
প্যারট আইল্যান্ডের গুপ্তধন
অনন্যা দাশ
।।
১ ।।
স্কুলের গরমের ছুটি পড়লেই টম
আর তার বন্ধু মাইক নৌকা নিয়ে সাগরে বেরিয়ে পড়ে। নৌকাটা বিলির। এটার অবস্থা খুব
একটা ভালো নয়, তাই বিলি মাছ ধরার জন্যে আর এটাকে ব্যবহার করে না। ওর আরও অন্য বেশ
কয়েকটা নৌকা আছে সেই কাজের জন্যে। এটাকে এমনিতেও কয়েকদিন বাদে অবসর নেওয়াতে হবে,
তাই টম আর মাইক এটাকে নিয়ে কিছুদন আনন্দ করে নিলে তার কিছু যায় আসে না। মাঝে মাঝে
আরও কিছু বন্ধুও জুটে যায় ওদের সঙ্গে। আজ যেমন মাইকের খুড়তুতো যমজ ভাই বোন নোয়েল
আর নোরা এসে জুটেছে। ওরা অবশ্য বয়সে টম আর মাইকের চেয়ে কিছুটা ছোটো। নোরা
দূরবিন দিয়ে সব কিছু দেখছে মন দিয়ে আর নোয়েল কেবল ঘ্যান ঘ্যান করছে খিদে পেয়েছে,
খিদে পেয়েছে বলে!
মাইক তো বিরক্ত হয়ে টমকে বলল,
“নোয়েলটাকে না নিয়ে এলেই ভালো হত! তখন থেকে কেবল খাই খাই করে চলেছে! অথচ সকালেই এত
এত জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছি আমরা। ওরা এসেছে বলে মা প্যানকেক বানিয়েছিলেন।”
টম পকেট থেকে একটা আপেল বার
করে নোয়েলকে দিয়ে বলল, “এই নে এটা খা। আর কিন্তু কিছু চাইবি না। হাওয়া-টাওয়া নেই
তেমন আজ। দাঁড় বেয়ে পাড়ে পৌঁছতে অন্তত এক ঘন্টা লেগে যাবে।
আমাদের সবারই খিদে পেয়েছে কিন্তু কেউ তোর মতন ঘ্যান ঘ্যান করেছে না!”
নোয়েল আর কিছু না বলে
আপেলটাকে নিয়ে কচর মচর করে চিবোতে শুরু করল।
এমনি ঝকঝকে দিন, কিন্তু বেশ
গরম। তবে চারিদিকটা ভারি সুন্দর। নীল জল, নীল আকাশ আর সবুজ দ্বীপের সারি। দূরে
একটা বেশ দামি নৌকা দেখা যাচ্ছিল।
মাইক সেটাকে দেখে বলল, “উফ কী
গরম রে বাবা! ওই নৌকার কেবিনে থাকলে ভালো হত। ওদের নিশ্চয়ই এসি আছে! কী আরামের
জীবন।”
টম বলল, “শুধু কি এসি? ওটা তো
মোটর দেওয়া নৌকা, দাঁড়ও টানতে হবে না! নে এবার কাজে মন দে নাহলে আর বাড়ি পৌঁছতে
হবে না!”
নোরা দূরবিন দিয়ে দেখেই চলেছিল,
হঠাৎ বলল, “লোকটাকে মেরে জলে ফেলে দিল!”
টম এক কান দিয়ে শুনছিল কথাটা,
বলল, “কী বললি?”
নোরা বলল, “ওই যে দামি নৌকাটাতে।
একটা লোক অন্য লোকটাকে বৈঠা দিয়ে ঘা মেরে জলে ফেলে দিল! আমি দেখেছি।”
মাইক বলল, “কী যা তা বলছিস!
জলে কেউ পড়লে তো আমরা দেখতে পেতাম!”
“এই দিকে না, উলটো দিকে,
যেদিকটা দেখা যাচ্ছে না সেই দিক দিয়ে ফেলল তো!”
“হ্যাঁ! যেদিকটা দেখা যাচ্ছে
না তুই সেই দিকটাই দেখতে পেলি! যত্ত সব!” মাইক বিড়বিড় করে বলল।
“ওকে মারল আমি দেখতে পেলাম,
তারপর রেলিংয়ের ওপর দিয়ে তুলে জলে ফেলে দিল!”
নোয়েল আপেল চিবোতে চিবোতে বলল,
“মা বলেন নোরার কল্পনাশক্তি খুব প্রখর, ও বড়ো হয়ে অনেক গল্প লিখবে!”
টম ব্যাপারটাকে সামাল দিতে
দিতে বলল, “ঠিক আছে নোরার পিছনে আর লাগতে হবে না,” বলে জোরে জোরে দাঁড় বাইতে লাগল।
।।
২ ।।
টমকে মনে আছে তোমাদের? সেই যে
সেই টম, যার বন্ধুরা ওকে বলে, “জানিস বেড়ালদের নাকি ন’টা প্রাণ
থাকে? তুই তো বেড়াল নোস বটে, কিন্তু তোরও মনে হয় ন’টা প্রাণ আছে!”
আসলে টম অনেকবারই গেল গেল করে
যেতে যেতেও প্রাণে বেঁচে গেছে তাই অনেকেই ওকে ওই কথাটা বলে। সমুদ্রের
ধারে জেলেদের বস্তিতে মানুষ টম। খুব
ছোটোবেলায় নাকি একবার নৌকা থেকে জলে পড়ে গিয়েছিল কী ভাবে। টমের
অবশ্য কিছুই মনে নেই। সাঁতার কাটতে
জানে না ওই টুকুন পুঁচকে, কিন্তু এক গাদা জল খেয়েও সে বেঁচে গেল। মা বলেন
সে নাকি দশ মিনিট জলে ছিল! টমের যদিও সে কথা বিশ্বাস হয় না, মা মনে হয় সময়টাকে অনেকটা বাড়িয়ে ফেলেছেন ভালোবাসার টানে! ওর বয়স যখন সাত তখন দস্যিপনা করতে গিয়ে দোতলার ছাদ থেকে পড়ে যায়। পা ভাঙ্গা
ছাড়া কিছুই হয়নি ওর। বারো বছর বয়সে
কোন এক অনুষ্ঠান বাড়িতে পচা খাবার খেয়ে প্রায় যায় যায় অবস্থা হয়েছিল কিন্তু শেষমেশ
বেঁচে যায় টম। অন্য প্রায় জনা কুড়ি লোক মারা গিয়েছিল
ফুড পয়জনিং হয়ে। সেই থেকেই সবাই টমকে নিয়ে বেড়ালের ন’টা
প্রাণের কথা বলে।
মাইক সব সময় বলে, “এবার একটু সাবধানে থাকিস বাপু! তিনটে জীবন তো ব্যবহার
করা হয়ে গেছে এই ক’দিনেই!”
টম হাসে ওর কথা শুনে, বলে, “দূর! তুই বড্ড সাবধানি!”
যাই হোক পাড়ে ফেরার পর প্রবল
পরিশ্রমে ক্লান্ত টম আর মাইক হাত পা ছড়িয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর টম বলল, “এবার
বাড়িতে যাই। বিকেলে মেলাতে আসবি তো?”
ওদের গ্রামে একটা মেলা চলছে। সেদিনটাই
শেষ দিন।
মাইক বলল, “হ্যাঁ আসব, তবে
দুটো লেজুড়ও আসবে আমার সঙ্গে। আর কাকা আমাদের সবাইকে মেলা দেখার জন্যে ডলার
দিয়েছেন, তাই আপত্তি করছি না ওদের আনতে!” বলে চোখ টিপে বাড়ির দিকে রওনা দিল মাইক,
নোয়েল আর নোরাকে সঙ্গে নিয়ে।
।।
৩ ।।
বিকেলে ওরা চারজন যখন মেলায়
গিয়ে পৌঁছল তখন মেলা পুরোদমে চলছে। মাইকের কাকুর দেওয়া ডলার দিয়ে পিজা, আইসক্রিম,
পপ কর্ন ইত্যাদি খেয়ে ওরা যখন ঘুরছে তখন হঠাৎ নোরা বলল, “ওই নীল ভাল্লুকটা আমার
চাইই চাই! বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটিয়ে কে ওটা আমার জন্যে জোগাড় করে দেবে?”
মাইক আর টম দু’জনেই বন্দুক
দিয়ে বেলুন ফাটাতে রাজি, কিন্তু গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে টিকিট কিনতে কেউ রাজি নয়! তাই
দেখে নোরা বলল, “ঠিক আছে, টিকিট আমি কেটে দিচ্ছি, কিন্তু ভাল্লুক না জিততে পারলে টিকিটের
দাম ফেরত দিয়ে দিতে হবে!”
মাইক বলল, “উফ কী পাকা মেয়ে
রে বাবা!” আর তাই শুনে নোয়েল খিক খিক করে হাসল।
মাইকের টিপ একটুর জন্যে ফসকে
গেল, তাই ওর ভাগ্যে টেডি বেয়ার জুটল না। নোরাকে টিকিটের দাম ফিরিয়ে দিতে হল তাকে,
কিন্তু টম পারল। নীল রঙের টেডি বেয়ার পেয়ে নোরা খুব খুশি। এর মধ্যে নোয়েলের শখ
হয়েছে যে সে নাগরদোলায় চড়বে। নোরা আবার সেটাতে কিছুতেই চড়তে রাজি নয়, তার নাকি
উঁচুতে উঠতে ভারি ভয় করে। অগত্যা মাইক, টম আর নোয়েল নাগরদোলায় চড়তে গেল। নোরা বলল
সে নিচেই দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দেখবে।
মাইক বুঝিয়েসুঝিয়ে একটা বুড়ির
মাথার পাকা চুলের প্যাকেট কিনে ওকে ধরিয়ে বলল, “খবরদার কোথাও যাবি না কিন্তু!
এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি। আমরা যেন ওপর থেকে তোকে দেখতে পাই। মেলার এই ভিড়ে তুই
হারিয়ে গেলে খুব মুশকিল হবে, বুঝেছিস? কাকু মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে আমাকে।”
নোরা শুনে বলল, “হারাবো কেন?
আমি তো বড়ো হয়ে গেছি!”
মাইক তাও আবার বলল, “এখান
থেকে একদম নড়বি না!” কাকু কাকিমা ওকে বাচ্চা দুটোর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন বলে
কথা।
ওরা তিনজন নাগদোলায় উঠল।
নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করল একটু পরেই। হঠাৎ টম নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “নোরা চিৎকার
করে আমাদের কী একটা বলতে চেষ্টা করছে রে!”
মাইক বলল, “দূর দূর! তোর কথাই
শুনতে পাচ্ছি না ঠিক করে আর ওর কথা! এমনিতেই ও একটু বেশি বকে!”
ওরা তিনজন খুব মজা-টজা করে
যখন নিচে নামল তখন দেখল নোরা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাইক
ওকে দেখে বলল, “কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
নোরা বলল, “তোদের এত করে
ডাকলাম তোরা শুনলি না!”
“ধ্যাৎ বোকা, ওটা একবার চলতে
শুরু করেলে কিছুই শোনা যায় না! কী বলছিলি?”
“ওই লোকটাকে দেখলাম আমি!”
“কোন লোকটাকে?”
“ওই যে লোকটা আজ দুপুরে অন্য
লোকটাকে মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল!”
“অ্যাঁ! বলিস কি রে!”
“হ্যাঁ, সে এখানে এসেছিল। আমি
চেঁচিয়ে তোদের ডাকলাম কিন্তু তোরা শুনলি না! এখন তো লোকটা অন্য কোথাও চলে গেছে, আর
দেখতে পাচ্ছি না,” নোরা মনখারাপ করে বলল।
এমন সময় এক মহিলা এসে নোরাকে
বলল, “তুমিই একটু আগে চেঁচাচ্ছিলে না যে ‘এই লোকটাই একজনকে মেরে জলে ফেলেছিল, তাকে
দেখতে পেয়েছি’? সেই কথাটা সত্যি?”
টম আর মাইক মুখ চাওয়াচাওয়ি
করল। টম বলল, “নোরা তুই কী ওই কথাটা জোরে জোরে বলে চেঁচাচ্ছিলি?”
নোরা বলল, “হ্যাঁ, তোদের
ডাকার চেষ্টা করছিলাম তো! কেন ডাকছি সেটা বলতে হবে না!”
মাইকের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল,
“সর্বনাশ করেছে! ওই লোকটাও নির্ঘাত শুনতে পেয়েছে নোরার কথা তাই সটকে পড়েছে! কিন্তু
সে তো জেনে গেল যে নোরা দেখে ফেলেছে! এবার কী হবে? সে তো নোরার ক্ষতি করার চেষ্টা
করবে!”
টমের চোয়াল শক্ত হল, সে বলল,
“তাহলে আমাদের কাজ নোরাকে ওর সামনে না পড়তে দেওয়া! হ্যাঁ রে নোরা, তুই তো অনেক দূর
থেকে দেখছিলি। ওই লোকটার মুখ দেখতে পেয়েছিলি ঠিক করে? ঠিক করে না দেখে থাকলে
কিন্তু তোর কাউকে দেখে ওই রকমভাবে বলাটা ভারি অন্যায়, সেটা বুঝতে পারছিস তো?”
কিন্তু নোরাকে টলানো গেল না।
সে বার বার বলতে লাগল, “আমি লোকটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি! আমার ভুল হয়নি!”
“কিন্তু তোর কথা যদি ঠিক হয়
তাহলে ওই লোকটা একজনকে মেরে জলে ফেলেছে, তাই তো? তাহলে তো পুলিশকে বলতে হবে।”
টমের কথা শুনে মাইক কী একটা
বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে একটা লোক ওদের দিকে এগিয়ে এল।
পুলিশ যে, তাকে টম আর মাইক
ভালোই চেনে। ওদের ওখানকার থানার পুলিশ সে। জর্জ না কী একটা
যেন নাম। তার সঙ্গে যে দাড়িওয়ালা লোকটা তাকে অবশ্য ওরা চেনে না। জর্জ পুলিশকে অন্য
লোকটা বলল, “এই যে এই মেয়েটা! এই মেয়েটাই চিৎকার করে বলছিল যে সে একজন লোককে দেখেছে
আরেকজনকে মেরে জলে ফেলে দিতে! আমি তো সিটি ক্রনিকালের রিপোর্টার, তাই আমি মনে
করলাম আপনাকে কথাটা জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব! সে রকম যদি সত্যি কিছু ঘটে থাকে
তাহলে তো সেটা পুলিশের আওতায় পড়ে যায় তাই না?”
ওরা চারজন চুপ করে দাঁড়িয়ে
রয়েছে দেখে জর্জ পুলিশ নোরাকে জিজ্ঞেস করল, “কী খুকি তুমি কী দেখেছ বলতে পারবে?”
নোরা তো তাই শুনে রেগে বম! সে
মুখ গোঁজ করে বলল, “আমি খুকি নই! আর না বলতে পারার কী আছে? আমি কী বোবা নাকি? যা
দেখেছি তখনই তো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে দিলাম। সারা মেলার লোকজন শুনতে পেয়ে গেছে,
শুধু যাদের জন্যে বলা তারাই শুনতে পেল না।”
জর্জ পুলিশ আবার জিজ্ঞেস করল,
“কী দেখেছিলে, কোথায় দেখেছিলে, ঠিক করে বলো তো শুনি।”
টম তখন বলল, “আমরা আজ দুপুরে
নৌকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ওই যে ছোটো দ্বীপটা আছে যেটাকে প্যারট আইল্যান্ড বলা হয়,
সেটার কাছাকাছি। আরেকটা বেশ দামি বড়োসড়ো নৌকা কিছুটা দূরেই ছিল। আমরা দাঁড়
বাইছিলাম তাই খেয়াল করিনি কিছু, কিন্তু নোরা বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে বসেছিল, তাই
ওই যা দেখার দেখেছে।”
“কী দেখেছ তুমি খুকি?”
নোরা আবার বলল, “আমি খুকি নই!
আমি দেখলাম একজন লোক আরেকজনকে দাঁড় দিয়ে দমাস করে মেরে তাকে জলে ফেলে দিল! আর আজ
যখন ওরা নাগরদোলায় চেপেছিল, আমি যাইনি আমার ভয় করে বলে, তখন সেই লোকটাকেই আমি
মেলাতে দেখতে পেলাম! তাই আমি উত্তেজিত হয়ে চেঁচাতে শুরু করলাম। সেটা আমার ভুল
হয়েছে, কারণ এবার তো লোকটা জেনে গেছে যে আমি ওকে দেখেছি, ও এবার আমার ক্ষতি করার
চেষ্টা করবে হয়তো!” নোরা বিজ্ঞের মতন বলল।
জর্জ পুলিশ সব শুনে বলল, “ও
এই ব্যাপার! তা আমরা থাকতে সে তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। দেখি কেউ হারিয়ে
গেছে কিনা, কারো জন্যে মিসিং পার্সন রিপোর্ট হলে তখন তদন্ত করতে সুবিধা হবে। তুমি
সাবধানে থেকো, আশা করছি কিছু হবে না। তাও কাল
আর্টিস্ট এলে তাকে দিয়ে তোমার দেখা লোকটার চেহারাটা আঁকিয়ে নেব একবার। আমাদের
আর্টিস্ট খুব ভালো। তোমাকে কিছু করতে হবে না, ওই তোমার কাছ থেকে সব কিছু বার করে
নেবে। যাও, আজ সাবধানে বাড়ি যাও।”
রিপোর্টার লোকটা বলল, “আমি
ওদের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি না হয়। আমার কাগজের জন্যে ভালো গল্প পেয়ে গেছি মনে হচ্ছে!”
পুলিশ চলে যেতে রিপোর্টার
লোকটা বলল, “আমার নাম জোনাথন পার্কার। আমি শহরের সিটি ক্রনিকালে কাজ করি। আর
পাঁচটা মেলার মতো এই মেলাটাকে কভার করতে এসে দারুণ খবর পেয়ে গেলাম!”
টম বলল, “তুমি নোরার কথা
বিশ্বাস করছ নাকি? ও যা গল্প বানাতে পারে না! তুমি ওই সব কাগজে ছাপার আগে একটু
ভেবে দেখো বাপু।”
লোকটা বলল, “লোকটাকে হয়তো ও
ঠিকঠাক নাও চিনতে পারে, কিন্তু মেরেছে কেউ একটা কাউকে সেটা দেখাতে তো ওর ভুল হবে
না!”
বাড়ি ফিরতে ফিরতে লোকটা অনেক
গল্প করছিল, “তোমাদের এই জায়গাটা খুব সুন্দর। সমুদ্র, দ্বীপ, একেবারে স্বর্গ যেন!”
মাইক বলল, “যখন সমুদ্রে ঝড়
ওঠে না তখন একেবারে নরক মনে হয়!”
“তোমরা প্যারট আইল্যান্ডে গেছ
কখনও?”
টম শুনে বলল, “অনেকবার। দাদুর
সঙ্গে, বিলের সঙ্গে, মাইকের সঙ্গেও বার দুয়েক গেছি। ওখানে প্রচুর পাখি আসে। যারা
পাখি দেখতে চায় তারা ওখানে যায় স্পেশাল পারমিট নিয়ে। মাঝে মাঝে আমরা লোকজনদের নিয়ে
যাই দূর থেকে ওখানকার পাখি দেখাতে। দ্বীপে না নামলে পারমিট লাগে না।”
গল্প করতে করতে ওরা প্রায় যখন
বাড়ি অবধি পৌঁছে গেছে তখন জোনাথন বলল, “কাল তোমাদের সময় থাকলে আমাকে একবার ওই
প্যারট আইল্যান্ডের কাছে নিয়ে যাবে? আমি জায়গাটাকে একটু দেখতে চাই, দ্বীপে যাব না
তাই পারমিট লাগবে না। আমার হাতে দু’দিন সময় আছে!”
শুনে টম বলল, “হ্যাঁ, সে আর
এমন কী ব্যাপার। একটা নৌকা জোগাড় করতে পারলেই হল। আমাদের তো স্কুলের ছুটি, তাই
সময়ের অভাব নেই।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, নৌকার কোনো
সমস্যা হবে না। আমি কালকেই একটা নৌকা ভাড়া করে নেব। সবাই মিলে যাওয়া যাবে।”
বাড়ি ফিরে টম মা’র ফোনটা নিয়ে
সিটি ক্রনিকালে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, জোনাথন পার্কার বলে আপনাদের কোনো
রিপোর্টার আছে?”
ওদিক থেকে উত্তর এল, “হ্যাঁ,
জোনাথন তো আমাদের খুব ভালো রিপোর্টারদের একজন। তবে এখন ও অ্যাসাইনমেন্ট বেরিয়েছে।
ওকে কেন খুঁজছেন চাইলে আমি সাহায্য...”
টম ফোনটা ছেড়ে দিল। সাবধানের
মার নেই বাপু। সব কিছু যাচাই করে নেওয়াই ভালো।
।।
৪ ।।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওরা
শুনতে পেল হুলুস্থুল কান্ড। নোরা ঠিকই দেখেছিল। রবার্ট মেসন বলে একজনের মৃতদেহ
সমুদ্র ফিরিয়ে দিয়েছে। সাগর তটে পাওয়া গেছে তার দেহ।
নোরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই
মাইকদের বাড়িতে পুলিশ এসে হাজির। ও তো ঠিকই দেখেছিল, তাই পুলিশদের ওকে দরকার। পুলিশের
আর্টিস্ট ওর কাছে বিবরণ নিয়ে ছবি আঁকতে চায়। নোরা অবশ্য ওদের বেশ কড়াভাবেই জানিয়ে
দিল যে দাঁত না মেজে, জলখাবার না খেয়ে সে কোথাও যাবে না! তাই শুনে পুলিশের লোকজনের
সে কী হাসি!
নোরার সঙ্গে সঙ্গে ওরা তিনজনও
গেল। ওদের অবশ্য পুলিশ স্টেশনের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হল না। বাইরেই অপেক্ষা করতে
লাগল ওরা। চারিদিকে প্রচুর পুলিশ। এমনিতে ওদের ছোটো জায়গায় এত পুলিশ দেখা যায় না
খুব একটা।
মাইক বলল, “কেন মারা হয়েছে
লোকটাকে সেই নিয়ে কিছু শুনেছিস? আমি তো কিছুই জানি না। ঘুম থেকে উঠে দেখি তিনজন
ষন্ডামার্কা পুলিশ ঘরে বসে রয়েছে। তারা নাকি নোরাকে নিয়ে যাবে! মা-কাকিমা তো ভয়েই
অস্থির!”
টম সকাল থেকে খবরের কাগজ দেখে,
খবর শুনে বোঝার চেষ্টা করেছে। সে বলল, “রবার্ট মেসন, যাকে সবাই বব বলে ডাকত, এক
বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা ভাড়া করে কোন একটা দ্বীপে যাচ্ছিল। খুব সম্ভব গুপ্তধন
উদ্ধার করার পরিকল্পনা নিয়ে। ওরা মনে হয় কোথাও
থেকে একটা ম্যাপ পেয়েছিল! তারপর যা হয়। মনে হয় অর্থের জন্যে দুই বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া
হয়। আর বন্ধু ববকে মেরে গুপ্তধন নিয়ে পালিয়ে যায়! এখন পুলিশ তাকে জোর খুঁজছে বলে
এত পুলিশ।”
শুনে মাইক আফসোস করে বলল,
“যাহ! ওরা তো প্যারট আইল্যান্ডের কাছে ছিল। ওখানে গুপ্তধন ছিল বুঝি! জানতাম না তো!
আমরা তো কাল ওদিকেই গিয়েছিলাম, চাইলে আমরাও চেষ্টা করে দেখতে পারতাম!”
নোয়েল বলল, “পারতে না, পারতে
না! ম্যাপ ছিল না তো তোমাদের কাছে!”
টম বলল, “এখানে আশপাশের অনেক
ক’টা দ্বীপ নিয়েই যে গল্পটা প্রচলিত সেটা হল জলদস্যুরা জাহাজ লুট করে ফেরার সময়
তাদের নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া লেগে যায় কে বেশি অংশ পাবে সেই নিয়ে। তখন কোনো একজন সব
ধনরত্ন নিয়ে কোনো একটা দ্বীপে সেগুলোকে লুকিয়ে ফেলে যে পরে এসে নিয়ে যাবে, কিন্তু
তার পরে আর আসা হয়ে ওঠে না! অনেক সময় তারা হয়তো মৃত্যুশয্যায় কোনো এক বন্ধুকে একটা
ম্যাপ এঁকে দেয় গুপ্তধন কোথায় আছে দেখিয়ে, কিন্তু সেটাও বেশিরভাগ সময় ভুল হয়। যাই
হোক সেই রকমই কোনো ম্যাপ মনে হয় ওদের হাতে পড়ে গিয়েছিল। সেই জন্যেই ওই রবার্ট ওরফে
ববকে প্রাণ দিতে হল। গুপ্তধনের লোভ ভয়ঙ্কর লোভ বাবা!”
“একদম ঠিক বলেছ!” কথা শুনে টম
ফিরে তাকিয়ে দেখল জোনাথন চলে এসেছে।
মাইক বলল, “তুমি খবর শুনেছ?”
“হ্যাঁ, খবর নিয়েই তো আমাদের
কারবার! ও, নোরাকে বুঝি পুলিশ অপরাধীর ছবি আঁকার জন্যে নিয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, আমরা অপেক্ষা করছি ওর
জন্যে। ও বেরোলেই রওনা দিতে পারব। বারবার করে বলে দিয়েছে ওকে ছেড়ে যেন না যাই! তা
নৌকা জোগাড় হয়েছে?”
“হ্যাঁ, বিলি বলে একজনের কাছ
থেকে নিয়েছি একটা নৌকা।”
“সে কী! ভাঙ্গা নৌকাটা নয়
তো?” টম আর মাইক একসঙ্গে বলে উঠল।
“না, না এটা তো মোটরবোট! সাঁ
সাঁ করে যাব আর আসব। কোনো ঝামেলাই নেই! আমার বস এখন আমাকে প্যারট আইল্যান্ডের
কয়েকটা ছবিও তুলে আনতে বলেছেন, তাই এখন আর চিন্তা নেই! যা খরচ হবে সব পেয়ে যাব!”
একটু পরে নোরা বেরিয়ে এল। টম
জিজ্ঞেস করল, “কী রে? কেমন হল? ওরা ঠিকঠিক লোকটার ছবি আঁকতে পারল?”
নোরা ঠোঁট উলটে বলল, “নাহ!
লোকটা ভালো আঁকতেই পারে না! যা বলি তার উলটোটা আঁকে! এমন একটা সরু চোয়াল ছুঁচলো
মুখ লোককে এঁকেছে যে বলবার নয়! ওই ছবি দেখে যদি লোকজন যে মেরেছে তাকে খোঁজার
চেষ্টা করে তাহলে আসল লোক কোনোদিনই ধরা পড়বে না।”
“যাহ! কী হবে তাহলে?”
“কী আর হবে! আবার আঁকবে!
সেটাই ওকে বলে এসেছি। খুব খিদে পেয়েছে যে, যাওয়ার আগে কিছু খেলে মন্দ হত না!”
“চলো আমি খাওয়াচ্ছি!” বলে টম
ওদের সবাইকে হট ডগ আর আইসক্রিম খাওয়াল। ইতিমধ্যে নোরাকে নোয়েল পুরো ঘটনাটা বলে
দিয়েছে।
নোরা তো শুনে বলল, “কী মজা!
আমরা প্যারট আইল্যান্ডে যাচ্ছি গুপ্তধন খুঁজতে!”
মাইক তাই শুনে বলল, “এ বাবা!
সেটা আবার কোথা থেকে শুনলি! জোনাথন দূর থেকে প্যারট আইল্যান্ডের কয়েকটা ছবি তু্লবে
ব্যস। আমাদের কাছে কী আর পারমিট আছে না ম্যাপ আছে যে আমরা গুপ্তধন খুঁজব? এমনিতেও
কাগজে খবরটা বেরোনোর পর কাল থেকে এমন ট্যুরিস্ট আসতে শুরু করবে ওই গুপ্তধনের লোভে
যে আমাদের এদিকে খুব ভিড় হয়ে যাবে। সবাই প্যারট আইল্যান্ডে যেতে চাইবে।”
টম বলল, “না, সেটা হতে দেবে
না পুলিশরা বলেছে। প্যারট আইল্যান্ডের জন্যে পারমিট দেওয়া কিছুদিনের জন্যে বন্ধ
থাকবে। ওখানে বেশি লোক গেলে নাকি পাখিদের কষ্ট হবে। লোকজন যাওয়া মানেই তো আগুন
জ্বালানো, পিকনিক, খাওয়া দাওয়া, নোংরা করা... দ্বীপটা একেবারে তছনছ হয়ে যাবে! সেটা
আটকাবার চেষ্টা হবে।”
জোনাথন শুনে বলল, “বাহ, খুব
ভালো পরিকল্পনা! চলো এবার বেরোনো যাক। নোরা, নোয়েল তোমরা যেতে পারবে তো?
অনেকক্ষণের পথ কিন্তু। আর নোরা তো পুলিশ স্টেশনে এতক্ষণ বসে ছিল, নিশ্চয়ই
ক্লান্ত!”
নোরা বলল, “না, না আমি
ক্লান্ত হইনি! আমি যাব!” নোয়েলও কিছুতেই থাকতে রাজি নয়, তাই ওরা সবাই চলল।
দিনটা সেদিন খুবই ভালো। একটা
ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। আগের দিনটার মতন গুমোট নয়। গান গাইতে গাইতে মজা করতে করতে
ওরা মোটরবোটে করে প্যারট আইল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
টম এবার জোনাথনকে বলল, “আর
কাছে যাওয়া ঠিক হবে না পারমিট ছাড়া। তোমার যা ছবি তোলার তুলে নাও, তারপর আমরা ফিরে
যাব। ফেরার পথে অবশ্য তোমাকে খুলি দ্বীপটা দেখিয়ে দিতে পারি। ওটাতে নামার জন্যে
পারমিট লাগে না।”
“ও বাবা খুলি দ্বীপ! ওই রকম
নাম কেন? ওখানে জলদস্যুদের খুলিটুলি আছে বুঝি?”
“আরে না, না। ওখানে যে
পাহাড়টা আছে সেটাকে দূর থেকে দেখলে খুলির মতন দেখতে লাগে, তাই ওই নাম। কী হল? ছবি
তুলে নাও এবার। আর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না বলছি না।”
“আরেকটু আরেকটু!” জোনাথন বলল,
“এত দূর থেকে সবুজ গাছ ছাড়া কিছুই আসবে না। আমি দুয়েকটা পাখিও ধরতে চাইছিলাম।”
টম গম্ভীরভাবে বলল, “না, আর
কাছে যাওয়া যাবে না। পারমিট ছাড়া এই সাদা বয়াগুলো ছাড়িয়ে যাওয়া বারণ। শক্তিশালী
ক্যামেরা হলে এখান থেকেই পাখির ছবি খুব ভালো ওঠে, আমি দেখেছি!”
হঠাৎ ধাঁ করে একটা ঘটনা ঘটে
গেল। জোনাথন পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করে নোয়েলের মাথায় ঠেকিয়ে বলল, “এবার তো
পারমিট ছাড়া প্যারট আইল্যান্ডে নামা যাবে নাকি? না নামলে এর ঘিলু বার করে দেব! ওই
গুপ্তধন আমার চাই! অনেক দূর এসেছি আমি ওটার জন্যে!”
টম আর মাইক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
গেল। এই রকমটা ওরা আশা করেনি মোটেই। ওরা ভেবেছিল জোনাথন ভালো লোক! হাজার হোক
রিপোর্টার তো সে! নোরা হঠাৎ বলে উঠল, “বুঝতে পেরেছি! তুমিই সেই লোক! কাল আমি
মেলাতে তোমাকে চিনে ফেলে চিৎকার করে সবাইকে বলে দিয়েছিলাম বলে তোমাকে দাড়ি গোঁফ
লাগাতে হয়েছে! সেই জন্যেই আমি তোমাকে চিনতে পারিনি! তুমিই ওই ববকে মেরেছিলে! আমি
তোমাকেই দেখেছিলেম!”
জোনাথন একটা ক্রূর হাসি হেসে
বলল, “ঠিক বলেছ খুকুমণি! আমিই সেই লোক। গুপ্তধনের ম্যাপটাও আমার কাছে আছে। তোমরা
আমাকে গুপ্তধন খুঁজে বার করতে সাহায্য করবে, কেমন? না হলে তোমার ভাইটিকে ববের কাছে
পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব!”
টম আর মাইকে চোখাচোখি হল। কোনো
উপায় নেই আর। প্যারট আইল্যান্ডে নামতেই হবে। টম আর মাইক দুজনেই ওস্তাদ নৌকাচালক, তাই
খুব সহজেই দ্বীপে নৌকা নিয়ে গিয়ে তুলল। প্যারট আইল্যান্ড অসাধারণ সুন্দর। সাদা
বালির চর, ঘন সবুজ গাছপালা আর সেই সব গাছে এসে বাস করে নানা রঙের অদ্ভুত সুন্দর
দেখতে সব পাখি। তাদের কলরবে চারিদিক মুখর হয়ে থাকে। এমন সুন্দর দ্বীপ খুব কম আছে
নাকি পৃথিবীতে। বিল বলে, মানুষের থাবা পড়েনি বলেই ভালো আছে। যেদিন পারমিট দেওয়া
বন্ধ করে সবাইকে যেতে দেবে সেদিনই শেষ হয়ে যাবে সব!
“তোরা তো আগেও এসেছিস অনেকবার,
তাই এবার আমাকে এই ম্যাপ দেখে গুপ্তধনের কাছে নিয়ে চল,” জোনাথন বলল।
পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার
করে ওদের সামনে মেলে ধরল সে। হলদেটে কাগজে নীল কালি দিয়ে প্যারট আইল্যান্ডের ম্যাপ
আঁকা আর দ্বীপের ম্যাপের মাঝখানটায় একটা এক্স চিহ্ন দেওয়া। এ ছাড়া ম্যাপটার বাইরে
শুধু প্যারট আইল্যান্ড লেখা ছাড়া অন্য কোনো কিছু লেখা নেই।
“কাল ববকে জলে ফেলে আর একা
একা কিছু করতে সাহস করিনি। আমি তো আর দ্বীপটা চিনি না তেমন। ভাড়া করা নৌকাটা
ফিরিয়ে মেলা দেখতে ঢুকেছি, ওমা, এই মেয়ে আমাকে দেখে চেঁচাতে শুরু করল! যাই হোক,
সেই সুযোগে তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তোমরা দ্বীপটাকে চেনো। ম্যাপে যেখানে এক্স
লেখা সেই জায়গাটায় নিয়ে যেতে হবে আমাকে। গুপ্তধন পেয়ে গেলে আমি নোয়েলকে ছেড়ে দেব,
কথা দিচ্ছি!”
টম বলল, “নাহ, তোমার কথার কোনো
দাম নেই। গুপ্তধন পেলে তুমি যে আমাদের মেরে ফেলবে না সেটা তো আমরা জানি না! তুমি
একজনকে তো মেরেছ এটার জন্যে, আমাদেরও মেরে ফেলতেই পারো।”
জোনাথন হা হা করে হেসে বলল,
“আরে বব ছিল ছিঁচকে চোর! ম্যাপটা ওই মিস্টার ফুমিয়াকার ওখান থেকে চুরি করেছিল। একা
আসতে পারবে না বলে আমাকে সঙ্গে নিয়েছিল। আমি ওকে না মারলে ও আমাকে মারত! আর তোরা
তো ছুঁচো! তোদের মেরে আমি হাত গন্ধ করতে চাই না মোটেই!”
“ঠিক আছে তোমাকে নিয়ে আমরা যাচ্ছি
গুপ্তধনের ওখানে, তবে সেটা পেলে আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। আমরা কাউকে কিছু বলব না।
তাছাড়া বলেও তো লাভ হবে না কিছু, কারণ তুমি পালিয়ে যাবে আর তোমার আসল নামও তো আমরা
জানি না। তুমি সিটি ক্রনিকালের জোনাথন নয় সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে!”
“হা, হা, খুব বুদ্ধি তোর!
জোনাথন অ্যাসাইনমেন্টে গেছে মিডিল ইস্টে সেটা আমি জানতাম। তাই ওর ছদ্মবেশ ধরে নিতে
অসুবিধা হয়নি! হ্যাঁ, গুপ্তধন পেলে আমি হাওয়া হয়ে যাব। একেবারে যাকে বলে ভ্যানিশ!
তাই আমার নাম জেনে আর কাজ নেই। ভয় নেই তোদের কোনো ক্ষতি হবে না!”
নৌকা থেকে নেমে চিকচিকে সাদা
বালির ওপর দিয়ে ওরা এগিয়ে চলল। একটু পরেই বালি শেষ হয়ে জঙ্গল এলাকা শুরু হল। টমের
পকেটে ছোটো পকেট নাইফ থাকে। প্রথমে এগিয়ে গিয়ে সেটা দিয়ে জঙ্গলের গাছপালা কেটে
কেটে সরিয়ে দিচ্ছিল সে যাতে অন্যদের অসুবিধা না হয়।
“তুই ঠিক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিস
কিনা কী করে বুঝব?” ‘জোনাথন নয়’ লোকটা বলল।
“ওই ক্রসটা দ্বীপের মাঝামাঝি
জায়গায় রয়েছে। সেখানেই যাচ্ছি আমরা।”
মাইক হঠৎ বলল, “গুপ্তধন যদি
মাটির নিচে থাকে তাহলে তো খোঁড়ার জন্যে কিছু লাগবে।”
“দশ জোড়া হাত রয়েছে তাই দিয়েই
হবে!”
“সাবধানে পা ফেলবে সবাই।
এখানে সাপও আছে!” টম সবাইকে সাবধান করে দিল।
লোকটা হ্যা হ্যা করে হেসে
বলল, “আমি কিন্তু সাপে ভয় পাই না! আর আমার কাছে রিভলভার রয়েছে। সাপের মাথা থেঁতলে
দিতে যথেষ্ট।”
যদি ওই রকম অবস্থাতে না আসতে
হত তাহলে দারুণ একটা অভিযান হত ওদের। কত রকমের পাখি, তাদের রকমারি সব ডাক। ফুরফুরে
হাওয়া দিচ্ছে, চারিদিকে ঘন সবুজ, সব কিছুই খুব সুন্দর কিন্তু প্রাণ নিয়ে বাড়ি
ফিরতে পারবে কিনা সেই ভয়ে ওরা আর কিছুই উপভোগ করতে পারছিল না।
“দ্বীপের মাঝখানে এসে গেছি
আমরা!” টম ফিসফিস করে বলল।
“অত আস্তে কথা বলার কী আছে?”
“তেষ্টায় গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে
না যে,” টম আবার ফিসফিস করে বলল। লোকটা নোয়েলের মাথা থেকে বন্দুকটা অল্প সরিয়ে
নিয়ে মাটিটা দেখতে লাগল। মনে হয় কোন জায়গাটা খুঁড়বে সেটাই ভাবছিল। মাটিতে একটা নাম
না জানা বড়ো ফল পড়ে ছিল। টম ঝট করে সেটাকে তুলে নিয়ে কাছের একটা গাছকে টিপ করে
দমাস করে মেরেই ‘পালা’ বলে চিৎকার করল। ওর কথায় বাকি তিনজন ছুটতে শুরু করল। ‘জোনাথন
নয়’ লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাছ থেকে দুটো বিশাল লাল, হলুদ, নীল মেশানো রঙিন
ম্যাকাও বেরিয়ে এসে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! রিভলভারের গুলি চালাল লোকটা কিন্তু
পাখিদের আক্রমণে ফসকে গিয়ে গুলিগুলো এলোপাথারি হয়ে গেল। তার মধ্যে একটা টমের প্রায়
পা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ম্যাকাওদের বেঁকানো ধারালো ঠোঁট ‘জোনাথন নয়’-কে
কাবু করে ফেলল। তাদের সঙ্গে পেরে উঠল না বদমাইশ লোকটা। তার
হাত থেকে বন্দুক পড়ে গেল। চিৎকার করতে লাগল সে। ওরা চারজন আর কিছু না দেখেই
প্রাণপণে ছুটতে লাগল। নৌকা অবধি এসে হুড়মুড় করে তাতে চড়ে জলে ভাসিয়ে দিল। দ্বীপ
থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তবে শান্তি।
নোয়েল আর নোরা তো ভয়ে চুপ করে
বসেছিল। টম মুখ খুলে বলল, “মিস্টার ফুমিয়াকাকে আমার মনে আছে। গত বছর আমি আর বিলই
ওনাকে প্যারট আইল্যান্ড অবধি নিয়ে এসেছিলাম। উনি পাখির ছবি তুলতে এসেছিলেন। ন্যাশানাল
জিওগ্রাফিকে ছবি বের হয় ওনার। ম্যাকাওদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিল ওনার কিন্তু পাননি। ম্যাকাওরা
এমনিতে কিছু করে না তেমন। খুব শান্তিপ্রিয় পাখি। কত লোকে পোষে তো, কিন্তু এই সময়টা
ওরা ডিম পাড়ে। এখন ওদের বিরক্ত করলে আর রক্ষে নেই। সেই জন্যেই আমি ফিসফিস করে কথা
বলছিলাম। এখানে আসার পারমিট নিলে ওরা বলে দেয় সেই সব যে এখন ওরা ডিম পেড়েছে, এখন
ওদের কাছে যাবেন না। মিস্টার ফুমিয়াকা সেই জন্যে ওই ম্যাপে দাগ কেটেছিলেন যে পরে
এসে ওদের দেখে যাবেন। ওই দুই বুদ্ধু ভেবেছে ওটা গুপ্তধনের ম্যাপ, তাই সেটাকে চুরি
করে এত কান্ড!”
নোয়েল ভয়ে ঝিমিয়ে ছিল, খিদে
পেয়েছে বলতেও ভুলে গিয়েছিল। এবার বলল, “ও আমাদের পিছনে আসবে না তো?”
মাইক হেসে বলল, “দূর বোকা,
কোথা থেকে আসবে! ম্যাকাওরা এতক্ষণে ওকে কিমা বানিয়ে ফেলেছে আর যদি ওদের হাত থেকে
পালাতেও পারে তাহলে নৌকা তো নেই! আমরা তো নৌকা নিয়ে পালিয়েছি। এবার ফিরে গিয়ে
পুলিশকে বলে দেব সব কথা। ওরা এসে উদ্ধার করুক!”
ওর কথা শুনে নোয়েল আর নোরার
মুখে এবার হাসি ফুটল। নোয়েল বলল, “বড্ড খিদে পেয়েছে যে!”
“এই নে আপেলটা খা! বাড়ি ফেরা
পর্যন্ত আর কিছু খেতে চাইবি না বলে দিচ্ছি!” টম পকেট থেকে আপেল বার করে ওর হাতে
দিয়ে হেসে বলল।
* * *
পরে ওরা জেনেছিল যে ‘জোনাথন
নয়’ আসলে হ্যারি নামের একজন। মিস্টার ফুমিয়াকার বাড়িতে কাজ করত ওর বন্ধু ওই বব।
মিস্টার ফুমিয়াকার শরীর খারাপের সুযোগ নিয়ে সে বেশ কিছু অর্থ আর ম্যাপ চুরি করে
এবং বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে গুপ্তধন খুঁজবে বলে। চুরি করা অর্থ দিয়ে বড়োসড়ো একটা
নৌকা ভাড়া করে প্যারট আইল্যান্ডের জন্যে রওনা হয় দু’জনে। তারপরই অবশ্য কে
গুপ্তধনের বেশি অংশ পাবে সেই নিয়ে দুই বন্ধুতে ঝগড়া হয় এবং ববকে মরতে হয় হ্যারির
হাতে। নোরা দেখে ফেলে সেটা এবং মেলায় হ্যারিকে দেখে চিনতে পেরে চিৎকার করে। তখন
দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে ছদ্মবেশ ধরে আর নানান ফন্দি করে টমের সাহায্যে প্যারট আইল্যান্ডে
যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলে হ্যারি। ম্যাকাওদের ঠোঁটের আঘাতে সাংঘাতিক ক্ষত বিক্ষত
অবস্থায় প্যারট আইল্যান্ড থেকে উদ্ধার করা হয় হ্যারিকে। এখন সে জেলের হাসপাতালে
ভর্তি। তার চিকিৎসা চলছে।
মাইক অবশ্য টমকে পরে মজা করে বলেছিল,
“ওই হ্যারি লোকটা যখন রিভলভার থেকে গুলি করছিল তখন আমার বেজায় ভয় করছিল। একটা গুলি
তো তোর পায়ে লেগেই যাচ্ছিল প্রায় তুই সবার পিছনে ছিলি বলে। তারপর মনে হল তুই
যতক্ষণ আমাদের সঙ্গে রয়েছিস ততক্ষণ আমাদের কিছু হবে না! তোর না বেড়ালের মতন অনেক ক’টা
প্রাণ! তোর সঙ্গে থেকে থেকে আমারও মনে হয় সেই রকম হয়ে যাচ্ছে!”
_____
ছবিঃ সুমিত রায়
দারুণ
ReplyDeleteভালো লাগলো
ReplyDeleteকী অসাধারণ লিখেছেন অনন্যা-ম্যাডাম! গল্পের মধ্যে এমন ভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে,শেষপর্যন্ত না গিয়ে থামতে পারিনি! আমার স্কুল-জীবনে "চাঁদের পাহাড়" পড়ে যেমন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলা,তেমনই ঘোরের মধ্যে আছি এখন ম্যাম। আশ্চর্য উপস্থাপন! টম,মাইক, নয়েল, নোরা...সব ক'জনকে যেন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে! আপনার জাদু-লেখনীই পারে এমন এক গল্প রচনা করতে! আমার তরফে আপনার এমন শারদ উপহারের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা অন্তহীন।
ReplyDelete