
ছড়া পড়ে আনন্দ পায় না কে!
কিন্তু কেন এই ছড়া আমাদের মনকে মাতিয়ে তোলে, অবোধ শিশু অবধি ছড়ার তালে তালে
হাততালি দিয়ে দুলতে থাকে, তা নিয়ে আমরা পারতপক্ষে ভেবে দেখি কি? এই প্রশ্নের
উত্তরে বলা যায় ‘আম খাচ্ছ খাও, কষ্ট করে আঁটি গোনার কী দরকার?’ কিন্তু এটা নিয়ে
একটু ভেবে দেখলে ক্ষতি কী আর যদি তাতে আনন্দও পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে নতুন কিছু
শেখাও যায়!
পণ্ডিতেরা এই ছড়ার ছন্দ নিয়ে
বিস্তর গবেষণা করেছেন, সে-সব বলে আমি তোমাদের মোটেই এখানে ঘাবড়ে দিতে চাই না। শুধু
সহজ করে বলি, এই ছন্দ আমাদের বাংলাভাষার সঙ্গী সেই আদ্যিকাল থেকে – সে-ই সাধারণ
দিশি মানুষেরা এই ছন্দে গান গাইত, তাল দিত, এই ছন্দেই মিশে আছে লোকসংগীতের বাদ্যি
আর নাচের বোল। তাই তখনকার পড়াশুনো করা মানুষেরা এই ছন্দকে অত সমীহের চোখে দেখতেন
না, তাঁরা পদ্য লিখতেন প্রধানত পয়ার ছন্দে, যে ছন্দ তোমরা আজও শোন লক্ষ্মীর
পাঁচালি পড়া-তে। ছড়ার ছন্দকে সবার প্রথমে সম্মানের আসনে তুলে আনলেন রবীন্দ্রনাথ,
তিনি দেখালেন শুধু হালকা চালের ছেলেভোলানো কবিতা বা লোকসংগীতই নয়, এ-ছন্দে লেখা
যায় চমৎকার উঁচুদরের কবিতা। তাঁর ‘পলাতকা’ নামের কবিতার বইতে এই ছন্দে অপূর্ব ভাবের
কবিতা লিখে তখনকার পাঠকদের অবাক করে দিলেন তিনি।
এই ছড়ার ছন্দ নিয়ে খুব তলিয়ে
আলোচনা করেছেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যাঁকে বলা হত ছন্দের জাদুকর। তাঁর ‘ছন্দ
সরস্বতী’ নামে বইতে এই ছন্দ সম্বন্ধে ভারি চমৎকারভাবে তিনি বলেছেন, “ওকে অত সহজে
আয়ত্ত করতে পারবে না, ও হল বাংলা ভাষার প্রাণপাখি। ওকে যে বশ করতে পারবে বঙ্গবাণীর
স্বরূপ মূর্তি সে প্রত্যক্ষ করবে, ...দেখতে ছোটো বটে, কিন্তু সহজে ওকে হাত করতে
পারবে না।” এই ছন্দের আরেকটি গালভরা নাম আছে, সেটি হল ‘স্বরবৃত্ত’। বাংলা পদ্য কবিতায়
সাধারণভাবে তিন রকমের ছন্দের দেখা পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি হল ছড়ার ছন্দ।
পণ্ডিতেরা বলেছেন এই ছন্দে মুক্ত বা স্বরবর্ণান্ত অক্ষর (সিলেব্ল) সবসময়েই
একমাত্রা আর রুদ্ধ বা ব্যঞ্জনান্ত অক্ষরও সাধারণত একমাত্রার মূল্য পায় এবং প্রতি
পর্বে মাত্রার সংখ্যা থাকে চার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেন, “এটা তিন মাত্রার ছন্দ...
এর প্রত্যেক পা-ফেলার লয় হচ্ছে তিনের।” রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের উদাহরণ হিসেবে
দেখা যেতে পারে এই চিরচেনা ছড়াটিকে –
বৃষ্ টি /
পড়ে- / টাপুর / টুপুর / নদেয় / এল- / বা-ন।
শিবঠা /
কুরের / বিয়ে- / হবে- / তিন্ ক / ন্নে- / দা-ন।
আসল কথা হল, ছড়ার ছন্দের একটা
বিশেষ সুবিধে এই যে, এখানে ইচ্ছেমতো স্বরকে টেনে লম্বা করা যায়, ছোটোও করা যায়,
ফলে এর একটা ফ্লেক্সিবিলিটি বা নমনীয়তা আছে, কবিতার বিষয় ও ভাব অনুসারে একে
চমৎকারভাবে ব্যবহার করা যায়, এবং রবিঠাকুর আর তাঁর পরবর্তী কবিরা তা করেওছিলেন।
![]() |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সেকালের বিখ্যাত কবি ও লেখকেরা [বসে ডানদিক থেকেঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচি, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়; দাঁড়িয়ে ডানদিক থেকেঃ প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ বাগচি এবং চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়] |
এবার বলি একজন প্রায় বিস্মৃত
ছোটোদের ছড়াকারের কথা। যে-সময়ে বাংলাতেও ছোটোদের জন্যে পয়ার বা অক্ষরবৃত্তে (প্রতি
চরণে ১৪টি করে অক্ষর) কবিতা লেখা হত, যেমন –
“পাখি সব
করে রব রাতি পোহাইল
কাননে
কুসুমকলি সকলই ফুটিল”
সে-সময় পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার সোনারং গ্রামে হরিপ্রসন্ন
দাশগুপ্ত বিদ্যাবিনোদ নামে এক কবি ছিলেন, দরিদ্র কিন্তু পড়াশুনো-অনুরাগী।
বিদ্যালয়ের উঁচু ডিগ্রি তাঁর ছিল না কিন্তু মানুষটি ছিলেন স্বশিক্ষিত। নানা বিষয়ে
ছিল তাঁর আগ্রহ, উদ্ভিদবিদ্যা, সাহিত্য, সর্বোপরি ছন্দশাস্ত্র। তিনি প্রবাসী,
ভারতী প্রভৃতি তৎকালীন বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায় প্রায় নিয়মিতই কবিতা লিখতেন।
পঞ্চস্বরের মিল দিয়ে কবিতা লিখে এক প্রতিযোগিতায় হরিপ্রসন্ন রবীন্দ্রনাথের
প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন।
অক্ষরবৃত্ত অর্থাৎ পয়ার ছন্দে
কবিতা পাঠে অভ্যস্ত গ্রামের শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা রবীন্দ্রনাথের মাত্রাবৃত্ত ছন্দে
লেখা কবিতা অক্ষরবৃত্তের চালে পড়তে পারছেন না, অপেক্ষা হরিপ্রসন্নের জন্য, এবার সে
জব্দ হবে, এই কবিকে সে এত বড়ো বলে, অথচ দেখ ছন্দেই ভুল! হরিপ্রসন্ন এলেন এবং
নির্ভুলভাবে পড়ে শোনালেন সাত মাত্রার ছন্দে লেখা কবিতাটি। গ্রামের লোকেরা জানলেন
ছন্দ এরকমও হতে পারে।
হরিপ্রসন্ন আদতে ছিলেন কবি,
প্রধানত লিখতেন ছোটোদের জন্য কবিতা। তাঁর এরকম কতগুলি কবিতার বইও বেরিয়েছিল –
‘রঙ্গিলা’, ‘বেদানা’, ঈশপের গল্পের চমৎকার কাব্যরূপ ‘আঙুর’। এখন বইগুলি আর পাওয়া
যায় না, কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগেও তাঁর নাতি দেখতে পান কোনও এক পত্রিকায় ‘কবি
অজ্ঞাত’ পরিচয় দিয়ে তাঁর দাদুর একটি কবিতা কেউ উদ্ধৃত করেছেন। এভাবেই অপরিচয়ে
হারিয়ে যান দরিদ্র হরিপ্রসন্নরা, কিন্তু তবু টিঁকে থাকেন। এখানে দিলাম সেই ‘অজ্ঞাত-পরিচয়’
কবির সেই উদ্ধৃত কবিতাটি, যেটি ঈশপের গল্পের কাব্যরূপ, নীতিবাক্য সমেত, প্রায় একশো
বছর আগে লেখা হরিপ্রসন্ন দাশগুপ্তর এই কবিতাটিতে ধরা আছে ছোটোদের শিক্ষার জন্যে
ছড়ার ছন্দ ব্যবহারের এক চমৎকার নমুনা -
ব্যাং ও ষাঁড়
কেউটেকুড়ির বিল,
তাতে ছুড়লে পরে
ঢিল;
দেখ্তে পারো
ব্যাং এর নাচন্ -
কিল্ বিল্
কিল্ বিল্!
তাতে একটা ছিল
ব্যাং,
তার লম্বা সরু
ঠ্যাং,
বাদ্লা
দিনে গাল ফুলিয়ে
ডাক্ত ঘ্যাঙর
ঘ্যাং!
তার বড্ড
ছিল জাঁক,
কথায় লাগিয়ে
দিত তাক্,
বল্ত সদা –
‘এক্লা আমি
মার্তে
পারি লাখ্ !’
সেদিন নান্নু
মিঞার ষাঁড়
এলো চর্তে বিলের
ধার;
ব্যাংটা বলে
– ‘তফাত রহো
ছোট্ট জানোয়ার’!
রাগে ফুলিয়ে
দেহ খান্,
তিনি ষাঁড়টি
হ’তে চান্;
শেষ কালেতে পেটটি
ফেটে
হ’লেন লবেজান।
নীতি – ছোটো
যদি আপনারে বড়ো ব’লে ভাবে।
একদিন তার ফল হাতে হাতে পাবে।।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment