![]() |
পুরীর জগন্নাথ মন্দির, ১৮৯০ |
বাঙালির প্রিয় নীল দেশে
রাজর্ষি গুপ্ত
যারা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে তাদের কাছে ভ্রমণ নিয়ে লেখা
যেমন খুব আনন্দের ব্যাপার,
তেমনই আবার বিড়ম্বনার কথাও বটে। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কত রকম দেশ দেখা
হয়ে যায়, কত ধরনের পুরোনো গল্প জানা হয় আর কত যে নতুন গল্প তৈরি হতে থাকে! সে সব গল্প বলতে পারা তো ভীষণই আনন্দের ব্যাপার, কিন্তু
কোনটা ছেড়ে কোনটা আগে বলবে সেটাই যে ঘুরে বেড়ায় তার কাছে বিড়ম্বনার ব্যাপার। তবে ‘ম্যাজিক ল্যাম্প’-এর সম্পাদক দিদি একটা উপকার করেছেন আমার। আমাকে পুরী ভ্রমণ নিয়ে লিখতে অনুরোধ
করে আমার কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছেন। ছোটোবেলা থেকে ওই একটি জায়গায় এতবার
গিয়েছি যে আমার পুরী ভ্রমণের ঝুলি থেকে অভিজ্ঞতাগুলো মাছের বাজারের মতো চেঁচামেচি করতে
থাকে ‘আমায় দ্যাখো, আমায় নাও’ বলে। কিন্তু পুরী বেড়াতে যাওয়া ব্যাপারটাই
আমার কাছে সব মিলিয়ে এমন জমজমাট একটা ব্যাপার যে সেটার যে ‘এবার-ওবার-সেবার’ হতে পারে এটা আমার
মাথাতেই আসে না। আমি সব মিলিয়ে পুরীকে যেমন দেখেছি-বুঝেছি তাই বরং খানিক-খানিক বলি।
বাঙালির সব চেয়ে প্রিয় তিনটি ঘোরার জায়গা হল দীঘা, পুরী আর দার্জিলিং। কাজেই পুরীকে একরকম বাঙালির ‘সেকেন্ড হোম’
বলা চলে। এখানে রাস্তাঘাটে ঘুরতে ঘুরতে তোমরা
এত বাংলা কথা শুনতে পাবে যে মনেই হবে না নিজের দেশ ছেড়ে এসেছ। এখানকার স্থানীয় লোকেরাও বেশ ভালো
বাংলা বোঝেন ও বলতে পারেন। আমার কাছে পুরীর এই বাংলা আর ওড়িয়ার
মিশ্র ভাষা আর সংস্কৃতি খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। ওড়িয়া-বাঙালির এই মেলবন্ধন
ওড়িশার অন্য সব জায়গাতেও দেখা যায় না। এই মেলবন্ধন কিন্তু খুব প্রাচীন কাল
থেকেই চলে আসছে। অবশ্য
পুরীর যিনি অধিষ্ঠাতা দেবতা, সেই জগন্নাথই ওড়িশা আর বাংলাকে এক সুতোয় বেঁধেছেন সেই শ্রীচৈতন্যদেবের
সময় থেকে। শ্রীচৈতন্যদেব
যে কৃষ্ণভক্তির ভাগীরথীকে নামিয়ে এনেছিলেন নবদ্বীপে তার মোহনাও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের
পাশের সমুদ্র; সেই ভক্তিরসের স্রোতে ‘উড়িয়া-গৌড়িয়া’
নির্বিশেষে ভেসে গিয়েছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবেই পুরীর শাসক
খুর্দারাজ প্রতাপরুদ্রদেব বৈষ্ণবধর্মে মন দেন। তবে পুরী বাঙালির সম্মান করে আসছে
আরও আগে থেকে। প্রতাপরুদ্রদেবের
সভার বিখ্যাত পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম ছিলেন বাঙালি। পুরীতে অবস্থানের প্রথম দিকে তাঁর
বাড়িতেই শ্রীচৈতন্যদেব অবস্থান করতেন। বাঙালির সাহিত্যেও কতবার কতভাবে পুরীর
কথা উঠে এসেছে! উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুরী ভ্রমণের কথা লিখেছেন কিশোরদের উপযোগী করে। তাঁর পৌত্র সত্যজিৎ রায়ও তাঁর সৃষ্ট
গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদাকে সারা ভারতবর্ষ ঘোরাতে ঘোরাতে ‘হত্যাপুরী’
উপন্যাসে এনে ফেলেছেন পুরীতে। পুরীর অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব ভালো কিছু
গল্প (তার অনেকগুলিই অতীন্দ্রিয় রসের) লিখেছেন গজেন্দ্রকুমার
মিত্র—সে তোমরা আর একটু বড়ো হলে পড়ে রসগ্রহণ করতে পারবে।
পুরী ভ্রমণের কথা উঠলেই আমাদের মনে সাধারণত দুটো ছবি
ভেসে ওঠে—সমুদ্র আর জগন্নাথের বিখ্যাত মন্দির। আসলে কিন্তু পুরীতে দেখার জায়গা আরও
অনেক আছে। শহর
ছাড়িয়ে একটু দূরে গেলেই পড়ে আঠারো নালার অতি প্রাচীন সেতু। পুরোনো পাথরের তৈরি এই সেতু পেরিয়েই
আগে পুরীতে প্রবেশ করতে হত। পাথরের গাঁথনিতে আঠারোটি ফোকর আছে
বলে এই নাম। লোকে
বলে এই সেতু যে রাজা তৈরি করেছিলেন তিনি নাকি জলদেবতাকে তুষ্ট করতে তাঁর আঠেরোটি ছেলেকে
বলি দিয়েছিলেন। এখান
থেকেই আগে জগ্ননাথ মন্দিরের চূড়ার ধ্বজা দেখা যেত। চৈতন্যদেবও এই পথেই পুরী এসেছিলেন। তাছাড়া পুরী হল ভারতের অন্যতম প্রধান
তীর্থক্ষেত্র। কাজেই
এখানে যে মন্দিরের ছড়াছড়ি হবেই তাতে আর আশ্চর্য কী? স্টেশনের কাছেই রয়েছে খুব সুন্দর করে
জাপানী শৈলীতে সাজানো এক বুদ্ধমন্দির। শহরের ভিতরের দিকে নানান মঠ-আশ্রম ছড়িয়ে আছে। যেমন শঙ্করাচার্যের মঠ, হরিদাস মঠ ইত্যাদি। আবার দক্ষিণাকালী, চক্রনৃসিংহ,
সোনার গৌরাঙ্গ এই সব নানান মন্দিরও রয়েছে হাতের কাছেই। রথযাত্রার সুবাদে গুণ্ডিচা মন্দির
কিনা জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’ হিসেবে খুব বিখ্যাত, তাই এখানকার লোকেরা এইসব মন্দিরগুলির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক পাতাতে ছাড়েনি;
কোনোটিকে জগন্নাথের মামার বাড়ি, কোনোটিকে তাঁর
শ্বশুর বাড়ি ইত্যাদি বানিয়ে ছেড়েছে। চক্রতীর্থ ছাড়িয়ে সমুদ্রের ধারে রয়েছে
বেড়ি হনুমান মন্দির। এই মন্দিরের পিছনের পৌরাণিক গল্পটা আমার খুব মজার লেগেছে, তাই
তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। সুভদ্রা হলেন জগন্নাথ-বলরামের আদরের বোন। তা এই ছোটো বোনটি সমুদ্রের প্রচণ্ড
গর্জনে খুব ভয় পান বলে দাদারা সমুদ্রের ধারে স্থির হয়ে বসে থেকে সমুদ্রের গতিবিধির
দিকে নজরদারির ভার দিলেন হনুমানের উপর। কিন্তু হনুমান কিনা স্বভাবতই বড়ো চঞ্চল। তার উপর তাঁর বড়ো লাড্ডু খাওয়ার শখ। এই বিজন সমুদ্রের ধারে বালিয়াড়িতে
তিনি লাড্ডু কোথায় পাবেন?
অবশেষে একদিন যখন তিনি জানতে পারলেন অযোধ্যায় ঢের লাড্ডু বিলানো হচ্ছে,
তখন আর থাকতে না পেরে শ্রীক্ষেত্র ছেড়ে এক লাফে অযোধ্যায় গিয়ে হাজির
হলেন। জগন্নাথ
আর বলরাম তো জানতে পেরে রেগে কাঁই। তাঁরা হনুমানকে আক্ষরিক অর্থেই ধরে
বেঁধে নিয়ে এলেন আবার। এবং এইবার সমুদ্রের ধারে তাঁকে বসিয়ে তাঁর হাত-পা বেড়ি বা শিকল দিয়ে
বেঁধে দিলেন যাতে হনুমান আর ‘চেকপোস্ট’ ছেড়ে যেতে না পারেন। সেই থেকে ‘বেড়ি হনুমান’
নাকি এই সমুদ্রের ধারেই বসে পাহারা দিচ্ছেন।
পুরীর অনেক কিছুই ‘নীল’। পুরীর সমুদ্র নীল; পুরীর আর এক নাম
‘নীলাচল’ বা ‘নীলাদ্রিক্ষেত্র’;
এমন কী জগন্নাথের আদিরূপের নামও ‘নীলমাধব’। ‘নীলাচল’ কিংবা ‘নীলাদ্রি’ নামের বেশ মজার
ইতিহাস আছে। সংস্কৃত ‘অচল’ আর ‘অদ্রি’ শব্দের মানে
‘পাহাড়’। এখন তোমরা প্রশ্ন করতে পারো পুরীতে
পাহাড় কোথায়? কেবলই তো সমুদ্র। তা নয়। পাহাড় আছে। দীর্ঘকাল বালির স্তূপ জমে জমে সেই
পাহাড়—আসলে উঁচু ঢিবি বা টিলা—তৈরি হয়েছিল, এবং সেই পাহাড়ের উপরেই ‘নীলমাধবের’ মন্দির অবস্থিত বলে এমন নাম। তোমরা যারা পুরীতে গিয়েছ তারা খেয়াল
করে থাকবে হয়তো, পুরীর সমুদ্রের ধার থেকে যে রাস্তা স্বর্গদ্বার মোড় হয়ে সোজা মন্দিরের দিকে
উঠে গিয়েছে তা ক্রমাগত চড়াই উঠেছে। এ আসলে ঢাল বেয়ে ওই ‘নীল পাহাড়েরই’
মাথায় পৌঁছানো। দেবতার মন্দিরে পৌঁছানোর সোজা সরল
রাস্তা এইখান থেকেই শুরু বলে এই জায়গার নাম ‘স্বর্গদ্বার’, এমনটাই
বলে লোকে। সমুদ্রের
ধারে স্বর্গদ্বার মোড়ের ঠিক আগে পথের ধারে একটি খুব ছোটো জগন্নাথ মন্দির আছে। পুরোনো দিনের মন্দির। কী সুন্দর আর সূক্ষ্ম কারুকার্য সে
মন্দিরের ভিতরে বাইরে!
কিন্তু দোকানপাটে তা এমন ঢেকে গিয়েছে যে পথচলতি মানুষ মন্দিরটির কারুকার্য
আর ভিতরে দু’হাত বাড়িয়ে বসে থাকা দেবতার কথা ভুলেই যায়। স্বর্গদ্বারের নাকি এমনই স্থানমাহাত্ম্য
যে এখানে মারা গেলে বা মৃত্যুর পর এখানে দাহকাজ হলে সাক্ষাৎ অক্ষয় স্বর্গবাস হয়। এই অক্ষয় পুণ্য লাভের জন্য স্বর্গদ্বারের
এক পাশে যে বিরাট শ্মশান আছে সেখানে শুধু পুরী নয়, ওড়িশার দূরদূরান্ত থেকেও শবদেহ নিয়ে
আসা হয়। কী
জানি, এখনও যখন ধড়ে প্রাণ আছে তখন এই স্থানমাহাত্ম্যের কথা চাক্ষুষ বলতে পারব না। আমাদের কাছে স্বর্গদ্বারের আর এক স্থানমাহাত্ম্য
আছে। মন্দিরের
পরেই এ হল পুরীর ভ্রমণার্থীদের জন্য সব চেয়ে বড়ো আকর্ষণের জায়গা। দোকানবাজার, হোটেল, মন্দির আর সমুদ্র—সব মিলিয়ে স্বর্গদ্বার গম্গম্ করছে। এর পাশেই সি-বিচে পুরীর বিখ্যাত
সান্ধ্য বিচ-মার্কেট বসে। নানান রকম খাবার, খেলনা, শৌখিন জিনিস, শাঁখ আর আরও হাজার রকম টুকিটাকির ছোটো ছোটো
দোকান মিলিয়ে রোজ সন্ধ্যায় সমুদ্রের ধারে যেন মেলা বসে যায়। বালিতে কাগজ বা কাপড় বিছিয়ে কিংবা
চেয়ার পেতে (চেয়ার ভাড়া পাওয়া যায়) বসে থাকেন পর্যটকরা। তাঁদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ব্যাবসা করেন
কত রকম মানুষ। কেউ
ছবি তুলে দেবেন, কেউ মাথায় তেল মালিশ করে দেবেন, কেউ কাঁধে বাঁক ঝুলিয়ে
মিষ্টি নিয়ে এসেছেন, কেউ বা আবার বিক্রি করছেন সমুদ্রের ফেনা,
কড়ির মালা আর সলতে। এরই মধ্যে গুটগুট করে চলতে থাকে ভাড়ার
ঘোড়া আর উট। আহা, কী রংবাহারি সাজ তাদের!
কোথাও আবার সমুদ্রতীরের বালি এক জায়গায় বিরাট স্তূপাকার করে নানান রকম
মূর্তি গড়েছেন এক-একজন শিল্পী। এই স্যান্ড আর্ট বা বালুশিল্পের সূক্ষ্ম
কারুকাজ দেখলে চোখ টেরা হয়ে যায়। ওড়িশা শিল্পীর দেশ, আর বালুশিল্পীদের
এখানে বিশেষ কদর। এই সব মিলিয়ে পুরীর স্বর্গদ্বারের সমুদ্রতীর সন্ধ্যাবেলায় জমজমাট
হয়ে ওঠে।

তবে এত মানুষজনের ভিড় যদি পছন্দ না হয় তবে সমুদ্রতীর
ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়াই যায় বাঁদিকে চক্রতীর্থের দিকে কিংবা ডানদিকে সেই লাইটহাউস
পর্যন্ত। এলোমেলো
ঝোড়ো হাওয়া, সমুদ্রের গর্জন আর নোনা জলের গন্ধ মেশানো আমেজ একবার যে পেয়েছে সে সারাজীবনের
মতো সমুদ্রের প্রেমে মজতে বাধ্য। বিশেষ করে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের
সময় সমুদ্রতীর অন্য রূপ ধারণ করে। পুরীর সমুদ্রতীর সেই সব দুর্লভ সমুদ্রতীরের
একটি যেখান থেকে সমুদ্রের উপর সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুইই দেখা যায়। দুই সময়েই লাল-গোলাপি-সোনালি-নীল রঙের অবিশ্বাস্য, আশ্চর্য
সব খেলা দেখা যায়। মনে হয় যেন আকাশ আর জলের বিশাল ক্যানভাসে কোনো এক বিরাট চিত্রকর
আনন্দ মনে খেয়ালবশে রং-এর পর রং চাপিয়ে যাচ্ছেন। আমি হাঁ করে শুধু তাকিয়ে দেখি আর ভাবি, এমন সৌন্দর্যের মাঝে
বাস করেও মানুষের মনে হিংসা, লোভ, রাগ এ
সব জন্মায় কী করে? শহরের বাইরে সমুদ্রের ধারে মৎস্যজীবীদের গ্রাম। তাঁরা বিকেল থাকতেই মাছ-ধরা নৌকা নিয়ে সমুদ্রে
ভেসে পড়েন। সারা
রাত নানান রকম মাছ ধরে সকালে ফিরে আসেন। সেই মাছ বাজারে বিক্রি হয়ে চলে যায়
পুরীর হোটেলে হোটেলে। ভোরবেলা সমুদ্রের ধারে দাঁড়ালে সেই সব মাছ-ধরা নৌকাকে সার বেঁধে
ফিরে আসতে দেখা যায়। সে এক চমৎকার দৃশ্য। সমুদ্রের নীল জলের বুকে কালো কালো
ঝাপসা বিন্দুগুলি আস্তে আস্তে বড়ো হতে হতে কখন যেন হঠাৎ নতুন ওঠা সূর্যের আলো গায়ে
মেখে পুরোদস্তুর নৌকা হয়ে গিয়ে বেলাভূমিতে এসে লাগে। আর সঙ্গে সঙ্গে বালির উপর হট্টগোল
লেগে যায়। একদল
লোক নৌকা থেকে লাফিয়ে নেমে দড়ি দিয়ে নৌকা টানতে থাকে, মাছের পাইকাররা চেঁচিয়ে
ভিড় জমায়, আর তারই মধ্যে ধপাস করে বিরাট মাছের জাল বালির উপর
ফেলে শুরু হয় বিকিকিনি। ব্যস্, পুরী সমুদ্রের ধারে
ভোর শেষ, সকাল শুরু। এইবার তুমি পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরে
গিয়ে চা-ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করতে পারো।
এখন অবশ্য স্বর্গদ্বার বিচের পাশ থেকে চক্রতীর্থ পর্যন্ত
সমুদ্রতীরকে ‘গোল্ডেন বিচ’ নাম দিয়ে, নীল পতাকা
উড়িয়ে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। এই নীল পতাকার অর্থ হল বিচের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা,
পরিবেশ উন্নয়নের প্রতি খেয়াল রাখা, ভ্রমণার্থী
আর স্নানার্থীদের নানান রকম সুযোগসুবিধা ইত্যাদি অনেক বিষয় বিবেচনা করে পৃথিবীতে এক-একটি বিচকে ‘ব্লু ফ্ল্যাগ বিচ’ ঘোষণা করা হয়। পুরীর এই বিশেষ অংশের সমুদ্রতীরও সেই
সম্মান অর্জন করেছে,
এ একটা বিরাট গর্বের কথা। এখানে ঢুকতে হলে আলাদা টিকিট লাগে। প্রায় দু-আড়াই কিলোমিটার লম্বা
সমুদ্রতটের নানান জায়গা মূর্তি আর বিভিন্ন শিল্প দিয়ে সাজানো। ইতি-উতি বসার ব্যবস্থা। সমুদ্রে স্নানের জন্য আলাদা জায়গা
আছে, সেখানে
পেশাদার স্নান-সহযোগীর সাহায্য নিয়ে সমুদ্রস্নানের মজা উপভোগ
করা যায়। এই
গোল্ডেন বিচ পেরিয়েই যে অংশটি সেটি আগে ছিল অত্যন্ত নোংরা। একটা নালার জন্য এমন দুর্গন্ধ ছড়াত
যে আমরা ওদিকে বেড়াতে যেতেই চাইতাম না। কিন্তু এবারে গিয়ে একেবারে তাক লেগে
গেল। সমুদ্রের
ধারে বাগান করে, মুক্তমঞ্চ করে, পাথরের মূর্তি দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে জায়গাটার
ভোল পালটে দিয়েছে একদম। বছর দুয়েক আগে যে মারাত্মক ঘূর্ণীঝড় ‘ফণী’ ঘণ্টায় দেড়শো কিলোমিটার বেগে পুরীর উপর আছড়ে পড়ে গোটা শহর তছনছ করে দিয়েছিল,
এই ‘নীলাদ্রি বিচ’ আর
‘গোল্ডেন বিচ’ দেখলে সে কথা মালুমই হয় না। আঘাত ঝেড়ে ফেলে ‘জয় জগন্নাথ’
হুঙ্কার দিয়ে পুরী আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
জগন্নাথের উপর পুরীর নির্ভরশীলতা দেখলে অবাক শ্রদ্ধায়
মাথা নিচু হয়ে আসে। শুধু
শ্রীক্ষেত্র পুরী তো না,
গোটা ওড়িশার মানুষ জগন্নাথকে তাঁদের ‘মউড়মণি’
মানে ‘মাথার মুকুট’ বলে মানেন। জগন্নাথ হলেন তাঁদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জাতিসত্ত্বার
মূর্ত প্রতীক। পুরীর শ্রীমন্দিরের গর্ভগৃহে রত্নসিংহাসনের উপর বসে থাকা জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা তাঁদের কাছে সব বিপদের আশ্রয়, সব আনন্দের উৎস,
সব দুঃখের সঙ্গী। তাঁরা যে শুধু এই ত্রিদেবকে ভক্তি
করেন তা তো নয়। ভক্তি
আর সম্মান কতটা বড়ো হয়ে উঠলে মানুষ দেবতাকেও আত্মবৎ মানে নিজের মতো করে সেবা করতে পারে! পুরীতে এলে ঠিক সেটাই
বোঝা যায়। সুভদ্রা
যেন দেবী হলেও ওড়িশাবাসীর নিজেদেরই আদরের ছোটো বোনটি। বলরাম যেন একটু রাগী, একটু অবুঝ বড়ো দাদা। আর জগন্নাথ—তিনি তো রয়েইছেন বন্ধু
হয়ে। মানুষ
যেমন খাওয়াদাওয়া করেন,
তেমনই তাঁরাও খান। সাধারণ ওড়িয়াজনের প্রিয় ‘পখাড় ভাত’
বা পান্তা ভাত তাঁরও প্রিয়; আবার রাজকীয় ছাপ্পান্ন
পদের ভোগও তাঁকে উৎসর্গ করা হয়। ভোগের ব্যাপারে একটু পরে বলছি। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাও বছরে একবার করে সাধারণ মানুষের মতো মাসির বাড়ি গিয়ে এক সপ্তাহ থেকে
ভালোমন্দ খেয়ে আবার মন্দিরে ফিরে আসেন। তাঁরা যান রথে চড়ে, আর সেই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে
পুরীতে দেশবিদেশ থেকে ছুটে আসেন ভক্তরা। ভারতবর্ষের অন্যতম বড়ো উৎসবই হল পুরীর
এই রথযাত্রা। রথযাত্রার
কিছু আগে হয় তাঁদের স্নানযাত্রা। ঘড়া ঘড়া সুগন্ধী জলে স্নান করে জগন্নাথের
নাকি জ্বর আসে। তখন
তিনি চুপটি করে ঘরের মধ্যে শুয়ে থাকেন আর ‘পখাড় ভাত’-এর বিশেষ ভোগ
খান—ঠিক যেমন গ্রাম্য ওড়িশাবাসী জ্বর হলে পান্তাভাতের পথ্য খেয়ে
ঘর অন্ধকার করে ঘরের এককোণে গায়ে গামছা জড়িয়ে পড়ে থাকে। তখন মন্দিরে দেবদর্শন বন্ধ। তারপর সেরে উঠে তিন ভাইবোন রথে চড়ে
মাসির বাড়ি যান যখন,
তখন মা লক্ষ্মী রেগে যান তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়নি বলে। তিনি রেগেমেগে সারা পথ উজিয়ে গিয়ে
জগন্নাথের রথের একটু অংশ ভেঙে দিয়ে আসেন। আবার যখন জগন্নাথের ফিরে আসার সময়
হয় তখন তিনি অভিমান করে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে রাখেন। শেষে জগন্নাথকে ‘রসগোলা’ খাইয়ে তাঁর অভিমান ভাঙাতে হয়। উলটোরথের পরের দিন তাই গোটা পুরীতে
রসগোল্লার ছড়াছড়ি (এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ওড়িশার রীতিমতো ঠান্ডা লড়াই চলে, তোমরা জানো হয়তো)। এমন ‘মানুষের মতো’
বলেই বোধ হয় পুরীর জগন্নাথ আমাদের এত কাছের দেবতা।
পুরীর মন্দিরের ইতিহাস যে কত পুরোনো তা কেউ বলতে পারে
না। মন্দিরের
ভিতরে তালপাতায় লেখা এক ধরনের বিশেষ পুঁথি আছে। কবে থেকে কেউ জানে না সে পুঁথি তাড়ায়
বেঁধে রাখা হচ্ছে। একে
বলে ‘মাদলাপাঁজি’। মাদলাপাঁজি হল একাধারে পঞ্জিকা আর
ওড়িশার ইতিহাস। তাতে
পাওয়া যায় যে, কোনো এক আধা-পৌরাণিক রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথকে স্বপ্নে দেখেন। তিনি নাকি জঙ্গলে শবর জাতির মধ্যে ‘নীলমাধব’ রূপে পূজা পাচ্ছেন, রাজা যেন তাঁকে শ্রীক্ষেত্রে এনে
প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা মন্দির প্রতিষ্ঠা করে আজ্ঞা পালন করলেন। তবে এখন যে মন্দির দেখা যায় তা দশম
শতাব্দীতে রাজা অনন্তবর্মণের তৈরি। ওড়িশার মন্দির নির্মাণের শৈলী ভারতের
মধ্যে একেবারে অন্য ধরনের। সেই শৈলীর অন্যতম সেরা কাজ হল পুরীর
জগন্নাথ মন্দির। মন্দির
চত্বরে শুধু তো জগন্নাথের মন্দির নেই, তেত্রিশ কোটি দেবতার সবাই যেন এসে বসেছেন এখানে। এঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন বিমলা
দেবী—মা
দুর্গার এক রূপ। জগন্নাথকে কৃষ্ণের এক রূপ বলে মানা হয় যেমন, তেমনই তান্ত্রিক বা
শাক্ত মতে বিমলা দেবীর ভৈরব অর্থাৎ স্বয়ং শিব হিসেবেও তাঁকে কল্পনা করা হয়। এ বড়ো অদ্ভুত ব্যাপার। যাঁরা ভারতের ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি চর্চা করেন তাঁদের কাছে পুরীর জগন্নাথ আর তাঁর মন্দির এক বড়ো অদ্ভুত
বিষয়। বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য, বৈদান্তিক, ভক্তিবাদী, তান্ত্রিক—হিন্দুধর্মের প্রায় সব ক’টি শাখা এখানে এসে মিলেছে শুধু নয়, এমনভাবে মিশেছে যে তাদের একে অপরের থেকে আলাদা করার আর জো নেই। শুধু হিন্দুধর্মই তো নয়, জগন্নাথের মন্দির
ও উপাসনায় বৌদ্ধ আর জৈন প্রভাবের ভূমিকাও বিরাট, কারণ এই দুই
ধর্মই এককালে ওড়িশার অন্যতম প্রধান ধর্ম ছিল। তোমাদের বয়স বাড়লে আরও মাথা খাটিয়ে
তোমরা এ সব পড়বে আর জানবে। আপাতত পুরীর মন্দির নিয়ে দুটো কথাই
শুধু বলব। এক
হল পুরী গেলে সন্ধ্যায় মন্দিরের চূড়ার ধ্বজা পালটানো অবশ্যই দেখা উচিত। সে এক দেখার মতো জিনিস। প্রতি সন্ধ্যায় আরতির আগে মন্দিরের
মাথায় বাঁধা আগের দিনের লাল-হলুদ রঙের পতাকা খুলে নতুন পতাকা বাঁধা হয়। ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত
যা খুশি হয়ে গেলেও এই নিয়মের অন্যথা হবে না। দুশো ফিট উঁচু পাথরের মন্দিরের গায়ে
আর চূড়ায় কতদিনের পুরোনো শ্যাওলা জমে আছে। মন্দিরের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে, সেই শ্যাওলা মাড়িয়ে,
স্রেফ নিজের সাহস আর জগন্নাথের উপর বিশ্বাসকে সম্বল করে একজন মানুষ অদ্ভুত
কায়দায় তরতর করে উঠে যান মন্দিরের চূড়ায়, আবার পুরোনো পতাকাগুলি
খুলে নিয়ে উলটো পথে একই কায়দায় ফিরে আসেন। পুরোনো পতাকার খণ্ডগুলি নেওয়ার জন্য
কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
আর দুই হল জগন্নাথের ভোগ খাওয়া। মন্দিরের ভিতরে একপাশে দেবদেবীদের
বিশাল পাকশালা। হাজার-হাজার রাঁধুনি ব্রাহ্মণ
সেখানে রাতদিন রান্নার জোগাড়ে লেগেছেন। লোকে বলে এই রান্নাঘরের ‘ইন-চার্জ’ নাকি স্বয়ং দেবী মহালক্ষ্মী—জগন্নাথের মূল মন্দিরের পিছনেই যাঁর মন্দির। এই পাকশালায় উনুনে আগুন জ্বেলে তার
উপর বড়ো থেকে ছোটো হাঁড়ির উপর হাঁড়ি (এঁরা বলেন ‘গুণ্ডি’)
চাপিয়ে চাপিয়ে রান্না হয় ভোগ। ভাত, ঘি-ভাত, পোলাও, খিছুড়ি, সবজি দেওয়া ঘন ডাল, সবজির তরকারি, নানান রকম মিষ্টি এই সব সাধারণ খাদ্য তো থাকেই, ছাপ্পান্ন
ভোগে থাকে আরও হরেক রকমের খাবার—অত হিসেব আমার মনে নেই। অতুলনীয় তার স্বাদ, দেবভোগ্য সেই খাবার। খাবারের মধ্যে দিয়ে যদি ওড়িশাকে জানতে
হয় তাহলেও জগন্নাথের ভোগ ছাড়া গতি নেই। প্রতিটি পদে ওড়িশার নিজস্বতার ছোঁয়া
রয়েছে। ওড়িয়ারা
এমনিতেই মিষ্টিপ্রিয়। মিষ্টির নিরিখে জগন্নাথকে তাঁরা নিজেদের সেরাটাই উজাড় করে দেন। মন্দিরের মধ্যে ভোগ বিক্রয়ের জায়গা
যে আনন্দবাজার, সেখানে অর্ধেক দোকানই কেবল মিষ্টির। জগন্নাথের ভোগের মতো মালপোয়া, ক্ষীর, লাড়ু ইত্যাদি মিষ্টি আমি আর কোথাও খাইনি। আর পুরীর যে খাজা এত বিখ্যাত, সে তো জগন্নাথের ভোগের
সুবাদেই। স্বর্গদ্বার
মোড় থেকে বাজার-মন্দির সর্বত্র সেই খাজার গন্ধে ম-ম করে। আর আমরাও তো পাড়াপড়শি কেউ পুরী যাচ্ছেন
শুনলেই আবদার করে বসি,
‘এক কেজি খাজা আমার জন্য এনো কিন্তু’—তাই না?
পুরী নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষই হবে না। পুরীর বাইরেও কত সুন্দর সুন্দর জায়গায়
গিয়েছি। ওড়িশার
রাজধানী মন্দিরের শহর ভুবনেশ্বর, ভুবনেশ্বর পেরিয়ে নন্দনকানন চিড়িয়াখানা তো দেখতেই হয়। উদয়গিরি আর খণ্ডগিরিতে রয়েছে সম্রাট
অশোকের আমলের শিলালিপি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে। দয়া নদীর পাশে ধবলগিরি বা ধৌলিতে ইন্দো-জাপানী বৌদ্ধ চৈত্যমন্দির
কলিঙ্গযুদ্ধের পর অশোকের শান্তিময় বৌদ্ধধর্মের শরণ নেওয়াকে মনে পড়িয়ে দেয়। চন্দ্রভাগা নদীর মোহনার কিছু দূরে
কোণার্কে অসামান্য কারুকার্যময় ভাঙা সূর্যমন্দির ওড়িশার শিল্পকলার গৌরবময় ইতিহাসকে
আগলে পড়ে আছে। রয়েছে
শিল্পীগ্রাম রঘুরাজপুর তার ওড়িশার প্রাচীন পটচিত্র, ভাস্কর্য, তালপাতা
শিল্প আর ওড়িশি নাচের ঐতিহ্যকে বুকে ধরে। সে সব গল্প আবার কখনও হবে না হয় সুযোগ
পেলে।
![]() |
পুরীর জগন্নাথ মন্দির, ১৮৬৫ |
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment