সম্রাটের গ্রীষ্মাবাস
অমিয় আদক
প্যারিস মহানগরের কুর্বেভোয়া। মূলত
বাণিজ্যিক এলাকা। কুর্বেভোয়ার পার্ক দ্যু মিলেনিয়ার বসতি এলাকা। এখানে অনেক ছোটো
বড়ো মাঝারি পার্ক। বসতি
এলাকায় বহুতলগুলির লাগোয়া রাস্তাগুলিও বেশ শোভন। সেই
সব রাস্তার পাশে, বাঁকে বাঁকে পার্কের শোভা। পার্কগুলির
অর্ধেকের বেশি শিশু এবং মায়েদের জন্য সংরক্ষিত। বহু
সংখ্যক পার্কের শোভায় ভূষিত এলাকার নাম পার্ক দ্যু মিলেনিয়ার। সেখানেই
দশতলা অট্টালিকার সাততলায় পুত্রের আস্তানা।
পার্ক দ্যু মিলেনিয়ার থেকে বেরিয়ে
পড়ি আমরা চারজন। শীত-পোশাকের মোড়কে শরীর। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা
না হলেও, বেশ ঠান্ডা বলাটাই সঙ্গত। পিঠের
ব্যাগে লাঞ্চপ্যাক, ক্যামেরা, ডায়েরি। হেঁটে
পৌঁছাই লাদেফঁন্স স্টেশন। সময় সকাল সাড়ে সাতটা। সেখান থেকে ট্রেনে কয়েক মিনিটেই হাজির
গার্দেনিয়ার ষ্টেশন।
গার্দেনিয়ার থেকে আমাদের
ট্রেন ছোটে মেলোঁ-র (Melun) পথে। প্যারিস
মহানগরের উচ্চ অট্টালিকার বাহার পেরোই। সিন নদীর সেতু পেরিয়ে ট্রেন এগিয়ে
চলে। প্যারিস
মহানগরের সীমানা পেরোই। ট্রেনের অভিমুখ দক্ষিণ-পূর্বে।
উৎসুক চোখদুটো ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত। গ্রামীণ
ফ্রান্সের চেহারা তেমন নজরে আসে না। রেল লাইনের দু’পাশে বিশ্বকর্মার
সাম্রাজ্য। ছোটো, বড়ো, মাঝারি শিল্প-কারখানা। মাঝে মাঝে
কিছু ফসলের খেত।
অনেক খেতেই অর্ধশুষ্ক ভুট্টাগাছ। গ্রামীণ
ফ্রান্সের চাষের খেতগুলো প্রায় এক কিমি লম্বা। চওড়াতেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাত-আটশো মিটার। তারা পাকা ফসলের
তৃপ্তি মাথায় নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কিছু খেত কাটা ফসলের স্মৃতি বুকে নিয়ে
বিমর্ষ। বেশ কিছু খেতে পরবর্তী ফসলের প্রস্তুতি প্রায় সারা। সেইসব
জমিতে ট্রাকটরের সমান্তরাল কর্ষণরেখা দেখে অবাক। সমান্তরাল
কর্ষণ রেখারা যেন অনেক দূরে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়। সেই সব খেতের মাঝেই স্থায়ী গাছপালায় শোভিত ফার্ম-হাউস।
মাঝে মাঝে ছিটেফোঁটা গ্রামীণ
ফ্রান্সের চেহারা।
বিচ্ছিন্ন বনভূমি রেল লাইনের দু’পাশেই। তারা যেন নিপুণ
শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি। তারা অনবরত পিছনে
সরে যায়। শরতের
আকাশে ছেঁড়া সাদা মেঘেদের অলস আনাগোনা। এইসব দেখতে দেখতে
আমাদের বাহন ট্রেন হাজির মেলোঁ স্টেশনে। ট্রেন থেকে নামি।
বেশ ছিমছাম স্টেশন। প্ল্যাটফর্মে
যাত্রীর ভিড় অনুপস্থিত। স্টেশন এবং প্ল্যাটফর্মের অঙ্গসজ্জা বেশ দৃষ্টিনন্দন। স্টেশন
সংলগ্ন বাহারি ফুলের বাগিচা সত্যই দৃষ্টিনন্দন। স্টেশনের
বাইরে বের হওয়ার রাস্তাও ফুলের বাহারে সেজে আছে। আধা
শহরের স্টেশন।
সারা স্টেশন জুড়ে মনকাড়া পরিচ্ছন্নতা। সেখানে পরিচ্ছন্নতা
শুচিতা রক্ষার বিজ্ঞাপন অনুপস্থিত। শুচিতার বিজ্ঞাপন
না থেকেও, শুচিতা লেপটে তার সারা অঙ্গে। মেলোঁ শহরটিও তার স্টেশনের
মতোই সুন্দরী।
সে নিঃশব্দে সাদর আহ্বান জানায় আমাদের।
স্টেশনের গেট পেরিয়ে বাইরে যাই। দু’শো
মিটার দূরেই বাসস্ট্যান্ড। স্টেশনের বাইরে পথ নির্দেশ তেমনটাই। হেঁটেই
হাজির বাসস্ট্যান্ডে। মোহিনী গড়নের একটি বাস থামে। বাস
থামে মৃদু-মিষ্টি ব্রেক চাপার আওয়াজ দিয়ে। আমরা এবং আমাদের মতো আরও কয়েকজন যাত্রী
বাসের উদরে প্রবেশ করেন।
কী সুন্দর বাসের অভ্যন্তর! এমন
পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্য বাস অবশ্য প্যারিসেও। বসার সিটটা পাই জানালার পাশেই। তাই
মনের ভিতর খুশির জলতরঙ্গ। শ’তিনেক মিটার গিয়েই সামনে ত্রিপথের সঙ্গম। ত্রিসঙ্গমের
বামদিকের বাঁকে আমাদের বাহন অভিমুখ বদলায়। আমাদের বাহন মেলোঁ শহরের মায়া কাটাতে
আগায় সেই বাঁকেই।
ফন্টেনব্লুর দিকে প্রধান সড়কে দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে বাসটি। আমাদের
দেশের দ্রুতগামী বাসের চেয়েও অনেক বেশি দ্রুততায়।
বাহন মেলোঁ নগর সীমানা ছাড়ায়। প্রবেশ করে
প্রকৃতির অরণ্য রাজত্বে। দু’পাশে কেবল মধ্যম ঘনত্বের অরণ্যভূমি। প্রবীণ মহীরূহদের
ছায়ার আলপনায় প্রায় ঢাকা বিস্তৃত রাজপথ। পাতা ঝরার শঙ্কায় বেশিরভাগ পর্নমোচিদের
শরীরে হলুদ বিষণ্ণতা। পথে পিষ্ট অঢেল ঝরে পড়া পাতা। তাদের
হালকা বাদামি অবশেষ সামান্য ওড়ে শরৎ বাতাসে।
ফ্রান্সের শরৎ পাতা ঝরানোর
ঋতু। তার মাঝেও হরিৎ সমারোহের অভাব নেই। পথের দু’পাশেই মাঝারি ঘনত্বের
অরণ্যের বিস্তার।
প্রবীণ পাদপেরা শরৎ বাতাসের ঝিরিঝিরি শব্দ শোনায়। দাঁড়িয়ে
তারা যেন ফিসফিস করে কাছে দূরে। প্রশস্ত রাজপথের উপর ছড়িয়ে অঢেল মনমরা হলুদ, ঈষৎ বাদামি রঙের পাতা।
আমরা হাজির ‘ফনটেনব্লু’-তে (Fontainebleau)। বাসের উদর
মুক্ত।
অদূরেই নজরে আসে অতীতের গ্রীষ্মাবাস-প্রাসাদ। সেই
বিশাল প্রাসাদ এবং সংলগ্ন বাগিচা সমূহ, মিউজিয়াম ইত্যাদি
মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য পর্যটনক্ষেত্র। ফরাসী সরকার
এই পর্যটন দপ্তরের দায়িত্বে। ফন্টেনব্লু তার নিকটবর্তী বনভূমির সৌন্দর্যের
জন্যও বিখ্যাত। একসময় এই বনভূমিকে রাজপুরুষগণ প্রমোদ শিকারের প্রয়োজনে ব্যবহার
করতেন। বর্তমান বনভূমি প্রায় আগের পরিসরেই বর্তমান। ঘাটতির
পরিমাণ উল্লেখযোগ্য নয়। বনভূমির বুক চিরেই প্রায় সোজা প্রশস্ত রাজপথ।
ইংলিশ গার্ডেন
বেলি অ ফাউনটেন (ইংলিশ গার্ডেন)
আমরা এগিয়ে চলি পায়ে পায়ে রাজপ্রাসাদের
দিকে। রাজপ্রাসাদের আগেই দি ইংলিশ গার্ডেন। মনোরম, অতি পরিছন্ন, সুবিন্যস্ত উদ্যান।
শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা ছবির মতোই অনুপম সুষমা। সবুজ ঘাসের মখমলের উপরেই
হাঁটাপথ। গাছের
শাখা প্রশাখায় অজ্ঞাতনামা পাখিদের মিষ্টি ডাক। সামান্য
শব্দিত পরিবেশ। চলমান তাদের চঞ্চল ডানার ওড়াউড়ি। এইসব দেখতে দেখতেই হাঁটা বা হাঁটতে
হাঁটতেই দেখা সবুজের সমারোহ। পরেই পাই পাথর বাঁধানো পথ। তার দু’পাশে
যত্নে লালিত সবুজ ঘাসের মখমল।
দি ইংলিশ গার্ডেন মূলত পাইন,
ফার, উইলো, উইপিং উইলো ইত্যাদি গাছের সুরম্য উদ্যান। তার কেন্দ্রীয় অংশে বেলি-অ (Belle-Eau) ফাউনটেন। বেলি-অ ফাউনটেনের সামনে কয়েকটা ছবি ওঠে। দি ইংলিশ
গার্ডেনের পাথর বাঁধানো পথ। হাঁটতে হাঁটতে দেখি প্রকৃতির অসীম রূপবৈভবকে।
গাইড জানালেন, দি
ইংলিশ গার্ডেনের পূর্বনাম পাইন গার্ডেন। তখন সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিসের আমল। পাইন
গার্ডেনের মতন আরও অনেকগুলি ছোটো ছোটো বাগিচাকে একত্রিত করেন সম্রাট চতুর্দশ লুই।
একত্রিত বাগিচার নামকরণ করেন দি ইংলিশ গার্ডেন। অনেক বিশেষ প্রজাতির গাছে বাগিচাটি
সজ্জিত করার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে এই বাগিচা আরও সমৃদ্ধির
সুবাস পায়। তখন
সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নের রাজত্বকাল। তাঁরই উদ্যোগে বাগিচা স্থপতি হার্টঅল্ট
বাগানটির সৌন্দর্য্যায়ন ঘটান। নেপোলিয়ানের পছন্দের অনেক গাছ বাগিচায় জায়গা দখল করে।
সেই বাগানে গাছের ছায়ামাখা
পাথর বাঁধানো পথ। সেই
পথেই হেঁটে এগিয়ে যাই। বেশ খানিক সময় কাটে। প্রকৃতির অনুপম বাহার দেখায় পরিতৃপ্ত
দুই চোখ। বাগিচার
সব গাছে চিকন সবুজের সমারোহ অনুপস্থিত। আগত শরতে অনেক গাছের পাতায় শঙ্কার
হলুদ বিষণ্ণতা। পেয়েছে পাতা ঝরানোর খবর। তাতেও সেই বাগিচার প্রাকৃতিক রূপভাণ্ডারে
তেমন ঘাটতি নেই।
সবুজ, হলুদ, হালকা বাদামি রং-এর অঢেল
আয়োজন সারা বাগিচায়।
দি ক্যুইনস ফাউনটেন (গ্র্যান্ড পার্টেরি)
রাজপ্রাসাদের
পিছনের দৃশ্য
কার্প পন্ড
হেঁটে চলি পূর্ব মুখে।
রাজবাড়ির পিছনের পথে। দক্ষিণ অভিমুখী রাস্তায় গিয়ে পাই একটা সংযোগকারী সেতু। সেই
সেতু প্রাসাদের দুটি অংশের সংযোজক। সেতুর অর্ধবৃত্তাকার আর্চের নিচে
দাঁড়িয়ে নাতনি রাই আবিষ্কার করে প্রতিধ্বনির আনন্দ। আমরাও অনুভব করি একটানা ত্রিশ
সেকেন্ড ‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো’ শব্দের ক্রমশ মিলিয়ে
যাওয়া মিষ্টি অনুরণন।
আমরা হাজির রাজকীয় পুষ্প
বাগিচায়। সেটির পরিমাপ আশি একরের বেশি। বাগিচার বিশালত্বের জন্যই নাম দি গ্র্যান্ড
পার্টেরি। সম্পূর্ণ ফরাসি বাগিচা-বিন্যাসেই
রূপায়িত।
বাগিচার অন্দরে জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলির বিন্যাসে তাই প্রমাণিত। সম্রাট ষোড়শ
লুইয়ের বাগিচা বিশারদ লে নোট্রে এই বাগিচার স্থপতি এবং রূপকার। বাইরের বোর্ডে সেটাই বিজ্ঞাপিত।
বাগিচার পূর্বদিকে একটি
চতুর্ভুজাকৃতি জলাশয়। সেই জলাশয়ের কেন্দ্রে অবস্থিত দি কুইন’স ফাউনটেন। নিরন্তর
ঢেলেই চলে জলের ধারা। এই বাগিচার পরে একটি সংকীর্ণ খালপথ। সেটি সম্রাট চতুর্থ
হেনরির আমলে নির্মিত। এই বাগিচার উত্তর এবং পশ্চিম দিকের পথগুলি তুলনায় উঁচু এবং
বিস্তৃত। পথের
দু’পাশে সারিবদ্ধ চিনার জাতীয় বাহারি পাতার গাছ।
সেইসব পাদপছায়ার নিচেই দর্শনার্থীদের বসার কংক্রিটের বেঞ্চ। বেঞ্চগুলির
দূরত্ব আনুমানিক পাঁচ মিটার।
তেমনই এক বেঞ্চে বসি। রূপসী
বাগানের রূপকে আমার পিপাসিত দু’চোখ পান করতে থাকে। ক্যামেরাবন্দি
করি বাগিচার কিছু অংশের সৌন্দর্যকে। লোভ সামলাতে পারি না। হেঁটে এগিয়ে
যাই গ্র্যান্ড পার্টেরির কিনারায়। বিনা অনুমতিতেই প্রবিষ্ট বাগিচার
অন্দরে। ফুল এবং ফুল গাছের সৌন্দর্য, বাগিচা খণ্ডের জ্যামিতিক বিন্যাস বৈভব
চাক্ষুষ করে সত্যিই বিস্মিত।
এই বাগিচার পশ্চিমে বিশাল কার্প-পন্ড।
কার্প-পন্ডের পাড়ে গাছের ছায়ায় বসি। তার
স্বচ্ছ গভীর নীলাভ জলে বড়ো চেহারার মাছেদের আনন্দ সন্তরণ। রাজপরিবার
এই পুকুরের মাছ খেতেন কিনা, তা জানার
সুযোগ নেই। অনেকেই
মাছেদের, হাঁস, রাজহাঁসদের খাবার দিতে ব্যস্ত। তাঁদের
দেখাদেখি নাতনি রাই যায় কিছু খাবার নিয়ে। রাজহাঁসদের ডেকে ডেকে আদর করে খাবার দেয়। সেই ঘটনার
ছবিও ওঠে।
এই দৃশ্য বড়োদের কাছেও সমান
উপভোগ্য। সেজন্যই পুকুরের জলের সীমানার কাছাকাছি ছোটোদের সঙ্গেই ঘুরতে থাকি। রাই-এর খাবার খাওয়ানো শেষ হতেই চায় না। হাঁসেদের
খাবার দেওয়ার আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে একান্তই অরাজি। প্রায়
জোর করেই তাকে কার্প-পন্ডের পাড় থেকে ফিরিয়ে আনি।
এবার উদর পূরণের পালা। মাথার
উপর দি ইংলিশ গার্ডেনের পাদপ ছায়া। পায়ের নিচে পুরু কার্পেট সবুজ ঘাস। মৃদু তাপের
রোদ সেথায় পৌঁছায় না। শুকায়নি শিশিরের আর্দ্রতা। সেই সবুজ মখমলে সামান্য ভিজে
ভাব। তার উপরেই পা ছড়িয়ে বসি। কোলের উপর টিসু পেপার। তার উপরে
পেপার প্লেট। পরোটা, আলুভাজি,
ডিমের মশলা কারি পরিবেশিত। লম্বা
হাঁটাহাঁটির জমাটি খিদে। তাড়াতাড়িই খাদ্য বস্তুসমূহ উদরে প্রবিষ্ট। সেখানেই
মিনিট দশেকের বিশ্রাম। তারপরেই প্রবেশের পালা রাজবাড়ির অভ্যন্তরে, একাধিক মিউজিয়ামে। ফরাসি
ইতিহাসের ডেরায়।
‘ফন্টেনব্লু’-এর সংক্ষিপ্ত অতীত জানাই পাঠকদের জন্য। এই সংক্ষিপ্ত
অতীত আহরণ করি মিউজিয়ামে প্রদত্ত বুকলেট থেকে। এই
গ্রীষ্মাবাস তৈরি সম্রাট সপ্তম লুইয়ের আমলে। সময়কাল দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগ। সম্রাট
প্রথম ফ্রন্সিস পনেরোশো আটাশ খ্রিস্টাব্দে এই প্রাসাদের সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন।
তিনি ইতালীয় স্থাপত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গোল্ডেন গেট তৈরি করান। সেটির
অবস্থান ডিম্বাকার চত্বরের প্রবেশপথে। ডিম্বাকার চত্বরের চারদিকেই সম্রাট এবং
রাজপরিবারের পরিজনদের নিমিত্ত সমস্ত কক্ষগুলি নির্মিত। বলরুম
অংশটি সম্পূর্ণ সম্রাট দ্বিতীয় হেনরির আমলে।
বেলি চেমিনি কক্ষসারি এবং তার
সংলগ্ন রাজকীয় ইতালিয়ান সিঁড়ি সত্যই দর্শনীয়। এই প্রাসাদের কিছু অংশের গঠনশৈলীতে
ফরাসি স্থাপত্যে ইতালিয়ান রেনেসাঁর প্রভাব পরিষ্কার। সপ্তদশ শতকে সম্রাট চতুর্থ
হেনরির প্রচেষ্টায় এই প্রাসাদের বিশালত্ব বৃদ্ধি পায়। তাঁর আমলে
প্রাসাদে গির্জাও স্থাপিত। সেই গির্জায় ত্রয়োদশ লুইয়ের ব্যাপটিজম ঘটে। চতুর্থ হেনরির
আমলেই স্থাপিত ডায়ানা গ্যালারি, স্ট্যাগ গ্যালারি, অ্যাভিয়ারি
এবং জিউ দ্য পুমে কোর্ট।
রট আয়রন গেট
অষ্টাদশ শতকে সম্রাট পঞ্চদশ
লুইয়ের আমলে আগের ইউলিসিস গ্যালারির সংস্কার ঘটে। স্থপতি
গ্র্যাব্রিয়েলের সহায়তায় নির্মিত হয় বিরাট প্যাভেলিয়ান। ফরাসি
বিপ্লবের পর এই প্রাসাদ সাময়িক পরিত্যক্ত। সম্রাট নেপোলিয়ান এই গ্রীষ্মাবাসকে
রাজকীয় আবাসে পরিণত করেন। তাঁর আমলেই রট আয়রন গেট তৈরি। সম্রাট
তৃতীয় নেপোলিয়ানের আমলে এই বিশাল প্রাসাদের আভ্যন্তরীণ বিন্যাসে লাগে ব্যাপক
শিল্পের ছোঁয়া।
মিউজিয়াম বিষয়ে খোঁজ নিই
ইনফরমেশন অফিসে। একটা খুশির বিষয় জানতে পারি, মিউজিয়ামের
কোনো প্রবেশমূল্য লাগে না। ক্যামেরা নিয়ে মিউজিয়ামে প্রবেশে বাধা নেই। সঙ্গে ব্যাগ
থাকা নিষেধ। সেগুলি রাখার ব্যবস্থা বিনা ভাড়ার ভল্ট পাওয়া যায়। চাবি নিজেদের
কাছেই রাখা যায়। কেবল বিশেষ সিকিউরিটি চেকিং করেই রাজপ্রাসাদের মিউজিয়ামে প্রবেশের
অনুমতি মেলে।
আমি এবং আমার স্ত্রী বিদেশি পর্যটক হিসাবে পাসপোর্টের প্রতিলিপি জমা দিয়ে সিকিউরিটি চেকিং-এর সুযোগ পাই।
সিকিউরিটি চেকিং সমাপ্ত। হাতে
মিউজিয়ামের প্রতিটি প্রধান অংশের নন স্কেলড্ ম্যাপসমেত বুকলেট। তাতেই সূচিত
ফন্টেনব্লুর সংক্ষিপ্ত অতীত, প্রধান
দর্শনীয় বস্তুর ধরন এবং মিউজিয়ামগুলির অবস্থান। প্রদর্শনীর
প্রথম অংশ নেপোলিয়ন মিউজিয়াম। দ্বিতীয় অংশ দি পোপ’স অ্যাপার্টমেন্ট। তৃতীয় অংশ দি
গ্রেট অ্যাপার্টমেন্ট। চতুর্থ দ্রষ্টব্য চাইনিজ মিউজিয়াম। প্রথম তিনটি দ্রষ্টব্য রাজপ্রাসাদের
দ্বিতলে। শেষ
দ্রষ্টব্যের অবস্থান নিচের তলায়।
দি পোপ্ স অ্যাপার্টমেন্টের করিডর

কোর্ট এবং মন্ত্রণালয়
সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাই। প্রথমেই
প্রবিষ্ট নেপোলিয়ান মিউজিয়ামে। সে এক বিশাল পোর্টেডের রাজত্ব। গ্যালারিতে সাজানো
প্রথম নেপোলিয়ান বা নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের, তাঁর উত্তরসূরিদের পরিবার ও পরিজনদের ছবি। ছবিগুলি অবশ্যই
ফ্রান্সের মহান শিল্পীদের অমূল্য সৃজন। সেই শিল্পসম্ভারের সামনে দাঁড়িয়ে অজ্ঞাত
মহান শিল্পীদের প্রতি অন্তর শ্রদ্ধানত হতে বাধ্য। বিস্ময়াভিভূত অবস্থায় ধীর পায়ে এগিয়ে
চলি। গ্যালারির
শেষে রাজপরিবারের ব্যবহৃত আসবাবপত্রের বিন্যাসেও পাই অপার মুগ্ধতা। বিস্ময় যেন
সীমাহীন।
গ্যালারির দ্বিতীয় অংশ দি
পোপ’স অ্যাপার্টমেন্ট। এখানের একটি কক্ষে আঠারোশো চার খ্রিষ্টাব্দে পোপ সপ্তম
পায়াস থাকেন ক’দিন। সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের
রাজ্যাভিষেকের জন্য প্যারিস যাওয়ার পথে তৎকালীন এই গ্রীষ্মাবাসে ক’দিনের অতিথি। সেই থেকেই রাজপ্রাসাদের এই অংশের নাম
দি পোপ’স অ্যাপার্টমেন্ট।
প্রকৃতপক্ষে এই অংশের
কক্ষগুলি রানি মায়েদের জন্য। সেই কক্ষগুলির শিল্পমাধুর্য অনুপম।
প্রতিটি কক্ষের সিলিং এবং দেয়ালের সঙ্গে মেঝে, আসবাবপত্রের বিন্যাস প্রতিটি
দর্শককে অবাক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। নিজের চোখে দেখাকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ফরাসি শিল্পকলা তার আপন সুষমার কারণেই বিশ্ববরেণ্য।
সর্বশেষ অংশ দি গ্রেট
অ্যাপার্টমেন্ট। এই অংশে রাজাদের কক্ষগুলিকে আগের মতোই সাজানো। চোখে দেখা সৌন্দর্য্য
ভাষায় প্রকাশ করা একান্তই অসম্ভব। প্রতিটি কক্ষের সিলিং আর্ট অনবদ্য। দেয়ালের উপর
কাপড়ে আঁকা চিত্রগুলি আজও অমলিন। কিছু ক্ষেত্রে ফ্রেসকো বা দেয়াল চিত্রও বর্তমান।
সেই সব পুরানো চিত্রকলায় ফরাসি শিল্পীদের শিল্প নৈপুণ্যই প্রকাশিত। সেগুলির
সৌন্দর্য্যসুষমা ভাষায় প্রকাশ করার যোগ্যতা আমার নেই।
রাজা এবং রাজপরিবারের
পরিজনদের ব্যক্তিগত কক্ষ, বিশ্রামকক্ষ, শয়নকক্ষ, অতিথিদের
সাক্ষাতের কক্ষ, রাজার মন্ত্রণাকক্ষ, আরও বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনের কক্ষগুলি অবাক চোখে দেখতে
দেখতে এগিয়ে চলি।
রাজকীয় নাট্যশালা বা থিয়েটার এই গ্যালারির মধ্যেই। দি গ্রেট অ্যাপার্টমেন্টের
মধ্যেই জিউ দ্য পুমে কোর্ট বা রাজকীয় বিচারালয়।
গ্যালারির শেষ অংশে একটা
বিশেষ গ্যালারি। সেটির নাম গ্যালারি অফ ডায়ানা। এই গ্যালারির সামনেই একটি বিশাল
গ্লোব। গ্লোবটি স্থাপিত আঠারোশো একষট্টি খ্রিষ্টাব্দে। গ্যালারিটি আশি মিটার লম্বা।
গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চতুর্থ হেনরি। সময়কাল সপ্তদশ শতকের প্রথম দশক। রানির
অন্য মহিলাদের সঙ্গে প্রমোদনৃত্য এবং ব্যায়াম ইত্যাদির জন্য এই গ্যালারি নির্মিত এবং
ব্যবহৃত। এই
অংশে মৃদু শব্দাবেশ। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে নৃত্যের তালবাদ্য। গ্যালারি
যন্ত্রসঙ্গীতের মৃদু মূর্ছনায় পরিপূর্ণ। কেবল নৃত্যরতা সুন্দরীরাই অনুপস্থিত।
এখানে অর্ধবৃত্তাকার সিলিংয়ে
চিত্রগুলির সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। বেশিরভাগ চিত্রই
যুদ্ধের দেবী ডায়ানার মিথকে অবলম্বনে অঙ্কিত। পরবর্তীকালে সেই সিলিং চিত্রাবলীর
দু’পাশে ফরাসি রাজবংশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন বয়সের ছবি কালানুক্রমে
সজ্জিত। সেগুলির
মধ্যে সম্রাট নেপোলিয়ান বা প্রথম নেপোলিয়ানের ছবির সংখ্যাই সর্বাধিক। সম্রাট ষোড়শ
লুই এই গ্যালারিতে কিছু নিওক্ল্যাসিক চিত্রও যুক্ত করার ব্যবস্থা করেন।
অতীতে গ্যালারিটি রানি,
রাজকন্যা, তাঁদের সহচরিদের নৃত্যচর্চা এবং নৃত্যানুষ্ঠানের বাদ্যানুষঙ্গে আচ্ছন্ন
থাকত। এখন
কেবল সাক্ষী মাত্র। বর্তমানে গালারিটি একটি মূল্যবান পুস্তকের সংগ্রহালয়। এই
গ্যালারির দুই পাশের আলমারিতে বহু মূল্যবান পুস্তক সংরক্ষিত। সব কিছু দেখে
একটা কথাই বার বার মনে ভাসে। ‘আহা কী দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও
ভুলিব না’।
বিস্ময়ের ঘোর নিয়েই নির্গত দি
গ্রেট অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। আসি নিচের তলায়। নিচের তলায় মিউজিয়ামের অফিস এবং দ্রষ্টব্য
সংরক্ষণের জন্য আধুনিক পরীক্ষাগার ও গবেষণাগার। এখানেই মিউজিয়ামের সর্বশেষ অংশ
চাইনিজ মিউজিয়াম। প্রবেশ করি চাইনিজ মিউজিয়ামে। এই মিউজিয়ামের দ্রষ্টব্য বিভিন্ন সময়ের
রানিদের এশিয়ান আর্টের সংগ্রহ। সঙ্গে আছে সিয়ামের রাজার উপহার। এইসব উপহার সিয়ামের
রাজা মহামান্য ফরাসি সম্রাটকে পাঠান আঠারোশো একষট্টি খ্রিষ্টাব্দে। আঠারোশো ষাট
খ্রিষ্টাব্দে ফ্রেঞ্চ-ব্রিটিশ যৌথ বাহিনীর লুটের মালগুলিও এখানের দ্রষ্টব্য। বেজিং-এর ওল্ড সামার প্যালেস লুট করে পাওয়া শিল্পসামগ্রীও এই
চাইনিজ মিউজিয়ামের প্রদর্শ তালিকায়। চাইনিজ মিউজিয়াম বেশ দক্ষতার সঙ্গে
বিন্যস্ত।
চাইনিজ মিউজিয়ামে রানিদের
ব্যবহৃত পাঁচটি ওক কাঠের নকশাদার রত্নখচিত পালকি সযত্নে রক্ষিত। বিভিন্ন
সময়ের রানিদের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনে এগুলি ব্যবহৃত। চিনের
সিয়ামির রাজমুকুট এবং সপ্তদশ শতকের নকশাদার চীনা পর্দাও সংরক্ষিত যত্নের সঙ্গে। সেইসব
সংগ্রহগুলি অবাক চোখে দেখি। বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায় না।
সবশেষে যাই সম্রাজ্ঞী
জোসেফিনের ব্যক্তিগত কক্ষে। কক্ষটির মধ্যে প্রাচীন এবং আধুনিক অলঙ্কার ও অন্যান্য
আসবাবপত্রের সমাহার ভীষণ নজরকাড়া। এই কক্ষটি পূর্বে সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের পত্নী মারি
আঁতোয়ানেতের ব্যক্তিগত কক্ষ। ফরাসী বিপ্লবের পর এটি সম্রাজ্ঞী
জোসেফিনের ব্যক্তিগত কক্ষ হিসাবে পুনর্বিন্যস্ত। আজও
সম্রাজ্ঞী জোসেফিনের কক্ষ দর্শকদের আলাদাভাবেই আকর্ষণ করে। কক্ষের আসবাবপত্রের
বিন্যাস, দেয়ালচিত্র, আসবাবের নকশা, পালিস, সিলিং আর্ট ইত্যাদি অনবদ্য। বিস্ময়ে
আবিষ্টই থাকি।
বেরিয়ে আসি সেই কক্ষ থেকে। বেরিয়ে আসি সম্রাটদের গ্রীষ্মাবাসের বাইরে।
এবার ঘোড়ার গাড়ি চড়ার পালা। ঘোড়ার
গাড়িতে চড়ে গ্র্যান্ড পার্টেরির চৌহদ্দি ঘুরতে যাই। আয়তাকার
গ্র্যান্ড পার্টেরির চারদিকেই চওড়া পাথর বাঁধানো রাস্তা। সেই রাস্তায় যেতে যেতেই
গ্র্যান্ড পার্টেরির বিভিন্ন অংশের সৌন্দর্য আবার নতুন করে উপভোগ করি। ফাউ পাই
রাস্তায় ছোটো ছোটো বাচ্ছাদের খুশির ছুটোছুটি। গ্র্যান্ড পার্টেরির পশ্চিমে খাল।
খালের অপর পারে বেশ কয়েকটা আঙুরের খেত। আঙুর তোলায় ব্যস্ত কিষাণ কিষাণি ছুটন্ত
ঘোড়ার গাড়ির দিকে তাকান মাঝে মাঝে।
গ্র্যান্ড পার্টেরির দক্ষিণেও
অনেক আঙুরের খেত রাস্তার পাশেই। ঘোড়ার গাড়ি থামানোর ইঙ্গিত করেন দৌড়ে আসা আঙুর
চাষি। তিনি তাঁর খেতের প্রথম তোলা আঙুর আমাদের খাওয়াতে ইচ্ছুক। আমাদের সকলকে
এক থোকা করে আঙুর উপহায় দেন। আমরাও ধন্যবাদ জানাই। তিনিও
আমাদের প্রথম ফসল উপহার দিয়ে আপ্লুত। খুশিতে তাঁর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল। গাড়ি
ছাড়ে, তিনি সবাইকে বিদায় জানান নিজস্ব ভঙ্গিমায়।
ঘোড়ার গাড়ি চড়ার সঙ্গে আঙুর
পেয়ে সবাই খুশি। বেজায় মিষ্টি আঙুর একটা একটা করে মুখের মধ্যে পড়তে থাকে। ঘোড়ার গাড়ি
থেকে নামার পরেও শেষ হয় না। হেঁটে এগিয়ে
চলি ফন্টেনব্লু সিটি সেন্টারের দিকে, অ্যাভন
সমাধিক্ষেত্র দেখার তাগিদে।
অ্যাভন সমাধিক্ষেত্রে যাই দশ
মিনিটের জন্য। রাশিয়ার দার্শনিক আইভোনিচ গার্দিজেফ এবং নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত
লেখিকা ক্যাথেলিন ম্যান্সফিল্ড মুরির সমাধি বুকে নিয়ে আছে এই শহরের প্রখ্যাত অ্যাভন
সমাধিক্ষেত্র। খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসি, তাঁদের মনে
মনে শ্রদ্ধা জানিয়ে। বাস এবং পরবর্তী ট্রেন ধরার তাড়া। বাস
স্ট্যান্ডে যাই।
মেলোঁ যাবার বাসে চড়ি। মেলোঁতে এসেই ট্রেন পাই কয়েক মিনিটের
মধ্যে। প্যারিসে
ফিরি, পার্ক-দ্যু মিলেনিয়ারে পুত্রের আবাসে। তখন রাত্রি সাড়ে ন’টা। কান্তিতে অগাধ ক্লান্তি, কিন্তু
অন্তর পূর্ণ অনাবিল আনন্দে, সুখকর অভিজ্ঞতায়।
----------
ছবি - লেখক
No comments:
Post a Comment