
লালমোহন
তপোব্রত
সান্যাল
মুখে না বললেও মাঝে মাঝে বোঝা
যায় তোমার মন খারাপ হয়েছে। যেমন আজ তোমার
মনটা ভালো নেই। কারণ কাল থেকে স্কুলের ছুটি শুরু। কতদিন প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা
হবে না, জমিয়ে গল্প হবে না। তবে এর চেয়েও বেশি মন খারাপ হচ্ছে অন্য একটা কারণে। তোমার
বেস্ট ফ্রেন্ড এই ছুটিতে ঘুরতে যাচ্ছে রাজস্থান আর তুমি যেতে পারছ না। পুরো ছুটি
বাড়িতেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে। মা অনেক করে
বুঝিয়েছে তোমাকে। আদর করে এইয়া বড়ো বড়ো লালমোহনও খাইয়ে দিয়েছে। সেই সুস্বাদু
লালমোহনগুলো খেতে দারুণ লাগলেও তোমার মন এখনও খারাপ। তবে আমি মন ভালো করার একটা
দারুণ গল্প জানি। শুনলে দেখবে সব মন খারাপ ফুস করে উড়ে গেছে।
আমরা কেউ শান্ত, কেউ আবার
দস্যি, কেউ পড়তে ভালোবাসি, কেউ বা খেলতে। তবে আমরা যেমনই হই না কেন আমরা সক্কলে
গল্প শুনতে ভীষণ ভালোবাসি। আর সেই গল্প যদি হয় গোয়েন্দা বা অ্যাডভেঞ্চারের অথবা
দুটোই, তাহলে তো আর কথাই নেই। আমাদের এই বাংলায় সেই রকম এক ডাকসাইটে গোয়েন্দা
আছেন। তার নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র, কিন্তু আমরা তাকে চিনি ফেলুদা বলে।
তার এত নামডাক যে তার তলব আসে দূরদূরান্ত থেকে। আর সেই সব ডাকে সাড়া দিয়ে সমগ্র
ভারতবর্ষ ঘুরে তিনি অনেক দুঃসাধ্য সব ঘটনার তদন্ত করে সমাধান করেছেন।
তাকে তুমি দেখেছ অনেক সিনেমায়, দুষ্টু লোকদের শিক্ষা দিতে। কী, মনে পড়ছে সোনার কেল্লা,
বোম্বাইয়ের বোম্বেটে, বাদশাহি আংটির কথা? সঙ্গে তার ছায়াসঙ্গী, তার খুড়তুতো ভাই
তপেস রঞ্জন মিত্র। ডাকনাম তোপসে।
তো সেবার হল কী, তোপসেরও
স্কুলে ছুটি পড়েছে। তোমার মতো ওরও ঘুরতে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাই ফেলুদা এসে একটা
কেসের ব্যাপারে বাইরে যাওয়ার কথা বলতেই সে এক পায়ে খাড়া। পরদিনই ব্যাগ-পত্তর
গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল যোধপুরের পথে। কিছু দুষ্টু লোক মুকুল নামের একটি ছেলেকে ধরে
নিয়ে গেছে সোনার কেল্লা খুঁজতে। তাই ওদের জব্দ করবে বলেই ফেলুদার যাওয়া। সে এক
রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার, টানটান উত্তেজনা। শত্রুরা বারবার ফেলুদাকে রাস্তা থেকে
সরানোর চেষ্টা করেছে। কখনও ঘরে কাঁকড়া বিছে ছেড়ে দিয়েছে, কখনও বা উঁচু জায়গা থেকে
ঠেলে ফেলে দিতে চেয়েছে। কিন্তু শেষমেশ দুষ্টু লোকগুলোর খারাপ উদ্দেশ্য আর সফল
হয়নি। ফেলুদা ওদের জব্দ করে মুকুলকে ঘরে ফিরিয়ে এনেছে।
এই সোনার কেল্লা খোঁজার সফরে
আরেকটা দারুণ জিনিস হয়েছে। একজন এমন
মানুষের সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে, যিনি এরপর থেকে ওদের আর পিছু ছাড়তেই পারেননি কখনও।
বলতে পারবে তিনি কে? তার নাম শ্রীযুক্ত লালমোহন গাঙ্গুলি। তার নামটা যেমন মিষ্টি,
তেমনি তিনি মানুষটাও ভারি মিষ্টি। ফেলুদা ও তোপসে যখন ট্রেনে উঠেছে যোধপুর যাবে
বলে, সেইসময় তাদের পাশের সিটে এসে বসলেন লালমোহনবাবু। সহযাত্রীদের নিজের পরিচয়
দিলেন তিনি একজন রহসরোমাঞ্চ লেখক, জটায়ু ছদ্মনামে লিখছেন বহুকাল। এরপর থেকেই আমরা
ফেলুদার গল্প বলতেই বুঝি ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ু।
বিশ্ববিখ্যাত লেখক ও চিত্রপরিচালক
সত্যজিৎ রায় ১৯৬৫ সালে প্রথম মানুষকে ফেলুদার সঙ্গে পরিচয় করান ‘ফেলুদার
গোয়েন্দাগিরি’ গল্পের মাধ্যমে। এরপর আরও চারটি গল্প লিখলেও সেখানে জটায়ুর কোনও
উল্লেখ ছিল না। শেষমেশ ১৯৭১ সালে ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে নিয়ে আসেন সেই মজার চরিত্রটিকে।
সত্যজিৎ রায় মোট পঁয়ত্রিশটি গল্প লেখেন ফেলুদাকে নিয়ে। তার মধ্যে সাতাশটি গল্পে
আমরা জটায়ুকে খুঁজে পাই। অর্থাৎ লালমোহনবাবুর চরিত্রটি এতটাই জনপ্রিয় হয় সেই সময়
যে স্বয়ং লেখক মহাশয় বাদ দিতে পারেননি তাকে। তুমি এবার বলতেই পারো, কেন জটায়ু এত
বিখ্যাত হল? তিনি তো গোয়েন্দা নন! আর গোয়েন্দাদের মতো মারামারিও করতে পারেন না।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তিনি
গোয়েন্দা নন। তার বদলে বলা যেতে পারে, তিনি গোয়েন্দাদের থেকে অনেক অংশে ভীতু। উনি
শুধু যে অন্ধকারে একা হাঁটতে ভয় পান তা নয়, দিনের বেলায় সাউথ পার্ক স্ট্রিটের পুরোনো
কবরখানায় যেতেও ভীষণ ভয় পান। সে তুমি আর আমিও ভয় পাই, তবে সেটা রাতের বেলায়। দিনের
বেলায় তো আমরা সাহসী। লালমোহনবাবু হয়তো মনে মনে ভাবেন, এত দিনের পুরোনো ভুতগুলো
যদি তার ঘাড়ে চেপে বসে। কিন্তু গল্প বলার সময় আগডুম বাগডুম সব গল্প। না হলে ওঁর
গল্পের নায়ক ‘প্রখর রুদ্র’ শরীরে সাত সাতটা গুলি খেয়েও বেঁচে যায়! তিনি অনেকটা
আমাদের সেই কাকা বা মামাদের মতো, যে মজার মজার কথা বললেও তাঁর বানানো গল্পে ভুলভাল
সব তথ্য। তবুও আমরা তাঁকে খুব ভালোবাসি।
লালমোহন বাবু দেখতে ছোটোখাটো।
পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি। মাঝে মাঝে পাঞ্জাবির ওপর জওহর কোট পরতে ভালোবাসেন, আর
শীতকালে মাফলার আর মাঙ্কি টুপি তাঁর জাতীয় পোশাক।
মাথায় একটা বিশাল টাক, শুধু দুই পাশে আর পেছনের দিকে অল্প চুল।
সেই অল্পসংখ্যক চুল তিনি সবসময় পরিপাটি করে আঁচড়ে রাখেন। যেহেতু তিনি রহস্যরোমাঞ্চ
গল্প লেখেন এবং সেই গল্প দারুণভাবে বিক্রি হয় তাই তাঁর আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো।
পাঠক মহলেও দারুণ নামডাক। তোপসেও তোমার মতো দারুণ দারুণ রহস্যরোমাঞ্চ গল্প পড়ে। সে
নিজেই বলেছে, সে জটায়ুর সব লেখা পড়েছে। কী,
তোমারও ইচ্ছে করছে নাকি সেই সব গল্প পড়তে? কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। জানো তো, লালমোহনবাবুর লেখা গল্পগুলোর নামগুলো
ভারি অদ্ভুত। যেমন - সাহারায় শিহরন, ভ্যাঙ্কুভারের ভ্যাম্পায়ার, হন্ডুরাসে
হাহাকার, আটলান্টিকের আতঙ্ক, বিদঘুটে বদমাশ প্রভৃতি। এই সকল নাম তিনি রীতিমতো
জ্যোতিষী দেখিয়ে, চন্দ্র-সূর্য-তারা গণনা করিয়ে তবেই ঠিক করেছেন। তিনি
প্রতিবার বই বার করবার আগে তিন, চারটি নাম নিয়ে জ্যোতিষীর কাছে যান। জ্যোতিষী
তারপর সঠিক নাম আর দিনক্ষণ নির্বাচন করে দেন।
লালমোহনবাবু ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসেন।
সময় পেলেই টুক করে বেরিয়ে পড়েন ইচ্ছেমতো। সঙ্গে নেন দামি জাপানি সুটকেস। সাত কূলে
তার কেউ নেই। বিয়েও করেননি। তাই যা রোজগার করেন তাই খরচা করেন নিজের ওপর। এসবের
মধ্যে তার এক বিদঘুটে শখ হল বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সংগ্রহ করা। কেউ জিজ্ঞেস করলে
বলেন যে এসব নাকি আত্মরক্ষার জন্য। কখনও নেপালের খুকরি, কখনও স্মোক বোম, কখনও আবার
আফ্রিকার বুমারাং। আর সে সব অনেক সময় ফেলুদার হেরে যাওয়া বাজি পালটে দিতেও সাহায্য
করছে। তাই বলা যেতেই পারে ফেলুদারও যথেষ্ট জটায়ুকে প্রয়োজন।
ফেলুদার সবচেয়ে বড়ো শত্রু হল
মগনলাল মেঘরাজ। তাকে আবার লালমোহনবাবু খুব ভয় পান। কেন ভয় পান তার পেছনে অবশ্য আরেকটা
গল্প রয়েছে। একবার মগনলাল মেঘরাজ ফেলুদা, তোপসে
আর লালমোহনবাবুকে তার ডেরায় ডাকেন। সেখানে লালমোহনবাবুকে এক কাঠের দেয়ালে দাঁড়
করিয়ে একজন দক্ষ ছুরি নিক্ষেপকারীকে (নাইফ থ্রোয়ার) বলেন ছুরিগুলো একের পর এক
ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে। সেগুলো ছুটে ছুটে এসে লালমোহনবাবুর শরীরের চারপাশের কাঠের দেয়ালে
গেঁথে যায়। সেই দেখে লালমোহনবাবুর প্রাণ প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। মনে
মনে বড়ো কষ্টও পেয়েছিলেন তিনি। এরকম তিনি আবার আরেকবার কষ্ট পেয়েছিলেন, যখন তার
গল্প মুম্বাইয়ে সিনেমা হবে বলে ঠিক হয়, আর সিনেমা নির্মাতা গল্পের প্রায় অনেকটাই
পালটে দিয়েছিলেন তাঁকে না জানিয়ে। এমনকি দুটো গানও সিনেমায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে
না বলে। তিনি বেচারা কিছু বলতেও পারেননি। সহজ সরল মানুষ কিনা। তবে শেষমেশ সেবারও
হয়েছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
লালমোহনবাবু হঠাৎ একদিন গাড়ি
কিনে ফেললেন কাউকে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে। একটা সবুজ রঙের অ্যাম্বাসাডর। তার
হর্নটাও ছিল ভারি অদ্ভুত, কানে লাগার মতো। ফেলুদা পরে
লালমোহনবাবুকে বলে বদল করিয়েছিলেন সেই হর্ন। কিন্তু
গাড়ি কিনলেও লালমোহনবাবু নিজে কখনও চালাতে পারতেন না, তাই তিনি একজন ড্রাইভারও
রেখেছিলেন সবসময়ের জন্য। তার নাম ছিল হরিপদ। ‘গোরস্থানে
সাবধান’ গল্পে এই হরিপদবাবুই গিয়ে পুলিশ ডেকে এনেছিল। তাই সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে
গিয়েছিল ফেলুদা অ্যান্ড কোং। ফেলুদাকে নিয়ে এখনও পর্যন্ত বাংলায় অনেক সিনেমা
হয়েছে। কিন্তু জটায়ুকে ছাড়া কোনও সিনেমাই আসল ফেলুদার সিনেমা মনে হয়নি। মনে হয়েছে
খুব কাছের কেউ একজন নেই।
আচ্ছা এবার বলো তো, এই গল্প
শুনে তোমার ইচ্ছে করছে লালমোহনবাবুর বাড়ি যেতে? তাকে জটায়ু বলে ডাকতে? তার সঙ্গে
মজার মজার গল্প করতে? আমার কিন্তু ভীষণ ইচ্ছে করছে। চলো তবে একদিন গড়পাড়ে
লালমোহনবাবুর বাড়ি যাই। খুব মজা হবে। কী যাবে তো? আমি
কিন্তু অপেক্ষা করব।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment