
সেই রাতের গল্প
বনবীথি পাত্র
সে অনেক বছর
আগের কথা। তখন এমন হাতে হাতে মোবাইল ফোন তো দূরের কথা ল্যাণ্ডফোনও থাকত পাড়ার
দু-একটা বড়োলোক বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকত চিঠিপত্রের মাধ্যমে।
দুপুরবেলা বাড়ির সদর দরজায় কড়া নেড়ে পিওন এসে চিঠি দিয়ে যেত। আর তেমন কোনো
গুরুত্বপূর্ণ খবর হলে টেলিগ্রাম আসত। টেলিগ্রাম শুনলেই বুকের মধ্যে একটা ভয় ছলাৎ
করে উঠত, এই বুঝি কোনো খারাপ খবর এল। সেবার
পুজোর আগে আগে আমাদের বাড়িতেও টেলিগ্রাম এল। বাবা অফিস গেছে। আমি সেদিন স্কুল
যাইনি। বাবার অফিসে টানা ছুটি বলতে শুধু এই পুজোর দিন ক’টাই। তাই প্রতিবারই এই সময়
আমাদের নিয়ে বাবা বেড়াতে যেত। খুব যে দূরে কোথাও এমনটা নয়। পুরী, দিঘা, বিষ্ণুপুর, শান্তিনিকেতন। বাবার এক ছোটোবেলার বন্ধু থাকে জামশেদপুরে।
সেবার আমরা ওই কাকুর বাড়িতেই যাব। ওখান থেকে আমরা রাঁচি যাব। কাকুরাও আমাদের সঙ্গে
যাবে। কাকুর দুটো মেয়ের ছোটো মেয়েটা নাকি আমারই বয়সি। তার
সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়তি পাওনা হবে আমার। শেষ বেলায় সব গোছাতে গিয়ে ঠিক কিছু না কিছু
ভুল হয়ে যায়। তাই মা এবার সময় থাকতে ব্যাগপত্র গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে। আর সেই
উপলক্ষ্যে আমিও সেদিন আর স্কুলে যাইনি। বাবা আর দাদা বেরিয়ে যাওয়ার পর মা রান্নার
পাট মিটিয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগে। আমি মাকে সাহায্য করছিলাম। ওইসব করতে গিয়েই অনেকটা
বেলা হয়ে গেল। আমার খিদে পেয়ে গিয়েছে। মা স্নান করে বেরিয়েই খেতে দেবে। তখনই
টেলিগ্রামটা এল। আমি তো তখন সবে ক্লাস টুতে পড়ি, টেলিগ্রাম
কি আর পড়তে পারি! টেলিগ্রাম শুনেই মা তো কোনোরকমে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসে
বাথরুম থেকে। আমার হাত থেকে টেলিগ্রামের কাগজটা নিয়েই তো মায়ের মুখের চেহারা যেন
পালটে গেল। আমিও ভয় ভয় গলায় শুধোলাম, “কী খবর মা? কার কী হয়েছে?”
মা
টেলিগ্রামের কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “যত্ন
করে রেখে দে, বাবা অফিস থেকে এসে দেখবে। তোর
পিসিঠাম্মা খুব অসুস্থ, আমাদের
সবাইকে দেখতে চাইছেন।”
বাবার ছোটোপিসিকে
আমি আর দাদা পিসিঠাম্মা ডাকি। আগে পিসিঠাম্মা মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি আসত, কিন্তু এখন বয়স হয়েছে বলে আর আসতে পারে না। বাবা যখন ছোটো
তখন আমার ঠাকুমা মারা গিয়েছিল। এই
পিসিঠাম্মার কাছেই বাবা মানুষ হয়েছে। এসব কথা পিসিঠাম্মার মুখেই শুনেছিলাম। বাবার
ছোটোবেলার দুষ্টুমির সব গল্প আমি আর দাদা পিসিঠাম্মার কাছে যে কতবার শুনেছি তার
হিসাব নেই। যতবার শুনতাম সব যেন নতুন লাগত। টেলিগ্রামের কাগজটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই
থাকলাম। মনটা ভীষণ খারাপ করছে। তবে সেটা পিসিঠাম্মার জন্য নয়। এখন বাবা যদি
পিসিঠাম্মাকে দেখতে যায়, তাহলে তো
আমাদের রাঁচি যাওয়াটাই হবে না। আমি যে রাঁচি বেড়াতে যাওয়ার কথাটা ইস্কুলে বন্ধুদের
কতদিন আগে থেকে বলে রেখেছি। মা উঠোনের দড়িতে ভিজে জামাকাপড় মেলতে মেলতে বোধহয় আমার
মনখারাপটা বুঝতে পারে। কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বলে, “কী
হল?”
করুণস্বরে
বললাম, “আমাদের রাঁচি যাওয়াটা হবে না মা?”
মা বলল, “একজন মানুষ অসুস্থ, আমাদের
দেখতে চাইছেন। এখন নিজেদের বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবতে আছে? রাঁচি
তো আমরা পরেও যেতে পারব।”
বাবা অফিস
থেকে ফিরল সন্ধেবেলা। টেলিগ্রাম দেখে যথারীতি আমাদের জামশেদপুর-রাঁচি
যাওয়ার সব পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল। পুজোর ছুটি পড়ার মুখে অফিসে কাজের খুব চাপ, ছুটি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাঝে তো আর পাঁচটা মাত্র
দিন। যেদিন আমাদের জামশেদপুর যাওয়ার কথা ছিল, সেদিনই
আমরা পিসিঠাম্মার কাছে যাব। বাবা আমার
আর দাদার মনখারাপটা বুঝতে পেরে বলল, “ওই
গ্রামের নামটা না খুব সুন্দর, অকালপৌষ। আর
গ্রামটাও ভীষণ সুন্দর। স্টেশন থেকে গ্রামের ভেতরে যাওয়ার রাস্তার দু’ধারে সবুজ
চাষের জমি। মাঝে মাঝেই পুকুর দেখতে পাবি। পিসিমাদের নিজেদের একটা পুকুর আছে। আমরা
ছোটোবেলায় ওই পুকুরেই তো সাঁতার শিখেছিলাম।”
দাদা এতক্ষণ
মুখভার করে বসেছিল। সাঁতার শেখার কথায় উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠে, “আমাকে সাঁতার কাটাটা এবার শিখিয়ে দিতে হবে কিন্তু....”
দাদা সাঁতার
শিখবে আর আমি শিখব না, এমনটাও কি হতে পারে! আমিও বায়না
ধরলাম, আমাকেও সাঁতার শেখাতে হবে।
বাবা দু’জনকেই
অভয় দিল। তবে একটু সন্দেহের সুরে বলল, “কতদিন
সাঁতার কাটি না, শরীর ভারি হয়ে গেছে। কী জানি, আর কি
পারব সাঁতার কাটতে?”
তারপর মঈদুল
চাচার কাছে বাবার সাঁতার শেখার গল্প শুনতে শুনতেই সেদিনের সন্ধেটা কেটে গেল। দেখতে
দেখতে কেটে গেল পাঁচটা দিন। যেদিন সকালে আমাদের রওনা হওয়ার কথা, সেদিন সকালেও কী একটা যেন জরুরি কাজ পড়ে গেল বাবার। অগত্যা
সকালের ট্রেন বাদ দিয়ে দুপুরের ট্রেনে রওনা হলাম আমরা। পুজোর শেষ মুহূর্তের
কেনাকাটায় রাস্তায় বিশাল ভিড়। জ্যামে আটকাতে আটকাতে বাস যেন আর এগোতেই পারছে না।
ওদিকে ট্রেনের টাইম হয়ে আসছে। কোনোরকমে বাস থেকে নেমেই বাবা ছুটল টিকিট কাউন্টারের
দিকে। আর আমরা ব্যাগপত্র দিয়ে বাবাকে ফলো করছি।
শেষ অবধি
সবাই মিলে ট্রেনে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। দুপুরের ট্রেন হলেও
মোটামুটি ভিড় আছে। কোনোরকমে খুঁজেপেতে মা আর দাদার বসার জায়গা হল। দু-একটা স্টেশন
পরে একটা জায়গা ফাঁকা হলে বাবা বসার ব্যবস্থা করে রাখল। আর আমি দু’দিকের সিটের
মাঝে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওই ভিড়ে চাপাচাপি করে বসার থেকে এই বেশ। জানলা দিয়ে
বেশ ফুরফুরে হাওয়া আসছে। বাবা ব্যাগগুলো কোনোটা সিটের নিচে, কোনোটা বাঙ্কে তুলতে গিয়ে এতক্ষণে খেয়াল করল, পিসিঠাম্মার জন্য কেনা রসমালাইয়ের ভাঁড়টা বাসেই থেকে গেছে।
এখনকার মতো প্যাকেটে মিষ্টি দেওয়া চালু হয়নি তখনও। বাবা দোষারোপ করল মাকে, মা ধমক দিল দাদাকে। দাদার হাতেই নাকি মিষ্টির ভাঁড়টা ছিল।
সবার সামনে বকুনি খেয়ে দাদার মুখভার হয়ে গেল। একটু পরেই বারো ভাজা বিক্রি করতে
এলেই বাবা আমাদের দু-ভাই-বোনকে তা কিনে দিতেই দাদার মুখভার গায়েব।
মা দু-একবার
মায়ের কোলে বসার জন্য ডাকাডাকি করলেও আমি জানলার ধারে দাঁড়িয়েই ভালো আছি। আমি কি
আর ছোটো আছি যে মায়ের কোলে বসব! জানলা দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
মাঠঘাট, গ্রাম, শহর
সব পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। স্টেশন এলে ট্রেন থামছে। শুরু হচ্ছে যাত্রী
ওঠানামার হইচই। কেউ ট্রেন থেকে নামার জন্য ব্যস্ত, কেউ বা জিনিসপত্র নিয়ে ট্রেনে ওঠার জন্য তাড়াহুড়ো করে।
নির্দিষ্ট সময় থেমে ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বেলা ফুরিয়ে আসছে। মাঠে
ছেলেরা ফুটবল খেলছে। মেয়েরা দলবেঁধে ছোটাছুটি করছে। কী যে খেলছে বুঝতেই পারলাম না।
কী ভীষণ নীল লাগছে আকাশটা। তার মাঝে থোকা থোকা সাদা মেঘের দল। দাদা জলরঙ দিয়ে যেমন
আকাশ আঁকে ঠিক যেন তেমনটা। দূরে সূর্যটা হেলে পড়েছে আকাশের গায়ে, আর একটা অদ্ভুত কমলা রঙের আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আগে কোনোদিন
আমি এত সুন্দর আকাশ দেখেছি বলে মনেও করতে পারছি না। দূরে পাকা রাস্তা দিয়ে একটা
লরি আমাদের ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসতে আসতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। শুধু লরিটা নয়, রাস্তাটাও আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই ডান চোখে কী যেন
পড়ল। ভীষণ কড়কড় করছে। ডান হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে চলে এলাম মায়ের কাছে। মা তো
সঙ্গে সঙ্গে জলের বোতল থেকে জল বের করে ঝামটা দিল চোখে। চোখে নাকি ইঞ্জিনের কয়লা
উড়ে এসে পড়েছে। এখনকার মতো ইলেকট্রিক ট্রেন তো দূরের কথা, তখন
লোকাল ট্রেনে ডিজেল ইঞ্জিনও ছিল না। কয়লার ইঞ্জিনে ট্রেন চলত। আর মাঝেমধ্যেই এমন
কয়লাকুচি উড়ে এসে যাত্রীদের ভোগান্তির কারণ হত। মা কাপড়ের খুঁট সরু করে পাকিয়ে যত
আমার চোখ টেনে খুলে কিছু পড়েছে কিনা দেখতে যায়, আমি
ভয়ে তত শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নিই। কতক্ষণ যে এই পর্ব চলল কে জানে! শেষ অবধি চোখের
কড়কড়ানি বন্ধ হল। তাও আর জানলার ধারে ফিরে গেলাম না। মায়ের পাশে একটুখানি জায়গায়
আমাকে বসতে দিয়ে একজন উঠে গেল। আমি ওখানে বসে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে থাকলাম।
ট্রেনের দুলুনিতে এতক্ষণ পর আরাম করে বসতে পেয়ে বোধহয় একটুখানি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।
বাবার ডাকাডাকিতে ধড়মড় করে জেগে উঠলাম। সামনেই আমাদের স্টেশন আসছে, নামতে হবে। ব্যাগপত্র সব নিয়ে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। যখন
স্টেশনে নামলাম, সূর্য অস্ত গেছে। ঝুলমাখা অন্ধকার
চারদিকে। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা টিমটিমে হলুদ আলো জ্বলছে স্টেশন জুড়ে।
ধূ ধূ ফাঁকা
স্টেশন। আমরা চারজন ছাড়া আর জনা চার-পাঁচ মানুষ যারা ট্রেন থেকে নেমেছে, তারা ছাড়া আর কোনো মানুষজন নেই। এমন স্টেশন আগে কখনও
দেখিনি। কোথাও কোনো শেড, ওভারব্রিজ, স্টল কিছুই নেই। অনেকটা দূরে একটা টিনের শেড দেওয়া একটা লাল
ইটের ঘর। আর প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে একটা বড়ো লোহার কালো ফলকে হলুদ রঙ দিয়ে লেখা
‘বাঘনাপাড়া’। আমি তো বাবাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, “এই পাড়ায় কি বাঘ থাকে বাবা?”
দাদা আমার
চুল টেনে বলে উঠল, “তুই কি বাঘপাড়া লেখা আছে দেখছিস? ভালো করে দেখ, লেখা আছে
বাঘনাপাড়া।”
আমার চুল
টেনে দেওয়ার জন্য মায়ের কাছে নালিশ করতে যেতেই মা আমাদের দু’জনকেই ধমক দিয়ে বলল, “রাস্তাঘাটেও এমন ঝামেলা করলে আর কোনোদিন কোথাও নিয়ে আসব
না।”
তারপর
বাবাকে বলল, “এই ভর সন্ধেতে কোন্ ধাপধরা গোবিন্দপুরে নিয়ে
এলে গো! স্টেশন থেকে গ্রাম তো অনেকখানি দূর। ছেলেপুলে নিয়ে ভালোয় ভালোয় পৌঁছাতে
পারব তো?”
বাবার
চোখেমুখেও চিন্তার ছাপ। একটু গম্ভীর গলাতেই বলে, “সেই
বিয়ের আগে শেষ এসেছিলাম। এত বছরেও এতটুকু কোনো উন্নতি হয়নি দেখছি। চলো আর দাঁড়িয়ে
থেকে লাভ নেই। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি গ্রামে যাওয়ার কী ব্যবস্থা রয়েছে।”
প্লাটফর্ম
ধরে হেঁটে এসে সেই লাল ঘরটার পাশ দিয়ে বাইরে বেরোনোর রাস্তা। বাইরেটাও শুনশান।
কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই। আমি তো ভয়ে ভয়ে একেবারে মায়ের কোল ঘেঁষে হাঁটছি। একটা
ছোটো চায়ের গুমটি দোকান নজর পড়তেই বাবা সেখানে গিয়ে জানতে চাইল, “ভাই, অকালপৌষ যাব, ভ্যান
বা গরুর গাড়ি কিছু পাওয়া যাবে?”
লোকটা
অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দেখে একটু বিরক্তির স্বরে বলে, “তা
কতদিন পর আসা হচ্ছে এ তল্লাটে?”
উত্তরের
অপেক্ষা না করে নিজেই বলে, “ওই
শিরীষতলায় তো ভ্যানগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। এগিয়ে গিয়ে দেখেন কেউ আজ সে গাঁয়ে যেতে চায়
কি না!”
“কেন আজ কী
হয়েছে?”
মা লোকটাকে
কথাটা জিজ্ঞাসা করল বটে, কিন্তু বাবা
ততক্ষণে দাদার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে উত্তরটা না শুনেই মা-ও আমার হাত ধরে
হাঁটতে লাগল বাবার পিছু পিছু। মাটির এবড়োখেবড়ো পথ, এইটুকুতেই
দু’বার হোঁচট খেলাম। সঙ্গে মায়ের বকুনিও। শিরীষতলায় এসে অনেকগুলো ভ্যান চোখে পড়ল।
ভ্যানগুলো আবার নৌকার মতো ছাউনি দিয়ে ঘেরা। কিন্তু কেউ তো ওই গ্রামে যেতে রাজিই
হচ্ছে না। আজ দিনের বেলায় নাকি হিন্দু-মুসলমানে বেজায় ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হয়েছে। একজন
মারাও গেছে। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে কয়েকজনকে। এখন মুসলমান পাড়া পেরিয়ে যেতে গেলে ওরা
নাকি লাশ ফেলে দেবে।
বাবা-মায়ের
তখন দিশেহারা অবস্থা। কী করবে বুঝতে পারছে না। মা বিরক্তির সুরে বলে, “তখনই বলেছিলাম, আমাদের আজ
আসার খবরটা টেলিগ্রাম করে দাও। তাহলে তো কেউ অন্তত আমাদের এগিয়ে নিতে স্টেশনে আসত!
তা নয় কী বললে, না বলে এসে একেবারে সবাইকে চমকে দেবে।”
বাবা
নিশ্চুপ। উত্তর দেওয়ার মতো কোনো উত্তর বোধহয় ছিল না বাবার কাছে। হঠাৎই একজন ভ্যানওয়ালার কী মনে হল কে জানে, ভ্যানটা সামনে এগিয়ে এনে বলে, “চাপেন
মা জননী। খোকা-খুকু তোমরাও উঠে বসো দেখিনি। আপনিও ওঠেন কত্তা। তবে জোড়া দিঘি অবধি
পৌঁছে দেব আমি। তার বেশি যেতে পারবনি।”
বাবার মুখ
দেখে মনে হল জোড়া দিঘি থেকে বোধহয় পিসিঠাম্মার বাড়ি বেশি দূর নয়। বাবা উৎফুল্ল হয়ে
বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, তাই
চলো ভাই। ওটুকু না হয় হেঁটেই চলে যাব আমরা। এই সব ভ্যানে সাবধানে উঠে বস তো....”
পথে কোনো
আলো নেই। আকাশেও নখের মতো একফালি চাঁদ। আলো বলতে ভ্যানের সামনে ঝোলানো একটা ছোটো পুঁচকে
হ্যারিকেন। ডানে বাঁয়ে হেলতে দুলতে ভ্যান চলছে। শক্ত করে ধরে না বসলে উলটে পড়ে যাব
মনে হচ্ছে। ছাউনির ভেতর থেকে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করেও কিছুই দেখতে
পেলাম না। অনেক দূরে শুধু জোনাকির মতো কিছু আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। ওইটাই নাকি
গ্রামের নিশানা। তবে গ্রামের নিশানার অনেক আগেই ভ্যান থেমে গেল। জোড়া দিঘি এসে
গেছে। ভ্যান থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ভ্যানওয়ালা চলে গেল। শিরশিরে ঠাণ্ডা
হওয়ায় বেশ শীত শীত করছে। অন্ধকারেই চোখ যেন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে এসেছে। দুটো দিঘির
মাঝখানের পথ দিয়ে হাঁটছি আমরা। হঠাৎ দূর থেকে কে যেন হাঁকল, “এই আঁধারে ও পথে কে যায়?”
আমি আর দাদা
দু’জনেই তো ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছি। আমার মনে তখন বীরপুরুষ কবিতার ডাকাত পড়ার ঘটনাটা
মনে পড়ছে। বাবা হেঁকে বলে, “চৌধুরীদের
বাড়িতে যাচ্ছি। কলকাতা থেকে আসছি আমরা...”
“ছোটন বাবা?”
বাবার
ডাকনাম ছোটন। বাবা এতক্ষণের হারিয়ে যাওয়া সব মনোবল যেন ফিরে পেয়েছে এমন গলায় বলে, “মঈদুল চাচা তুমি! এত রাতে পথে কী করছ?”
অন্ধকারের
মানুষটা ততক্ষণে কাছে এগিয়ে এসে মায়ের হাত থেকে একটা ব্যাগ নিজের হাতে নিতে নিতে
হাসি হাসি গলায় বলে, “এই তোমাদের জন্যই তো অপেক্ষা
করছিলাম। গাঁয়ের অবস্থা ভালো না। এই রাত বিরেতে বৌমা আর ছেলেপুলে নিয়ে আসাটা মোটেও
ঠিক করো নাই।”
আমি অবাক
হয়ে শুধাই, “আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলে বললে যে, আমরা আসব তুমি কি জানতে?”
হাসতে হাসতে
আমাকে কোলে তুলে নেয় লোকটা, “জানতাম তো দিদিভাই। আমি যে সব কিছু আগে থেকে জানতে
পারি।”
বাবার মুখে এই
মঈদুল চাচার গল্প আমরা অনেক শুনেছি। এটা সেটা কথা বলতে বলতে কখন যে পথটুকু পেরিয়ে
এলাম বুজতেই পারিনি। গ্রামে ঢুকতে তবু দু-চারটে মানুষের বাড়ি, কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। আলো জ্বলছে ঘরে ঘরে। রাস্তাঘাট যদিও
অন্ধকার। আমাকে কোল থেকে নামিয়ে মঈদুল চাচা বলে, “ওই
দেখো তোমার পিসিমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আর কোনো ভয় নাই তোমাদের। এবার আমি চলি গো ছোটন
বাবা।”
“তুমিও চলো
আমাদের সঙ্গে। একটু চা খেয়ে...”
মায়ের মুখের
কথা শেষ না হতেই অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেল মানুষটা। বাবা হেসে বলে, “মঈদুল চাচা সেই আগের মতোই রয়ে গেল!”
আমাদের দেখে
তো পিসিঠাম্মার বাড়িতে একেবারে হইচই পড়ে গেল। জেঠু অবশ্য এত রাতে আসার জন্য বকাবকি
করছিল। আগে খবর পাঠালে বাড়ি থেকে গরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিত। খিদে পেয়েছিল খুব। হাত-মুখ
ধুতে ধুতেই এত রাতে আর অন্য কিছু না খেয়ে একেবারে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়
জেঠিমা। ইস্, তখনই লোডশেডিং! হ্যারিকেনের আলোয় গোল হয়ে খেতে বসেছি আমরা। বাবা, জেঠু আর কাকা খেতে খেতে গল্প করছে। মা ভাত মেখে খাইয়ে
দিচ্ছে আমাকে।
“স্টেশন
থেকে কোনো ভ্যানই তো আসতে চাইছিল না। শেষে একজন তো তাও ওই জোড়া দিঘি অবধি পৌঁছে
দিয়ে গেল। তবে আজ মঈদুল চাচার সঙ্গে দেখা না হলে এটুকু পথে হেঁটে আসতে পারতাম কিনা
কে জানে! এতবছর পর এই অন্ধকারে রাস্তা চিনতে না পারলে আর এক কেলেঙ্কারি হত।”
খাওয়া
থামিয়ে জেঠু আর কাকা একসঙ্গে বলে ওঠে, “মঈদুল
চাচা!”
জেঠিমা
হাতায় করে তরকারি দিতে গিয়ে থমকে যায়।
বাবা বলে, “হ্যাঁ, মঈদুল চাচাই তো পৌঁছে দিয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করো তোমার
বৌমাকে। খুকুকে কোলে নিয়ে পুরোটা পথ এল...”
বাবার কথাটা
শেষ হওয়ার আগেই কাকা বলে ওঠে, “কিন্তু
মঈদুল চাচার তো আজকের দাঙ্গায় বুকে গুলি লেগেছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা
গেছে।”
পুরো ঘরটা
নিমেষে কেমন যেন থমথমে। অনেকদিন আগের কথা হলেও মনে পড়ে সেই মুহূর্তে একটা শব্দই
বেরিয়েছিল আমার মুখ দিয়ে,
“ভূঊঊঊঊততত...”
তারপর আর
কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরেছিল নাকি অনেক রাতে। পরে শুনেছি, যে জামাটা পড়ে আমি মঈদুল
চাচার কোলে চেপে এসেছিলাম, সেই
জামাটাতে নাকি রক্তের দাগ লেগেছিল। আমি ভয় পাব বলে সেটা অবশ্য আমাকে কেউ আর
দেখায়নি...
----------
ছবি - শ্রীময়ী
ছবি - শ্রীময়ী
No comments:
Post a Comment