
পূর্ণমিদং
[মূল গল্পঃ আর কে নারায়ণ-এর লেখা ‘সাচ পারফেকশন’]
অনুবাদঃ পার্থপ্রতিম মাইতি
_____
[মূল গল্পঃ আর কে নারায়ণ-এর লেখা ‘সাচ পারফেকশন’]
অনুবাদঃ পার্থপ্রতিম মাইতি
সোমের মনটা শান্তিতে ভরে গেল। তার পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রম শেষ হতে চলেছে। সারা জীবনে বহু মূর্তি গড়েছে সোম, কিন্তু এইবারের কাজটা তার নিজেরই অতুলনীয় লাগে। এমনকি নিজেকে শুনিয়ে অস্ফুটে একবার বলেও ফেলে, মহাপ্রলয়ে গোটা চরাচর ভেসে গেলেও তার হাতের গড়া এই নটরাজ নৃত্য করেই যাবেন।
সোম ছাড়া আর কেউ মূর্তিটি এখনও দেখেনি। সোম নিজেই কাউকে দেখতে দেয়নি। যাতে না কেউ উঁকিটিও মারতে পারে তাই দরজা-জানলা শক্ত করে এঁটে তবে সে কাজে বসে।
গরমে ঘেমেনেয়ে একসা হলেও বিরক্ত হয় না। হাজার হোক, তার এতদিনের তীব্র মনোযোগের ফল এবার ফলবে। হাতের চেটোয় কপালের ঘাম মুছে ফেলে পরম সন্তুষ্টির সঙ্গে নিজের হাতের কাজ নিরীক্ষণ করতে থাকে সোম। মূর্তির আভিজাত্য তাকে বিস্ময়ে ভরিয়ে তোলে।
ভক্তি আর ভয়ে হাঁটু মুড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে পড়ে, “হে নটরাজ, পাঁচ বছর ধরে সব কাজ ফেলে শুধু তোমায় গড়েছি। আমাদের গ্রামের মন্দিরে তুমি অধিষ্ঠান হও, তোমার কৃপার অধিকারী হোক সকল প্রাণ।”
মাটির প্রদীপের নিভু নিভু আলোয় নিজের হাতে গড়া মূর্তিটিকে নিজেই চিনতে পারে না সোম। আধো আলো-অন্ধকারে ছায়ায় মায়ায় সেটি যেন প্রাণ পেয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তা দেখে ভাস্কর বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে সৃষ্টির সামনে।
কোথা থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে – “বাবা, এই মূর্তি তুমি ঘরের বাইরে কোরো না, মূর্তি বড়ো নিখুঁত।”
সোম চমকে ওঠে, ঘুরে দেখে, ঘরের এককোণে যেখানে প্রদীপের আলো পৌঁছতে পারেনি সেখানে অনেকটা আঁধার জমে আছে৷ সেখানেই লুকিয়ে ছিল লোকটা।
সোম এক লাফে লোকটার ঘাড় চেপে ধরল, “তোমার এখানে কী?”
লোকটা কুঁকড়ে গেল, বলল, “আমি তোমার খুব সুখ্যাতি করি বাবা, তোমার কাজ বড়ো ভালো। আজ পাঁচ বচ্ছর ধরে…”
“ঘরের ভেতর ঢুকলে কী করে?”
“তুমি যখন বাইরে খাবার খেতে গেছিলে তখন অন্য একটা চাবি লাগিয়ে…”
সোম রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠল, “তোমাকে এখানেই ঠাকুরের বলি করে দিই?”
“তোমার ইচ্ছা বাবা,” লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “তাতে যদি তোমার সাহায্যে লাগি... তবে, আমার সন্দেহ আছে। বলি দিলেও তুমি ও মূর্তি বের করতে পারবে কি? বড়ো নিখুঁত! এ মানুষের জন্য নয়।”
সোম হঠাৎ যেন ভেঙে পড়ল, “ওভাবে বোলো না। আমার এত পরিশ্রম সব ওই জন্য, মূর্তিতে যেন এতটুকুও খুঁত না থাকে। এ মূর্তি আমার দেশের লোকের জন্য। মূর্তির ভেতর দিয়ে স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের কাছে আসবেন। তাঁকে আসতেই হবে। তুমি অমন বোলো না।”
লোকটি কিন্তু সবাইকে জানিয়ে দিল আর সোমের সব লুকোছাপা প্রকাশ পেয়ে গেল। গ্রামের সব মানুষের মনে একটা অজানা ভয় এসে জাঁকিয়ে বসল।
পাঁজি থেকে সামনে একটি শুভযোগ দেখে সোম গ্রামের বড়োমন্দিরের পুরুতঠাকুরের কাছে গেল। বলল, “আসছে পূর্ণিমার দিন বড়ো শুভদিন। ওই দিন আমার গড়া নটরাজের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়ে দিন পুরুতঠাকুর। এই বড়োমন্দিরেই পুজো হোক।”
ব্রাহ্মণ কী একটা ভেবে বললেন, “তার আগে মূর্তিটি আমাকে দেখাও।”
সোম তাঁকে ঘরে নিয়ে গেল। মূর্তি দেখে ব্রাহ্মণ একই কথা বললেন, “এমন আশ্চর্য সৃষ্টি, এই নিখুঁত মূর্তি, এ মানুষের জন্য নয়। ঈশ্বর আমাদের অন্ধ করে দেবেন। পুজোর মন্ত্র পড়লেই নটরাজ নৃত্য শুরু করবে... আর… মহাপ্রলয়ে মনুষ্যজাতি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে।”
সোমের মুখটি কালো হয়ে যায়। তা দেখে ব্রাহ্মণ আরও বললেন, “এক কাজ করতে পারো, নোড়া দিয়ে মূর্তির পায়ের গোড়ালি বা হাতের আঙুলটা অল্প একটু ভেঙে দাও। তাহলে আর কোনও বাধা থাকবে না।”
সোম সক্রোধে বলে তার আগে সে পুরুতমশাইয়ের মাথার খুলিটা ভাঙবে। তখন ব্রাহ্মণ কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন।
একটু পরেই গ্রামের ভদ্রলোকের দল সোমের ঘরে এল। “আমাদের ভুল বুঝো না সোম,” তারা বলে, “তোমার ও মূর্তির জায়গা বড়োমন্দিরে হবে না। আমাদের সব মানুষের আপদ বিপদের কথা ভাবতে হয়। তবে, এখনও যদি বল যে, মূর্তিতে একটু খুঁত করে দিতে রাজি আছ…”
সোম চিৎকার করে বলল, “বেরিয়ে যান সবাই, আমার ঘর থেকে। আপনাদের মন্দির আমি থোড়াই পরোয়া করি। আমি নটরাজের জন্য আলাদা মন্দির করব। সেই মন্দির পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মন্দির হবে, আপনারা তখন দেখবেন।”
পরের দিন ঘরের একদিকের দেয়াল ধসিয়ে দিল সোম। রাস্তা পর্যন্ত একটা ফটক তুলে দিল। তারপর রামকে ডাকল, যে রামের ঘোড়ার গাড়ি আছে; তাকে বলল, “তোকে একটা রুপোর টাকা দেব। আশেপাশের সব গাঁয়ে ঢেঁড়া দিয়ে আয় যে সামনের পূর্ণিমায় নটরাজের অধিবাস। যদি ভালো লোক হয়, একটা নবাবগঞ্জের শাল পাবি।”
পূর্ণিমার দিন চাঁদ উঠতে না উঠতেই সোমের ঘরের পাশে লোক ভেঙে পড়ল। কাচ্চা-বাচ্চা, মেয়ে-মদ্দ, বুড়ো-বুড়ি কেউ বাদ নেই। রাস্তার ধারে রসুইয়ের ভিয়েন বসে গেল, খেলনা বিক্রেতা আর ফুলওয়ালীরা চেঁচিয়ে লোক ডাকতে লাগল। চারদিকে একটা উৎসব উৎসব গন্ধ। বাঁশির শব্দ, শিশুর খুশির হাসি, একটু পরেই চারদিকে গলা রূপো ছড়িয়ে গোল থালার মতো উঠল পূর্ণিমার চাঁদ।
দুনিয়ার কেউ কোনোদিন রাতের আকাশে অত বড়ো চাঁদ দেখেনি।
মূর্তির ওপর ঢাকা পর্দাটা সরানো হল, সুগন্ধি কর্পূর জ্বালানো হল, বেজে উঠল তামার বড়ো ঘন্টা।
টুঁ শব্দটুকুও কোত্থাও নেই। সবার চোখ মূর্তির ওপর।
পোড়া কর্পূরের উজ্জ্বল ধোঁয়ায় নটরাজের চোখ জ্বলে উঠেছে; তাঁর হাত-পা যেন নড়ছে, পায়ে নুপূর-নিক্কন শোনা যাচ্ছে। লোক চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে।
নটরাজ এক পা রাখলেন ভূমিতে, অন্য পা নৃত্যের ভঙ্গিমায় তুললেন। তিনি পদদোলায় মহাবিশ্ব ধ্বংস করেন, ধ্বংসস্তূপের পোড়া ছাই মাখেন বুকে; ডুগ ডুগ ডুগডুগি বাজান আর তারই ছন্দে আবার ছাই ফুঁড়ে মাথা তোলে জীবন - তাঁর সৃষ্টি, তাঁরই বিনাশ। জীবনের অর্থ, ঈশ্বর সত্য। মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে যেন পাথর হয়ে যাওয়া ভিড়ের লোকজন নতুনভাবে উপলব্ধি করে। তা যেন এতদিন ভুলে গিয়েছিল তারা।
পুব আকাশে একটা হাওয়া বয়ে গেল। চাঁদের আলো যেন হঠাৎ করে ফুরিয়ে গেল। হাওয়া বাড়তে লাগল, কালো মেঘ জমা হতে লাগল আকাশে। বাজ পড়ে একটা খড়ের গাদায় আগুন ধরে গেল। পুজো উপলক্ষে দশ গ্রামের লোক জড়ো হয়েছিল, তারা এবার আতঙ্কিত হয়ে শুরু করল দৌড়। ভীষণ গর্জন করে কোথাও আরেকটা বাজ পড়ল। বাচ্চা আর তাদের মায়েরা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। সড় সড় করে একটা প্রাগৈতিহাসিক সাপের মতো বৃষ্টি নেমে এল, হিস হিস করে নিভে গেল বাজ পড়া আগুন। এমন বৃষ্টি হল যা আর কোনদিনও হয়নি। রাস্তার দু’দিকে দুটো বিল, বৃষ্টির জল উপচে তারা আজ এক হয়ে গেল। ঝড়ের চোটে গাছের ডাল আর মানুষের ঘর - দুই-ই পড়ো-পড়ো হল।
“আজ জগতের শেষ!” কার করুণ আর্তনাদ শোনা গেল।
পরের দিন সমানতালে বৃষ্টি আর ঝড় হতেই থাকল। সোম ঘরে মূর্তির সামনে বসে, কী ভাবনায় তার মাথা ঝুঁকে পড়েছে। ফুল আর মালা চারিদিকে ছড়ানো, বৃষ্টির জলে সেগুলো ভেজা। গ্রামের কিছু লোক জল ঝড় ডিঙিয়ে এসেছে, বসে বলল, “তুমি সন্তুষ্ট এবার?”
তারা জল্লাদের মতো তার ওপর ঝুঁকে এসেছে, “জানো কত লোক মরেছে? কত ঘর পড়েছে? ওই ঝড় কত লোককে উড়িয়ে নিয়ে গেছে? জানো?”
“না না, জানি না আমি, জানতেও চাই না,” চিৎকার করে বলেছে সোম, “চলে যাও, বোলো না আমাকে ওসব কথা।”
“ঈশ্বর তাঁর মহিমার একটুখানি দেখালেন। আর তাঁকে খেপিও না। কিছু করো। আমাদের জীবন তোমার হাতে। আমাদের বাঁচাও সোম, এই মূর্তি… খুব নিখুঁত!”
তারা চলে যাওয়ার পর সোম একই ভাবে বসে রইল। তাদের বলে যাওয়া কথারা তাকে ব্যথা দিচ্ছে।
“আমাদের জীবন তোমার হাতে।” তারা কী বলতে চাইছে সোম জানে। কান্না গড়িয়ে নামে তার দু-গাল বেয়ে।
‘কী করে… কী করে আমি এই মূর্তিতে খুঁত করব?... তার চেয়ে বরং দুনিয়াটা জ্বলে যাক, পুড়ে যাক... আমি পরোয়া করি না... আমি ও মূর্তি ছুঁতে পারব না।”
সোম একটা প্রদীপ জ্বালে, মূর্তির সামনে রাখে। দেখতে থাকে। দূরে আকাশে গম্ভীর গর্জন হয়।
‘ওই শুরু হল আবার… বেচারা মানুষ, দুর্বল মানুষ… সবাই মরবে… মরবে... তাও ভালো…’
সোম মূর্তির গোড়ালির দিকে তাকাল।
‘এই ছেনি-টা দিয়ে শুধু একটা টোকা, সব সমস্যার সমাধান।’
সোম দেখতেই থাকে। ‘কীভাবে… কেমন করে পারব আমি?’ বাইরে উন্মত্ত বাতাসের দাপাদাপি চলতে থাকে। অনেক লোক বাইরে জড়ো হয়, করুণ সুরে প্রার্থনা জানাতে থাকে।
সোম ঘরের বাইরে বেরোল। সে দেখল গ্রামের দুই বিল এখন যেন একটা সমুদ্র। পূর্ব আকাশে একটা বিরাট কালো ছায়া দানা পাকাচ্ছে।
‘যখন ওই মেঘটা এসে পৌঁছবে... মহাপ্রলয় শুরু হবে। হে নটরাজ! আমি তোমার মূর্তিতে খুঁত করতে পারি না... কিন্তু আমি নিজেকে তোমার কাছে উৎসর্গ করতে পারি। তুমি আমাকে নাও হে ঈশ্বর... আর… শান্ত হও…’
সে পায়ে পায়ে বিল যেখানে সমুদ্র হয়ে গিয়েছে সেদিকে এগোল। চোখ বন্ধ করল।
‘মৃত্যুর আগে যে শেষবারের মতো তোমাকে দেখতে চাই, নটরাজ।’ ঝড়-বাদলের বাধা সরিয়ে সে আবার ঘরে এল। বাতাসের শীৎকার, বড়ো বড়ো বৃক্ষের সে কী আছাড়ি-পিছাড়ি। মানুষ-পশুর বাঁচার সে কী আকুতি।
ঘরে ফিরে দেখল একটা গাছ পড়ে আছে চালের ওপর, তার ডালপালা ফুঁড়ে ঢুকে গিয়েছে ভেতরে।
‘নটরাজ!’ সোম ছুটে ঘরে ঢোকে। প্রদীপ গেছে নিভে, ঘর অন্ধকার৷ ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে অল্প ঢুকছে আলো।
টালির কানা লেগে মূর্তির গোড়ালির নিচ-টা ভেঙে দূরে ছিটকে পড়ে রয়েছে।
‘ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করতে নিজের মূর্তিতে এই লীলা করলেন। তাঁর জয় হোক!’ সবাই সমস্বরে বলল।
মূর্তিটি মহা-আড়ম্বরে পরের পূর্ণিমায় গ্রামের মন্দিরে অধিষ্ঠিত করা হল। আবার ভেঙে পড়ল দশ গ্রামের লোক। মেলা বসল। শিশুর খুশির হাসি শোনা গেল। ফুলওয়ালীরা লোক ডাকতে লাগল।
শুধু সোম-কে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
তার সৃষ্টি যেদিন স্বীকৃতি পেল, শ্রেষ্ঠ ভাস্কর সেদিন গ্রাম ছেড়ে চলে গেল।
ছবিঃ লাবণি চ্যাটার্জি
খুব ভালো অনুবাদ।
ReplyDeleteOnek Dhonnobad ☺
ReplyDelete