
শয়তান সহচর ডিকন
শেরিডান লে ফন্যু
অনুবাদঃ সম্রাট লস্কর
বছর তিরিশ আগের কথা। বিত্তশালী দুই বৃদ্ধা
বোন আমাকে নিয়োগ করেছেন ল্যাঙ্কাশায়ারের পেন্ডেল বনানীর কাছে তাদের যে সম্পত্তি
আছে তার একটা ব্যবস্থা করতে। পেন্ডেল বনানীর কথা তো
আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে, মিঃ এইন্সওয়ার্থের ‘ল্যাঙ্কাশায়ারের ডাকিনী’ তো এই পেন্ডেল
নিয়েই।
আমার কাজ তেমন কিছু নয়।
দুই বোন উত্তরাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তিটি পেয়েছেন, যার মধ্যে আছে একটা বিশাল বাড়ি আর তৎসংলগ্ন জমি,
সেটার আইনমাফিক পার্টিশন করা।
ঘোড়ার গাড়িতে চলেছি। যাত্রার শেষ চল্লিশ
মাইলের অভিজ্ঞতা একদম অন্যরকম। এই রাস্তা নির্জন, লোকজনের যাতায়াত কম। রাস্তার দু’ধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবশ্য দেখবার মতো।
সময়টাও অনুকূল—
সেপ্টেম্বর মাস, শরৎকাল, প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।
ইংল্যান্ডের এইদিকটায় আগে কখনও আসা হয়নি।
শুনেছি এই সব জায়গা আগে আরও আদিম আর বন্য ছিল, অতএব সুন্দরও ছিল বেশি।
যাত্রার মাঝে এক সরাইখানায় বিরতি নিতেই হল।
ঘোড়াগুলো ক্লান্ত, ওগুলো
বদল করতে হবে আর হ্যাঁ, পাঁচটা বেজে গেছে তাই ডিনারটাও করে নেওয়া ভালো। সরাইখানার
মালিক মজলিশি মানুষ; বছর
পঁয়ষট্টি বয়েস। অতিথিদের সঙ্গে বকবক করাতে কোনো কার্পণ্য নেই, একটু উশকে দিলেই হল। কথার স্রোতে সবাই ভাসবে।
বারউইক মানে যে সম্পত্তিটিতে আমি যাচ্ছি তার
সম্পর্কে আমার যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। বারউইকের কাছাকাছি কোনো সরাইখানা না থাকায় আমার
এক রাতের থাকার ব্যবস্থা ওই বাড়িতেই করা হয়েছে।
‘থ্রি নানস’ সরাইখানার মালিক যদিও এই
ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারলেন না। শুধু জানালেন যে বছর কুড়ি আগে জমিদার বোজ়
মারা যাওয়ার পর থেকে বারউইক হলে এক মালি আর তার বউ ছাড়া কেউ-ই থাকে না।
“টম উইন্ডসর, মানে ওই মালির বয়েস আমার মতোই হবে, তবে
ব্যাটা একটু ঢ্যাঙা, আর
আমার মতো স্বাস্থ্যবান নয়,” সরাইখানার মালিক অবশ্য রীতিমতো মোটাসোটা।
“কিন্তু ওই বাড়ির ব্যাপারে মনে হয় কিছু
গল্প আছে,
তাই না? যার জন্য ওখানে কোনো ভাড়াটে আসে না,” আমি
কৌতূহল চাপতে পারলাম না।
“যত্তসব আষাঢ়ে গল্প। অনেক দিন আগে
শুনেছিলাম। এখন আর মনেও নেই। আরে মশাই, কোনো বাড়ি অনেক দিন এরকম ফাঁকা পরে থাকলে
রটনা রটবেই। ওগুলোকে আমি কোনোদিনই গুরুত্ব দিইনি।”
ব্যস, এইটুকুই। কোনো অজ্ঞাত কারণে সরাইখানার
মালিক এর বেশি কিছু বললেন না। অথচ আমার মনে হচ্ছিল উনি অনেক কিছুই জানেন কিন্তু
বলতে চাইছেন না।
যাই হোক, আমি পয়সা মিটিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
সরাইখানার বিরতিটা ভালোই কাটল কিন্তু তবুও কেন যেন মনটা খচখচ করছিল।
প্রায় ঘন্টাখানেক যাত্রার পর আমরা পৌঁছোলাম
এক রুক্ষ প্রান্তরে। আমার জানা ছিল যে এই অঞ্চলটা পেরিয়ে মিনিট পনেরো গেলেই আমার
গন্তব্য বারউইক হলে পৌঁছে যাব।
কিছু দূর যাওয়ার পর চারিদিক আবার মনোরম।
প্রকৃতি সুন্দর,
অপাপবিদ্ধ, আকর্ষণীয়। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের
সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ করে সামনে দেখা গেল সেই বাড়ি, বারউইক হল। সুবিশাল আর পুরোনো। ব্ল্যাক অ্যান্ড
হোয়াইট প্যাটার্নে বানানো, মানে ওক কাঠের কালো রঙের ফ্রেমওয়ার্কের মাঝে সাদা
প্লাস্টার এমন কায়দায় করা হয়েছিল যে দূর থেকে দেখলে মনে হয় বাড়িটা যেন কোনো
সাদা-কালো ডোরাকাটা জামা পড়ে আছে। বাড়িটা দেখে আন্দাজ করা যায় যে এটা
এলিজাবেথান যুগে বানানো। ম্যানর বাড়ির মতো চারপাশে অনেকটা জমি। তবে বারউইক হলের বিশালতা
যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল চারপাশের সুদীর্ঘ বৃক্ষগুলি, দিনান্তে যাদের ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছিল
বাড়িটাকে।
বাড়ির চারপাশের প্রাচীরে বয়সের স্পষ্ট ছাপ
পড়েছে;
আইভি লতাও গজিয়ে উঠেছে
এখানে ওখানে। গোধূলির সূর্যের আলো আর পাতার ধূসর অন্ধকার এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের
সৃষ্টি করেছে। একটু দূর তাকাতে একটা জলাশয় চোখে পড়ল — একটা ঝিল যার জল শীতল ও পিচ-কালো। ঝিলটা যেন
কোনো গোপন পাপের ভারে স্থির হয়ে আছে।
ঝিল! হঠাৎ যেন কিছু আবছাভাবে মনে পড়ল আমার।
এই আলো-আঁধারিতে ঝিলটা দেখেই মনে হচ্ছিল যে এটা বিপজ্জনক। এই বাড়ির ব্যাপারে শোনা
কোনো গল্পতে ঝিলটার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ঠিক কী শুনেছিলাম সেটা আর মনে আসছিল না।
আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল সামনে। পাতাঝরার
মরশুম;
গাছ থেকে ঝরে পড়া শরতের
লাল-হলুদ পাতায় রাস্তা ঢাকা। মূল ফটকের কাছে গাড়ি থেকে নামলাম। তারপর বাড়িটাকে
ভালো করে দেখতে শুরু করলাম। বারউইক হল নিঃসন্দেহে বিশাল, তবে সময়ের স্পষ্ট ছাপ
পড়েছে। যত্নেরও অভাব। জানালাগুলোর বাইরে আগাছা জন্মেছে, কাঠের বিমগুলো শ্যাওলা ধরা, প্লাস্টার খসে পড়েছে জায়গায় জায়গায়, বিভিন্ন রঙের ছোপও পড়েছে বাড়ির গায়েতে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চারিদিক দেখছিলাম।
ঝিলটা এখন আরও কাছে, বাঁ
দিকে তাকালে পরিষ্কার দেখা যায়। খুব যে বড়ো তা নয়, বড়োজোর দশ-বারো একরের হবে, কিন্তু ঝিলটার
উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে জায়গাটার বিষণ্ণতা বাড়িয়ে তুলেছে। ঝিলের মাঝে একটা ছোট্ট
চর,
তাতে খুব প্রাচীন দুটি
অ্যাশ গাছ পরস্পরের দিকে ঝুঁকে আছে। গাছ দুটির বিষাদ-ছায়া ঝিলের জলে প্রতিফলিত
হচ্ছে। এই ভারী বিষণ্ণতার মধ্যে একমাত্র দিনান্তের সূর্যালোকই কিছুটা আশার কিরণ
নিয়ে উপস্থিত ছিল। আমি দরজায় ঠক ঠক করলাম। আওয়াজটা জায়গাটার নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রতিধ্বনিত
হল কিছুক্ষণ। একটু পরে দূর থেকে এক ঘন্টার বিরক্ত ধ্বনি ভেসে এল যেন দিবানিদ্রার সময় এই অযাচিত উৎপাতে সে
যারপরনাই বিরক্ত।
অবশ্য দরজা খুললেন এক চটপটে, হাসিখুশি, লাল-মুখো বৃদ্ধ। ওনার মুখের হাসি আর চোখের
ভঙ্গি দেখেই বুঝলাম আমার আসার খবর ওনার কাছে আছে। আপ্যায়ন ভালোই হবে মনে হল। দেখা যাক।
ভিতরে ঢুকেই হলঘর। আকারে বিশাল, কিন্তু
এখানেও সেই আলো-আঁধারির খেলা। হল পেরিয়ে বাঁদিকে এলাম একটু। এদিকেই আমার থাকার
ব্যবস্থা করা হয়েছে। এলাহি ব্যবস্থা। দুটো ঘর। একটা বৈঠকখানা, আরেকটা শয়নকক্ষ। দামী পুরানো আসবাব, কারুকার্য করা লম্বা পর্দা, তুরস্কের কার্পেট, ফায়ারপ্লেস - কী নেই! আর হ্যাঁ, দুটো ঘরের জানলা দিয়েই ঝিলটা দেখা যায়।
ঘরগুলো প্রশস্ত, পরিষ্কার অথচ কেমন যেন গম্ভীর, বিষণ্ণ। অনুযোগ করার কিছুই নেই, কিন্তু আমার
কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিল। সাপারে কী খাব জানিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ টম উইন্ডসরকে
ডাকলাম। বুড়ো টম এখন আর খালি মালি নয়, এই সম্পত্তির কেয়ারটেকারও বটে। সূর্যের আলো
এখনও আছে,
এস্টেটটা একবার ঘুরে এলে
কেমন হয়?
টমকে বললাম সঙ্গ দিতে।
লালমুখো টম তৎক্ষণাৎ রাজি।
সেপ্টেম্বরের মনোরম সন্ধে। টম আমায় পথ
দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। বয়েস হলে কী হবে, ব্যাটা এত জোরে হাঁটে যে ওর পিছু পিছু আমায়
প্রায় ছুটতে হচ্ছে।
এস্টেটের উত্তর সীমানার কাছে গাছের ফাঁক
দিয়ে একটা ছোট্ট, পুরানো
গির্জা চোখে পড়ল। কৌতূহল হল। লোহার গেট পার হয়ে গির্জার প্রাঙ্গণে ঢুকলাম আমি আর
বুড়ো টম। গির্জার দরজা খোলা। সেক্সটন বোধহয় কবর খুঁড়ছিলেন একটু আগে; এখন কোদাল, বেলচা এইসব গুছিয়ে রাখছিলেন। এই সময় আমরা
গিয়ে হাজির। ঈষৎ কুঁজো সেক্সটন ভদ্র মানুষ। আনন্দের সঙ্গেই আমাদের গির্জাটা
ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। কবরস্থানের একটা সৌধে চোখ আটকে গেল। এটা জমিদার বোজ়ের
সমাধিসৌধ। এনারই সম্পত্তি বারউইক হল আর তৎসংলগ্ন জমি যা উত্তরাধিকার সূত্রে
পেয়েছেন ওই দুই বোন। সমাধিসৌধে দেখলাম এপিটাফ হিসেবে জমিদার বোজ়কে নিয়ে ভালো
ভালো কথা লেখা আছে। জানতে পারলাম চার্চ অব্ ইংল্যান্ডের একনিষ্ঠ সদস্য বোজ় মারা
যান ওনার একাত্তর বছর বয়েসে।
সূর্যের শেষ কিরণ এর মধ্যে বিদায় নিয়েছে।
আমরা যদিও তখনও গির্জার প্রাঙ্গণেই আছি।
“কুড়ি বছর হল জমিদার বোজ় মারা গেছেন,” নিজেকেই যেন বললাম।
“হ্যাঁ স্যার, গত মাসের নয় তারিখে ওনার মৃত্যুর কুড়ি বছর
পূর্ণ হল।”
“কেমন মানুষ ছিলেন উনি? ভালো? হাসিখুশি?”
“দিব্যি মানুষ ছিলেন। ওনার অধীনে কাজ করতে
কোনো অসুবিধা হয়নি। নির্বিবাদ মানুষ ছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন একটা মাছিও বোধহয়
মারেননি। তবে... এই সমস্ত জমিদারেরা তো কিছুটা খামখেয়ালি হয়। পরের দিকে এদের যে
কেমন পরিবর্তন হয় তা আন্দাজ করা মুশকিল। অনেকে তো পাগলও হয়ে যান।”
“উনিও কি শেষ জীবনে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?”
“উনি? পাগল? না না। উনি হননি। হয়তো একটু অলস হয়ে
পড়েছিলেন, কিন্তু মগজ সজাগ ছিল। কী চাইছেন সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল ওনার।”
বুড়োর কথার ভঙ্গিতে কিছু যেন একটা রহস্য ছিল,
কিন্তু আমি আর এই ব্যাপারে কথা বাড়ালাম না।
আমরা দু’জন হাঁটতে হাঁটতে বারউইক হলে
ফিরছিলাম। রাস্তার দু’ধারে
একশো বছরেরও পুরোনো এল্ম্ গাছের সারি, জমাট বাঁধা অন্ধকার। আমরা দু’জন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের দিকে
ছুটে এল কিছু একটা। সঙ্গে অদ্ভুত এক আওয়াজ। চাপা হাসির মতো। মানুষের অবয়ব।
আমাদের পেরিয়ে পিছনের অন্ধকারে মিশে গেল নিমেষেই। অস্বীকার করব না, আচমকা খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মানুষটির
পরনের পোশাক ছিল সাদা। প্রথমে মনে হয়েছিল যে কোনো সাদা ঘোড়া বোধহয় আমাদের দিকে
ছুটে আসছে। বুড়ো টম পিছু ফিরে মানুষটির উধাও হয়ে যাওয়া অবয়বটির দিকে তাকিয়ে
থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “ছেলেটার রাতের অভিযান শুরু হল। রাতে শোয়ার জায়গা ঠিক জুটিয়ে নেবে। রুক্ষ
প্রান্তর,
শুকনো গর্ত – যে কোনো
জায়গাতেই ও শুয়ে পড়তে পারে। প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল ছেলেটা কোনো বাড়ির
বিছানায় ঘুমোয়নি।
বিছানায় ঘুমোনো ওর আর হবে
না।”
“ছেলেটার মাথায় গন্ডগোল আছে নাকি?”
“তা একটু আছে অবশ্য। ছেলেটা একটু
ন্যালাখ্যাপা ধরনের। ওকে আমরা ডাকি ডিকন শয়তান বলে। ওর মুখ থেকে একটা শব্দই বার বার
শোনা যায় – ‘শয়তান’।”
আমার হঠাৎ মনে পড়ল যে এই হাবাগোবা ছেলেটার
কথা যেন আগে শুনেছিলাম। জমিদার বোজ়ের অদ্ভুত গল্পগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে
ছেলেটার যোগ আছে।
জিজ্ঞেস করাতে টম স্বীকার করল যে ছেলেটার
ব্যাপারে কিছু রটনা আছে।
“কুড়ি বছর এই ছেলেটা কোনো বাড়ির বিছানায়
ঘুমোয়নি। তার মানে জমিদার বোজ়ের মৃত্যুর সময় থেকে?”
“হ্যাঁ, ওই সময়টাই হবে। তবে উনি মারা যাবার কিছুদিন
পর থেকে।”
“আজ সাপারের পর এই গল্পটা একটু বোলো তো টম।
নিশ্চিন্তে শোনা যাবে।”
টম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমার কথা তার পছন্দ
হয়নি। আমার দিকে না তাকিয়েই সে তারপর বলল, “দেখুন স্যার। বারউইক হলের ভিতরে বা বাইরে
শেষ দশ বছর কোনো উপদ্রব হয়নি। আমার বুড়ি বউ এসব নিয়ে কোনোরকম আলোচনা পছন্দ করে
না। আমারও তাই মত। যা ঘুমিয়ে আছে তাকে না জাগানোই ভালো,” এই বলে সে মুখে কুলুপ
আঁটল।
বাকি রাস্তায় আর কোনো কথা না বলে বারউইক হলে
ফিরে এলাম। ভিতরে ঢোকা মাত্রই অনেকটা স্বস্তি বোধ করলাম। বাইরে তেমন ঠান্ডা নেই
বটে তবুও ফায়ারপ্লেসে কাঠ পুড়ছে দেখে ভালো লাগল। ঘরে একজোড়া মোমবাতিও জ্বলছে।
একটা ছোটো টেবিলে সাপারের ব্যবস্থাও প্রস্তুত।
টম উইন্ডসরের থেকে গল্পগুলো শুনতে পেলে
দিব্যি লাগত। কিন্তু সাপারের পর এত ঘুম পেয়ে গেল যে ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার
শক্তিও রইল না। সারাদিনের দীর্ঘ যাত্রা, অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, এলাহি সাপার - চোখ আর খুলে রাখতে পারছিলাম
না। বিছানায় শুয়েই দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাতের ঘুমে কীরকম বিঘ্ন ঘটেছিল তা একটু বাদেই
বলছি। তেমন কিছু হয়তো নয়, তবে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অদ্ভুত।

পরের দিন খুবই ব্যস্ততার মধ্যে কাটল।
সম্পত্তির যে কাজে এসেছিলাম তাই নিয়ে সারাটা দিন যে কীভাবে কেটে গেল টেরই পাইনি।
তবে সময় পেলাম রাতে সাপারের পর। সারা দিনটাই ছিল প্যাচপেচে, বাতাসে আর্দ্রতা অত্যন্ত বেশি, ঘরের একটা জানালা তাই খুলে রেখেছি। জানালার
পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি, পাশে ব্র্যান্ডি আর জলের বোতল। আকাশ চাঁদ নেই। চারপাশের
গাছগুলোর ঘন অন্ধকার এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করেছে।
একটু বাদেই চলে যাব, তাই বুড়ো টম আমাকে সঙ্গ
দিচ্ছে।
“টম, তুমি আর তোমার বউ ছাড়া এই বাড়িতে অন্য আর
কেউ থাকে নাকি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
টম দরজার কাছে বসে ছিল। আমার কথা শুনে হাতের
পানপাত্রটা মাটিতে রেখে চুপ করে আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, “আর কেউ? না, এই বাড়িতে আমরা ছাড়া আর তো কোনো জীবিত
মানুষ থাকে না।” শেষের কথাগুলো ধীরে ধীরে
উচ্চারণ করে বলল। তারপর আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আরও কিছু শোনার
জন্য।
“তাই?” টমের স্থির দৃষ্টির সামনে কিছুটা অস্বস্তি
বোধ করছিলাম। “তুমি নিশ্চিত যে গতকাল রাতে তুমি একবারও আমার ঘরে প্রবেশ করনি।”
“আজ সকালে আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার আগে
একবারও আপনার ঘরে ঢুকিনি আমি।”
“কিন্তু আমি নিশ্চিত আমার শোয়ার ঘরে কেউ
প্রবেশ করেছিল। গতকাল আমি এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে আমার ওঠার শক্তি ছিল না,
কিন্তু আমি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। একবার তো মনে হল কেউ যেন আমার আনা স্টিলের
বাক্সগুলো জোরে ধাক্কা দিল। ওখানেই তো এই এস্টেটের সব জরুরি কাগজপত্রগুলো আছে।
হেঁটে চলার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, একটা হালকা আলোও জ্বলতে দেখেছি। অথচ শোয়ার আগে মোমবাতি
নিভিয়ে শুয়েছিলাম। আমার তখন মনে হয়েছিল টম যে তুমি বুঝি আমার জামাকাপড়গুলো
নিতে এসেছ আর ভুল করে বাক্স দুটোয় ধাক্কা মেরে দিয়েছ। যেই এসে থাকুক না কেন একটু
পরেই সে চলে গেল। ঘর আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার, কিন্তু কী একটা
অস্বস্তিতে ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল। দেখি দরজার উলটো দিকের দেয়ালে একটা আলোর রেখা।
কেউ দরজা খুলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। এক লাফে উঠে বসলাম। সত্যিই দরজাটা আস্তে
আস্তে খুলছে,
বাইরে থেকে মোমবাতির কাঁপা
আলোও প্রবেশ করছে। আর একটা অদ্ভুত হাত দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। তোমার
হাত দুটো দেখি তো একবার?”
টম সঙ্গে সঙ্গে নিজের দুটো হাতই বাড়িয়ে
দিল।
“না না, তোমার হাত দুটো তো স্বাভাবিক। ওই হাতটার
বিশেষত্ব ছিল। মোটাসোটা, মধ্যমাটা অনেকটাই ছোটো, ভাঙা মতন। আর ভাঙা আঙুলের নখটা তীক্ষ্ণ, শিকারী পাখির নখরের মতো। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘কে ওখানে?’ আমার গলা শুনেই হাত আর আলো দুটোই তৎক্ষণাৎ
বিদায় নিল। আর কোনো ঝামেলা হয়নি তারপর।”
“হায় ঈশ্বর! এটা উনি। নিশ্চিত উনি।” টমের সারা মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
“কার কথা বলছ?”
“বুড়ো জমিদার বোজ়। ওটা ওনারই হাত। ভাঙা
মধ্যমা,
নখর - সব মিলে যাচ্ছে।
আপনার অনেক ভাগ্য যে আপনার গলার আওয়াজ শুনে উনি আর ভিতরে ঢোকেননি। আপনাকে একটা
কথা বলি। দুই মিস ডিমকদের সম্পত্তির ব্যাপারে আপনি এখানে এসেছেন। কিন্তু
জমিদারমশাই কোনোদিনই চাইতেন না যে ওনার সম্পত্তি এই দুই বোন পাক। উনি সেই মর্মে
একটা উইলও তৈরি করতে দিয়েছিলেন, কিন্তু উনি হঠাৎ মারা যাওয়াতে সেটা আর হল না।
উনি খুবই ভদ্র মানুষ ছিলেন, কিন্তু কেন জানি না এই দুই বোনকে একদম সহ্য করতে
পারতেন না। আপনি ওদের সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থা করতে এসেছেন শুনে মনটা কু ডাকছিল আর
দেখুন যা ভয় করেছিলাম তাই হল। আবার ওনার উৎপাত শুরু হবে।”
আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। পুরো বিষয়টা জানতেই
হবে। একটু চাপাচাপি করার পর বুড়ো টম জমিদার বোজ় মারা যাবার পর যে সব অদ্ভুত ঘটনা
ঘটেছিল তা বলতে লাগল।
“আপনাকে তো আগেই বলেছি যে কোনো উইল না করে
জমিদার বোজ় মারা যান। এখানকার লোকেদের খারাপ লেগেছিল। জমিদার বোজ়কে সকলেই পছন্দ
করত। উনি কোনোদিন দুর্ব্যবহার করতেন না, কাউকে ছোটো দেখাতে চাইতেন না। একদম অহিংস এক
মানুষ ছিলেন। তাই ওনার মৃত্যুর পর যা সব শুরু হল তা অবাক করার
মতোই বটে।
“দুই বোন সম্পত্তি পেয়েই প্রথম যে কাজটা
করলেন তা হল প্রচুর সংখ্যক গবাদি পশু কিনে ব্যাবসা শুরু করা। আমার মতে সিদ্ধান্তটা
তাদের একদম ঠিক ছিল না, কারণ এই ব্যাবসায় তাঁদের কোনোরকম অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু
তাছাড়াও তাঁরা বুঝতে পারেননি যে কত বড়ো ঝামেলা ডেকে আনা হয়েছে।
“গন্ডগোল শুরু হল কয়েকদিন বাদে। কোনো আপাত
কারণ ছাড়াই একে একে গরু-বাছুর অসুস্থ হয়ে মরতে শুরু করল। কিছু রটনাও ছড়িয়ে
পড়ল একই সময়ে। অনেকেই নাকি জমিদার বোজ়কে দেখেছে। কোনো কোনো সন্ধ্যায় লাঠি হাতে
তিনি হেঁটে বেড়ান পার্কে, গবাদি পশুগুলোর পাশে। কখনও থেমে যদি কোনো পশুর গায়ে আলতো
হাত বোলান পরের দিন নিশ্চিত সেই পশুটা অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন বাদে মরে যাবে। ওটা যে
জমিদার বোজ়ই তাই নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। সেই চেনা পোশাক, সেই লাঠি, হাঁটার সেই পরিচিত ভঙ্গি। বিকেলের পর ভয়ে
কেউ আর বারউইক হলের দিকে আসত না। একে একে গবাদি পশুর মারা যাওয়া চলতেই থাকল।
ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে লাগল।
“সেই সময় এই সম্পত্তির দেখাশোনা করত টমাস
পাইক। টমাস ছিল জমিদার বোজ়ের নিজস্ব ভৃত্য। বারউইক হলেও ও তখন একাই থাকত।
“একের পর এক গবাদি পশুর মৃত্যুতে টমাস ক্ষেপে
যাচ্ছিল। কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া এই অসুস্থতা আর মৃত্যু মেনে নেওয়াও যায় না।
জমিদার বোজ়কে নিয়ে যে গল্পগুলো শোনা যাচ্ছিল টমাস তার একটাও বিশ্বাস করেনি।
এদিকে গবাদি পশুগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়াও যাচ্ছে না। সবাই আতঙ্কিত।
উপায় না দেখে টমাস তাই ডার্বিশায়ারের ম্যাটলক গ্রাম থেকে ওর ভাই রিচার্ড পাইককে
এখানে নিয়ে এল। রিচার্ডই হল ডিকন যাকে আপনি গতকাল দেখেছিলেন।
“ডিকন আসার পর কিছুদিন কোনো গোলমাল হল না।
নতুন করে কোনো গবাদি পশুও অসুস্থ হল না। কোনো কোনো সন্ধেতে জমিদার বোজ়কে দেখা
যাচ্ছিল বটে, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি আর পার্কের মধ্যে আসছিলেন না। ডিকন পাইক আসার পর থেকেই বোজ় দূরে দাঁড়িয়ে
থাকতেন।
জঙ্গলের মুখে অনেক সময়
উনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, কখনও এক ঘন্টারও ওপর। তারপর আস্তে আস্তে ওনার অবয়ব ধোঁয়ার
মতো মিলিয়ে যেত।
“বারউইক হলে তখন টমাস আর ডিকন দুই ভাই-ই রাত
কাটাত। পরিচারকদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে একটা বড়ো খাটে দুই ভাই পাশাপাশি শুয়ে
ঘুমোত।
“ঘটনাটা ঘটল নভেম্বরের এক ঠান্ডা রাতে। খাটের
ভিতর দিকে মানে যে দিকটায় দেয়াল আছে সেদিকে টমাস শুয়ে। ঘুম আসছিল না তার। খাটের
সামনের দিকটায় ডিকন অঘোরে ঘুমিয়ে।
“দরজার দিকে তাকিয়ে টমাস কিছু একটা ভাবছিল।
হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। ঘরে ঢুকলেন... জমিদার বোজ়। মুখ ফ্যাকাশে, রক্তহীন। যেন সোজা কফিন থেকে বেরিয়ে এখানে
এসেছেন।
“ভয়ে টমাস অবশ হয়ে গেল। তবুও সে তার চোখ
বন্ধ করতে পারল না। জমিদার বোজ়ের ওপরে তার দৃষ্টি যেন আটকে গেছে।
“জমিদার বোজ় ডিকনের পাশে এসে কিছুক্ষণ
দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ছেলেটাকে পাঁজাকোলা করে
তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ডিকন তখনও গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।
“বোজ় চলে যাওয়ার পরও টমাস শুয়েই রইল। তার
শরীর সাড়হীন। ভোরের আগে সে স্বাভাবিক হতে পারল না।
“ডিকন নিশ্চিতভাবেই উধাও। বাড়ি বা বাড়ির
বাইরে কোথাও সে নেই। টমাস অনেক কষ্টে দু-একজনকে রাজি করিয়ে জঙ্গলের মধ্যেও খুঁজল।
কিন্তু সব বৃথা। ডিকনকে পাওয়া গেল না।
“অবশেষে একজন বলল ঝিলের মাঝের ওই চরটার কথা।
একবার ওখানে দেখলে হয় না! খুব একটা আশা না থাকলেও একটা ছোটো ডিঙি করে চরে যাওয়া
হল। আশ্চর্য! ডিকনকে ওখানেই পাওয়া গেল। একটা অ্যাশ গাছের নিচে বসে আছে ছেলেটা।
চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। টমাসরা যাই জিজ্ঞেস করে ডিকনের মুখে একটাই কথা, ‘শয়তান বোজ়। দেখো, দেখো। শয়তান বোজ়।’ ছেলেটা সেই থেকে পাগল হয়ে গেল। কোনো
বাড়ির বিছানায় আর সে কোনোরাত ঘুমোয়নি। দিনের বেলা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
কেউ বাধা দেয় না। আটকেও রাখে না। এমনিতে তো ছেলেটা নিরীহ। কিন্তু সন্ধের সময়
থেকেই সবাই ওকে এড়িয়ে চলে। ওর জন্য নয়। সবাই ভয় পায় যে রাতের দিকে ও একা থাকে
না। পাশে কেউ থাকে। ডিকন রাতের বেলা হয়ে যায় সেই শয়তানের সহচর।”
বুড়ো টমের গল্প এখানেই শেষ হল। ঘরময়
নিস্তব্ধতা। আমরা দু’জন চুপচাপ বসে। হঠাৎ একটা আওয়াজ। জানালার পাশ দিয়ে সাদা
রঙের কিছু একটা ছুটে গেল আর সঙ্গে শোনা গেল অদ্ভুত গলার স্বর, ‘হু-উ-উ-উ। শয়তান বোজ়। তোমার পিছনেই।
হু-উ-উ-উ।’ বুড়ো টম মোমবাতি নিয়ে
জানালার কাছে চলে এসেছে। সেই আলো পড়েছে ডিকনের মুখের ওপর। ডিকন এক পলক আমাদের
দিকে তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর বিড়বিড় করতে করতে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল।
জানলা বন্ধ করে টম ঘরের দরজার দিকে এগোল।
গল্প শেষ হলেও তার রেশটা তখনও রয়েই গেছে। অস্বীকার করব না সেই সময় বাইরে ঘোড়ার
খুরের আওয়াজ শুনে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার যাবার সময় হয়েছে। বুড়ো
টমকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। পিছনে পড়ে রইল
বারউইক হল,
ডিকন আর তার সঙ্গে... না
থাক। তিরিশ বছর পরেও সেটা আর ভাবতে চাই না।
--------
মূল গল্পঃ ব্রিটিশ লেখক Sheridan Le Fanu রচিত ‘Dickon the Devil’
--------
লেখক পরিচিতিঃ শেরিডান লে
ফন্যু (১৮১৪ - ১৮৭৩): ভিক্টোরিয় হরর সাহিত্যের
পুরোধা এই লেখক এখন কোনো অজ্ঞাত কারণে বিস্মৃতপ্রায়। জন্মসূত্রে আইরিশ ফন্যু অনেক
ধরনের লেখাতে বিচরণ করলেও ওনার খ্যাতি মূলত হরর সাহিত্যের লেখক হিসেবেই। ভয়
সৃষ্টির জন্য ইঙ্গিত আর পরিবেশের কত বড়ো ভূমিকা তা ফন্যুর
লেখা পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়। এম আর জেমস, ব্রাম স্টোকারের মতো অনেকেই ফন্যুর লেখা থেকে
অনুপ্রাণিত। ফন্যুর বিখ্যাত লেখাগুলোর মধ্যে ‘আঙ্কেল
সাইলাস’,
‘কার্মিলা’, ‘ইন আ গ্লাস ডার্কলি’ অগ্রগণ্য।
--------
ছবিঃ আন্তর্জাল
অত্যন্ত সুচারু অনুবাদ। লে ফন্যুর মূল রচনার স্বাদ সম্পূর্ণ বজায় রেখে বাংলার নিজস্বতা দিয়ে গড়া। গা শিরশিরে ভয়ের রেশের মধ্যেই সাংস্কৃতিক সংযোগ নিবিড় হয়েছে। খুব ভালো লাগল।
ReplyDelete