
টেন্ট-হাউসের আতঙ্ক
দেবানন্দ সেনগুপ্ত
ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময়।
প্রথম প্রথম নীলার মা-বাবা মনে করেছিলেন যে বেড়াতে যাবার মানসিক উত্তেজনায় এবং ভ্রমণের কায়িক পরিশ্রমে শরীরটা দুর্বল হয়েছে নীলার। এই ১৫ পেরিয়ে ১৬-তে পা রেখেছে নীলা। চিরকাল শক্তসবল ও ডানপিটে মেয়ে সে। আমাদের দেশে প্রতিবছর যে ভাইরাল ফিভার অবধারিতভাবে মানুষকে আক্রমণ করে ভোগায়, তার শিকার সে আজ পর্যন্ত হয়নি। মশাবাহিত যে নানা রোগের জন্য আমাদের দেশ কুখ্যাত, সেগুলোও তাকে কোনোদিন স্পর্শ করেনি। কিন্তু আজ বেড়াতে এসে কী যে বিপত্তি ঘটল!
ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক। নীলা ওরফে নীলাক্ষী মা-বাবার একমাত্র সন্তান। লেখাপড়ায় খুব উচ্চমানের না হলেও হকি খেলা, মিউজিক ব্যান্ডে ড্রাম বাজানো, নাটকে অভিনয় – এ সব ব্যাপারে বেশ চৌকশ। মন তার সদা বহির্মুখী, চঞ্চল, সুদূরের পিয়াসী। ছুটির মরসুমে স্কুলের বড়ো ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য সে মুখিয়ে থাকে। নীলার বাবা সুমিতবাবু নীলাদের স্কুলেরই অঙ্কের টিচার, বেশ নামকরা ও সম্মানীয় মানুষ তিনি। স্কুলটা সরকারি স্কুল। সেই স্কুলের টিচাররা কুড়ি বছর শিক্ষকতা করার পর এবং অবসর গ্রহণ করার আগে যে কোনো সময় এশিয়ার যে কোনো দেশে সপরিবারে বেড়াতে যাওয়ার ও সেখানে থাকা খাওয়ার ভাতা পেয়ে থাকেন। সেই সুযোগ শিক্ষকতা-জীবনে একবারই সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে। সুমিতবাবুর ২২ বছর শিক্ষকতা করে কেটে গিয়েছে। এবার তার মনে হল জীবনের অঙ্ক মেলাতে গেলে শরীর সুস্থ থাকতে থাকতে সেই ছুটিটা এবার নিয়ে নেওয়াই ভালো।
বাবার মুখে দারুণ খবরটা পেয়ে নীলা আনন্দে নেচে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সে এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণ সংক্রান্ত ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে বসে পড়ল। দেখা গেল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করা যেতে পারে, যেখানে জঙ্গল পাহাড় সমুদ্র প্রাকৃতিক শোভা একসঙ্গে দর্শন করা যাবে। অনেক ভেবে ঠিক হল থাইল্যান্ড যাওয়া হবে।
যথাসময়ে থাই এয়ারলাইন্সের বিমানে চেপে সাউদার্ন থাইল্যান্ড অবতরণ করে সুর্যাট থানি অঞ্চলে একটি হোটেলে তারা উঠল। সেখানে একটি বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে। কয়েকদিন ওখানকার স্থাপত্য দর্শন, এলিফ্যান্ট হিলসের হস্তীযূথের সঙ্গে রোমাঞ্চকর মোলাকাত এবং নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করে অসাধারণ কাটল সময়টা। নীলার আনন্দ দেখে কে! এরপর শুরু হল জঙ্গল ট্রেকিং। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে নদীপথে বোটে চেপে জঙ্গলে প্রবেশ করা হল। সেখানে জঙ্গলের মাঝে রাত কাটাবার জন্য অনেকগুলো টেন্টহাউস বা তাঁবুর আস্তানা রয়েছে। সেখানে ক’দিন থাকা হবে, স্থির হল। সুমিতবাবু একটু ইতস্ততঃ করলেও নীলার আবদারে তাঁর আপত্তি ধোপে টিকল না। লাক্সারি টেন্টগুলোয় অতি সুন্দর ব্যবস্থা। জঙ্গলে ভ্রমণের জন্য গাইডও রয়েছে। তার সঙ্গে অনেকক্ষণ ট্রেকিং করে ক্লান্ত হয়ে টেন্টে ফিরে ডিনার খেয়ে ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।
ভোরে পাখির ডাকে নীলার ঘুম ভাঙল। উঠেই সে অনুভব করল, শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। অদ্ভুত, কালকে এত চাঙ্গা থাকার পর আজকে এরকম, এ কি কালকের ট্রেকিং-এর ক্লান্তি? সুমিতবাবু তাকে তৈরি হতে বললে সে বলল, “বাবা, আজকে রেস্ট নেবে?” নীলার মুখে এই কথা শুনে বেশ চমকে গেলেন সুমিতবাবু। “থাক তাহলে,” বলে উঠলেন নীলার মা কাবেরী দেবী।
কিন্তু দিন গড়ালেও নীলার শরীরের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না। সারাদিন কেমন নির্জীব হয়ে শুয়ে থাকল সে। শুধু অপ্রত্যাশিত বলেই নয়, বিদেশ বিভূঁই বলেও বেশ চিন্তায় পড়লেন সুমিতবাবু। টেন্টঅফিসের প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে ক্লিনিক্যালি সবকিছুই স্বাভাবিক বের হল, তবে কিছুটা রক্তশূন্যতা ধরা পড়ল। সেরকম চিন্তার কিছু নেই, জানালেন স্বাস্থ্যকর্মী। তবুও নীলার বাবা-মা উদ্বিগ্ন হলেন। টেন্ট ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে এক সিনিয়র ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া গেল যিনি এখানে ডিউটিতে থাকেন, তবে আজকে তাকে এখানে পাওয়া যাবে না। ফোনে কথা হয়ে গেছে, আগামীকাল তিনি আসবেন, ম্যানেজার নিশ্চিন্ত করলেন।
হালকা গল্প করে আর বই পড়ে রাতে শুয়ে পড়লেন সুমিতবাবু। নীলা আচ্ছন্নের মতো ঘুমোচ্ছে, জ্বর নেই যদিও।
রাতের দিকে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল সুমিতবাবুর। অন্ধকারে তার মনে হল টেন্টের মধ্যে কিছু একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সেটা উড়ছে। চোখ কচলে ভালো করে তাকাতে মনে হল জোনাকিপুঞ্জের মতো চিকমিক করছে কিছু একটা। টর্চ জ্বালাতেই ঝটপট করে একটা আওয়াজ, কিন্তু তারপর আর কিছু দেখতে পেলেন না সুমিতবাবু। পাখি-টাখি ঢুকেছিল নাকি? যাই হোক, নীলা অঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখে শুয়ে পড়লেন তিনি।
পরের দিন সকালে দেখা গেল নীলা আরও নির্জীব। উঠে দাঁড়াতেও তার কষ্ট হচ্ছে। টেস্ট করে দেখা গেল, রক্তাল্পতা আরও বেড়েছে। এবারে বেশ ঘাবড়ে গেলেন সুমিতবাবু আর তাঁর স্ত্রী। নীলার মা কাতর হয়ে বললেন, “চল এখান থেকে আমরা চলে যাই।” কিন্তু এই অবস্থায় এখান থেকে দুর্বল নীলাকে নিয়ে যাওয়াটাও কষ্টকর।
সেদিন সন্ধেবেলা শহর থেকে সেই সিনিয়র ডাক্তারবাবু
এলেন। অনেকক্ষণ ধরে নীলাকে দেখে আর রিপোর্ট দেখে তিনি একটু গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন। সুমিতবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, “আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এটা দেখে যে মেয়েটির শরীরে রক্ত তৈরির কোনো বিরাম নেই, কিন্তু লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে কীভাবে যেন রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। ঠিক আছে, আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি, আজকের রাতটা যাক। দেখি কেমন থাকে।”
রাতে মৃদু গোঙানির মতো আওয়াজ শুনে উঠে বসলেন সুমিতবাবু। নীলার গলা মনে হচ্ছে, জ্বর এল নাকি? সুইচ জ্বালানোর জন্য উঠতে যাবেন, হঠাৎ একটা সবুজ আভা চোখে পড়ল তার। প্রথমে ঠিক ঠাহর করতে না পারলেও তিনি বুঝলেন আভাটা দেখা যাচ্ছে নীলার বিছানার কাছে।
বেশ হকচকিয়ে গেলেন সুমিতবাবু। ওখানে ওরকম ফ্লুরোসেন্ট লাইটের মতো ওটা কী দেখা যাচ্ছে? ধড়ফড় করে মেঝেতে নামতেই একটা ঝটপট শব্দ হয়ে আর দেখা গেল না আলোটা। কী যেন একটা সরে গেল চোখের সামনে দিয়ে। লাইট জ্বালাতে তিনি দেখলেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নীলা। মুখে একটা অস্বস্তির ছাপ, জামাকাপড় কিছুটা এলোমেলো।
নীলার মা-ও উঠে এসেছেন। নীলার গায়ে হাত দিয়ে দেখে বললেন জ্বর নেই। কিন্তু সুমিতবাবু ভাবছেন ওই আওয়াজটার আর আলোটার কথা। পর পর দুই রাত একই ব্যাপার। একটা আলো, তারপর একটা আওয়াজ। দু’দিনই কি তার চোখের কানের ভুল হবে? না, কিছু একটা যে ছিল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই তাঁর।
“কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে না?” নাক কুঁচকে বলে উঠলেন কাবেরী দেবী। হ্যাঁ, একটা পচা চামড়া চামড়া গন্ধ পাচ্ছিলেন সুমিতবাবুও। কাল থেকেই অল্প অল্প পাচ্ছেন, এখন সেটা আরও প্রকট। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন তাঁবুর গন্ধ, তারপরে নীলার শরীর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আর খেয়াল করা হয়নি। “তাঁবুর কাপড় আর জলের গন্ধ বোধ হয়,” বলে আশ্বস্ত করতে চাইলেন তিনি স্ত্রীকে, যদিও এখন তাঁর নিজেরও সবকিছু একটু অস্বাভাবিক লাগছে। “না, এই দেখ নীলার গা আর গাউন থেকে বেরোচ্ছে, এই কাপড়ে তো এরকম গন্ধ হবার কথা নয়,” বললেন কাবেরী। আবার একটা খটকা লাগল সুমিতবাবুর, “যাই হোক, কাল দেখব” বলে শুয়ে পড়লেন তিনি। বাকি রাতটা তাঁর আর ঘুম এল না, নীলা অবশ্য আবার বেশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।
সকালে উঠে সুমিতবাবু দেখলেন বাতাসে পচা গন্ধটা তখনও রয়েছে, তবে রাতের থেকে কম। ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে। নীলা আজ আরও দুর্বল, কেমন যেন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাকে। ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে সে বলল তার পিঠে খুব ব্যাথা করছে। সুমিতবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন আজই যেমন করে হোক তারা চলে যাবেন শহরে, বড্ড রিস্ক হয়ে যাচ্ছে এই অবস্থায় এখানে থাকাটা। তাছাড়া রাতের ওই আলো আর ঝটপট আওয়াজের ব্যাপারটার জন্য তার একটা কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। দিনের আলোয় সেরকম কিছু মনে হয় না, কিন্তু কাল রাতে তিনি বেশ আতঙ্কিতই হয়ে পড়েছিলেন।
ডাক্তারবাবু এলেন সকাল এগারোটায়। নীলাকে পরীক্ষা করে তার ভুরু বেশ খানিকটা কুঁচকে গেল। “স্ট্রেঞ্জ, দু’ডোজ ওষুধ পড়ল, অথচ রক্ত আরও কমে গেছে শরীরে,” বলে কপালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন তিনি। কাবেরী দেবীর সেই শুনে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা, “ওগো, আজকেই এখান থেকে চলো, আর ঘোরার লোভ করে লাভ নেই।” নীলা ডাক্তারবাবুকে পিঠের ব্যাথার কথাটা বলতে তিনি নীলার পিঠ দেখে একটু থমকে গেলেন। পিঠের বেশ খানিকটা জায়গা ফুলে রয়েছে, অনেকটা ইঞ্জেকশন দিলে কিছুটা সময়ের জন্য যেমন হয় সেরকম।
সুমিতবাবু ডাক্তারকে জানালেন যে তাঁরা সেদিনই শহরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ডাক্তার বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না, তিনি যেন বেশ কিছুটা সংশয়ান্বিত। যাই হোক, সুমিতবাবু ডাক্তারের সঙ্গেই গেলেন টেন্টহাউস অফিসে, শহরে যাবার বন্দোবস্ত করতে। ওদিকে ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে, বৃষ্টি বাড়ছে।
ম্যানেজারকে তাদের চলে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানাতে একটা সমস্যার কথা জানা গেল। বোটিং স্টেশনে যাবার গাড়িটা গেছে বিগড়ে। আর সবথেকে বড়ো কথা ঝড়বৃষ্টিতে বোটিং সার্ভিস এখনকার মতো বন্ধ, আবহাওয়া ভালো না হলে আজকে আর চালু নাও হতে পারে। প্রমাদ গুনলেন সুমিতবাবু। মেয়ের টেন্ট হাউসে আসার আবদার শুনে রাজি হয়ে একটু বেশিই দুঃসাহস দেখানো হয়ে গেছে তাদের পক্ষে, মনে হল তাঁর।
ম্যানেজার তাকে বললেন, “আমি অনুরোধ করছি আপনারা আজকের দিনটা থেকেই যান, এই ঝড়বৃষ্টিতে জঙ্গুলে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আর যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। আমি কিন্তু ব্যবসায়িক দিক থেকে কথাটা বলছি না।” ডাক্তারও সায় দিলেন, নীলার শরীরে দুর্বলতা ছাড়া আর রক্তাল্পতা ছাড়া এমনি আর কিছু বিপদ নেই, কাজেই একদিনে আশা করা যায় বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না, আশ্বস্ত করলেন তিনি।
“আচ্ছা এখানে রাত্রিবেলায় তাঁবুতে কি কোনো পাখি-টাখি ঢোকে?” সুমিতবাবুর প্রশ্নে একটু অবাক হলেন ম্যানেজার। তাঁবুর সিস্টেম যা তাতে টেন্ট-ডোর লাগিয়ে দিলে পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র, শুধু একদম উপরে ভেন্টিলেশনের জন্য রাখা অতিক্ষুদ্র ফাঁক ছাড়া, ম্যানেজার জানালেন। বললেন, “ওই ফুটো দিয়ে চড়াইপাখিও ঢুকতে পারে না।” সুমিতবাবুও অবশ্য সে বিষয়টা খেয়াল করেছিলেন। একটু ভেবে তিনি বলেই ফেললেন ব্যাপারটা আমতা আমতা করে। সবুজ চিকমিকে আলোর আর ঝটপট আওয়াজের কথা শুনে ম্যানেজার আর ডাক্তারবাবু দু’জনেই হতবাক। “আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে,” ম্যানেজার বললেন।
“না হচ্ছে না, উনি ঠিকই দেখেছেন,” কথাটা এল পিছনদিক থেকে। সুমিতবাবু পিছনে ঘুরে দেখলেন একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে। আগের দিনও একে দেখেছিলেন সুমিতবাবু। অফিসের গার্ড বা দারোয়ান হবে, বেশ গম্ভীরভাবে নিমীলিত চক্ষে বসে থাকে অফিসের দরজার পাশে।
“ওয়েম্ফেই, ওয়েম্ফেই চীন,” চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠল লোকটি। ম্যানেজার একটু কাষ্ঠহাসি হেসে ‘ইডিয়ট’ বলে উঠলেন। “কী বলছেন উনি?” সুমিতবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
“ডোন্ট লিসেন টু হিম, চুয়ান ইজ ইন্টু ক্রেজি থিংস, ইজন’ট ইট ডক্টর?” ম্যানেজার হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেন ব্যাপারটা। সে শুনে চুয়ান, অর্থাৎ বয়স্ক লোকটি রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা শুরু করে দিল। সুমিতবাবু দেখলেন ডাক্তার নিশ্চুপ, কী যেন ভাবছেন।
বাইরে বেরিয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এ জিনিসটা কি আপনি শুধু রাতেই খেয়াল করছেন?” সুমিতবাবু হ্যাঁ বলাতে আবার একটু ভেবে ডাক্তার বললেন, “আজ রাতটা তো আপনাদের থাকতেই হচ্ছে। আজকে আপনি একটু কষ্ট করে জেগে থাকবেন, আর একজন প্রহরী তাঁবুর বাইরে থাকবে।” শঙ্কিত হয়ে সুমিতবাবু কারণ জিজ্ঞাসা করায় ডাক্তার বললেন, “কিছুই না, একটু সাবধান থাকা, ব্যাপারটা নিয়ে আমারও কৌতূহল হচ্ছে।” মাথা নাড়লেন সুমিতবাবু। খানিকক্ষণ চুপ করে একটু মনটা হালকা করার জন্য ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, “চুয়ানের কথায় মনে হচ্ছে একটা অন্যরকম টান, তাই কি?” ডাক্তার অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, “হুম, উনি থাই চাইনিজ। আমার মতোই।”
বৃষ্টি একটু ধরেছে। ডিনারের পর একটা চেনা গলায় ডাক শুনে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে সুমিতবাবু দেখলেন বাইরে চুয়ান দাঁড়িয়ে আছে। প্রহরী হাজির। কাঁধে তার একটা ঝোলা, হাতে একটা লাঠি। সব অস্ত্র কি ঝোলার ভিতরে? সুমিতবাবুর একটু হাসিই পেল। কিছুটা রহস্য করে চুয়ান তাকে বলল যে আজকে এক বিশেষ শক্তির বলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না, না ঘুমিয়ে তাঁরা যেন চুপচাপ শুয়ে থাকেন। সুমিতবাবু হালকা হাসলেন কিছু না বলে। লোকটা বোধহয় সত্যিই পাগলাটে।
রাত গভীর হল। নীলা থেকে শুরু করে কারও চোখে ঘুম নেই। কাবেরী দেবী চিন্তায় ছটফট করছেন। বাইরে নানা রাতজাগা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আচ্ছা পাখিদের গা থেকে কি কখনও আলো বেরোয়? শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবছিলেন সুমিতবাবু। কীরকম যেন বিভীষিকাময় লাগছিল রাতটা কোনো একটা অজানা আশঙ্কায়। বাইরে চুয়ানের হাঁটাচলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যদিও সেটা পরিস্থিতিটাকে বোধহয় আরও অদ্ভুতুড়েই করে তুলছিল।
প্রায় ভোর হয়ে আসছে। চোখ লেগে আসছে এবার। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে চুয়ানও জেগে না ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে। হঠাৎ তীব্র একটা গন্ধ নাকে এল সুমিতবাবুর। ঠিক সেইরকম, চামড়া-পচার মতো।
এমন সময় জোরে গুঙিয়ে উঠল নীলা। “কী হল, কী হল,” করে উঠে বসলেন সুমিতবাবু। অন্ধকারে তাঁর মনে হল নীলার গায়ে যেন একটা চকচকে মোটা চাদর নড়াচড়া করছে। এবার চেঁচিয়ে উঠল নীলা। “নী-লা-আ-আ” বলে আর্তস্বরে ডেকে উঠলেন কাবেরী দেবী।
এর পরে যা হল তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। নীলার গায়ের চাদরের মতো জিনিসটা যেন হাওয়ায় হঠাৎ ভেসে উঠল। আর সঙ্গে সেটা থেকে একটা সবুজ উজ্জ্বল আভা বেরোতে লাগল। জিনিসটা তাঁবুর ভেতরে এক কোণ থেকে আরেক কোণে ভেসে বেড়াতে শুরু করল ঝটপট করে। পাখির মতোই, কিন্তু অনেক বড়ো আকৃতির। এত বড়ো কোনো পাখি হয় বলে সুমিতবাবুর জানা নেই।
আতঙ্কে সুমিতবাবুর কন্ঠরোধ হয়ে গেছে, খাট থেকে নামা তো দূরের কথা। নীলা আরেকবার চেঁচিয়ে ওঠায় ভেজানো টেন্ট-ডোর ঠেলে ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ল চুয়ান। হতবাক সুমিতবাবু দেখলেন তার গায়ে তখন একটা অন্যরকম রঙচঙে পোশাক।
ঢুকেই সুর করে একটা মন্ত্র পড়তে লাগল চুয়ান। একটানা। উড়ে বেড়ানো জিনিসটা যেন হঠাৎ দিগভ্রষ্ট হয়ে গোঁত্তা খেল তাঁবুর এক কোণে। পরমুহূর্তেই সেটা সরে ক্রমে উপরে উঠতে থাকল। চিকমিক চিকমিক জোনাকির মতো সেই আলো দেখা যাচ্ছে এখন। চুয়ান এবারে একটা আয়না তার দিকে তাক করায় সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে গোটা তাঁবু কেমন একটা অপার্থিব রূপ ধারণ করল। স্বপ্ন দেখছেন না সত্যি, কাবেরী দেবী বুঝতে পারছিলেন না। সুমিতবাবু এখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
জিনিসটার সঙ্গে তখন যেন চুয়ানের একটা যুদ্ধ চলছে। সে যত উপরে উঠতে চায়, কোন অদৃশ্য টানে তার খালি নিচে পড়ার উপক্রম হয়। দুটো পরস্পরবিরোধী শক্তি যেন একে অপরের সঙ্গে যুঝছে, সুমিতবাবুর স্ট্যাটিক্সের অঙ্কের মতো। এর মধ্যে নীলা দৌড়ে তার মায়ের কাছে চলে এসেছে। আতঙ্কে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছেন মা-মেয়ে।
সহসা চুয়ান ‘ওয়েম্ফেই জিয়াংশি ওয়েম্ফেই জিয়াংশি’ বলে জোরে মন্ত্র পড়তে পড়তে ঘরময় কতগুলো কয়েন ছুঁড়তে লাগল। আর একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে সোজা উপরে উঠে যেতে লাগল উড়ন্ত বস্তুটা। চুয়ান ঘরের মাঝে চলে এল। সজোরে তার লাঠি ঘোরাতে থাকল প্রবল জিঘাংসায়। রকেটের মতো সবেগে উড়ে প্রাণীটা তাঁবুর চূড়ার কাছে উঠে গেল। তারপরে ঝপ করে একটা শব্দ। কিছু একটা এসে মেঝেতে পড়েছে।
তীব্র একটা হুঙ্কার দিয়ে চুয়ান হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেটার উপর। দিয়ে একটা উল্লসিত চিৎকার করে উঠল সে। নিজেই আলো জ্বালিয়ে সুমিতবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ডিমন গন। ইউ সেফ নাউ।” মুখে তার একটা তৃপ্তির হাসি, সারা শরীরে ঘাম ঝরছে। পুরোনো কোনো চীনা সিনেমার চরিত্রের মতো লাগছে তাকে দেখতে।
“কাম স্যার, সি,” বলে উঠল সে। কিন্তু সুমিতবাবুর তখনও সম্বিত ফেরেনি। মিনিটখানেক বসে একটু ধাতস্থ হয়ে তিনি চুয়ানের কাছে গিয়ে দেখলেন মেঝেয় একটা কালো চামড়ার মতো জিনিস পড়ে রয়েছে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে তিনি বুঝলেন জিনিসটা একটা আলখাল্লা জাতীয় পোশাক, অনেকটা কেপ-এর মতো।
ততক্ষণে অল্প অল্প ভোরের আলো ফুটেছে। নীলা এখন আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছে এক পাশ ফিরে। কাবেরী দেবী তো বটেই, সুমিতবাবুও বিহ্বল। এমন সময় ডাক্তার সাহেব এসে ঢুকলেন তাঁবুতে। চুয়ান তাকে দেখেই তৃপ্ত স্মিতহাস্য হাসল। নিজেদের ভাষায় কিছু কথা হল তাদের মধ্যে। চুয়ানের কথা শুনে আর পড়ে থাকা আলখাল্লা দেখে ডাক্তারের চোখ ক্রমশঃ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠছিল। চুয়ানকে রীতিমতো সসম্ভ্রমে অভিবাদন করলেন তিনি, চুয়ানের মুখে তখন অদ্ভুত এক আভা। এরপর অন্য কোনো কথা বলার আগে ডাক্তার প্রথমে নীলাকে পরীক্ষা করে দেখলেন। আজ অনেক নিশ্চিন্ত লাগল তাকে। নীলাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে তিনি সুমিতবাবুকে
বললেন, “খেলাধুলা করা মেয়ে বলে এই রাতের আতঙ্কের গোপন আক্রমণ সহ্য করতে পেরেছে, দুর্বল প্রকৃতির মেয়ে হলে হার্টফেল করে মারা যেত।”
“কিন্তু যা দেখলাম সেটা কী?” কোনোরকমে জিজ্ঞাসা করলেন সুমিতবাবু।
“আমি একজন ডাক্তার। আমি যা বলব তা অন্যসময় শুনলে আপনারা হয়তো আমাকে পাগল ভাবতেন, বা আদৌ আমি ডাক্তার কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ করতেন। কিন্তু আপনারা প্রত্যক্ষদর্শী, তাই নির্দ্বিধায় আপনাদের বলতে পারছি। যেটা দেখেছেন সেটা একধরনের ভ্যাম্পায়ার, মানে রক্তচোষা।”
“মানে বাদুড়?”
“না ঠিক বাদুড় না। এই জিনিসটা ঠিক কোনো জীবন্ত প্রাণী নয়।”
আবার বাক্যহারা অবস্থা সুমিতবাবুর। ডাক্তার বলতে লাগলেন, “এরা একরকম মন্ত্রসিদ্ধ পিশাচ বা জোম্বি। কোনো অল্পবয়সির মৃতদেহকে আশ্রয় করে এরা ঘুরে বেড়ায়। এদের শেপ শিফটিং-এর ক্ষমতা রয়েছে, ফলে মনুষ্য চেহারা থেকে এরা উড়ন্ত রূপ ধারণ করতে পারে। প্রকৃতিগত ভাবেই এদের মানবরক্ত, বিশেষ করে অল্পবয়সি মানুষের রক্ত লাগে। তাই নানাভাবে এরা মানুষকে আক্রমণ করে।”
কাবেরী দেবী শিউরে উঠে নীলাকে জড়িয়ে ধরলেন।
“আপনি এর মুখোমুখি হয়েছেন আগে কখনও?” ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন সুমিতবাবু।
“না, ইন ফ্যাক্ট এবারেও তো দেখতে পেলাম না। চীনা উপকথায় এদের ব্যাপারে শোনা যায়, কিন্তু একজন শহুরে শিক্ষিত লোকের মতো আমিও এদের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিলাম। এদের ব্যাপারে বহু শুনেছি। চুয়ান, যিনি আমার অনেক দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন, আমাকে এদের অনেক গল্প বলেছেন।”
“গুড, ইউ বিলিভ নাউ,” হেসে বলল চুয়ান।
মৃদু হেসে ডাক্তার বলতে লাগলেন, “নীলার ঘাড়ে পিঠে পরীক্ষা করে আমার হুল ফুটিয়ে রক্ত পান করার কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু কে পান করছে রক্ত? মশা তো হতে পারে না। চুয়ান আমাকে প্রথম দিনই ওয়েম্ফেই জিয়াংশি অর্থাৎ রক্তচোষা পিশাচের কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। অথচ হিসেব মিলছিল না কিছুতেই। নীলার ওই আচ্ছন্ন ভাবটা হত সম্ভবত ভ্যাম্পায়ারটির স্প্রে করা স্যালাইভা থেকে। এইভাবে শিকারকে আচ্ছন্ন করে ও বারে বারে একটা সরু সিরিঞ্জের মতো হুল ফুটিয়ে রক্তপান করত। এই হুল এত সরু যে ঘাড়ে বা পিঠে ফোটালেও চারিদিকে সামান্য ফোলা ছাড়া আর কোনো চিহ্ন থাকে না। আজকে রক্তপান করার সময়ে ও ধরা পড়ে, ফলে দ্রুত পালাতে গিয়ে ওর হুল জোরে ফুটে যায় নীলার পিঠে, তাই কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়েছে নীলার পিঠে।”
“কিন্তু এত বড়ো একটা জিনিস টেন্টে ঢুকল কী করে? আর কোথায়ই বা উবে গেল?”
“এদের শুধু নানারকম চেহারা ধরার ক্ষমতা আছে তাই নয়, এরা নিজের দেহকে ইচ্ছেমতো ছোটো বড়ো বা সরু মোটা করে নিতে পারে। তাই যে ছোটো ছিদ্র ধরে ছোট্ট পাখিও ঢুকতে পারে না, সেটা দিয়ে ঢোকা বেরোনো এদের পক্ষে কোনো ব্যাপার নয়। কালকে আপনি যখন চামড়া পচার গন্ধ আর সবুজ আলোর কথা বললেন তখনই আমার কিছুটা বিশ্বাস হল চুয়ানের কথায়, কারণ ঠিক এই বর্ণনাই আমি উপকথার বইতে পেয়েছি, চুয়ানের মুখেও শুনেছি।”
“কিন্তু উনি এত কিছু জানলেন কী করে?”
চুয়ান হাসছে মিটিমিটি। ডাক্তার বললেন, “উনি একজন চীনা তান্ত্রিক বংশের সন্তান। পূর্বপুরুষক্রমে ওঁর পরিবার নানা অপদেবতা পিশাচসিদ্ধদের নিয়ে কাজ করে এসেছে। অবস্থার ফেরে ওঁকে প্রহরীর চাকরি নিতে হলেও পারিবারিক শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগ উনি কিশোর বয়স থেকেই করে এসেছেন বলে শুনেছি। আপনার বর্ণনা শুনে আমার কেমন প্রত্যয় হয়েছিল যে হয়তো আমাদের জানাশোনার বাইরে অনেক কিছু থাকতেও পারে যা বাস্তবে ঘটে। আজ প্রমাণ পেলাম।”
কৃতজ্ঞতাভরে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন কাবেরী চুয়ানকে। মাথা নেড়ে অভিবাদন করল চুয়ান। সুমিতবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু এই ওয়েম্ফেই গেল কোথায়? এরা থাকেই বা কোথায়?”
চুয়ান বলে উঠল, “এরা যেখান থেকে আসে, সেখানেই আপাতত ফিরে গেল। সেটা এক অন্য জগৎ, আমাদের চক্ষু কর্ণের গোচরের বাইরে, অন্য স্তরে। সেখানে আমরাও পৌঁছোতে পারব না।”
“এই চামড়ার মতো জিনিসটা এদের পোষাক, আসুন সেটা দেখা যাক,” বলে তাঁবুর কোণে গিয়ে হঠাৎ চমকে চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার।
“কী হল?” সুমিতবাবু বলে উঠলেন।
“দ্য কেপ হ্যাস ভ্যানিশড্।”
সত্যিই দেখা গেল এতক্ষণ যেখানে ওই কেপ-টি পড়ে ছিল সেখানে মেঝেতে কিচ্ছু পড়ে নেই। তাঁবুতে কোথাও আর খুঁজে পাওয়া গেল না সেটিকে। এবার সুমিতবাবুর সঙ্গে ডাক্তারও হতবাক।
চুয়ান বিড়বিড় করে কী মন্ত্র পড়ে মৃদু হেসে বলল, “যেখানে থাকে সেখানেই নিয়ে গেছে।”
এই সময় কাবেরী দেবী বলে উঠলেন, “থাক, ওসব ভেবে আর আমাদের কাজ নেই, এখন ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরুক।” নীলার বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলার দিকে তাকালেন।
নীলা তখন এক দৃষ্টিতে তাঁবুর উপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
ম্যাজিক ল্যাম্প 



No comments:
Post a Comment