
সবিতা
বিশ্বাস
জগাই ওরফে জগবন্ধু নাথ এখন
রাগ করে বসে আছে। না, বাড়িতে নয়। বসে আছে দত্তদের পুরোনো ইটভাটার চিমনির পিছনে।
জগাই ক্লাস ফোর। নামেই ফোর,
“ক” লিখতে কলম ভাঙে। এখনও পর্যন্ত নিজের নামটাই ঠিকমতো বলতে পারে না। লেখার কথা না
ভাবাই ভালো। নাম জিজ্ঞাসা করলে বলে জগবন্ডু নাড্। এই সামান্য একটা কারণে পাড়ার ছোটো
ছোটো বাচ্চারা পর্যন্ত ওর পিছনে লাগে। হাত-পাগুলো লিকপিকে বলে খেলার মাঠেও ওকে কেউ
পাত্তা দেয় না। ব্যাট ধরলেই রে-রে করে তেড়ে আসে। না হয় বাউন্ডারি মারতে পারে না,
কিন্তু রান তো ওঠে। তাও এ সবগুলোতে জগাই কিচ্ছু মনে করেনি, কিন্তু শেষপর্যন্ত মা!
শুধু মা নয়, বাবাও। পরিস্কার বলে দিল আজ থেকে খাওয়া বন্ধ। জগাইয়ের কী দোষ? পড়তে
ভালো লাগে না, লিখতে ভালো লাগে না। দুধ খেতেও ভালো লাগে না। বাবা বললো, পড়াশোনা
ভালো না লাগলে স্কুলে যেতে হবে না, হরিহর বিশ্বাসের বাড়ির গরুর বিচালি কাটুক। সঙ্গে
সঙ্গে জগাইয়ের চোখের সামনে গরুগুলোর চেহারা ফুটে উঠল। ওরে বাবা!
চিমনির পিছনে বসে চোখ মুছছিল
জগাই। মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। সেই সকালে এসেছে, মা একবার ডাকল না? কিন্তু জগাই
এখানে এল কী করে! একশো, দুশো বছর আগে এখানে একটা ইটভাটা ছিল। তারপর কী যে হয়েছিল তা
জগাই জানে না। তবে কোনও মানুষ, গরু, ছাগল, শেয়াল কেউ এদিকে আসে না। এখানে এলে কেউ
আর ফিরে যায় না।
অথচ জগাই সেখানে বসে আছে।
যেদিকে তাকাচ্ছে ঘন জঙ্গল। বাবলা গাছ আর কাঁটা। কিন্তু পায়ে তো একটাও কাঁটা ফোটেনি।
ও কি তবে উড়ে উড়ে এসেছে? যাঃ তাই আবার হয় নাকি? “হয়, হয়, ইচ্ছে থাকলে সবই হয়।” কে?
কে বলল কথাটা? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, এখনও পর্যন্ত কাউকেই দেখেনি। তবে কি ভূত?
ও মাগো, আমাকে ভূটে খেয়ে ফেলল গো।
“চুপ করো, চুপ করো। ভূট, ভূট
কোরো না। আমি ভূত হতে যাব কেন? আমি ভগাই।”
জগাই চোখের জল মুছে এদিক,
ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে যখন আবার কাঁদবে ভাবছে, ঠিক তখুনি সামনের বাবলা
গাছ থেকে পাকা আম পড়ার মতো টুপ্ করে একটা ছেলে ওর সামনে এসে পড়ল। ছেলেটা জগাইয়ের
খুড়তুতো ভাই তিন বছরের গুবলুর থেকেও ছোটো দেখতে। জগাই ভেবেই পেল না, ঐটুকু ছেলের
গলার স্বর ভবেশ কাকার মতো মোটা কেন, আবার ছেলেটা কাঁটা ভর্তি বাবলা গাছে উঠল কী
করে? ভগাই বলল, “তুমি অত ভেবো না। আমি পরে সব বুঝিয়ে দেব। আগে তুমি খেয়ে নাও।
সারাদিন কিছুই খাওনি। নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে। চলো আমার বাড়ি চলো।”
জগাই কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে
পারছে না। এই ভগাইকে আগে কোনোদিন দেখেনি, এর সঙ্গে যাওয়া কি ঠিক হবে?
ভগাই ওর হাত ধরে টানতে টানতে
অনেককালের পুরোনো শ্যাওলাধরা ইটের পাঁজার কাছে নিয়ে গেল। জগাইকে বলল, এই যে আমার
বাড়ির দরজায় এসে গেছি। দরজা? কোথায়? এ তো জগাইয়ের স্কুলের বিল্টুর থেকেও বদমাশ মনে
হচ্ছে। বিল্টু একদিন নিমপাতার রসে পাকা পুঁইমিচুরির রস মিশিয়ে এনে বলেছিল, ‘খা
জগাই। আমার মায়ের গুরুদেব দিয়েছে। এটা খেলেই তোর জগবন্ডু নামটা জগবন্ধু হয়ে যাবে।
খা, খা, তাড়াতাড়ি খা।’ খুব আনন্দ করে যেই না চোঁ চোঁ করে চুমুক দিয়েছে, ও মাগো! কী
তেতো, কী তেতো। বাড়ি ফিরে এক বাটি গুড় খেয়েও তেতো কাটে না।
ভগাই বলল, “আমি মোটেও তোমার
বন্ধু বিল্টুর মতো না।”
মানে? জগাই যা ভাবছে ভগাই সব
জানছে কী করে? এ তো ভারী মুশকিলে পড়া গেল।
“মুশকিলের কিছুই নেই। এসো
আমার সঙ্গে।”
জগাই আর কী করে, খিদেও পেয়েছে
খুব। ভগাই ইটপাঁজার মাঝে একটুকুনি ফাঁকের মধ্যে ঢুকে জগাইকে ডাকল, “এসো এসো।
দাঁড়িয়ে থেকো না। এরপরে অন্ধকারে রাস্তা খুঁজে পাবে না।”
একটা টিকটিকি ঢোকার মতো ফাঁক,
ওর মধ্যে জগাই কী করে ঢুকবে? ভগাই-ই বা ঢুকল কী করে? ও কি ম্যাজিক জানে? একবার
পিছন ফিরে দেখল, কী অন্ধকার! এর মধ্যে সূর্য ডুবে গেল? আর কিছু ভাবার আগেই শক্ত
হাতের হ্যাঁচকা টানে জগাই ঢুকে পড়ল ইটপাঁজার আড়ালে। আরে! সত্যিই তো একটা রাস্তা। কী
সুন্দর। পাশে ফুলের গাছ। ফলের গাছও আছে। পেয়ারা, লেবু, ডালিম। অন্যগুলো চিনতে পারল
না। সেই অচেনা ফলটার দিকে হাত বাড়ানোর আগেই কে যেন হাতটা ধরে ফেলল। কানের কাছে
ফিসফিস করে বলল, “জানো না, না বলে কারও কোনও জিনিসে হাত দিতে নেই। ছোটোবেলায় এগুলো
কেউ শেখায়নি বুঝি? তোমাকে অনেক কিছুই শিখতে হবে। এখন যাও হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে
বোসো।”
যে বলল, তাকে দেখা গেল না।
ভগাইকেও না। সামনে একটা টলটলে পুকুর দেখতে পেল। শ্যামল দাদাদের বাড়ি যেমন বাক্সের
মধ্যে জল আর মাছ থাকে, ঠিক তেমনি একটা পুকুর। মাছগুলো ধরার খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু
আবার কে কথা শোনাবে, তাই হাত মুখ ধুয়ে উঠে পড়ল। ওরে বাবা, অ্যাতো খাবার! দারুণ
সুন্দর গন্ধ। কর্মকার বাড়ির বড়ো ছেলের বিয়ের ভোজ খেয়েছিল জগাই। ঠিক সেইরকম গন্ধ। আর
দেরি না করে জগাই খেতে শুরু করে দিল। খেতে খেতে থালার পাশে দু-চারটে ভাতের দানা,
তরকারি পড়ে গিয়েছিল, তখনই সেই অদৃশ্য গলাটা বলে উঠল, “খাবার ফেলে নষ্ট কোরো না।
এতক্ষণ খিদেয় কষ্ট পেয়েও তোমার শিক্ষা হল না।” এরপরে একদানাও ফেলেনি জগাই। একেবারে
চেটেপুটে সব খেয়ে নিয়েছে।
খাওয়া তো হল, এবার? ভগাইকেও দেখা
যাচ্ছে না। ভগাই সত্যি খুব ভালো। কী ভালো বাড়ি ওদের। যাঃ বাড়ি কোথায়? পুকুরে
হাতমুখ ধুলো, তারপর পুকুরটা উধাও হয়ে গিয়ে একটা বাড়ি হল। এখন কিছুই নেই। গাছপালা
আছে, ফুল-ফল আছে, কিন্তু পাখি কই? গরু ছাগলও তো নেই! মাঠ আছে, মাঠের মধ্যে ওরা কারা?
বিল্টু, পল্টু, এ বাবা মেনকা মাসিও আছে দেখছি। ভগাই ওদের সঙ্গে আছে। জগাইয়ের মনটা
ভালো হয়ে গেল। বিল্টু, পল্টুর সঙ্গে খেলতে পারবে। ওরা খুব ভালো ছেলে নয়। তবু বন্ধু
তো! তবে ভগাই খুব ভালো। একটু ছোটো। তা হোক।
জগাই দৌড়ে মাঠে চলে গেল। এ কী!
বিল্টু পল্টু ছোট্ট ছোট্ট দুটো খুরপি দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে। মেনকা মাসি পাশের একটা
এঁদো, হেজেমজে যাওয়া পুকুর থেকে প্লাস্টিক, আবর্জনা পরিস্কার করছে। জগাই চিনতে
পারল পুকুরটা। মেনকা মাসি সব আবর্জনা ফেলে পুকুরটা নষ্ট করেছে। এ ম্যাগো, কী পচা
গন্ধ। ভগাই ওকে দেখতে পেয়ে মোটা গলায় বলল, “তুমি এখানে কী করছ? যাও, স্কুলে যাও।”
স্কুল? এখানে? ভাবতে না ভাবতেই
জগাই সমর স্যারের গলা শুনল। ‘এই যে জগবন্ডু, নাম লেখো। ভুল হলে তোমাকেও ওদের মতো
কাজ দেওয়া হবে। বিচালি কাটার কাজ।’ জগবন্ধু পড়তে শুরু করল। বেশ তো, দিব্যি গড়গড়
করে পড়তে পারছে। তাহলে আর ওকে বিচালি কাটার কাজটা করতে হবে না। সমর স্যার বলল, ‘উঠে
দাঁড়াও। একটা হাত মুড়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকো।’ মানে? কোনও দোষ করলাম না, তাও
শাস্তি পেতে হবে!
‘হবে।’ কে বলল কথাটা? ‘আমি।
তোদের বাড়ির উঠোনের টগর গাছ। এই দ্যাখ আমার একটা ডাল কেমন বাঁকা। তুই বিনা কারণে আমাকে
মুচড়ে দিয়েছিলি। এবার দ্যাখ কেমন লাগে?’ তখুনি ভুলি ভৌ ভৌ করে ডেকে বলল, ‘তোর গায়ে
এই আধলা ইঁটটা ছুঁড়ব?’ জগাই চীত্কার করে উঠল, ‘না- আ-।’ ‘না কেন? তুই যে আমার গায়ে
ছুঁড়েছিলি? এই দ্যাখ্ এখনও আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটি। অন্য কুকুররা আমায় ল্যাংড়া
বলে।’ পাশের বাড়ির ময়না কাকিমার পোষা বেড়াল ‘আহ্লাদী’ বলল, ‘ম্যাঁও। আমি তোর গায়ে
জলভর্তি মগ ছুঁড়ে মারব, তোর চোখ কানা হয়ে যাবে। যেমন আমার হয়েছে।’ এবার জগাই
কাঁদতে শুরু করল। ‘না—না—আমি আর কোনোডিন এইসব খারাপ কাজ করব না। আমায় ছেড়ে দাও।’
ভগাই বলল, “কক্ষনো না, এখান
থেকে ছাড়া পাওয়া অত সহজ নয়। ওই দ্যাখো তোমার বন্ধুদের, ওরা এখন গাছ লাগাবে, গাছে
জল দেবে। মাঠ পরিষ্কার করবে, ওরা যা যা খারাপ কাজ করেছে তার শাস্তি ওদের পেতেই হবে।
যাও, কান্নাকাটি করে লাভ হবে না। ফোরে পড়ছ, অথচ অ আ শেখোনি। একদম প্রথম থেকে শুরু
করো। যদি সব ক্লাসে ঠিকঠাক পাশ করতে পারো, আর ভালো ব্যবহার করো, তবে খুব সুন্দর
একটা জায়গা দেখাব তোমাকে। তোমার বন্ধুদেরও।”
তারপর কতদিন কেটে গেল, জগাই
পড়তে পড়তে বড়ো হয়ে গেল। না, না, লম্বায় নয়। বুদ্ধিতে। ব্যবহারে। তখন ভগাই বলল, “চলো,
তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাই। ইচ্ছে হলে তুমি সেখানে থাকতেও পারো।” কী চমত্কার জায়গা!
বাড়িঘর, খেলার মাঠ, পুকুর, স্কুল বাজার দোকান সব একেবারে ঝকঝকে, তকতকে। সবাই সবার সঙ্গে
কী মিষ্টি করে হেসে কথা বলছে। আচ্ছা, জায়গাটা বেশ চেনা চেনা লাগছে না? হ্যাঁ,
লাগছেই তো। পলাশ কাকু জগাইকে ডেকে হাতে চারটে ডাঁশা পেয়ারা দিয়ে বলল, ‘জগবন্ধু, এই
নে তোর জন্যেই আনলাম।’ মানে? পলাশ কাকুর গাছের কাছাকাছি গেলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করে,
অথচ - ।
না, এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে
জগাই আর বাড়ি ফিরবে না। কিছুতেই না।
“কাকিমা, এই দ্যাখো জগাই, অর্কদের
ইটের গাদার পিছনে আশশ্যাওড়ার ঝোপের মধ্যে শুয়ে শুয়ে বিড়বিড় করছে।” সবাই দৌড়ে গিয়ে
দ্যাখে, জগাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলছে, ‘আমি আর বাড়ি ফিরব না। কিছুতেই না। সবাই আমাকে
মারে, বকে।’
জগাইয়ের মা ওকে জড়িয়ে ধরে
কাঁদতে লাগল। জগাই চোখ খুলে মাকে বলল, “কেঁদো না। আমি আমার নাম লেখা শিখে গেছি।
চলো, বাড়ি চলো।” জগাইয়ের পিছন পিছন সবাই ওদের বাড়ি গেল। জগাই খাতা কলম নিয়ে এসে
নিজের নাম লিখল, জগবন্ধু নাথ। তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে বলল, “আমাকে ভগাই সব শিখিয়ে
দিয়েছে। আমি এবার থেকে কোনও দুষ্টুমি করব না।”
মা বলল, “ভগাই? সে কে? কোথায়
থাকে?”
“ভগাই আমার বন্ধু। ও থাকে
দত্তদের পুরোনো ইটপাঁজার আড়ালে?”
সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “মানে?”
_____
ছবিঃ সুজাতা চ্যাটার্জী
ছবিঃ সুজাতা চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment