্ছপ আছে।

-----
১৮৭৬
সালে বানানো একটি কাঠখোদাই যেখানে কচ্ছপের ওপর চার দিগগজ রয়েছে (ছবি - আন্তর্জাল)
এবারে বলব মহাভারতের এক গল্প। এটাও
অমৃত নিয়ে। পাখিদের রাজা হলেন গরুড়।
তিনি এক বিশাল পাখি
বলতে পারো। তার
মায়ের দাসিত্ব ঘোচাতে তার
ওপর ভার পড়েছিল স্বর্গ থেকে অমৃত নিয়ে আসার। দেবতারা তো স্বর্গে অমৃতকে ভয়ঙ্কর পাহারায় রেখেছে যাতে অসুরদের নাগালে না
আসে আর সেখান থেকেই গরুড়কে অমৃত চুরি করতে
হবে। যাই
হোক
এখন অমৃত চুরির গল্প
নয়, বলব চুরি করতে
যাওয়ার গল্প আর রাস্তায় খাওয়াদাওয়ার গল্প।
গরুড় তো স্বর্গে যাবে
অমৃত আনতে, কিন্তু সেই
লম্বা রাস্তায় খাবে কী, তার
পেট তো অল্পেস্বল্পে ভরার
কথা নয়। তখন
গরুড়ের বাবা কশ্যপ মুনি
বলে দিলেন যে দূরের এক হ্রদে থাকে অতিকায় দুটি জন্তু – একটি
কচ্ছপ যার শরীর ১৩০
কিলোমিটার লম্বা আর হাতি
তো তার দ্বিগুণ।
তারা অবিরত লড়াই করে
থাকে। এই হাতি
আর কচ্ছপ ছিল দুই
ভাই, বিভাবসু আর সুপ্রতীক। সম্পত্তি নিয়ে
দু’জনের মধ্যে চলছিল বিস্তর ঝামেলা।
একদিন বড়ো ভাই বিভাবসু রেগে ছোটো ভাইকে অভিশাপ দেন হাতি হবার।
ছোটো ভাই সুপ্রতীকও ছাড়ার পাত্র নয়, সেও দাদাকে কচ্ছপ বানিয়ে ফেলল অভিশাপ দিয়ে। তাতেও সমস্যা মিটল না। দু’জনে হাতি আর
কচ্ছপ হয়েও সবসময় লড়াই
করতেই থাকে। কশ্যপের পরামর্শে গরুড় স্বর্গে যাবার পথে এই দুই অতিকায় গজকচ্ছপকে দুই পায়ের নখে
বিঁধিয়ে উড়তে উড়তে ভাবছিলেন যে কোথায় বসে এগুলোকে শান্তিতে খাওয়া যায়।
তখন তিনি দেখতে পেলেন এক একশো যোজন লম্বা বটগাছের ডাল। ভাবলেন যে এর ওপরে বসে
খাওয়া যাক। ও
মা! ডালের ওপর বসতেই তা মড়মড় করে ভেঙে
পড়ল। গরুড়, হাতি, কচ্ছপ সবার
ওজন মিলে কী কম
নাকি! আবার সেই ডালে
ঝুলে তপস্যা করছিলেন বাল্যখিল্য মুনিরা তাই গরুড় সেই
ডালকেও তুলে নিলেন ঠোঁটে। এবার গরুড় কোথায় যায়? অগতির গতি সেই
কশ্যপমুনি। তিনি শেষে
এক জনমানবশূন্য, বরফে ঢাকা
পর্বতের সন্ধান দিলেন যেখানে গরুড় ঐ প্রকাণ্ড ডালটা ফেলে আরাম করে বসে
হাতি আর কচ্ছপকে খেয়ে
স্বর্গের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিলেন।
তাহলে দেখলে এখানেও দৈত্যাকার কচ্ছপ। গজকচ্ছপকে খাওয়ার জন্যে যে জনমানবশূন্য,
বরফে ঢাকা পর্বত বেছে
নেওয়া হয়েছিল এই রকম
পর্বত তো হিমালয় ছাড়া
ভারতে আর কিছু নেই
আর বিশ্বাস অনুযায়ী সেখানেই নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে গরুড়ের দ্বারা ভক্ষিত সেই দানবাকার গজকচ্ছপের হাড়গোড়। এবারে আমরা আজকের সময়ে ফিরে
আসি। তোমরা জানো
যে মানুষ আসারও আগে
থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রাণী আর উদ্ভিদ পৃথিবীতে এসেছিল। তোমরা নিশ্চয়ই ডাইনোসরের সম্বন্ধে জানো আর তাদের ছবি বা সিনেমা দেখেছ। ভাগ্য ভালো যে
ঐরকমের বিশাল জানোয়ার সব
বিলুপ্ত হয়ে গেছে, নয়তো মানুষ হয়তো পৃথিবীতে আসতেই পারত না। আমরা
এই সব প্রাণী আর
উদ্ভিদ নিয়ে জানতে পারি
পাথর হয়ে যাওয়া তাদের দেহের অংশ দেখে যাদের ফসিল বা জীবাশ্ম বলে। ব্রিটিশ সময়ে যখন
আমাদের দেশে ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলছিল তখন হিমালয়ের শিবালিক পর্বতশ্রেণী থেকে অনেক
জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল আর
তার মধ্যে ছিল বিশাল বিশাল সব কচ্ছপের খোলা।
তোমরা জাদুঘরে গিয়ে সেই
দৈত্যের মতো বড়ো কচ্ছপের খোলা দেখে আসতে পারো। এই কচ্ছপগুলো প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে
পৃথিবীতে ছিল আর তিন
কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে যত ধরনের কচ্ছপ এসেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিল এই কচ্ছপ যাদের বৈজ্ঞানিক নাম
হল Megalochelys atlas. প্রায় একতলা বাড়ির সমান
লম্বা (৯ ফুট) ছিল এই
কচ্ছপগুলো আর ওজন হত
দুই হাজার কেজি।
নিচে কলকাতা জাদুঘরে রাখা
এই ধরনের কচ্ছপের একটা
খোলার ফসিলের ছবি দিলাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
মানুষের সঙ্গে তুলনা করলেই বুঝতে পারবে যে কী
প্রকাণ্ডই না হত এই
প্রাণীগুলো।

-----
নেপালে
পাওয়া যায় এমন কিছু প্রাগৈতিহাসিক হাতির ছবি দেওয়া ডাকটিকিট (Paleophilatelie.eu থেকে নেওয়া)
এবারে ভাব যে
আমাদের পৌরাণিক কাহিনিতে যে
অতিকায় কচ্ছপের গল্প চলে
এসেছে তা কি এই
ফসিল দেখে ধারণা করা
হয়েছিল? এই কচ্ছপ তো
মানুষ পৃথিবীতে আসার অনেক
আগেই বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছিল, তাহলে মানুষের এগুলো দেখে গল্প বানাবার কোনো
সুযোগই ছিল না।
সেক্ষেত্রে আমরা ভাবতে পারি
যে মানুষ হয়তো কচ্ছপের অতিকায় ঐ রকম খোলা
দেখে ভাবতে চেষ্টা করেছে যে শুধু খোলাটাই যদি
এত বিশাল হয় তাহলে পুরো প্রাণীটা না
জানি কত প্রকাণ্ডই ছিল। তার সঙ্গে এমনও
ভাবতে পারে যে এই
ধরনের প্রাণী বা এর
চেয়েও বড়ো কচ্ছপ হয়তো
এককালে পৃথিবীতে ছিল। খোলাগুলো পাথর হয়ে
গেছে দেখে এটাও নিশ্চয়ই বুঝেছিল যে এগুলো অনেক
আগের জীব। দৈত্যাকার কচ্ছপের গল্প হয়তো এভাবেই মুখে মুখে ছড়িয়েছে আর
যেমন হয় তেমনই, গল্প যত
ছড়িয়েছে ক্রমশ কচ্ছপের আকার
বেড়ে গেছে।
আমার কথাটি ফুরাল,
ভাবনা ফুরাল না।
বিভিন্ন কিংবদন্তি, লোককথা, বীরগাথা, উপকথা, ধর্মের উপাদান এইভাবে ফসিলকে আশ্রয় করে
নিয়েছে। কতকগুলি আমরা
পরিষ্কার দেখতে পাই, যেমন শালগ্রাম শিলা। বিষ্ণু হিসেবে পূজিত শালগ্রাম শিলা
প্রকৃতপক্ষে একটি ফসিল, একে অ্যামোনাইট
(Ammonite) বলে। তার গল্প
না হয় আরেকদিন হবে।
----------
No comments:
Post a Comment