নড়েচড়ে পৃথিবী
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের এই পৃথিবীটা যে
সূর্যের চারিদিকে নিরন্তর আবর্তিত হয়ে চলেছে, সে কথা আমাদের সবারই জানা। আবার সে
যে নিজের এক অক্ষেও পাক খেয়ে চলেছে, সে কথাও অজানা নয়। পৃথিবীর এই পাক খাওয়া
কিন্তু আমরা টের পাই না। এর কারণ হল - জাড্য বা ইনার্শিয়া। পৃথিবীর
শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে মনে হয় বুঝি সেটা স্থির। আসলে
কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। আমাদের পায়ের নিচে পৃথিবীর খোলসটা কিন্তু মাঝে
মধ্যেই নড়াচড়া করে। আবার ওই খোলসটা একটু বেশি নড়ে গেলে হয় ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের
ফলে কোনও কোনও জায়গায় মানুষের জীবননাশ হয়, বাড়ি-ঘর ও অন্যান্য সম্পদ হয় ভয়ংকর ভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত।
পৃথিবীর মোট তিনটি স্তর আছে –
কোর, ম্যান্টল ও ক্রাস্ট। বাইরের খোলসটাকে বলা হয় - ক্রাস্ট। প্রায়
সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে, গ্যাস ও পাথর দিয়ে তৈরি বিশালাকায় পিণ্ড থেকে অভিকর্ষজ
টানের ফলে জন্ম নেয় পৃথিবী। ক্রমশ
নানারকম বিক্রিয়ায় তরল অবস্থায় আসতে তার সময় লেগেছিল আরও কোটি কোটি বছর। তারপর
ঠাণ্ডা হতে হতে পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠ শক্ত হয়ে যায়, ঠিক যেমন করে গরম দুধের উপর সর
জমে। এইটা হল পৃথিবীর খোলস, বা ক্রাস্ট।
অনেকটা যেন ডিমের শক্ত খোলার মতো।
ক্রাস্টের নিচে আছে তরল
ম্যান্টল। আর তারও নিচে পৃথিবীর কেন্দ্রের
অংশকে বলা হয় কোর। সেটি যেন ডিমের কুসুমের মতো। এর
তাপমাত্রা খুব বেশি। প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। কোরের আবার দুটি ভাগ
— ভিতরের কোর, যার বেধ ১৪০০ কিমি ও বাইরের কোর, যার বেধ ২০০০ কিমি। লোহা আর নিকেল
দিয়ে তৈরি ভিতরের কোর প্রবল অভিকর্ষজ বলের কারণে কঠিন অবস্থায় আছে, যদিও তার
তাপমাত্রা অনেক বেশি। কঠিন অবস্থা বলার চাইতে স্পঞ্জের মতো বলাটা বেশি ঠিক হবে। বাইরের
কোর কিন্তু তরল অবস্থায় আছে। ম্যান্টেলের তাপমাত্রা প্রায় ৪০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস
এবং এইখানে আছে গলিত পাথর – ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রন সিলিকেট রূপে। পৃথিবী
পৃষ্ঠে ফাটলের সৃষ্টি হলে ম্যান্টলের তরল ম্যাগমা বাইরে বেরিয়ে আসে যাকে আমরা বলে
থাকি - লাভা উদ্গিরন। আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে সেই গলন্ত লাভা
পৃথিবী পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে ঠাণ্ডা হয়ে পাথরে পরিণত হয়।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি
অস্ট্রেলিয়ান পরিবেশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগেনার নিজের জীববিজ্ঞানের কাজের পাশাপাশি
ভূতত্ত্ব নিয়ে অনেক মাথা ঘামান। তিনি বলেন, মোট পাঁচটা প্লেট দিয়ে তৈরি পৃথিবীর
উপরিভাগ। এক সময়ে নাকি এই প্লেটগুলো জুড়ে ছিল। পরে আলাদা হয়ে গিয়েছে। এর অনেক আগে
পৃথিবীর ম্যাপ তৈরির কাজে যারা হাত দিয়েছিল, তারা লক্ষ্য করে বিভিন্ন দেশের ম্যাপ
জোড়া দিলে জিগ-শ পাজলের মতো তাদের ধারগুলো এক্কেবারে মিলে যায়। এই ঘটনা ওয়েগেনারও
লক্ষ্য করেছিলেন। তার ধারণা হল — পৃথিবীর উপরের প্লেটগুলো চলনশীল, স্থির নয়। তিনি প্লেটের
এই চলনশীলতার নাম দিলেন কন্টিনেন্টাল ড্রিফট, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় – মহাদেশীয়
প্রবাহ। আজ থেকে প্রায় সাড়ে সতের কোটি বছর আগে ক্রাস্টের প্লেটটা একদম আস্ত ছিল।
ওয়েগেনার আস্ত প্লেটের নাম দিলেন – প্যাঞ্জিয়া (শব্দটি আসলে গ্রীক, যার অর্থ –
সমগ্র স্থান)। তিনি বললেন, পাঁচটি মহাদেশ একসময়ে এক সঙ্গে মিলেমিশে ছিল, কিন্তু কোনও
এক অজ্ঞাত কারণে পরবর্তীকালে তারা পরস্পর আলাদা হয়ে গেছে। ওয়েগেনার তার যুক্তির স্বপক্ষে
মহাদেশের তটরেখা মিলে যাওয়ার ঘটনাটি তুলে ধরলেন। কিন্তু প্যাঞ্জিয়া ভেঙে টুকরো হয়ে
কীভাবে আলাদা আলাদা প্লেট হয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তি তিনি দিতে
পারলেন না। ফলে তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারকে কেউ বিশেষ পাত্তা দিল না। নিজের
কাজের স্বীকৃতি পেলেন না ওয়েগেনার। সবাই উলটে তাকে পরিহাস করে বলতে শুরু করল —
নিজের কাজে মন দাও। ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা তোমার কম্ম নয়। তার চাইতে বরং
প্রাণীবিদ্যা নিয়ে চর্চা করো।
ওয়েগেনারের মৃত্যুর প্রায়
তিরিশ বছর পর, ১৯৬০ সাল নাগাদ বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, সেদিন ওয়েগেনারের প্রণীত
তত্ত্বে কোনও ভুল ছিল না। অদ্ভুতভাবে দেখা গেল এক মহাদেশের সন্নিকটে যে আর এক মহাদেশ,
তাদের তটরেখায় অবস্থিত পাহাড়ের পাথরের মধ্যে
মিল আছে। শুধু তাইই নয়, যে সমস্ত জীবাশ্ম এক
মহাদেশে পাওয়া গেছে, কাছাকাছি আর এক মহাদেশে সেই একই জীবাশ্ম পাওয়া গেল। দক্ষিণ
আমেরিকা ও আফ্রিকার তটরেখা ও জীবাশ্মের মধ্যে পাওয়া গেল অদ্ভুত সাদৃশ্য, যার ফলে
ওয়েগানারের তত্ত্ব মেনে নিতে বাধ্য হলেন ভূতাত্ত্বিকেরা। কিন্তু মেনে নিলে তো হবে
না, প্রমাণ করতে হবে কন্টিনেন্টাল ড্রিফট থিওরি। ওয়েগেনারও
বুঝতে পেরেছিলেন, সমুদ্রের তলদেশে প্রচণ্ড কোনও শক্তি দু’দিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে
দিচ্ছে সেখানকার জমি।
এবার বিজ্ঞানীরা কোমর বেঁধে
নেমে পড়লেন অনুসন্ধানে। কোন সেই আসুরিক শক্তি, যা টেকটনিক প্লেটগুলোকে ধাক্কা দিয়ে
সরিয়ে দিচ্ছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশে পর্যবেক্ষণ
চালানোর তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শত্রু ডুবোজাহাজ খোঁজার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম
সমুদ্রের তলদেশে অভিযান চালায় আমেরিকা। আমেরিকান নৌ-বাহিনীতে
এই কাজের দায়িত্বে যে সামরিক অফিসারটিকে নিয়োগ করা হয় তিনি ছিলেন একজন
ভূপদার্থবিদ। তার নাম হ্যারি হেস। ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। তাই নিজের সামরিক
কর্তব্য পালন করার ফাঁকে ফাঁকে বৈজ্ঞানিক কাজকম্ম করে তিনি সমুদ্র তলদেশের ম্যাপিং
করে ফেললেন। উঠে এল অনেক গুরুত্বপূর্ণ অজানা তথ্য। দেখা গেল মহাসাগরের মাঝ বরাবর জলের
নিচে রয়েছে বিশাল পর্বতশ্রেণী। এই পর্বতশ্রেণীকে বলা হল – “মিড-ওশান রিজেস”,
বাংলায় বলা যায় – শৈলশিরা। হেস প্রশ্ন করলেন – তবে কী মহাসাগরের নিচে নতুন জমি
সৃষ্টি হচ্ছে, যা জেগে উঠে ধাক্কা দিচ্ছে দু’পাশের ভূস্তরকে? হেস তার এই নব
আবিষ্কৃত তত্ত্বের নাম দিলেন – “সি-ফ্লোর স্প্রেডিং”, বা সাগরতলের প্রসারণ।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর বিশ্ব জুড়ে এল পরিবর্তন। বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায়
বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা ও আবিষ্কার মানব সভ্যতার নবদিগন্ত উন্মোচন করে দিল। সাগরতল
সম্প্রসারণের কারণ খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা। সমুদ্রের নিচে, শৈলশিরার দু’পাশে পাওয়া
গেল ভূ-আস্তরণের মধ্যে সাদৃশ্য। বিজ্ঞানী হেস এই সাদৃশ্যের নাম দিলেন “জিও-পোয়েট্রি”,
অর্থাৎ ভূ-কাব্য। কাব্য তো নিশ্চয়ই, নাহলে ভূপৃষ্ঠে এত ছন্দ কেন? এবার অন্য
বিজ্ঞানীরা ভূ-কাব্যের অবগুণ্ঠন খুলতে মাঠে নেমে পড়লেন। কাজটা সহজ ছিল না মোটেই।
মহাসাগরের তলায় অনুসন্ধান চালানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! যাই হোক, দেখা গেল, পুরোনো
পাথরের স্তর শৈলশিরা থেকে দূরে অবস্থিত। আর
শৈলশিরায় যে পাথর পাওয়া গেল, তারা একেবারে সদ্যোজাত। হাতেনাতে হেসের প্রণীত তত্ত্বের
প্রমাণ পাওয়া গেল।
এবার জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীর পাথরের বয়সের সুলুক সন্ধান খুঁজে পান। পাথরের
বয়স নির্ধারণে ভূবিজ্ঞানীরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তাকে বলা হয় প্যালিওম্যাগনেটিস্ম। পাথরে
উপস্থিত বেশ কিছু খনিজ পদার্থ চুম্বক ধর্ম বহন করে, যেমন ম্যাগনেটাইট। পৃথিবীর
চুম্বক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয় এবং তার দিক বদল হয়। চুম্বক ধর্মের এই পরিবর্তন পাথরে
রেখে যায় তার পদচিহ্ন। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সেই পাথরের চুম্বক ধর্মের
বিশ্লেষণ করে জানতে পারেন ভূ-স্তরের বয়স।
এবার দেখা যাক কীভাবে
সমুদ্রপৃষ্ঠে নতুন পাথরের স্তর সৃষ্টি হচ্ছে। পৃথিবী
পৃষ্ঠের উপরিতল, যাকে বলা হয় লিথোস্ফিয়ার, সেটা দু’রকমের। মহাসাগরের
তলায় যেটি আছে তাকে বলা হয় ওশানিক প্লেট, আর একটি হল কন্টিনেন্টাল প্লেট – এটি
স্থলভাগে আছে। ওশানিক প্লেট অনেক পাতলা। তুলনায়
কন্টিনেন্টাল প্লেট অনেক বেশি পুরু। পৃথিবীর কেন্দ্রে যে কোর আছে, তার তাপ
ম্যান্টেলকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে চলেছে। এর ফলে ম্যান্টেলের তরলীভূত পাথর, “কনভেকশন”
বা পরিচলনের কারণে নিচ থেকে উপরে প্রবাহিত হয়। বিপরীত
দিশায় ঘূর্ণায়মান দুই ম্যান্টল প্রবাহের কারণে সমুদ্রের তলদেশের প্লেটে ফাটল তৈরি
হয়। পৃথিবীপৃষ্ঠে উঠে আসা লাভা জলের সংস্পর্শে এসে ঠাণ্ডা হয়ে সৃষ্টি হয়
আগ্নেয়গিরি। আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে লাভা নির্গত হতে থাকে। এইভাবে জেগে ওঠা নতুন
পর্বতশ্রেণী জন্ম নেওয়ায় দু’পাশের জমিতে চাপ পড়ে এবং তারা ভাগ হয়ে দূরে সরে যায়।
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত দীর্ঘস্থায়ী হলে শৈলশিরা আরও উঁচু হয়ে জন্ম দেয়
দ্বীপপুঞ্জের। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এমনই এক শৈলশিরা থেকে জন্ম নিয়েছিল অনেক অনেক বছর
আগে।
![]() |
পৃথিবীর তিনটি স্তর |
যখন
ক্রাস্টের একটি প্লেট অপরটির নিচে চলে যায়, তখন পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠে সৃষ্টি হয়
পরিখা। আগ্নেয়গিরির চারিপাশে জেগে ওঠা দ্বীপপুঞ্জের কাছে এমন পরিখা দেখতে পাওয়া
যায়। সমুদ্রতলের প্লেট বিভিন্ন ভাবে শৈলশিরার দুই পাশে সরে যেতে পারে। একটা প্লেট
আর একটির নিচে চলে যেতে পারে, অথবা একটি প্লেট আর একটির সঙ্গে পাশাপাশি সমান্তরাল
ভাবে ধাক্কা খেতে পারে, বা পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে পারে। প্লেটের সরে যাওয়ার
ধরণ নির্ভর করে প্লেটের আকৃতি ও ধাক্কার দিকের উপর।
কন্টিনেন্টাল প্লেটও দু’ভাগে
ভাগ হয়ে যেতে পারে। যদি ভূ-পৃষ্ঠের নিচে ম্যান্টেলের প্রবাহের ফলে আগ্নেয়গিরি
যথেষ্ট জাগ্রত হয়, তবে হাজার হাজার বছরের ক্রমাগত লাভা উদ্গিরন হয়ে অবতল ভুমির
সৃষ্টি হয়, যাকে বলা হয় রিফট ভ্যালি। ভূ-পৃষ্ঠের অবনতির জন্য সমুদ্রের জল ছুটে এসে
সেখানে জমিকে দু’ভাগে ভাগ করে দেয়। এমনই ভ্যালি সৃষ্টি হয়েছিল পূর্ব আফ্রিকায়।
![]() |
আইসল্যান্ডের রিফট ভ্যালি |
ম্যান্টেলের
উপর ভাসমান দুটি প্লেট পরস্পর ধাক্কা খেয়ে পর্বতরাজীর সৃষ্টি করতে পারে। লক্ষ লক্ষ
বছর আগে ভারতবর্ষ দক্ষিণ এশিয়ান প্লেটের সঙ্গে জুড়ে ছিল না। ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান
প্লেট ধাক্কা খায় ইউরাশিয়ান প্লেটের সঙ্গে। ফলে চিনের সঙ্গে জুড়ে যায় ভারত ভূখণ্ড।
ধাক্কা যে খেয়েছিল, তার বড়ো প্রমাণ – হিমালয় পর্বতমালা, যা এই উপমহাদেশকে উত্তর
দিশায় অন্য মহাদেশ থেকে আলাদা করেছে বিশাল প্রাচীরের সৃষ্টি করে। এই ধাক্কার ফলে একটি
প্লেট আর একটির নিচে ঢুকে যায়। হিমালয় অঞ্চলে ইন্ডিয়ান প্লেটের এই ম্যান্টেলের
দিকে ঢুকে যাওয়া এখনও চলেছে, তবে অত্যন্ত ধীর তার গতি — গড়ে ৪০ মিমি প্রতি বছরে। তাই
আমরা এই চলন বুঝতে পারি না। কিন্তু মাঝে মধ্যে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিকম্প
হলে বোঝা যায় কোথাও একটি প্লেট আর একটির নিচে একটু বেশিই প্রবেশ করেছে হঠাৎ।
দুটি প্লেটের সংযোগস্থলকে
বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন – একটিভ জোন। এখানেই ভূমিকম্প হয়ে জমি ধ্বসে যাওয়ার
সম্ভাবনা প্রবল। সাম্প্রতিক নেপালের ভূমিকম্পর কথা আমরা সবাই জানি। নেপাল দেশটি
এমনই একটিভ জোনের উপরে স্থিত হওয়ার কারণে এই ভূমিকম্প তার ভয়াবহ চেহারা দেখিয়েছিল। প্লেট-টেকটনিক্স
তত্ত্ব আবিষ্কৃত হওয়ার আগেও বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোথায় কোথায় ভূমিকম্প হওয়ার
সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু তার সঠিক কারণ জানা ছিল না। পৃথিবীর মানচিত্রে সাতটি টেকটনিক
প্লেটের নির্দেশ দেওয়া হল নিচের চিত্রে।
![]() |
পৃথিবীর উপরের খোলের সাতটি প্লেটের অবস্থান |
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে নেপাল
যে ভূমিকম্পের ফলে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার কারণ ছিল ইন্ডিয়ান প্লেটের
ইউরাশিয়ান প্লেটের নিচে অবনমন। এই দুটি প্লেট তাদের সংযোগস্থলে আটকে ছিল। যদিও
তাদের চলন ছিল অব্যাহত। আটকে থাকার জন্য ক্রমাগত একটি প্লেট আর একটিকে চাপ দিতে
থাকে। চাপের পরিমাণ যখন একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে, তখন প্লেট ম্যান্টেল
অভিমুখে হঠাৎ ধ্বসে যায়। নেপালের ভূমিকম্পের সময় ইন্ডিয়ান প্লেট প্রায় তিন মিটার
নিচে নেমে যায়। প্রবল ভূমিকম্পে ধ্বসে যায় ঘর বাড়ি। মাটি ও ইট দিয়ে তৈরি বাড়িগুলো
মাটিতে মিশে যায়। স্টিল রড, সিমেন্ট আর বালি দিয়ে তৈরি বাড়িগুলো বেঁচে যায়, কারণ
তারা এই প্রবল ঝাঁকুনি সহ্য করতে পেরেছিল। ভূমিকম্পের পর উপর্যুপরি আরও কম্পন সৃষ্টি
হয়ে থাকে, যাকে বলা হয় “আফটার-শক”। দুটি
প্লেটের মধ্যে জমে থাকা চাপ মুক্ত হয়ে এই কম্পন পৃথিবীপৃষ্ঠে সৃষ্টি হয়ে থাকে। ভূ-বিজ্ঞানীদের
কাছে আফটার-শক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কম্পন ভূমিকম্পের ধরণ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে
আগাম সংকেত দিয়ে মানুষকে বিপদের আগে পুনর্বাসন করায় সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গে
উল্লেখ করা যায়, ভূমিকম্প মাপার যন্ত্রের নাম সিস্মোগ্রাফ। কম্পন মাপার একক —
রিখটার স্কেল। ৭.৫ বা ৮ রিখটার স্কেলের বেশি কম্পন হলে ভূমিকম্প বিধ্বংসী হয়ে ওঠে।
নেপালের ভূমিকম্পের পরিমাপ ছিল ৭.৮ রিখটার স্কেল।
এ তো গেল স্থলভাগে ভূমিকম্পের
কথা। সমুদ্রের নিচে যদি প্লেটের সংঘর্ষ হয়, তবে জলোচ্ছ্বাস ঘটে থাকে, যেমন সুনামি।
২০০৪ সালে যে সুনামি হয় তাতে ভূমিকম্পের পরিমাণ ছিল ৯.০ রিখটার স্কেল। মাত্র ৩০
মিটার নিচে ছিল এর উপকেন্দ্র (এপিসেন্টার)। ইন্ডিয়ান প্লেট বার্মিস প্লেটের নিচে
চলে যায়। ফলে সমুদ্রতল ভেঙে গিয়ে ১৫-২০ মিটার উত্থিত হয়। ৭২০ কিলোমিটার প্রতি
ঘণ্টায় ছুটে আসে সাগরের ঢেউ, ভেসে যায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপের
সমুদ্র সৈকত। প্রায় ১,৭৫,০০০ মানুষ এই সুনামিতে মারা যায়। সবচাইতে বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্দোনেশিয়া। মানব ইতিহাসে জানা তথ্য অনুযায়ী এই সুনামিটিই
সর্বাপেক্ষা বিধ্বংসী ছিল।
একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন
মানুষের মনে উদয় হয় — ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী কি সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তরে
বিজ্ঞানীদের এখন পর্যন্ত কার্যকলাপ বলছে — না। ভূকম্পন মাপবার যন্ত্র এখনও এতটা
উন্নতি লাভ করেনি। তবে ইঁদুর, সাপ, মাছ, পাখি ও আরও অনেক প্রাণী নাকি ভূমিকম্পের
পূর্বাভাস জানতে পারে তাদের সহজাত অভ্যাসে। এমনকি কিছু জনবসতি থেকে বিচ্ছিন্ন আদিম
অধিবাসীরও এই ক্ষমতা আছে বলে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন।
তথ্যসূত্র –
1.
Theory of Plate Tectonics, CK-12, Flexbook, 2013
2.
Plate
Tectonics and Crustal Evolution, Condie, K.C., Pergamon, Oxford,1997
3. Plate Tectonics: Continental Drift and Mountain Building,
Wolfgang Frisch, Martin Meschede, Ronald C. Blake, Springer Publication, 2011.
_____
No comments:
Post a Comment