
হুঁশ
অমিতাভ সাহা
(১)
অমিতাভ সাহা
চুল কাটানো নিয়ে মহা জ্বালায় পড়েছি। রোববার ছাড়া
ফুরসত পাই না। অন্যদিন অফিস থাকে। আর রোববার করে সেলুনে যা ভিড়! বাড়ির আশেপাশে কাছাকাছির
মধ্যে তিন-চারটে সেলুন আছে। সকাল দুপুর যখনই যাই, চার-পাঁচ জনের লাইন। একটা সেলুন
ছেড়ে আরেকটায় যাই। সেখানেও একই অবস্থা। ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করা অত্যন্ত
বিরক্তিকর। বিকেলের দিকে অবশ্য ফাঁকা থাকে। কিন্তু তখন যেতে ইচ্ছে হয় না। আসলে ছোটোবেলা
থেকে অভ্যেস সকাল সকাল চুল কাটিয়ে এসে চান করে নেওয়া। তিন হপ্তা ধরে ঘুরছি। মাথা
ভর্তি চুল, গালভরা দাড়ি নিয়ে পুরো উশকোখুশকো অবস্থা।
এখন আবার ইয়ার এন্ডিংয়ের সময়। অফিসে ভীষণ কাজের
চাপ। সমস্ত পেন্ডিং কাজগুলো দ্রুত কমপ্লিট করতে হবে। ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি
সাহেব প্রায়শই তাগাদা দিচ্ছেন। সব জেলার আধিকারিকদের নিয়ে মিটিং
করছেন, কাজের খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং কাজ শেষ করার ডেডলাইন ফিক্স করে দিচ্ছেন। এর আগে দু’বার ডেডলাইন মিস করেছি এবং তার জন্য গালমন্দ শুনতে হয়েছে।
এবার ডেডলাইনের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে আর মুখ দেখানো যাবে না। অ্যাকচুয়ালি
আমার কাজ হল ফিল্ডে কনট্রাক্টরদের কাজ তত্ত্বাবধান করা। কৃষিকাজের সেচের জন্য গভীর নলকূপ, কুয়ো ইত্যাদি খনন, পাম্প
হাউজ বানানো ইত্যাদি সিভিল ওয়ার্কসের কাজ সুপারভিশন করা এবং কাজ শেষে মেজারমেন্ট নিয়ে কনট্রাক্টরদের
পেমেন্টের জন্য বিল
করে পাঠানোই আমার ডিউটি। কিন্তু সাইটে কনট্রাক্টররা কাজ
না করলে আমার হাত-পা বাঁধা। ওদের তো আঠারো মাসে বছর। ওদের অনেকবার বলেছি কাজগুলো
তাড়াতাড়ি শেষ করতে। ওরা গায়েই লাগায়নি। আগে থেকে কিছু করেনি। এখন শেষ মুহূর্তে এসে পড়িমরি করে কাজ আরম্ভ
করেছে। আমিও প্রতিনিয়ত সাইট সুপারভিশন করে যাচ্ছি এবং কাজের বিল রেডি করছি। কিন্তু
এত বিল জমে গেছে, যে এখন প্রতিদিন সাইট সুপারভিশন করে আট ঘন্টা অফিস করেও বিলের কাজ শেষ করা
যাচ্ছে না। মাঝখান থেকে কনট্রাক্টরদের গাফিলতির জন্য আমাকে গাল খেতে
হচ্ছে। আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো কমতি নেই। ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে
আছি। এখনও কাজ শেষ হয়নি। সেক্রেটারি সাহেব কাজের অগ্রগতি নিয়ে
জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেব তাই ভাবছি।
সকাল সকাল সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাজার করতে। পাড়ার মোড়ে পৌঁছোতেই
সেলুনটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। একদম ফাঁকা। একটা লোকও নেই। সেলুনের ছেলেটা
বাইরে বেঞ্চে বসে পেপার পড়ছিল। আমি তাড়াহুড়ো করে সেলুনের সামনে
সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে সেলুনে গিয়ে ঢুকলাম। পাছে অন্য কেউ এসে পড়ে। গিয়ে সরাসরি
রিভলভিং চেয়ারে বসে পড়লাম। ছেলেটা পেপার পড়া ছেড়ে আমার কাছে এসে সাদা চাদরটা বার
করে ঝাড়া দিয়ে আমার গা ঢেকে দিয়ে চাদরের কোনাটা পেছনে বেঁধে দিল। তারপর মাথায় জল
স্প্রে করে দিয়ে বলল, “মুখ থেকে মাস্কটা সরাও।”
আমি বললাম, “কেন? মাস্ক পরা থাকলে তোর সমস্যা
কোথায়?”
“মাস্ক পরা থাকলে চুল কাটতে কাটতে তোমার মাস্কের
ফিতেটাই কেটে যেতে পারে। এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো
মাস্ক পরে আছি। হাতও স্যানিটাইজ করেছি।”
“করোনা হবে না তো?”
“আরে, কিচ্ছু হবে না। এত ঘাবড়াচ্ছ কেন?”
আমি মাস্ক খুলে সামনের ডেস্কের উপর
রাখলাম। ও চুল
কাটতে আরম্ভ করল। ওয়াল হ্যাঙ্গিং ফ্যানটা চালিয়ে দিয়েছিল। ভেজা চুলে ফ্যানের
ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে খুব আরাম লাগছিল। আমি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। ও কাঁচি দিয়ে চুল
কেটে যাচ্ছিল। কাটার ফাঁকে ফাঁকে চুলগুলো টেনে টেনে মাথা মালিশ করে দিচ্ছিল। আহ!
কী আরাম লাগছিল। এতদিন পর মনে হয় মাথা পাতলা হল। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান ভেসে আসছিল,
“হাওয়া মে উড়তা যায়ে, তেরা লাল দুপাট্টা মলমল কি...।” আমি ছেলেটাকে বললাম, “এসব
পুরোনো গান সরা! ঝিনচ্যাক গান লাগা।” ও ক্যাসেটটা বদলে একটা নতুন
হিন্দি সিনেমার গান চালিয়ে দিল।
ছোটো করে চুল কাটার পর খুর দিয়ে ঘাড়টা চেঁছে
দিচ্ছিল। সুড়সুড়ি লাগছিল আর সেই সঙ্গে আরামে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম। মাঝখানে একবার
পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। বার করে দেখি, বাড়ি থেকে ফোন। ছেলেটাকে বললাম, “এই!
গানের ভলিউমটা একটু কমা তো!”
ফোন রিসিভ করতেই বাড়ি থেকে বলল, “কচি লাউ পেলে নিয়ে
আসিস তো, আর কুচো চিংড়ি দেখিস, আর একটা গোটা মুরগি কাটিয়ে নিয়ে আসিস।”
“আচ্ছা, আচ্ছা, রাখো তো।”
একটু বিরক্ত হলাম। মনে মনে বললাম, এদের আর
ফাইফরমাশের শেষ নেই। চুল কাটা শেষে ফোম দিয়ে দাড়িও শেভ করে দিল। দাড়ি কাটা শেষে গালে যখন
ফিটকিরি ঘষছিল, তখন যে কী জ্বলছিল না! যাই হোক, চুল কাটিয়ে দাড়ি কামিয়ে যখন সেলুন
থেকে বেরোলাম, মাথাটা একদম ঝরঝরে লাগছিল।
বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে গেলাম সবজি-বাজারে। গিয়ে আগে
কুচো চিংড়ি খুঁজতে আরম্ভ করলাম, কারণ চিংড়ি ভালো না পেলে আগে লাউ নিয়ে লাভ নেই।
দু-এক জায়গায় চিংড়ি পেলাম, কিন্তু চিংড়িগুলো একটু বড়ো সাইজের। গলদা চিংড়ি দিয়ে লাউ
মনে হয় ভালো লাগবে না।
এক মাছওয়ালা আমাকে দেখেই ডাকাডাকি শুরু করে দিল।
“আরে, শোনো না। এদিকে আসো। কী মাছ খুঁজছ?
ভালো শোল মাছ আছে। নিয়ে যাও। এক কেজির শোল। লাউ দিয়ে রান্না করবে। দারুণ লাগবে।”
এ ব্যাটা তো দারুণ ওস্তাদ! আমাকে লাউয়ের বিকল্প রেসিপি দিয়ে দিল। জ্যান্ত শোল
মাছ, নড়ছিল।
ভালোই হবে। আমি নেব কিনা দোনামনা করছিলাম।
মাছওয়ালা বলল, “আরে দাম কম রাখব। তুমি নিয়ে যাও তো।”
আমি রাজি হয়ে গেলাম। মাছওয়ালা মাছের আঁশ ছিলে কেটেকুটে
রেডি করে দিল। আমি
মাছ নিয়ে সবজি-বাজারে গিয়ে কচি লাউ খুঁজতে লাগলাম। এ দোকান ও দোকান ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ
পাশেই দেখি সেলুনের ছেলেটা বাজার করছে। হাতে সবজি ভর্তি বাজারের ব্যাগ। অবাক হয়ে
গেলাম। এ কী! ও আবার এর মধ্যে কখন এল! দোকান বন্ধ
করে চলে এল নাকি! আমি তো সেলুন থেকে বেরিয়ে সরাসরি বাজারেই এসে ঢুকেছি। ও এর
মধ্যে এত কিছু বাজারও করে ফেলল। আশ্চর্য ব্যাপার! ওকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “কী
রে? তুই আবার দোকান ফেলে কখন চলে এলি?”
“দোকান! আজ আবার দোকান কীসের। আজ তো বন্ধ!”
“কী বলিস! আমাকে না একটু আগেই তোর দোকানে চুল কেটে
দিলি?”
“মাথা-টাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার? আজ তো দোকানই
খুলিনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারেই তো এলাম।”
“অ্যাঁ! কী বলছিস! আজ
দোকান খুলিসনি? আমি তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলাম?”
“আজ মঙ্গলবার যে।”
“আজ মঙ্গলবার নাকি? রোববার না?”
“মাথাটা গেছে তোমার।”
আমি মাথায় হাত বোলাতে
লাগলাম। এ কী! মাথার চুলগুলো আগের মতো বড়ো বড়োই লাগছে। গালে হাত বুলিয়ে দেখি
দাড়িগুলো খোঁচা খোঁচা। এ কী করে
সম্ভব? আজ কি মঙ্গলবার? আজ তো সেক্রেটারি সাহেব আমাকে কাজের প্রোগ্রেস নিয়ে ধরবেন।
কানে লাগানো হেডফোনে আমার
নাম ধরে ডাকাডাকি শুনে হুঁশ ফিরল।
“অমিতাভ! এই অমিতাভ! আরে
কোন দিকে তাকিয়ে আছ? ওদিকে তাকিয়ে আপনমনে কী ভাবছ?”
সামনে তাকিয়ে কম্পিউটার
স্ক্রিনে দেখি অন্যান্য জেলার আধিকারিকদের সঙ্গে সেক্রেটারি সাহেবও উপস্থিত। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “ওহ!
সরি স্যার।”
সেক্রেটারি সাহেব বললেন, “গালে
মাথায় হাত বোলালে কি কাজ উদ্ধার হবে? যেটা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। তোমার
কাজের প্রোগ্রেস কী বলো। কবে শেষ করবে?”
মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম,
“কাজ এখনও শেষ হয়নি স্যার। আরও তিন-চার দিন লাগবে।”
আমি এখন ভিডিও
কনফারেন্সিংয়ে।
ছবি - সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment