
(একদম ছোটো
শিশুদের জন্য, যারা এখনও যুক্তাক্ষর পড়তে পারে না)
রম্যাণী গোস্বামী
।। এক।।
বি ফর বাঘুমামা
তুবড়িকে বাড়িতে সবাই ডাকে
তুবু বলে। ও এখনও এ-বি-সি-ডি পড়তে শেখেনি ভালো করে। এ ফর অ্যাপেল নয়, ও বলে, এ ফর
আম। বি ফর ব্যাট নয়, ও বলে, বি ফর বাঘুমামা। তুবু যেখানে থাকে সেটা শহর হলেও তার চারপাশে গভীর বন। তা
একদিন শীতের রাতে পাড়ার সকলে বলল, বাঘ এসেছে! বাঘ এসেছে! ঐ যে একতলা বাড়িটার টিনের
চালে দ্যাখা গিয়েছে বাঘের চকচকে গা। তাতে চকরা বকরা ছোপ ছোপ। শুনে মনে
মনে খুব ভয় পেলেও তুবুর ভারি সাধ হল বাঘুমামাকে নিজে গিয়ে দেখে আসার। আলো হাতে
বাবাই গেল। কাকাই গেল। ওরা তুবুকে নিল না। এদিকে অত লোকজন আর ভিড় আর আওয়াজে তো
বাঘুমামা নিজেই খুব ভয় পেয়ে গ্যাছে। অচেনা অজানা জায়গা। পালানোর পথ পায় না বেচারি।
শরীরটা ছোটো করে গুটিয়ে বাঘুমামা তখন একটু আড়াল খুঁজছে। তারপর বন বিভাগের লোক এল
খাঁচা নিয়ে। ঘুমপাড়ানি মাসি পিসির গান নয়, সত্যিকারের ‘গান’ দিয়ে ঘুমপাড়ানি গুলি
মেরে বাঘুমামাকে ওরা নিয়ে গেল। সব কথা শুনে তুবুর ভারি দুঃখ হল বাঘুমামার জন্য।
পরে যখন বাবাই বললেন যে ওরা ওকে বনে ছেড়ে দিয়ে আসবে, তখন তুবুর মনটা আরাম পেল।
বাবাই একথাও বললেন যে বড়োরা বনের সব গাছ কেটে ফেলছে। তাই বনের জীব বাইরে বেরিয়ে
শহরে চলে আসছে। তুবু এখন ঠিক করেছে ও যখন বড়ো হবে তখন ও একটাও গাছ কাটবে না। বরং
অনেক অনেক গাছ পুঁতবে।
।। দুই।।
তুষার-বাড়ি
টিনি
যখনই ওর মায়ের কাছে যায়, দেখে মা একমনে খুব জরুরি কোনও কাজ করছেন অথবা মোবাইলে
খুটখুট করছেন। বাবার মুখের সামনে সবসময় ল্যাপটপ খোলা। দাদাই পড়াশোনা, টিভি দেখা
নয়তো ফুটবল খেলা নিয়ে মেতে আছে। টিনি এবার যায় কোথায়? মুখ ভার করে টিনি তাই ছবি
আঁকার খাতার পাতাগুলোতে মোম রং দিয়ে হিজিবিজি আঁকে। তাড়াতাড়ি পাতা ফুরিয়ে যায় বলে
মা বকেন। বাবা বকেন। বকা খেয়ে টিনি আরও হিজিবিজি আঁকে। এবার জন্মদিনে টিনি ওর
মা-বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছে বিশাল এক পুতুল বাড়ি। এতই বড়ো যে শুধু টিনির পুতুলগুলো
নয়, টিনি নিজেও কোনওমতে চেপেচুপে ঢুকে যেতে পারবে। বাড়িটায় খুদে খুদে জানলা। খুদে
খুদে দরজা। একদম টিনির আঁকা ছবির ঘরবাড়ির মতো। টিনি প্রথমেই আঁকার খাতায় আঁকে
অ্যাত বড়ো বাড়ি। তারপর তার জানলা আঁকে এইটুকু। দরজা আঁকে এইটুকু। এও ঠিক তেমন। বেশ
হয়েছে। বড়োদের কেমন আসতে মানা। টিনি বাড়ি পেয়ে মহা খুশি। বাড়িটার তুষারের মতো রং। তাই
টিনি তার নাম রেখেছে তুষার-বাড়ি। একদিন নিঝুম দুপুরে সকলের নজর এড়িয়ে টিনি চুপিচুপি
লুকিয়ে পড়ল তুষার-বাড়ির ভিতরে। বিকেল হতেই ওর খোঁজ খোঁজ। মা খুঁজলেন, বাবা খুঁজলেন, কত
ডাকলেন নাম ধরে। ও সাড়া দিল না। শেষে মায়ের গলা ধরে এল। মায়ের ফোঁপানির শব্দ কানে
এল টিনির। তখন আর সে থাকতে পারল না। একছুটে মায়ের কোলে। মা তখন ওকে আদর করতে করতে
বললেন, রাগ করে না সোনা। আজ থেকে আমরা সবাই তোমার খেলার সাথি। তাই শুনে
খুশিতে টিনি, বাবা, দাদাই আর তুষার-বাড়ির ভিতরের পুতুলগুলো অবধি হেসে উঠল।
।। তিন।।
টুবলুর ভূত
দেখা
টুবলু
বলেছে সে আর কখনও ইশকুলে যাবে না। ওদের ইশকুল বাড়ির তিনতলায় ভূত আছে। জিয়ন দেখেছে,
মানসি দেখেছে, সবাই দেখেছে। বাবা শুনে বলেছেন, যাহ। ওসব বাজে কথা। ভূত বলে আবার
কিছু হয় নাকি? রাতে মায়ের পাশে শুয়ে টুবলু শোনে বাগানের পাঁচিলে বসে একটা বেড়াল
কেমনভাবে কাঁদছে। বিছানার চারপাশে খুটখাট আওয়াজ হয়। শুনতে শুনতে ওর খুব ভয় ভয় করে।
এর মধ্যে একদিন টুবলুদের বাড়িতে বেড়াতে এল ওর মামাতো দাদা পলাশ। পলাশ খুব
সাহসী। সাইকেলে চেপে ওরা শহর ছাড়িয়ে চলে এল দূরে। পথে একটা গাব গাছ পড়ে। দিনের
বেলায় সেখানে গেলে কোনও ভয় নেই। তবে রাতে সেখানে না যাওয়াই ভালো। এদিকে ফুরফুরে
হাওয়ায় নদীর ধারের বাঁশের মাচার উপরে বসে ছোলাভাজা খেতে খেতে কখন যেন বিকেল ফুরিয়ে
গিয়েছে। পাখিরা সব ঘরে ফিরছে। ওরাও বাড়ির দিকে চলল। দূরে দেখা
যাচ্ছে ঐ গাব গাছটা। তাই দেখে ভয়ে টুবলুর বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। সে পলাশের
হাত আঁকড়ে ধরে আছে। গাব গাছের তলাটায় ঝুপসি আঁধার। হঠাৎ সেখানে কী যেন একটা নড়ে
উঠল। টুবলু শিউরে উঠে চেঁচিয়ে বলল, ভূত! পলাশ বলল, তুই কী রে? দ্যাখ ভালো করে।
টুবলু তাকিয়ে দেখল বুড়ো মতো একজন মানুষ। গায়ে তার ছেঁড়া পোশাক। হাতে একতারা। আহা!
লোকটার বাড়ি নেই। ঘর নেই। শোবার জায়গা নেই। কেউ ওকে আজ রাতে রেঁধে খাওয়াবে না।
দেখে টুবলুর ভারি দুঃখ হল। ইস, ভূত বুঝি এমন হয়? তারপর থেকে টুবলু আর কোনওদিন
ভূতের ভয় পায়নি।
।। চার।।
বাবাইয়ের
রোববার
বাবাই
এমনিতেই খুব ছটফটে। তার ওপরে জল নিয়ে খেলতে সে বড়ো ভালোবাসে। চানের বড়ো গামলার তলা
অবধি হাত ডুবিয়ে ও মগের পর মগ জল তোলে আর মেঝেতে ফেলে। তারপর জল থইথই মেঝের উপর
দাঁড়িয়ে ধেই ধেই করে নাচে। এই কারণে বাড়িতে রোজ চানের জল ফুরিয়ে যায়। মা টের পেয়ে
বকেন। তবুও বাবাই একই কাজ করবে। বাবা ওর পিঠে ধমাস ধমাস করে দুই ঘা লাগিয়ে দিলে ও
ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে। অথচ চানের ঘরে ঢুকলেই ওর যে কী হয়। আবার শুরু হয় জল নিয়ে খেলা।
মা দেখলেন, নাহ, এভাবে তো হবে না। বাবাইকে তিনি আদর করে বোঝান। শোনো বাবু, জল
দামি। জল আমাদের জীবনে খুব জরুরি একটা জিনিস। জল ফুরিয়ে গেলে আমরা যে কেউ বেঁচে
থাকব না সোনাই। তুমি কি জানো কত জায়গায় মানুষের কী জলের অভাব? পাহাড়ের দেশে কোথা
থেকে ভারি বালতি ভরা জল টেনে টেনে নিয়ে লোকজন উপরে ওঠে। তুমি কি এটাও জানো যে
মাটির তলার ভালো জলগুলো সব শুকিয়ে আসছে? আর তুমি এভাবে জল খরচ করছ? বরং আমাদের জল
বাঁচিয়ে রাখা দরকার। বাবাই অবাক হয়ে শোনে। সেই রোববার বাবাই চটপট চান সেরে নেয়।
একটুও বেশি জল খরচ করে না ও। মা খুব খুশি। বাবাই সোনা কেমন বড়ো হয়ে গেল।
।। পাঁচ।।
বইয়ের নেশা
তুরার
বই পড়তে একদম ভালো লাগে না। ছড়ার বই, আঁকার বই, কথা ও কাহিনী এসব দেখলেই ওর শুধু
মনে হয় পালাই পালাই। মানির উপর ভারি রাগ হয়েছে ওর। পুজোর সময় মানি
ওকে খেলনা না দিয়ে বই দিয়েছে যে! আজ দুপুরে শুয়ে শুয়ে ওর কিছুতেই ঘুম আসছে না। এত
গরম। পাখা যেন ঘুরছেই না। অথচ বিছানা ছেড়ে ওঠা বারণ। বালিশের পাশে পড়ে আছে মানির
দেওয়া বইখানি। চারুমাসি রেখে গিয়েছেন। তুরার বাবা অফিসে। মায়েরও কলেজ। কে থাকে ওর
সাথে সারাদিন? কেন? চারুমাসি। তুরা কী করবে বুঝতে না পেরে তুলে নেয় বইটি। পাতা
ওলটাতেই অবাক হয়ে যায় ও। কী চমৎকার বড়ো বড়ো লেখা, রঙিন ছবিগুলো, বই নয় তো, যেন
রূপকথার দেশ। তুরা নৌকো চেপে ভেসে যায় মেঘের ফাঁক দিয়ে আসা আলো ঝিকিমিকি পথে।
রামধনু টপকে ও সোজা চলে যায় তুলো তুলো মেঘের ভিতর। কুলপির মতো নরম মেঘের টুকরো
মুখে দিতেই তা মিছরির মতো গলে যায়। দেখা হয় ডানাওয়ালা ঘোড়ার পিঠে চড়া রাজকুমারের
সাথে। ওরা একসাথে কত খেলা করে। মা কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখেন তুরা ঘুমে কাদা। আর ওর
বুকের উপর খোলা রয়েছে মানির দেওয়া বইখানা। দেখে তো মা দারুণ অবাক!
এখন তুরা
কত বদলে গিয়েছে। ও অনেক বই পড়ে। বইমেলায় গিয়ে ও নিজেই মানির কাছে আবদার করে চেয়ে
নেয় নিজের ভালোবাসার বইটি। ওর এখন একটাই নেশা। আর তা হল বই পড়া।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
ছবিঃ আন্তর্জাল
💕 দারুণ ভালো।
ReplyDelete