
তিন হাজার কুড়ি
সুমিত নাগ
।। ১।।
।। ২।।
_____
সুমিত নাগ
।। ১।।
তিয়ানি’র চোখ খুঁজে খুঁজে দেখছিল
সব কিছু। এই বিশাল
বিল্ডিং, ডি-এন-এ গঠনের মতো পাক খেয়ে-খেয়ে উঠেছে একেবারে আকাশ
ফুঁড়ে। নিচের তলা’র ফাঁকা জায়গাটা আলোচনা
সভা’র জন্য আর বাকি প্রতিটা তলা ভর্তি বইয়ের দোকানে; বই আর পাঠকের ভিড়ে। প্রত্যেক দোকানেই একজন করে রোবট-বিক্রেতা
উপস্থিত, প্রয়োজনে অন্যান্য যন্ত্রকর্মীও। তারা ক্রেতা
ও পাঠকের চাহিদা মতো বই ও বই-সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করছে, তাদের কাছে বই পৌঁছে
দেবার ব্যবস্থা করছে। সমস্ত জায়গা ঝলমল করছে সাদা আলোয়, সূর্যের সাত বর্ণ শুদ্ধ রঙ আলাদা করে
ছেঁকে, তাদের নতুন করে বিশেষ পদ্ধতিতে মিশিয়ে এই রঙ তৈরি করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে, এলিয়েনদের
সাহিত্য নিয়ে পৃথিবীতে দারুণ উৎসাহ দেখা গেছে। প্রায় আশি আলোকবর্ষ দূর থেকে ‘সোলাক্স’ গ্রহের একজন সাহিত্যিক ভার্চুয়ালি
যোগ দিয়েছেন এই বইমেলায়। ‘তান্দুলা’ গ্যালাক্সি’র সবচেয়ে বড়ো
লেখক বলে মনে করা হচ্ছে তাঁকে। সভায় তিনি
পৃথিবীর সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। এছাড়াও আলোচনায়
উপস্থিত আছেন রোবট-সাহিত্যিকরাও। মানব ও
এলিয়েন সমাজে তাঁদের সাহিত্যে’র গুরুত্ব ও মর্যাদা — এই নিয়ে তাঁরা বক্তব্য রাখছেন। উপস্থিত গুণমুগ্ধ দর্শক-পাঠকরাও। সবার ভার্চুয়াল উপস্থিতি জমজমাট করে তুলেছে
গোটা জায়গা। সব মিলিয়ে জমে উঠেছে এবছরের
আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রতিটা কোনা।
তিয়ানি কিন্তু বেশিক্ষণ এদিকে
থাকার প্রয়োজন অনুভব করল না। তার আসল আগ্রহ
প্রাচীন বইয়ের প্রতি। সে পড়াশোনাও করছে প্রাচীন
ভাষা-সাহিত্য নিয়ে, তাও প্রায় হাজার বছর আগের। ওর মা অবশ্য চেয়েছিলেন যে, সে তাঁরই মতো টাইম-সায়েন্টিস্ট হোক। কিন্তু তিয়ানি’র ইচ্ছের কাছে সেটা পাত্তা
পায়নি। সে বেশি সময় নষ্ট না-করে একদম উপর
তলায় চলে এল। এদিকে সেই প্রাচীন বইয়ের স্টলগুলো,
লোকজনও স্বাভাবিকভাবেই কম। মূলত
গবেষকদের ভিড়। দোকানগুলোও নিজেদের প্রাচীন বই
সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন করছে পাঠক-মনন আকর্ষণ করতে। সে একটার পর একটা দোকানের ডিসপ্লে দেখে যেতে থাকল, যদি পছন্দমতো কিছু
পাওয়া যায়। তবে, সমস্ত প্রাচীন বই-ই আর কিনতে
পাওয়া যায় না। ‘দুর্লভ’ বলে চিহ্নিত সেই বইগুলো
রাখা হয় উৎসাহী পাঠকদের দেখাবার জন্য, গবেষকরা চাইলে, কিছুদিনের জন্য সেগুলো
ব্যবহার করার আবেদনও করতে পারেন। তিয়ানি ঠিক
করেছে তার প্রয়োজনমতো কোনও বই না-পেলে সে এটাই করবে। প্রতিবার খুঁজে-খুঁজে সে দেখে, তার গবেষণার উপযোগী কোনও প্রাচীন বই আছে
কিনা, কিন্তু প্রতিবারই খালি হাতে ফিরতে হয়। হয়, পাওয়া যায়
না; নয়তো ‘দুর্লভ’ বলে চিহ্নিত। তবে প্রাচীন
লেখক ও তাঁদের লেখা নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ সে অনেক কিনেছে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো
এখনকার বইয়ের মতো ভার্চুয়াল। ফলে আগেকার কোনও
ছাপা বই সংগ্রহ করা হয়নি ওর। পুরোনো
বইগুলো’র ঘ্রাণ কী যে ভাল লাগে ওর! কয়েকবার হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে, ও শুঁকে
দেখেছে মলাট, ভিতরের পাতা - সেই সুগন্ধের সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা হবে না। আগেকার বইয়ের একটা মজাও ছিল বটে।
‘হ্যামলেট’, ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’,
‘ইউলিসিস’ - ইংরেজি বইয়ের দোকান ছাড়িয়ে চলে এল তিয়ানি। এই ভাষাটাকে সে একবারে বাগে আনতে পারেনি। একটু-আধটু পড়তে পারে মাত্র। এখন আর পৃথিবীতে শুদ্ধ ভাষা বলে কিছু নেই। ভাষাবিজ্ঞানীদের প্রায় পাঁচশো বছরের প্রচেষ্টায়
‘আন্তর্জাতিক সাংকেতিক ভাষা’ (আসাভা) তৈরি হয়েছে। এখন তাঁরা ব্যস্ত মহাজাগতিক কোনও ভাষা সৃষ্টি করতে যা বিভিন্ন গ্যালাক্সির
মধ্যে যোগাযোগ রাখতে ব্যবহার করা যাবে। তিয়ানি
ফরাসি, স্প্যানিশ ভাষার স্টলগুলো ছাড়িয়ে এগোতে লাগল। তিয়ানি’র মাঝে-মাঝে মনে হয় সব বই কিনে নেয়, সে ভাষা জানুক আর না-ই জানুক!
কিন্তু সেটা সম্ভব না। এখন প্রত্যেক মানুষের জন্য
নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ধার্য করা থাকে, কেউ ইচ্ছেমতো যা খুশি খরচ করতে পারে না।
তেমনি সকলের খাদ্যও নির্দিষ্ট। ফলে ধনী-গরিব
বলে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। এসব নিয়ে
এখন আর কেউ বিশেষ ভাবেও না, সবার লক্ষ্য জ্ঞানের চরম সীমা অর্জন করা।
দেখতে-দেখতে হঠাৎ থেমে গেল তিয়ানি। একটা দোকানের ডিসপ্লে’তে নজরে এল, একটা ছোট্ট
বইয়ের মলাট। মেটে হলুদ রঙের মলাটের ওপর লাল অক্ষরে কিছু লেখা। যদিও কী লেখা — সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তিয়ানি সঙ্গে-সঙ্গে দেখতে চাইল বইটা। মুহূর্তের মধ্যেই তার স্ক্রিনে ফুটে উঠল বইয়ের তিন-মাত্রিক হলোগ্রাম,
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে থাকল বইটাকে, বিভিন্ন কোণ থেকে। ভেসে এল ‘আসাভা’ ভাষায় রোবোটিক স্বরে বইটির আনুষঙ্গিক তথ্যাদি, ‘২০২০
খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। একটিই কপি অবশিষ্ট। উদ্ধার করেছেন গবেষক লালিওগাম এবং তাঁর
সহযোগীরা, স্থান -...’ ইত্যাদি।
তিয়ানি জিজ্ঞেস করল, ‘এটি কি
বিক্রয়যোগ্য?’
‘অবশ্যই,’ রোবোট-বিক্রেতা উত্তর
দিল।
অর্থাৎ মোটেই কোনও মূল্যবান বই নয়। নাহলে, একটাই কপি আছে যখন, বিক্রি করা হত না।
‘কত?’ জিজ্ঞেস করল তিয়ানি।
‘বারো এল্যান।’
বাহ, বারো! তেমন বেশি না তো! দ্রুত
পাওনা মিটিয়ে বইটা নিয়ে নিল ও।
‘ধন্যবাদ। চার সেকেন্ডের মধ্যে আপনাকে আসল বইটি পৌঁছে দেওয়া হবে। এই প্রাচীন গ্রন্থটি সংগ্রহের জন্য আপনাকে
অভিনন্দন।’
তিয়ানি একগাল হাসি ফেরত দিয়ে
স্ক্রিন অফ করে দিল। তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আসল বইখানা
চলে এল ওর গ্রাহক-যন্ত্রে। বইটা হাতে
তুলে নিয়ে তিয়ানি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল স্ক্রিনের সামনেই। বইটা এখনই সে খুলল না, বরং ধীর পায়ে তার ঘরের
জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে তখন
গোধূলি। গোলাকার-চৌকো-ত্রিভুজাকারসহ
বিভিন্ন আকারের লাল-হলুদ-সবুজ-নীলসহ বিভিন্ন রঙের কৃত্রিম মেঘগুলো সূর্যের আলো’কে
প্রতিফলিত করে আরও সুন্দর করেছে; যেন রংমশাল জ্বলছে সারা আকাশ জুড়ে। তিয়ানি বইটা বুকে জড়িয়ে ধরে তার ওম নিল প্রাণ
ভরে। যাক, এতদিনে একটা কাগজের বই সে
নিজের করে সংগ্রহ করতে পেরেছে। আর এমন বই যা
সে পড়তে পারবে, সেই ভাষাতেই লেখা যে ভাষার, সাহিত্যের চর্চা সে করে। হ্যাঁ, এটা
একটা বাংলা বই। হয়তো তেমন বিখ্যাত নয়, যেগুলোর কথা
সে পড়েছে, জানে; যেগুলো গবেষণার কাজে লাগে ওর। কিন্তু তাও একটা বাংলা বই, একেবারে তার নিজের! আর এ তো তার নিজেরই ভাষা। একসময় যখন মানুষ ধর্ম-জাতি-দেশের নামে পরিচিত হত,
সেইসময় তার পরিবার ছিল বাঙালি। ওর
বাবা-মায়ের কাছে তাঁদের পরিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে সবই জেনেছে সে। তিয়ানি বুক ভরে
শ্বাস নিল। কী আনন্দ! তার অনেক দিনের স্বপ্নপূরণ হল আজ, বাংলা ভাষায় লেখা, ছাপা
একটা বইয়ের অধিকারিণী হবার স্বপ্ন। গোধূলির আলোয়
ওর চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল।
।। ২।।
নাহ, থামি এবার। অনেকটা লিখলাম। আর পারব না। আজকের মতো এই। তবে কী আশ্চর্যই না লাগছে এই ভেবে যে, এমন
একটা গল্প আমি লিখতে বসব, তাও কল্পবিজ্ঞানের - কোনও ধারণাই ছিল না দু’দিন আগেও।
টুকটাক লেখালিখি করি। ছাপতে দিই-টিই। বেশিরভাগই ছাপা হয় না। তবু ভালোবেসে লিখি, স্বপ্ন দেখি একদিন বড়ো লেখক হব, আমার লেখাও লোকে পড়বে,
যুগে-যুগে পড়বে। কিন্তু কতটা সারবত্তা আছে সেই
স্বপ্নের, জানি না। কিন্তু, এই লেখা আমাকে লিখতেই হবে। তবে যে-ঘটনাগুলো কাল রাত থেকে ঘটল, সেগুলো
না-ঘটলে এই গল্পও আমি লিখতে শুরু করতাম না।
তখন, অন্তত রাত একটা। আমি নিজের মনে বিছানায় বসে, ল্যাপটপে ঘাড়
গুঁজে পুরোনো একটা গল্পকে ঘষে-মেজে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছি, যেন আলোকবৃষ্টি হল।
কিংবা ভুল বললাম হয়তো। একটা নিঃশব্দ ঝড়, নীরব বজ্রপাত। চমকে পিছনে ফিরে দেখলাম একটা ধোঁয়ার আস্তরণ আর
সেটা ফিকে হচ্ছে ধীরে-ধীরে। আমি
মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকলাম, পাশের ঘরেই মা-বাবা ঘুমোচ্ছে — তাদের ডাকার মতো
ক্ষমতা অবধি হল না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, বিস্ফারিত
চোখে বুঝি তাকিয়ে ছিলাম খালি। কোনও সাড় ছিল না কিছুক্ষণ। তারপর একসময় চমক দিয়ে
হুঁশ ফিরল। দেখলাম, সেটা ধোঁয়া নয়, বিশেষ ধরণের রশ্মি আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে
একটা মেয়ে। হ্যাঁ, একটা মেয়েই তো, আমারই মতো বয়স হয়তো। কিন্তু মুখের হাবভাব দেখে মনে হয়, ঠিক যেন মানুষের মতো নয়। তার মাথার আকার বেশ বড়ো, কিন্তু একটুও চুল
নেই। চোখের ওপর ভুরুও নেই। হাতের আঙুলগুলো ছোটো, ভোঁতা। হাত-পা যেন বয়সের তুলনায়
দুর্বল। তার প্লাস্টিকের পোশাক পাতলা, স্পেসশ্যুটের
মতো, একটু ফোলাফোলা। আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না
দিয়েই সে বলল, ‘তোমাকে অনুধাবন করতে কী সমস্যা হল অনুমান করতেও পারবে না।’
অনুধাবন? অনুমান? এমন বাংলা আমি
কখনও কাউকে বলতে শুনিনি। জিজ্ঞেস করলাম,
‘তু-তুমি কে?’
‘আমি তিয়ানি। আমি আসছি তোমাদের হিসেবে ৩০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। তোমার সঙ্গে বিশেষ আলাপচারিতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমার এই আগমন।’
আমার কী যে হল — কে জানে, মাথা
নিশ্চয় কাজ করছিল না একটুও, তাই বোধহয় সব ছেড়ে ফস্ করে বলে ফেললাম, ‘তোমার বাংলাটা
যেন কেমন।’
‘স্বাভাবিক,’ সে বলল, ‘কারণ আমাদের
পৃথিবীতে বাংলা বা তোমার সময়ের অন্য কোনও ভাষাই অবশিষ্ট নেই। আমি নিজে প্রাচীন
ভাষার গবেষক। মানে, এই বাংলা’র। তাই বলতে, লিখতে, বুঝতে পারি। তবে শুদ্ধ বাংলা বলি। তোমরা মিলিয়ে মিশিয়ে বলো যে-ভাষা, যে-ভাষায় লেখ — সে সব পড়তে বা বুঝতে
পারি। কিন্তু, স্বছন্দভাবে বলতে পারি না। কারণ, আমি
এটা ছাড়া আর কোনও ভাষাই জানি না। তবে, তোমার কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে আমি যা বলছি?’
সে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। অবশ্য ভুরুর
জায়গায় লোম নেই।
এই কথা শুনে বাঙালি হিসেবে লজ্জাই
লাগল একটু। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে ওকে বসতে
বললাম। সে বলল, ‘নাহ, বিশেষ সময় নেই আমার। মায়ের সময়যান লুকিয়ে ব্যবহার করে এসেছি।
তোমাকে যে খুঁজতেই হত। আগে বল, আমার নাম জানলে কী করে? কীভাবেই বা লিখলে এসব?’
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। অবাক
চোখে ওর দিকে তাকালাম। মানে, অবাক হবার তখনও যদি বাকি
থাকে কিছু। বলতে গেলে, অবাকের সুপারলেটিভ।
‘তুমি কী বলছ? আমি তোমাকে...
মানে... আমি জানিই না, তুমি কে...।’
‘কিন্তু সে কী করে সম্ভব। তুমি তো আমাকে নিয়েই লিখেছ।’
‘আমি মানে... কী লিখেছি?’ আমি
জিজ্ঞেস করলাম।
আমার দিকে ভালো করে দেখল সে। ভাবল
কিছু। তারপর, যে কাহিনি সে আমাকে শোনাল,
তাই আমি লিখতে আরম্ভ করেছি ওপরে। সেটা তার মুখ থেকেই শোনা। তবে আপাতত
আমার মুখ থেকেই শোনো তার বাকি কিছুটা, আমার ভাষায় —
সে-রাতে তিয়ানি তার
মাধ্যাকর্ষণশূন্য ঘরের রিভলভিং বিছানায় গুছিয়ে বসেছিল বইটা পড়ার জন্য। তার আর তর
সইছে না। হাতটা নিশপিশ করছিল, আগেকার মানুষদের মতো হাতে ধরে বই পড়ার। বইটার মলাটের
রঙ অনেকটা চটে গেছে, রাসায়নিক ব্যবহার করে আসল অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা
হয়েছিল, কিন্তু অক্ষরগুলো পড়া যায়। ভিতরের পাতা
খুলে সে দেখল লেখা ‘৩০২০’। লেখক — রৌদ্র
সেনাপতি, স্থান- মাটিহাটা। তারপর পাতা উলটে
গল্পের প্রথম লাইনটা পড়ল। আর তখনই চমকে উঠল সে। লেখা - ‘তিয়ানি’র চোখ ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল
সব কিছু’। এটা কী করে সম্ভব। তার নাম,
এতদিন আগের বইতে? সে পরের অংশগুলো দ্রুত পড়তে থাকল। আর চমকে-চমকে উঠতে লাগল। অসম্ভব, এটা স্রেফ অসম্ভব। তার সঙ্গে আজ বইমেলা থেকে যা-যা ঘটেছে সব লেখা এই বইয়ে। সে পড়ে যেতে থাকল, শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। শেষে যখন শেষ পাতাটা মুড়ে বইটা বন্ধ করল তখন
পরের দিন সকাল। সে ঘুমোয়নি সারা রাত। কিন্তু, সকালেও সেদিন তার ঘুম এল না। মাথায় ঘুরছিল এই অদ্ভুত লেখা। ৩০২০ খ্রিস্টাব্দে তিয়ানি বলে একটা মেয়ের
অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। ঠিক যেন তাকে নিয়েই লেখা। সে-ই গল্পের মূল চরিত্র।
এইখানে থেমে তিয়ানি বলেছিল, ‘বইটা পড়ে
তো আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রথম ঘটনাগুলো তো হুবহু আমার সঙ্গে ঘটেছে। তাহলে
পরেরগুলোও কি ঘটবে নাকি? এও কি সম্ভব? ঠিক করলাম, এর রহস্য আমাকে জানতেই হবে।’
এরপর তিন দিন ধরে তিয়ানি চেষ্টা
করে পুরোনো ডেটাবেস থেকে এই লেখক এবং এই গল্প সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে। লাভ হয় না
কিছুই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কোথাওই
এই লেখক বা এই কাহিনির উল্লেখ নেই। শেষে হাল
ছেড়ে দেবার মতো অবস্থায় তার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। তখন অনেক রাত হয়েছে। মা-বাবা গভীর ঘুমে। সে চুপি চুপি মায়ের ‘টাইম মেশিন’-এ চড়ে বসল। এই যানকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল ওর জানা। মা ওকে বহুবার এই ফিল্ডে উৎসাহিত করতে হাতে ধরেই এটা চালাতে শিখিয়েছিলেন। সে জানে, কোনও নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট
সময়ে, নির্দিষ্ট লোকের নাম জানা থাকলে তার কাছে পৌঁছোনো অসম্ভব না। সমস্যা হয়, একই জায়গায়, একই নামের, একাধিক লোক
থাকলে। কিন্তু ‘মাটিহাটা’ নামের কোনও
জায়গায় ‘রৌদ্র সেনাপতি’ কতজন থাকতে পারে? একটা ঝুঁকি নিল তিয়ানি। বাংলা ভাষার ইতিহাস চর্চা করতে-করতে ওর বাংলার
ইতিহাস-ভূগোলের জ্ঞানও হয়েছে কিছুটা। মনে হয় না,
মাটিহাটা তেমন বড়োসড়ো জায়গা, যেখানে এরকম নামের লোক আরও কেউ থাকবে। ‘ম্যানহাটান’ হলে অন্য কথা ছিল! সে মেশিন চালু করল। শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল উত্তেজনায়। আগে কয়েকবার একশো-দেড়শো বছরের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে বটে, কিন্তু সেটা তো
মায়ের সঙ্গে। এখন সে একা, আর সময়কালের তফাৎ
হাজার বছর। মেশিনে ঠিকঠাক নামধাম দিতেই
মুহূর্তের মধ্যেই একটা ঝাঁকুনি, তারপর হাজার আলোর ফুলকি। চোখে ধাঁধা। পরের কয়েক মুহূর্ত ভারহীন মনে হল। তারপর ধীরে-ধীরে আলোর সেই ফুলকি কমতে লাগল, আর
ফিরে আসতে থাকল শরীরের ভার। সবটা পরিষ্কার
হতে সে দেখল, একটা গুহার মতো জায়গায় এসেছে ও, সামনে একটা মানুষ — ইতিহাসে পড়া সেই
প্রাচীন মানুষের মতোই, বসে বসে একটা আদ্যিকালের যন্ত্রের সামনে কী সব করছে। তবে,
মানুষটার বয়স বেশি হবে বলে মনে হল না। এই সেই লেখক
নাকি?
এটা শুনে আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস
করেছিলাম, ‘আমার ঘরটা কিনা তোমার গুহা মনে হল?’
‘আমাদের কাছে তাই-ই।’
‘কিন্তু বইটা? সেটা আনলে না?’
‘নাহ, প্রাচীন জিনিস, একবার
ভবিষ্যতে গেলে আবার প্রাচীন কালে ফিরিয়ে আনা যায় না। ছাড়ো ওসব। এবার মূল গল্পের অভিযানগুলো শোনো, যেগুলো আমি
করেছি বলে, লিখেছ তুমি।’ এই বলে সে গল্পটা বলে চলল।
কাল, কাল রাত ছিল সেটা। কালই তার কাছে এই গল্প শুনে এই লেখা লিখতে
বসেছি আমি। আমারই লেখা গল্প, ভবিষ্যতে পড়ে,
সেই গল্প আমাকেই শোনাল সে। আর সেই গল্পই
আমি লিখতে বসলাম আজ। কী আশ্চর্য! আবার এই গল্পই নিশ্চয় সে পড়বে আজ থেকে হাজার বছর
পরে, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। ভাবলে, যেন গুলিয়ে যায় সব! এও কী সম্ভব! জীবন কি এইরকম
চক্রের মতো? পূর্বনির্দিষ্ট সব কিছু? এ যেন রাম না জন্মাতেই রামায়ণ! রামের জীবনের
ঘটনাও বাল্মীকি যা লিখেছিলেন সত্যি হয়েছিল, এটাও সেরকম। তবে, ঐ গল্পে তিয়ানি’র
আমার কাছে আসার ঘটনাটা নেই। ভাবছি, একটু
পালটে সেটাও ঢুকিয়ে দেব কিনা। তাতে গল্পটাও
একটু অন্যরকম হয়ে যাবে। হয়তো গল্পটাই বদলে যাবে, তিয়ানির
জীবনের অ্যাডভেঞ্চারগুলোও।
তবে, হ্যাঁ। যাবার আগে একটা কথা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি, ‘তিয়ানি, বলতে পারবে আমি ভবিষ্যতে
বড়ো লেখক হতে পেরেছি কিনা?’
ভবিষ্যতের মানুষ মনে হয়, মিথ্যে
সান্ত্বনা দিতে জানে না। সে বলেছিল, ‘যদি হতে, তাহলে তোমাকে
সহজেই খুঁজে পেতাম, তাই না? তোমার নামও পাওয়া যেত সহজেই।’
‘ঠিক,’ দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল আমার। তাহলে কি... এই সাধনা মিথ্যে? এত স্বপ্ন
দেখা, এত ভালোবাসা সাহিত্যকে, এত পরিশ্রম! সবই মিথ্যে? চোখে জল এসে গিয়েছিল আমার।
ভবিষ্যতের মানুষেরা কাঁদে কি? জানি না। কান্না লুকোতে পারে? তাও, জানি না। জিজ্ঞেস
করলে হত তিয়ানিকে। আমি কান্না লুকিয়ে ছিলাম।
তারপর, সে চলে যায়। যাবার আগে বলে,
আমার জন্যই নাকি তার ছাপা বই বাংলা ভাষায় পড়ার স্বপ্নপূরণ হয়েছে। ‘ধন্যবাদ রৌদ্র, ভাল থেকো।’ এই ছিল তার শেষ
কথা।
আমি আর কিছু বলিনি। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কষ্ট পেয়েছি
আমার লেখক-জীবনের কথা ভেবে। তারপর, মনে হয়েছে না হয় না-ই বা চিনল কেউ, জানল কেউ
আমাকে আমার সময়ে। হাজার বছর পরে আমার বইয়ের একটি কপি ভবিষ্যতের মানুষের হাতে পৌঁছে
যাবে, এই বা কম কী? কম কী আমারই জন্য একজনের বাংলা ভাষায় লেখা বই পড়ার স্বপ্ন সফল
হবে? এর থেকে বেশি এই সামান্য লেখক আমি, কী বা চাইতে পারি? তাই, আমি তিয়ানি’কে
মনে-মনে ধন্যবাদ দিয়েছি, যতটা সে আমাকে দিয়েছে —তার আরও অনেক বেশি। সময়কে অতিক্রম করার সৌভাগ্য সকল লেখকের হয় না,
আমার মতো এক সামান্য লেখকের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছে, এও কি আমার, এই লেখকের
স্বপ্নপূরণ নয়? আমার সব সাধনা, সব পরিশ্রম — এর জন্য অনেক অনেক বেশি!
ছবিঃ সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment