
“এই রুমি দেখ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে!”
ও মা! তাই তো! হোটেলের রুম থেকে দেখা যাচ্ছে তাকে। সূর্যের আলো পড়ে ঝকঝক করছে। রুমি আর নড়তে পারে না। বাবা বললেন, “লাগেজ রেখে এখন লাঞ্চ সেরে আসি। তারপর রেস্ট। বিকেলে ঘুরতে যাব।”
রুমির মা বললেন, “আগে স্নান সেরে নিই। তারপর লাঞ্চ।”
রুমি একভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখছে। কী ঠান্ডা লাগছে! হঠাৎ চোখে মুখে ঠান্ডা জল পড়তেই রুমি চেঁচিয়ে উঠল।
“কতক্ষণ ধরে ডাকছি রুমি। সকাল হয়ে গেছে কতক্ষণ। স্কুল যেতে হবে তো নাকি,” মা চিৎকার করছেন। মায়ের হাতে এক গ্লাস জল। তার মানে রুমি এতক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা কোথায়? কোথায় সেই ঝাঁ চকচকে হোটেল! কাল রাতে একটু ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল তাই ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।
রুমির মন খুব খারাপ হয়ে যায়। এই নিয়ে সে প্রায় দিন পনেরো হল এই স্বপ্ন দেখছে। কেন যে দেখছে ভগবানই জানেন। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর ভূগোলে কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা পড়েছে। তারপর থেকে সে এই পাহাড়ে বেড়াতে আসার স্বপ্নই দেখছে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেরাচ্ছে সে হলুদ প্রজাপতির মতন। কখনও আবার মোমো খাচ্ছে। মনাস্ট্রিতে বসে ভগবান বুদ্ধের সামনে প্রার্থনা করছে। কখনও চা বাগানে মায়ের হাত ধরে ঘুরছে। কখনও বরফ নিয়ে খেলছে পাহাড়ি শিশুদের সঙ্গে। কিন্তু কেন এমন হয়? পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া রুমিদের কাছে বিলাসিতা। বাবার একটা জামাকাপড়ের দোকান আছে মার্কেটের দিকে। কিন্তু করোনার পর থেকে দোকানটা মার খাচ্ছে। মাও সেলাই করেন, বিউটিশিয়ানের কাজ জানেন। কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন। খুব শখ করে তাঁরা মেয়েকে খুব ভালো স্কুলে ভরতি করেছেন। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া সম্ভব নয় কোনোমতেই। পাড়ায় একবার বাস ছেড়েছিল, তখন রুমিরা দীঘা গেছিল। খুব আনন্দ হয়েছিল তখন। বাবা মা সবাই ছিলেন।
রুমির স্কুলে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়। প্রজেক্টের কাজ ছিল কিছু। রুমির বন্ধু সুমালা কী সুন্দর পাহাড় বানিয়েছে। ছোট্ট একটা ট্রের মধ্যে পাহাড় বানিয়েছে। চা বাগান বানিয়েছে। তার মধ্যে ছোট্ট একটা মেয়ে পুতুল। পিঠে ঝুড়ি নিয়ে চা তুলছে! আহা ওই মেয়েটি যদি রুমি হত! কী ভালোই না হত! ক্লাসে সুমালার হিল স্টেশন ফার্স্ট হল। ম্যাম খুব প্রশংসা করলেন। কীভাবে সুমালা সব বানিয়েছে বার বার জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলেন। রুমি বানিয়েছিল একটা ন্যাকড়ার পুতুল। এমন কিছু ভালো হয়নি। তাই ম্যাম ভালো বললেন না।
রুমির মন খুব খারাপ হয়ে গেল। পাহাড়ে যাওয়ার বায়নাও করতে পারছে না। বাড়ির অবস্থা সে খুব ভালো করেই বোঝে। আজ থেকে গরমের ছুটি পড়ে যাচ্ছে। অনেকেই পাহাড়ে বেড়াতে যাচ্ছে। সুমালাও দার্জিলিং যাচ্ছে। ছুটির পর বাড়িতে ফিরে রুমি দেখল মামা মামিমা এসেছেন নৈহাটি থেকে। মা কথা বলছেন। মামা মামিমা দার্জিলিং যাচ্ছেন সামনের সপ্তাহে। মা বললেন, “তোরা রুমিকেও নিয়ে যা। ওর খরচ যা লাগে আমি দিয়ে দেব। বেচারি কোথাও যেতে পারে না।”
মামিমা বললেন, “তা কী করে হয়? আমাদের টিকিট কাটা সেই কবে থেকে! আর পরের মেয়ের দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।”
রুমির মায়ের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। তোমাদের ছাড়া কি আমি কোথাও যেতে পারি? তুমি বোঝো না কেন মা?
“এই রুমি তোর ফোন বাজছে।”
রুমি বাথরুম থেকে দৌড়ে আসে। আবার ফোন নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর বাইরে আসে। উফ আজ সেই দিন! এই দিনটা দেখার জন্য সে প্রায় বাইশ বছর অপেক্ষা করেছে। নিজের স্বপ্নপূরণ হতে দেখতে পাবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। নিজে সুন্দরভাবে সেজেগুজে তৈরি হয়ে যায়। রুমির বাবা-মাও তৈরি। আজ সে নিজেই গাড়ি চালাবে। নিজের গন্তব্য আসতেই রুমি দেখতে পেল জায়গায় প্রচুর লোক। তবে আজ টিভি চ্যানেল এবং খবরের কাগজের রিপোর্টাররা এসেছে। দু’দিন পর এই পার্ক সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। আজ উদ্বোধন হবে। পুলিশ পোস্টিং চারিদিকে। টলিউডের কয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রী এবং মন্ত্রী এসেছেন। রুমির প্রতিভা আজ সব সেলিব্রিটিদের ম্লান করে দিয়েছে। রুমির ছোটোবেলার বন্ধু সুমালাও এসেছে রুমির আমন্ত্রণে। কিন্তু রুমি এমন কী করল? ছোট্ট গনেশের মূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে লাড্ডু দিয়ে নারকেল ফাটিয়ে প্রণাম করে অভিনেত্রী সিমি এবং নেত্রী মধুবনী ঠাকুরের আর্শীবাদ প্রার্থনা করলেন। ফিতে কাটলেন একজন মন্ত্রী।
বিখ্যাত শিল্পপতি সুশীল বাজুরিয়া এই পার্ক তৈরি করেছেন রুমির প্ল্যান মতো। ওনার মেয়ে কাব্যও রুমির বান্ধবী। সেও উপস্থিত। এই পার্কের নাম ‘হিমালয়া’। ভেতরের বিশাল ফটক খুলে গেল। রুমির মা জিজ্ঞাসা করেন, “হ্যাঁ রে, ভেতরে কী আছে?”
“ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবে মা,” রুমি হেসে উত্তর দেয়।
“আমার খুব ভয় লাগছে রে মা,” বাবা ভিতু ভিতু গলায় বললেন।
“বাবা মা তোমরা প্লিজ পুরানো দিনের কথা ভেবো না। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল হিমালয় দেখার। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য কখনও তা সম্ভব হয়নি। তাই আমি চেষ্টা করেছি হিমালয়কে আমাদের কাছে নিয়ে আসার। যারা অর্থের অভাবে ঘুরতে যেতে পারে না তাদের জন্য ছোট্ট একটা উপহার। সপ্তাহে দু’দিন এন্ট্রি ফি লাগবে না। এছাড়া বড়োদিন থেকে নিউ ইয়ার পর্যন্ত এন্ট্রি ফি লাগবে না।”
সুমালা এসে রুমির হাত ধরে টান দেয়, “তোমরা প্লিজ ভেতরে চলো। আমি আর থাকতে পারছি না।”
ভেতরে এসে চোখ জুড়িয়ে যায় রুমির মায়ের। সত্যিকারের হিমালয় কেমন দেখতে ওঁরা জানেন না। সারা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই দিন চলে গেছে। রুমি অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট। তাই স্কলারশিপ পেয়ে বাইরে পড়তে যায়। ওখানেই আলাপ হয় একজন শিল্পপতি সুশীল বাজুরিয়ার সঙ্গে। আসলে বাজুরিয়ার মেয়ে কাব্য রুমির বান্ধবী। সেও এই ইউএসএ-তে পড়তে এসেছে।
রুমি একদিন কথায় কথায় নিজের স্বপ্নের কথা বলে কাব্য এবং বাজুরিয়া আঙ্কলকে। লাকিলি উনি জমি দিতে রাজি হয়ে যান। একটা পার্ক এবং রিসর্ট তৈরি করার কথা তিনিও ভেবেছিলেন। রুমি নিজেই মাথা খাটিয়ে এই সমভূমিতে হিল স্টেশন বানানোর সব প্ল্যান তৈরি করে ফেলে। এই সব গল্প কতবার শুনেছেন মা। চোখ জলে ভরে আসছে। পাহাড়গুলো সত্যি নয়। তবু দেখে দেখে যেন আশ মিটছে না। দেবদারু আর পাইন গাছগুলোর মধ্যে কিছু আসল কিছু নকল। কাব্য আর সুমালা তাই বলাবলি করছে।
আহা গাছের গন্ধ কী অপূর্ব! চা পাতা তুলছে কিছু লেপচা মেয়ে।
“চা গাছ এখানে কী করে করলি রে?” মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন রমলা দেবী।
“মা এখন চা গাছ সমভূমিতেও হয়। ওই কাঠের বাড়িগুলো হল রিসর্টের মতো। তবে এখনও থাকার ব্যবস্থা হয়নি।”
“আরে! ছোট্ট ট্রেনের মতো এটা কী আসছে রে?”
“মা, এটা টয়ট্রেন। চল, আমরা এতে উঠব।”
সবাই টয়ট্রেনে চড়ে বসেন। কফি আর লাঞ্চ এখানেই দেওয়া হল। ট্রেনে করে সমস্ত পার্ক ঘুরিয়ে দেখার ব্যবস্থা।
“আমরা এখানে কী দেখব রে মা?” রুমির বাবা কমলেশবাবু জিজ্ঞাসা করেন।
“আমরা মনাস্ট্রি আর আদিবাসি মিউজিয়াম দেখে ফিরে আসব।”
ছোট্ট একটা বুদ্ধদেবের মন্দির বা মনাস্ট্রির সামনে ছোট্ট স্টেশনে গাড়ি থামল।
“এই শহরে বসে এই রকম দৃশ্য আমি কল্পনাই করতে পারছি না,” মন্তব্য করলেন সিরিয়াল অভিনেত্রী মেহেক। সবাই ধন্য ধন্য করছে মিস্টার বাজুরিয়া এবং রুমিকে। বাজুরিয়া মানুষটি খুব সৎ। তা না হলে সব ক্রেডিট উনিই নিয়ে নিতেন।
মনাস্ট্রীর পাশে ছোট্ট একটা নকল ঝরনা। রংবেরং-এর ফুল ফুটে আছে। বুদ্ধদেব একাকী বসে আছেন মন্দিরে। রমলা দেবী হাত জড়ো করলেন। এখানে যারা আসবে তাদের মনে শান্তি দিও ঠাকুর। আর সবাই সব ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এর পাশে আদিবাসী মিউজিয়াম। পাহাড়ি মানুষরা কেমনভাবে জীবন কাটায়, কেমনভাবে লোকে পাহাড়ে ট্রেক করে এই সব নিয়ে একটা মিউজিয়ামের মতো।
রমলা দেবী জিজ্ঞাসা করেন রুমিকে, “পাহাড়গুলো কী করে বানিয়েছিস?”
“একধরনের মেটিরিয়াল। পুজোর প্যান্ডেলে যেমন দেখো ওই রকমই, তবে আরও দামি জিনিস। মাঝে মাঝে এগুলো সুন্দর করে সাজাতে হবে। বরফ পড়া করা যায়। আর ভাবছিলাম রোপওয়ে থাকবে ছোটো ছোটো। পুতুল বসে থাকবে তাতে।”
সবাই হাততালি দিয়ে ওঠেন। এমন ইট কাঠে শহরে এমন সুন্দর পার্ক বানানোর জন্য প্রত্যেকেই ধন্য ধন্য করছেন। প্রচুর গাছপালার জন্য এবং লেক থাকার জন্য গরমও তেমন লাগছে না। বাইরে তো এসি করা যাবে না।
“সত্যি রুমি তোর জন্য গর্ব হচ্ছে আমার,” সুমালা রুমির হাত ধরে বলে ওঠে।
“এই সব কিছু তোর জন্য সম্ভব হয়েছে। তুই স্কুলের প্রজেক্টে হিল স্টেশন বানিয়েছিলি। তোর মনে আছে? ওটা দেখেই তো মাথায় এল!”
“ওহ, তাই নাকি!”
রমলা দেবী বসে পড়েন একটা গাছের তলায়। জীবনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তিনি বেড়াতে এলেন। রুমির দিকে তাকান। মেয়েটা আজ কত খুশি। মায়ের দিকে আড়চোখে তাকায় রুমি। ক্লান্ত মুখে আজ প্রশান্তির ছাপ। এত দেশ বিদেশ ঘুরেও জীবনে দ্বিতীয়বার সে বেড়াতে এসেছে।
No comments:
Post a Comment