
প্রবাসে দুর্গোৎসবঃ কোগরা ভ্রমণ
সুমন মিশ্র
এক
দুই
তিন
চার
পাঁচ
_____
ফোটোঃ লেখক
সুমন মিশ্র
স্থানঃ
কোগরা (Kogarah), নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। সময়টা ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস। মনমেজাজ কিছুদিন যাবৎ তেমন ভালো থাকছিল না।
সময় যত এগোচ্ছিল তত মন খারাপের একটা মেঘ যেন বুকের মধ্যে জমে উঠছিল। বাংলার আকাশে বাতাসে
তখন শরতের সুঘ্রাণ। বেজে
উঠেছে আগমনীর সুর। কিন্তু
আমি সেই সময় কর্মসূত্রে ছিলাম এই সবকিছুর থেকে বহু দূরে, পৃথিবীর
অন্য প্রান্তে, অন্য এক দেশে।
যেখানে ছিল না পুজোর সেই মনকেমন করা আবেশ, ছিল না সেই নাওয়া-খাওয়া ভোলা সাজো
সাজো রব।
প্রথমবার
দুর্গাপুজোয় বাংলার বাইরে।
এমন পরিস্থিতি যে হতে পারে তা আমি জানতাম, মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। তবে এটাও
ভেবেছিলাম কোনও না কোনও জায়গায় ঠিক একটা বেঙ্গলি এ্যাসোসিয়েশনের খোঁজ পেয়ে যাব, আর
তাহলে অবশ্যই খোঁজ পেয়ে যাব দুর্গা পুজোর।
কিন্তু
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক রকম। সময় এগিয়ে চললেও ঠিকঠাক খবরটা জোগাড় হচ্ছিল না। সিডনির
নিকট প্যারামাটায় আসার পর পরই একদিন আমি প্যারামাটা নদীতে গনেশ বিসর্জন হতে
দেখেছিলাম। তবে তা ছিল পারিবারিক পুজোর বিসর্জন। পরে খবর নিয়ে জানতে পারি
প্যারামাটায় কালীপুজো না হলেও দিওয়ালির উৎসব হয়। এমনকি প্যারামাটা পার্কে আতসবাজি
প্রদর্শনীও হয়ে থাকে। কিন্তু আশেপাশে দুর্গাপুজোর সন্ধান কেউ দিতে পারল না।
আমার এক ফ্ল্যাটমেট ছিল
ভেঙ্কট। অদ্ভুত মানুষ, বয়েস প্রায় পঁয়তাল্লিশ, বিয়ে-থা করেনি। তার ঘরে থাকত যীশু খ্রিষ্টের ছবির
পাশে হনুমানজির ছবি। একবার জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল প্যারামাটায় চলে আসার পর তার
কিছুতেই চাকরি জুটছিল না। সমস্ত রকম চেষ্টা করার পরেও ভাগ্যলক্ষ্মী বার বার মুখ ফিরিয়ে
নিচ্ছিলেন। শেষে
হতাশা যখন ক্রমশ তাকে গ্রাস করছে, সব পথ একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন
সে ঠিক করল আর না, এবার সে দেশেই ফিরে যাবে। একদিন নিজের মনে সে প্যারামাটার রাস্তায়
ঘুরে বেড়াচ্ছিল। প্যারামাটায়
ক্যাথিড্রাল চার্চ আছে বেশ কিছু, কিন্তু অধিকাংশেরই দরজা থাকে বন্ধ। কিন্তু হঠাৎ তার চোখে পড়ল ‘প্রিন্স
আলফ্রেড স্কোয়ার’-এর পূর্ব প্রান্তে ‘সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথিড্রাল’-এর দরজা খোলা
আছে। সে সোজা ঢুকে গেল সেই দরজা দিয়ে। জেসাসের মূর্তির সামনে গিয়ে বলল –
আমি তোমার বাসস্থানে এসে প্রার্থনা জানাচ্ছি। যদি তোমার মনে হয় আমার এই দেশে থাকা
উচিত তাহলে তুমিই তার ব্যবস্থা কর, নয়তো আর কিছুদিন পরেই আমি দেশে ফিরে যাব।
এর কয়েকদিনের মধ্যেই সে
একটি সুস্থায়ী চাকরি পেয়ে যায় এবং তখন থেকেই যীশু খ্রিষ্টের প্রতি তার অগাধ আস্থা।
রাতে খাওয়ার পর এক মনে
প্রথমে হনুমানজির নাম জপ করত, তারপর নিজের মতো করে জেসাসের কাছে প্রার্থনা জানাত।
সেই সময় তাকে ডাকাডাকি করলে সে ভয়ানক রেগেও যেত। তবে ওইটুকু রাগ বাদ দিলে সে ছিল
সদা হাস্যময় এবং পরোপকারী বন্ধু। সে মাঝে মাঝেই যেত প্যারামাটার
নিকট মুরগান মন্দির আর দুর্গা মন্দিরে। আবার ব্ল্যাক টাউনের গুরুদ্বারে তার নিয়মিত
যাতায়াত ছিল। তাই উপায়ান্তর না দেখে তাকেই ধরে বসলাম। কিন্তু সেও খবর আনল
প্যারামাটার কাছে দুর্গা মন্দিরে নবরাত্রিতে প্রতিদিন সন্ধ্যা আরতি হবে বটে তবে
আলাদা করে আমি যেমন খুঁজছি সেই রকম পুজো হবে না। তবে সে এটাও আশ্বাস দিল কোনও না
কোনও খবর সে নিশ্চয়ই আনবে। দিনগুলো এক এক করে কাটতে থাকল, খবর
আর এল না।
দিনটা
ছিল মহালয়া। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনে ঠিক সকাল চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র
অনুষ্ঠান শোনার জন্যে। ছোটোবেলা থেকেই বাড়ির বড়োদের দেখে গড়ে উঠেছে এই অভ্যাস। শুধু অভ্যাসই বা বলি কীভাবে, এর সঙ্গে
জড়িয়ে আছে আবেগ। ভোরের আলো যখন সদ্য ফুটে ওঠে, যখন ঘুম ভাঙা পাখিরা তাদের কলতানে
ভরিয়ে তোলে চরাচর, আকাশে বাতাসে মিশে থাকে ভোরের মিঠে সুবাস, ঠিক তখনই বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্রের অবেগঘন গলায় বেজে ওঠে -
‘হে
অমৃতজ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরণী হোক প্রাণময়ী।
জাগো!
জাগো! জাগো মা!’
সেটাই
তো সূচনালগ্ন বাঙালির প্রাণের পুজোর। এ
তো শুধুই ত্রিগুণাত্মিকা মহামায়াকে জেগে ওঠার আহ্বান নয়। এ যে ধর্ম বর্ণ
নির্বিশেষে, রাজ্য রাষ্ট্রের গন্ডি অতিক্রম করে সকল বাঙালির প্রতি আহ্বান। বাঙালিরও যে জেগে ওঠার সময় এসে
গেছে। তার
বৃহত্তম পার্বণ যে দোরগোড়ায় উপস্থিত।
তবে
আগেই বলেছি ২০১৮ সালটা ছিল আমার কাছে একটু অন্যরকম।
সিডনির
তিনটি ইন্টারন্যাশানাল টাওয়ারের একটিতে, সুউচ্চ অফিস
ক্যাফেটেরিয়ায় কফির কাপ হাতে বসে সে সব কথাই ভাবছিলাম। মনটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। বাংলার তখনও মহালয়ার সকালে জেগে
উঠতে কয়েক ঘণ্টা বাকি। কিন্তু ইউটিউবের দৌলতে কয়েক ঘণ্টা আগেই শুনে নিয়েছি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
তারপর থেকেই পুজোর সময় বাড়ির থেকে এত দূরে থাকার বিষণ্ণতা আরও তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল
আমার চেতনায়।
সামনের
কাচের ওপারে দেখা যাচ্ছে সিডনির অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যপট। আলোকোজ্জ্বল সুন্দর এক সকাল।
ডার্লিং হারবারের গাঢ় নীল জল রৌদ্রের প্রতিফলনে ঝলমল করছে। ভেসে চলেছে ফেরি, ‘রিভারক্যাট’,
বিভিন্ন ব্যাক্তিগত মালিকানাধীন বোট এবং অন্যান্য জলযান। কিছু প্রতিদিনের জল
পরিবহনের অংশ, কিছু টুরিস্টদের নিয়ে চলেছে বিভিন্ন পর্যটন স্থলে। চারপাশে মন ভালো
করা দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের রঙ মনমাতানো সুনীল। কোনও
কোনোদিন আকাশে একটুকরো মেঘও চোখে পড়ে না, আবার কোনও কোনোদিন আকাশ থাকে ধূসর
মেঘাচ্ছন্ন। আজ সুনীল আকাশের বুকে ভেসে চলেছে নিরীহ সাদা মেঘের মান্দাস। ঠিক যেন
আমাদের শরতের আকাশ। অস্ট্রেলিয়ার বুকে আজ যেন নেমে এসেছে এক টুকরো অকাল শরত।
খাতায়
কলমে অস্ট্রেলিয়ার বুকে এই সময়টা বসন্তকাল।
চারপাশে শুরু হয়েছে অপূর্ব রঙের খেলা। ‘রয়্যাল বোটানিক্যাল
গার্ডেন’ সেজে উঠেছে দেশবিদেশের নানা রঙের ফুলে। আর কিছুদিন পরেই সিডনির পথের ধারে
‘জ্যাকারান্ডা’ (Jacaranda) গাছগুলি ঢাকা
পড়বে অপরূপ বেগুনি ফুলের চাদরে।
ঝরে পড়া ফুলে ফুলে রাস্তা হয়ে যাবে মায়াময় বেগুনি। শীতের কামড় হালকা হয়ে এসেছে, কিন্তু সম্পূর্ণ কমেনি। হালকা একটা শীত শীত ভাব থেকেই গেছে।
আমার
এক দক্ষিণ ভারতীয় সহকর্মী আমায় খোঁজ দিয়েছিল সিডনির অফিসে একজন বাঙালি আছেন, তিনি
হয়তো আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। চলে গেলাম তাঁর কাছে। তিনি আমায় বেশ কিছু
পুজোর সন্ধান দিলেন, বেশিরভাগই প্যারামাটা থেকে অনেকটা দূরে। একে বিদেশের মাটি,
তারপর সব জায়গায় একা একাই ঘুরে বেড়াই, ব্যক্তিগত সুরক্ষার স্বার্থে তাই একেবারে
অচেনা জায়গায় যেতে প্রথমেই সাহস পেলাম না। অস্ট্রেলিয়া সুরক্ষিত দেশ হলেও ভারতীয়দের
উপর আক্রমণের বিক্ষিপ্ত ঘটনার কথা মাঝে মধ্যে কর্ণগোচর হয়। যদিও তা বিরল, তবুও
সাবধানের মার নেই। একেবারে কাছেপিঠের মধ্যে স্ট্র্যাথফিল্ডে (Strathfield) একটা
দুর্গাপুজো হওয়ার কথা আছে। তবে হিসেব করে দেখলাম সেটা হবে নিয়ম অনুযায়ী একাদশীর
দিন। আসলে অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালিদের পুজো পার্বণগুলো হয় সপ্তাহান্তে। হয়তো পঞ্জিকা
অনুযায়ী দুর্গাপুজো হওয়ার কথা সপ্তাহের মাঝে, কিন্তু এখানে সেই সপ্তাহেরই আগের বা
পরের শনি-রবিবার একসঙ্গে সপ্তমী থেকে দশমীর পূজা পদ্ধতি সম্পন্ন করা হয়। ঠিক করলাম
স্ট্র্যাথফিল্ডেই
যাব পুজো দেখতে।
১২
অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার। পঞ্জিকা মতে তৃতীয়া। কলকাতা সেজে উঠেছে পুজোর সাজে, ঝলমল
করছে আলোর রোশনাইতে। আমার ফোনের হোয়াটসআপ, ফেসবুক উপচে পড়ছে সেইসব ছবিতে। বন্ধুরা
ছবি পাঠাচ্ছে, আমার খবর নিচ্ছে, ভিডিও কল করে মন ভালো রাখছে। বন্ধুদের প্রয়োজন
একজন মানুষের জীবনে যে কতটা এইসব ছোটো খাটো মুহূর্তগুলো বার বার প্রমাণ করে।
ভেঙ্কট
গিয়েছিল গুরুদ্বারে। ফিরতে বেশ
রাত হল। আমার সঙ্গে দুটো কথা বলে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে
তার দক্ষিণ ভারতীয় টান মিশ্রিত হিন্দিতে বলল - দুর্গাপুজো কোথায় হচ্ছে খোঁজ পেলে?
আমি
তাকে সবিস্তারে বললাম। সে বলল – আমিও খোঁজ পেলাম ‘কোগরা’ বলে একটা জায়গায় বড়ো করেই দুর্গাপুজো হবে। খোঁজ নিয়ে দেখো।
কোগরার
নাম আমি আগে শুনিনি। টুরিস্ট স্পট হলে আমার কাছে খবর থাকত। পুজো সত্যিই হলে, হয়
পরের দুই দিনে হবে, নয়তো তার পরের সপ্তাহে।
রাত
তখন এগারোটা, গুগলে সার্চ করে দেখলাম পরের দুই দিনই সেখানে পুজো আছে। আর যা যা
বিষয়ে তথ্য দরকার সব লিখে নিলাম। প্যারামাটা থেকে ট্রেনে ঘণ্টা খানেকের জার্নি।
গুগল
ম্যাপে কোগরা স্টেশন থেকে পুজোর আয়োজন স্থল অবধি যাওয়ার রাস্তাটাও মোটামুটি বুঝে
নিলাম।
পরের
দিন আমার যাওয়ার কথা ছিল ‘ফেদারডেল ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক’-এ। সেখানে নিজের হাতে ক্যাঙ্গারুকে
খাবার খাওয়ানো যায়। সেই পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা ত্যাগ করে কোগরার দুর্গাপুজোয়
যাব কিনা সেই বিষয়ে মনস্থির করতেই সময় কেটে গেল অনেকটা।
ঘড়ির
কাঁটা তখন রাত একটা ছুঁই ছুঁই, ঠিক করলাম দুর্গাপুজো দেখতেই যাব।
পরের
দিন সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে রওনা হলাম গন্তব্যে। প্যারামাটা স্টেশনে
ট্রেন এল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে।
শনিবার বলে ট্রেনের কামরা একদমই ফাঁকা। ফলে পছন্দমতো দোতলার জানালার ধারের
আসন পেতে সমস্যা হল না। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এখানকার সমস্ত ট্রেনই দোতলা। ট্রেনের
দরজা থাকে প্ল্যাটফর্মের সোজাসুজি, যাত্রীরা ট্রেনে প্রবেশ করে সেখানে দাঁড়াতে
পারে, সঙ্গে কিছু বিশেষ ‘কার্টসি’ আসন থাকে বয়স্ক মানুষ ও মহিলাদের জন্য। সেখান
থেকে যাত্রীরা কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে বা নেমে ট্রেনের দোতলা বা একতলায় যেতে পারে।
ট্রেনের একতলার আসন থাকে প্ল্যাটফর্মের থেকে একটু নিচে, ফলে প্ল্যাটফর্ম থাকে প্রায় যাত্রীদের
চোখের সমান উচ্চতায়। তবে কাচে ঢাকা বড়ো জানলাগুলোর জন্য বাইরের দৃশ্য দেখতে
অসুবিধে হয় না। তবে আমার দোতলার আসনই পছন্দ ছিল কারণ সেখান থেকে অনেক দূর অবধি
দেখা যায়। এখানে সব ট্রেনই দ্রুতগতির এবং সব স্টেশনে দাঁড়ায় না, তাই গন্তব্য
অনুযায়ী ট্রেনে উঠতে হয়, যেমন প্যারামাটা, সেন্ট্রাল, রেড ফার্নে অনেক ট্রেন
দাঁড়ালেও প্যারামাটার পাশে হ্যারিস পার্কে অনেক কম ট্রেন দাঁড়ায়।
প্যারামাটা
থেকে কোগরা
প্রায় চল্লিশ মিনিটের ট্রেনযাত্রা। সরাসরি যাওয়া যাবে না। প্রথমে রেড ফার্ন বা
সেন্ট্রাল স্টেশনে যেতে হবে, তারপর অন্য লাইনের ট্রেন ধরে কোগরা। ঠিক করলাম রেড ফার্ন
দিয়েই যাব, কারণ অফিস যাওয়ার পথে দেখেছি রেড ফার্নে মোটে কয়েকটা প্ল্যাটফর্ম,
কিন্তু সেন্ট্রালে যেহেতু সব প্রান্তের রেলপথ এসে মিলিত হয় তাই প্ল্যাটফর্মের
সংখ্যা প্রায় পঁচিশ। আমি যে ট্রেনে উঠেছিলাম সেটা প্যারামাটার পরে সরাসরি থামত
স্ট্র্যাথফিল্ড এবং রেড ফার্ন স্টেশনে।
রেড ফার্ন পৌঁছে দেখলাম
কোগরা যাওয়ার ট্রেন আসে ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। রেড ফার্নে মাটির উপর দশটি
প্ল্যাটফর্ম। এগারো এবং বারো ‘আন্ডার গ্রাউন্ড’ প্ল্যাটফর্ম।
ব্যাপারটা বুঝতে যেটুকু সময় লাগল তারপর হাতে ছিল মাত্র দুই মিনিট। কোনোমতে ছুটে
গিয়ে ট্রেন ধরতে হল।
এবার আসি কোগরা (Kogarah)
প্রসঙ্গে। এটি দক্ষিণ সিডনির একটি ছোট্ট শহরতলী। সিডনির বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট থেকে
চোদ্দ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি সিডনির রেল পরিবহনের ‘টি ফোর’ বা ‘ইস্টার্ন
সাবার্ব এন্ড ইলাওয়ারা’ লাইনে অবস্থিত। রেড ফার্ন থেকে পাঁচটি স্টেশন দূরে।
কোগরার নামটি এসেছে
জর্জেস নদীর ‘বোটানি বে’-তে (Botany Bay) মোহনার সামান্য আগে অবস্থিত ছোট্ট একটি উপসাগর
‘কোগরা বে’-র (Kogarah Bay) নাম থেকে। আগে কোগরা এলাকা
‘কোগরা বে’ অবধি বিস্তৃত ছিল। পরে এলাকা বিভাজনের পরে ‘কোগরা বে’ কোগরা থেকে
অনেকটা দক্ষিণে অবস্থান করছে। কোগরা শব্দটা প্রাচীন জনজাতিরা ব্যাবহার করত, যার
মানে বড়ো ঘাসের এলাকা। প্রাচীন জনজাতিকে প্রায় বিলুপ্তির মুখে ছুড়ে দিলেও, তাঁদের
ব্যবহৃত নামগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে।
কোগরাতে ইউরোপীয়দের
বসবাসের ইতিহাস উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে। একদম প্রথমের দিকে জন টাউনসন এবং জেমস
চ্যান্ডলার নামক দুই ব্যাক্তি এখানে বিপুল জমির অধিকারী হন। সেই সময় এই এলাকা থেকে
সিডনিতে সবজি, ফল, ঝিনুক ইত্যাদি রপ্তানি হত।
বর্তমান কোগরা পরিচিত তার
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর জন্য। অস্ট্রেলিয়ার বহু
বিখ্যাত মানুষ কোগরার বাসিন্দা ছিলেন। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক
এবং বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান স্টিভ স্মিথের জন্ম এখানেই।
রেলপথে রেড ফার্ন থেকে
কোগরা আসতে লাগল পনেরো মিনিট। পথে দু’পাশে দেখা গেল সিডনির প্রান্তভাগে শহরতলীর
নয়নাভিরাম দৃশ্য। দু’পাশের এলাকায় ঢালু রাস্তা নেমে এসেছে রেলপথের সমান্তরাল গাড়ি
চলাচলের পথ অবধি। সেই ঢালু রাস্তার ধারে বাড়িগুলো পরিকল্পনামাফিক সাজানো। বাগানগুলোয়
ছড়িয়ে আছে বসন্তের রঙ।
![]() |
কোগরা স্টেশন |
কোগরাতে ট্রেন থামল চার নম্বর
প্ল্যাটফর্মে।
অদ্ভুত এক আলোআঁধারি সমস্ত স্টেশন জুড়ে। এমন অদ্ভুত স্টেশন আমি সিডনির আশেপাশে
আর কোথাও দেখিনি। এর
কারণ কোগরার রেলস্টেশনের উপরেই গড়ে উঠেছে এক শপিং মল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার পথ ওই শপিং
মলের মধ্য দিয়ে।
গুগল ম্যাপ দেখে
গন্তব্যের উদ্দেশে চললাম। আমাকে যেতে হবে ‘জেমস কুক বয়েজ টেকনলজি হাই স্কুল’-এ।
সেখানেই ‘বাংলাদেশ পূজা এসোসিয়েশন’-এর উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী
দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়েছিল।
রাস্তা চিনতে কোনও
অসুবিধা হল না। স্টেশনের সামনের রাস্তার নাম ‘রেলওয়ে প্যারেড’, বেশ
কোলাহল পূর্ণ। রাস্তা পার করে গিয়ে পড়লাম ‘মন্টগোমেরি স্ট্রিটে’। সকাল থেকে আকাশটা পরিষ্কারই ছিল।
নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের আনাগোনা। চারপাশ ঝকঝক করছে। এই রাস্তার শুরুর কিছুটাকে
আইন পাড়া বলা চলে। বাড়িগুলো পুরোনো স্থাপত্যের স্মারক, সুন্দরভাবে সংরক্ষিত। নতুন
বাড়িও আছে, তবে নতুন পুরোনোর মধ্যে এক অকথিত সাম্য আছে। ছোটোখাটো ক্যাফেও কিছু
চোখে পড়ল। কিছুটা এগোতেই ডান হাতে পড়ল ‘সেন্ট জর্জ পুলিশ স্টেশন’ এবং কোগরা কোর্ট
হাউস। আশেপাশের বাড়িগুলোতেও চোখে পড়ল বিভিন্ন আইনজীবীদের বিজ্ঞাপন। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখলাম বেশ কিছু পুলিশের গাড়ি।
![]() |
‘মন্টগোমেরি স্ট্রিটে’-র উপর দেখা যায় এমনই শতাব্দী প্রাচীন অনেক বাড়ি। চিত্রে দেখা যাচ্ছে একটি বাড়ির উপর তৈরির সময়কাল লেখা ১৮৮৮। |
এখানে কোগরা কোর্টের
ব্যাপারে দু-একটা কথা না বললেই নয়। একটি আর্টস স্কুলকে কেন্দ্র করে ১৯১৮ সালে তৈরি হয়
এই কোর্ট হাউস। প্রধান স্থপতির নাম জর্জ ম্যাকরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার যে
কয়টি স্থাপত্য এখনও টিকে আছে এই এলাকায়, তাদের মধ্যে এই কোর্ট হাউস অন্যতম। ‘এন এস
ডাব্লিউ অফিস অফ এনভায়রনমেন্ট এন্ড হেরিটেজ রেজিস্টার’ এই কোর্ট হাউসকে ‘অ্যান অ্যাট্রাকটিভ
এন্ড মডেস্ট ফেডারেশন আর্টস এন্ড ক্রাফটস স্টাইল পাবলিক বিল্ডিং’ বলেছে। তবে এখানে
২০১৫ সালের পর থেকে ক্রিমিনাল কেসের শুনানি হয় না। সপ্তাহে দুই দিন অসামরিক এবং
প্রশাসনিক মামলার শুনানি হয়।
![]() |
শতাব্দী প্রাচীন ‘কোগরা কোর্ট হাউস’ |
‘মন্টগোমেরি স্ট্রিট’ ধরে
এগিয়ে চললাম। ‘কেনিংস্টন রোড’-এর সংযোগস্থল থেকে আরও এগিয়ে গিয়ে পড়লাম ‘সাউথ
স্ট্রিট’। এইখানে আছে সেন্ট জর্জ হসপিটাল যেখানে জন্মেছিলেন ক্রিকেটার স্টিভ
স্মিথ। তারপর
কয়েক পা এগোতেই সামনে পড়ল ‘প্রিন্সেস হাইওয়ে’। এই হাইওয়ে কোগরাকে সিডনির সঙ্গে
যুক্ত করেছে। ‘প্রিন্সেস হাইওয়ে’ সম্পর্কে এক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়ে
রাখা উচিত। ১৯২০ সালে তৎকালীন ‘প্রিন্স অফ
ওয়েলস’ এবং পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। ১৯৩৬
সালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের মৃত্যু হলে অষ্টম এডওয়ার্ড রাজা হন। কিন্তু
বছর খানেকের মধ্যেই তিনি রাজমুকুট পরিত্যাগ করায় বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের
বাবা,
ষষ্ঠ জর্জ রাজত্ব লাভ করেন।
সেই অষ্টম এডওয়ার্ডের
সম্মানে এই রাস্তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘প্রিন্সেস হাইওয়ে’। দ্বিতীয়ত প্রায় বারোশো মাইল লম্বা
এই হাইওয়ে সিডনি থেকে অ্যাডিলেড অবধি উপকূলরেখার কাছ বরাবর বিস্তৃত।
এই রাস্তাটুকু পেরোলেই পৌঁছে
যাব গন্তব্যে।
![]() |
‘জেমস কুক বয়েজ টেকনলজি হাই স্কুল’-এর খেলার মাঠ। আকাশে চলছে মেঘের খেলা। |
বিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ
করেই প্রথম চোখে পড়ল একদল কমবয়েসি যুবক যুবতী গল্প করছে। যুবকদের পরনে পাঞ্জাবি, মেয়েদের
পরনে শাড়ি। জিজ্ঞাসা করলাম পুজো কোথায় হচ্ছে, তাঁরা আমাকে দিক নির্দেশ করে দিল।
আমি নিজেই চারপাশটা ভালো করে দেখলে হয়তো জায়গাটা খুঁজে নিতে পারতাম, কিন্তু
বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আর একদল বাঙালির সঙ্গে বাংলায় কথা বলার যে আনন্দ সেটা আমি
হাতছাড়া করতে চাইনি।
বিদ্যালয়টি বিশাল এলাকা
নিয়ে অবস্থিত। বিদ্যালয় চত্বরে বেশ কিছু ভবন থাকলেও কোনোটিরই উচ্চতা বিশেষ নয়।
একতলা বা দুইতলা। তবে পুজো দেখার জন্য আমি যেখান দিয়ে প্রবেশ করলাম সেটা
শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার স্থান। সামনেই পড়ল বিশাল এক রাগবি খেলার মাঠ, তার পাশে
আরও একটি বড়ো মাঠ। মাঠের প্রান্ত বরাবর অনেক বড়ো বড়ো গাছ রয়েছে। বিদ্যালয়ের এলাকার
প্রান্তভাগে, দ্বিতীয় মাঠটির শেষপ্রান্তে বেশ কিছু বাস্কেটবল এবং টেনিস কোর্ট। শনিবার,
স্কুল চত্বরে শিক্ষার্থীদের কোলাহল নেই। মাঠের উপর নিশ্চিন্তে ঘুরে
বেড়াচ্ছে ‘অস্ট্রেলিয়ান ম্যাগপাই’ আর কিছু ক্রেস্টেড বা ঝুঁটিওয়ালা পায়রা। সঙ্গে
আছে বিশাল আকাশের বুকে সাদা মেঘের খেলা। ইস, আমাদের দেশেও যদি স্কুলের সঙ্গে এত বড়ো
মাঠ এবং এত রকম খেলার সুবিধা থাকত। দেখেই বোঝা যায় এখানে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার
উপর বেশ জোর দেওয়া হয়।
![]() |
চলছে প্রথম দিনের পুজো |
পুজো হচ্ছিল যে হল ঘরটিতে
সেটার গড়ন লম্বাটে। সেখানে প্রবেশ করে দেখলাম সেটা আসলে ইন্ডোর বাস্কেটবল কোর্ট। আপাতত
সেই কোর্টের পুরো জায়গাটা জুড়ে দর্শনার্থীদের জন্যে আসন পাতা। হলের শেষ প্রান্তে
একটা মঞ্চ, হয়তো বাৎসরিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়। তবে আপাতত সেখানে অধিষ্ঠান করছেন
সপরিবারে মা দুর্গা। পুজো চলছিল। ঘড়ি বলছিল প্রায় পৌনে বারোটা,
তবুও উপস্থিত লোকজনের সংখ্যা যথেষ্ট কম। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে পুজো দেখলাম। তারপর
একটু আশেপাশে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। যত পুষ্পাঞ্জলির সময় এগিয়ে আসতে থাকল এক এক
করে গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকল। পুজোর নির্ঘণ্ট বলছিল দুপুর একটায় পুষ্পাঞ্জলি, ঘড়ির
কাঁটা যদিও এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট সময়কে উপেক্ষা করেই। লোক সমাগম ধীরে ধীরে বাড়ছিল। মাঝে
মাঝে বেজে উঠছিল মন মাতানো ঢাকের বাদ্যি।
অবশেষে
মায়ের ভোগ নিবেদন পর্ব সমাধা হলে ধূপ ধুনো ঘণ্টা সহযোগে আরতি হল। তারপর হল পুষ্পাঞ্জলি। পুষ্পাঞ্জলির
মন্ত্র ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত, অন্তত আমি যেটুকু শুনে বুঝলাম। হয়তো সময় সংকুলানের
জন্য। আসলে আমরা তো দিন দিন শুধু ছুটে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, তাই সব কিছুই হয়ে
যাচ্ছে সংক্ষিপ্ত। সব শেষে চরণামৃত বিতরণের পর শুরু হল প্রসাদ বিতরণ পর্ব।
সকলে
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রসাদ সংগ্রহ করল। এইসব করতেই বেজে গেল প্রায় তিনটে। সময়সূচির
হিসাবে সব কিছুই চলছিল বেশ বিলম্বিত লয়ে। তাই দুপুরের ভোগ প্রসাদের জন্যে আর
অপেক্ষা করতে পারলাম না।
বেরিয়ে
পড়লাম আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্যে। বিদ্যালয়ের সীমানা বরাবর রেলিং-এর গা ঘেঁষে ছিল
‘বটলব্রাশেস ক্যালিসটিমন’ (Bottlebrushes Callistemon) ফুলের গাছ. লাল রঙের অনিন্দ্যসুন্দর ফুলে ঢাকা পড়েছে সেই গাছ। ঠিক উলটোদিকেই
দেখলাম একটি ছিমছাম ছোট্ট চার্চ, ‘সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথলিক চার্চ’। কিন্তু কিছু
মেরামতির কাজ চলায় ঢুকতে পারলাম না।
![]() |
‘বটলব্রাশেস ক্যালিসটিমন’ (Bottlebrushes Callistemon) ফুলের গাছে বসন্তের সাজ |
বিদ্যালয়
ভবন থেকে হাইওয়ে ধরে সামান্য এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল ডান হাতে চলে গেছে ‘প্রেসিডেন্ট
এভিনিউ’। মোটামুটি চওড়া দ্বিমুখী সড়ক সোজা চলে গেছে ‘বোটানি বে’-র দিকে। ‘বোটানি
বে’ দেখার ইচ্ছা ছিল অন্য কারণে। এ তো শুধু এক ভৌগলিক এলাকা বা সামান্য উপসাগর নয়। ‘বোটানি বে’-র সঙ্গে নিবিড়ভাবে
জড়িত অস্ট্রেলিয়ার ইউরোপীয় উপনিবেশের ইতিহাস। ক্যাপ্টেন জেমস কুক ১৭৭০ সালের
এপ্রিল মাসে এই ‘বোটনি বে’-র ধারে বর্তমান ‘কার্নেল’ নামক এলাকায় অস্ট্রেলিয়ার
বুকে পা রাখেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ১৭৮৮ সালে বন্দিদের
নিয়ে প্রথম জাহাজ আসে এই নব আবিষ্কৃত ভূখণ্ডে। তবে ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের মনে
হয় ‘বোটানি বে’-র আশেপাশে বসতি গড়ে তোলার কিছু সমস্যা আছে। মূলত তাঁর মনে হয় এখানকার
মাটি বাড়িঘর তৈরির পক্ষে দুর্বল। এছাড়া
স্বাদুজলের অভাব এবং জাহাজ নোঙর করার সমস্যার জন্য ‘বোটানি বে’-তে বসতি স্থাপনের
পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয়। এরপর আর্থার ফিলিপ জাহাজ নিয়ে আরও উত্তরে গিয়ে এক
প্রাকৃতিক বন্দর খুঁজে পান এবং সেখানেই প্রথম ইউরোপের দাগী আসামীদের নিয়ে তৈরি হয়
উপনিবেশ। সেই প্রাকৃতিক বন্দরই আজকের পৃথিবী বিখ্যাত ‘সিডনি হারবার’।
যদিও
আমি ‘প্রেসিডেন্ট এভিনিউ’ ধরে এগিয়ে ‘বোটানি বে’-র যেখানে পৌঁছতাম সেখান থেকে ‘কার্নেল’
নামক জায়গাটা ছিল অনেক দূরে। প্রেসিডেন্ট এভিনিউ’-র
শেষ প্রান্তে সমুদ্র সৈকতে নামলে, সেখান
থেকে বাঁ দিকে দেখা যায় সিডনির ‘কিংগসফোর্ড স্মিথ’ বিমান বন্দর, আর ডান দিকে দূরে
দেখা যাওয়ার কথা ‘কার্নেল’-এর অংশবিশেষ।
![]() |
‘প্রেসিডেন্ট এভিনিউ’। এই রাস্তা ধরেই এগিয়ে গেলে পৌছনো যাবে ‘বোটানি বে’-তে। |
চলার
পথে দু’পাশে ছোটো এক বা দুইতলা বাড়ি, সামনের বাগানগুলি বসন্তের স্মারক স্বরূপ ফুলে
ফুলে মোড়া। মনোরম পরিবেশ। মাঝরাস্তা অবধি আসতে না আসতেই দেখলাম আকাশের সুনীল ভাব ততক্ষণে
মলিন হয়ে গেছে, শুরু হয়েছে ঘন কালো মেঘের ভ্রূকুটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আশঙ্কা সত্যি
প্রমাণিত করে বজ্র বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি শুরু হল। কোনোমতে দৌড়ে কয়েকটি বড়ো গাছের নিচে
আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি একটু পরেই ধরে এলেও টিপ টিপ করে পড়েই চলছিল, তাই বাড়ি ফিরে
আসাই মনস্থির করলাম।
নাঃ,
‘বোটানি বে’ দর্শন আমার আর হয়নি।
‘বাংলাদেশ
পূজা এ্যাসোসিয়েশন’-এর দুর্গোৎসবের পরিবেশ আমার এতটাই ভালো লেগেছিল, দ্বিতীয় দিনও,
মানে রোববার আবার সেখানে যাওয়া মনস্থ করি। প্রথমেই যে কাজটা করি বিদ্যালয়ে যাওয়ার
পথে আগের দিনের মতো ‘সাউথ স্ট্রিট’ না ধরে তার ঠিক আগের রাস্তা ‘হগবেন স্ট্রিট’ ধরলাম।
সেখানে ‘প্রিন্সেস হাইওয়ে’ পার করার জন্য একটি ওভারব্রিজ আছে। সেখান থেকে দেখতে পাওয়া
যায় নীল আকাশের নিচে এই রাজকীয় রাস্তার এক অনবদ্য দৃশ্য।
![]() |
‘হগবেন স্ট্রিট’-এর ওভার ব্রিজের উপর থেকে তোলা ‘প্রিন্সেস হাইওয়ে’-র ছবি (দক্ষিণ দিকের) |
![]() |
‘হগবেন স্ট্রিট’-এর ওভার ব্রিজের উপর থেকে তোলা ‘প্রিন্সেস হাইওয়ে’-র ছবি (উত্তর দিকের) |
এইদিন
পুজো সময় মেনে হওয়ায় ঠিক সময়ে পুস্পাঞ্জলি এবং প্রসাদ বিতরণ সম্পন্ন হয়। দুপুরের
ভোগ প্রসাদও বিতরণ করা হয়।
কথায়
কথায় একজনের থেকে জানতে পারি ‘জেমস কুক বয়েজ টেকনলজি হাই স্কুল’-এরও এক ইতিহাস আছে। ২৯শে
এপ্রিল ১৯৭০, ক্যাপ্টেন জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়ার বুকে পা রাখার দ্বিশত বর্ষ উদযাপন
উপলক্ষে ইংল্যান্ডের বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। তখন অবশ্য এই স্কুলের নাম ছিল ‘মোরে ফিল্ড বয়েজ হাই
স্কুল’। সঙ্গে
এসেছিলেন তাঁর স্বামী
‘ডিউক অব এডিনবার্গ’, প্রিন্স ফিলিপ এবং রাজকন্যা
এ্যান।
দ্বিতীয়
দিন পুজোয় গিয়ে কিছু নতুন জিনিস চোখে পড়ে। প্রথম
দিন যিনি পুজো করছিলেন পরের দিন তিনি অন্য দায়িত্ব পালন করছিলেন। দ্বিতীয় দিনের
পুরোহিত ছিলেন অন্য ব্যাক্তি। সমস্ত আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর ঢাকের আওয়াজের
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা প্রতিমার সামনে পূজার স্থান বেশ কয়েকবার
প্রদক্ষিণ করার পর সেই বছরের মতো দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা হয়। এই ব্যাপারটা আমার
কাছে বেশ নতুন লেগেছিল।
আর একটা পর্যবেক্ষণ আমাকে
আনন্দ এবং বেদনা দুটোই দিয়েছিল। দেখলাম বাঙালি কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা তাদের
অস্ট্রেলীয় বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এসেছে পুজো দেখাতে। ভালো লাগল বাঙালি সংস্কৃতির এই
প্রচার দেখে। সঙ্গে খারাপ লাগল যখন দেখলাম মাঝবয়সিরা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা
বললেও কম বয়েসিরা নিজেদের মধ্যে বাংলায় প্রায় কথা বলছিলই না, তারা আড্ডাও মারছিল
ইংরেজিতে। তাদেরই বা দোষ দিই কীভাবে। খাস কলকাতার বুকেই তো চোখে পড়ে
বাংলা ভাষার হিন্দি, ইংরেজি মিশ্রিত বিকৃত ব্যাবহার। যেখানে কলকাতাতেই দেখা যায় বাংলার
থেকে ইংরেজি কথা বলাকে আধুনিকতার প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হয় সেখানে সিডনির উপকণ্ঠে
বসে কী করে কমবয়েসিদের বাংলায় কথাবার্তা আশা করি। তবুও ভয় হয় এইভাবে প্রজন্মের পর
প্রজন্ম ধরে বাংলা ব্যবহারের ক্ষয়িষ্ণুতার পথ ধরে একসময় অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী
বাঙালি সমাজে বাংলা ভাষা শুধু অতীত শিকড়ের স্মৃতিটুকু হয়ে থাকবে না তো?
কোগরার দুর্গোৎসব শেষ হল,
কলকাতার দুর্গোৎসব শুরু হবে পরের দিন থেকে। কোগরার দুর্গাপুজো আমার দেশের বাইরে
থাকার দুঃখ কিছুটা হলেও লাঘব করতে সমর্থ হয়েছিল। মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে
গিয়েছিল। না, এ শুধু দেশ থেকে এত দূরে থাকার পরও দুর্গোৎসব উপভোগ করতে পারার আনন্দ নয়।
দেশের বাইরে বাঙালি সংস্কৃতির কাছাকাছি আসতে পারার আনন্দ, দেশের বাইরে দু’দিন একদম
বাঙালি হয়ে বাঁচতে পারার আনন্দ। যার ফলস্বরূপ পরের সপ্তাহে আবার গিয়েছিলাম
স্ট্র্যাথফিল্ডে পুজো দেখতে। তবে সেই অভিজ্ঞতার কথা পরে একসময় বলব।
কোগরাকেও কি আমি পুরোপুরি
চিনে উঠতে পেরেছিলাম? দেখা হয়নি অনেক কিছু। কিছুটা সময়ের অভাবে, আর কিছুটা
অভিজ্ঞতার অভাবে। দেখা হয়নি কোগরা কোর্টের ঠিক পিছনের রাস্তায় সুন্দর ‘গ্রিক অর্থোডক্স
চার্চ’, দেখা হয়নি ১৮৬৯ সালে তৈরি ‘সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল’ চার্চ। আসলে কোগরা সেই
রকম পর্যটন স্থল হিসেবে সামনের সারিতে এখনও উঠে আসেনি। তাই এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলি
খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। তবে কোগরা চিরকাল আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকবে ২০১৮
সালের দুর্গোৎসবের সুমধুর স্মৃতির জন্যে।
ফোটোঃ লেখক
No comments:
Post a Comment