
শয়তান ও বক্সার
ফ্লোরিডোর পেরেজ
অনুবাদঃ শর্বরী গরাই
যখনই নরকের কারবারে মন্দা আসত, মক্কেলের
সংখ্যা কমতে শুরু করত, শয়তান তার ব্যাবসার প্রচারে পৃথিবী সফরে বার হত।
সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে চষে
বেড়াত শহর আর গ্রামগুলো। ধনসম্পত্তির লোভনীয় টোপ দিয়ে কিনতে চাইত মানুষের আত্মা।
এমনিভাবে সে পৌঁছল এক জেলেদের
গ্রামে, যেখানে
আমি গরমের ছুটি কাটাতে যেতাম। শয়তান সব রকম ফন্দি দিয়ে এক বক্সারের আত্মা কিনে
নেওয়ার চেষ্টা করছিল। অল্পবয়সি একটা ছেলে, আস্তে আস্তে
সে ওই এলাকার আকর্ষণ হয়ে উঠছিল।
দিনের বেলা সেখানে সবাই নিজের
নিজের কাজে ব্যস্ত থাকত। গ্রামের লোকেরা পিঁপড়ের মতো পরিশ্রম
করত, আর
ট্যুরিস্টরা মাছের মতো সাঁতার কাটত। কিন্তু
সন্ধ্যা নামলেই সব ফারাক দূর হয়ে যেত, ছেলে বুড়ো সবাই হাঁটা দিত স্কুলের
দিকে, ‘অক্টোপাস’ লোপেজের ট্রেনিং-এর জন্য সেখানে
বক্সিং রিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘অক্টোপাস’ লোপেজকে
এই নামে ডাকার কারণ, ও এত তাড়াতাড়ি ঘুষি মারত যে একবার লড়াই শেষে ওর
প্রতিদ্বন্দ্বী বলেছিল, “মনে হচ্ছে যেন আমাকে কেউ অনেকগুলো
হাত দিয়ে মারছে।”
এই ‘অক্টোপাস’ ছিল
ওখানকার আদর্শ,
শয়তান ভাবল ওকে হাত করতে পারলে গোটা এলাকাটা জয় করার দরজা খুলে যাবে। কিন্তু
ছেলেটা যেমন ওকে একটুও পাত্তা দিচ্ছিল না, নরকের রাজাও
তেমন হাল ছাড়ছিল না।
ভিড়ের মধ্যে মিশে শয়তান লক্ষ করল ছেলেটার
ক্ষয়ে যাওয়া জুতো, সাত-পুরোনো প্যান্ট, রং চটা
জামা।
“তোমাকে অনেক
পেসো দিতে পারি। অনেক!” চলতে চলতে ওকে বলল।
ছেলেটা উত্তর দিল, “আমার
প্রয়োজন খুব অল্প, আর আমি জানি কী করে সেটা রোজগার করতে হয়।”
ও বাবার সঙ্গে ডুবুরির কাজ
করত।
আঞ্চলিক খবরের কাগজগুলো ওকে
চিলির বক্সিং দুনিয়ার নতুন আশা বলে ডাকতে শুরু করেছিল। তাই দেখে শয়তান ভাবল আরও উচ্চাশা
জাগিয়ে ছেলেটাকে দুর্বল করে দেবে।
অটোগ্রাফ নিতে রিং-এর ভেতর
ঢুকে পড়েছে এরকম এক খ্যাপা ভক্ত সেজে শয়তান ওর দিকে একটা নোটবই এগিয়ে দিল, তাতে
লেখা, “আমি
তোমাকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে পারি।”
এর উত্তরে ছেলেটা ওই ছাগুলে
দাড়িওয়ালাকে ছুঁড়ে ফেলার ভান করল, রসিকতা মনে করে সবাই হাততালি দিল।
শয়তান এবার ‘অক্টোপাস’-কে
তার আসল ভালোবাসার জালেই ফাঁসাবার মতলব আঁটল।
ঘোষণা করল, “শুনুন! সবাই
শুনুন! আপনাদের
চ্যাম্পিয়ন আজ একটা প্রতিযগিতায় লড়বে। শুধু এক রাউন্ড… এই অধমের
সঙ্গে।” (একটা হাত নিজের বুকে রেখে মাথা
ঝুঁকিয়ে লোক দেখানো বাও করল, কেউ হাসল, কেউ হাততালি
দিল।)
আরও বলল, “যদি
আমি হারি,
ওর ট্রেনিং-এর জন্য কুড়ি লক্ষ পেসো দেব।” (এবার আর কেউ
হাসল না। সবাই হাততালি দিল।)
“শুধু একটাই
অনুরোধ,”
অচেনা লোকটা পাদরি-কে বলল।
“বলুন, আমরাও
শুনছি,” বলে
উঠল এক সার্জেন্ট।
“আমরা জুতো
পালটাপালটি করব। আমি
ওর কাজের জুতোজোড়া পরব আর ও পরবে আমার হাঁটার জুতো দুটো।”
“আর যদি তুমি
হারো, তাহলে
আরও অনেক বেশি
দেব,
কিন্তু তোমার আত্মাটা আমি জিতে নেব।”
এর আগেও অনেকে এসেছে লোপেজকে
লোভ দেখাতে,
কিন্তু গ্রামের লোকেদের মনে হল এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর হয় না, তাই
তারাও খুব উৎসাহ দিল। ছেলেটা ওর নিজের লোকেদের আশা পূর্ণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাই
চ্যালেঞ্জটা অস্বীকার করতে পারল না।
সে তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে রাজি
হয়ে গেল,
আর চুপি চুপি নিজের ছোটো ভাইকে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে বলে দিল।
শয়তান প্রথমে রিং-এ উঠল, হাতে
নিজের জুতোজোড়া,
ভাবছিল ওগুলোর বদলে খুব সহজেই ছেলেটার জুতো পরে নেবে। ওর পরেই উঠে এল ‘অক্টোপাস’, তুলে
নিল প্রতিপক্ষের জুতো আর তার বদলে রাখল সীসার তৈরি অদ্ভুত একজোড়া জুতো। শয়তান
জীবনে এমন জিনিস চোখে দেখেনি।
ওগুলো পায়ে শয়তান অনেক কষ্টে
তিন-চার পা এগোতে পারল। এদিকে ‘অক্টোপাস’ হালকা পায়ে
এগিয়ে পিছিয়ে, প্রতিপক্ষের চারিপাশে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ওকে না ছুঁয়ে শুধু বক্সিং গ্লাভস পরা হাতের মুঠো
দিয়ে দেখাতে লাগল ওর মুখ, পেট, বুকের
ডানদিকের পাঁজর,
বাঁ দিকের পাঁজর, আরও যেখানে যেখানে ও ঘুসি মারতে পারে। এক মিনিটের মধ্যেই
শয়তান দু’হাত ওপরে তুলে খেলা ছেড়ে দিল। রেফারিকে ডেকে নিয়ে বিচারকের কাছে নালিশ করল, “চুক্তি
ভঙ্গ করা হয়েছে। আমি লড়তে চেয়েছিলাম বক্সারের কাজের জুতো পরে, ওই
উঁচু, হালকা
বুটজোড়া,
ওগুলো পরেই তো ওকে ট্রেনিং নিতে দেখেছি…”
“তা, ঠিকই,” গ্রামের
মাষ্টারমশাই ভালো করে বোঝাতে এলেন, “কিন্তু আপনি লড়তে এসেছিলেন আমার
প্রাক্তন ছাত্র তাতো লোপেজের সঙ্গে, যে এই গ্রামের সেরা ডুবুরি। সেটাই
ওর জীবিকা। আর ওগুলো ডুবুরির জুতো। বক্সিং ওর শখ।”
“যদিও, এবার
থেকে, মানে
আপনার এই সাহায্য পাবার পর থেকে হয়তো ও বক্সিংকেই নতুন পেশা হিসাবে বেছে নেবে,” হই
হই করে বলে উঠল সার্জেন্ট।
গ্রামের
একমাত্র সাংবাদিক সেদিন অজ পাড়াগাঁয় নিজের ধর্মবাপকে দেখতে গিয়েছিল, তাই
এই সংক্ষিপ্ততম অথচ বিখ্যাত লড়াইটার খাতাকলমে কোনো রেকর্ড থাকল না। ইন্টারভিউ
নেওয়া হয়নি বলে সেই রহস্যময় প্রতিপক্ষের নামও জানা গেল না। আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে
তাকে ‘এক
অচেনা শুভানুধ্যায়ী’ বলে উল্লেখ করা হল। অন্যদিকে ‘অক্টোপাস’ লোপেজ, যাকে
ডুবুরি বক্সার নামে ডাকা শুরু হয়েছে, ‘তিনি
শুধু এটুকুই বলেছেন যে, এ ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন
না।’
আর যদি ও নিজে না বলে, তাহলে
আমিও বলে বেড়াব না যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে ওর শেষ কথোপকথন আমি শুনে ফেলেছিলাম।
নকল মিষ্টি গলায় পাপীদের
পাণ্ডা বলছিল, “যদি
এখনও আমাকে না চিনতে পেরে থাকো তাহলে আজ রাত বারোটায় আমাকে ডেকো। খুশি মনে দেখিয়ে
দেব আমি কে।”
‘অক্টোপাস’ লোপেজ
হেসে বলল,
“তার কোনো দরকার নেই। মশাই, আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমার
কাজই হল জলের নিচে দেখা...”
দু’চোখে আগুন ঝরিয়ে নরকের
রাজা উধাও হল।
--------
মূল গল্পঃ ‘El Diablo y el boxeador’ - Floridor
Pérez
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment