
বুনুপিসির পরিবার
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
বুনুপিসি আর তার
আশ্চর্য পরিবারের পাল্লায় পড়ে একবার যে কী ঝামেলাতেই পড়েছিলাম তোমরা
কল্পনাও করতে পারবে না। আমি আবার মিশতে পারি না তেমন, তাই লোকে যা নয় তাই
বলে আমার সম্পর্কে। এমনিতে আমার মাথা বেশ ঠান্ডাই, কিন্তু লোকজনের
সংস্পর্শে এলেই আমার মাথা সাঙ্ঘাতিক গরম হয়ে যায় আর কান কটকট করতে থাকে। বেশ বুঝতে
পারি তাদের মনের মতো আমি কিছুই করে উঠতে পারিনি এ যাবৎ। আমার
সবটাই ভুলে ভরা। তাই পরামর্শ আর উপদেশ দিতে তারা একবার শুরু করলে আর থামতে পারেন
না। তবে বুনুপিসির বাড়ি যেতে ভালোই লাগত। বুনুপিসির ভাই বাঘাকাকাকে
একটুও ভালো লাগত না। পড়াশোনা পরীক্ষা ইত্যাদি যা তা বলে বিরক্ত করত।
এখনও করে। যার যা কাজ!
আমার বুনুপিসি বাবার
মামাতো বোন। মায়ের খুব বন্ধু। ফোনে দু’জনের কথা হয় রোজ। সেবার বুনুপিসির
বাড়ি গেছিলাম একটা জন্মদিনের নিমন্ত্রণে। বুনুপিসির বাড়ি দক্ষিনেশ্বরে। পিসির
বাড়ির পাশে ওদেরই একটা পুরানো বাড়ি ছিল। ওটা রিপেয়ার করে পিসে ভাড়া
দিয়েছিল, কিন্তু একতলাটা নাকি ভূতুড়ে ছিল, কেউ থাকতে পারত না।
তবে দোতলায় ভূতের উৎপাত ছিল না। মনে হয় ভূতের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে প্রবলেম ছিল। দোতলায় ভাড়া থাকত
ডানপিটে কিছু ছেলে। তারা পড়াশোনা বা চাকরির কারণে কলকাতায় থাকত।
আমি গেছিলাম বুনুপিসির
নাতি বুবুনের জন্মদিনে। আর মায়ের শরীর খারাপ থাকায় একাই যেতে হয়েছিল। আমার এইসব
গেট টুগেদার ভালো লাগে না একেবারেই, তবু কল্যাণী থেকে দক্ষিণেশ্বর
যেতে হয়েছিল মায়ের পীড়াপীড়িতে। মা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব ভালোবাসে খুব। মেশার
প্রয়োজন তো আছেই। দশটা বিরক্তিকর লোক থাকলেও একটা ভালো লোক ঠিক পাবেই পাবে।
আর সেই একটা ভালো লোককে খুঁজে বার করার জন্য মানুষের সঙ্গে
মেলামেশার দরকার।
বুনুপিসির নাতির
জন্মদিনের কথা হচ্ছিল। তেমন কেউ নেই নিমন্ত্রিত। সন্ধের দিকে বুবুনের বয়সি কিছু বাচ্চা আসার
কথা। বুনুপিসি পিসে আর বুবুনের মা কাবেরী, কাবেরীর মা, পিসি চুমকি বাড়িতেই ছিল।
ছিল না বুবুনের বাবা আমার পিসির ছেলে বান্টি। অফিসের কাজে ও চেন্নাইতে। কাবেরী
আর চুমকি রান্নাঘরে ব্যস্ত। যার জন্মদিন সে ছিল না। বুবুন স্কুলে বা প্রাইভেট কোচিং-এ। এত বছর পর এখন আর
ঠিক করে মনে পড়ে না। বুনুপিসি আমাকে বসাল, ঠাকুরের প্রসাদ এবং জল দিল। চুমকি চা আর
লুচি-আলুভাজা এনে দিল। রান্নাঘর থেকে দারুণ সব গন্ধ ভেসে আসছে। আমারও মনখারাপটা
কেটে গেল। মনে পড়ে গেল ছোটোবেলায় পিসি খুব ভালোবাসত আমায়। যেখানে
বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। বাঘাকাকাও এসে বসে আছে। ছোটোবেলায় পরীক্ষার
রেজাল্ট কেমন হল তাই নিয়ে বিরক্ত করত, এখন বিয়ে কবে করছি, চাকরি কেন করছি না
এইসব নিয়ে বিরক্ত করে। মানে আলোচনাটা ওইদিকেই চলে যায়। কিন্তু এ কী! এখনও পর্যন্ত কেউ
আমাকে কোনোরকম কিছু বলছে না। বিয়ে নিয়ে খোঁটা দিল না, চাকরি নিয়ে কিছু বলছে
না। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগছে।
পিসির সঙ্গে কথাবার্তা
বলছি টুকটাক। চুমকি ঘরে এল। হাতে একটা
সুন্দর বাক্স। চুমকি কসমেটিকস এর ব্যাবসা করছে, সঙ্গে জাঙ্ক জুয়েলারি। দেখাতে
শুরু করে দিল। দেখলেই যে নিতে হবে এমন কোনও ব্যাপার নেই সেটা ও আগেই বলেছে।
তবু দেখতে দেখতে লোভ তো এসেই যায়। সাজতে তো ভালোই লাগে। নিয়েই ফেললাম
বেশ কিছু। চুমকি একটা ডায়েরিতে লিখে ফেলল হিসেব। কাবেরীও এসে
বসেছে কুর্তি আর সালোয়ার-এর পিস নিয়ে। কী করবে, আজকাল তো চাকরির
বাজার মন্দা। তাই ঘরে বসে বা অন লাইনে বিজনেস করছে অনেকেই। কয়েকটা
কিনতে হল। কাবেরী আর চুমকি খুব ওস্তাদ সেলস-এর কাজে। বুনুপিসিও দেখছি কী সব কৌটো
খুলছে। ট্যাপারওয়ার নাকি কী ছাই একটা নাম বলল। মায়ের জন্য কয়েকটা কিনলাম। জিনিসপত্র
দেখছি আর দিব্যি আড্ডা চলছে। আমার আবার শপিং মল-এ বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। বেশি
জিনিস একসঙ্গে দেখলে সিলেক্ট করতে অসুবিধা হয় যে কোনটা নেব। কিন্তু এটা তো বুনুপিসির
বাড়ি। শপিং মল তো নয়। কী সব উলটোপালটা ভাবছি!
দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। বাঘাকাকার
জায়গা বেছে বেছে আমার পাশেই করেছে চুমকি। ভীষণ উন্নাসিক মানুষ এই বাঘাকাকা। বাঘা
এর নাম নয়, কিন্তু এই নাম আমিই দিয়েছি। আমাকে দেখলেই গর্জন করে। এই
একটু আধটু লিখি বলে কী তুচ্ছ তাচ্ছিল্যটাই না করে আমাকে। আমার নাকি একটা লেখাও
ভালো নয়। কোনোভাবে দয়া দাক্ষিণ্য করেই
সম্পাদকরা আমার লেখা ছাপেন। এই তার অভিমত। আবার এই কথাগুলোই বলবে মনে করে একটু
বিমর্ষ হলাম। এই তোর এতগুলো জিনিস কিনলাম আর এই তার প্রতিদান! চুমকির গলাটা
টিপে দিতে পারলে ভালো হত। ইস, ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন
খাওয়ার আনন্দ মাঠে মারা গেল।
বাঘাকাকা আমার লেখা
নিয়ে কিছু বলল না দেখে ভালো লাগল। মানুষের তো পরিবর্তন হয়।
নিশ্চয় অনেক নরম হয়েছে এখন। বয়স তো হচ্ছে। কিন্তু ভুল ভাঙল অচিরেই। বাঘাকাকা এখন
অবসর নিয়ে পলিসি করছে। সেই পলিসি সংক্রান্ত কথাই আমাকে বোঝাতে শুরু করল।
ফ্রায়েড রাইস না ঘাস খেলাম কিছুই বুঝলাম না। চিলিচিকেনও মাটি। বাঘাকাকার বাঘাটে
গলায় পলিসির নিয়ম কানুন শুনতে শুনতে কখন খাওয়া শেষ। কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে
ভাবছিলাম এবার কাটব। বুবুনের সঙ্গে আর দেখা হল না। ওর জন্য গল্পের
বই কিনেছিলাম। সেটা কাবেরীর হাতে দিয়েছি। বাঘাকাকা এখন আমাকে ছেড়ে চুমকির
হাজব্যান্ডকে নিয়ে পড়েছে। আমার ভগ্নিপতিটিও নিরীহ কেউ নয়। একটু আগে
রেইকি নিয়ে একগাদা লেকচার দিল। আমার মাথায় কিছুই ঢুকল না। কাবেরী আসরে প্রবেশ করল
নিজের মায়ের হাত ধরে। আদুরে গলায় ঘোষণা করল, মা কিছু বলতে চাইছে,
প্লিজ তোমরা শোনো সবাই। কাকিমা কোনও ভূমিকা না করেই বললেন, আমি কিছুদিন হল একটা
ব্যাবসার কাজ শুরু করেছি। আসলে বাড়িতে একা একা আর ভালো লাগছিল না। তোমরা
একটু সহযোগিতা করো। নিজের থলে থেকে ধুপ, ধুনুচি, মোমবাতি, ছোটো ছোটো ধুনোর
প্যাকেট, নকল ফুল, ছোটো ছোটো মঙ্গল ঘট, আরতির স্ট্যান্ড, বাতাসা, মিছরির কৌটো বার করতে
শুরু করলেন।
তারপর কী হল? আমার শরীর
খারাপ করল। বুনুপিসি ছুটে এল। কেউ এক
গ্লাস জল এগিয়ে দিল, কেউ হাওয়া করতে লাগল। আমি বললাম, একটু রেস্ট নিলেই ঠিক
হয়ে যাব। বুনুপিসির থেকে চাবি নিয়ে সোজা সেই
ভূতের বাড়িতে। আমি যে ঘরে বসলাম, একটা ভাঙ্গা চেয়ার ছাড়া কিছু ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ
পরেই দেখি সুন্দর একটা বিছানা। আর তাতে বসে আছে একটা কালো রঙের ছায়া। আমি ভয়েই উলটে যাচ্ছিলাম চেয়ার
সমেত। ভূত বলল, একদম ভয় নেই। আমি ভূত হলেও কাউকে জ্বালাই না। তুমি বিছানায়
রেস্ট নাও।
“আপনি এখানে কেন আছেন!” কোনোভাবে জিজ্ঞাসা করি।
“আমি তোমার পিসির শাশুড়ি। কিছুদিন
হল ভূত হয়েচি। আগে ওই বাড়িতেই থাকতাম। তবে এখন আর থাকি না।
আমার মনে পড়ে গেল
পিসির শাশুড়িকে আমি দিদা বলতাম। খুব ভালোবাসতেন আমায়। বাণ্টিদার বিয়ের পর
মারা যান। জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন?”
“আর বলিস না। সারাদিন গোলমাল
চলে। নিরিবিলিতে ঠাকুরের নাম করার উপায় নেই। কাবেরীর মা আবার দশকর্মার
জিনিস নিয়ে আমাকে বিক্রি করতে এসেছে। এদিকে আমি তখন ছাদে কাপড় শুকানোর
দড়িতে বসে দোল খাচ্ছিলাম। বলছে মাসিমা আপনি তো ঠাকুর দেবতা ভালোবাসেন। আমার থেকে ক’টা জিনিস কিনুন না।
ব্যস! আমি আর নেই। হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেলাম। তারপর থেকে পুরানো
বাড়িতেই থাকি। কাবেরীও কুর্তি টপ গছানোর চেষ্টা করেছে। এই বয়সে এসব পড়ে কেউ! আর
তোর পিসির ওই ডেঞ্জারাস ভাই! একদিন জিজ্ঞাসা করছে মরার পরও পলিসি করব কিনা! ওকে বেশ
করে জলবিছুটি দিলে ভালো হয়।”
“হ্যাঁ দিদু। কী সাঙ্ঘাতিক ফ্যামিলি!
আমারও হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
“দূর পাগলি। একটু বিশ্রাম
কর। খুব ধকল গেছে তোর।”
দিদুকে
জড়িয়ে ধরতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না। শুধু একঝলক ঠান্ডা হাওয়া আমায় ছুঁয়ে গেল।
_____
ছবিঃ শ্রীময়ী
Misti
ReplyDelete