
স্বর্ণজালে জলন্ধর
সহেলী রায়
।। ১ ।।
।।
২ ।।
।। ৩ ।।
_____
ছবিঃ রাজা আক্তার
সহেলী রায়
হেলিকপ্টারটি মঙ্গলপুর স্পোর্টিং
ক্লাবের সবুজ গালিচার মতো ফুটবল মাঠ ছেড়ে কয়েক ফুট উঠে শূন্যে দুলতে লাগল। মাথার প্রকান্ড পাখাটি খুব আস্তে ঘুরলেও
মাঠে এই উড়োযানের ছায়া পড়া অংশটায় যেন সর্ষে খেতের দোল লেগেছে। চিকু জানে ওই বন বন করে ঘোরা পাগলা
পাখাটিকে ‘রোটর’ বলে। কী সাঙ্ঘাতিক শব্দ। কানে তালা লেগে যাবে যেন এক্ষুনি। চিকুর চুলগুলোও কার্টুন ছবির কোনও
চরিত্রের মতো ওপর দিকে চুড়ো হয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। প্রচন্ড হাওয়ার দাপটে দু’দিকের চোখের পাতা টেনে খুলে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিকু। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আকাশ তো পরিস্কার। তবে এ কীসের ঝলকানি। চিকু অবাক হয়ে মুখ তুলে রইল ওপর দিকে। ভয়ঙ্কর শব্দে একটা বাজ পড়ল। চারিদিক যেন মৃদু কেঁপে উঠল। চিকুর মাথা ঘুরছে। টাল সামলাতে না পেরে মাঠে উপুড় হয়ে
বসল চিকু। হেলিকপ্টারের
শব্দও বাড়ছে আস্তে আস্তে। চিকু
আবার মুখ তুলল। এ
কী! যেখানে হেলিকপ্টারের ছায়া ছিল সেখানে কীসের ছায়া? একটা
প্রকান্ড পা। মাঠের
ওই অংশটুকু আস্তে আস্তে বসে যাচ্ছে।
ঠিক যেমন অর্জুনকে কর্ণের নাগাস্ত্রমের হাত থেকে বাঁচাতে শ্রীকৃষ্ণ রণভূমিকে
নিজের পায়ের চাপে ভূগর্ভে প্রবেশ করিয়েছিল ঠিক তেমনই স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবল মাঠের
খানিকটা অংশ ভূগর্ভে প্রবেশ করছে।
চিকু আর্তনাদ করে উঠল।
মুহূর্তের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়তে শুরু করল চোখ বন্ধ করেই। চোখ খোলার ক্ষমতা নেই তার। সামনে থেকে কেউ এসে তাকে জড়িয়ে ধরল।
“অ্যাই চিকু! হলটা কী?”
চিকু তখনও হাঁপাচ্ছে। সজোরে জড়িয়ে ধরেছে সামনের মানুষটিকে।
“আরে ছাড় ছাড়, লাগছে তো আমার।”
একপ্রকার জোর করেই ছাড়িয়ে নিল
নিজেকে মিঠুমামা। চেঁচামেচিতে
খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাল চিকু।
পাখাটা বেশ জোরেই ঘুরছে।
তবে হেলিকপ্টারে নয়, কড়িবর্গায়। চিকু অবাক হয়ে আশেপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাতে
লাগল।
“নাগাস্ত্রম?”
প্রশ্নটা করে চিকু নিজেই চমকে
উঠল।
“অহ! এই ব্যাপার? আজ রাত থেকে
ঘুমোবার আগে আর কোনও মহাভারত, রামায়ণ, পৌরাণিক নয়।
আমি একের পর এক আউড়ে যাব আর তুমি আধা শুনেই সেই দিব্য যুগে বিচরণ করবে তারপর
ভোর রাতে ঘুমের মধ্যে যত্ত হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি, আর
সামলাতে পারব না বাপু, নিজের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে।”
তাই তো। চিকুর বেশ লজ্জাই করছিল। তবে এত কাছ থেকে এত বড়ো হেলিকপ্টার
চিকু কখনও দেখেনি। আর
কেমন হাওয়ায় ঝুলে ছিল। মিঠুমামার
অফিস ক্লাবে সেই ম্যাজিক শোয়ের মতো।
ম্যাজিশিয়ন যেমন সেই বিদেশিনীকে চেয়ার থেকে তুলে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিল। মেয়েটিও কাঠের পুতুলের মতো দুলছিল
ডাইনে বাঁয়ে। এসব
হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে চিকু শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে বিশ্রাম করে
বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিল চিকু। নর্থ পয়েন্ট স্কুলে ক্লাস ফাইভের ছাত্র
সে। বাবার অফিস থেকে ফিরতে প্রায়দিনই দেরি হয়। তবে মিঠুমামা
ফিরে আসে সন্ধে ছ’টার মধ্যেই। মা সন্ধের জলখাবার বানাতে ব্যস্ত। মিঠুমামা
চিকুর মায়ের মামাতো ভাই। বাড়ি মুর্শিদাবাদে। আসানসোলে চাকরিসূত্রে থাকা। বাড়ি ভাড়া নিয়ে অন্য জায়গায় থাকতে
চেয়েছিল মিঠুমামা। কিন্তু চিকুর মায়ের জোরাজুরিতে চিকুদের বাড়িতেই পাকাপাকিভাবে থাকতে
হয়েছে চিকুর বেস্টফ্রেন্ড, মিঠুমামাকে। এ পাড়াতে চিকুর বয়সি তেমন
কেউ নেই। স্কুলেই যতটুকু খেলাধূলা হয়। সন্ধে থেকে মিঠুমামার সঙ্গে চলে পড়াশুনো,
ব্রেইন গেম, ক্যারম আর গল্প শোনা। তবে মিঠুমামা প্রায়ই মাকে বলে চিকুর কিন্তু বিকেলবেলা
বাইরে খেলাধূলার প্রয়োজন।
“চল চিকু, রেডি তো?”
দোলনদাদা সাইকেল নিয়ে হাজির গেটের কাছে। চিকু রেডিই
ছিল। ‘মা আসছি’ বলে গেট খুলতেই মা আর মাধবীপিসি দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন
ঘর থেকে।
“দোলন, ভাইকে চোখে চোখে রাখবি, নিজে খেলতে গিয়ে
আবার ভুলে যাস না যেন ভাই আছে সঙ্গে।”
মাধবীপিসি বেশ কড়া করে কথাগুলো বলল দোলনদাদাকে।
মাধবীপিসি চিকুদের বাড়িতে মায়ের কাজে সাহায্য করে। চিকু জন্মে থেকেই মাধবীপিসি,
দোলনদাদাকে দেখছে। দোলনদাদা মাধবীপিসির ছেলে। কাছেই একটা কলোনিতে থাকে
ওরা। আগে মাধবীপিসি যখন কাজে আসত দোলনদাদাও আসত সঙ্গে। এখন একটু বড়ো হয়ে গেছে বলে
আসে না। তাছাড়া চিকুও তো স্কুলে থাকে সারাদিন। মিঠুমামার ফ্যান দোলনদাদাও। মাঝে
মাঝে সন্ধেবেলায় দোলনদাদাও আসে গল্প শুনতে। মিঠুমামাই দোলনদাদাকে দায়িত্ব দিয়েছে চিকুকে রোজ মাঠে খেলতে নিয়ে যেতে।
“চিকু একদম দুষ্টুমি করবি না, দোলনদাদার সঙ্গে
সঙ্গে থাকবি। দোলন বেশি দেরি করিস না, একটু খেলেই চলে আসিস বাবা।”
মা চোখ পাকিয়ে চিকুকে আর দোলনদাদাকে
কথাগুলো বলে গেট বন্ধ করতে লাগলেন।
“তাড়াতাড়ি চলে আসব মামি, চিন্তা কোরো না।”
দোলনদাদা মিষ্টি করে হেসে কথাগুলো বলে চিকুকে
সাইকেলের সামনের রডে বসিয়ে প্যাডেলে চাপ দিল।
মঙ্গলপুরের এই ফুটবল মাঠে চিকু
আগেও এসেছে। মিঠুমামা শনি রবিবার ছুটি থাকে বলে মুর্শিদাবাদ চলে যায়। কোনও কোনও
সপ্তাহে আসানসোলে থেকে গেলে চিকুকে নিয়ে আসে মাঠে। বিকেলবেলা বেশ ভিড় হয় মাঠটাতে। আয়তনে
বেশ বড়ো বলে ছেলেপুলেরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কেউ ক্রিকেট, কেউ ফুটবল, কেউ লুকোচুরি
খেলে মাঠে। রাস্তা
থেকে মাঠে ঢোকবার মুখেই মঙ্গলপুর স্পোর্টিং ক্লাব। সেখানেও বড়ো দাদারা, কাকুরা
জটলা করে গল্প করেন, শীতকালে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে, ক্যারম খেলাও চলে।
মাঠের একদম শেষ প্রান্তে একটা ভাঙাচোরা বাড়ি আছে। ওদিকে কারও যাওয়া বারণ। শোনা যায় এই মাঠের জমিটাও ঐ বাড়ির
মালিকের ছিল। নিজের গ্রামের নামেই এই মাঠ ও ক্লাব। বাড়িটার চারপাশে বাঁশ দিয়ে ঘেরা
আছে। বাচ্চারা মাঠে খেললেও ক্লাবঘর থেকে খেয়াল রাখা হয় কেউ যেন ওই ভাঙা বাড়ির
দিকটায় না যায়। দিনের আলো কমে এলেই সব্বাইকে মাঠ থেকে প্রায় ছাগল তাড়ানোর মতো
তাড়িয়ে দেন কাকুরা। সন্ধের অন্ধকার খানিকটা ঘন হলে ক্লাবও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেউই
থাকে না মঙ্গলপুর মাঠে। মিঠুমামা চিকুকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বাড়িটার সামনে
এসে দাঁড়িয়েছিল। বাড়িটার ইটগুলো দৈত্যর দাঁতের মতো বেরিয়ে আছে। দেওয়ালের গায়ে শাকচুন্নির চুলের
মতো বটগাছের ঝুরি নেমে এসেছে। মিঠুমামা হাঁ করে তাকিয়েছিল বাড়িটার দিকে। একটা ছেলে
দৌড়ে এসে, মিঠুমামাকে ওখান থেকে চলে যেতে বলেছিল। মিঠুমামা কারণ জানতে চাইলে
বলেছিল, “ঠিক জানি না, তবে ক্লাব থেকে বলে পাঠাল এদিকে আসা বারণ।”
রোজের মতোই ছেলেরা এদিক
ওদিক ভাগ হয়ে খেলছে। দোলনদাদার বন্ধুরা চিকুকে নিয়ে ফুটবল খেলছে। তবে ওরা বয়সে অনেকটাই
বড়ো বলে চিকু ওদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। তাও খানিকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে মনটা চনমন করে
উঠল চিকু্র। খুব হাঁপিয়ে, মাঠে শুয়ে খানিকটা গড়াগড়ি দিয়ে নিল সে। তখনই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। যেখানে
গড়াগড়ি দিচ্ছিল মাঠের সেটুকু জায়গার ঘাসগুলোর রঙ অন্য ঘাসের থেকে আলাদা। কেমন হলুদ
হয়ে এসেছে। যেন ভারি কিছু চাপা পড়েছিল ঘাসগুলো। চিকু অবাক হয়ে দেখতে লাগল। একটু
দূরে গিয়ে জায়গাটা দেখতে গিয়ে দেখল বিকট একটা পায়ের পাতার আকৃতির জায়গাটা।
“কী দেখছিস চিকু? আর খেলবি
না? বাড়ি যাবি?” দোলন এসে জিজ্ঞেস করল চিকুকে।
চিকু চমকে উঠল একটু।
“আচ্ছা দোলনদাদা ওই ভাঙা বাড়িটায়
যাওয়া বারণ কেন?” চিকুর জিজ্ঞাসু চোখ ভাঙা বাড়িটার দিকে।
“পুলিশ কেস চলছে, মামা
জানেন তো, মামাই তো থানা থেকে জায়গাটা বাঁশ দিয়ে ঘিরিয়ে দিয়ে গেছেন।”
চিকুর বাবা আসানসোল থানার
ওসি। দোলন দাদার উত্তরে চিকুর কৌতূহল শেষ হল না। দোলনও ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
“তখন আমি বেশ ছোটো। আমাদের কলোনির কাছের পাড়াতেই একজন
ভাড়ায় এসেছিলেন। বিভাস
স্যর। স্যর এসে মামাকে, পাড়ার বাকি বড়োদেরও জানিয়েছিলেন উনি আমাদের কলোনির
বাচ্চাদের পড়াতে চান কোনও টাকাপয়সা ছাড়াই। ওই বাড়িটা যদি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। বাড়িটা
এমনিই খালি পড়ে আছে অনেক দিন। মায়ের কাছে শুনেছিলাম ওখানে এক বুড়ি ঠাকুমা থাকত
বহুদিন ধরে। তার নাকি কেউ ছিল না। মাঝেমধ্যে গ্রাম থেকে কেউ আসত দেখা করতে। ঠাকুমা
একদিন মারা গেল। অপঘাতে। কেউ ভারি কিছু দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়েছিল। তারপর কয়েক বছর
পর বিভাস স্যর ওখানে প্রতিদিন সন্ধেবেলা আমাদের স্কুল বসাতেন।”
দোলনের কথা শুনে চিকু
অবাক। সন্ধেবেলা আবার স্কুল হয় নাকি?
“স্যর সারাদিন থাকতেন না।
অনেক দূরে নাকি চাকরি করতেন। তাই সন্ধেবেলাতেই পড়াশোনা হত। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে
দারুণ সব গল্প বলতেন। সেই থেকেই তো আমার গল্প শোনার নেশা হয়েছিল। এখন সেইজন্য
মিঠুমামার কাছে গল্প শুনতে যাই।”
চিকুর মুখ থেকে তাও
প্রশ্নের ধোঁয়াটা সরছে না।
“তারপর কী হল দোলনদাদা?”
দোলনের মুখটা কেমন উদাস
হয়ে গেল।
“আমাদের কলোনিরই দুটো ছেলে
ক্লাস চলার সময় বাথরুম করতে গিয়ে আর ফিরল না। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না। দু’দিন পর
বডি পাওয়া গেল। কেউ মাথায় ভারি কিছু দিয়ে থেঁতলে মেরে রেখে গেছিল।”
চিকুর মুখটা শুকিয়ে গেল।
বুকটাও কেমন ঢিপ ঢিপ করছে। বার বার চোখ চলে যাচ্ছে মাঠের হলুদ হয়ে যাওয়া পায়ের
ছাপটার ওপর। ব্যাপারটা দোলনদাদাকে জানাতে গিয়েও কিছু বলতে পারল না চিকু। কেউ যেন
বলতে দিচ্ছে না।
“বাড়ি চল দোলনদাদা।”
চিকুর অবস্থা দেখে দোলন
খুব হাসল।
“ভয় পেলি? অনেক বছর হয়ে
গেছে আর কিছু হয়নি। বিভাস স্যরও এই ঘটনার দিন দু’য়েকের মধ্যে গায়েব হয়ে গেলেন। সবার
ধারণা স্যরকেও মেরে কোথাও লুকিয়ে রাখা আছে। মামারা অনেক খুঁজেও কোথাও পেলেন না।
বাড়িটা সিল হয়ে গেল। ওদিকে কারও যাওয়া বারণ।”
আজ পুরো বিপরীত
কান্ডকারখানা চলছে। পড়াশোনা চলাকালীনই চিকু মিঠুমামাকে বলার চেষ্টা করেছিল কথাগুলো। কিন্তু পড়ার সময় অন্য কথা বলা
যাবে না বলে থামিয়ে দিয়েছে বার বার মিঠুমামা। রাতের খাওয়া সেরে তাই আজ মিঠুমামার
বদলে চিকু বলছে ভাঙাবাড়ির রহস্য। আর
মিঠুমামা মন দিয়ে শুনছে। বাবা ঘুমোতে যাওয়ার আগে রোজ একবার করে চিকুদের ঘরে আসেন।
আজও এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কীসের গল্প? শ্রীকৃষ্ণ নাকি দ্রোণ? যুদ্ধ শেষ হল?”
চিকু কিছু বলার আগেই
মিঠুমামা বাবাকে ভাঙাবাড়ির কথাটা জিজ্ঞেস করল। চিকুর বাবাকে খুব চিন্তিত দেখাল।
“মিঠু, এখনও খুঁজে চলেছি
সমাধান। কিছুতেই কূলকিনারা পাচ্ছি না। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কত কেস এল গেল।
কিন্তু বাচ্চাগুলোকে, সেই বুড়িকে আজও জাস্টিস দিতে পারলাম না।”
বাবার কথা শুনে মিঠুমামাও
দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিকুর মুখেও ভয়ের ছাপ।
“ধুর ভীতু। কত বছর হয়ে
গেছে। আর কিছু নেই ওখানে। তুই তো সাহসী। মুখটা অমন করে আছিস কেন?”
মিঠুমামা আজ মিস্টার বীনের
সিরিজ দেখাচ্ছে ল্যাপটপে। দু’জনে মিলেই হেসে কুটোপাটি। চিকু ভাঙাবাড়ির কথা ভুলেই
গেল। দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে।
চাঁদের আলোয় বাড়িটা ভেসে যাচ্ছে। যেন রূপোয় মোড়া রাজপ্রাসাদ। চারপাশের গাছগাছালি কেমন যেন হাত মেলে
ডাকছে চিকুকে। চিকু
পায়ে পায়ে গেটের কাছে এসে হাজির হল।
ঠান্ডা বাতাস আর কুয়াশামাখা ধোঁয়া চিকুকে আলিঙ্গন করছে, আপ্যায়ন করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে ভিতরবাড়িতে। বাড়ির মাথায় মেঘের পাহাড়। যেন বরফের পর্বতমালা। চিকু আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে। অদ্ভুত একটা সুগন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধটুকু বুকে ধরে রাখার জন্য চিকু
জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
“আঃ!”
সজোরে কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে
চিকু আর্তনাদ করে উঠল। কোনোক্রমে
চোখ তুলে দেখল এক বিশালাকায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বিরাট একটা লাঠি। পাহারাদার? চিকু বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মানুষটির চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। এত কালো অন্ধকারেও আগুনের মতো জ্বলছে। চিকু কিছু বোঝার আগেই একদলা আগুন সেই
চোখ থেকে চিকুর দিকে ছুটে আসতে লাগল।
চিকু নিচু হয়ে শুয়ে পড়ল।
মাথার ওপর দিয়ে গরম আভার স্পর্শ পেল।
মুখ তুলে দেখল আগুনের গোলাটা চিকুকে না পেয়ে সামনের বাগানে গিয়ে পড়ল। দাউদাউ করে জ্বলে যাচ্ছে সবটুকু।
“আগুন! আগুন! ওঁম নমঃ শিবায়! ওঁম নমঃ শিবায়!”
চিকু বিড়বিড় করছে।
“অ্যাই অ্যাই আবার? ওঠ, কী বলছিস?”
মিঠুমামার ঝাঁকুনিতে চিকু উঠে
বসল। ফ্যালফ্যাল
করে এদিক ওদিক তাকিয়ে জড়িয়ে ধরল মিঠুমামাকে।
“কী হল আজ আবার কোন অস্ত্র
দেখলি?”
মিঠুমামা মাথায় হাত বোলাতে
বোলাতে জিজ্ঞেস করল।
“জলন্ধর।”
চিকুর কন্ঠস্বর কাঁপছে।
“জলন্ধর? মানে? জলন্ধর দৈত্য?”
মিঠুমামার প্রশ্নে চিকু আরও
শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিঠুমামাকে।
“স্বয়ং মহাদেব দাঁড়িয়েছিলেন
পাহারায়। ভগবান
ইন্দ্রের মতো আমিও তাঁকে চিনতে পারিনি।
আর তাতেই উনি রেগে গিয়ে আগুনের গোলা ছুঁড়ে মারলেন।”
চিকু এক নাগাড়ে বলে চলেছে।
“তারপর?”
“আমি মহাদেবের মন্ত্র উচ্চারণ
করলাম দেবরাজ ইন্দ্রের মতো, রাগ বোধহয়
কমল। আগুনের
গোলা আমায় না ছুঁয়ে সামনের বাগানটা জ্বালিয়ে দিল। আচ্ছা মিঠুমামা ওই অগ্নিই তো সমুদ্রে
গিয়ে পড়েছিল একটা চেহারার আকৃতি নিয়ে।
সেই আগুন থেকেই তো জন্ম নিয়েছিল জলন্ধর দৈত্য?”
মিঠুমামার ভালো লাগে, চিকু পুরো কাহিনিই মনে রেখেছে। তবে এমন ভয়ের উদ্রেক ঠিক নয়। চিকুকে এই ভয় থেকে বের করতেই হবে।
“হ্যাঁ। তা হয়েছিল। কিন্তু এত ভয় পেলে চলে?...”
“মিঠু, মিঠু, দরজাটা একটু
খুলবি?”
মিঠুমামার কথা শেষ হওয়ার আগেই
দরজায় সশব্দে আঘাত। চিকুর
মা ডাকছেন। খুব
অস্থির গলা। এই
ভোররাতে কী দরকার পড়ল? কোনও বিপদ? মিঠুমামা উঠে দরজা খুলে দিল।
“কী হয়েছে দিদি?”
“মঙ্গলপুর ক্লাবে আগুন লেগেছে। চিকুর বাবা আগেই বেরিয়ে গেছেন। এখন সবাই আগুন আগুন করে দৌড়চ্ছে ওদিকেই। একবার দেখবি? আমার খুব ভয় লাগছে।”
চিকুর মা কথাগুলো বলতে গিয়ে
খুব হাঁপাচ্ছেন। ভয়
পেয়েছেন বেশ।
“এক্ষুনি যাচ্ছি। তুমি চিকুর কাছে থাকো দিদি।”
কথাগুলো বলেই চিকুর দিকে অবাক
চোখে তাকাল মিঠুমামা। আগুনের
কথাই বলছিল চিকু। চিকুও
মিঠুমামার দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে।
ক্লাবের বাগানটা জুড়ে আগুনের
রেলিং। ছেলেরা
বালতি করে জল ঢেলে নেভানোর চেষ্টা করছে।
চিকুর বাবা কল্যাণবাবু ছাড়াও আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার সেখানে রয়েছেন। বাগান ছাড়া আর কোথাও আগুন ছড়ায়নি বলে
দমকল ডাকা হয়নি।
“ক’দিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল লোকটা আবার ফিরে এসেছে এখানে। প্রায় রাতেই আমি আসি এদিকে টহল মারতে। দু’দিন
আগে দেখলাম, যা ভাবছি সেটাই সত্যি। ক্লাবের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম
একটা বড়ো পায়ের আকৃতির ট্রাঙ্ক ওই ভাঙা বাড়িটা থেকে বের করে মাঠের মাঝখানটায় রাখল কেউ। লোকটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেতেই আমি
দৌড়ে গিয়ে ট্রাঙ্কটা টেনে এনে এই বাগানের ঝোপে লুকিয়ে রাখি।”
চিকুর বাবাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে
আছে সকলে। মিঠুমামাও
খুব আতঙ্কিত।
“আজ কী হল কল্যাণদা?”
মিঠুমামা কৌতূহল চেপে রাখতে
পারছে না।
“আজ আমি সটান বাড়ির সামনেই
চলে যাই। মনে
হল ভেতরে কোনও বাচ্চা কাঁদছে।
সাবধানে ঢুকি। এগোতে
গিয়ে ধাক্কা খাই। তারপর
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ আমার গালে খামচে ধরে। এতটাই জোরে যে আমার হাত পা অসাড় হয়ে
আসে। জোরে
ঠেলা মারি তাকে। সে
দৌড়তে থাকে, ধাওয়া করতে করতে ক্লাবের সামনে আসি, আমার হাতের লাঠি ছুঁড়তেই সেও পালটা একটা রুমাল জ্বালিয়ে আমার
দিকে ছুঁড়ে মারে। রুমালটাতে
সম্ভবত কেরোসিন মাখা ছিল। আমার
গায়ে না লেগে বাগানে এসে পড়ে, ধরতে পারলাম
না।”
চিকুর বাবা মুষড়ে পড়লেন।
“জলন্ধর! মহাদেব যে অগ্নি দেবরাজ ইন্দ্রের দিকে নিক্ষেপ করেছিলেন, ইন্দ্রের স্তুতিতে শান্ত হয়ে সে অগ্নি মহাদেব সমুদ্রে পাঠিয়ে
দেন। তা
থেকে জন্ম হয় এক বালকের। তার
কান্নাকাটি দেখে ব্রহ্মা তাকে কোলে নেন।
ব্রহ্মার দাড়ি এমন টেনে ধরে সে, ব্রহ্মা সহ্য
করতে না পেরে চোখ থেকে জলধারা ফেলতে থাকেন, তাই
মহাদেবের রোষ থেকে জন্ম হওয়া এই বালকটির নাম হয় জলন্ধর। ব্রহ্মা তাকে অসুর রাজ্যে পাঠিয়ে দেন। ব্রহ্মার দেওয়া বরের বলেই সে ভয়ঙ্কর
দৈত্য হয়ে ওঠে। ধ্বংস
করে দেয় দেবতারাজ্য।”
মিঠুমামা গড়গড় করে আওড়াতে থাকে।
“এসব কী বলছ মিঠু?”
চিকুর বাবার প্রশ্নে মিঠুমামা
নিজেই চমকে ওঠে। সত্যিই
কেন সে বলছে এসব কথা? চিকুর স্বপ্নের গল্পটা শেষ
হওয়া দরকার। চিকুর
জানা দরকার যুগে যুগে অসুরদের বিনাশ হয়।
“স্যর!”
একজন পুলিশ অফিসারের চিৎকারে
সবাই ছিটকে গেল। বাগানের
আড়াল থেকে হঠাৎ কেউ একজন বেরিয়ে পালাতে যাচ্ছিল। ভেবেছিল সবাই কথাবার্তায় অন্যমনস্ক
হয়ে আছে। চিকুর
বাবা এক লাফে তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।
“বিভাস স্যর?”
লোকটাকে কোনোরকমে টেনে ক্লাবঘরে
ঢোকানো হয়। এক
মুখ দাড়ি, ঘোলাটে চোখ। এমন জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে যেন কোনও
দানবীয় শক্তি তার কব্জায়।
“অমৃতবালা। মঙ্গলপুর গ্রামের জমিদার বংশের বউ। সে সব জমিদারি পাঠ কবেই চুকে গেছে। লোকমুখে জানতে পারি বুড়ি অনেক ধনসম্পত্তি
সঙ্গে করে আসানসোলে বসবাস করে।
খুঁজতে খুঁজতে চলে আসি, মঙ্গলপুর গ্রামের নাম দেখে সহজেই পেয়ে যাই বুড়ির সন্ধান। বুড়িকে আমি মেরে ফেললেও কোনও সম্পত্তি
খুঁজে পাই না। তাই
কয়েক বছর পর ফিরে এলাম। এখানে
আসর জমাতে প্রথমে পড়ানো শুরু করি গরিব বাচ্চাদের। তারপর বাচ্চা দুটোকেও একইভাবে মেরে
ফেলে ভয় দেখাই যাতে লোকজন এ বাড়িতে না আসে।
নিজেও গায়েব হই কয়েক বছর।
আবার এসেছি আর খুঁজেও পেলাম সেই জমিদারবাড়ির মহাদেবের তোরঙ্গ। কিন্তু…”
বিভাস স্যরের বাকি গল্প সকলেরই
জানা। ভোরের
আলো ফুটে উঠেছে। বিভাস
স্যরকে ভ্যানে তোলা হয়েছে।
পায়ের আকৃতির ট্রাঙ্কটা দেখতে সত্যিই লোভনীয়। সকলেরই কৌতূহল কী আছে ওর মধ্যে? পুলিশের সহায়তায় খোলা হল ট্রাঙ্ক। সবার চোখ বিস্ফারিত। একটা বিশাল মাছ ধরার জাল। পুরোটাই সোনার জরি দিয়ে বোনা। একটি জরি থেকে আরেকটি ছোট্ট হীরে দিয়ে
আটকানো। সবাই
যখন জাল নিয়ে ব্যস্ত, মিঠুমামা ট্রাঙ্কের নিচে একটা
ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পেল।
‘মহাদেব প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য। ব্রহ্মার বরে তাকে মহাদেব ছাড়া আর
কেউ বধ করতে পারবেন না। মহাদেব
জলন্ধরকে তাড়া করতে করতে নিয়ে ফেলল পাহাড়ের ওপর। প্রকান্ড পায়ের চাপে জলন্ধরকে মাটির
নিচে পতিত করলেন মহাদেব। দৈত্যের
কানটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।
ওঁম নমঃ শিবায়!
বহুযুগ ধরে শিবের আরাধনা করে
আসা আমাদের জমিদার বংশের গৌরব লেগে আছে মুঘল নবাবের কাছ থেকে পাওয়া এই উপহারে। বংশপরম্পরায় অসুরের দল এই স্বর্ণজালের
লোভে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে।
মহাদেবের পায়ের আকৃতির তোরঙ্গে লুকিয়ে বংশের ঐতিহ্য রক্ষা করার তাগিদে শহরে
এসেছি সামান্য সম্বল নিয়ে।
আমার সঙ্গেই যেন এই স্বর্ণজালও মুক্তি পায় বিনাশের অন্ধকার থেকে।’
গোটা গোটা সুন্দর হাতের লেখায়
লেখা জলন্ধর বধের শেষটুকু।
স্বর্ণজাল যাবে মিউজিয়ামে।
বাড়িটা হেরিটেজ বিল্ডিং করার চেষ্টা করা হবে। চিকু আর মিঠুমামা ছাদে সকালের রোদ
পোয়াচ্ছে। দু’জনেরই
চোখ চলে গেল ভাঙা বাড়িটার দিকে।
চিকুদের ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা বাড়ির
ছাদটুকু।
“মিঠুমামা-আ-আ দেখ! বাড়িটার ছাদটা কেমন কানের মতো দেখতে।”
চিকু আনন্দে লাফাচ্ছে। মিঠুমামাও অবাক। তাই তো, এতদিন কেউ খেয়ালই করেনি। পুরো বাড়িটাই কেমন কানের আকৃতির।
“জলন্ধর দৈত্য জাল ছিঁড়ে পালাতে
পারেনি। মহাদেব
তাকে পায়ের চাপে পাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ওই দেখো কান, জলন্ধরের কান।”
চিকু খিলখিল করে হাসছে। এ ধরাধামে যা কিছু অন্যায় যা কিছু
অন্যায্য সব কিছুর বিনাশ হয়।
অহেতুক ভয় ঘিরে ধরে আমাদের।
আত্মবিশ্বাসের ছন্দ শুধু চিকু
নয় মিঠুমামার হাতের মুঠোতেও ধরা দিচ্ছে রাতজাগা সকাল হয়ে।
ছবিঃ রাজা আক্তার
বেশ ভালো লাগলো।
ReplyDelete