
রাজস্থানে রক্তপাত
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
আর পাঁচটা বাঙালীর মতো ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব
ছেলেবেলা থেকেই।
কখন যে ওরা আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেল, তা টেরও পাইনি। দিন
নেই রাত নেই, সকাল সন্ধের হিসেব নেই, ওদের সঙ্গে যে কত সময় কাটিয়েছি, তার হিসেব রাখিনি। কখনও দুপুরে আয়েশ করে ওদের ২১ রজনী সেন রোডের বাড়িতে বসে সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি
আবার কখনও শীতে বেরিয়ে পড়েছি বাক্স-প্যাঁটরা
নিয়ে, পাড়ি দিয়েছি হাজার মাইল পথ। গাড়ি
নিয়ে চষে ফেলেছি থর মরুভূমির দেশটা। আগে জানতাম না, শীতে
মরুভূমি এতটা মায়াময় হয়। ওদের পাল্লায় পড়ে সেটা জেনেছিলাম। একবার গাড়ির চাকা ফেটে
গেছিল। কিন্তু দমে যাইনি। "কুছ পরোয়া নেহি" - এই ভেবে উটের পিঠে চেপে
বসেছি।
এই উট সম্পর্কে সেই টাক মাথা লোকটা বলেছিল - "আশ্চর্য জানোয়ার! নিজের
পাকস্থলীর মধ্যে ওয়াটার সাপ্লাই, এই বয়ে নিয়ে দূর, দূর পথ হেঁটে চলেছে।"
তাতে আবার রোগা ছিপছিপে লোকটা সেই ভুল শুধরে দিয়ে বলেছিল - "উটের জলটা
আসে উটের কুঁজ থেকে। পাকস্থলীর সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই!"
টাকমাথা লোকটা নাকি তাঁর লেখা একটা বইতে এই ভুল তথ্যটাই এতদিন চালাচ্ছিলেন।
ছ’টা এডিশনও নাকি বের হয়ে গেছিল। তাতে সেই রোগা লোকটা
বলেছিল, "সাতে শুধরে নেবেন!"
হাঃ হাঃ হাঃ - হাসি চাপা যায়! তবে সামনে হাসতে পারিনি বটে! পরে অবশ্য সেই
টেকো লেখক উটের পিঠে চাপার পর প্রায় ভিরমি খেয়ে উট সম্পর্কে বলেছিলেন, "ভয়ানক
জানোয়ার!"
ওদের সঙ্গে সেবার রাজস্থানে গিয়ে দেখি, মরুভূমির পরতে পরতে রোমাঞ্চ! যেদিকে তাকাও, শুধু কেল্লা আর কেল্লা। সেগুলো দেখে
তো আরেকটা টাকমাথা লোক বলেই ফেলল, "এরা তো দেখছি যেখানে
পেরেছে একটা করে কেল্লা গুঁজে রেখেছে!"
এই দুই টেকো ছাড়াও আরও এক টেকোর সঙ্গে আমার সেবার পরিচয় হয়েছিল। সে আবার নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দিচ্ছিল। পরে
অবশ্য জেনেছিলাম সে বেটা এক মহা ধড়িবাজ। ডাক্তার-ফাক্তার সব ভাঁওতা! আসলে সে ওই বাচ্চা মিষ্টি ছেলেটাকে হাতিয়ার করে গুপ্তধন
হাতাবার ধান্দায় ছিল।
আমি কী নিয়ে কথা বলছি, তা বোঝা যাচ্ছে কি? বুঝেও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তাই না?
যাক, আর কাউকে অন্ধকারে রাখব না। যারা আন্দাজ করে ফেলেছ, তাদেরকে মাথা ঝুঁকিয়ে "হ্যাঁ"
বলি। আর যারা এখনও মাথা চুলকাচ্ছো, তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আনি।
তোমরা ঠিকই ধরেছ। আমি বাংলা ছবির মাইল স্টোন, "সোনার কেল্লা"
ছবিটার কথাই বলছি। বাংলার অন্যতম সেরা ছোটোদের ছবির
কথা উঠলে এই ছবির নাম আসবেই। তবে সোনার কেল্লাকে আমি কিন্তু বাংলার "অন্যতম
সেরা" ছবি বলতে নারাজ। আমার মতে এ'ছবি পৃথিবীর অন্যতম সেরা। আর তা শুধু ছোটোদের নয়, আমাদের সবার। বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক শ্রী সত্যজিৎ রায়ের এক অমর
সৃষ্টি।
যেই দিন সত্যজিৎ রায় তাঁর সোনার ছবিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, সেটা ছিল
১৯৭৪-এর ২৭ শে ডিসেম্বর। দেখতে দেখতে প্রায় পঁয়তাল্লিশটা বছর হতে চলল! আমাদের
মধ্যে কতজন তো তখন জন্মগ্রহণই করিনি! সেবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল এই ছবি। তা ছাড়া, সেরা শিশু অভিনেতা (কুশল চক্রবর্তী), সেরা চিত্রনাট্য (সত্যজিৎ রায়) আর
সেরা পরিচালকের (সত্যজিৎ রায়) পুরস্কারও এসেছিল এই ছবির জন্য। এ ছাড়া চিকাগো ইন্টারন্যাশন্যাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে
নমিনেশনও পেয়েছিল ছবিটি।
১৯৭৪-এর আগের তিন বছর দর্শক কিন্তু ছিল
পাঠক। মানে, গল্পটা লেখা হয়েছিল ১৯৭১-এ। আপাদমস্তক রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা গল্প বলতে
আমরা যা বুঝি, "সোনার কেল্লা" হল তাই। অপরাধীর পরিচয় পেতে আমাদের শেষ
অবধি গল্পটা পড়তে হয়। অবশ্য ছবিতে কিন্তু গল্পটা আমরা পাই একটু অন্যভাবে। সে
আলোচনায় আমি পরে আসছি।
ছবিটা ইতিহাস হয়ে ওঠার পেছনে ছিল এর গল্প আর চিত্রনাট্য। সাহিত্য যখন ছবিতে
প্রকাশ পায়, তখন তার গতি বা ধারা অনেকসময় পরিবর্তিত হয়। পৃথিবীবিখ্যাত
চিত্রনাট্যকার বা পরিচালকরা এই ধারাতেই বিশ্বাসী।
ছবিতে আমরা দেখতে পাই, কলকাতা শহরের এক নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে মুকুল ধরের
জীবনে আচমকা একটা পরিবর্তন আসে। মাত্র ছ'বছরের মুকুল চলে যায় প্রায় সাতশো বছর পেছনে। সে দাবি করে, বহুদিন আগে কোনও এক সোনার কেল্লার ভেতরের একটা
শহরে সে থাকত।
ছোটোবেলায় সে যুদ্ধ দেখেছে। রাজা দেখেছে। ময়ূরও
দেখেছে। উটও দেখেছে। তার দেখা জিনিসগুলোর ছবিও আঁকে সে। কিন্তু সেগুলো সে করে রাত
তিনটের সময় উঠে! গড়গড়িয়ে সে বলতে থাকে সাতশো বছর
আগেকার কথা! মুকুলের বাবা-মায়ের আর
বুঝতে বাকি থাকে না যে তাঁদের ছেলে জাতিস্মর! মানে তার পুনর্জন্ম হয়েছে। এই জন্মে তার
আগের জন্মের কথা মনে পড়ছে! ছেলের অবস্থা দেখে চোখ কপালে ওঠে বাবা-মায়ের। কিন্তু আসল বিপদটা সে ডেকে আনে সাংবাদিকদের সামনে দামি পাথরের কথা
বলে। সে বলে যে, সে তার বাড়িতে দামি দামি পাথর
দেখেছে। সে কথা কাগজে বেরোয় আর মুকুল পড়ে যায় দু’জন
দুষ্টু লোকের চোখে। অপহরণ করার চেষ্টা করা হয় তাকে। কারণ ততক্ষণে চারদিকে চাউর হয়ে
গেছে যে মুকুলের সেই সোনার কেল্লার বাড়িতে গুপ্তধন ছিল। তাই শেষমেশ ফেলুদার
শরণাপন্ন হন মুকুলের বাবা।
এবার মঞ্চে প্রবেশ ফেলুদার (ভালো নাম,
প্রদোষ চন্দ্র মিত্র)। পেশায় সে একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। কেস নিয়ে হিল্লি-দিল্লি
করে বেড়ায়। তোপসে (তপেশ রঞ্জন মিত্র) হল ফেলুদার খুড়তুতো ভাই।
সে ফেলুদার নেওটা। তোপসে নামটা ফেলুদারই ভালোবেসে দেওয়া। আর সব থেকে বড়ো কথা, সে হল ফেলুদার সহকারী।
মুকুলের কেসটা নিতে রাজি হয় ফেলুদা। কেল্লা, উট, ময়ূর - এই সবের কথা শুনে
ফেলুদা আন্দাজ করে মুকুল হয়তো পশ্চিম
রাজস্থানের কথাই বলছে। মুকুল অবশ্য ততক্ষণে তার ডাক্তার জেঠুর (ডঃ হেমাঙ্গ হাজরা) সঙ্গে রাজস্থানের উদ্দেশে রওনা
দিয়ে দিয়েছে সোনার কেল্লা দেখার আশায়।
এই ডঃ হাজরার ব্যাপারে আগে থেকেই একটু জেনে নিতে চায় ফেলুদা। তাই সে এবারে
যায় তার সবজান্তা সিধু জ্যাঠার বাড়ি। এখানেই সে জানতে পারে দুই শয়তান ভবানন্দ আর
তার চেলার সম্পর্কে। এলাহাবাদে অনেকদিন আগে ডঃ হাজরা নাকি এই ভবানন্দ আর তার
চেলানন্দকে বেজায় জব্দ করেছিল।
মজার ব্যাপার, এই ভবানন্দ আর তার চেলানন্দই হল এই "সোনার কেল্লা"
ছবির দুই দুষ্টু লোক। মানে চলতি কথায় "ভিলেন"। ভবানন্দর আসল নাম, এম
বর্মণ। আর তার চেলা মন্দার বোস। মুকুলদের সঙ্গে একই ট্রেনে তারাও এবার রওনা দেয় রাজস্থানের উদ্দেশে। দেখতে দেখতে পরিচয়ও করে ফেলে মুকুলদের সঙ্গে। ডঃ হাজরা কিন্তু কোনও ভাবেই তাদের চিনতে পারেন না। কারণ, এলাহাবাদের ঘটনার
পর কেটে গেছে বহুদিন। আর তাদের চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে অনেক।
এবার সুযোগ বুঝে ডঃ হাজরাকে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দেয় মন্দার বোস। আর
আসল ডঃ হাজরার জায়গায় এবার ডঃ হাজরা সেজে বসে মিঃ বর্মণ! তারপর মুকুলকে হাত করে এই
বলে যে, তারাই এবার ওকে সোনার কেল্লা দেখাবে। উদ্দেশ্য, মুকুলের আগের জন্মের বাড়ি
খুঁজে বের করা আর তারপর সেখান থেকে গুপ্তধন হাতানো।
কিন্তু জয়পুরে সার্কিট হাউসে পৌঁছে মুকুলের বাবার করা একটা টেলিগ্রাম পেয়ে
টনক নড়ে দু’জনের। কোনও এক পি সি মিটার (ফেলুদা)
নাকি মুকুলের সাহায্যে আসছে এইখানেই! ফেলুদাকে শায়েস্তা করার জন্য এবার তৈরি হয় দুই শয়তান। আসলে এই টেলিগ্রামটা মুকুলের বাবা করেছিলেন আসল ডঃ হাজরার
উদ্দেশে। দুর্ভাগ্যবশত তা দুষ্টু লোকেদের
হাতে চলে আসে।
ফেলুদা তখন ট্রেনে। সঙ্গে তোপসে।
এবার ট্রেন কানপুরে ঢুকতে, তাদের কামরায় এসে ঢোকেন এক আশ্চর্য মানুষ। পাঁচ ফুটের
সামান্য বেশি উচ্চতা। মাথা ভর্তি টাক। পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবী। মাফলারে ঢাকা কান আর
মাথা, আর তার সঙ্গে
জহর কোট। ভদ্রলোকের হিন্দি শুনেই বোঝা যায় উনি বাঙালি।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ সবাই। বই-এর পাতা
থেকে এই প্রথমবার জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখি বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা ছবির জগতের অন্যতম
জনপ্রিয় চরিত্র "জটায়ু"-কে। ভালো নাম (ওনার ভাষায় - "আসলি নাম") লালমোহন গাঙ্গুলী। অবশ্য এই পদবিটাকেও
উনি কায়দা করে বলেন - "গাঙ্গোওলী"। প্রাথমিক পরিচয়েই ইনি যেমন ফেলুদার
সম্পর্কে মুগ্ধ হয়ে যান, তেমনই আমরাও সবাই ভালোবেসে ফেলি ওনাকে। ফেলুদা রাজস্থান যাচ্ছে শুনে উনি ঝুলে পড়তে চান ফেলুদা
আর তোপসের সঙ্গে। জানান, ভয়ডর বলে ওনার কিছু নেই।
তাই ফেলুদা যখন ওনাকে বলেন যে পথে বিপদ-আপদ আসতে
পারে, তখন উনি হো হো করে হেসে বলেন, "আপনি বিপদের ভয় দেখাচ্ছেন?
জটায়ুকে!" যদিও উটের পিঠে চড়তে গিয়ে বেচারার নাকানি-চোবানি খেয়ে একসার অবস্থা হয়। মানে বিপদ না আসা পর্যন্ত জটায়ুর বিপদে কোনও ভয় নেই! শুরু হয় পথ চলা থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের।
প্রায় অনেক রাত করেই ফেলুদা এন্ড কোং পৌঁছয় জয়পুরের সার্কিট হাউসে। কিন্তু
তাকে স্বাগতম জানানো হয় বিষাক্ত কাঁকড়া বিছারূপী মৃত্যু ফাঁদ পেতে রেখে। এর
কারসাজি অবশ্যই মন্দার বোসের। যদিও বুদ্ধিটা নকল ডঃ হাজরার। সেবার তোপসের তৎপরতায়
প্রাণ বাঁচে ফেলুদার। অবশ্য তারা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না এর পেছনে আসলে
হাত কাদের।
সবাই মিলে এবার শুরু হয় সোনার কেল্লা খোঁজা। আর এখানেই আসল উত্তেজনা! কারণ ফেলুদারা
জানতেই পারে না যে নকল ডঃ হাজরা বা মন্দার বোসই আসলে দুষ্টু লোক! মূর্তিমান শয়তান!
তাহলে? মুকুলের কী হবে? ফেলুদা এন্ড কম্পানির কি তবে ঘোর বিপদ? কিন্তু
শেষমেশ গল্পে মোড় আসে।
মুকুলকে হিপ্নোটাইজ (সম্মোহিত) করে দুষ্টু লোকেরা জানতে পারে মুকুলের সোনার
কেল্লা আসলে জয়সলমীরে। আর ফেলুদা তা জানার আগেই তারা মুকুলকে নিয়ে পাড়ি দেয় সেখানে।
কিন্তু ফেলুদাও কম ধূর্ত নয়। নামের বানান দেখে সে জেনে ফেলে নকল ডঃ হাজরার আসল
পরিচয়। তোপসে আর জটায়ুকে নিয়ে সেও গিয়ে পৌঁছয় জয়সলমীর। উদ্ধার করে মুকুলকে।
টান টান উত্তেজনার মধ্যে চেয়ারের হাতল খামচে ধরে ছবিটা দেখতে হয়েছিল
দর্শককে। এর অন্যতম কারণ কিন্তু এর দুর্ধর্ষ চিত্রনাট্য। সারা ছবি জুড়ে প্রতিটা
মুহূর্তেই কিছু না কিছু ঘটছে। বই পড়লে দেখা যাবে রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে একেবারে
শেষে। কিন্তু ছবিতে আমরা খল চরিত্রকে আগেই চিনে ফেলেছি। এই ছবির গল্প বলা হয়েছে
অনেকটা বিখ্যাত চিত্র পরিচালক অ্যালফ্রেড হিচককের ঢংয়ে। মানে, প্রথমেই দর্শক জেনে
যাচ্ছে আসল অপরাধীর পরিচয়। এইসব ক্ষেত্রে কিন্তু দর্শকের বাকি ছবি দেখার ইচ্ছেটাই
চলে যেতে পারে। তাই তাদেরকে দর্শকাসনে বসিয়ে
রাখার জন্য ভীষণ মুন্সিয়ানার প্রয়োজন হয়। আর তা আমাদের প্রিয় সত্যজিৎ রায় কতটা ভালোভাবে দেখিয়েছেন তা বিশ্লেষন করার সাহস আমার নেই।
আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল, সত্যজিৎ রায় তাঁর পাঠক বা দর্শককে কখন যে সব
তথ্য গুলে খাইয়ে দেবেন তা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যাবে না। কথাটা কিন্তু ভীষনভাবে
খাঁটি। জটায়ু আর ফেলুদার কথাবার্তার মধ্যেই
আমরা যেমন জানতে পারি আরাবল্লীর ডাকাতরা তাদের শত্রুদের শাস্তিস্বরূপ নাক কেটে দেয়। আবার
ফেলুদার থেকেই জানতে পারি উটের পানীয় জল থাকে তার কুঁজের
মধ্যে। এই কুঁজটা আসলে চর্বি যা সে অক্সিডাইজ করে জল তৈরি করে শরীরে জলের প্রয়োজন মেটায়। তেমনই জয়পুর থেকে জয়সলমীরের দূরত্ব যে প্রায়
দেড়শো মাইল (ছবিতে নকল ডঃ হাজরা মন্দার বোসকে জানাচ্ছে, "আসতে যেতে প্রায় তিনশো মাইল"), তাও আমরা জানতে পারি এই ছবি থেকে। নিঃসন্দেহে রাজস্থান ঘুরতে গেলে এই
তথ্য আমাদের কাজে লাগবে।
আর সিধু জ্যাঠাই তো আমাদের বলেন আই সি এস ইংলিশ ম্যান উইলিয়াম জেমস হারশেল-এর কথা, যিনি কিনা আঙুলের ছাপ থেকে অপরাধী ধরার উপায় সম্পর্কে ১৮৮০ সালে
ইংল্যান্ডের নেচার পত্রিকায় একটা চিঠি লেখেন।
তবে শুধুমাত্র চিত্রনাট্য বা কাহিনি নিয়ে
আলোচনা করলে অন্যায় করা হয় ছবির ক্যামেরা বা এডিটিং-এর প্রতি। সৌমেন্দু রায়ের
ক্যামেরা আজও আমাদের মুগ্ধ করে। রাজস্থানের দৃশ্যপট কী অসাধারণভাবে ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে, না দেখলে তার স্বাদ পাওয়া যাবে না। ছবি
দেখতে দেখতে কখন যে আমরা ফেলুদাদের সঙ্গে
রাজস্থানে পৌঁছে যাই তা টের পাই না। এর সিংহভাগ কৃতিত্ব কিন্তু অসাধারণ ক্যামেরার কাজের। বিশেষ করে উঠের পিঠে চেপে ফেলুদা, তোপসে আর
জটায়ুর ট্রেনের পেছনে ধাওয়া করার
দৃশ্যটা! এটা কিন্তু ছিল সত্যজিৎ রায়ের সব থেকে প্রিয় দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটা। ক্যামেরা ছাড়াও আছে দুলাল দত্তর অসাধারণ
এডিটিং।

এবার আসি ছবির সঙ্গীত ও আবহ বা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কথায়। যা না বললে
একটা বিরাট শূন্যতা তৈরি হবে! এর সৃষ্টিকর্তাও স্বয়ং সত্যজিৎ রায়! ছবিতে রাজস্থানী পরিবেশ তৈরির পেছনে আবহর বিরাট হাত ছিল। সেখানকার লোকসঙ্গীতকে কী দারুণভাবে ব্যবহার
করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে সেই দৃশ্যটার কথা। যেখানে
মাঝরাতে মন্দার বোস ফেলুদাকে ‘খতম’ করার জন্য রামদেওরা স্টেশনে অপেক্ষা করছে। আর একদল লোক সেখানে প্রায় আপাদমস্তক
চাদর মুড়ি দিয়ে গোল হয়ে বসে দেহাতি গান গাইছে। শোনা যায়, এক সময় ব্যক্তিগত জীবনে ওদের
পেশা ছিল ডাকাতি! মজার ব্যাপার হল, যে গানটা আমরা শুনি, তার গলাও ছিল তাদেরই! ভাবা
যায়! আর ছবির সেই মন মাতাল করা থিম মিউজিক? ছবিটা একবার দেখলে তা কানে বাজবে একশো
বার! অনেকে তো (আমিও) সেটাকে আজকাল ফোনের রিং টোন হিসেবেও ব্যবহার করেন দেখেছি।
ছবির প্রতিটা চরিত্র আজও অমর। ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন, ভয়ডরহীন এক যুবক হল
ছবির নায়ক। শ্রী প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। মানে আমাদের প্রিয় ফেলুদা। স্বভাবে সামান্য
গম্ভীর হলেও প্রয়োজনে কিন্তু রসিকতা করতে ছাড়ে না। অবশ্য
যাই করুক না কেন, চোখ আর কান কিন্তু ফেলুদার সবসময় সচল। কোনোকিছুই নজর এড়ায় না
তার। লালমোহনবাবুকে দেখেই বলে দেন তিনি বেশ কিছু দিন হল বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। কারণ, তাঁর হাতের ঘড়ির ব্যান্ডের তলায় চামড়ার আসল রংটা তখন উঁকি দিচ্ছিল,
যেটা কিনা ফেলুদার নজর এড়ায়নি। আর এর সঙ্গে আছে দুর্দান্ত উপস্থিত বুদ্ধি, যাতে করে যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূল করে নিতে পারে সে।
তাছাড়া সহজ সরল তোপসের (ফেলুদার ভালোবেসে দেওয়া
নাম তোপসে) স্বভাব আমাদের মন কাড়ে। ফেলুদা তার একাধারে বন্ধু আর শিক্ষক।
তাকে সে যেমন ভালোবাসে তেমন শ্রদ্ধাও করে খুব।
আর শিশুসুলভ আচরণসম্পন্ন লালমোহনবাবু বা জটায়ু? প্রথম দেখায় আমরা জানতে পারি আজ পর্যন্ত উনি সাতাশখানা কাহিনি লিখেছেন (ওনার কথায় - "আপ টু ডেট
সাত্তাইশ কাহানিয়া লিখখি হ্যায়")। এবার উনি যোধপুরের পটভূমিকায় একটা
কাহিনি লিখতে চান। কিন্তু তাঁর লেখাতে
তথ্যে ভুল থাকে। পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই, প্রায়ই ফেলুদা তাঁর লেখার ভুল ধরিয়ে
দেয়। অবশ্য এত নামকরা লেখক হয়েও উনি কিন্তু ফেলুদার সব সমালোচনা ইতিবাচক ভাবেই
গ্রহণ করেন এবং নিজের ভুল স্বীকার করে সবার সামনে জিভও কাটেন। ওনার গল্পের নামগুলোও
আকর্ষণীয়! ‘সাহারায় শিহরণ’, ‘হন্ডুরাসে হাহাকার’, ‘বোর্নিওর বিভীষিকা’ বা নতুন
বই ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’ - নামগুলো শুনলে মনে হতেই পারে এগুলো হয়তো কোনও হাসির গল্পের বই। অবশ্য জটায়ুর ভাষায়
এগুলো সব ‘রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস’। জানার জন্য বলি, এই মিলিয়ে মিলিয়ে দেওয়া নামের পদ্ধতিকে বলে ‘অ্যালিটারেশন’ বা ‘অনুপ্রাস’।
বলতে গেলে প্রায় সব সময়ই একটা নোট বই আর পেন হাতের কাছে রাখেন জটায়ু। যেটা দরকার মনে হয়, নোট করে নেন। যখন মন্দার বোস ঠাট্টা করে বলেন ‘রাজস্থানে রক্তপাত’, সঙ্গে
সঙ্গে তিনি তখন সেটা নোট করে নেন। বলেন, ওনার পরের উপন্যাসের
উনি এই নামটাই দেবেন আর সেটা আশা করা যায় “নামের
জোরেই কেটে যাবে”, কারণ উনি এবার রাজস্থান নিয়েই
লিখতে চলেছেন।
এছাড়া ভালো লোকেদের দলে আছেন ডঃ হেমাঙ্গ
হাজরা আর সিধু জ্যাঠা। আপাদমস্তক ভালো মানুষ
ডঃ হাজরা একজন প্যারাসাইকোলজিস্ট (যাঁরা পূর্বজন্ম নিয়ে গবেষণা করেন)।
আর সিধু জ্যাঠা? খবরের কাগজের কাটিং জমানো হল ওনার নেশা। জ্ঞান আর স্মৃতিশক্তির
বহর দেখে মনে হতেই পারে আজকের গুগল হয়তো ওনাকে
ভেবেই তৈরি হয়েছে!
এবার আসি নকল ডঃ হাজরা (আসলে এম বর্মণ) ও মন্দার বোসের কথায়। মানুষটা যে
মূর্তিমান শয়তান, তা নকল ডঃ হাজরার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। আর মন্দার বোস? চারিত্রিক
দিক থেকে খল তো বটেই, আরও একটা বিশেষণ তাঁর নামের পাশে অনায়াসে বসিয়ে দেওয়া যায় -
"মজাদার"। হাতের খেলা থেকে শুরু করে নানান ভেলকি এমনকি হরবোলা (গলা দিয়ে
নানান পশু পাখির ডাক) পর্যন্ত সে করতে পারে।
ছবির সঙ্গেই অমর হয়ে আছে ছবির সংলাপ।
সিধু জ্যাঠার মুখে আমরা শুনি - "আমি অনেক কিছু করলে অনেকেরই পসার থাকত
না ফেলু, তাই আমি কিছুই করিনি।"
লালমোহনবাবু ফেলুদার বুদ্ধির তারিফ করতে গিয়ে বলেছিলেন - "আপনাকে তো
কাল্টিভেট করতে হচ্ছে মশাই!" - কথাটা কিন্তু আজ অনেকেই মজা করে ব্যবহার করেন।
আর এখানেই তো ছবির সংলাপের সার্থকতা - তাই
না? আর তাছাড়া জটায়ুর মুখে যখন আমরা শুনি "এরা
কি বন্য উট" বা "কাঁটা কি এরা বেছে খায়?", তখন আমাদের না হেসে উপায়
থাকে না।
তারপর নকল ডঃ হাজরার সেই হাড় হিম করা
সংলাপটা? - "টিকটিকি বিছের খাদ্য, নাকি
বিছে টিকটিকির?" - ভোলা যায়?
ভোলা যায় না মন্দার বোসের সেই কথাগুলো - "জয়সলমীর যাবে? তোমায় পথে
বসিয়ে তবে আমি ছাড়ছি।" বা জটায়ুকে ঠেস
দিয়ে বলা কথাটা - "আপনি কামচটকা গেছেন?" অথবা, "আপনি শনি মনসা
দেখেছেন? শনিবারে শনিবারে ফুল ধরে,
বুঝেছেন? শনিবারে শনিবারে ফুল ধরে।"
কত বলব? শেষ হবে না। তাই সংলাপ নিয়ে বলতে গিয়ে শেষ কথা বলি ফেলুদার মন্দার
বোসের উদ্দেশ্যে বলা সেই কথাটা - "ভবানন্দের চেলা, সাঙ্গ তোমার ভবের
খেলা"।
এবার আসি ছবির কলাকুশলীদের কথায়। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অভিনেতা
শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমরা পেয়েছিলাম ফেলুদা হিসেবে। লোকে বলত, ওনাকে মাথায়
রেখেই নাকি সত্যজিৎ রায় ফেলুদার চরিত্রটা সাজিয়েছিলেন। তাঁর অভিনীত ফেলুদার পরের
ছবি ছিল "জয় বাবা ফেলুনাথ"। সেটাও কিন্তু আরেকটা দুর্দান্ত ছবি। কোনওদিন
সুযোগ পেলে সেই ছবি নিয়েও গল্প করা যাবে।
তোপসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন
সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জী। "জয় বাবা ফেলুনাথ"-এও উনি ছিলেন। অবশ্য পরবর্তীকালে ওনাকে আর আমরা তেমনভাবে অভিনয় জগতে
দেখতে পাইনি।
আসল আর নকল হাজরার ভূমিকায় ছিলেন যথাক্রমে শৈলেন মুখার্জী ও অজয় ব্যানার্জি।
আর মন্দার বোস? যাঁকে ছাড়া "সোনার কেল্লা" ভাবাই যায় না? হ্যাঁ,
পর্দার মন্দার বোসের মতোই আসল মানুষটা, মানে কামু মুখার্জিও
কিন্তু ছিলেন বেজায় আমুদে মানুষ। এত বড়ো অভিনেতা
খুবই কম পেয়েছে বাংলা ছবি।
একই কথা বলা যায় সিধু জ্যাঠা মানে অভিনেতা হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে।
ছবির মতোই আসল মানুষটাও কিন্তু ছিলেন
অসম্ভব জ্ঞানী।
সবশেষে আসি ছবির মধ্যমণি, মানে আমাদের সবার প্রিয় জটায়ু বা সন্তোষ দত্ত-র কথায়। প্রথম দর্শনেই সবার মন কেড়ে নিয়েছিলেন উনি। ‘সোনার
কেল্লা’ ফেলুদার গল্প হলেও আদতে শিরদাঁড়া
কিন্তু ছিলেন জটায়ু। লালমোহনবাবু ছাড়া ফেলুদা? ভাবা যায়? সন্তোষ দত্ত-র কমেডির টাইমিং এত মারাত্মক ছিল যে অনেক বাঘা বাঘা অভিনেতাও ওনার সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে হিমসিম খেতেন। তাই হয়তো ওনার মৃত্যুর পর সত্যজিৎ রায় আর ফেলুদাকে নিয়ে ছবি বানাননি।
এছাড়া আছে শ্রীমান মুকুল। যার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কুশল চক্রবর্তী। আজ উনি
কিন্তু খুব খ্যাতনামা একজন অভিনেতা। প্রতিভা তো ছিলই, তাঁর সঙ্গে ছিল সত্যজিৎ রায়ের অভিনয় বের করে নেবার দক্ষতা। ছোট্ট কুশল চক্রবর্তীকে
কিন্তু কখনও কুশল চক্রবর্তী বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল সাহিত্যের পাতা থেকে মুকুল
সোজা নেমে এসেছে রুপোলি পর্দায়।
সব মিলে ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটার মধ্যে যেন একটা ছন্দ রয়েছে। আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয় এই
ছবি। নব্বই-এর দশকে আমরা যখন স্কুলে, তখন
টিভির এত চ্যানেল ছিল না। সব মিলে চ্যানেল মাত্র দুটো। ডিডি ওয়ান আর মেট্রো। গরমের
বা পুজোর ছুটিতে সেই সময় রোজ সকাল দশটা নাগাদ ‘ছুটি ছুটি’ বলে একটা অনুষ্ঠান হত। হাঁ করে টিভির
সামনে বসে গিলতাম ছোটোদের সব ছবি। সেখানেই আমার প্রথম
দেখা ফেলুদার সঙ্গে। অবশ্য আলাপ হয়েছিল তারও আগে।
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় এক পরিচিতর থেকে ফেলুদার বইগুলো নিয়ে পড়েছিলাম। তোপসের চোখ
দিয়েই আমি প্রথম দেখেছিলাম রাজস্থান। সেই তখন থেকেই যেন ফেলুদা-তোপসে-জটায়ুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছি আমি। তারপর থেকে
কতবার যে ছবিটা আমি দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। হয়তো একশো ছাড়িয়ে গেছে! আরও একশো যদি করে ফেলি, অবাক হবার কিছু নেই কিন্তু! কারণ প্রতিবারই নতুন নতুন কিছু
পেয়ে যাই যে!
আর হ্যাঁ, এত কিছু কিন্তু ছবিটা উপভোগ করা যায় আরও একজন মানুষের সঙ্গে বসে। তিনি হলেন স্বয়ং পরিচালক মশাই! কারণ মনে মনে উনিই তো প্রথম ছবিটা
দেখেছিলেন। তাই ছবিটা দেখতে বসে আমার সবসময়ই মনে হয় আমার একেবারে পাশেই বসে আছেন
সত্যজিৎ রায়!
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
ভালো লেখা।
ReplyDeleteBhalo hoachay. Nostalgic.
ReplyDeletekhub bhalo
ReplyDelete