
রুপোলি সুতোর রূপকথারা
শাম্ব চ্যাটার্জী
॥ ১ ॥
শিয়ালদহ স্টেশনে ঢোকার মুখে
ট্রেনটা আচমকা দাঁড়িয়ে যেতেই অনুরাগের চটকাটা ভাঙল। এই ব্যাপারটা এখন রোজকার
অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আসলে যাত্রী বাড়লেও শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রান্তিক স্টেশনের ব্যাপ্তি
ততটা বাড়েনি। ফলে নিত্যযাত্রীদের ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে বই কমার কোনও লক্ষণ নেই! রেলও কিছুটা নিরুপায়, আর তাই কিছু এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ার ব্যবস্থা করা
হয়েছে নতুন কলকাতা স্টেশন থেকে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তেও প্রকৃত সুরাহা কিছু হয়েছে
বলে আদৌ মনে হয় না! সময়ে ট্রেন ঢোকা তাই অলীক কল্পনার
পর্যায়ে পর্যবসিত। গেটের কাছে ঝুলতে ঝুলতে অনুরাগ কোনোরকমে
লক্ষ করল সিগন্যাল অবশেষে সবুজ হয়েছে। ট্রেনটা শেষমেশ সেই ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই
ঢুকিয়েছে। একরাশ বিরক্তির মাঝে অনুরাগ বুঝতে পারল আজও পিকে স্যারের ক্লাসটা সে মিস
করতে যাচ্ছে। স্যারের পপুলারিটি ‘পিকে’ মুভিটা রিলিজ করার পর বেড়েছে বই কমেনি। না
যা ভাবছেন, ঠিক তা নয়। সিনেমার নামের পিছনে যে কাহিনি ছিল
ব্যাপারটা ঠিক উলটো! ওঁর চেহারার সব থেকে লক্ষণীয় অংশ হচ্ছে ওঁর খাড়া কর্ণযুগল। ওই
ব্যাপারে সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে এমন যুগান্তকারী সাদৃশ্য লক্ষণীয় ব্যাপার বৈকি!
তাই ‘পিকেডি’, মানে প্রশান্ত কুমার দে থেকে ‘পিকে’ হতে বেশি সময় লাগেনি। এসব
সত্ত্বেও স্যারের ক্লাসে ভিড় রীতিমতো দেখার বিষয়। পলিটিকাল সায়েন্স সাবজেক্টটা ওঁর
মতো করে এ তল্লাটে খুব কম লোকই বোঝাতে পারেন। তাছাড়া স্যার রসিকও বটে। একবার গ্যারিকে
যা নাজেহাল হতে হয়েছিল! গ্যারির পুরো নাম গৈরিক ব্যানার্জী। ঠাকুরমার দেওয়া আদরের
নামটা মফঃস্বল থেকে কলকাতা পৌঁছে গ্যারি-তে পরিণত হয়। খ্যাংরাকাঠির মতো চেহারায়
নিত্যনতুন ফ্যাশনের আনাগোনা ছিল সে এক দেখবার মতো বিষয়! এহেন গ্যারি সেদিন পিকে
স্যারের ক্লাসে রিপড নি জিন্স পরে উপস্থিত। বসবি তো বস, তাও এক্কেবারে ফার্স্ট বেঞ্চে!
স্যার স্বভাবগাম্ভীর্যে রোল কল শেষ করার পর আড়চোখে গোটা ক্লাসের দিকে তাকিয়ে গট গট
করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সবার হতভম্ব ভাবটা কাটার আগেই
উনি আবার ফিরে এলেন। ক্লাসে ঢুকে সটান ফার্স্ট বেঞ্চে গৈরিকের সামনে গিয়ে
দাঁড়ালেন। আচমকা সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে, হাতের মুঠো থেকে
স্টেপলারটা বার করে খচাখচ স্টেপল করতে শুরু করলেন হাঁটুর কাছের ছেঁড়া অংশগুলো! হতবাক গৈরিক, থুড়ি গ্যারির অবস্থা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কাজ শেষ করে উঠে
দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে স্যার বললেন, “যেখানে ভেন্টিলেশন প্রয়োজন সেখানে তো এই গরমেও
টুপি দিয়ে ঢেকে রেখেছিস। আর তার বদলে...। তুই আজ প্রমাণ করলি যে ‘লম্বাদের বুদ্ধি
হাঁটুতে থাকে’, নাহলে ওখানে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করিস।” গোটা ক্লাস এরপর হাসিতে
ফেটে পড়ল। হঠাৎ কনুইয়ের গুঁতো পড়তে বাস্তবের
প্রেক্ষাপটে ফিরল অনুরাগের মন। স্টেশনে ঢোকার পর ট্রেন থেকে নামার আগেই জানালার
ধারের সিট দখলের এই উৎপাত নিত্যযাত্রীদের বরাবরের অভিজ্ঞতা। নিজেকে সামলে নিয়ে
মানুষের স্রোতে সামিল হল অনুরাগ।
॥ ২ ॥
সেই সুন্দর গন্ধটা আবার
পাচ্ছে মলয়। মায়ের গায়ের এই গন্ধটা তার খুব প্রিয়। সারাদিনের কাজের শেষে মা যখন
পাশে এসে বসত, তখন মায়ের আঁচলে মুখ ডুবিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিত সে। সেই ভরাট
অনুভূতির মাঝে মায়ের হাতের নরম স্পর্শ একরাশ ভালো লাগা অনুভূতি এনে দিত। এখন সেই
একইরকম বোধ হচ্ছে তার। অদ্ভুত নরম এক ছোঁয়া সারা মুখে মাখামাখি হয়ে স্নেহ ঢেলে
চলেছে। হঠাৎ চটকা ভেঙে চোখ মেলে চাইতে বাস্তবের মাটিতে ফিরে এল মলয়। এতক্ষণে বুঝতে
পারল মায়ামাখা স্বপ্নের ঘোরে ছিল সে। আর ঘুমের ঘোরে ফেকুর আদরকেই সে মায়ের হাতের
স্পর্শ ভেবে বসেছিল। মনটা ভার হয়ে এল। ঠিক সেই
সময় আবার ফেকুর সশব্দ উপস্থিতি তাকে মনে করিয়ে দিল এবার চটপট উঠে পড়তে হবে। আসলে
রোজ ভোর রাত থাকতে থাকতে ফেকু তাকে এভাবেই ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। এরপর
চট করে সকালের কাজ সেরে স্নান করে নিয়ে বাবার জন্য খাবার বানিয়ে রান্নাঘরে ঢাকা
দিয়ে রেখে দেয় মলয়। তারপর একমুঠো মুড়ি চিবোতে চিবোতে
স্টেশনমুখো রওনা দেয়। ভোরের আলোয় চারপাশে সদ্য আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠা গ্রাম্য
মফস্বলের রাস্তা ধরে আনমনে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায় সে। ফেকু
তাকে রোজ স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। সকাল ৬:৪২-এর লালগোলা-শিয়ালদহ প্যাসেঞ্জার ধরে
কলকাতা রওনা দেয় মলয়। মুড়াগাছা স্টেশনের স্টেশনমাস্টার থেকে শুরু করে চায়ের
দোকানের মন্টুদা পর্যন্ত সক্কলে তাদের এই দোস্তির সাক্ষী। যতক্ষণ পর্যন্ত মলয়ের
ট্রেনটা দূরে রেললাইনের বাঁকে অদৃশ্য না হয়ে যায়, ততক্ষণ ফেকু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে
প্ল্যাটফর্মের কদমগাছটার তলায়।
ট্রেনের জানালা দিয়ে স্টেশনে
দাঁড়ানো ফেকুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে জল এসে যায় মলয়ের। পুরোনো দিনের কথা
মনে পড়ে যায়। কতই বা বয়স হবে তখন, দশ-এগারো। বাড়ির কাছে মুড়াগাছা হাইস্কুলে পড়ত সে।
সকাল হতেই বাবা স্টেশনমুখো রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই উঠে পড়তে
হত। মা শিয়রে এসে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম ভাঙাতেন। ওই সময়টা মলয়ের
খুব প্রিয় ছিল। মায়ের আঁচলের গন্ধ নেওয়ার অছিলায় ঘুমের ভান করত মলয়। আর মা সেটা
জানতেন বলেই শেষমেশ তাড়া লাগাতেন। এরই মাঝে ফেকু এসে সেই আদরে কিছুটা ভাগ বসাত। মলয়
আর ফেকুর মধ্যে মলয়ের মাকে নিয়ে এক মিষ্টি যুদ্ধ চলত। ফেকুকে
মা’ই তুলে আনে। এক শীতের রাত্তিরে বেচারা ওদের ছোট্ট
এক চিলতে উঠোনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো ঠক ঠক করে কাঁপছিল। ছোট্ট ফেকু তখন নিজের মাকে
হারিয়ে কেঁউ কেঁউ করে আওয়াজ করছে আর ইতিউতি চাইছে। মা উনুন ধরানোর জন্য উঠোনে জড়ো
করা জ্বালানীর কাঠকুটো আনতে গিয়ে ওকে দেখতে পায়। মাকে দেখামাত্র কে জানে কিসের
টানে গুটি গুটি পায়ে মায়ের পায়ের কাছে এসে ফেকু মুখ ঘষতে থাকে। মলয়ের মা তৎক্ষণাৎ বেচারাকে
দু’হাতে আলতো করে তুলে নিয়ে উঠোনের অন্য পাশে ছোট্ট ছাউনি দেওয়া অংশে খড়ের গাদায়
পুরোনো কাপড় পেতে ওর নতুন ঠাঁইয়ের ব্যবস্থা করে দেন। বড়ো হয়ে ওঠা পর্যন্ত তিনি ওকে
পরিষ্কার ন্যাকড়া গুটলি পাকিয়ে দুধে চুবিয়ে মুখের কাছে ধরে খাইয়ে দিতেন। ফেকুও
ওমনি চুক চুক করে সেই দুধ ঝটপট খেয়ে ফেলত। ফেকু নামটা মা-ই আদর করে দিয়েছিল।
বাপ-মা হারানো অবলা জীবটা ধীরে ধীরে মলয়দের পরিবারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে
যায়। আজ বছরখানেক হল মা আর নেই। প্রথম প্রথম মায়ের জন্য ভীষণ মন কেমন করত তার। মা
মারা যাওয়ার পর বাবাও কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার পর আজও পুরোপুরি
স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি তিনি। সঠিকভাবে বলতে গেলে ওঁর মধ্যে থেকে সহজ
সাবলীলভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টাটাই চলে যায়। ঘটনাটার স্মৃতি এখনও টাটকা মলয়ের মনে। রেললাইনে
প্যাসেঞ্জার ট্রেনের চাকার ঘটাং ঘটাং শব্দে সংবিৎ ফিরল মলয়ের। ভোরের মায়ামাখা
আলোটাও কেমন বাবার ফ্যালফ্যালে দৃষ্টির মতো ঘোলাটে মনে হচ্ছে তার।
॥ ৩ ॥
কলেজ ক্যান্টিনের এই কোণের
টেবিলটা অনুরাগের কলেজ ঢোকার প্রথম দিন থেকেই খুব প্রিয়। এখনও মনে আছে যেদিন
ভর্তির লিস্ট টাঙানো হয়েছিল, সেদিন একরাশ টেনশন মাখানো মুখে এখানে বসেই সাত-পাঁচ
ভাবছিল সে। ঠিক সেই সময়টাতেই প্রবালের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। প্রবাল তখন সামনের
চেয়ারটাতে বসে প্রবল উৎসাহে পাউরুটি আর আলুর দম খাচ্ছিল। ফর্ম তোলার দিন লাইনে
দাঁড়ানোর সময় প্রবালকে সে আগেই দেখেছিল। মুখটা মনে
করতে তাই বেশি বেগ পেতে হয়নি। প্রবালকে দেখে হতবাক অনুরাগ একটা কথাই ভাবছিল, এমন
টেনশনের মুহূর্তে কী করে একটা মানুষ এভাবে তৃপ্তি সহকারে তারিয়ে তারিয়ে খেতে পারে!
অনুরাগের তখন ওই ভ্যাপসা গরমেও রীতিমতো হাত-পা ঠাণ্ডা! প্রথম কথাটা প্রবালের তরফ
থেকেই ভেসে এল, “কোন সাবজেক্টে অ্যাপ্লাই করেছ ভাই? আমি তো চোখ বুজে পল সায়েন্সে
ফর্ম ভরে দিয়েছি। আরে বাবা, কলেজে যখন পড়ব তখন মাঝে মধ্যে আমাদের আবেদন-নিবেদন
নিয়ে মিটিং-মিছিলে তো মুখ দেখাতেই হবে, তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানই সই। বাস্তব জীবনের
অভিজ্ঞতার ঝুলিটাই তো আসল পড়াশোনা। আলাদা করে বিষয়টা নিয়ে মাথাও ঘামাতে হবে না, আর
ক্লাসে স্যারেদের গুরুগম্ভীর লেকচার থেকেও অব্যাহতি মিলবে।” বিষয় নির্বাচনের স্বপক্ষে
এমন অকাট্য যুক্তি যে দিতে পারে, তার পক্ষে টেনশনের মুহূর্তে আলুর দম খেয়ে তৃপ্তির
ঢেঁকুর তোলাটা নিতান্তই স্বাভাবিক! প্রথমটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও অনুরাগ সামলে
নিয়ে হেসে ফেলেছিল। সামনে বসে পাউরুটির শেষ টুকরোটা আলুর দমের বেঁচে থাকা ঝোলে
মাখিয়ে নিয়ে মুখে চালান করে প্রবালও তখন হাসছিল। দু’জনের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে তাই বেশি
সময় লাগেনি। ভর্তির লিস্টে নিজেদের নাম দেখার পর তারা সেদিন একসঙ্গে কলেজ স্ট্রীটে
বইপাড়ায় ঘোরাফেরা করে ফেরার পথ ধরেছিল।
কলেজে ঢুকে কিছুদিনের মধ্যেই
প্রবালের কল্যাণে ওদের বন্ধুবান্ধবের দলটা আকারে বেশ বড়োসড়ো হয়ে ওঠে। প্রবাল নিজের
কথাই বজায় রেখেছিল। ক্লাসে বেশি সময় দেওয়ার বদলে
স্টুডেন্ট কমন রুমেই দিনের অর্ধেক সময় কাটত তার।
অথচ ক্লাস-টেস্টগুলোতে প্রবাল বেশ ভালো নম্বরই পেত! কী করে এই অসম্ভবকে সে সম্ভব
করত তা একমাত্র ভগবানই জানেন! যদিও সেই চৌকাঠ তাকে অনুরাগ কোনোদিনও মাড়াতে
দ্যাখেনি। প্রবালের সহজ সরল ব্যবহার আর
সাদামাটা চালচলনের কারণে সিনিয়র দাদা-দিদি থেকে ডিপার্টমেন্টের স্যারেরা প্রবালকে
খুবই পছন্দ করত। ওকে পছন্দ করার আর একটা প্রধান কারণ ছিল সকলের যে কোনও সমস্যা বা
প্রয়োজনে ও নিজের জান লড়িয়ে দিত। নিজের বন্ধুভাগ্য নিয়ে তাই অনুরাগের গর্বের অন্ত
ছিল না। এভাবেই দিনগুলো স্মৃতির ভাঁড়ার অমূল্য সম্পদে ভরিয়ে তুলছিল।
পিঠে হালকা চাপড়ে চটকা ভাঙল
অনুরাগের। ফিরে দ্যাখে বরুণ দাঁড়িয়ে। পিছনে তাদের ক্লাসের শ্যামল, রুদ্র, অনির্বাণ
এরা সবাই। ওদের দেখে কিছুটা অবাক হল অনুরাগ! পিকে স্যার তো এত তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ
করেন না! ওর প্রশ্ন করার আগে মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বরুণ বলে ওঠে, “আজ স্যার জলদি
ছেড়ে দিয়েছেন। আসলে সামনেই কলেজ সোশ্যালের অনুষ্ঠান। প্রিন্সিপাল স্যার নোটিশ
পাঠিয়েছিলেন, ওই ব্যাপারে স্টুডেন্ট কমিটির সঙ্গে ছোট্ট একটা মিটিং করবেন। পরের
ক্লাসটা ওঁর থাকায় সেই সময়েই কমিটির সবাইকে ডেকেছেন। ক্লাসের মুড বুঝে তাই পিকে
স্যার আজ বেশ খানিকটা আগেই ছেড়ে দিলেন।” সব শুনে অনুরাগ হাফ ছেড়ে বাঁচল। যাক আজ
তাহলে স্যার বেশি পড়াননি। কলেজ সোশ্যালের কথাটা শুনে ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠল। কলেজে
ঢুকে অবধি কলেজ সোশ্যালের সম্পর্কে বহু কিছু শুনে আসছে সে। বন্ধুবান্ধব মিলে
আনন্দে মাতোয়ারা হবার এমনি সুযোগ কি বার বার আসে? এরই মধ্যে সে শ্যামলকে জিজ্ঞাসা
করে, “প্রবাল কোথায়? মিটিং-এর নিউক্লিয়াসই তো মিসিং দেখছি?” উত্তরে শ্যামল বলে,
“আজ ক্লাসে তো ওকে দেখিনি, তবে প্রিন্সিপালের রুমে গেলে দেখবি আমাদের আগেই সেখানে
পৌঁছে গিয়েছে। এসব ব্যাপারে ওর উৎসাহ আর আইডিয়া দুটোই মারাত্মক।” অনুরাগ মৃদু হেসে
মাথা নেড়ে শ্যামলকে সমর্থন করে। এরপর সবাই মিলে ক্যান্টিনের চা-সিঙ্গারা ধ্বংস
করতে করতে আসন্ন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় মেতে উঠল।
॥ ৪ ॥
দশটা নাগাদ শিয়ালদহ স্টেশনে
নেমে জোরে পা চালাল মলয়। বেশি দেরি হলে আবার সনৎদা দু’চার কথা শুনিয়ে দেবেন। এমনিতে
মানুষটা ভালো, কিন্তু কাজের এদিক-সেদিক হলে আর রক্ষে নেই। আসলে সকালের এই সময়টা এক
রাশ কাজ জমে থাকে। টেবিলপত্তর ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে বাসন গুছিয়ে রাখা সবই
তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। পরে ভিড় শুরু হলে দম ফেলার ফুরসত থাকে না। বৈঠকখানা বাজার
পাশে হওয়ায় মাছ-মাংস বা সবজিপত্তরের মজুতে টান পড়লে চটজলদি সুরাহা করা যায়, কিন্তু
রান্নাবান্না চড়তে দেরি হলে পরে আর সামলানো যায় না। আর ভিড়ের সময় বেচাল হলেই
সনৎদার মেজাজ উত্তরোত্তর চড়তে থাকে। গায়েগতরে দু’চার ঘা পড়লে দাঁত চিপে সহ্য করে
নেয় মলয়। চাকরি বড়ো বালাই। আসলে এটা হারালে পথে বসতে হবে। তার ছোট্ট কাঁধটার দায়িত্ব
অনেক। মাকে সে কথা দিয়েছিল বাবার পাশে সব সময় থাকবে। বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে
বাড়িটা বন্ধক দিতে হয়েছে। সে ঠিক করেছে প্রতি মাসের মাইনে থেকে একটু একটু করে সেটা
শোধ করবে। মায়ের আঁচলের গন্ধমাখা বাড়িটা কোনোমতেই হারিয়ে ফেলা যাবে না। চাকরি
হারালে তাই সব শেষ। এসব কিছুর মাঝে স্বপ্ন দেখাটা ছাড়েনি মলয়। স্কুলের গণ্ডি
পেরিয়ে কলেজে পড়ার ইচ্ছেটা তাই এখনও মনের কোণে জিইয়ে আছে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা
তাকে বরাবরই ভীষণ স্নেহ করেন। মায়ের চলে যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে গিয়ে স্কুলের
মায়া তাকে একরকম ত্যাগ করতে হয়েছিল। বাবার অসহায়
চাহনির তুলনায় নিজের শৈশবের অপমৃত্যুকে তাই মলয়ের নিতান্তই পানসে মনে হয়। কলেজ
ক্যান্টিনের এই চাকরিটা বাবার বন্ধু হারুদাই জোগাড় করে দেন। সময়ের অভাবে স্কুলের
দরজা সেদিন তার কাছে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলপথের নিত্যসঙ্গী ফেকুর চোখেও
সেদিন একইরকম বেদনার আভাস পেয়েছিল মলয়।
ভাগ্যের আকস্মিক বিপর্যয়ে তার
একমাত্র সহযোদ্ধা ছিল আদরের ফেকু। আর সেদিন থেকেই ফেকু মলয়ের অঘোষিত অভিভাবক হয়ে
ওঠে। তার প্রমাণ মলয় কিছুদিন পরেই পায়। স্কুলের সকলেই তাদের দোস্তির কথা জানত। রবিবারের
এক সকালে হেডস্যার হঠাৎ করেই মলয়ের বাড়িতে উপস্থিত হন। মলয় তখন বাবার পথ্যি তৈরিতে
ব্যস্ত। উঠোনে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্রের নাম ধরে ডাক দিতেই মলয় বেরিয়ে আসে।
বাইরে বেরিয়ে সে দ্যাখে হেডস্যার স্নিগ্ধ হাসিমাখা চাহনি নিয়ে তার অপেক্ষায়
দাঁড়িয়ে। মলয় ছুটে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে। স্কুল ছাড়ার পর লজ্জায় সে বহুদিন
স্যারের মুখোমুখি হয়নি। স্যারের স্নেহাশীর্বাদের ছোঁয়া পেয়ে মুখ তুলতে উনি
জিজ্ঞাসা করলেন, “স্কুল ছাড়ার পর আর আসিসনি কেন? নিজের অসুবিধার কথাটা মুখ ফুটে
একবার আমায় বলতে পারলি না রে হতভাগা? এই বয়েসে যে গুরুদায়িত্ব তুই নিয়েছিস, সেটা বয়েসে
বড়ো অনেকেই করতে পারে না। তাই বলে পড়াশুনোটা বন্ধ করে দিবি! তোর জন্য আমি স্কুল
কমিটির সঙ্গে কথা বলে একটা উপায় বার করেছি। ছুটিছাটার দিনে বিষয় শিক্ষকেরা তোকে
সপ্তাহের পড়া পড়িয়ে দেবেন। শুধু পরীক্ষার সময়টুকু কাজের জায়গায় ছুটি চেয়ে নিবি।
দরকার হলে হারুকে বলে আমি সে ব্যবস্থা করে দেব। ভাগ্যিস ফেকু আমায় জোর করে হারুর
কাছে টেনে নিয়ে গেল, নইলে তো...।” স্যারের আড়ালে দাঁড়িয়ে তখন ফেকু তার ল্যাজ
নাড়িয়ে সারমেয়সুলভ ভঙ্গিতে নিজের খুশি প্রকাশে ব্যস্ত। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ
ভিজে গেল মলয়ের। স্যার চলে যাওয়ার পর সে ঘরে এসে বিছানায় আধশোয়া বাবার পাশে এসে
বসল। বাবার মলিন মুখের অভিব্যক্তির মাঝে
কোথাও যেন ভোরের আশার আলো ঘোরাফেরা করছে। চোখের কোল বেয়ে আসা কয়েক ফোঁটা মুক্তোর
দানা ঝরে পড়ল অব্যক্ত খুশির নীরব ধারায়। বাবার বুকে আলতো করে মাথা রাখল মলয়। শুধু
একটাই দুঃখ বড্ড খোঁচা দিচ্ছে তাকে। বিছানা থেকে
উঠে এসে সামনের দেওয়ালে টাঙানো মায়ের সাদাকালো ছবিটার দিকে তাকাল সে। মায়ের হাসি হাসি
মুখটার মাঝে মনে ভেসে ওঠা প্রশ্নটারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে, কিন্তু জবাব মেলে না।
চোখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকাতে মলয় লক্ষ্য করেছিল যে তিনি একদৃষ্টে ঘরের এক পাশের
বন্ধ ট্রাঙ্কের দিকে চেয়ে আছেন। বিদ্যুৎচমকের মতো তার খেয়াল হল তাদের জীবনের
হারাতে বসা এক অধ্যায়ের কথা। ওখানেই যে লুকিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া সেই অধ্যায়ের
জিওনকাঠি।
ক্যাঁচ শব্দে ব্রেকের আওয়াজে আর
জোরালো একটা ধাক্কায় এক ঝটকায় বাস্তবে ফিরল মলয়। আরেকটু হলে বাইকটা ধাক্কা মারত
তাকে। চারপাশে পথচলতি মানুষ তার হঠকারিতায় বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে। প্রাথমিক ট্রমা
কাটিয়ে উঠতে কানে এল, “এত বেখেয়ালে পথ চললে হয় ভাই। কলকাতার রাস্তায় একটু সতর্ক
থাকা উচিত।” এই বলে সামনে জমে ওঠা ভিড়কে হতাশ করে তাকে একরকম টানতে টানতে বার করে
আনে কলেজপড়ুয়া ছেলেটি। সামান্য পিঠ চাপড়ে দিয়ে কলেজমুখো এগিয়ে যায় সে। এই
ছেলেটি আর কেউ নয়, প্রবাল।
॥ ৫ ॥
যথাসময়ে প্রিন্সিপালের রুমের
সামনে জড়ো হয় অনুরাগ ও ক্লাসের অন্য বন্ধুরা। দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে স্যারের
পরিচিত মন্দ্রস্বরে জবাব আসে, “কাম ইন।” দরজার ফাঁক দিয়ে বাড়ানো পরিচিত মুখগুলো
দেখতেই এক রাশ হেসে প্রিন্সিপ্যাল অনল কুমার কুণ্ডু ওদের স্নেহমাখা গলায় বলেন, “কী
কলকাকলির দল, নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে এমন সময়ে আগমন ঘটেছে। অবশ্য তার কিছুটা
আভাস আমি আগেই পেয়েছি।” এই বলে তিনি ঘরের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা প্রবালের দিকে
সহাস্যবদনে ইঙ্গিত করেন। শ্যামল পাশে দাঁড়ানো অনুরাগের দিকে সকলের অলক্ষে আলতো করে
চোখের ইশারায় তার ক্যান্টিনে বলা কথাটার সার্থকতা বোঝানোর চেষ্টা করে। শ্যামলের বোঝানোর
অঙ্গভঙ্গিতে অনুরাগ কোনোক্রমে পেটের ভেতর সুড়সুড়িয়ে ওঠা হাসি চেপে স্যারের দিকে
তাকিয়ে ওঁর বক্তব্যের সমর্থনে মাথা নাড়িয়ে বলে, “এতক্ষণে হয়তো আপনি আমাদের আসার
কারণটা প্রবালের মুখে অনেকটাই শুনে ফেলেছেন স্যার। আসলে এবারে আমরা বরাবরের মতো
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও নতুন ধরনের কিছু করতে চাইছি। অন্যান্য বার আমরা কোনও
খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পীকে আমাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে তাঁকে সংবর্ধিত করতাম।
সংবর্ধনা শেষে শিল্পীর মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠান দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হত। এছাড়াও
ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান তো ছিলই। কিন্তু এবারে ব্যতিক্রমী কোনও
অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা যদি করা যায়, তাহলে বেশ হয়। এ ব্যাপারে ক্যান্টিনে আমি
সবাইকে আমার এই প্রস্তাবের কথা জানিয়েছি, আর সকলের তাতে সম্মতিও আছে।” এই
বলে মুচকি হেসে অনুরাগ প্রবালের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়। প্রবাল হেসে বলে,
“আমারও এতে সায় আছে স্যার। তবে নতুন কিছু করতে গেলে বাজেটের বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে।
সে ক্ষেত্রে স্পনসর জোটানো একটা বড়ো সমস্যা। আসলে আজকাল স্পনসররা সেখানেই উৎসাহ
দেখায় যেখানে মিডিয়ার আগ্রহ আছে। আর সেখানেই যত গণ্ডগোল। আমাদের মতো কলেজে মিডিয়ার
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে কোনও হেভিওয়েট ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ করতে হবে, অথবা এমন
একটা কিছু যেটা আগে কখনও কোনও কলেজ সোশ্যালে কেউ ভাবতে পারেনি। প্রথমটা হলে স্পনসর
আপনিই আসবে, কিন্তু সেরকম কাউকে রাজি করিয়ে এত কম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান করাটা
রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ। তবে অনুরাগ আর বাকি বন্ধুদের প্রস্তাব মানলে এমন কিছু
ভাবতে হবে যেটা বাজেটে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।” গ্যারি মানে গৈরিক বহুক্ষণ ধরে
শ্যামলের পিছনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলবে বলে উশখুশ করছিল।
প্রবাল থামতে সে বলে উঠল, “স্যার যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমার মাথায় একটা আইডিয়া
এসেছে।” ঘরে উপস্থিত সবার নজর তখন একযোগে গৈরিকের দিকে। সবার চোখমুখ দেখে বিলক্ষণ
বোঝা যাচ্ছিল যে একটা আস্ত অ্যাটম বোমা ঘরে ফাটার অপেক্ষায় এক্কেবারে তৈরি। কেননা
গৈরিকের আইডিয়া মানে নিদারুণ ব্যাপার! কিছুদিন আগে কলেজে পুনর্মিলন উৎসব হয়েছিল। আর
সেই অনুষ্ঠানে গৈরিকের উপর অনুষ্ঠানের থিম আর টাইটেল স্পনসর ঠিক করার গুরুদায়িত্ব
বর্তায়। দায়িত্ব দেওয়ার থেকেও বড়ো কথা ও একরকম জোর করেই দায়িত্বটা নিয়েছিল। গোলমালটা
বাঁধল অনুষ্ঠানের দিন। সব সিনিয়রদের হাতে অনুষ্ঠানের তরফ থেকে স্মারক আর উপহারের
প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়। ঢাউস সাইজের প্যাকেট দেখে সবাই বেশ খুশি ছিল। ভেবেছিল
দুর্দান্ত কিছু চমক অপেক্ষা করছে বোধহয়! আনন্দের আতিশয্যে যেই না প্যাকেট খোলা
ওমনি সব অবাক! ভিতরে ‘ম্যাজিক টাচ’ অ্যাডহেসিভের প্রমাণ সাইজের বোতল, আর তার উপরে
সুন্দর করে লেখা - “সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়ে উঠুক ‘ম্যাজিক টাচ’-এর ম্যাজিক
স্পর্শে।” সবাই তো হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছিল না! প্রিন্সিপাল স্যারও রীতিমতো
হতবাক। হঠাৎ করে সবার নজর পড়ল চারিদিকে লাগানো ফেস্টুন আর হোর্ডিং-এর দিকে। ‘ম্যাজিক
টাচ’-ময় বিজ্ঞাপনে রি-ইউনিয়ন হল তখন জমজমাট। পুরোনো স্মৃতির কথা মনে পড়তেই সক্কলের
আবার আক্কেলগুড়ুম! সবাই তখন ভাবছে এবারে কী বোমা ফাটতে চলেছে। ঘর নিশ্চুপ। একটা
আলপিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। প্রিন্সিপাল স্যার হাঁ করে তাকিয়ে গ্যারি, থুড়ি
গৈরিকের দিকে। সেই হাঁ-টা দেখে শ্যামল অনুরাগের কানে ফিসফিস করে বলল, “স্যারের
অ্যানাকোণ্ডা নিকনেমটা সার্থক।” আসলে ছাত্রমহলে উনি ওই নামেই জনপ্রিয় কিনা। এমনকি স্যারের
টেবিলের উপর উড়তে থাকা মাছিটাও পরিস্থিতির চাপে বারকয়েক খাবি খেয়ে জানালা দিয়ে বেরোনোর
কথা বেবাক ভুলে গিয়ে স্যারের দিগন্তবিস্তৃত হাঁয়ে তখন ঢুকব ঢুকব করছে। অমন স্মার্ট
প্রবালও কিঞ্চিৎ থতোমতো খেয়ে দাঁড়িয়ে। এরকম সাঙ্ঘাতিক একটা অবস্থায় গ্যারি নিতান্ত
স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল, “স্যার, আমরা তো এবারে ডিজে ছৌ-নাচ আর ডিজে ধুনুচি নাচের
অনুষ্ঠান করতে পারি। বলিউডের গানের তালে ছৌ-নাচের পুরাণ কথা। ব্যাপারটা ইউনিকও
হবে, আর মিডিয়া এক্কেবারে ঝাঁপিয়ে পড়বে স্যার। মানে এর আগে কোনও কলেজে এরকম
অনুষ্ঠান বোধহয় হয়নি।” খট্ করে একটা আওয়াজ হতে অনুরাগ ফিরে তাকাতে দ্যাখে স্যারের
হাঁ বন্ধ হয়েছে, আর সেই সঙ্গে ঘরের মধ্যে উড়তে থাকা মাছিটাও হাওয়া! টেবিলের উপরের
ফোনটা সশব্দে বেজে উঠতে সবার সংবিৎ ফিরল। জলের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে স্যার
বললেন, “দারুণ প্রস্তাব। এটা বরং ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। তুমি তো রি-ইউনিয়নে ভালোই
দায়িত্ব পালন করেছ, এবারটা না হয় প্রবাল আর বাকিরা সামলাক।” মুচকি হেসে প্রবাল
সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে আমাদের দিকে তাকাতে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর সব ঘর থেকে
বেরিয়ে আবার ক্লাসমুখো রওনা দিল। প্রবাল
সেদিকে না গিয়ে ক্যান্টিনের দিকে এগোল। অনুরাগ জানে মাস্টারপ্ল্যানটা প্রবাল আজই
ছকে ফেলতে চায়।
॥ ৬ ॥
প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে
বেরিয়ে কমন রুমের পথে পা বাড়াল প্রবাল। নেক্সট ক্লাসটা অফ আছে। এক রাউন্ড টেবিল
টেনিস খেললে বুদ্ধির সলতেটা পাকিয়ে নেওয়া যাবে। স্যার গুরুদায়িত্ব ভরসা করে চাপিয়ে
দিলেন বটে, কিন্তু তার চোখের সামনের পথটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না। নানা কথা ভাবতে
ভাবতে আনমনে এগোতে গিয়ে করিডর বেয়ে ডান দিকে বাঁক নিতেই আচমকা ধাক্কা খেতে খেতে কোনোক্রমে
নিজেকে সামলাল প্রবাল। ধাতস্থ হয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে ওর ক্লাসেরই শ্রীময়ী
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে। সামনে মেঝেতে তখন ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে লাইব্রেরি থেকে
তোলা বইগুলো আর ব্যাকপ্যাকটা। তাকিয়ে দেখল এক রাশ বিরক্তি খেলা করছে শ্রীময়ীর
চোখেমুখে। কাঁচুমাচু মুখে বইগুলো কুড়িয়ে ওর হাতে তুলে দেবার পর যখন ব্যাকপ্যাকটা
তুলতে যাবে, হঠাৎ করে প্রবালের চোখ পড়ল ব্যাকপ্যাকের চেন থেকে ঝুলতে থাকা ছোট্ট
সুন্দর পুতুলটার উপর। ওটার ডিজাইনে গ্রামবাংলার অদ্ভুত ছোঁয়া রয়েছে। গ্রামীণ কুটীর
শিল্প মেলার দৌলতে এই জিনিসগুলো হাল ফ্যাশনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। ঠিক এরকমই
একটা কিছু অন্য কোথাও দেখেছে বলে মনে হল প্রবালের। সেই সময়ই শ্রীময়ীর আওয়াজ কানে
এল তার, “কী রে, আজকাল কবিতা-টবিতা লিখছিস নাকি? কোন ভাবজগতে রয়েছিস অ্যাঁ?” সংবিৎ
ফিরতে প্রবাল হালকা হেসে ব্যাকপ্যাকটা শ্রীময়ীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে কমন রুমের দিকে
রওনা দিল। তখনও তার মনে চিন্তাটা ঘুরপাক
খাচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছে পুতুলের ওই ডিজাইনটা? কমন রুমে ঢুকতে বরুণ হাঁক পাড়ল, “কী
রে, স্যারের ওখানে আলোচনায় কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল? চল ক্যান্টিনে বসে গরম গরম
আলুর চপ আর মশলা চা সহযোগে বিস্তারিত সব শোনা যাবে’খন। সনৎদার বানানো আলুর চপটা
জাস্ট মার্ভেলাস!” বরুণের মুখে ‘ক্যান্টিন’ শব্দটা প্রবালের এতক্ষণ বয়ে চলা
চিন্তাস্রোতে দাঁড়ি টানল। এই ছোট্ট যোগসূত্রটা বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে! আজ সকালেই
তো অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে সনৎদার ক্যান্টিনে ফাইফরমাশ খাটা ছেলেটাকে বাঁচাতে
গিয়ে ওর হাত থেকে ছিটকে পড়া ঝোলাব্যাগের ফাঁকে হাতখানেক সাইজের ছোট্ট একটা পুতুল
দেখেছিল প্রবাল। নিজের ছড়ে যাওয়া হাতের দিকে খেয়াল না করে ছেলেটা তখন পুতুলসুদ্ধ
ঝোলাব্যাগটাকে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে নিজের পথে এগিয়ে যায়। একটা পুতুলের জন্য ওর
মুখে তাৎক্ষণিক সন্তানসুলভ অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখেছিল প্রবাল। নিজের জগতে ফিরতে
বন্ধু বরুণকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাল সে। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বরুণের পিঠ চাপড়ে
ছোট্ট করে প্রবাল বলল, “চল ক্যান্টিনেই যাওয়া যাক।”
আজ ক্যান্টিনে ঢুকতে আর একচুল
দেরি হলেই মুখঝামটা খেত মলয়। ভাগ্যিস সনৎদা ওইসময় কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য বাজারে
মুদির দোকানে গিয়েছিল। ক্যান্টিনে ঢুকতে মানদা মাসি হাতের
ইশারায় ওকে ডেকে বলে, “ঝটপট বাসনগুলো মেজে ফ্যাল দিকিনি। বাবু
তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল, তা আমি বলিছি ভাঁড়ারে কয়লা বাড়ন্ত বলে তোকে আনতে পাঠিয়েছি। তেনার
আসার আগে কাজে লেগে যা। কোনও কথার উত্তর দিবিনি, চুপচাপ কাজ করে যাবি।”
মানদা মাসির কথায় আবার চোখের কোণ ভিজে আসে মলয়ের। মা’র কথা মনে পড়ে যায়। ঠিক
এমনিভাবেই আগলে রাখত মা। কাঁধের ঝোলাব্যাগটা সযত্নে কোনার আলমারিটাতে রেখে কাজে
লেগে পড়ে মলয়।
দুপুরে লাঞ্চ টাইমটা শেষ হতে
ক্যান্টিনের দিকে এগোল প্রবাল। ছেলেটার একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। ফার্স্ট হাফে ভালো
করে খেয়াল করেছিল সে। বোধহয় আজ ভেতরের কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই দেখা মেলেনি। সনৎদার
কাছে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে পারত, কিন্তু সেটা করলে হয়তো ছেলেটাকে বিপাকে ফেলা হবে।
আদৌ ঘটনাটা সে সনৎদাকে বলেছে কিনা সেটা তো আর তার জানা নেই। ক্যান্টিনে ঢুকে পুরো
ঘরটায় একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল প্রবাল। নাহ, আশেপাশে কোথাও ছোঁড়ার টিকি দেখা
যাচ্ছে না! কী মনে হতে রান্নাঘরের পিছনে কলঘরের দিকটায় উঁকি মারল সে। এরপরে দেখা
দৃশ্যটা প্রবালের কল্পনার বাইরে ছিল! মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে দেখল ছেলেটা একমনে সেই
ঝোলার পুতুলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার হাতের আঙুলগুলো সুনিপুণ ভঙ্গিমায় খেলা
করে চলেছে পুতুলটার সঙ্গে বাঁধা তারের সঙ্গে লাগানো কাঠের অংশটাতে। গুন গুন লোকগীতির
সুরের হালকা রেশ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। ছেলেটার হাতে পুতুলটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে!
অদ্ভুত মায়ামাখানো এক রূপকথার রাজ্য আকস্মিকভাবে যেন ভুলবশত শহর কলকাতায় হাজির! প্রবালের
হুঁশ ফিরল সনৎদার ডাকে – “তুমিও কি আমার মতো ধাঁধায় পড়ে গেলে ভায়া? প্রথম যেদিন ওকে
দেখেছিলুম, সেদিন ভাবতেই পারিনি ছেলেটার মধ্যে কোনও এক রূপকথার জাদুকর লুকিয়ে বসে
আছে! এই বয়েসের একটা ছেলেকে কাজে নেওয়ার ইচ্ছা আমার একদমই ছিল না, কিন্তু ওর
পরিবারের অবস্থা শুনে আর মুখ ফুটে না করতে পারিনি। ক্যান্টিনের কাজের চাপে
মাঝেমধ্যে রাগের মাথায় হাত উঠে যায় বটে, পরে আফসোসও হয়। মা-হারা ছেলেটাকে ভাগ্যের
পরিহাসে লেখাপড়ার বয়সে লোকের খিদমত খাটতে হচ্ছে। বাপটাও অসুস্থ, প্রায় শয্যাশায়ী। তবে
এর মধ্যেও ছেলেটা পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে। হফতায় একটা দিনের ছুটি, তাও ঠিকঠাক
বিশ্রাম জোটে না কপালে। শুধু ওই পুতুলটা নিয়ে বসলে ওর মুখে একটা অদ্ভুত আলোর ছাপ
ফুটে ওঠে। সব ক্লান্তি ভুলে যায় ছেলেটা।” এই বলে সেখান থেকে সরে যায় সনৎদা। ধীর পায়ে
ছেলেটার দিকে এগোয় প্রবাল। তার মাথায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখাগুলো আঁকিবুঁকি
কাটতে থাকে। পাশে দাঁড়িয়ে আলতো করে কাঁধে হাত রাখল সে। কিছুটা চমকে ফিরে তাকিয়ে
পাশে প্রবালকে দেখে হতচকিত হয়ে পড়ল মলয়। সকালের সেই দাদাটা। আজ ক্যান্টিনে বসে যখন
আরেকটা দাদার সঙ্গে কথা বলছিল, দূর থেকে দেখে মলয় আর কাছে ঘেঁষেনি। পাছে সকালের
ঘটনাটা আবার সনৎদার কানে যায়। দাদাটার চোখ যে সমানে তাকেই খুঁজছিল সেটা আন্দাজ
করতে মলয়ের বেশিক্ষণ লাগেনি। কিন্তু এখন সে কী করবে! এভাবে যে দাদাটা তার খোঁজে
ভিতরে চলে আসবে সেটা ছিল তার কল্পনার বাইরে। এইসব ভাবনার মাঝেই প্রবাল নীরবতা ভেঙে
বলে উঠল, “বেশ গাও তুমি। আমার নাম প্রবাল। এই কলেজেই প্রথম বর্ষের ছাত্র। যদি কিছু
মনে না কর, তুমি যে গানটা গাইছিলে আর একবার গাইবে।” মলয় আবার সুর লাগাতে চারপাশে
রূপকথারা আবার নেমে এল। সুরে বুঁদ হয়ে সেই সাগরে ডুব দিল প্রবাল। বেশ কিছুটা সময়
পরে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে এগোল মলয়। তার হাত সে তখন সঁপে দিয়েছে প্রবাল নামক
নির্ভরতার বলিষ্ঠ হাতে। পরিকল্পনারা ডানা মেলল পঙ্খীরাজে চড়ে।
॥ ৭ ॥
ভিড় ঠেলে নয়
নম্বর প্লাটফর্মের দিকে এগোতে শুরু করে মলয়। এইমাত্র স্টেশনের ডিসপ্লে বোর্ডে ভেসে
উঠেছে ৮.২০-র ট্রেনটা সেখান থেকেই ছাড়বে। এইসময় শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরটা ঘরফেরতা
যাত্রীদের কল্যাণে বেশ জমজমাট থাকে। মাঝে মাঝে মলয়ের অবাক লাগে প্রত্যেকদিন কত শত
মানুষের দিন গুজরানের নীরব সাক্ষী এই স্টেশন! শহরের বুক চিরে বয়ে
চলা গঙ্গা নদীর জোয়ার-ভাটার স্রোতের মতোই রোজকার এই আসা-যাওয়া। তাদের মতো মানুষের
দল রুটিরুজির টানে রোজ ছুটে আসে এখানে। এক হিসাবে এই কল্লোলিনী তিলোত্তমা তার মতো
আরও অনেকের মাতৃসমা। সত্যি ক্যান্টিনের এই কাজটা না জুটলে তো একপ্রকার না খেয়ে
মারা পড়তে হত। আর আজকের ঘটনাটার পর এ শহরের প্রতি তার কৃতজ্ঞতাবোধ আরও বেড়ে গেল।
এখনও স্বপ্নের ঘোর কাটছে না তার। হ্যাঁ, স্বপ্নই বটে! সে কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল
জীবনের সুতোয় বেঁধে যাওয়া গিঁটগুলো এমনিভাবে আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করবে! ট্রেনে
উঠে জানালার পাশের সিটে জায়গা পেয়ে গেল মলয়। নাহ, আজ তার বৃহস্পতি তুঙ্গে। মনে মনে
হেসে ফেলে সে। সারা দিনের ক্লান্তি আজ আর তেমন করে স্পর্শ করছে কই? মনটা বেশ
ফুরফুরে লাগছে। সিটে হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ পড়ল তার। ট্রেনটা
ধীরগতিতে প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গতি বাড়াতে শুরু করল। গালে হাত দিয়ে বাইরের সরে
যাওয়া আলোআঁধারির দৃশ্যগুলো তাকে অনতিদূর অতীতের রাজ্যে নিয়ে গেল। মনে হয় এই
সেদিনের কথা। বাবা-মা, মলয় আর ফেকু – এই চার জনে মিলে তাদের ভরাট জগত। বাবা সারা দিন
রিকশা চালিয়ে যা রোজগার করতেন, সেই যৎসামান্য আয়েই সুন্দর করে সংসার চালিয়ে নিতেন
মা। অভাবের সংসারে দুঃখের কোনও স্থান ছিল না বললেই চলে। সরকার পোষিত স্কুলে পড়ার
জন্য মলয়ের পড়াশুনোর খরচও নামমাত্র। লেখাপড়ায়
মলয়কে নিয়ে তার স্কুলের কোনও অভিযোগই কখনও ছিল না। সব শিক্ষকেরই প্রিয়পাত্র ছিল
সে। মলয়ের মা তাই নিজের সংসার নিয়ে ভীষণ সম্পৃক্ত ছিলেন। শুধু একটা কাঁটা তার মনের
মধ্যে খচ খচ করত। আসলে মলয়দের একটা সুন্দর ঐতিহ্যের অতীত ছিল। ওর বাবা বরাবর পেশায়
রিকশাচালক ছিলেন না। তিনি ছিলেন ওই অঞ্চলের নামকরা তারের পুতুলনাচের কারিগর। ‘তারের
পুতুল’ বা ‘সুতোর পুতুল’ ছিল বাংলার অন্যতম ঐতিহ্য। বাবার মুখে মলয় শুনেছে, প্রায়
একশো বছর আগে রাজস্থান থেকে এক দল পুতুলনাচের সম্প্রদায় অবিভক্ত বাংলার বরিশাল
জেলার খেজুরতলা গ্রামের মেলায় অনুষ্ঠান করতে এসেছিল। স্থানীয় মানুষদের সেই
অনুষ্ঠান এতটাই ভালো লেগেছিল যে তারা দ্রুত সেই শিল্পের অনুকরণ করে নেন। সেই
ঐতিহ্য ক্রমে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। দেশভাগের পরে ওপার বাংলা থেকে চলে আসা ছিন্নমূল কয়েকটি
পরিবার পঞ্চাশের দশকে মুড়াগাছা কলোনিতে ঘর বাঁধে।
মলয়ের বাবা এরকমই এক পরিবারের উত্তরপুরুষ।
কাজের অভাবে তাদেরই কয়েকজন
মিলে তৈরি করেছিল নতুন দল ‘ভারতমাতা’। আস্তে
আস্তে চাহিদা বাড়ায় বাইরে থেকে লোক এনেও দল চালাতে হত। তারাই আবার পরে সব শিখে
গিয়ে বর্ধমান, নবদ্বীপ, শিলিগুড়িতে
দল খুলে বসে। প্রথম প্রথম মুড়াগাছায় পঞ্চাশটিরও বেশি দল দাপিয়ে অনুষ্ঠান করে বেড়াত। নানারকম
পালা বাঁধত সবাই মিলে – ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, ‘বেহুলা-লখিন্দর’, ‘সাবিত্রী-সত্যবান’
ইত্যাদি আরও কত কী। নাম শুরু করলে সে আর ফুরোবে না! গোল
বাঁধল নব্বইয়ের দশকের শেষে, নিত্যনতুন বিনোদনের আগমনে আর কেবল টিভির দাপটে সেই
সংখ্যা গিয়ে ঠেকল আঠারোতে। অনেকেই পুতুল বেচে অন্য জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।
মলয়ের ঠাকুরদার বানানো দলটাও সে সময় ভেঙে গেল। বাধ্য হয়ে মলয়ের বাবা মহাজনের কাছ
থেকে ধার নিয়ে রিকশা চালানো শুরু করে। মা’র কাছে বহুবার মলয় বাবার অব্যক্ত বেদনার
গল্প শুনেছে। দল ভেঙে যাওয়ার ধাক্কাটা বাবার ভেতরটা একবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। মলয়
কেবলই ভাবত বড়ো হয়ে সেও একটা পুতুলনাচের দল খুলবে। আসলে
ছোট্ট মলয়ের তখন বাজারের ওঠাপড়া সম্পর্কে ধারণাটাই গড়ে ওঠেনি। এ কথা মাকে সে বহু বার
বলেছে, প্রতিবারই মা মিষ্টি করে হাসত আর বলত লেখাপড়াটা আগে শেষ করতে। বাবাকেও যখনই
বলেছে, ও খেয়াল করেছে বাবার চোখটা অজানা আনন্দে চক চক করে উঠত। ঘরের কোণের তোরঙ্গ
খুলে পুতুলগুলোকে বার করে পরমস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরত বাবা। সুতোর রূপকথার রাজ্যে
মলয়ের হাতেখড়ি হয়ে যায় তখনই। সবই ঠিক ছিল সেই দিনটার আগে, সেই কালান্তক দিনটা। সেদিন
রোজকার মতোই বাবা রিকশাটা নিয়ে রওনা হবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ভোটের কারণে স্কুল
ছুটির জন্য মলয় আর ফেকু ছিল ঘরের ভেতরে। সাধারণত মলয়ের ছুটিতে বাবা খুব একটা রিকশা
নিয়ে বেরোতেন না। সেদিন কী হল, বললেন যে চট করে কয়েক রাউন্ড মেরে চলে আসবেন। মা
অভ্যাসমতো বাবার রিকশার সিটের তলায় টিফিনের বাক্সটা রাখতে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা
কানফাটা আওয়াজে ওদের বাড়িটা থর থর করে কেঁপে উঠেছিল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে মলয়
যখন বাইরে বেরিয়ে এল, দেখল উঠোন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মা আর নেই। একটু দূরে
রান্নাঘরের সামনের অংশটায় বসে বাবা ফ্যালফ্যাল করে সেইদিকে তাকিয়ে বসে। ডান হাতের
দুটো আঙুল আর নেই। আশেপাশের লোক শব্দ শুনে ছুটে এসে বাবা-মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মাকে আর বাঁচানো যায়নি। ওই ঘটনার পর বাবার বাকশক্তি যায় হারিয়ে। সেই থেকে ঘরই হয়ে
উঠল তার ঠিকানা। সময়ের আগেই অনেকটা বড়ো হয়ে গেল মলয়। পরে
শুনেছিল, ভোটের আবহে দুষ্কৃতীরা বাবার রিকশার সিটের নিচে বোমা লুকিয়ে রেখেছিল। পরে
পুলিশের টহলদারিতে নিয়ে পালাতে পারেনি। অপরাধীদের অবশ্য পরে আর সনাক্ত করা যায়নি।
শুধু তাদের ভরাট সংসারটাই যা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনের হুইসলের আওয়াজে হুঁশ
ফিরল মলয়ের। ধীরগতিতে মুড়াগাছা স্টেশনের প্লাটফর্মে ঢুকছে ট্রেনটা। জানালা দিয়ে
উঁকি মারতে মলয় দেখল, ফেকু কদমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ধাবমান কামরাগুলোর
দিকে তাকে খুঁজে চলেছে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে এক ছুটে এগিয়ে এল সেখানে। কাছে
এসে অভিভাবকসুলভ আওয়াজ ছাড়ল, “ঘ্রাউউউউউ...।”
বাড়ি ফেরার
পথে বাসে বসে মলয়ের কথা ভাবছিল প্রবাল। সত্যি ছেলেটার প্রশংসা করতে হয়। অদম্য
ইচ্ছাশক্তি না থাকলে এভাবে স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করা একপ্রকার অসম্ভব! প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে ছেলেটা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। চোখ থেকে বয়ে চলা জলের
ধারা দেখে সামনে বসা প্রিন্সিপাল স্যারও প্রথমটা কিছু আন্দাজ করতে না পেরে
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। আসলে মলয়ের মনে সংশয়ের এক অদ্ভুত দোলাচল চলছিল। চটজলদি
ঘটে চলা ঘটনাগুলো তার সবুজ মনকে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে এই চাকরিটা বোধহয় তার
হাতছাড়া হতে চলেছে। সব শুনে প্রিন্সিপাল স্যার যদি সনৎদাকে ডেকে তার বয়সি ছেলেকে
কাজে রাখার ব্যাপারে কিছু জবাবদিহি চান, তাহলে সনৎদা হয়তো তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে
দেবেন। কী কুক্ষণে যে সে পুতুলটাকে নিয়ে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল কে জানে! এই মুহূর্তে
তার অস্তিত্ব এক চরম অনিশ্চয়তার সুতোর উপর দুলছে।
নাহ, চাকরি টেঁকার আশাটা না করাই ভালো। মলয়ের মন পড়ে নীরবতা ভেঙে প্রবাল সামনে বসা
স্যারকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাটা খুলে বলে। মলয়ের মাধ্যমে প্রায় লুপ্ত হতে বসা
একটা ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরে শহরবাসীর মনকে নাড়া দিতে চায় সে। শেষ চমকটা
শোনার পর স্যার চেয়ার থেকে নিজের অগোচরেই উঠে দাঁড়ান। এগিয়ে এসে প্রবালের কাঁধ
চাপড়ে দিয়ে বলেন, “আমি জানতাম যে আমি যোগ্য লোকের কাঁধেই দায়িত্ব তুলে দিয়েছি।
তুমি তোমার পরিকল্পনা মাফিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু করে দাও, বাকিটা আমি সামলে
নেব।” এই বলে মলয়ের মাথায় স্নেহভরা হাত রাখলেন তিনি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মলয়। সে বুঝল
আপাতত তার ঘাড়ে নতুন দায়িত্ব চাপতে চলেছে। স্যারকে দুম করে একটা প্রণাম ঠুকে আর
প্রবালের দিকে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে আবার ক্যান্টিনমুখো হল মলয়। আজ বাবা আর ফেকুর
কাছে সারাদিনের গপ্পো না করা পর্যন্ত তার পেটের ভাত হজম হবে না। মলয়ের কাণ্ড দেখে
পিছনে দাঁড়ানো প্রিন্সিপাল স্যার আর প্রবাল দুজনেই হেসে উঠলেন। সেই হাসি ছিল নতুন
ভোরের স্বপ্নের মতো।
॥ ৮ ॥
গোটা
অডিটোরিয়াম হাততালির শব্দে ফেটে পড়ছে। এইমাত্র
অনুষ্ঠানের প্রথম চমক হিসাবে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ নাটক পরিবেশনার পর এক অদ্ভুত আবেশ
সকলকে ঘিরে রেখেছে। বীরভূম থেকে আসা একটি মানবপুতুল
নাট্যগোষ্ঠীর অপূর্ব উপস্থাপনায় উপস্থিত দর্শকেরা রীতিমতো মন্ত্রমুগ্ধ! কলেজের
আধুনিকতায় মোড়া স্থবির মননে প্রায় ফসিল হয়ে ওঠা ঐতিহ্যের এ এক আশ্চর্য পুনর্জন্ম! পুরো
ব্যাপারটাই তো তাদের কাছে একেবারে নতুন! যন্ত্রনির্ভর সমাজে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের
কাছে যেখানে ‘মেলা’ শব্দটাই বিপন্ন প্রজাতির মতো টিমটিম করে জ্বলছে, সেখানে
‘পুতুলনাচ’-এর স্বপ্নঘেরা ছোটোবেলা তো কল্পনাতীত ব্যাপার! মঞ্চে যখন একের পর এক
অভিনেতা অভিনেত্রীরা বাজিকরের অদৃশ্য সুতোর টানের অনুকরণে অভিব্যক্তির রামধনু
ফুটিয়ে তুলছিল, আর আড়াল থেকে ভেসে আসা সূত্রধরের মুখের সংলাপ দর্শকের মনে গল্পের মায়াজাল
বুনে চলছিল; ঠিক তখনই মঞ্চের পাশে দাঁড়ানো প্রবালের মুখে ছিল তৃপ্তির হাসির আমেজ। সে ও
তার দলবল আজ বেজায় খুশি। তাদের পরিশ্রম সফল। দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় স্পনসরদের
মুখেও চওড়া হাসির ঝিলিক। মিডিয়া আজ পুরো অনুষ্ঠানটাই প্রাইম টাইমে সম্প্রচার করছে।
এর পিছনে অবশ্য প্রিন্সিপাল স্যারেরও কৃতিত্ব রয়েছে। আসলে স্যারের অভিন্নহৃদয়
বাল্যবন্ধু হলেন রাজ্যের পদস্থ মন্ত্রী। আর উনি আসবেন শুনে মিডিয়ার দলবল আজ নিজের
উৎসাহেই কলেজের অনুষ্ঠান কভারেজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। সব মিলিয়ে চারিদিক
এক্কেবারে সরগরম।
গ্রিন রুমের
এক কোণে চেয়ারে থম মেরে বসেছিল মলয়। বুকটা তার রীতিমতো ঢিপ ঢিপ করছে। এতদিন মায়ের
মুখে শোনা গল্পগুলোই তাকে পুতুলনাচের রূপকথার জগতের সঙ্গে পরিচিতি করিয়েছে, কিন্তু
আজ সে বাস্তবের কঠোর মঞ্চে উপস্থিত। বাবা যদি আজ তার পাশে মঞ্চে থাকতেন, তবে হয়তো
সে স্নায়বিকভাবে এতটা দুর্বল হয়ে পড়ত না। ক্যান্টিনে নিজের মনে গান গেয়ে
পুতুলগুলোর সঙ্গে মেতে থাকা আর এত লোকজনের মাঝে অনুষ্ঠান করা, এ দুটো যে এক নয়
সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি তার আছে। কিন্তু মলয় এটাও জানে, বাবার স্বপ্ন সফল করার এমন
মঞ্চ সে আর হয়তো পাবে না। সামনের টেবিলে রাখা বোবা পুতুলগুলো একদৃষ্টে তার দিকে এক
অদ্ভুত আকুতি নিয়ে চেয়ে রয়েছে। ওরা যেন বলতে চাইছে, মলয় তুমি সাহস করে এগোও, আমরা
তোমার পাশে আছি। নাহ, আজ যদি সে হেরে যায় তাহলে কিছুতেই বাড়ি গিয়ে আর বাবার ঘোলাটে
চোখের জিজ্ঞাসার সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে না। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল মলয়। হঠাৎ
দরজার বাইরে কারও টোকা দেওয়ার শব্দ এল। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে দরজাটা খুলতেই
চমকে উঠল মলয়!
ধীরে ধীরে
মূল মঞ্চের পর্দা সরতে এক আলোছায়ামাখা পরিবেশের সৃষ্টি হল। আলোআঁধারির সেই অদ্ভুত
জগতের মধ্য দিয়ে সুতোয় ঝোলানো পুতুলগুলো রূপকথার গল্প বুনে চলেছিল। হারিয়ে যাওয়া
ঠাকুরমার ঝুলির কাহিনির চরিত্ররা একটু একটু করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল সকলের
সামনে। সামনে বসা দর্শকরা তখন মোহাবিষ্ট।
তাদের দৃষ্টির মুগ্ধতাই মলয়কে সে কথা স্পষ্ট জানান দিচ্ছিল। সামনের সারির দর্শকদের
মাঝে বসে থাকা বাবার চোখের দিকে তাকাতে মলয় দেখল ঘোলা হয়ে যাওয়া চোখের মণি থেকে
আনন্দের ছটা ঠিকরে বেরোচ্ছে।
মঞ্চের পাশে
পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো প্রবাল তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী! মলয়ের হাতের নিপুণ
মোচড়ে পুতুলগুলো একের পর এক দৃশ্য ফুটিয়ে চলেছে। পাশে টুলের উপরে বসে ফেকু নিজের
মুখ আর সামনের পায়ের সাহায্যে মলয়ের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গতে ব্যস্ত। ফেকু
আর মলয়ের বাবাকে প্রবালই নিজের উদ্যোগে মুড়াগাছা থেকে নিয়ে এসেছিল সে। ঘুণাক্ষরেও
সে মলয়কে তা টের পেতে দেয়নি। ওর বাবাকে সামনের সারিতে বিশেষ আসনে বসিয়ে, অনুরাগের
হাতে তার দায়িত্ব সঁপে গ্রিন রুমে ফেকুকে নিয়ে যায় প্রবাল। তখনও সে কল্পনাতে আনতে
পারেনি এমন অসাধারণ মেলবন্ধনের কথা! ভাঙ্গাগড়ায় ভরা জীবন ফেকু আর মলয়কে সার্থক
সহযোদ্ধা হতে শিখিয়েছে।
পর্দা নেমে
আসার পরও অডিটোরিয়াম জুড়ে এক সীমাহীন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। অনুরাগ, শ্যামল,
বরুণ ওরাও বাকিদের মতো এক লহমায় রূপকথার দেশে পৌঁছে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাননীয়
মন্ত্রী মহোদয়ের উচ্ছাসে ভরা তালির শব্দে সকলের চটকা ভাঙল। একরাশ খুশির দল ফুলের
রেণুর মতো অডিটোরিয়ামের বাতাসে উড়ে বেড়াতে লাগল। কানফাটানো হাততালিতে ভরল সারা ঘর।
সেই আনন্দময় মুহূর্ত আরও ঘন হয়ে উঠল ওনার পরবর্তী বক্তব্যে। মলয়ের যাবতীয় পড়াশোনার
ব্যয়ভার গ্রহণ করার পাশাপাশি উনি ঘোষণা করলেন এক দারুণ কর্মসূচীর কথা। এবার থেকে
সরকার পোষিত সমস্ত বিদ্যালয়ে পুতুলনাচের বিশেষ অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
পুতুলনাচের মাধ্যমেই দেশের ইতিহাস থেকে শুরু করে আরও অনেক অজানাকে জানবে তারা।
স্কুলে স্কুলে শুরু হবে পড়াশুনোকে ভালোবাসার নতুন অধ্যায়। এই সব কথার মাঝে মিডিয়া
তখন মলয়কে খুঁজে চলেছে।
সবার নজরের
আড়ালে মলয় তখন ফেকুকে নিয়ে ক্যান্টিনের সামনের খোলা অংশটায় দাঁড়িয়ে। আকাশের একরাশ
তারার মাঝে একটা তারা খুব উজ্জ্বল হয়ে যেন তাদের দিকেই হাসিমাখা মুখে তাকিয়ে।
মায়ের কাছেই মলয় ছোটোবেলায় শুনেছিল মৃত্যুর পরে সবাই ওই নিঃসীম আকাশের মাঝেই তারা
হয়ে মিশে যায়। বড়ো হওয়ার পর সে বুঝেছিল মৃত্যুর পরের
আসল গন্তব্য। আজ হঠাৎ করে মা’কেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে তার। ফেকুর দিকে তাকিয়ে
মলয় অস্ফুটে বলে ওঠে, “মা ঠিকই বলত, না রে ফেকু? পৃথিবীর মায়া কাটলে সবাই ওই দূরের
আকাশে তারা হয়েই রয়ে যায়। ওই যে মা’কে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, না রে?” ফেকু মলয়ের
দিকে তাকিয়ে সমর্থনের সুরে আওয়াজ করল, “ঘেউউউউউউউ...।” জোনাকির নরম আলোয় সৃষ্টি হল
নতুন এক রুপকথা।
_____
(সব চরিত্র
ও ঘটনা কাল্পনিক)
_____
ছবিঃ অনুষ্টুপ শেঠ
Darun sundor golpo
ReplyDelete