
অভিনেতা নিখোঁজ
অনন্যা দাশ
এক
দুই
তিন
চার
পাঁচ
_____
ছবিঃ সুমিত রায়
অনন্যা দাশ
“ওদিকে তাকিও
না সোজাসুজি, কিন্তু একটা মেয়ে এই ঢুকেছে আর হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে!
অদ্ভুত লোকজন সব! ওইভাবে তাকিয়ে থাকাটা যে বাজে অভ্যাস আর রুড সেটা জানে না!” কিম
রেগেমেগেই বলল। সে আমেরিকান, এইসব ব্যাপারে তার খুব জোরালো মতামত।
রিয়ার খুব কৌতূহল হচ্ছিল, কিন্তু তাও কিমের কথা শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিল।
ওরা দু’জনে স্টার বাকসে কফি খেতে এসেছে। আজ ওদের দু’জনের প্রেজেন্টেশন ছিল ওদের ল্যাবের মিটিংয়ে। দু’জনেরটাই ভালো হয়েছে বলে ওরা স্টার বাকসে এসে কফি আর কুকি দিয়ে
সেলিব্রেট করছিল।
“থাক আর ঘাড় ঘুরিয়ে
তাকে দেখতে হবে না। সে এদিকেই আসছে!” কিম ঘোষণা করল।
কয়েক সেকেন্ড পর একটা মেয়ে রিয়াদের
টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। রিয়ার দিকে চেয়ে বলল, “তুমি
রিয়া না?
দিশা আমাকে তোমার একটা ছবি দেখিয়েছিল,
সেটা থেকেই চিনতে পারলাম। তোমাদের ল্যাবে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে একজন বলল তোমরা এখানে।”
রিয়া বিরক্ত হয়েই বলল, “হ্যাঁ, আমি রিয়া।” সে মনে মনে ভাবল দিশার সঙ্গে কথা
বলতে হবে। ওকে সাহায্য করা মানে তো এই না যে সে সবাইকে ছবি দেখিয়ে বেড়াবে।
“আমার একটু
দরকার ছিল। আসলে আমার দাদা কফি খায় না, তাই আমারও কফি
খাওয়ার অভ্যেস নেই, সেইজন্যেই স্টার বাকসে আসা হয় না তেমন। এখানে যে এত ভিড় হয় আমার
জানা ছিল না। এখান থেকে বেরিয়ে একটু একান্তে কথা বলা যাবে?” মেয়েটা বলল।
কিম চোখ ওলটাল। এইভাবে
গায়ে এসে পড়া ব্যাপারটাকে সে অত্যন্ত অপছন্দ করে।
ওরা দু’জনেই কিছু বলছে না দেখে মেয়েটা বলল, “সরি, এইভাবে
তোমাদের বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, কিন্তু আমি ভীষণ
সমস্যায় পড়েছি। সেইজন্যেই, প্লিজ আমাকে
সাহায্য করতেই হবে।” বলতে বলতে মেয়েটা কেঁদে ফেলল।
রিয়া দেখল মহাবিপদ। অনেকেই
ওদের দিকে তাকিয়ে দেখছে। সে বলল, “ঠিকই বলেছ, এখানে অনেক লোক, এখানে
তো ঠিক কথা বলা যাবে না। পাশের রিভার-এন্ড পার্কটাতে
গিয়ে কথা বললে কেমন হয়?”
মেয়েটা চোখের জল মুছে ঘাড়
নেড়ে হ্যাঁ বলল।
কফির দাম দিয়ে উঠে পড়ল রিয়া
আর কিম। পার্কে যেতে আর পাঁচ মিনিট লাগল। মেয়েটাও এসে পড়ল তখনই।
মেয়েটা বলল, “আমার
নাম ক্যাসান্ড্রা, সবাই আমাকে ক্যাসি বলেই ডাকে। আমার ভীষণ বিপদ, কারণ আমার দাদা ল্যারি মানে লরেন্সকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
রিয়া বলল, “তাতে
আমরা কী করব?
তুমি পুলিশের কাছে যাও।”
“গিয়েছিলাম, কিন্তু
ওরা পাত্তা দিচ্ছে না। ল্যারির বয়স তিরিশ। সে এখানকার সিরিয়াল-সিনেমায় কাজ করে। কিছু
মডেলিংয়ের কাজও করে, তাই ওরা মনে করছে সে নিজের ইচ্ছেতেই
কোথাও চলে গেছে। গতকাল ওর এখানে আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল এই লেবার ডে উইক-এন্ডটা আমার সঙ্গে কাটাবে বলে। ও তো আসেইনি, কোনো ফোনও করেনি। আমি ফোন করলে দেখছি ওর ফোন সুইচড অফ, অথচ ও জন্মে ফোন বন্ধ রাখে না। ওদের লাইনে ফোনই সব। তাই
আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। দাদা লাস্ট গিয়েছিল গ্লোরি বিচে শুটিং করতে। পরশুই সেই
শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার কথা এবং কাল তাই দাদার আমার এখানে আসার কথা ছিল।”
রিয়া মাথা নাড়তে শুরু করল, “দেখ, আমাদের পক্ষে এখন কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। এই তিন দিন ছুটি, তার মধ্যে কী করব আমরা?”
মেয়েটা তাও হাল ছাড়ার পাত্রী
নয়। বলল, “আমি তোমাদের কিছু করতে বলছি না। দাদা
এই কাছেই বাল্টিমোরে থাকে। আমি শুধু চাই তোমরা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখ। আমি
পারছি না। আমার খালি কান্না পেয়ে যাচ্ছে। তারা সবাই কাছেপিঠেই থাকে, তাই তোমাদের দূরে কোথাও যেতে হবে না। আমি তোমাদের দাদার
ফ্ল্যাটেও নিয়ে যাব, সেখানে যদি কিছু পাও। আসলে আমি এসব ব্যাপারে একদম কাঁচা।
এলিমেন্টারি স্কুলে পড়াব বলে কলেজে পড়ছি। আমাদের মা-বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন।
আমার কাছে দাদাই মা আর দাদাই বাবা। দাদার কিছু হলে আমি...” বলতে বলতে আবার
কাঁদতে শুরু করল ক্যাসি।
ক্যাসির অবস্থা দেখে রিয়া
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। এই তিনটে দিন। কাল সকালে আমরা তোমার সঙ্গে
বাল্টিমোর যাব। কার কার সঙ্গে কথা বলতে হবে?”
“দাদার
এজেন্ট গ্যাভিন কাইজার, দাদার বন্ধু কাম অ্যাকাউন্টেন্ট
নাইজেল পেরি আর দাদার ফ্ল্যাটের হাউজ কিপার মিসেস ফিশার। দাদার যদি কিছু হয়ে থাকে
তাহলে এদের তিনজনই কেউ না কেউ জানবে। তার মধ্যে তোমরা চাইলে ‘স্টার
ক্রসড’ সিনেমাটা
দেখে রাখতে পার। দাদা ওটাতে হিরোর বন্ধুর পার্ট
করেছে। নেটফ্লিক্সে আছে সিনেমাটা।”
রিয়া বলল, “ঠিক
আছে। নিশ্চয়ই দেখে রাখব। তবে কিছু যদি মনে না করো একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
তোমরা কি ভারতীয়? কথায় অবশ্য বোঝা যায় না,
কিন্তু চেহারাটা ভারতীয় মনে হচ্ছে তাই।”
ক্যাসি মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের
মা-বাবা গোয়ার। আমার বয়স যখন তিন, তখন থেকে
এখানেই। আমাকে দেখে বুঝতে পারলে ঠিকই, কিন্তু
দাদাকে দেখে অবশ্য বুঝতে পারবে না। তাকে এদেশিয় বলেই মনে হয়।”
পরদিন সকাল ন’টায় ওদের নিতে আসবে বলে মেয়েটা ওদের ঠিকানা, ফোন নম্বর ইত্যাদি নিয়ে চলে গেল।
কিম শুধু বলল, “লেবার
ডে উইক-এন্ডের ছুটিটার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেল ক্যাসি।
এখন ওর দাদা যদি সত্যি বোনের সঙ্গে ছুটি না কাটাতে চেয়ে হুট করে অন্য কোথাও গিয়ে
থাকে, বা
কাজের জন্যে কোথাও যায়, বা তার ফোন যদি হারিয়ে গিয়ে থাকে
তাহলে ওই ক্যাসি আমাদের কত ডলার দিলে ঠিক হবে বলে মনে হয়?”
রিয়া হেসে বলল, “আমার
তো অন্য কোনো প্ল্যান ছিল না বাড়িতে বসে খাওয়া আর সিনেমা দেখা ছাড়া!”
কিম মাথা চাপড়ে বলল, “সেটাই
তো! ওগুলোই তো করতে পারি না ল্যাবে কাজের দিনগুলোতে।”
রিয়া আর কিম নিউ চেরিভেলের
কলেজে একই ল্যাবে পি.এইচ.ডি
করছে। ওদের বস বেশ নামকরা, তাই কাজের
চাপও বেশি। ছুটি পেলে তাই ওদের আর অন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে না।
পরদিন ঠিক ন’টা নাগাদ ক্যাসি এসে হাজির। রিয়া আর কিমও তৈরিই ছিল। যদিও ছুটির
দিনে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে বলে কিমের মেজাজটা বেশ বিগড়েই ছিল, বলছিল, “কে এক
নাম না জানা অ্যাক্টর, তার জন্যে আমরা ভুগে মরছি!”
রিয়া বলল, “আমি
কাল রাতে ‘স্টার
ক্রসড’ সিনেমাটা
দেখেছি হলমার্কে। ল্যারি খারাপ অভিনেতা নয়। আর ওকে দেখলে সত্যিই বোঝা যায় না যে ও গোয়ার
ছেলে।”
কিম শুধু বলল, “হুঁ।”
ক্যাসি আসার পর অবশ্য আর কিছু
বলেনি কিম।
ক্যাসি বলল, “প্রথমে
নাইজেলের ওখানে যাচ্ছি। দাদা বাড়ি নেই বলে মিসেস ফিশার ভার্জিনিয়াতে মেয়ের কাছে
চলে গিয়েছিলেন। আমি ফোন করতে বললেন চাবি নিয়ে আসছেন। তবে একটু দেরি হবে।
তাই আগে নাইজেল আর গ্যাভিনের সঙ্গে দেখা করে নিয়ে তারপর ফ্ল্যাটে যাব। ততক্ষণে
আশা করা যায় মিসেস ফিশার চলে আসবেন।”
রিয়া জিজ্ঞেস করল, “তোমার
কাছে তোমার দাদার ফ্ল্যাটের চাবি নেই?”
“দাদা দিয়েছিল।
বাড়িতে খুঁজে পেলাম না। আচ্ছা এখানে দেখি তো।” বলে
গাড়িতে এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে বলল, “এই তো পেয়েছি! ভুলেই গিয়েছিলাম এখানে
রেখেছি। তবে নাইজেল আর গ্যাভিনকে বলে দিয়েছি। দু’জনেই
কাজ-পাগল, তাই
শনিবারও কাজ করবে। আগে ওদের কাজের ওখান হয়ে তারপর দাদার অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া
যাবে। চাবি যখন পেয়ে গেছি তখন মিসেস ফিশার পরে এলেও কোনও ক্ষতি হবে না।”
ক্যাসি বেশ জোরেই গাড়ি চালায়
দেখা গেল। গোল্ডবার্গ অ্যাসোসিয়েটস বলে একটা কোম্পানিতে কাজ করে নাইজেল। ওরা
এগারোটা নাগাদ ওর অফিসে পৌঁছতে নাইজেল ওদের একটা ছোটো মিটিং ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। কফি
মেশিন থেকে রিয়া আর কিমের জন্যে কফিও এনে দিল। ক্যাসি রিয়া আর কিমের পরিচয় দিল ওর
বন্ধু বলে।
ক্যাসিকে নাইজেল বলল, “ল্যারির
জন্যে আমারও বেশ চিন্তা হচ্ছে। ফোন ছাড়া তো সে কিছুতেই থাকে না। আসলে ভুলটা আমারই, আমিই
ওকে গ্যাভিনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম একটা পার্টিতে। গ্যাভিন ওকে খাটিয়ে
মারছে। যা কাজ আসে সবই প্রায় নিতে বাধ্য করে। ল্যারি মনে হয় আর পেরে উঠছে না।
ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কয়েকদিন আগে যখন দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে তখন বলছিল ‘আর
ভালো লাগছে না গ্যাভিন! ক্যাসির পড়াশোনা শেষ হলেই আমিও এইসব ছেড়ে দেব। অন্য কিছু
করব। আর পেরে উঠছি না।’ তবে ওই সিনেমার শুটিংটা নিয়ে বেশ
উত্তেজিত ছিল। গ্লোরি বিচে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিল আর পার্টটাও নাকি বেশ ভালো। আমাকে
বলছিল, ‘এই
অভিনয়টা ভালো করে করতে পারলে অস্কার পেয়ে যেতে পারি সাপোর্টিং অ্যাক্টর
ক্যাটেগরিতে।’ তারপর কেন
সে এইভাবে পালাল জানি না। শুটিং শেষ করেছিল?”
“করেছিল মনে
হয়। গ্যাভিন হয়তো জানবে। ওর সঙ্গে কথা হয়নি। এরপর যাব। আচ্ছা, দাদার অর্থের টান পড়েনি তো?” ক্যাসি
জিজ্ঞেস করল।
“না, সেদিক
থেকে তো গ্যাভিন ওর এজেন্ট হওয়ার পর থেকে অর্থ বেশিই আসছে। তবে সব কিছু ল্যারি
নিতে চায় না। যেমন ওই সিগারেটের অ্যাডটা ও করতে চায়নি। বলেছিল, ‘আমি
নিজে যেটা করতে চাই না সেটা লোকেদের কেন করতে বলব?’ সেই নিয়ে
গ্যাভিনের সঙ্গে ওর তুমুল লাগে। শেষমেশ ল্যারিই জিতেছিল,
কিন্তু গ্যাভিনের অত্যাচার নাকি তারপর আরও বেড়ে যায়। যাই হোক, তোমরা কিছু খবর পেলে আমাকে জানিও। পুলিশ কেন যে কিছু করছে
না ভেবে পাচ্ছি না।”
“প্রাপ্তবয়স্ক
কেউ নিখোঁজ হলে ওদের ওইরকমই পলিসি,” ক্যাসি হতাশ সুরে বলল, “হতেই
পারে যে অনেকে বাড়ির লোকেদের না বলে কয়ে কোথাও চলে যায়, আবার পরে
ফিরে আসে। তখন পুলিশের সময় নষ্ট হয়। কিন্তু আমি ওদের কী করে বোঝাব যে আমার দাদা ওইরকম
নয়!”
নাইজেল বলল, “হুঁ, একেবারেই
না। সেইজন্যেই আমার ভয় হচ্ছে।”
নাইজেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
ওরা গ্যাভিনের সঙ্গে কথা বলতে গেল।
গ্যাভিনের অফিস তার বাড়ির
সামনের ঘরটাতেই। গোলগাল চেহারা, মাথায় টাক, চোখে
মোটা চশমা, কিন্তু মুখে একবিন্দু হাসি নেই। ক্যাসি যে নিজের
বন্ধুদের নিয়ে ওর আস্তানায় এসে হাজির হয়েছে সেটা তার একদম পছন্দ নয় বোঝা যাচ্ছে।
সে গজগজ করে বলল, “মঙ্গলবার
থেকেই আবার শুটিং শুরু, আশা করি তেনার সেই খেয়াল আছে! ল্যারি
কাজে না পৌঁছলে ডাইরেক্টর আমার মাথা খাবে।”
ক্যাসি ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আরে
তুমি বুঝতে পারছ না যে দাদার কোনো ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে?”
ব্যাপারটার মোড় ঘুরে যাচ্ছে
দেখে রিয়া প্রশ্ন করল, “আপনার সঙ্গে ক্যাসির দাদার শেষ কবে কথা হয়েছে?”
গ্যাভিনের দৃষ্টি রিয়ার দিকে
ঘুরে গেল। “ল্যারির লাস্ট শুটটাতে একটু ঝামেলা
হওয়ায় সময় বেশি লেগে গিয়েছিল। তাই সে
ফিল্ম ইউনিটের দলের সঙ্গে গ্লোরি বিচে যেতে পারেনি। আমিই ওদের সঙ্গে কথা বলে ওর
জন্যে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। ‘সুপার
চপার প্লাস’ বলে একটা কোম্পানি আছে। ল্যারি মাঝে মাঝেই ওদের
হেলিকপ্টারে করে এদিক ওদিক যেত। কোম্পানিটার মালিক ডেভ নিজেও হেলিকপ্টার চালায়।
যাই হোক, অন্য পাইলটরা ব্যস্ত ছিল বলে সে-ই হেলিকপ্টারে
করে ল্যারিকে গ্লোরি বিচে নিয়ে যায়। সেখানে শুটিং ঠিকঠাকই হয়েছিল সে খবর আমি
পেয়েছি। ওর একটা ভয়ংকর ডেয়ার ডেভিল সিন ছিল। ল্যারি নিজেই করতে চাইছিল, কিন্তু আমি বারণ করি। বলা তো যায় না। লেগে-টেগে গেলে অনেকদিনের ধাক্কা। সব শুটিং ক্যানসেল করতে হবে।
অনেক বলে কয়ে ওকে ডুপ্লিকেট স্টান্টম্যান নিতে রাজি করাই। সেটাই আমার
ল্যারির সঙ্গে শেষ কথা। তবে আমি ডাইরেক্টরের সঙ্গে কথা বলেছি। গ্লোরি বিচের
সিনগুলো ভালোভাবেই হয়ে গেছে। লেবার ডে-র পর মঙ্গলবার ম্যানহ্যাটানে ল্যারির কয়েকটা
সিন আছে। তার আগে সে উদয় না হলে আমরা বিপদে পড়ব। নামি ডাইরেক্টর, এখানে
ঝামেলা হলে মুশকিল আছে। ওইরকম চুনোপুঁটি অ্যাক্টরেরও ডেট পাওয়া যায় না, সেই বদনাম রটে গেলে পরে অন্য সিনেমা জোগাড় করতে অসুবিধা
হয়ে যাবে। ল্যারিকে আমি অনেকবার ফোন করেছি,
কিন্তু আমার ফোনের উত্তর দিচ্ছে না। তোমার সঙ্গে কথা হলে বোলো ভালো ছেলের মতন
মঙ্গলবারের শুটিংটা যেন করে নেয়।”
ক্যাসি কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল সে বেশ রেগেছে। গ্যাভিন আর কোনও কথা
বলতে রাজি হল না, তাই ওরা বেরিয়ে পড়ল।
বেরিয়ে এসে ক্যাসি রাগতভাবে বলল, “আমার
দাদা মোটেই চুনোপুঁটি অ্যাক্টর নয়। কী বদলোক! দাদাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই! সে যেন মঙ্গলবার দিন শুটিং করতে
চলে আসে!”
রিয়া বলল, “হুঁ।
আচ্ছা, ওই সুপার চপার প্লাস কোম্পানিটার সঙ্গেও
কথা বলতে হবে। যারা তোমার দাদাকে গ্লোরি বিচে নিয়ে গিয়েছিল তারাও হয়তো কিছু জানতে
পারে।”
ক্যাসি বলল, “হ্যাঁ, ওদের
কথা তো জানতামই না। বদ গ্যাভিন যাই হোক একটা খবর দিল। আচ্ছা, এবার
দাদার অ্যাপার্টমেন্টে যাই।”
ক্যাসির দাদার
অ্যাপার্টমেন্টের কাছে গিয়ে দেখা গেল সেখানে কিছুটা ভিড় জমে রয়েছে রাস্তায়। কী
ব্যাপার দেখতে যেতে লোকে বলল, “গুলি চলেছে। একজন গুরুতরভাবে আহত।
পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, তারা আসছে।”
সত্যিই দূর থেকে পুলিশ আর
অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের পোঁ পোঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ওরা ভিড় সরিয়ে দেখল একজন
মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। পিছন থেকে
দেখেই ক্যাসি ‘দাদা’ বলে
ডুকরে কেঁদে উঠল। ও এগিয়ে ছুটে যাচ্ছিল, এমন সময়
ওকে একজন ধরে বলল, “আমি ট্রাফিক পুলিশ। কিন্তু আমি
এখানে এসে পড়েছি, তাই ক্রাইম সিন আগলে রাখছি। এটা শুটিং
কেস। তুমি হাত না দিলেই ভালো। প্যারামেডিক্সরা
এখুনি এসে পড়বে। যা করার ওরাই করবে। ওরা জানে এইসব কেসে কী করতে হয়।”
দু-মিনিটের
মধ্যে পুলিশ আর প্যারামেডিক্সরা এসে পড়ল। ক্যাসি সমানে কেঁদে চলেছে। তারা সঙ্গে
সঙ্গে ক্যাসির দাদাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে চলে গেল। পুলিশের লোকজন ক্যাসির
নম্বর নিয়ে বলল,
“পাশের সেন্ট মেরি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্রিটিক্যাল কেস। আমরা তোমাকে
জানাব কী হচ্ছে। এমনিতেও এখন দেখতে পাবে না, ওকে
সার্জারি রুমে ঢুকিয়ে দেবে গুলি বার করার জন্যে। তবে অবস্থা ভালো নয়। নাও বাঁচতে
পারে। আমরা জানাব।”
রিয়া আর কিম ক্যাসিকে ধরে ওর
দাদার ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে বসাল। সে কাঁদতে
কাঁদতে মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।
একটু পরেই মিসেস ফিশার এলেন।
তিনিও শুনে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “এত ভালো
মানুষ ছিল ল্যারি। কোনও সাতে পাঁচে থাকত না। সিনেমার অভিনেতাদের জীবন সম্বন্ধে
যেরকম শোনা যায় সেইরকম উচ্ছৃঙ্খল মোটেই ছিল না সে। কেবল বলত, ‘মিসেস
ফিশার, এই লাইনে অর্থ বেশি বলে আমি এখানে এসেছি।
ক্যাসির পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলেই আমি এই লাইন ছেড়ে দেব।’ ওইরকম
ছেলের কেন যে এইরকম হল!”
একটু পরেই পুলিশের ফোন এল যে
গুলিবিদ্ধ যুবক মারা গেছে। ক্যাসিকে গিয়ে তার দেহ সনাক্ত করতে হবে।
রিয়া আর কিমই ওকে নিয়ে সেন্ট
মেরি হসপিটালে গেল। ক্যাসি গাড়ি চালাবার মতন অবস্থায় নেই দেখে কিমই চালাল।
ক্যাসিকে হাসপাতালের ঘরে নিয়ে
যাওয়া হল। ওরা নম্বর বলে দিয়েছিল। পুলিশের অফিসার বললেন, “তোমরা তো
এখানে থাক না, তাই ওকে আর মর্গে টেনে নিয়ে যেতে চাইনি।” তারপর
ক্যাসিকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস গোমস, আপনি ভালো
করে দেখে বলুন এই আপনার দাদা কিনা।”
ক্যাসি মুখ তুলে চেয়ে মৃত
যুবকের মুখটা দেখে গোল্ডফিশের মতন মুখ খুলতে বন্ধ করতে লাগল। পুলিশ
অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল? জল খাবেন? আমি জানি
ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক, কিন্তু...”
ক্যাসি হাত আর মাথা নেড়ে
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “না না, ভীষণ ভুল হয়ে গেছে আমার। এটা তো আমার দাদা নয়! পিছন থেকে
দেখে মনে হচ্ছিল দাদা, কারণ অনেকটাই মিল, একইরকম
চুলের ছাঁট,
চেহারার গড়ন! দেখতেও একইরকম অনেকটাই, কিন্তু দাদা নয়!”
এইবার পুলিশ অফিসার বললেন, “সেইজন্যেই
আপনাকে এখানে ডেকেছিলাম। আসলে মৃত যুবকের পকেট থেকে ওর আই.ডি
ইত্যাদি দেখে আমরা বুঝতে পারি ওর নাম ম্যানুয়েল পেরেজ। আপনার দাদার নাম তো লরেন্স
গোমস। আমরা ভাবছিলাম এ হয়তো আপনার কাজিন বা কেউ হবে।”
ক্যাসি মাথা নাড়ল, “নাহ্, একে
আমি কোনোদিন দেখিইনি।”
রিয়া হঠাৎ ফট করে বলল, “ক্যাসির
দাদা একজন অভিনেতা। তাঁর জন্যে শক্ত সিন করতে একজন স্টান্টম্যান ছিল, এ
সে নয় তো?”
পুলিশ অফিসার বললেন, “একদম
ঠিক। ম্যানি মানে ম্যানুয়েল স্টান্টম্যানই ছিল। ও খুব সম্ভব
ল্যারির সঙ্গে দেখা করতে ল্যারির বাড়িতে আসছিল। এদিকে কিছু লোক ল্যারিকে মারবে বলে
ওর অ্যাপার্টমেন্টের ওপর নজর রাখছিল। ম্যানুয়েলকে ল্যারি ভেবে ভুল করে গুলি করে
তারা।”
ক্যাসি আবার কাঁদতে শুরু
করেছে। “কিন্তু তাহলে আমার দাদা কোথায়?”
পুলিশ অফিসার এবার বললেন, “হ্যাঁ, এবার
এটা যখন খুনের মামলা হয়ে গেছে তখন আপনার দাদাকে খুঁজে বার করতেই হবে। ট্যাক্সি
চালকের ধারণা, কোনও একটা কালো গাড়ি থেকে গুলি চালানো হয়েছিল।
কিন্তু কেউ লাইসেন্স প্লেটের নম্বর দেখেনি বা কী গাড়ি সেটাও না। তাই গাড়ি
খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল হবে।”
হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে
এসে ক্যাসি বলল,
“সত্যি আমি মনে খুব শান্তি পাচ্ছি মৃতদেহটা দাদার নয় জেনে।
কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে ওই ছেলেটাও তো দাদার বয়সি একজন। তারও নিশ্চয়ই একটা
জীবন ছিল,
আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন।
সব কিছু ওই কয়েকটা গুলিতে শেষ হয়ে গেল।”
ফোনে ঠিকানা দেখে সুপার চপার
প্লাসের কোম্পানিতে গিয়ে হাজির হল ওরা। রিসেপশনের মহিলা কাকে চাই বলতে রিয়া বলল, “ডেভের
সঙ্গে দেখা করতে পারি? ব্যাপারটা জরুরি।”
ওদের তিনজনকে আপাদমস্তক দেখে
নিয়ে মহিলা বললেন, “আজ আর কোনও চপার ফ্লাইট নেই। পাইলটরা সব বেরিয়ে গেছে।
শুধু ডেভ রয়েছে, কিন্তু ও আজ যাবে না কোথাও।”
রিয়া উত্তর দিল, “না না, আমরা
চপার বুক করতে আসিনি। একটা ব্যাপারে মিস্টার ডেভের সঙ্গে একটু কথা ছিল। বেশি সময়
নেব না। বলুন ল্যারি গোমসের বোন ক্যাসি এসেছে।”
মহিলা উঠে গিয়ে একটা ঘরের
দরজায় টোকা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। একটু পরে বেরিয়ে এসে বললেন, “ঠিক আছে, ডেভ তোমাদের সঙ্গে কথা বলবে। ওই ঘরে চলে যাও।”
ঘরের দরজায় টোকা দিতে ভিতর
থেকে, ‘কাম
ইন’ বলল
কেউ।
ওরা ঘরে ঢুকে দেখল বিশাল একটা
টেবিলে একটা কম্পিউটারের সামনে বসে রয়েছে একজন। লম্বা সুপুরুষ দেখতে। বয়স চল্লিশ
মতন হবে। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া সোনালি চুল, মুখে হাসি,
কিন্তু নীলচে চোখগুলোতে হাসি নেই। ঘরের দেয়ালে ডেভের সঙ্গে অনেক নামি লোকেদের ছবি
টাঙানো।
ক্যাসি এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমি
ল্যারির বোন ক্যাসি। আর এরা আমার বন্ধু রিয়া আর কিম।
ল্যারিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে আমি বেশ চিন্তিত। আপনিই তো ওকে গ্লোরি বিচে
পৌঁচে দিয়েছিলেন, তাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলাম আপনি
কিছু জানেন কিনা।”
“ও, ল্যারিকে
পাওয়া যাচ্ছে না? ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো! আমিই তো ল্যারিকে গ্লোরি বিচে নিয়ে
গিয়েছিলাম আর কেউ ছিল না বলে। আসলে যাওয়ার সময় ল্যারি আমাকে বলেছিল যে সে আমার
সঙ্গেই ফিরবে, তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে। ওকে বোনের বাড়ি
যেতে হবে। ইউনিটের বাকিদের সঙ্গে ফিরলে দেরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কারণ সবাই সময় মেনে চলে না। আমিও রাজি হয়েছিলাম তাতে।
ভোরবেলা রওনা হওয়ার কথা ছিল আমার। আমি ল্যারিকে কোন সময়, কোথা থেকে
ছাড়বে চপার সেইসব
বলে দিয়ছিলাম, কিন্তু ও এল না। আমি আধঘণ্টা অপেক্ষা করে ওকে
ফোন করলাম, কিন্তু ফোন মেসেজে গেল। আমাদের তো ফ্লাইট
প্ল্যান জমা দিতে হয়, তাই বেশি দেরি না করে ফিরে এলাম
আমি। আমি ভেবেছিলাম যে ও হয়তো অত সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি, তাই আসেনি, পরে দলের
সঙ্গে ফিরে যাবে। আমি যদি জানতাম কিছু একটা গণ্ডগোল, তাহলে তো নিজেই খোঁজ নিয়ে দেখতাম।”
“শুধু গণ্ডগোল
নয়, ভয়ংকর
গণ্ডগোল,”
ক্যাসি বলল,
“আজ দুপুরে আমার দাদার যে ডুপ্লিকেট হয় সিনেমায়,
সেই লোকটাকে রাস্তায় গুলি করে মারা হয়েছে পিছন থেকে দাদার মতন দেখতে লাগে বলে!”
“কী
সাংঘাতিক! ল্যারি তো তেমন কিছু করার মতন ছেলে নয়। ওকে কেন কেউ মারতে চাইবে?”
রিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, “আপনাদের
এই চপার কোম্পানির কতদিন হল?”
“সুপার চপার
প্লাস আমি চার বছর আগে শুরু করি। তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অনেক
নামকরা লোক আমাদের কাছ থেকে চপার ভাড়া করেন।”
“আচ্ছা, দাদা কি আপনাকে কিছু বলেছিল? মানে
চিন্তায় আছে কিনা…”
“না, সেরকম
তো কিছু বলেনি। শুটিংয়ের ফাঁকে গ্লোরি বিচে সাঁতার কেটে আনন্দ করবে, এই ছিল ওর পরিকল্পনা। খুব আমুদে ছেলে, আমার
সঙ্গে ফ্লাইটে যেতে যেতেই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কথা হয়েছিল ওর শুটিং শেষ হলে
বাল্টিমোরে একদিন দেখা করে কফি খেতে খেতে গল্পসল্প করা হবে। কিন্তু কোথায় চলে গেল
সে? আমি
তো আর কিছু বলতে পারব না, কিন্তু
কিছু জানতে পারলে আমাকে নিশ্চয়ই জানিও। বাল্টিমোরে ওর একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে না? সেখানে
খুঁজে দেখা হয়েছে?”
“হ্যাঁ, সেখানেই
তো রয়েছি আমরা,”
ক্যাসি বলল,
“ওর হাউজ কিপার মিসেস ফিশারও ওকে দেখেননি। আর ও এইভাবে আমাকে কিছু না জানিয়ে কখনও
হাওয়া হয়ে যায় না।”
“হুঁ, ঠিক
আছে। এর বেশি তো আমি কিছু জানি না। ও আমার সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে গিয়েছিল আর ফেরার
সময় আমার সঙ্গে ফেরেনি, এইটুকুই। আমার একটা মিটিং আছে একটু
পরেই, তাই আমাকে তৈরি হতে হবে সেটার জন্যে। এই আমার
কার্ড। আর কিছু দরকার লাগলে ফোন কোরো।”
সুপার চপার প্লাস থেকে ওরা বাল্টিমোরে
ক্যাসির দাদার ফ্ল্যাটে থেকে যাবে সেটাই মনস্থ করল। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর আবার
ড্রাইভ করে নিউ চেরিভেলে ফেরার কোনও মানে হয় না।
পিৎজা দিয়ে ডিনার সেরে রিয়া
আর কিম বাইরের ঘরের দুটো সোফাতে শুলো আর ক্যাসি বেডরুমের খাটে। শুতে যাওয়ার আগে
ওদের দু’জনকে, “তোমাদের কী বলে যে ধন্যবাদ দেব!” এইসব
বলছিল।
রিয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আজ
আর না। কাল সকালে কথা হবে। এত ক্লান্ত যে থ্যাঙ্ক ইউ শোনার মতনও অবস্থা নেই।
ভালো করে ঘুমিয়ে নাও, কালকেও অনেক ধকল যাবে।”
ক্যাসি শুকনো হাসি হেসে ‘গুডনাইট’ বলে
শুতে চলে গেল।
মাঝরাতে দরজায় চাবির শব্দে
রিয়ার ঘুমটা ভেঙে গেল। সে সাঁৎ করে কিমের কাছে গিয়ে তাকে ঝাঁকাল। মুখে
আঙুল দিয়ে কথা বলতে বারণ করল। বাইরে থেকে রাস্তার আলো এসে পড়ছিল ঘরটায়, তাই দেখা যাচ্ছিল সব কিছুই। রিয়া একটা ভারী ফুলদানি হাতে
নিয়ে তৈরি হয়ে রইল। কিমও উঠে পড়েছে। সেও তৈরি। দরজাটা খুলে একটা ষন্ডামার্কা লোক
ঘরে ঢুকল। তার হাতে চকচক করছে রিভলভার। অন্ধকারটা লোকটার চোখ-সওয়া হওয়ার আগেই রিয়া এক লাফে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে ধাঁই
করে ফুলদানিটা দিয়ে লোকটার মাথায় মারল। একটু টলল লোকটা,
কিন্তু কিছুই যেন হল না। আগুনের মতো চোখ দিয়ে রিয়ার দিকে
ফিরে তাকাল। ততক্ষণে ব্ল্যাক বেল্ট কিম দুমাদুম
তার ক্যারাটের প্যাঁচ শুরু করে দিয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লোকটাকে কাবু করে
ফেলল সে। যদিও ঘরটার অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল সব ভেঙেচুরে। শব্দ শুনে ক্যাসি উঠে পড়ে
এসে আলো জ্বালিয়েছে। পর্দা বাঁধার দড়ি দিয়ে কাবু হয়ে যাওয়া লোকটাকে বেঁধে ফেলে
পুলিশ ডাকা হল।
ওরা যখন পুলিশের জন্যে
অপেক্ষা করছে তখন রিয়া হঠাৎ বলে উঠল, “আরে,
একটা কথা মনে পড়েছে! আমি তাই তখন থেকে ভাবছি কী যেন একটা ঠিক মিলছে না ওই ডেভের
কথাতে।”
ক্যাসি আর কিম সমস্বরে জিজ্ঞেস
করল, “কী?”
“আরে ওই যে ও
বলল না যে ক্যাসির দাদা বলেছে বাল্টিমোরে ফিরে দু’জনে
একসঙ্গে বসে কফি খাবে আর গল্প করবে? সেটা তো ক্যাসির দাদা বলতেই পারে না, কারণ
ওর দাদা তো কফি খায় না! তুমি তাই বলেছিলে না আমাদের?”
ক্যাসি বলল, “হ্যাঁ, ওর
একদম সুট করে না কফি। খেলে পেটে ব্যথা করে, রাতে
ঘুমোতে পারে না। তাই ওর কফি খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
দাদা খায় না বলে আমিও খাই না। অর্থাৎ ডেভ মিথ্যে কথা বলছে! কিন্তু কেন? আর
এই লোকটাই বা কে?”
দরজায় ঠক ঠক হতে পুলিশ মনে করে
ক্যাসি দরজাটা খুলে দিতেই বন্দুক হাতে হুড়মুড় করে ডেভ ঘরে ঢুকে এল। “কথাটা
বলে ফেলার পর আমি বুঝতে পারলাম আমার ভীষণ ভুল বলা হয়েছে। ল্যারি তো কফি খায় না।
তারপর তো আর তোমাদের বাঁচতে দেওয়া যায় না!”
“পুলিশ আসছে
এখুনি,” রিয়া
শান্ত গলায় বলল।
“তা আসুক।
তোমরা টুঁ শব্দ কোরো না। আমি ওদের সামলে নেব,” বলে সে ক্যাসির
ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে রাখল।
অন্য লোকটার বাঁধন খুলে দিতে
সে রিয়া আর কিমের ওপর বন্দুক তাক করে রইল ঘরের অন্য একদিক থেকে, যেই
দিকটা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কেউ দেখতে পাবে না।
পুলিশ আসতে দরজা খুলে
ক্যাসি বলতে বাধ্য হল, “সরি, ভুল করে
আপনাদের ডেকে ফেলেছিলাম। ডেভ আমার দাদার বন্ধু। ওর কাছে বাড়ির চাবি ছিল। সেটা দিয়ে
ঢুকেছিল আর আমরা মিছিমিছি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
এদিকে রিয়া আর কিমের চোখাচোখি
হল। কিছু একটা করতেই হবে। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে ওরা সবাই মরবে।
কিম হঠাৎ আ-আ-আ-আ-আ করে বীভৎস
একটা চিৎকার করে লাফ দিয়ে সোফার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। আর কিমকে দেখাদেখি রিয়াও তাই।
ষন্ডামার্কা লোকটা গুলি চালাল বটে, কিন্তু
ততক্ষণে ওরা দু’জন আর গুলির সামনে নেই, সোফার পিছনে
গুঁড়ি মেরে লুকিয়ে রয়েছে। গুলির শব্দ শুনেই পুলিশের লোকজন হাঁ হাঁ করে ঘরে ঢুকে এল। ব্যস, তারপর ডেভ আর তার সঙ্গী আর কিছুটি করতে পারল না, কারণ পুলিশ ওদের ধরে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
পুলিশের লোকজন ডেভকে জেরা করে
জেনেছিল, ডেভের হেলিকপ্টার বিজনেসের সঙ্গে ড্রাগ আর দামি
জিনিস স্মাগলিংয়ের বিজনেসটাও চলত। সেদিন গ্লোরি বিচে ওদের একটা অ্যাসাইনমেন্ট ছিল।
ল্যারির সুটকেসগুলোর মধ্যে থেকে একটা অবিকল ডেভের সুটকেসের মতন দেখতে বলে ল্যারি
ভুল করে সেটা নিয়ে নেমে যায়। দু-দিন পরে ডেভ
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হোটেলে ল্যারির ঘরে যায়। ততক্ষণে অবশ্য শুটিং শেষ হয়ে গেছে
আর ল্যারিও সুপার চপারের সঙ্গে জড়িত স্মাগলিং ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে গেছে।
কিন্তু তার যেটা ভুল হয়েছিল সে কাউকে বলেনি। ডেভের সঙ্গে দেখা হতে ল্যারি তাকে
পুলিশে দেবে বলে শাসিয়েছিল। তখন আর উপায় না দেখে ল্যারিকে গুলি করে সমুদ্রের জলে
ফেলে দেয় ওরা। তাও ল্যারির ফ্ল্যাটে কে ঢুকছে না ঢুকছে সেটার ওপর নজর রেখেছিল ওরা।
এদিকে বেচারা ম্যানুয়েল সত্যিই ল্যারির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছিল। সে বলেছিল
বাল্টিমোরে এলে ল্যারির সঙ্গে দেখা করবে। ল্যারি ওকে নিজের ঠিকানাও দিয়েছিল। সেইজন্যেই
এসেছিল ম্যানুয়েল আর ডেভের লোকজন পিছন থেকে তাকে ল্যারি বেঁচে ফিরে এসেছে ভেবে
গুলি করে।
লেবার ডে-র তিন দিন পর
শুক্রবার হঠাৎ ক্যাসির ফোনটা এল। রিয়া তুলতে সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি
আবার কাঁদছি, কিন্তু এটা অন্যরকম, এটা আনন্দের
কান্না। আমি গ্লোরি বিচের কাছে একটা হাসপাতাল থেকে বলছি, দাদাকে
খুঁজে পাওয়া গেছে। গ্লোরি বিচ থেকে কিছুটা দূরের এই হাসপাতালে রয়েছে সে। সমুদ্র
ওকে নেয়নি,
ফিরিয়ে দিয়েছে। ভাসতে ভাসতে গ্লোরি বিচ থেকে একটু দূরের একটা
প্রাইভেট বিচে গিয়ে পড়েছিল ও। সেই বিচের মালিক ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ওর পকেটে
কোনো আই.ডি বা ফোন কিছুই ছিল না। ওরা সব নিয়ে নিয়েছিল, তাই লোকজন ওর সম্পর্কে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
মারাত্মক চোট পেয়েছে বলে সে এতদিন অজ্ঞান ছিল। এখন জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু
কথা বলতে পারছে না। রক্তক্ষরণের জন্যে খুবই দুর্বল, তবে আমাকে
চিনতে পেরেছে! অল্প হেসেছে আমাকে দেখে। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে ওকে, কিন্তু আমি রয়েছি ওর সঙ্গে।
ওকে পারতেই হবে! দাদা ভালো হয়ে উঠলে তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাব। তোমরা না
থাকলে এত কিছু কোনোদিন হত না। ডেভ আর তার
লোকেরা আমাকেও মেরে ফেলত। দাদা সেরে উঠলে ওকে সেই সব ঘটনাগুলো
বলা হবে। তোমরা দাদার জন্যে প্রার্থনা কোরো, আর আমার
জন্যেও।”
কাজ থেকে বাড়ি ফিরে রিয়া দেখল
বাড়ির সামনে বিশাল একটা বাক্স। সেটাকে
খুলতে তার ভিতর থেকে একগাদা জিনিস বেরোল — চা, কফি, হট
চকোলেট, কুকিজ, চকোলেট, চিপস
ইত্যাদি আরো অনেক ধরনের খাবার। ক্যাসি লিখেছে, ‘তোমাদের
উপকারের কোনও দাম হয় না, কিন্তু
একটু কিছু দিতে ইচ্ছে করল। কিমের সঙ্গে ভাগ করে নিও। – ভালোবাসা, ক্যাসি।’
রিয়া কিমকে ফোন করে বলল, “বিশাল
ব্যাগ নিয়ে চলে এস, ক্যাসি অনেক উপহার পাঠিয়েছে আমাদের দু’জনের জন্যে।”
কিম বলল, “যাক, এই প্রথম আমিও কিছু পেলাম।
তবে আজকে শুক্রবার বিকেল, তাই আজ তো যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
কাল বা পরশুও, না, একেবারে সোমবার দিন দেখা যাবে।”
রিয়া বলল, “ঠিক
আছে, তাই এস। তবে সব কিছু
শেষ হয়ে গেলে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না!”
ছবিঃ সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment