
তন্ময় ধর
“পাপা, দ্যাখো কী সুন্দর
পাখিটা জানালায় এসে বসেছে! কী নাম ওর?”
“ওর নাম তুলোফুটকি।”
“বাহ। কী সুন্দর নাম! আমায়
তুলোফুটকি নামে ডাকতে পারো না?”
“বেশ। আজ থেকে তোকে
তুলোফুটকি নামেই ডাকব।”
আমাদের খুকি তুলোফুটকির
কোনো অস্তিত্বই ছিল না। মাতৃগর্ভেই মৃত্যু হয়েছিল ওর। কিন্তু ভোরের প্রথম
আলোকবিন্দু এসে আমাদের ঘরের জানালা ছোঁয়, একটা শিশু তুলোফুটকি পাখি যখন ডেকে ওঠে,
ভৈরবী রাগিনীর প্রথম কান্না এসে আমাদের ভোরের আধেকলীন স্বপ্নের প্যাথোস যখন ভিজিয়ে
দিয়ে যায়, ঠিক সেই সময় ও এসে হারিয়ে যাওয়া উষামানবীদের কথা শুনতে চায়।
ঝাপসা চোখে ওর ছোট্ট আঙুল
ধরে আমি হাঁটতে থাকি প্রাচীন এক পৃথিবীর মরুপর্বতময় প্রত্নস্থলে হারিয়ে যাওয়া
উষামানবীদের পায়ের চিহ্ন ধরে।
“আজ আমরা কোথায় যাব, পাপা?”
ভোরের আলোর মতো ল্যাপটপের ওপর ঝুঁকে পড়ে তুলোফুটকি।
“আজ আমরা যাব মধ্য এশিয়ার
একটু পশ্চিমে। কৃষ্ণসাগর আর ক্যাস্পিয়ান সাগরের মাঝে একখন্ড তৃণভূমির মধ্যে হারিয়ে
পাওয়া দমানিসি মানবীর খোঁজে...”
“দমানিসি! এ আবার কেমন নাম?
কেমন যেন অমানিশি টাইপের...”
“সেইজন্যেই তো ওকে নিয়ে
সেকালের কবিরা কবিতা লিখেছেন -
দমানিসি কিশোরী সে অমানিশি পেরিয়ে
পৃথিবীর রূপকথাদের সীমা এড়িয়ে
ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে ও চলতে
ভুলে গেছে কোন কথা রেখে যাবে
বলতে...”
“ওরা কি বাংলা জানত নাকি?”
“না। তবে ওঁরা অস্ফুট
ভাষায় যা বলতেন তা অনুবাদ করলে অমনই দাঁড়ায়। সে থাক, চল তুলোফুটকি, আমরা এখন ঠিক
সেই জায়গাটায় যাব ঠিক যেখানে দমানিসি কিশোরীকে পাওয়া গিয়েছিল। দ্যাখ, কত নীল আকাশ
এখানে! এপ্রিল মাসেও কেমন মিহি তুষারের কণা ছড়িয়ে আছে! গতকালই তুষারপাত হয়েছে। এই
যে, এই প্রত্নস্থলেই দমানিসি কিশোরীর মাথার খুলিটা পাওয়া গিয়েছিল। ওর দাঁত দেখে
বিজ্ঞানীরা বলছেন মাত্র তেরো বছর বয়সে ওর মৃত্যু হয়েছিল, আজ থেকে আঠারো লক্ষ বছর
আগে। কিন্তু কেন যে মাত্র তেরো বছরেই ওর মৃত্যু হয়েছিল, সেটা জানা যায়নি। চল,
জর্জিয়া ন্যাশনাল মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে আসি, দমানিসি কিশোরীকে ঠিক কেমন দেখতে ছিল।
জর্জিয়া আর ফরাসী প্রত্নবিজ্ঞানী আর শিল্পীরা বহু বছরের পরিশ্রমে দমানিসি কিশোরীর
কী সুন্দর মূর্তি বানিয়েছে, দ্যাখ...”
“আহা গো! কী সুন্দর
মেয়েটা! মাত্র তেরো বছরেই এমন রূপকথানীল আকাশের নিচের এমন সুন্দর দেশ ছেড়ে অজানার
দেশে চলে গেল?”
“সে তো তুইও চলে গিয়েছিস,
মাত্র ক’মাসেই। এই পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য্য দেখিসইনি...”
“আমার কথা আলাদা। আমি তো
ভোরের পাখির গান হয়ে, প্রভাতকল্পার আলো হয়ে ফিরে ফিরে আসতে পারি। তুমি দমানিসি কিশোরীর
গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করো...”
“দমানিসি কিশোরীর জীবাশ্ম
যখন আবিষ্কৃত হল, তখন তার জাতিপরিচয় এবং সময়কাল নির্ধারণ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন
বিজ্ঞানীরা। কার্বন-ডেটিং করে ওর সময়কাল যেটা দাঁড়াচ্ছে, সে সময়ের মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে
মিলছে না। আবার ওর চেহারাও আশেপাশের অঞ্চলের হোমো ইরেক্টাস গোষ্ঠীর সঙ্গে খাপ
খাচ্ছে না। নতুন এক প্রজাতির প্রস্তাব দিলেন বিজ্ঞানীরা - হোমো স্যাপিয়েন্স
জর্জিকাস। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়ল না। কেউ বললেন, দমানিসি কিশোরী আসলে হোমো
এর্গাস্টার, কেউ বললেন বিশুদ্ধ হোমো ইরেক্টাস, কেউ বললেন আদিম হোমো হ্যাবিলিস এবং
হোমো ইরেক্টাসের মিশ্র প্রজাতি। কেউ বললেন, ও নাকি ছোট্ট বয়সেই বাবা-মায়ের সঙ্গে
বহু পথ পাড়ি দিয়ে সুদূর আফ্রিকা থেকে এই মধ্য এশিয়ায় এসেছে...”
“তাহলে ওর দাদু-দিদিমা
নিশ্চয় আফ্রিকায় রয়েছে?”
“হ্যাঁ। রয়েছে তো। অনেক
পুরোনো। ৩২ লক্ষ বছরের পুরোনো দিদিমা। তার নাম লুসি...”
“কাল সে গল্প শুনব। আজ
আসি। বেলা হয়ে গেলে এমন চড়া রোদ্দুরে প্রাগিতিহাসের গল্পের মজা ঠিক জমে না।”
প্রত্নমানবী লুসির ভিডিও
জোগাড় করে পরদিন প্রভাততরল আলোয় ল্যাপটপ খুলে বসলুম। তুলোফুটকি হেসে বলল, “পাপা,
প্রাগিতিহাসের গল্প গরম কফি আর পেস্তা ক্রিম বিস্কুট ছাড়া ঠিক জমে না। আমার তো মুখ
নেই। তুমি খাও, খেতে খেতে গল্প বলো। তাহলেই আমি মজা পাব। আর ল্যাপটপে
ব্যাকগ্রাউন্ডে সরোদে ভৈরব রাগিনী চালিয়ে দাও।”
আমরা পিতা-কন্যা হেঁটে
চললাম ইথিওপিয়ার প্রত্নস্থলে। প্যালিওলিথিক সূর্যের স্নিগ্ধ আলো মাখা এক ভোরের
রাস্তায় আমি কাহিনি বলে চললুম – “১৯৭৬ সালে এই
হাদার প্রত্নস্থলেই আবিষ্কৃত আদিমানবীর জীবাশ্ম আলোড়ন ফেলেছিল প্রত্নবিদমহলে। জীবাশ্মের
নাম রাখা হয়েছিল ‘লুসি’। স্থানীয় আমহারিক ভাষায় যার অর্থ ‘তুমি বিস্ময়কর’। মানব
বিবর্তনের ইতিহাসে এত বিখ্যাত বোধহয় আর কোনো জীবাশ্ম হয়নি। পৃথিবীর প্রান্তে
প্রান্তে লুসির প্রতিরূপ নিয়ে অনেক প্রদর্শনী হয়েছে, বই লেখা হয়েছে। খুব অল্প
সময়ের মধ্যে ঘরে ঘরে সুপরিচিত নাম হয়ে গিয়েছে লুসি। লুসি ‘অস্ট্রালোপিথেকাস
আফারেনসিস’ গোষ্ঠীরই সদস্য। আর্গন-আর্গন ডেটিং পদ্ধতিতে লুসির বয়স নির্ধারিত হয়েছে
প্রায় ৩২ লক্ষ বছর। প্রায় কয়েকশো হাড়ের টুকরো পাওয়া গিয়েছে লুসির। মাথার খুলির প্রায়
৪০ শতাংশ এবং সমস্ত দাঁতসহ নিচের চোয়াল পাওয়া গিয়েছে। লুসির দেহ পুনর্নির্মাণ করে
পুরাতত্ত্ববিদেরা বলছেন যে, লুসির পাকস্থলী ছিল বিশালাকৃতি এবং সে প্রচুর পরিমাণে
শাকপাতা জাতীয় খাবার খেত। তার শরীরের রক্তপ্রবাহের ৬০ শতাংশ ব্যয়িত হত শুধু
পৌষ্টিকতন্ত্রেই। মস্তিষ্কে ১০ শতাংশের বেশি রক্ত পৌঁছাত না, তাই মস্তিষ্কের তেমন
বিকাশ হয়নি। বারো বছর বয়সে গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে লুসির মৃত্যু হয়।”
“গাছ
থেকে পড়ে মৃত্যু হল? কেউ বাঁচাতে পারল না?”
“হ্যাঁ,
ইতিহাস ওকে বাঁচিয়ে রাখল তো। হাদারের জল-বাতাস-ভূপ্রকৃতি সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে ওর
জীবাশ্ম। ওর বাবা-মা-ভাই-বোনের দেহাবশেষ হারিয়ে গিয়েছে কবেই।”
টুপ করে
ভোরের শিশিরের মতো জল গড়িয়ে পড়ে তুলোফুটকির চোখ থেকে। বত্রিশ লক্ষ বছর আগের এক
মায়াময় শস্যশ্যামলা পৃথিবীর পথে পথে ঘুরতে লাগল ওর কল্পনা।
পরদিন
ভোরে একটা পার্পল সূর্যপাখি এল তুলফুটকির সঙ্গে গল্প শুনতে।
“আজ
আমরা স্টার্কফন্টেন গুহার ‘ছোট্ট পায়ের মেয়ে’-র গল্প শুনব। অস্ট্রালোপিথেকাস
গোষ্ঠীর যত জীবাশ্ম আজ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে এই ছোট্ট পায়ের মেয়ের
জীবাশ্ম সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ। তবে সব হাড়গুলো পাথরের মধ্যে একেবারে আষ্টেপৃষ্টে
আটকানো ছিল, বিজ্ঞানীরা বহু পরিশ্রমে সেগুলো উদ্ধার করেন। ছোট্ট পায়ের মেয়ের হাত ও
পায়ের হাড়ের গঠন দেখে বোঝা গিয়েছে যে, ও সোজা হয়ে হাঁটতে পারত। তবে ও রাতে মাটিতে
শুয়ে ঘুমোত না, গাছে শুয়েই ঘুমোত। সম্ভবত গাছেই লতাপাতা দিয়ে চমৎকার এক বিছানা তৈরি
করে নিয়েছিল। ফলমূল আর উদ্ভিজ্জ খাবারই খেত ছোট্ট পায়ের মেয়েটা...”
“ওকে
নিয়ে অস্ট্রালোপিথেকাস কবিরা কবিতা বানায়নি?”
“হ্যাঁ।
বানিয়েছে তো। কী যেন লাইনগুলো... হ্যাঁ... মনে পড়েছে -
ছোট্ট পায়ের
মেয়ে
আকাশপানে চেয়ে
রূপকথাদের ঘুম
ভাঙিয়ে
ফুলের রঙে সব
রাঙিয়ে
চলছে যে কোন
স্বপ্নতরী বেয়ে
আরও
বানিয়েছে -
না-ফোটা তার
কথার ঠোঁটে
সব কাননে কুসুম
ফোটে
না-গাওয়া তার
গানের সুরে
যুগ পেরিয়ে অনেক
দূরে
জাগবে সবাই তারই
পরশ পেয়ে
ছোট্ট পায়ের
মেয়ে...”
ছড়া
শুনে তুলোফুটকি হাততালি দিল, আর পার্পল সূর্যপাখিটা ডেকে উঠল খুব জোরে।
পরদিন
সকালে আর্ডির গল্প শোনাতে শুরু করলাম তুলোফুটকিকে – “ইথিওপিয়ার আবাশ নদীর ধারে
শুকনো জমিতে আর্ডির হাতের হাড়ের টুকরো খুঁজে পেয়েছিলেন এক কলেজ ছাত্র ইয়োহান্নেস।
পরে বিজ্ঞানী টিম হোয়াইট জীবাশ্মের অন্যান্য অংশগুলি খুঁজে পান এবং বিজ্ঞানী আওয়েন
লাভজয় সেই প্রত্নমানবীর পুনর্নির্মাণ করেন। তার বিজ্ঞানসম্মত নাম রাখা হল
‘আর্ডিপিথেকাস রামিডাস’, স্থানীয় ইথিওপিয়ান ভাষায় তার অর্থ ‘ভূমিচারী শিকড়’, সে
শিকড় মানব বিবর্তনের। ডাকনাম ‘আর্ডি’। বিস্তর চর্চা হয়েছে আর্ডির জীবাশ্ম নিয়ে।
আর্ডির জীবনচর্চারও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তার দৈহিক উচ্চতা ছিল ৩ ফুট ১১ ইঞ্চি,
ওজন ছিল প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম। পায়ের আঙুলের হাড়ের গঠন দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সে
মাটিতে হাঁটতে যেমন স্বচ্ছন্দ ছিল, তেমনি ছিল গাছে চড়তে ওস্তাদ। দাঁতের এনামেল
দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, আর্ডির মূল খাদ্য ছিল ফল এবং দানাশস্য। আর্ডির চেয়ে পুরোনো
তোর কোনো দিদি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি। ওর বয়স ৪৪ লক্ষ বছর।”
“যাহ!
গল্প ফুরিয়ে গেল। আর কোনো দিদি নেই? কাল তাহলে আমি কী শুনতে আসব?”
“আগামীকাল...
খুঁজে দেখি... যদি কিছু পাই...” ভোরের হাওয়ার সামান্য স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে আমি
জিজ্ঞাসা করি, “আচ্ছা, তুই ডেনীর গল্প তো শুনিসনি, না?”
“না।
কাল তাহলে ডেনীর গল্প। আর
ব্যাকগ্রাউন্ডে বিভাস রাগ বাজাবে। আজ এলাম তাহলে...”
পরদিন
সকালে সাইবেরিয়ার আলতাই পাহাড়ে ডেনিসোবা গুহায় এলাম ডেনীর খোঁজে। চারদিকে বরফ আর
বরফ। তুলোফুটকি বলল, “আমি ডেনীর সঙ্গে স্নো বল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলব। কোথায় লুকিয়ে আছে
ও?”
ডেনীর
ইতিহাস লুকিয়ে ছিল বরফের তলায়। মানব বিবর্তনের ইতিহাসে এই নব্বই হাজার বছরের পুরোনো
বালিকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মা ছিল নিয়ান্ডারথাল জনগোষ্ঠীর আর বাবা ছিল
ডেনিসোবানিয়ান জনগোষ্ঠীর। ২০১২ সালে ডেনীর জীবাশ্ম আবিষ্কার হওয়ার পর সুবিখ্যাত
ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিট্যুটে ওর জিন নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে।
“পাপা,
ডেনীকে নিয়ে কেউ ছড়া লেখেনি?”
“নিশ্চয়
লিখেছে -
আমাদের ছোটো
ডেনী
দুলিয়ে দুলিয়ে বেণী
খেলা করে সুগভীর
বরফে
ছোট্ট ছোট্ট
পায়ে
পৃথিবীর
আলো-ছায়ে
লেখে ইতিহাস নয়া
হরফে
আমাদের তরফে।
মাত্র
তেরো বছর বয়সে ডেনীর মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি...”
“ডেনীর
কোনো মূর্তি বানায়নি বিজ্ঞানীরা?”
“মূর্তি
তো তার খুঁজে পেলুম না। তবে বিজ্ঞানীদের রিকনস্ট্রাকশনের ওপর ভিত্তি করে শিল্পীরা
ছবি এঁকেছেন। এই দ্যাখ সেই ছবি...”
“ওয়াও।
কী সুন্দর গোলাপী রঙ! কিন্তু ওর চুলে তো বেণী বাঁধা নেই!”
“হুম,”
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, “শিল্পীরা নিজের খেয়ালে চলেন। কবিদের সঙ্গে কনসাল্ট করেন না
বলেই অনেক ইতিহাস ফসকে যায়...”
“পাপা,
ওই ছবিটা কার? কী সুন্দর দুধে-আলতা রঙ! ও কি ডেনীর বোন নাকি?”
“মাসতুতো
বোন বলতে পারিস। ও জিব্রাল্টারের গুহায় হারিয়ে গিয়েছিল...”
“তবে যে
তুমি বলছিলে, আর গল্প নেই? কাল আসব এই দুধে-আলতার গল্প শুনতে। ছড়া আর ছবি জোগাড়
করে রেখো। ব্যাকগ্রাউন্ডে আশাবরী আর ভৈরবী মিশিয়ে বাজাবে। আজ চললুম।”
পরদিন
ভোরের হাওয়ার মতো এসে তুলোফুটকি প্রথমেই আবদার করল, “আগে ছড়াটা শোনাও। তারপর
গল্প...”
“বেশ।
তাই হবে। নিয়ান্ডার্থাল কবিরা খুব দুঃখমেশানো ছড়া লিখেছিল ওকে নিয়ে -
এই তো জীবন ওরে
দুধে-আলতা
আজ যা আছে, নেই
দেখ আর কাল তা!
এই তো জীবন ওরে
সুলোচনা
কার সাথে আর কী
করবি আলোচনা?
ও ঠোঁটের হাসি
আর ও চোখের ভাষাতে
ইতিহাস লেখা হয়ে
থাক নয়া আশাতে
যে কাল ফুরোলো,
যা রয়ে গেল বাকি
তোর হাতে বেঁধে
দিই সে কালের রাখী।”
“কেন?
এত দুঃখ কেন?”
“তখন
পৃথিবী থেকে গোটা নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতিই অবলুপ্ত হতে চলেছে। ক্রোম্যাগনন,
ডেনিসোভান ইত্যাদি গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে না পেরে আইবেরিয়ান
উপদ্বীপের একপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। মৃতের উদ্দেশ্যে ফুল দেওয়া, খাবার দেওয়া,
মাতৃ-উপাসনা, ছবি আঁকা, গয়না তৈরি ইত্যাদি আরো কত কী উদ্ভাবন করে মানব বিবর্তনের
ইতিহাস সমৃদ্ধ করে তারা নিজেরাই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে সে সময়।
নিয়ান্ডার্থাল কবিরা তখন উদাস হয়ে ভূমধ্যসাগর তীরে বসে দেখছে, বালুকাবেলায় পায়ের
চিহ্ন মুছে দিচ্ছে ঢেউ। দুধে-আলতা মেয়েটি ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে অস্ফুট ভাষায় ওদের
প্রবোধ দিত - সব ঠিক হয়ে যাবে...”
“তারপর?”
“ঠিক আর
হল না সব। পৃথিবী আরও উষ্ণ হল, খাবারের অভাব হল, যুদ্ধ হল। আস্তে আস্তে পায়ের
চিহ্ন মুছে গেল ওদের। সে সব দেখার আগে গুহার অন্ধকারে পথ হারিয়ে মৃত্যু হল
দুধে-আলতার...”
তুলোফুটকির
কান্নার মতো টুপ টুপ করে ঝরতে লাগল ভোরের শিশির। পৃথিবীর কোমলতম সেই শব্দের সামনে
থেকে আমিই হারিয়ে গেলাম এক সময়।

ছবিঃ অতনু দেব
No comments:
Post a Comment