হিমালয় অভিযান

মানবাহাদুর
রবীন্দ্রনাথ হালদার
মানবাহাদুর এক
বিরল মানুষ। তিনি বসবাস করেন নেপালের এক প্রত্যন্ত
গ্রামে। অর্থনৈতিকভাবে নেপাল অত্যন্ত দরিদ্র এক
দেশ। ঐ দেশটায় শিক্ষার প্রসারও তেমনভাবে ঘটেনি। সেইজন্য
দেশটা অনেক পিছিয়ে আছে। এই কথাগুলো বলছিলেন
মানবাহাদুর নিজেই। ভদ্রলোক পেশায় গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের
শিক্ষক। শিক্ষকতা করে যখন আর সংসার চালানো যাচ্ছে
না তখন অন্য গ্রামের ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে চলে এলেন ইন্ডিয়ায়,
পাহাড়ি শহর গাড়োয়ালের উত্তরকাশীতে। যাদের
সঙ্গে এলেন, গ্রামের ঐ পরিচিতজনেরা সকলেই পাহাড়ি শহরে মালবহনের
কাজে যুক্ত, এক কথায় বলতে গেলে এরা পেশায় সকলেই কুলি। অভাবমোচনের
জন্য সেই কাজের মানসিকতা নিয়ে উত্তরকাশীতে চলে এলেন মানবাহাদুর।
মানবাহাদুরের
সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৮৭ সালে উত্তরকাশীতেই। ঐ বছর
আমাদের অভিযান ছিল গঙ্গোত্রী হিমবাহের বাঁ দিকে রক্তবর্ণ হিমবাহর উপর থেলু ও কোটেশ্বর
পর্বতে। ঐ অভিযানে গাইড ও পোর্টার নেওয়া হয়েছিল
উত্তরকাশী থেকে। বচ্চন সিং উত্তরকাশীর স্থানীয় মানুষ। উত্তরকাশী
বাজারে বাস রাস্তার উপরেই দৈনিক সংবাদপত্র ও বইয়ের ব্যাবসা। মেজ
ভাই গোপাল সিংয়ের সাহায্য নিয়ে পাশে পোর্টার-গাইডের একটা এজেন্সিও
রেখেছেন। ঐ বছর বচ্চন সিং আমাদের পোর্টার গাইডের
ব্যবস্থা করে দেন। মানবাহাদুর ও দ্বিপবাহাদুর দু’জন গাইড, বাকি আট জন পোর্টার। পোর্টারদের
মধ্যে সব থেকে দরিদ্র ছিল মতিবাহাদুর। পোর্টার
ও গাইডদের পুরো দলটাই ছিল নেপাল থেকে আসা।
আমরা হোটেলে
বসে অভিযান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়
দরজার সামনে এসে এক ভদ্রলোক ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন। মুখের
দিকে একটু তাকিয়ে বললাম, ‘আসুন।’ ভিতরে ঢুকে হাতজোড় করে বললেন, “নমস্তে। বচ্চন
সিং নে ভেজা হ্যায়। মেরা নাম হ্যায় মানবাহাদুর।” কথোপকথন সবই হিন্দিতে হচ্ছিল। উনি
বললেন, ‘আমি অভিযানে গাইডের কাজ করি।’ বসতে বললাম এবং চায়ের অর্ডার দেওয়া হল। কথা
শুরু হল মানবাহাদুরের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা
করলাম, ‘এর আগে কোন কোন অভিযান করেছেন?’ উনি বললেন,
‘এর আগে আমি একটাই অভিযান করেছি, গঙ্গোত্রী-I,
গোপাল সিং-এর সঙ্গে। তিনটে
ট্রেকিংয়ে গাইডের কাজ করেছি।’ উত্তরকাশী অঞ্চলে
গোপাল সিং খুব নামকরা একজন গাইড, বচ্চন সিংয়ের মেজ ভাই। গোপাল
সিংয়ের ভরসায় বচ্চন সিংয়ের এই ব্যাবসায় যুক্ত হওয়া। দুই
ভাইয়ের যৌথ ব্যাবসা। স্বল্পভাষী মানবাহাদুরের
কথায় বোঝা গেল তার খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু শরীরী ভাষায়
আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। অল্প
ও সরল ভাষায় অভিযানটা সফল করার জন্য প্রাথমিকভাবে যে উদ্যোগগুলো নেওয়া দরকার সে দিকেই
দেখলাম বেশি নজর। খুব শান্ত, আস্তে আস্তে কথা বললেন। একটাও
বাড়তি কথা নয়। মানবাহাদুরকে দলের সকলেরই খুব ভালো লাগল। আমাদের
কথা শেষ হতেই উনি উঠে দাঁড়ালেন। সন্ধের
পরে আরেকবার আসবেন জানিয়ে সকলকে হাতজোড়ে নমস্কার করে বিদায় নিলেন।
পরের দিন ভোরে
বাস ধরে বেলা একটার সময় আমরা দল নিয়ে গঙ্গোত্রী পৌঁছে যাই। গঙ্গোত্রী
সেই সময়ে খুবই ফাঁকা আর খুব বেশি থাকার হোটেলও নেই। কেদার
গঙ্গার ব্রিজ পেরিয়েই নতুন হোটেলের চারটে রুমই আমরা নিলাম - দুটো আমাদের, দুটো পোর্টার ও গাইডদের। হোটেলের
সামনে ফাঁকা জায়গায় পোর্টাররা শুকনো কাঠ কুড়িয়ে এনে জড়ো করেছে, বিকেলে রান্না হবে। মানবাহাদুর
আমাদের দলের দু-একজন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গোত্রী মন্দিরের
দিকে গেলেন, যদি একটু কাঁচা শাকসবজি পাওয়া যায়। আমি
হোটেলের বারান্দায় চেয়ারে বসে ডায়রি লিখতে শুরু করলাম। আমার
সামনে দিয়ে কেদার গঙ্গা উত্তাল ও ফেনিল সোঁ সোঁ শব্দে গিয়ে মিশছে মূল গঙ্গার সঙ্গে। ঐ মূল
গঙ্গার সৃষ্টি হয়েছে গোমুখ থেকে, পূর্ব দিক থেকে বয়ে আসছে। চেয়ারে
বসে দুটো গঙ্গাকে একসঙ্গেই দেখতে পাচ্ছি। একটু
দূরে মূল গঙ্গার পারে বেশ কিছু মানুষ তাস খেলছে। তাদের
চারপাশ ঘিরে আরও কিছু মানুষ ঐ তাস খেলা দেখছে। ঐ প্রাকৃতিক
পরিবেশে আমি আপন মনে ডায়রি লিখে চলেছি। এমন
সময় আমাদের দলের এক সদস্য হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এল।
“রবীনদা, সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমার
সামনেই একজন নেপালি বাহাদুর জলে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করল। জলে
ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরটা একটা পাক খেয়ে তলার দিকে ঢুকে গেল, আর দেখা গেল না।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়? বিষয়টা কী হয়েছে?”
সদস্যটি হাতের
ইশারা করে বলল, “ঐ দিকে। এখানকার
লোকাল গাড়োয়ালিদের সঙ্গে একজন নেপালি পোর্টার তাস খেলতে গিয়ে হেরে গেছে। বাকি
তিন জন মিলে নেপালিটাকে ধরে জোর করে মুখে কালি মাখিয়ে দিয়েছে। ঘটনাটা
আমার সামনেই হচ্ছিল। নেপালি পোর্টারটা
লজ্জায় অপমানে দৌড়ে গিয়ে আমার সামনেই গোমুখ গঙ্গায় ঝাঁপ দিল। ঐ খরস্রোতা
জলে নিমেষেই ডুবে গেল।”
ওর কথা শোনার
পরে তাকিয়ে দেখলাম যেখানটায় তাস খেলা হচ্ছিল সেখানে অনেক মানুষের ভিড় জমে গেছে। আমাদের
ঐ সদস্যকে বলে দিলাম, হোটেল থেকে ঐ দিকে কিংবা আর কোথাও যাবে না। কারণ
নেপালি আর গাড়োয়ালিদের মধ্যে একটা গন্ডগোল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যারা
নেপালিটির মুখে কালি মাখিয়েছে তারা অবশ্যই অন্যায় কাজ করেছে। এটা
ক্ষমাহীন অপরাধ।
ব্যাপারটা ক্রমান্বয়ে
পুরো গঙ্গোত্রীতে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের
মধ্যে গঙ্গোত্রী মন্দিরেও ঘটনাটা ছাপ ফেলে দিল। পুরো
পরিবেশটাই থমথমে হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই
পুলিশের আনাগোনা দেখা গেল। বাজার
থেকে আমাদের ছেলেরা সবজি না নিয়ে খালি হাতে ফিরে এল, কিন্তু মানবাহাদুর
ফিরে এল না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গঙ্গোত্রীর সব নেপালি পোর্টাররা মানবাহাদুরকে ঘিরে ধরে আবেদন জানাচ্ছে যে
- তুমি একজন লেখাপড়া জানা আমাদের নেপালি মানুষ। আমাদের
এই বিপদের সময় তুমি কিছু করো, কারণ আমরা লেখাপড়া কিছু জানি না,
তার উপর আইন-কানুন বুঝি না। আমরা
এখানে এসেছি দুটো পয়সা রোজগার করার জন্য। এখানকার
স্থানীয় মানুষরা প্রায়ই আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার গালমন্দ করতেই থাকে। এটা
আজ হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে গেল যখন আমাদের একজন নেপালি ভাইয়ের মুখে জোর করে কালি মাখিয়ে
তাকে অপমান করাতে সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হল। আমাদের
এই চরম বিপদের সময় তুমিই একমাত্র ভরসা। একমাত্র
তুমিই পারবে এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে।
এই অমানবিক ঘটনায়
মানবাহাদুরও হতবাক। এদিকে আমরা বড়ো চিন্তায় পড়ে গেলাম আমাদের
গাইড ঐ সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে পড়ায়। সন্ধ্যার
পরে বড়ো ভারাক্রান্ত অবস্থায় মানবাহাদুর এলেন আমাদের কাছে। মুখের
সেই ছোট্ট হাসিটা কোথায় যেন উবে গেছে। এক রাশ
চিন্তা মাথায় নিয়ে বড়োই মনমরা অবস্থায় আমাদের হোটেলের কামরায় ঢুকলেন। আমরা
সব সদস্য এক জায়গায় হলাম। সকলের
সামনেই মানবাহাদুর খুব মৃদু স্বরে আস্তে আস্তে শুরু করলেন তার কথা – ‘দেখুন, আমি এসেছি আপনাদের দলের গাইড হয়ে ঠিকই। যে নেপালি
ভাই আত্মহত্যা করেছে আমি তাকে চিনিও না। আজ দুপুরের
পরে যে অঘটন ঘটে গেল সেটা যে কতটা মর্মান্তিক, সেটা নিশ্চয়ই আপনারা
সকলেই বুঝতে পারছেন। এই ঘটনায়
গঙ্গোত্রীর সব খেটে খাওয়া নেপালি মানুষগুলো খুব অসহায় বোধ করছে, কারণ আমরা সবাই ভিনদেশি মানুষ। তার
উপর এখানকার মন্দিরের যারা ব্রাহ্মণ আছেন তারা কেউই আমাদের কথা শুনছেন না এবং কোনোভাবেই
আমাদের সাহায্য করতে চাইছেন না, উপরন্তু যে তিন জন এই ঘটনা ঘটাল তাদের
গা ঢাকা দিতে সাহায্য করলেন। সেই
কারণেই, আমার দেশের ভাইদের এই অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে আমি আপনাদের সঙ্গে
কী করে যাই! এরা কেউই লেখাপড়া জানে না। এই মুহূর্তে
এদের পাশে থাকা আমার ভীষণ জরুরি।’
মানবাহাদুর কথাগুলো
একনাগাড়ে বলে এবার থামলেন। মানবাহাদুর
ছাড়া আমাদের সঙ্গে যদিও আরেকজন গাইড দ্বিপবাহাদুর আছে, কিন্তু তাকে কখনোই মানবাহাদুরের মতো আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হয়নি। কিন্তু
যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সে দিক থেকে মানবাহাদুর যে মানবিক দিক ভেবে
তার দেশের ভাইদের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন, সেখানে যদি আমাদের অভিযানকে
বড়ো করে দেখি, তবে সেটা হবে আরও বড়ো অমানবিক কাজ। মানবাহাদুর
নিজেই একটা সমাধানসূত্র বার করলেন। বললেন, ‘আমি আজ রাত্রে আমার নেপালি ভাইদের সঙ্গে বসে মিটিং করে কাল ভোর চারটের বাস
ধরে বেলা দশটার মধ্যে উত্তরকাশীতে পৌঁছে ডি.এম ও এস.পি-র অফিসে গিয়ে বিষয়টা নিয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়ে কাল তিনটের বাস ধরে রাত
ন’টায় গঙ্গোত্রী ফিরে আসব। এই দুটো
কাজ করা ছাড়া আমার এই মুহূর্তে আর বেশি কিছু করারও নেই। আপনারা
আগামীকাল সকালে এখান থেকে ভূজবাসা এবং পরের দিন রক্তবর্ণে পৌঁছে যাবেন। যেদিন
রক্তবর্ণ পৌঁছবেন তার পরের দিন আপনাদের রেস্ট আছে। আমি
একদিন পরে গঙ্গোত্রী থেকে শুরু করে ওই রেস্টের দিন রক্তবর্ণ গ্লেসিয়ারে পৌঁছে যাব। আপনারা
আমার দলে থাকা নিয়ে একটুও চিন্তা করবেন না। আমি
অবশ্যই আপনাদের অভিযানে থাকব। আজ আপনারা
আমাকে অনুমতি দিন যাতে এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে দেশের ভাইদের পাশে আমি দাঁড়াতে পারি।’
আমরা নির্দ্বিধায়
সকলেই একমত হয়ে মানবাহাদুরকে ছেড়ে দিলাম। মানবাহাদুর
ঠিক তার কথামতো সঠিক সময়ে রক্তবর্ণ বেস ক্যাম্পে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এবং
পরের দিনগুলিতে আমাদের অভিযান সফল করার জন্য সব দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আমাদের
দলের সব সদস্যই অভিযানের প্রতি পদে ওর সিদ্ধান্ত ও সাহসের পরিচয় কাছ থেকে দেখার সুযোগ
পেয়েছে। ঠিক তেমনই সাহসিকতার সঙ্গে বিদেশের মাটিতে
নির্ভয়ে গাড়োয়ালি ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন
মানবাহাদুর। তাঁর নীরব কাজের মধ্য দিয়েই মানবাহাদুর
প্রমাণ করেছিলেন, তিনি একাই একটি জাতি, একাই একটি দেশ। এ হেন
সরল সাদাসিধে নির্ভীক গ্রামীণ মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া জীবনের পরম সৌভাগ্য। মানবাহাদুর
এতকাল পরে আজও তাই হৃদয়ের গভীরে রয়ে গেছেন।
_____
শীর্ষচিত্রঃ
গঙ্গোত্রী – ফোটো অর্পিত রাওয়াত
পাহাড়ের রুক্ষতা যেমন তুষারের শুভ্রতায় উজ্জল হয়ে চারিধারে আলোকিত করে তোলে।এই অন্ধকার সমাজে মানবহাদুর এক আলোর উজ্জ্বলতা। তার কর্তব্য ও দায়িত্ব আমাদের শিক্ষণীয়।
ReplyDelete