
বৃষ্টি নামুক যুদ্ধ শেষে
দীপান্বিতা দে রায়
পর্ব ।। এক
“এই ইনু ঝড় আসছে,
ঘরে যাবি না। শোন কাকিমা কিন্তু বকবেন। সবাই চলে গেছে, ওঠ।”
“আর একটু থাকি না,
এই মেঘে বৃষ্টি হবে না দেখিস।”
“হ্যাঁ, তুই সব জানিস,” জোঈ আকাশের দিকে তাকিয়েই কথাটা বলল।
“হ্যাঁ রে, আমার মা বলে ভগবান যখন মেঘের কৌটো খুলে কালো কালো মেঘ ছড়িয়ে দেন আকাশের গায়ে,
তারপর খুব জোরে ফুঁ দেন তখন বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি পড়ার আগে তোর গায়ে সেই ঠান্ডা
ফুঁয়ের বাতাস ঠিক লাগবে দেখিস। এখনও মাটি কত গরম দেখ। বাতাস যেন চায়ের দোকানের গরম ধোঁয়া। এ মেঘে বৃষ্টি হবে না,” বললাম আমি।
“তাহলে আমি বাড়ি গেলাম। মা বলে এই সময় কালবোশেখি হয়। তখন বাড়ি না ফিরলে আমার পিঠ ভেঙে দেবে। তুই থাক তবে।” জোঈ বার বার চেষ্টা
করে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। মাঠের পরে সিবাইদের বাগানের দিকে রাস্তাটা
যেতে একটু ভয় পায় জোঈ। বেশ কয়েকদিন ধরেই বুড়িটা মারা গেছে। এখন অত বড়ো বাড়িটা ফাঁকা হু হু করে। যদিও গুলি খেলায় এখনও কয়েকদান বাকি
ছিল, জোঈর
তাই বাড়ি ফিরতে মন চাইছিল না।
“বাড়ি ফিরতে হলে গুলিগুলো
ফেরত চাইতে হবে, তাহলেই ইনু রেগে যাবে।” বাড়ি ফেরার পথে আপন
মনেই কথাগুলো বলে জোঈ। ভারী ভালোবাসে সে আমাকে। কয়েকদিন যা গরম পড়েছে একটু বৃষ্টি
হলে ভালোই হয়। রাতেও
ঘরের ভেতরে থাকা দায়। বাবার সঙ্গে ছাদেই শোয় জোঈ। ওর বাবা তারাদের গল্প শুরু করলেই তার
বেশ ঘুম জুড়ে আসে চোখে৷ আমি জোঈদের পাশের বাড়িতেই থাকি। ছোটোবেলা থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব।
সেদিন বৃষ্টি হয়নি ছিটেফোঁটা। জোঈ সন্ধেবেলা আমাদের বাড়ি এসেছিল
গুলি ফেরত নিতে। মা
মুড়ি মেখেছিল আমতেল আর কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে। আমার কাছে ছোলাভাজা ছিল একটু। স্কুলের সামনেই ছেলেটা বসে। বেশ ঝাল ঝাল ছোলাভাজা। সেই মেখে মুড়ি খেয়েছিলাম দু’জনে।
“কবে বৃষ্টি পরবে বল
তো ইনু? কী গরম পরেছে বল।” জোঈ মুড়ি খেতে খেতে
প্রশ্ন করে।
ওই যেদিন মেঘের কৌটো খুলে
কালো মেঘ উড়িয়ে দেবে আকাশে...
কথাগুলো আজও ছড়িয়ে আছে যেন
মালাঙ্গের আকাশে বাতাসে। বালি দ্বীপের তুবান থেকে পশ্চিমে ক্রোশ দুই দূরেই তাদের মালাঙ্গ
গ্রাম। ওই
যে চিলেকোঠার ছাদে দুটি কিশোরের স্মৃতি পাক খায় বার বার আমার মনের ঘরে।
দেখতে পাই বেল বাজাতে বাজাতে
দূরে চলে যাচ্ছে বয়ঃসন্ধি। জামরুল গাছের নিচে সাইকেল দাঁড়িয়ে
আছে। ঠিক
তার ছায়ায় মাটিতে আঁকিবুঁকির দাগ। আমাদের কৈশোর জুড়ে আছে মাটির আঁচড়। আমার গায়ে বাতাস ও বসন্ত দুই এসে লাগে
হঠাৎ, জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শরীরের উত্তাপ নিয়ে বসে থাকি। জেগে উঠলেই আবহাওয়া বদলে যায়। হোমাগ্নি জ্বলে। নতুন পিয়ানো বাজে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর
নিচে, ঢাকা পড়ে চাঁদ। সন্দিগ্ধ নয়নতারা ফোটে। মুঠোভর্তি বেড়ে ওঠে ঘুম, আবছা লোভ ঝাঁঝালো
স্বভাবে জানলায় দাঁড়িয়েছে চোখ...।
আকাশে রুয়েছে কেউ জ্যোৎস্নার
বীজ, ভেসে
ভেসে নির্জন নেমে আসে চোখের আয়তে।
যে বৃত্ত আঁকার কথা, বার বার অর্থহীন পেনসিলের
দাগে তা অসমাপ্ত থেকে যায়, চোখের সামনে ফুরিয়ে যাচ্ছে পথ,
কেবল একটা বিন্দুর চারপাশে রাস্তা আঁকতে গিয়ে দূরে সরে যাচ্ছি আমি নিজেই,
পুবের জানলা খুললে ছবি আসে - ছবিগুলি যায়,
আবার দরজা বন্ধ, বুকের ভেতর ভেজা ঘাম, বৃষ্টি আসে - বৃষ্টি থেমে যায়।
গ্রামের বাচ্চারা কেউ কালেভদ্রে
ডেকে ওঠে – আয় বৃষ্টি ঝেঁপে।
কবিতার ডানা থেকে জল ঝরে বর্ষার
ঝিরি ঝিরি ডাক, শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। স্রোতের উজানে, ভাসি সেতুহীন একা
আমি।
তারপর ভেসে যাই অন্য কোথাও। অন্য এক স্মৃতির রাজ্যে।
ফাল্গুনের নরম রোদ এসে পড়েছে
কৃষ্ণচূড়ার মাথায়। মেঠো
পথ জুড়ে আলোছায়ার জাফরি হয়ে আছে। মৌরিফুলের গন্ধ মেখে শিমুল আধভেজা
শাড়িটা জড়িয়েছে আলগোছে। হাতখোঁপা করে বাঁধা চুলের ভার মুক্তি পেতে চাইছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। আকাশের আজ এত সাজের বাহার কেন জানি
না। ওই
তো আমার প্রিয়া আমার জন্য সেজেছে। চোখে তার মায়াকাজল। ডুব দিয়ে হারিয়ে যাওয়া যায় এক শতাব্দী। শাঁখের আওয়াজে মনে পড়ে যায় এরপর আমার
পাশে এসে দু’দণ্ড বসবে সে। খোলা পিঠে আলপনা এঁকে দেব ভালোবাসার। কিন্তু এ কী! শাঁখের আওয়াজ এত তীব্র
যান্ত্রিক কেন! চিঁ চিঁ একটানা শব্দে দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। উফফ্ যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথাটা।
...আইভরি হোয়াইট ডিম্বাকৃতি
পোর্টালের ভেতর থেকে উঠে বসল ইভান্স।
...ইয়োর সিটিজেন কার্ড
হ্যাজ এক্সপায়ার্ড...
পোর্টাল থেকে যান্ত্রিক স্বর
ভেসে আসছে। বার
বার ঘুরেফিরে একই কথা। বায়োমেট্রিক আপলোড অপূর্ণ থেকে গেল ইভান্সের। স্মৃতির সরণি বেয়ে বাইনারি আপলোড সিস্টেমে
দেখা যায় যান্ত্রিক ত্রুটি। আন্তর্জালিক পোর্টালে নিজেকে নথিবদ্ধ
না করলে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাও সম্ভব নয়।
অবাক হল ইভান্স। সিটিজেন কার্ড তো মেয়াদ শেষ হওয়ার
কথাই নয়। স্মৃতির
সরণিতে এতক্ষণ ইভান্স ফিরে গেছিল শৈশব আর কৈশোরের সময়ে। মাঝপথে এইভাবে সংযোগ কেটে যাওয়ায় বেশ
বিরক্ত হল ইভান্স। বাইনারি
প্রোগ্রাম স্টেশনের কথা জানিয়েছিল আকিও হিরোটো। তাই এখানে আসা। সেও ইভান্সের মতো E.D.E.N থেকে এসেছে। নিজের পরিচয় গড়তে নিরন্তর পরিশ্রম
করছে দিনরাত। দু’জনের লড়াইটা কোথাও
এক হয়ে গেছিল এই স্বল্প পরিচয়ে। Exterior Division of Earth's Network অর্থাৎ ইডেনের নামে যে প্রচ্ছন্ন প্রহসন তা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে ইভান্স। আলফা-আর্থে ইডেনের সবার
পরিচয় তারা রিফিউজি।
আর কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু
হবে ইন্টারগ্যালাক্টিক অ্যাকশন ম্যাচের প্রতিযোগিতা। তারই প্রস্তুতি তুঙ্গে এখন কাউন্সিলের
বিভিন্ন ডোমেইনের প্রতিযোগীদের মধ্যে। এই কারণেই ইভান্সের ইডেন থেকে এখানে
আসা। গ্যালাক্সির
যে কোনো টেরেস্ট্রিয়াল এই প্রতিযোগিতার অংশ। তাই সুদক্ষ যোদ্ধা ছাড়া এখানে কেউ
আসে না।
আদিকালের ইতিহাস অবশ্য অন্য
কথা বলে। একবিংশ
শতাব্দীর শেষে এক অসাম্যের পৃথিবীর গল্প। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদকে ব্যবহার
করেছিল কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ। তাই পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছিল যুদ্ধ। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা নিয়ে নানা কথা
হলেও জলবায়ু পরিবর্তন,
বর্ধিত জনসংখ্যা আর সংকুচিত হতে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের কথা ভেবে ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে অতিরিক্ত আসক্তি মানুষকে
যুদ্ধের অভিমুখী করে। তারপর একদিন সবকিছুর বিনিময়ে শেষ অবধি
লড়াইয়ে টিকে থাকে অল্পসংখ্যক কিছু মানুষের অস্তিত্ব।
তাদের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে
সমান্তরাল পৃথিবী। কৃত্রিম
উপায়ে তৈরি হয়েছে এই আলফা-আর্থ। এর নিজস্ব বায়ুমণ্ডল ছাড়াও আছে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা। সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সাম্য এবং
সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের পরিচালনায়। পুরোনো পৃথিবীর ক্ষত বিক্ষত ধ্বংসস্তূপ
নিয়ে পড়ে থাকে ইডেন। প্রতিটি দেশই তাদের নিজস্ব স্পেস স্টেশন থেকে পরিচালন করে আলফা-আর্থ। স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তার
ঘটেনি আলফা-আর্থ কাউন্সিলের কড়া নজরদারিতে। কাউন্সিল শিথিল হলেই শক্তিশালী দেশ
কেড়ে নিতে চাইবে দুর্বল দেশের আন্তর্জাতিক সীমানার অধিকার। নতুন ভাবে যুদ্ধের পরিস্থিতি শুরু
হবে আলফা-আর্থ জুড়ে। তাই মূলত ইডেনের প্রবেশাধিকার নিয়ে
আলফা-আর্থ
বেশ সচেতন। তাই
ইডেনের মানুষদের অবাধ প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ। প্রয়োজন ছাড়া সিটিজেন কার্ড পাওয়া
সম্ভব নয়। আলফা
আর্থের কাছে ইডেন অতিরিক্ত এক দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইভান্সের অবস্থান অবশ্য এই
সমান্তরাল পৃথিবীতে নয়। সে ইডেনের বাসিন্দা। তার এখানে আসার একটাই উদ্দেশ্য নিজের
পরিচয় খুঁজে পাওয়া। প্রতিবছর
ঠিক এই সময়ে একটা প্রতিযোগিতা হয় দুই পৃথিবীর মধ্যে সু-সম্পর্ক রক্ষার উদ্দেশ্যে। ইন্টার গ্যালাক্টিক ডোমেইনে ইডেনকে
নেহাতই সৌজন্য রক্ষার খাতিরে এই সুযোগ দেওয়া হয়। অনেক কষ্টে নিজের নাম নথিবদ্ধ করলেও
আজ তার সিটিজেন কার্ড ডিক্লাইন হল। মা, তার মায়ের মুখটা মনে পড়ল ইভান্সের। নাহ! কিছুতেই হেরে যাবে
না সে। শেষ
চেষ্টা করতেই হবে।
তার বন্ধু আকিওর কথায় এখানে
এসেছিল ইভান্স। গত
এক মাস ঘুমের কারণে কাজে বেশ অসুবিধা হচ্ছে তার। শরীরেও তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রতিযোগিতা ছাড়া
আর কিছুই ভাবছে না ইভান্স। বাইনারি পোর্টাল থেকে বাইরে বেরিয়ে
এসে পাশেই একটা ক্যাফেতে ঢুকে ভার্চুয়াল স্ক্রিনে একটা কফির অর্ডার দিল ইভান্স। পোর্টালের ওয়েবসাইটে গিয়ে ফিডব্যাক
দেবে নিজের ওয়ার্ক স্টেশনে ফিরে গিয়েই। এখানে এসে কান্ট্রি ইউনিটে একটা কাজ
জোগাড় করেছে আকিওর সাহায্যে। কাউন্সিল কিছু লো প্রোফাইল কাজের জন্য
ইডেনবাসীকে নিযুক্ত করে অনেকসময়। আকিওর প্রতি ইভান্সের কৃতজ্ঞতা অসীম। তবু নিজের রিফিউজি পরিচয়টা ভুলতে পারে
না ইভান্স। ডান
হাতের বায়োক্লক জানান দিল তার শিফটের সময় হয়েছে। গাড়িতে ওয়ার্ক স্টেশনের ডেস্টিনেশন
ফিড করাই আছে। গাড়ি
গন্তব্যে পৌঁছাতে মাত্র তিন মিনিট সময় নেবে। চোখ বুজল ইভান্স। মাথাটা এখনও দপদপ করছে।
পর্ব ।। দুই

স্বচ্ছ বায়ো-ক্যাপসুলের মধ্যে
শুয়ে আছে পূর্ণ বয়স্ক একটি মানুষ। পাশের মনিটরে হার্ট রিডিং স্বাভাবিক। ডঃ জোনস আর ওনার সহকারী মিস নোরা ইলিয়াস
কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটে ওঠা তথ্যগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
“পালস ড্রপ করছে দ্রুত। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়,” ওর সহকারী মনিটরের
দিকে চোখ রেখেই বলে কথাগুলো।
ডঃ দ্রুত ক্যাপসুলের ভেন্ট
খুলে দিলেন। একটু
একটু করে জেগে উঠছে সেই মানুষটা। প্রায় ছয় ফুট লম্বা একটা মানুষ, মাথায় একটা স্বচ্ছ
হেলমেটের মতো যন্ত্র। ঘাড়টা নুয়ে পড়েছে সামান্য পাশের দিকে। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে
সামনের দিকে।
“লোডিং প্রায় আশি শতাংশ
কমপ্লিট হয়েছে প্রফেসর। মিঃ ইভান্সের সঙ্গে আরও দুটো সেশন
বাকি।”
নোরা ইলিয়াসের চোখ কম্পিউটার স্ক্রিনে আটকে আছে।
“আবার ফিরে আসবে ইভান্স। ফিরে আসতেই হবে ওকে। এই প্রতিযোগিতা ওর জন্য নিজেকে খুঁজে
পাওয়ার এক লড়াই। ওর
বায়োমেট্রিক আপলোডে টেকনিক্যাল ফল্ট দ্রুত খুঁজে পেতে হবে আমাদের।” প্রফেসর জোনস অধৈর্য
হয়ে ওঠেন।
“আর কতদিনের অপেক্ষা
প্রফেসর। এদিকে
কাউন্সিল থেকে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। আর বেশিদিন ওদের চোখের আড়ালে থাকতে
পারব কী?” নোরা ইলিয়াস প্রশ্ন করেন।
“তুমি ভুলে গেছ অতীতের
সেই পৃথিবীর কথা?” পালটা প্রশ্ন করেন প্রফেসর নার্ডিক জোনস।
“প্রথম বিশ্বের সবচেয়ে
শক্তিশালী দেশের সবচেয়ে উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা ছিলাম আমি। আমার মতো হাজার হাজার সৈনিক ছিল রাষ্ট্র
নিবেদিত প্রাণ। যুদ্ধ
শেষে যারা ফিরে যায় কিংবা সংখ্যায় হারিয়ে গেলাম। এতগুলো বছরে কেউ খোঁজ করেছে আমাদের? আজকের পৃথিবী প্রযুক্তিগত
দিক থেকে যে কোনো সময়ের চেয়ে সেরা সময় পার করেছে।” একসঙ্গে কথাগুলো বলে
খানিকটা থামলেন প্রফেসর।
“শান্ত হোন প্রফেসর।”
“অধিকাংশ শারীরিক মিথস্ক্রিয়ার
জায়গা দখল করে নিয়েছে রোবটকেন্দ্রিক মিথস্ক্রিয়া। কিন্তু আমাদের কী হয়েছে খোঁজ নেয়নি
কাউন্সিল। আমি
নিজের মতো করে ওদের ব্যবহার করেছি। অন্যায় তো করিনি। আরও উন্নত এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছি
আমি,” প্রফেসর জোনসের চোখ দুটো অসম্ভব শান্ত এখন। ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বাভাস।
“কিন্তু এতে তো পৃথিবীর
প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে প্রফেসর?” সহকারী মিসেস নোরা ইলিয়াসের
মুখে অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।
“ঈশ্বর যখন প্রাণ সৃষ্টি
করেছিলেন তখন একটাই ভুল করেছিলেন, মানুষকে নিজের মতো চিন্তা করার
শক্তি দিয়েছিলেন। সেই মানুষই একদিন চ্যালেঞ্জ করে বসল ঈশ্বরকে। আমার সৃষ্টিতে শুধুই আমার অধিকার থাকবে। আমি নতুন করে গড়ে তুলব আমার পৃথিবী। ওঁর সৃষ্ট প্রাণ নশ্বর। তাই জন্ম মৃত্যুর বিধাতা উনি। ওরা তো নিজেরাই সব শেষ করেছে। এখানে নতুন করে সব গড়ে তুলব আমি। এখানে ওই আদমের সন্তানদের প্রবেশ নিষেধ।” নোরা ইলিয়াস খেয়াল
করল প্রফেসরের চোখ দুটো জ্বলে উঠল যেন।
“আমি, আপনি, আমরাও তো আদমের সন্তান। তাছাড়া আলফা-আর্থ তো সব দিয়েছে
আমাদের,” নোরা ইলিয়াস প্রফেসরের এই রূপ আগে দেখেনি।
হা হা শব্দে হেসে উঠলেন প্রফেসর।
“জিন এডিটিং-এর প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে মিস নোরা। আর কিছুদিনের মধ্যেই এই হোমো সেপিয়েন্সের
বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাব আমরা। আমরা হয়ে উঠব সর্বশক্তিমান-অপ্রতিরোধ্য,
শুধু অপেক্ষা আর কয়েকদিনের। ইভান্স, এই ইভান্সই আমার সেই
চাবিকাঠি। এটা
আমার বিশ্বাস। ওকে
আমার কাছে আসতেই হবে। ওর নিয়তিই ওকে আমার কাছে আনবে একদিন। ইভান্স জানে না আমার বাইনারি আপলোড
প্রোগ্রাম ওকে আমার কতটা কাছে নিয়ে এসেছে।”
সময় তখন রাত প্রায় দুটো। স্কাইওয়েতে নিজের গতিতে ছুটে চলেছে
প্রফেসরের হাইপার-কার যিয়ান নিও-সুপার। ড্যাশবোর্ডের স্ক্রিনে গন্তব্য লেখা
রোবোটিক্স রিসার্চ সেন্টার। প্রফেসর যথাসম্ভব নিজেকে সংযত রাখার
চেষ্টা করলেও ওনার উদ্বেগের কারণই যে ওনাকে এত রাতে সেন্টারে যেতে একপ্রকার বাধ্য করেছে
সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
“রিসার্চ সেন্টারে গেলেই
কী আপনার সমস্যার সমাধান হবে প্রফেসর? এই প্রতিযোগিতা বন্ধ হবেই।”
স্ক্রিনজুড়ে একটা অডিও ক্লিপিং
প্লে হচ্ছে। প্রফেসরের
কপালে শীততাপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
“তুমি ভুলে যেও না আমার
ক্ষমতা অসীম, তোমাকে ঠিক খুঁজে পাব আমি,” প্রফেসর জোনসের গলায় তাচ্ছিল্যের সুর স্পষ্ট।
“কিন্তু আমি তো কেবলই
একটা সংখ্যা প্রফেসর। আমাকে ধ্বংস করবেন কী করে? একটা প্রাণের জন্ম
থেকে শুরু হয় সংখ্যার খেলা। ক্রোমোজমের সংখ্যা নির্ধারণ করে তার
প্রকৃতি। কিন্তু
আমি তো কেবল বাইনারি নাম্বার। এই দেখুন আপনার গাড়ির স্পিড ধীরে ধীরে
একশো ছুঁল। তারপর
আরও গতিবেগে ছুটবে আমার ইশারায়।”
“প্লিজ স্পিড কমাও। মনে রেখো আমার মৃত্যু হলেও আমার সৃষ্টির
মৃত্যু নেই।”
“আপনার জীবনটা আমি সব
কিছু দিয়ে রক্ষা করব। আমার কাছে আপনার জীবনটা সত্যি মূল্যবান, কিন্তু ওই দেখুন সামনে
এক পথচারী। নিয়মমতো
ট্রাফিকের ওই সময়ের সংখ্যাটার আরও তিরিশ সেকেন্ড পরে আপনার গাড়ির চলার কথা। দেখুন সামনে একজন বৃদ্ধ মানুষ, কিন্তু এ কী আপনার
গাড়ি তো থামছে না প্রফেসর।” ড্যাশবোর্ডের অডিও
ক্লিপিংটার গলায় কী অদ্ভুত শান্তি।
“প্লিজ থামাও গাড়িটা,
অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।”
মুহূর্তে পথচারীটি ছিটকে পড়লেন
রাস্তায়। প্রফেসরের
গাড়ি স্কিড করে কিছুটা দূরে গিয়ে থামতেই ট্রাফিক বিভাগের কিছু রোবট এসে গাড়ি থেকে প্রফেসরকে
নামায়। পথচারীটি
আহত বলে ইমার্জেন্সি হেলি-কার তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে যায়। শহরে এমন পথ দুর্ঘটনা প্রায় ঘটে না
বললেই চলে। গাড়ি
বেশিরভাগ সময়ে অটো পাইলটেই চলে। বিপদের সম্ভাবনায় সে নিজেই থেমে যায়
কিন্তু আজকের এই ঘটনা মুহূর্তে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
পর্ব ।। তিন
“মৃত্যু অপার শান্তি
নাকি শাস্তি?” আকিওর চোখ আটকে আছে টিভির পর্দায়।
খবরের হেডলাইন নাকি
কোনো?” ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করে ইভান্স। খাটের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিল ইভান্স।
“না রে, তুই প্রফেসর জোনসের ইন্টারভিউটা দেখলি আজ?” প্রশ্ন করে
আকিও।
“নার্ডিক জোনস। শুনেছিলাম উনি নাকি বেশ কয়েক বছর ধরে
রোবোটিক্সের ওপর গবেষণা করছিলেন। কিন্তু সরকারি অনুদান নাকি বন্ধ হয়ে
যায়। আজ
ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন,
দেখলাম কেমন যেন বিধ্বস্ত চেহারা হয়েছে ওনার।” ইভান্স জানায়।
“সব কেমন এলোমেলো হয়ে
যাচ্ছে ইভান্স, স্টেট কাউন্সিল তোর সিটিজেন কার্ড ডিক্লাইন করেছে। শুনেছিলাম প্রফেসর জোনস নিজেও একজন
প্রতিযোগী ছিলেন। আজ
ওনার অ্যাক্সিডেন্ট। কিছু একটা যোগাযোগ তো আছেই।” আকিওকে এত বিচলিত দেখেনি
আগে ইভান্স।
“স্টেট ফেডারেল আইন
অনুযায়ী আমি একমাত্র প্রতিনিধি, আমাকে যেতেই হবে। প্রফেসরের ইন্টারভিউটা নিলে হয়তো কিছু
জানা যাবে। তাছাড়া
তুই কি সত্যি এখনও প্রতিযোগিতা নিয়ে ভাবছিস? তাহলে প্রফেসর জোনস একমাত্র মানুষ যিনি সাহায্য
করতে পারেন তোকে।” আকিও বলে।
“তুই আমার জন্য অনেক
করেছিস আকিও। তুই না থাকলে এতটা পথ এগোতে পারতাম না। তাছাড়া তুই তো জানিস আমার বাবাও একদিন
এসেছিলেন আলফা-আর্থে। শুনেছিলাম এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রফেসর জোনস কি সত্যি সাহায্য করতে
পারবেন?” ইভান্সের চোখ দুটো অসহায়ভাবে চেয়ে থেকে আকিওর দিকে।
“তুই ভুলতে পারিস না
আজও জানি। তোকে
হেরে যেতে দেখতে পারব না। একবার শেষ চেষ্টা করবই। কাল যাবি আমার সঙ্গে।” আকিও উঠে আসে ইভান্সের
কাছে।
“ভুলেই তো যেতে চাই,
কিন্তু তাও অতীত বার বার সামনে এসে দাঁড়ায়, বাস্তবের
মুখোমুখি হতে হয় আমাকেই প্রতিবার। আমার জীবনটাই অস্তিত্বহীন। না আছে পিতৃপরিচয়, গেমিং কাউন্সিল থেকে
নির্বাচিত হয়েও আমি ওদের সদস্য হতে পারিনি। ওরা আমার সিটিজেন কার্ডের মেয়াদ শেষ
হওয়ার আগেই ডিক্লাইন করে দিয়েছে। এই প্রতিযোগিতা না জিতলে সব হারাব
আমি। মাকে
দেওয়া কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” ইভান্সের চোখদুটো আর্দ্র হয়ে আসে।
“কাল ওনার সঙ্গে একটা
সাক্ষাৎকার আছে। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারি। ওনার অবর্তমানে তোর কথা কাউন্সিল ভাবতেই
পারে যদি উনি রেকমেন্ড করেন। কাল তুই আমার সঙ্গে যাবি,” ইভান্সের কাছে এর
কোনো উত্তর নেই। অনেক বছর ধরে সে তার বাবাকে খুঁজেছে। কোনো খোঁজ পায়নি।
পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে ওরা
পৌঁছে যায় প্রফেসরের বাড়িতে। অবশ্য ওখানে সরাসরি প্রফেসরের সঙ্গে
সাক্ষাৎ হয় না ওদের। নোরা ইলিয়াস, ওনার সহকারী ওদের নিয়ে যায় একটা বিশেষ ঘরে। সেখানে ভার্চুয়াল স্ক্রিনে কথা হয়
ওদের।
“ইডেনে ফেরার জন্য তোমার
হাতে মাত্র সপ্তাহখানেক সময় আছে ইভান্স। তারপর এখানে থেকে যাওয়াটা ফেডারেল
কাউন্সিলের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, জানো নিশ্চয়ই।” ভার্চুয়াল স্ক্রিনে
যান্ত্রিক একটা গলার স্বর ভেসে আসে। ইভান্স জানে ও প্রান্তে প্রফেসর নার্ডিক
জোনস আছেন।
“ব্যস্ততম এক বিজ্ঞানীর
কাছে সময় অমূল্য। তাও আপনি আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন।” ইভান্সের চোখ আটকে
আছে ভার্চুয়াল স্ক্রিনে।
“আমার এতদিনের পরিশ্রম
আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। কোনোভাবেই আমি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ
করতে পারব না। আকিও
তোমাদের আসার কথা কালই জানিয়েছে। জানিয়েছে তোমার উদ্দেশ্যও। আমি জানি মিঃ ইভান্স এতদিন কীসের খোঁজ
করছ তুমি। সেই
অদৃশ্য সেতুর ওপারে তোমার জন্ম পরিচয়। এই মিশনটা শেষ করলে হয়তো খুঁজে পাবে। গেমিং কাউন্সিল তোমার এবারের প্রতিযোগিতা
নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু
আমার স্পেশাল পাসে তুমি অংশগ্রহণ করবে,” ভার্চুয়াল স্ক্রিনে প্রফেসরের কন্ঠস্বর ভেসে
আসে।
ক্রমশ অডিটোরিয়াম হলের বিশাল
স্ক্রিনজুড়ে ফুটে উঠল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ছবি। কোথাও মহামারি, কোথাও যুদ্ধ পরবর্তী
ধ্বংসের ছবি। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে পৃথিবীর আয়ু। যদিও পুরোটাই ভার্চুয়াল স্ক্রিনে, তাও বাকরুদ্ধ হয়ে
থাকে ইভান্স সেই স্ক্রিনের দিকে চেয়ে।
“এই পৃথিবীর স্বপ্ন
দেখেছিলে কি তোমরা? এর শেষ কোথায় বলতে পারো? কাউন্সিলের চোখ এড়িয়ে ইডেনে প্রতিনিয়ত চলছে শত্রু দেশের এই ভয়াবহ আক্রমণ। আমি জানি তুমি আবার ফিরে যাবে তোমার
পৃথিবীতে। আলফা-আর্থের সদস্যপদ তোমার
চাই না। আকিও
আমাকে জানিয়েছে সবটা। তোমাকে আমি নিজে রেকমেন্ড করব। বদলে পাবে তোমার ইচ্ছে-পূরণের চাবিকাঠি। কিন্তু শর্ত একটাই। বিজয়ী হতে হবে। তার পরিবর্তে চাইলে তুমি স্থায়ী সিটিজেন
কার্ড পেতে পারো আলফা-আর্থের। পারবে?”
“কিন্তু আমিই কেন?
আপনি তো আমাকে চেনেন না।”
“তুমি যে মুহূর্তে আলফা
আর্থে প্রবেশ করেছ তোমার প্রাথমিক ডেটা আমাদের কাছে আপলোড হয়েছে। ইডেনের স্পেশাল গেমিং ইউনিটের টিম
লিডার ছিলে তুমি। আমি
তোমার দক্ষতার প্রতি আস্থাশীল। এই স্পেশাল ওয়ারক্রাফট চালানোর প্রশিক্ষণ
খুব কম কমান্ডোর আছে। তুমি তার অন্যতম। তাছাড়া এই মিশনের একমাত্র অধিকারী
তুমি। এটা
তোমার পিতার অসম্পূর্ণ মিশন।”
“আপনি চেনেন আমার বাবাকে?”
প্রশ্ন করে ইভান্স।
“তুমি তৈরি তো?
আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা!”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কি পারবে প্রতিযোগিতায়
বিজয়ী হতে?” ভার্চুয়াল স্ক্রিনে প্রফেসরের গলার স্বর ভেসে আসে
শেষবারের মতো।
“আমাকে পারতেই হবে প্রফেসর।”
ইভান্স সেদিনের মতো ফিরে আসে
নিজের ইউনিটে।
পর্ব ।। চার
ইন্টারগ্যালাক্টিক ওয়ার গেমের
অন্যতম প্রতিযোগীর নাম এখন ইভান্স লেস্টারি। আনকোরা এই প্রতিযোগী যে সেমিফাইনালে
পৌঁছে যাবে ভাবেনি কেউ। ভার্চুয়াল ওয়ারহাউজে উপস্থিত হয়েছে প্রায় একশোটা দেশের প্রতিযোগী। সেমিফাইনালের পর মাত্র পনেরোজনকে নিয়ে
এই প্রতিযোগিতা। পুরো
প্রতিযোগিতাই অবশ্য ভার্চুয়াল জগতে নিয়ে যাবে ওদের। ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে প্যানেল রুমের। সবাই নিজের নিজের পোর্টালের বিশেষ
চেয়ারে বসে আছে। মাথায়
স্বচ্ছ একটা হেলমেট। চোখ বন্ধ করে ইভান্স। মাথাটা ভারী হয়ে আসছে। অন্তর্জালের দুনিয়ায় প্রবেশ করবে এবার
ওরা সবাই। ওখানে
সবাই একটা বাইনারি প্রোগ্রাম মাত্র। এখানে অপেক্ষা করবে ওদের শরীর।
ওয়ারক্রাফটের ভিউ রুম থেকে
দূরে নীল সবুজ গ্রহটা দেখা যায়। ট্রপোমণ্ডলের ঠিক ওপরে ভাসমান আলফা-আর্থ অনেকাংশে স্বচ্ছ। তাই চারিদিকে অনন্ত অন্ধকারের মাঝেও
ইভান্সের চোখে পুরোনো পৃথিবী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও পৃথিবীর কক্ষপথেই আলফা-আর্থের আবর্তন। এখান থেকেই শুরু হবে প্রতিযোগিতা। বাকি চোদ্দোজনকে হারিয়ে কে ছিনিয়ে
আনবে বিজয়ীর উপাধি?
ওয়ারক্রাফট কমব্যাট-হাইড্রা ট্রপোমণ্ডলে
ঢুকতেই ইভান্সের চোখে পড়ল লাল নীল সবুজ কিছু রঙিন ভাসমান বস্তু। আকারে খুব বড়ো নয়। আবার অন্য ওয়ারক্রাফটের মতো থার্মাল
ফুটপ্রিন্টও নেই। অটো
পাইলটে ইভান্সের ওয়ারক্রাফট যানটি এগিয়ে চলেছে।
আর এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি? অচেনা এন্টিটিগুলো
আইডেন্টিফাই করার জন্য স্টিলথ মোড অন করল ইভান্স।
আরও একটু কাছ থেকে দেখে অবাক
হয় ইভান্স।
খোলা আকাশে খেলে বেড়ায় রঙিন
ভোকাট্টা ঘুড়ি। কতদিন
পরে সে ঘুড়ি দেখল। সে
বুঝল গেমের এই অংশটা ইডেনের টেরেস্ট্রিয়াল জুড়ে।
ফসল কাটার প্রথম দিনকে উপলক্ষ্য
করে সারা মালাঙ্গের আকাশ জুড়ে দেখা যায় ঘুড়ি ওড়ানো।
ভারতের মানুষেরা সাধারণত মকরসংক্রান্তির
দিন কিংবা বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে ঘুড়ি ওড়ায়। সেখানে ব্যতিক্রম দেখা যায় মালাঙ্গে। মালাঙ্গের মানুষ কৃষিকার্যকে সম্মান
জানাতে বেছে নিয়েছে ঘুড়ি নিয়ে আকাশে কাটাকুটির খেলা। যে খেলাটি একটি আঞ্চলিক উৎসবে পরিণত
হয়েছে। শৈশবের
সরণি বেয়ে ইভান্স ফিরে পেল একটুকরো স্মৃতি।
হঠাৎ যান্ত্রিক একটা স্বর
ভেসে এল ওর ড্যাশবোর্ডে।
“ইভান্স এই মিশন অ্যাবোর্ট
করো দ্রুত।”
“কে আপনি? কী আপনার পরিচয়?” ইভান্স দ্রুত উত্তর দেয়।
“আমাদের এই জগতে সবার
একটাই পরিচয়। একটা সংখ্যা মাত্র আমরা। এখানে আমি একটা প্রোগ্রামিং মাত্র
ইভান্স, ঠিক তোমারই মতো।” ড্যাশবোর্ডে একটা হলোগ্রাফিক ইমেজ স্পষ্ট
হয়ে আসে। কোথায়
যেন দেখেছে ওনাকে, হ্যাঁ উনিই তো নোরা ইলিয়াস, প্রফেসরের সহকারী।
জোন ফাইভ থেকে অ্যাটাকের সিগন্যাল
তখন স্ক্রিনজুড়ে।
ইভান্স একজন অ্যাকশন গেমের
প্লেয়ার। আন-আর্থের গেমিং লিগে
প্রতিবছর সে বিজয়ী হয়েছে। অন্তর্জালের দুনিয়ায় চ্যাম্পিয়ন এক
যোদ্ধা সে। তাই
কোনোভাবেই ড্যাশবোর্ডের এই বিওটির সিগনালের দ্বারা সে প্রভাবিত হতে পারে না। সে জানে এটা একটা গ্লিচ মাত্র।
“তুমি শ্রেষ্ঠ এক যোদ্ধা
কিন্তু প্রফেসর জোনস তোমাকে চাবিকাঠি করেই চাইছেন অন্তর্জালের দুনিয়ায় প্রবেশের অধিকার। আমরা এতদিন ওনাকে আটকেছি। কিন্তু তুমি নিজে থেকে সরে না দাঁড়ালে
তা সম্ভব হবে না। তোমার
সিস্টেম আপলোড আটকেছিলাম আমিই। প্রফেসরের অ্যাক্সিডেন্টটাও।” ড্যাশবোর্ড জুড়ে নোরা
ইলিয়াসের যান্ত্রিক স্বর।
মাত্র কয়েকঘন্টার এই চ্যাম্পিয়নশিপের
জন্য সে নিজেকে তৈরি করেছে। কিন্তু এই প্রোগ্রামিংগুলো তার কাছে
অপ্রত্যাশিত।
“প্রফেসর জোনস ইন্টার
গ্যালাক্টিক কাউন্সিলের এক সৈনিক ছিলেন একসময়। সেই সময় যা সম্ভব হয়নি আজ সেই উদ্দেশ্যই
সফল করতে চাইছেন উনি। মাত্র কিছু সময় বাকি আর ইভান্স। তোমার প্রোগ্রামিং করা যুদ্ধযান আসলে
একটা ভাইরাস লোড। তোমার
প্রতিযোগিতা শেষ হলেই যা ডাউনলোড হবে ইন্টার গ্যালাক্টিক কাউন্সিলের সার্ভারে। তারপর দ্রুত হ্যাক হবে সমস্ত ডেটা। এটাই উদ্দেশ্য প্রফেসরের। তুমি যাকে বন্ধু ভেবে বিশ্বাস করেছ
সেই প্রফেসর তোমাকে কাজে লাগাতে চাইছেন।” নোরা ইলিয়াসের বিওটি
এখনও সক্রিয় ইভান্সের ড্যাশবোর্ডে।
ইভান্স জানে এক মুহূর্তের
থেমে যাওয়া মানেই সে হেরে যাবে।
“কীভাবে সম্ভব?
আমরা সবাই অন্তর্জালের দুনিয়ায় কুশীলব মাত্র এই কিছু সময়ের জন্য। সময় পেরিয়ে গেলেই আবার ফিরে যাব। আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য প্রফেসরের
কাছে স্পষ্ট। অপেক্ষা
করছে আমার পৃথিবী। আমাকে
শেষ করতেই হবে এই প্রতিযোগিতা।” ইভান্স দৃঢ় গলায় জানায়।
“প্রফেসর জোনস আর তোমার
পিতা একই সঙ্গে কাউন্সিলে যোগদান করেন। তোমার পিতার স্বপ্ন ছিল ইডেনকে ধীরে
ধীরে আলফা-আর্থের সঙ্গে যোগ করার। কিন্তু প্রফেসর জোনস চেয়েছিলেন আলফা-আর্থের সম্পূর্ণ অধিকার। ঈশ্বর হতে চেয়েছিলেন। মিঃ বেরাখ লেস্টারি এই প্রতিযোগিতার
শ্রেষ্ঠ প্লেয়ার ছিলেন। ওনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন প্রফেসর জোনস। সেই স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়
তোমার বাবা মিঃ বেরাখ লেস্টারি, তাই তিনি আজও বন্দি এই অন্তর্জালের দুনিয়ায় এক গ্লিচ হয়ে। আমার নিজেরও কোনো ক্ষমতা নেই ওনাকে
আটকানোর। প্রফেসরের
উদ্দেশ্য ছিল অসৎ। প্রথম
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধাদের নিয়ে তিনি এখন অদম্য এক সেনবাহিনী নির্মাণ করেছেন। তোমাকে এতদিন আমরা ওনার থেকে দূরে
রাখার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি যেদিন আলফা-আর্থে তোমার পিতার সন্ধানে এসেছিলে সেদিনই উনি
তোমার সন্ধান পান। তাই তোমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন এই ধ্বংসের। তোমার পিতাকে ব্যবহার করে যা সম্পূর্ণ
করতে চেয়েছিলেন উনি একদিন।
“আজকের এই ওয়ারক্রাফট
যদি সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত হয় তবে আলফা-আর্থের সমস্ত কিছুর আধিপত্য
পাবেন প্রফেসর। শুধু তাই নয়, ধ্বংস হবে তোমার পৃথিবী ইডেনও। মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় বাকি আর ইভান্স। তাকিয়ে দেখো ক্যাপটেন, র্যাডারে ক্রমশ কাছে
আসছে ওদের লঞ্চিং ভেসেলগুলো। বায়োলজিকাল এই অস্ত্র হবে ইডেনের ধ্বংসের
কারণ। আটকাতে
হবে ওকে,” নোরার নির্দেশগুলো স্ক্রিনে ভেসে আসছে। “ওই লঞ্চিং ভেসেলগুলোতে
প্যাথোজেন কিংবা জৈব রাসায়নিক বিষ আছে। ওই যে দূরে মেঘ দেখছ ইভান্স, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই
বিষাক্ত বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে। লাল নীল ঘুড়ির মতো বস্তুগুলো প্যাথোজেন
কেরিয়ার। এই
কালো মেঘ দেখে ইডেনের কোনো একজন আজও কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেবে হয়তো।”
ট্রপোমণ্ডলের নীচে ঘন কালো
মেঘ জমেছে। প্যাথোজেন
কেরিয়ারগুলো মেঘের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
“ক্ষমতার লোভ অন্ধ করেছে
প্রফেসর জোনসকে। হোমো সেপিয়েন্সের শারীরিক গঠন যে কার্বন গঠনের ওপর নির্ভরশীল
তার উপযুক্ত আবহাওয়া আলফা আর্থে উপস্থিত। কিন্তু একসময় তা শেষ হয়ে আসবে। প্রফেসর জোনস জিন এডিটিং করে তার সেনাবাহিনীকে
অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন। তাই তুমিই সেই চাবিকাঠি। এই গেমে বিজয়ী হওয়া প্রফেসরের পক্ষে
অসম্ভব। কিন্তু
তুমি তোমার পিতার মতোই শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। আমার কথায় বিশ্বাস কোরো না ইভান্স। তোমার কাছে যে ডেটা লগবুক আছে তাতে
সমস্ত তথ্য তুমি পেয়ে যাবে। আমি পাসওয়ার্ড দিচ্ছি। তুমি খুঁজে দেখো। তোমার পরিচয় বন্দি ওখানে।” নোরা ইলিয়াসের কণ্ঠে
এক অদ্ভুত বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল।
এবার ভার্চুয়াল স্ক্রিনে ফুটে
উঠল ২০৮৬ সালের মে মাস,
ভোর হতে একটু সময় বাকি। একজন মহিলার অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট
হচ্ছে ভার্চুয়াল স্ক্রিনে। মহিলার কোলে এক শিশু সন্তান। এই তো তাদের মালাঙ্গ। এই শিশু কি তবে ইভান্স? পাশের মানুষটা তার
বাবা। ছবিতে
কতবার দেখেছে। কতবার
বুকে জড়িয়ে ধরেছে ছবিটা। ছবির মানুষটা শেষবারের মতো বিদায় চুম্বন এঁকে দিচ্ছে শিশুটির
কপালে। মুহূর্তে
বদলে গেছে সময়। ওই
তো গেমিং কাউন্সিলের পোশাকে তার পিতা। মিঃ বেরাখ লেস্টারি।
ইভান্সের চোখদুটো ঝাপসা হয়ে
আসছে ক্রমশ।
“বাবা”... ছুঁতে গিয়েও ওর অবয়বটা অধরা থেকে গেল। ওটা যে হলোগ্রাফিক প্রোজেকশন, বুঝল ইভান্স।
“তোমাকে সাহায্য করব
আমি, তারপর আমার ছুটি। এটা আমাদের দু’জনের স্বপ্ন,
ক্যাপটেন ইভান্স উইশ ইউ লাক। আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ক্যাপটেন
মিঃ বেরাখ লেস্টারি নিজে। এই ভয়াবহ দিনের কথা ভেবেই হয়তো। আমার হয়তো আর ফেরা হবে না কোনোদিন, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে
এই সময়সরণি তৈরি করেছিলাম তা পূর্ণ হোক। প্রফেসর এতক্ষণে জেনে গেছেন আমার কথা। যদিও কাউন্সিলের কাছে ওনার সমস্ত তথ্য
জমা দিয়েছি আমি। আমাদের
মিশন শেষ হলেই কাউন্সিল দায়িত্ব নেবে পরবর্তী তদন্তের।” নোরার কথাগুলো মন দিয়ে
শুনছিল ইভান্স।
“আগে কেন আটকাননি ওনাকে?”
প্রশ্ন করে ইভান্স।
“কারণ জানতাম উনি তোমাকে
ঠিক খুঁজে বের করবেন। তাছাড়া ওনার সমস্ত তথ্যসূত্রের হদিস
পেতে আমার যথেষ্ট সময় লেগেছে। ওনার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে বহুদিন।”
“উনি নিজেও তো একজন
প্রতিযোগী ছিলেন। তবে আমাকে ব্যবহার করলেন কেন?” প্রশ্ন করে ইভান্স।
“সেটাই ওনার প্রাথমিক
উদ্দেশ্য ছিল। মিঃ বেরাখের মতো তোমাকেও এখানে বন্দি করার। কিন্তু ওনার অ্যাক্সিডেন্টটা সব পালটে
দেয়। তাই
তোমাকেই পাঠান উনি। তুমি
ওনার প্ল্যান বি। আমি
শেষ চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি। কোনোভাবেই হারতে শেখেননি মিঃ জোনস।
“টাইম আর ডাইমেনশনের
এই আবিষ্কার তোমাকে পৌঁছে দেবে ওই সার্ভারের উৎসে। মাঝপথে তুমি থেমে গেলে ধ্বংস হয়ে যাবে
সেলফ ডেস্ট্রাকশন মোডে তোমার ওয়ারক্রাফট। তাই তুমি প্রতিযোগিতা মাঝপথে ছাড়তে
পারবে না। বাকি
কাজ আমি করব। তারপর
তোমাকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাব তোমার প্যানেল রুমে। সেখানে অপেক্ষা করছে আকিও। তোমাকে পৌঁছে দেবে তোমার পৃথিবীতে। প্রফেসর জোনস ওকেও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এখন ও সবটা জানে, তোমাকে সাহায্য করবে।”
ভার্চুয়াল স্ক্রিনে ফুটে উঠছে
ওদের পরবর্তী ডেস্টিনেশন।
“আর এগিয়ে যাওয়া ঠিক
হবে না তোমার।” নোরার কথা ড্যাশবোর্ডে ভেসে ওঠে।
“সাধারণ গেমিং ম্যাপে
এই লোকেশন প্রতিযোগীদের আড়ালে থাকে। আমিও তাই খুঁজে পাইনি এর উৎস। তোমার ওয়ারক্রাফট নিয়ে তুমি সার্ভারের
বাইরে থাকবে।”
নোরার প্রতিটা কথা ইভান্সের স্ক্রিনে ভেসে আসছে।
লোডিং আটকানোর জন্য রিভার্স
প্রোগ্রাম লোড করল সুপার কম্পিউটার নোরা।
“আমার কাজ শেষ হল ইভান্স।” নোরার হলোগ্রাফিক ইমেজ
ইভান্সের দিকে এগিয়ে দিল ওর হাত। এবার তোমার ফেরার পালা ইভান্স।
সেলফ ডেস্ট্রাকশন মোড অন করল
ইভান্স। ও
জানে ওর ফেরা হবে না আর।
“আমার পরিচয় আমি এক
যোদ্ধা। ‘ওই, বাট টু ডাই অ্যান্ড গো উই নো নট হোয়্যার...
টু লাই ইন কোল্ড অবস্ট্রাকশন অ্যান্ড টু রট।’ গন্তব্য কোথায় কেউ
তা বলে না, অজানা এ গন্তব্য - এটুকুতেই
থেমে যেতে হয়। আমি এখানেই থেকে যেতে চাই। মাকে হারিয়েছি আগেই। পিতৃপরিচয় খুঁজতে এখানে আসা। আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, বিদায় জানিও আকিওকে।”
আলোর উৎস ধীরে ধীরে ম্লান
হয়ে আসছে। প্যানেলরুমে
ওর শরীরটা অপেক্ষায়। ইভান্স ভাবে দূরে কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়েছে তার পৃথিবীতে। হয়তো মেঘের কৌটো খুলে কালো মেঘ উড়িয়ে
দিয়েছে আকাশে... ধীরে অন্ধকার গ্রাস করছে ওকে, তারপর বৃষ্টির শেষে ওর
পৃথিবী ইডেনের বুকে মেঘ কেটে আলো ছড়িয়ে পড়ছে নিরন্তর।
----------
শীর্ষচিত্র - আন্তর্জাল, গল্পের মধ্যের ছবি - শুভশ্রী দাস
No comments:
Post a Comment