
আংটি রহস্য
হিমি মিত্র রায়
পরিবারের সকলে মিলে হঠাৎ ছুটি পেয়ে পুরী যাওয়া
ঠিক হল। প্রস্তাবটা রেখেছিল ছোটো কাকাই।
“কী বলিস রেয়া এ্যান্ড টিম?”
‘রেয়া এ্যান্ড টিম’
অর্থাৎ রেয়া নিজে, ওর ভালো নাম লহমা বসু, আর ওর দুই কাকাতো বোন চেরি, মিষ্টি আর
সবচেয়ে ছোটো ভাই রিকি। ওটা একটা পুচকে যদিও, কিন্তু খুব পাকা। রেয়াদের শাসন করে এখনই। বয়সে ছোটো হলেও রেয়াও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং প্র্যাকটিক্যাল। ক্লাস
এইটে পড়ে। কিন্তু ইতিমধ্যে গোপালপুরে গিয়ে একটা দারুণ রহস্যের সমাধান করেছে। ছোটো কাকাই ওই জন্য রেয়ার কাছে জানতে চাইল যে ও কী চায়।
“ছোটো কাকাই, আমরা প্রত্যেকেই
সমুদ্র দেখতে চাই কারণ আমরা পাহাড়ের কাছেই থাকি। চাইলেই পাহাড়ে চলে যেতে পারি।
কিন্তু সমুদ্রে তো আর সব সময়
যেতে পারি না। তাই না? তাই একবার যখন ভেবে ফেলেছি তখন যাই না সবাই মিলে, দারুণ সময়ও কাটাব!”
মিষ্টিরাও হাত তুলল যে ওরাও পুরীতে যেতে চায়।
ছোটো মা, মা বাপি প্রত্যেকে রাজি হল এই প্রস্তাবে। ঠাকুমাকেও রেয়ারা
একটু আদর করে নিজেদের টিমে নিয়ে নিল, ব্যস!
হোটেলের ওয়েবসাইট থেকে সমস্ত বুকিং করে ফেলেছিল
ছোটো কাকাই। তাই জন্য সবকিছু
খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে
হয়নি। আর পুরীতে পৌঁছে প্রথম যখন সমুদ্র দেখল ওরা, ড্রাইভার আঙ্কেল চমকে গিয়েছিল ওদের চিৎকারে, এমন লাফিয়ে উঠেছিল সবাই মিলে! ঢেউয়ের শব্দ কানে এসে লাগল। কী যে
আনন্দ হল বলে বোঝান যাবে না। বেশি টুরিস্ট এখন হবে না তার কারণ অল্প অল্প গরম পড়েছে।
ওরা ঠিক করে এসেছে যে অন্য কোথাও ঘুরতে যাবে না। শুধুমাত্র সমুদ্রেই স্নান করবে।
হোটেলে পৌঁছে ওরা ফ্রেশ হয়ে নিল প্রত্যেকে। কতক্ষণে
সমুদ্রে যাবে এখন! রেয়ার মা'তো বকাঝকা শুরু করে দিল।
“বেশি দূরে কোথাও যাবি না কিন্তু, সামনাসামনি
থাকবি।”
“কোনও
চিন্তা কোরো না মা, ছোটো কাকাই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে।”
“যাও, কিন্তু কাকাই-এর সঙ্গে সঙ্গেই থাকবে। সমুদ্রের ভেতরে
কিন্তু বেশি দূর যাবে না আমরা না যাওয়া পর্যন্ত।”
“এই যে শুরু হয়ে গেল। তোমার মনে নেই
মা, আমরা একা একা গোপালপুর এসেছিলাম তিন
বন্ধু মিলে! আমরা কি খারাপ কিছু করেছি?”
“জানি রে, তবুও মা হয়েছি এটুকু তো বলবই। সাবধানে সব কিছু, বেশি সাহস দেখাতে যেও না যেন।”
ঘূর্ণিঝড় ফনির প্রভাব এখনও খুব
ভালোভাবে রয়ে গেছে পুরীতে। ওদের
হোটেলের আশেপাশে কাজু বাদামের গাছের জঙ্গল। একজন লোকাল লোকের সঙ্গে কথা বলছিল
কাকাই। সে বলল কয়েক হাজার কুইন্টাল কাজু নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নতুন করে হতে বহুদিন
লাগবে।
রেয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল এইসব দেখে আর শুনে।
কত গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বলার
নয়। মানুষ যদি প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে একে ভালোবাসত তবে প্রকৃতিও মানুষের কম
ক্ষতি করত। এসব ভাবতে ভাবতেই মিষ্টুদের চিৎকার শুনতে পায় ও।
“কী রে দিদিভাই!! পাড়ে দাঁড়িয়েই থাকবি? ভয়
পাচ্ছিস নাকি??”
সবাই ওকে দেখে হাসছে আর স্নান করছে। রিকি
বালির ক্যাসল বানাচ্ছে মন দিয়ে, আর ঢেউ
এসে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে ওদেরই হোটেল বা অন্য হোটেলের অনেক মহিলা বাচ্চা
পুরুষ মহা আনন্দে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করছে। আর ছবিও উঠছে নানান রকম পোজে।
“কী রে!! নামছিস না যে! আয় এদিকে!”
“ছোটকা, দিদিভাই ভেবেছে এখানে কোনও রহস্য
সমাধান করবে!”
চেরি ঢেউয়ের ওপর একটা লাফ দিতে দিতে কথাগুলো বলে
খুব আনন্দ পেল।
রেয়া অবশ্য স্নান করতেই এসেছে। কী জানি কেন হঠাৎ মনে হল একটু পাড়ে
হাঁটাহাঁটি করতে ভালো লাগছে। আসলে পরিবেশটা অন্যরকম তো, ভিড়ভাট্টা নেই, অল্প লোক। কিছুটা হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে রেয়া। ছোটো কাকাই দূর
থেকে হাত নাড়িয়ে বলছে যে ওদিকে আর যেতে না, ওখানে থেকে ফিরে আসতে।
ঢেউয়ের চলে আসা ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে পা ভিজে
যাচ্ছিল। কিন্তু ওটা কী!! ছোট্ট একটা
জিনিস চকচক করছে আবার জলে ঢুকে যাচ্ছে! যতবার দেখতে যায় ততবার ওটা ডুবে যাচ্ছে। হাতে নিয়ে দেখতে গিয়ে আবার ঢেউ টেনে
নিয়ে চলে গেল জলে। কিন্তু সমুদ্র তো, একবার যা নেয় সেটা অবশ্যই ফিরিয়ে দেয়। ও দাঁড়িয়ে থাকল ওটা কী দেখার জন্য।
একটু নিচু হতেই আবার ঢেউ এসে ওর হাতের কাছে এনে
দিল ওটা। হাতে তুলে নিয়ে সামনে থেকে দেখে একটা আংটি, তার মধ্যে ‘এস. কে’
মিনে করা। বিয়ের আংটি যেমন হয় বরের, তেমনি সোনার আংটি। ইমিটেশনের হতে পারত,
কিন্তু ইমিটেশনের আংটিতে এরকম মিনে করা নামের অক্ষর খোদাই
করা কী থাকবে? ইমিটেশন হলে তো জলে থাকতে থাকতে রং পালটে যেত। এটা তো তা হয়নি, চকচক করছে এখনও।
আংটিটা ওর প্যান্টের পকেটে যত্ন করে রেখে দিল
রেয়া।
হোটেলে ফিরে এসে চান করার সময় পকেটে হাত দিয়ে
দেখল, হ্যাঁ আংটিটা আছে। এবার এর ব্যবস্থা
করতে হবে। থানায় গিয়ে জমা দিয়ে আসতে হবে এই মূল্যবান আংটি। দুপুরবেলায় ডাইনিং রুমে
খেতে এল ওরা সবাই। পেটপুরে খেল ওরা। রান্নাগুলো অপূর্ব হয়েছিল। খাবার পর প্রত্যেকে
একটা করে আইসক্রিম নিল।
অন্যান্য যারা আছেন তারা এসময় খেতে এসেছেন। বেশ
ভালোই ভিড়। এদেরই অনেক জনকে আজকে সমুদ্রের ধারে দেখেছে ও। ওই মেরুন রঙের
হাফপ্যান্ট পরা লোকটা, সঙ্গে স্কার্ট আর পিঙ্ক হ্যাট পড়া ভদ্রমহিলা আর তাদের একটা ছোট্ট বাচ্চা। আর
একটা বড়ো ফ্যামিলি যাতে একটাও বাচ্চা
নেই।
হঠাৎ কিছু একটা দেখে আইসক্রিম খাওয়া ফেলে চেয়ার
থেকে উঠে অন্যদিকে এগিয়ে গেল রেয়া। সবাই তো চেঁচিয়ে উঠল!
“দাঁড়াও আসছি,”
বলে এগিয়ে গেল ও। গিয়ে দাঁড়াল ওদের টেবিলের পাশের টেবিলেই
বসা একটা ফ্যামিলির সামনে। একজন পুরুষ
একজন মহিলা বসে রয়েছেন। অল্প বয়সি, নতুন বিয়ে হয়েছে বোঝা যাচ্ছে।
ছোটো কাকাই রেয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছেন তিনি।
রেয়া বলছে, “আপনি কি আজ দুপুরে সমুদ্রে গিয়েছিলেন?”
লোকটি বলল, “হ্যাঁ, আমি তো এখানে তিন দিন ধরে রয়েছি। আজও গিয়েছি। কেন?”
“আপনার নামটা কি জানতে পারি?”
“নাম? কারণটা কী বলবে? তুমি অনেক ছোটো, তাই তোমাকে ‘তুমি’
বললাম।”
“আপনার নাম জানাটা ভীষণ দরকার। আচ্ছা আপনার কি কোনও
জিনিস হারিয়েছে?”
ভদ্রলোকের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে
উত্তেজিত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ,
আমার তো একটা আংটি হারিয়েছে! বিয়ের আংটি! তুমি কী করে জানলে?”
ছোটো কাকাই কিছুই
বুঝতে পারছে না।
“আপনার নামটা একবার শুনলে আংটিটা আপনাকে
দিয়ে দেব।”
“সুমন কল্যাণ রায়। আমার আংটির উপরে
এস. কে লেখা রয়েছে।”
পকেট থেকে আংটিটা বার করে ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিয়ে একগাল হাসল রেয়া।
ভদ্রলোকের স্ত্রীর মুখেও আনন্দ। বলেই ফেললেন, “এতটুকু মেয়ে তুমি, কী করে বুঝলে যে ওই আংটি হারিয়েছে?”
রেয়া একটু হেসে বলল, “আমাদের হোটেলের যারা আছেন তারাই ওই সমুদ্রে স্নান করতে গিয়েছিলেন। কারণ এটা
হোটেলের নিজস্ব বিচ। ফলে এখানকারই কারও আংটি হারিয়েছে সেটা হওয়ার চান্স ছিল। আরও বুঝলাম,
কারণ লক্ষ করলাম সুমনবাবুর হাতের আঙ্গুলের একটা জায়গায়
সাদা হয়ে দাগ হয়ে রয়েছে। সমুদ্রে দু-একদিন চান করলে
আমাদের স্কিন-টোন পুড়ে যায়। শুধু আংটির জায়গাটুকু
দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে ওখানে আংটি পরেছিলেন। আর নামের আদ্যক্ষর জেনে জিজ্ঞেস
করে নিলাম কী নাম! ব্যস! হয়ে গেল, প্রমাণ পেয়ে গেলাম।”
সবাই প্রচন্ড অবাক। সুমনবাবু বললেন, “অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার বুদ্ধির
তারিফ না করে পারছি না। এইটুকু মেয়ে হয়ে কীভাবে বুঝে গেলে এত কিছু? কী নাম তোমার?”
“লহমা বসু।”
পেছন থেকে ছোটো কাকাই এসে রেয়াকে জড়িয়ে ধরল।
“একবারও বললি না আংটি পেয়েছিস! চুপ করে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছিস!”
“তোমাদের বলতাম,
তার আগেই এই ঘটনা ঘটে গেল। উনিও আংটি পেয়ে
গেলেন!”
টেবিলে এসে দেখে রেয়ার আইসক্রিম গলে ঝোল হয়ে
গেছে। ছোটো কাকাই বড়ো মুখ করে বলল, “রেয়া এখন আর একটা আইসক্রিম খাবে। ওর যেটা ইচ্ছে সেটা! প্রাউড অফ ইউ! তুই এভাবেই এগিয়ে চল, একদিন তুই অনেক বড়ো জায়গায় যাবি।”
দাঁত টিপে একটু হাসল রেয়া। আর বাকিরা দর্শক হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।।

_____
ছবিঃ রাজা আক্তার
No comments:
Post a Comment