
চোর
অদিতি সরকার
অদিতি সরকার
সেই তখন থেকে গালে হাত দিয়ে
চুপচাপ ব্যালকনিতে বসে ছিল টুকটুকি। ঘরের ভেতরে সক্কাল থেকে যা চলছে, চুপচাপ রকিকে
নিয়ে সরে পড়েছে সে তাই। কিন্তু ব্যাপারটা যে কী করে কী হল এতক্ষণ ধরে ভেবে ভেবেও
কোনও কূলকিনারা পাচ্ছিল না টুকটুকি। চুপি চুপি রকিকেও দু-চারবার জিজ্ঞেস করেছিল
সে, কিন্তু যথারীতি ছুঁচলো কানের ডগাদুটো কয়েকবার ওপরনিচ করা আর ফোলা ফোলা
সাদাকালো লেজটা টুকটুক নাড়ানো ছাড়া আর বিশেষ কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি সেখান থেকে।
ঠামি ওদিকে এখন সব ছেড়ে
বাণীদিদিকে নিয়ে পড়েছেন।
“আস্ত
জিনিসটা তো হাওয়ায় উবে যেতে পারে না বাণী। টুকটুকি বলছে সে দেখেইনি, বউমা বলছে ভুল
করে বাথরুমের জানালায় রেখে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু আমি বলতেই তার মনে পড়ে গিয়েছিল, অথচ
তক্ষুনি ফিরে গিয়ে আর পায়নি। তুমি যদি না নিয়ে থাক তাহলে বাকি রইল আমার ছেলে আর
আমি। তাহলে
কি আমাদের দুজনের মধ্যেই কেউ বউমার জিনিসটা নিয়েছি?
তাই বলছ তুমি?”
বাণীদিদি ফোঁপাচ্ছিল। খুব
খারাপ লাগছিল শুনতে টুকটুকির। কেন যে ঠামি এমন বিচ্ছিরি করে কথা বলছে বাণীদিদির
সঙ্গে। অথচ নিজের সব উলটোপালটা কাজে এই বাণীদিদিকেই লাগে ঠামির। সে বাবাকে লুকিয়ে একশোবিশ
জর্দা আনানোই হোক, আর অমাবস্যা পূর্ণিমায় হাঁটুতে ঘষে ঘষে ব্যথার মলম লাগিয়ে
দেওয়াই হোক। আজ পর্যন্ত একবারও কিন্তু বাণীদিদিকে আপত্তি করতে শোনেনি টুকটুকি।
“আমি
বউদির হার নিইনি মাসিমা। এত বছর এ বাড়িতে কাজ করছি, একটা কুটো কোনোদিন এদিক থেকে
ওদিক হতে দেখেছেন?”
“এতদিন
দেখিনি বলেই যে আজ দেখব না, এমনও তো কোনো কথা নেই বাপু। মানুষের মন বলে কথা, পালটে
যেতে কতক্ষণ? রোজ দেখছ না টিভিতে?”
ঠামির গলাটা কেমন যেন অচেনা লাগে শুনতে।
“কেঁদো
না বাণী, চোখ মোছো। হার তুমি নাওনি, আমি জানি। আমারই মনে হয় কিছু একটা ভুল হচ্ছে
কোথাও। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভাবতে দাও, ঠিক মনে পড়ে যাবে।” এটা মার গলার আওয়াজ। নরম, ঠাণ্ডা।
“আর
লাই দিও না বউমা। ওই করেই মাথায় চড়িয়েছ, এখন তার ফলটিও হাতে নাতে পাচ্ছ।” ঠাকুমা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।
“না
মা, আমায় মেরে ফেললেও আমি বাণীকে চোর ভাবতে পারব না। আপনিও ওর সম্বন্ধে অমন কথা আর
মুখে না আনলেই ভালো। মনে না আনলে তো সবচেয়ে ভালো।” মা
খুব শান্ত গলায় উত্তর দিল।
ঠামি বোধহয় মার কাছ থেকে এরকম
উত্তর আশা করেননি। কখনও ঠামির মুখে মুখে জবাব দেয় না তো মা। সে যত কড়া কথাই হোক। চুপ
করে থাকে নইলে সামনে থেকে সরে যায়। আজই হঠাৎ একটু অন্যরকম হল। ঠামি কীরকম হকচকিয়ে
গিয়ে বিড়বিড় করতে করতে চুপ করে গেলেন।
“বউদি,
চান করার সময় তোমার হাত লেগে নিচে পড়ে-টড়ে যায়নি তো?
জানালা তো খোলাই ছিল।” বাণীদিদির ফোঁপানি থেমেছে, তবে গলা
এখনও ভার।
“না
বাণী, অত বেখেয়ালও ছিলাম না যে আস্ত একটা জিনিস পড়ে যাবে হাত লেগে আর আমি টেরও
পাব না। খুলে রাখা পর্যন্ত মনে করতে পারছি, তার পরে যে কী করলাম সেটাই তো কিছুতেই
মনে আনতে পারছি না। গলায় তো পরিনি, কিন্তু কী করলাম?
ঘরে নিয়ে এসেছিলাম কি? এলে কোথায় রাখলাম? ড্রেসিং টেবিলের ওপরে নেই। মানলাম আমার ভুলো মন, ধরো যদি
ভুলে আলমারিতে ঢুকিয়েও রেখে থাকি, তাও তো খুলে দেখেছি। নেই। গেল কোথায়?”
বাবা, ওইটুকু সরু একচিলতে
একটা হার, তাই নিয়ে সকাল থেকে কী হইচই, কী হইচই। নাকি মা চান করার সময় গলা থেকে
খুলে বাথরুমের জানলার ধাপিতে রেখেছিল, তারপর পরতে ভুলে গেছে। মনে পড়তেই আবার
বাথরুমে গিয়ে দেখে হার নেই। সেইটা সবাইকে বলার পর থেকেই যে মহাভারত শুরু হল, এখনও
চলছে।
বলা আর কী, দেখল তো প্রথমে
ঠামিই। মা তো খেয়ালও করেনি।
“ও
বউমা, গলা খালি কেন গো তোমার?”
মা ব্রেকফাস্ট দিচ্ছিল তখন
সবাইকে। এই সময়টা খুব তাড়াহুড়োয় কাটে মা’র। বাবার ডিম টোস্ট চা, ঠামির ফল ছানা,
টুকটুকির দুধ কর্নফ্লেক্স, সবাইকে আলাদা আলাদা বেড়ে বেড়ে দিতে হয় তো। বাণীদিদি
হাত লাগায় যদিও মা’র সঙ্গে, তবু একটা ছুটোছুটি লেগেই থাকে মা’র রান্নাঘর আর টেবিলের
মধ্যে। তাও তো আজ টুকটুকি আর মা দুজনেরই ছুটি, স্কুল যাওয়া নেই কারোই। নইলে তো
রীতিমতো ঝড় বয় সকালে এই সময় বাড়িতে।
ঠামির কথা শুনে চমকে প্রথমে
নিজের গলায় হাত দিল মা। তারপরেই লজ্জা লজ্জা হেসে ফেলল।
“ওহো,
স্নানের সময় খুলে রেখেছিলাম বাথরুমে, আর পরা হয়নি।”
“খুলতে
গেছিলেই বা কেন হঠাৎ?”
“মাথা
ঘষতে গিয়ে চুলে জড়িয়ে যাচ্ছিল যে,” মা আরও
হাসে, “যাচ্ছি এক্ষুনি মা, পরে নিচ্ছি। আপনাদের জলখাবারটা
দিয়েই যাচ্ছি।”
“জলখাবার
পালাচ্ছে না, তুমি আগে ওটা পরে এসো তো। বউ মানুষ গলা খালি রাখে না অমন। কিচ্ছু
মানো না বাবা তুমি,” ঠামি গজগজ করে।
মা মুচকি হেসে হাতের প্লেটটা
নামিয়ে রাখে।
বাথরুম থেকে বেরোতে কিন্তু
অনেক দেরি হয় মা’র। যখন এসে টেবিলের পাশে দাঁড়াল তখন সেই হাসিমুখ আর নেই। কেমন যেন
ছায়া নেমে এসেছে পুরো মুখ জুড়ে।
প্রথম চোট তো যথারীতি এসে
পড়ল টুকটুকির ওপর। সে বেচারি যত বলে আমি হার-ফার কিছু দেখিইনি, তো ফেলবই বা কোথায়
আর লুকোবই বা কেন, কে শোনে কার কথা। টুকটুকিও রেগেমেগে পড়ার টেবিলের ড্রয়ার,
পুতুলের বাক্স, রকির বিছানা-টিছানা খাবারের গামলা সব উলটে ফেলে দেখিয়ে দিয়েছে।
তাতে আবার এক প্রস্থ বাড়তি বকুনি জুটল, নাকি খুব মেজাজ হয়েছে টুকটুকির আজকাল।
এইটুকু বয়সে এত ভালো নয়। বড়ো হলে ভুগতে হবে, এই ওই তাই। মা এসবের মধ্যে চুপ করেই
ছিল অবশ্য। শুধু চোখ দিয়ে টুকটুকিকে একটু শাসন করে দিয়েছিল।
বাবা আর ঠামি মিলে মাকেও একটু
বকে নিল তারপর। এত ভুলো মন, দামি জিনিসের প্রতি কোনও মায়া নেই, মন কোথায় থাকে
হ্যান-ত্যান। সারাক্ষণ শুধু বইয়ে মুখ, অন্য কোনোদিকে খেয়াল নেই, বাড়ির বউয়ের অমন
আলাভোলা হলে চলে না, সব দিকে নজর রাখতে হয়, আরো কত কী।
এইসব দেখেশুনে সেই যে রকির
কলার ধরে টেনে ব্যালকনিতে পালিয়েছে টুকটুকি, ঝামেলা না থামলে আর তার ভেতরে যাওয়ার
ইচ্ছে-টিচ্ছে নেই।
তাদের আটতলার ব্যালকনি থেকে চারপাশটা
বেশ পরিষ্কার দেখা যায়।
মা রোজ ব্যালকনির কোনায় কোনায়
টবের আড়ালে আড়ালে ছোটো ছোটো সরায় করে পাখিদের জন্য দানা আর জল দিয়ে রাখে, সেই
খেতে সারাদিন কত যে চড়াই আর বুলবুলির আনাগোনা। রান্নাঘরের জানালায় তো রুটির টুকরো
খেতে কাকও এসে ডাকাডাকি করে রোজ সকালে। রকি প্রথম প্রথম খুব বকাবকি করত লাফিয়ে
ঝাঁপিয়ে। আজকাল দু’পক্ষেরই অভ্যেস হয়ে গেছে, কেউ কাউকে কিছু বলে না। চড়াই দানা
খায়, রকি থাবায় মুখ গুঁজে শুয়ে শুয়ে মিটমিট করে দেখে।
ছোটোবড়ো অনেক গাছও আছে তাদের
ফ্ল্যাটের চারদিকে। কয়েকটা তো লম্বা হতে হতে ব্যালকনির রেলিং ছুঁয়েই ফেলেছে প্রায়।
তাতেও আবার প্রতি বছর কতরকম পাখি বাসা বাঁধে। টুকটুকি মা পাখির ডিম পাড়া থেকে
শুরু করে সেই ডিম ফুটে ছানা বেরিয়ে উড়ে যাওয়া পর্যন্ত পুরোটা ব্যালকনিতে বসে বসেই
দিব্যি দেখতে পায়। এবারও দেখেছে কদমগাছের মোটা ডালের খাঁজে পাতিকাক বাসা বানাচ্ছে
ক’দিন ধরে। কাঠিকুটি ঠোঁটে নিয়ে কাক আর কাকের বউ সারাদিন শুধু আসছে আর যাচ্ছে। জোর
করে ঘরের ভেতরের চ্যাঁচামেচি থেকে কান সরিয়ে ওদিকেই চোখ ঘোরায় টুকটুকি।
কত কিছু যে এনে জুটিয়েছে কাক দুটো,
বাব্বাহ্! ওই তো বাসার ছিরি। এদিক দিয়ে ঝুলছে, ওদিক দিয়ে খসে পড়ছে। তার মধ্যে কী
নেই! খানিকটা নীল রঙের উলের টুকরো, প্লাস্টিক ছেঁড়া কয়েক ফালি, তুলোর দলা, একটা
স্টিলের চামচও যেন মনে হচ্ছে চকচক করছে ওরই মধ্যে।
টুকটুকির দৃষ্টিটা হঠাৎ
ধারালো হয়ে ওঠে।
ওটা কী? পাতলা সুতোর মতো, চকচকে হলুদ?
গ্রিলের আরও কাছে এগিয়ে যায়
টুকটুকি। ভালো করে দেখার জন্য রেলিঙের ফাঁকে মুখ গুঁজে দেয়।
এবং তারপরেই চ্যাঁচাতে
চ্যাঁচাতে বাড়ির ভেতর ছোটে ধুপধাপ।
মা রান্নাঘরে কাজ করছিল।
মুখটা এখনও ভার। কপালে চিন্তার ভাঁজ। বাণীদিদি সকালের বাসনপত্র ধুয়ে তুলছিল
জায়গামতো। টুকটুকির ওরকম ডাকাডাকিতে দু’জনেই চমকে তাকায়।
“কী
হল কি? বাড়ি মাথায় তুললি যে একেবারে।”
এই রে। ঠামিও বেরিয়ে এসেছে ঘর
থেকে। মেয়েদের জোরে কথা বলা, ছুটোছুটি ঠামির একেবারে অপছন্দ। টুকটুকির আবার ওগুলোই
স্বভাব।
“একবার
বাইরে এসো না,” হাঁফাতে হাঁফাতে বলে টুকটুকি।
“কী
আছে বাইরে? দেখছ তো কাজ করছি,” মা
একটু গম্ভীরভাবে তাকায় টুকটুকির দিকে।
“কাকের
বাসা।”
“কী
কাকের বাসা? এখন তোমার সঙ্গে পাগলামি করার সময় নেই আমার
টুকটুকি, পুরো রান্না বাকি এখনও,” মা সত্যি
সত্যি রেগে যাচ্ছে এবার।
“পাগলামি
না। হার। তোমার। দেখবে চলো।”
আর কিছু বলতে হল না। সব কাজ
ফেলে হুড়মুড়িয়ে তিনজনই ব্যালকনিতে দৌড়ল। মা, ঠামি, বাণীদিদি।
টুকটুকিও টুকটুক করে গেল পেছন
পেছন।
কদম ডালের ফাঁকে বাসাটা
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। তেরছা হয়ে রোদের একটা ফালি এসে পড়েছে ঠিক তার মধ্যে, আর
রোদ পড়ে ঝলমল করছে জড়িমড়ি হয়ে পড়ে থাকা পাতলা একটা চেন। সোনার।
“কী
চোর পাখি দেখেছ বউদি? তক্কে তক্কে ছিল গো। যেই না তুমি
ঘর ছেড়ে বেরিয়েছ অমনি এসে নিয়ে গেছে টুক করে,”
বাণীদিদি গালে হাত দিয়ে বলে।
মা অবাক হয়ে তাকিয়েই ছিল
বাসাটার দিকে। বাণীদির কথায় মুখ ঘোরায়।
“তাই
তো দেখছি। চকচকে জিনিসে ওদের খুব লোভ শুনেছিলাম। চামচ-টামচ নিয়ে যায়। তবে এ যে একেবারে
ঘরে ঢুকে এসে গয়না পর্যন্ত নিয়ে যাবে কে জানত। টুকু দেখেছিল তাই। এমনিতে তো চট করে
পাখিকে কেউ চোর বলে সন্দেহও করবে না।” কেন যেন একবার
ঠামির দিকে তাকায় মা।
ঠামি এতক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে
ছিল। এখন তাড়াতাড়ি ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে ঢুকে যায়। কারও চোখে চোখ না রেখে।
“কিন্তু
ওটা অত উঁচু গাছ থেকে পেড়ে আনবে কী করে, মা?”
“গেটে
একবার ফোন কর তো টুকাই। ইলেকট্রিকের লোককে ওদের সেই লম্বা মইটা নিয়ে আসতে বল। ডিম
পাড়েনি ওরা এখনও।
বাসায় হাত দিলে বিশেষ কিছু বলবে না বোধহয়। চলো গো বাণী, ওদিকে আবার সব ছড়িয়ে
ছিটিয়ে এসেছি।”
মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকে যায়
মা। মুখের মেঘটা আর নেই।
ছবিঃ লাবণি চ্যাটার্জি
ছিমছাম তরতরে গল্প।
ReplyDeleteমিষ্টি গল্প। খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteSweetie
ReplyDelete