
ছায়াপুতুলের
কাহিনি
সুদীপ
চ্যাটার্জী
।। এক ।।
মুরারিবাবুর
কথা
মুরারি
জয়দেব এই দেশের একজন নামকরা ছায়া-পুতুল শিল্পী বা ‘শ্যাডো পাপেট
আর্টিস্ট’। ভারতবর্ষের পুতুলনাচের যে ঐতিহ্য
বংশানুক্রমে চলে আসছে, সে নিয়ে বিস্তর পড়াশুনা করেছেন। এককালে
দেশের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে বহু পুতুল-শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রাচীন বহু
নথি উদ্ধার করেছেন দেশবিদেশের নানা নিলাম থেকে পুতুলনাচ সম্পর্কে, নানাধরনের পুতুল সংগ্রহে আছে তাঁর। এই
শিল্প আজকের নয়, বহু পুরোনো সময় থেকে মানুষেরা পুতুলদের
ব্যবহার করে এসেছে নাট্যশিল্পে। ঋগবেদ, গীতা প্রভৃতিতে
পুতুলনাচের বিবরণ পাওয়া যায়।
কিন্তু তাঁর
আসল আগ্রহ শ্যাডো পাপেটরি বা ছায়া-পুতুল নিয়ে। এমনিতে ভারতবর্ষে সুতো-পুতুল আর
লাঠি-পুতুলের রমরমাই বেশি ছিল, মঞ্চের পিছন থেকে সুতোর সাহায্যে
খড়, শোলা, পাটকাঠি, কাপড় ও মাটি দিয়ে তৈরি পুতুলগুলোকে নাচ করিয়ে গল্প বলেন পুতুল-শিল্পীরা। কিন্তু
ছায়া-পুতুলের নাচে পুতুলের ছায়াই শুধু দেখা যায়, সেই ছায়া
পুতুলের হতে পারে, হাতের হতে পারে, আধুনিক
কালে যন্ত্রের ব্যবহার করেও ছায়া-পুতুলের গল্প মঞ্চস্থ করা হয়।
মুরারিবাবু
অবশ্য শুধুমাত্র ভারতবর্ষের পুতুলনাচ নিয়ে আগ্রহী নন। গত আটত্রিশ বছর ধরে সারা
পৃথিবী চষে তিনি নানাধরনের পুতুলনাচ নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং সফলভাবে উপস্থাপনা
করেছেন নানা মঞ্চে। ইন্দোনেশিয়ার ‘ওয়াং কুলিত’, কম্বোডিয়ার ‘খামের’, থাইল্যান্ডের
‘নাং ইয়াই’ এবং ফ্রান্সের আধুনিক ছায়া-পুতুল
নিয়েও তিনি কাজ করছেন বহুদিন ধরে। সারা পৃথিবীর পুতুল-শিল্পীরা তাঁকে এক ডাকে চেনেন
নামকরা পুতুল-শিল্পী ও সংগ্রাহক হিসেবে। হেন দেশের পুতুল নেই যা তাঁর সংগ্রহে নেই।
পুতুল সংগ্রহের এই নেশা তাঁকে পৃথিবীর অনেক জায়গায় ছুটিয়ে নিয়ে গেছে। যৌবনে এই
নিয়ে অনেক সময় অনেক ঝুঁকিও নিয়েছেন, প্রয়োজনে লোককে ঠকাতেও
পিছপা হননি পছন্দসই পুতুল পেলে।
এহেন
মুরারিবাবু ভুবনেশ্বর এসেছেন ‘আর্ট কনসাল্ট’ বলে একটা সংস্থার আমন্ত্রণে। আর্ট কনসাল্ট দেশবিদেশের প্রাচীন শিল্পচর্চা
সংরক্ষণ করার জন্য কাজ করছে। সেখান
থেকে অনিন্দিতা বলে এক মেয়ে মুরারিবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে অনুরোধ করে তিনদিনের
এই অনুষ্ঠান এবং শিল্পমেলায় আসার জন্য।
“অনেক অজানা অচেনা পুতুল-শিল্পী আসছেন গ্রাম-গঞ্জ থেকে স্যার, আপনার ভালো লাগবে। আফটার অল,
আপনি তো একসময় এদের নিয়েই কাজ করতেন।”
মুরারিবাবু
রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের গ্রাম-গঞ্জের পুতুলশিল্প নিয়ে তাঁর উদ্দীপনা আজও
আছে। আজকাল বেশিরভাগ সময় তিনি অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, বিখ্যাত
পুতুল-শিল্পী আর অ্যানিমেটর রিচার্ড বার্ডশ-এর সঙ্গে তাঁর প্রায় রোজ কথা হয়, কিন্তু মন থেকে তিনি আজও ফিরে যেতে চান ভারতের ছোটো ছোটো সেই গ্রামগুলোতে
যেখানে বহুকষ্টে কয়েকজন মানুষ টিকিয়ে রেখেছে এই প্রাচীন শিল্প। মহারাষ্ট্রের ‘চরমা বাহুলি’, দক্ষিণী রাজ্যের অসাধারণ পুতুলনাচ ‘কিলু বম্মে’ আর ওড়িশার ‘রাবণ
ছায়া’ নাচের তো কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই।
পরিকল্পনামতো
দু’দিন আগে মুরারিবাবু যোগ দিয়েছেন আর্ট কনসাল্ট-এর শিল্পমেলায়। নিজের সংগ্রহে
রাখা নানাধরনের কয়েকটা পুতুল তিনি সঙ্গে এনেছেন শিল্পীদের পুরস্কার দেবেন বলে। গত
দু’দিনে মুরারিবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে নানা নতুন পুরোনো পুতুল-শিল্পীর, কয়েকজন পরিচিত শিল্পীদের সঙ্গে দেখাও হয়েছে তাঁর। নানা
অঞ্চলের পুতুল-শিল্পীদের অনুষ্ঠানে, আমন্ত্রিত অতিথিদের
সঙ্গে আলোচনায় আর দেশীয় শিল্পে পুরোপুরি মজে গেছেন মুরারিবাবু। একেকবার যেমন দুঃখ
হয়েছে দেশের পুতুলনাচের পৃষ্ঠপোষকতা ও লোকজনের আগ্রহের অভাব নিয়ে, পরমুহূর্তেই আবার উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন নতুন কোনও প্রদর্শন বা পরীক্ষানিরীক্ষা
দেখে। কয়েকজন মেধাসম্পন্ন মানুষের উদ্দীপনা দিয়ে যদি এই শিল্প-আঙ্গিককে মর্যাদা
দেওয়া হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের শ্যাডো পাপেটরির মতো
আমাদের দেশেও যে পুতুলনাচ, বিশেষ করে ছায়া-পুতুলনাচের যে
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হবে, সে বিষয়ে মুরারিবাবুর কোনও সন্দেহ
নেই।
আজকে সকালেও
খোশমেজাজে ছিলেন তিনি। এমন সময় অনিন্দিতা একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে হাজির হল। গায়ের
রং ময়লা, পরনে কোঁচকানো সাদা জামা আর আদ্যিকালের পাতলুন, পায়ে চটি। কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলায় রাখা কিছু কাগজ ঝোলার ফাঁক দিয়ে
উঁকি মারছে। অনিন্দিতা মুরারিবাবুকে বলল, “এই ভদ্রলোকের নাম গোপাল সাঁপুই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, মানে পুতুল তৈরি করা থেকে গানবাজনা, সূত্রধার সব কাজ
ইনি একাই করেন। এর একক নাচের মঞ্চন দেখে আপনার ভালো লেগেছে বলে আপনার সঙ্গে দেখা
করানোর জন্য গোপালবাবুকে ধরে আনলাম।”
মুরারিবাবু
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন। গোপালের হাত ধরে বললেন, “আপনার মঞ্চায়ন খুবই
ভালো হয়েছে। পুতুলগুলো একেবারে জীবন্ত মনে
হচ্ছিল। রাবণ ছায়া-পুতুলনাচ আমি আগে অনেক দেখেছি, কিন্তু
কয়েকটা মাত্র পুতুল নিয়ে একা হাতে যে খেলা আপনি দেখালেন, তাতেই
আমরা অভিভূত হয়ে গেছি। তাই একটু কৌতূহল হচ্ছিল। আপনি কি সবসময় একলাই পুতুলনাচের
দায়িত্ব নেন, না এই অনুষ্ঠানের জন্যেই এরকম ভেবেছিলেন?”
লোকটার মুখে
একটা স্মিত হাসি দেখা গেল। একটু বিগলিত হেসে বলল, “আপনার মতো
বিদ্বান ব্যক্তির কাছ থেকে কাজের স্বীকৃতি পাওয়াই আমার কাছে অনেক। আপনি ঠিকই
বলেছেন, রাবণ-ছায়ার পারম্পরিক নাচে অনেক লোকজন, পুতুল, গান, বাদ্যি লাগে। কিন্তু
এখন আর সে যুগ নেই; লোকে পুতুলনাচ দেখতে আসে না। আমি মাঝে মাঝে এখান সেখান থেকে
ডাক পেলে একলাই চলে যাই, কখনও-সখনও আরও একজনকে নিই। আর আমিও আজকাল খুব একটা
প্রোগ্রাম করি না।”
মুরারিবাবুর
দুঃখই হল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কতদিন ধরে এরকম একা খেলা দেখাচ্ছেন? আপনাকে
দেখে তো ঠিক ওড়িশার লোক মনে হচ্ছে না!”
“আপনি ঠিক ধরেছেন, স্যার। আমি বাংলার মানুষ, এককালে
বেণী-পুতুল বা হাত-পুতুলে ছায়া খেলা দেখাতাম গ্রামে-গঞ্জে। রাবণ-ছায়া পুতুলনাচের
নামই শুনিনি।”
“তারপর এখানে এসে পড়লেন কী করে? নিজের দেশে ফিরে যাননি?” মুরারিবাবু কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
লোকটা
কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল, “সে একটা অদ্ভুত ব্যাপার, স্যার।
আপনাকে বললে হয়তো আপনার বিশ্বাস হবে না। আমার ওপর একটা অভিশাপ আছে, যতদিন না সেটা কাটছে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না।”
মুরারিবাবুর
ভুরু কুঞ্চিত হল। অভিশাপ? ব্যাপারটা কী? তিনি বললেন, “আরে, বলুন না। আমাকে বলতে সংকোচ করবেন না। না হয় আপনার গল্প শুনেই দেখি।”
লোকটা তাও
বলতে চায় না। মুরারিবাবু জোরাজুরি করতে লাগলেন। একসময় লোকটা নিমরাজি হল। একটা
চেয়ার টেনে তাকে বসতে বলে তার সামনে বসলেন মুরারিবাবু। লোকটা আস্তে আস্তে তার গল্প
বলতে লাগল।
।। দুই
।।
গোপাল
সাঁপুই-এর কথা
যখনকার কথা
বলছি তখন বোধহয় ১৯৬৫-৬৬ সাল। চিনের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে ভারতের আর্থিক অবস্থা
অনেকটাই নড়বড়ে। টাকা দিয়ে মঞ্চানুষ্ঠান দেখতে যাওয়ার কথা লোকে ভাবতেও পারছে না। তখন
আমি বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে ছোটো ছোটো বেণী-পুতুল আর ছায়া-পুতুলের অনুষ্ঠান
করছি রথের মেলায়, দুর্গাপুজোয়। রোজগার বেশি হয় না, তবে ছোটো ছেলেমেয়েরা দারুণ আনন্দ পায়, হাততালি দেয়
গ্রামের বৌয়েরা। অনেকে পয়সা না দিয়ে একবেলা খাইয়ে দেয় আমায় বাড়িতে ডেকে। তখনও
বিদ্যুতের যুগ আসেনি। অন্ধকারে
ছায়া-পুতুলের খেলা দেখে মানুষ মোহিত হয়ে পড়ত। একা মানুষ, অভাব থাকলেও যৌবনে সেরকম কষ্ট হয়নি। নিজের হাতে নানারকম দস্তানা বানিয়ে
হাতে পরে পুতুলের ছায়া তৈরি করে অভ্যেস করি অবসর সময়ে। গ্লাভ
পাপেটরি বা বেণী-পুতুল নিয়ে খানিকটা পড়াশুনা ছিল। ফেলিসেইন ট্রেওয়ে বলে একজন মহাগুণী
ব্যক্তি হাতের ছায়ায় চেনা মানুষের ছবি পর্যন্ত তৈরি করে ইউরোপে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর
গল্প শুনে শ্যাডোগ্রাফিস্ট হওয়ার ঝোঁক হয়েছিল। পুতুল-নাচিয়ে হিসেবে কাজটা আমি মনের
তাগিদেই করতাম। সুখে দুঃখে দিন ভালোই কাটছিল বলা যায়।
এমন সময়
একটা ব্যাপার ঘটল, যাতে আমার জীবনের মোড় সম্পূর্ণভাবে অন্যদিকে
ঘুরে গেল। খবর পেলাম, ওড়িশার খিচিং-এ ছায়া-পুতুল নাচের একটা ছোট্ট মেলা হচ্ছে। অনেক
গ্রাম-গঞ্জ থেকে নানা পুতুল-নাচিয়ে সেখানে যাবে। আমারও লোভ হল। এতদিন গ্রামে
গ্রামে ঘুরেছি, দেশ না দেখলে কি অভিজ্ঞতা হয়? কিন্তু এদিকে পকেট গড়ের মাঠ। বহুকষ্টে শেষমেশ খানিকটা পয়সা জোগাড় করে
একদিন চড়ে বসলুম রেলগাড়িতে।
যে সময়কার
কথা বলছি, তখন এত জঙ্গল কেটে রাস্তাঘাট বানানো হয়নি। পাহাড় আর জঙ্গলের
রাজত্ব দিয়ে চলেছি। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ এলাকাতে তখন ঘন বন, পাহাড়
কেটে রেল লাইন বসানোর কাজ চলছে অনেক জায়গায়। বাঘ-ভাল্লুকের ভয়ে শ্রমিকেরা দিন
থাকতে থাকতেই কেটে পড়ে। ফলে কাজ চলছে ধীরগতিতে। রেলগাড়ি খানিকটা করে যায় আর
দাঁড়িয়ে পড়ে। এর ফলে আমার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে বেশ খানিকটা দেরিই হয়ে গেল।
শেষমেশ
বিস্তীর্ণ অরণ্য পেরিয়ে খিচিং-এ যখন পৌঁছলাম, মনে হল চাঁদের হাটে
এসেছি। তখনকার দিনের অনেক রাজা-জমিদার হাতির পিঠে, পালকিতে
করে এসে হাজির হয়েছেন পুতুলনাচের আসরে। বহু পুতুল-শিল্পী ঘোরাঘুরি করছে। এত লোকের
মধ্যে পড়ে আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম। ভাবলুম, নিজে পুতুলনাচ
দেখিয়ে কাজ নেই, বরং অন্যান্য শিল্পীদের কাজ দেখেই বাড়ি ফিরে যাব। কিন্তু
ভাগ্যদেবতা আমার জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন।
বিকেলের পর
ছায়া-পুতুলের আসর শুরু হবে, কিন্তু ততক্ষণে অনেকেই ফিরে গেছেন নিজের
নিজের গ্রামে। অন্ধকার নামার পর কেউই বাইরে থাকতে চায় না। বনের জন্তু ছাড়াও
ডাকাতের ভয় আছে এই অঞ্চলে। তারা এমনই
নিষ্ঠুর যে লুটপাট করার পরেও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারে না মানুষজন। কয়েকজন
কাছাকাছি গ্রামের লোক ভিড় করে রইল। আমিও
অধীর আগ্রহে বসে রইলাম তাদের সঙ্গে। সন্ধে হয়ে গেছে অনেক আগে। কিন্তু
খিচিং মন্দিরের কাছাকাছি তৈরি মঞ্চের ওপর হালকা লন্ঠনের আলোয় বেশ একটা মায়াবী
পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মঞ্চ ছাড়া চারপাশে ঘন অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। এরই মাঝে একটা ছোটো
মঞ্চে ছায়া-পুতুলের গল্প মঞ্চন করছে একেকটা দল। আমার খারাপ লাগছিল না বটে, কিন্তু মনটা উসুখুসু করছিল।
সকলের খেলা
দেখানোর পর মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন একজন লোক। তাঁকে দেখে পুতুল-নাচিয়ে মনে হয় না, মনে হয় তান্ত্রিক সাধু। লম্বা দোহারা গড়ন, চুলদাড়ির
ফাঁক দিয়ে চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু সেই চোখের দৃষ্টি কোমল। দর্শকের সামনে
হাতজোড় করে তিনি বললেন, “আমি আমার দলের
একমাত্র নাচিয়ে। আমিই নাচিয়ে, আমিই সূত্রধার, আমিই খঞ্জনি আর হারমোনিয়াম বাজাই। আমি ছায়া-পুতুলের নাচে দুটো বা তিনটে
গল্প বলব আপনাদের। প্রথম গল্প আমাদের চেনা রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড, যেখানে হনুমান সীতা মায়ের খোঁজে গিয়ে লঙ্কা বাটিকাতে আগুন জ্বালিয়ে দেন। দ্বিতীয়
ঘটনা এই খিচিং-এর ইতিহাসের একটা পর্ব। যদি সম্ভব হয় তৃতীয় গল্পও বলা হবে। আপনারা
নিজেরাই স্বচক্ষে দেখবেন। তবে একটা অনুরোধ, পুতুলনাচের সময়
কেউ মঞ্চে আলো ফেলবেন না আর নাচ চলাকালীন কেউ মঞ্চের পিছনে উঠে আসবেন না।”
আমি
যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম। এরকম কথা বলতে আগে কোনও নাচিয়েকে শুনিনি। ছায়া-পুতুলদের
মঞ্চন করার সময় সাধারণত সাত-আটজন লোক থাকে, রামায়ণের গল্পে অনেকগুলো
চরিত্র থাকে। একজন লোক কী করে এতগুলো পুতুল নিয়ন্ত্রণ করবে? তার
ওপর গান আছে, কথা আছে, বাজনা আছে... আর
মঞ্চের ওপর আলো ফেললেই বা কী হয়েছে? লোকে আকছার মঞ্চে আলো
ফেলে দেখতে চায় কোন পুতুলের ছায়া কোন শিল্পী নাচাচ্ছে। আলো
পড়লে কি তান্ত্রিক বাবাজির মনসংযোগ নষ্ট হয়ে যাবে?
যাই হোক, তারপর পুতুলনাচ শুরু হল। খানিকক্ষণ
দেখেই আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। হালকা
কমলা আলোয় পর্দার সামনে প্রায় কয়েকশো পুতুলের ছায়া নাচ করছে, লাফাচ্ছে, দৌড়চ্ছে। হারমোনিয়াম আর খঞ্জনির তালে
তালে সূত্রধারের গলার সঙ্গে সঙ্গে মূকাভিনয় অভিনীত হয়ে চলেছে রামায়ণের দৃশ্যে। সাগর
পেরিয়ে হনুমানের ছায়া এসে পড়ল লঙ্কার অশোক বাটিকাতে, সেখানে
সীতার সঙ্গে তার কথোপকথন। সূত্রধারের গমগমে গলা আর সুরেলা তালের বাজনায় মোহিত হয়ে
বসে আছি আমরা। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া চলে না। কেমন একটা ঘোর পেয়ে বসেছে আমাদের।
মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই পুতুলগুলোই জীবন্ত, আর আমরা আসলে
তাদের হাতের পুতুল। যতক্ষণ তারা না চায় আমরা নড়তে পর্যন্ত পারব না।
একসময় লঙ্কা
রাজ্যে আগুন ধরে গেল। মনে হতে লাগল যেন জ্বলন্ত পর্দার
আগুনের ভিতর দিয়ে উড়ে চলেছে হনুমান। তখনও আমরা স্থাণু হয়ে বসে আছি। একসময় প্রথম
গল্প শেষ হয়ে এল। সূত্রধারের কথায় বুঝতে পারলাম,
হনুমানের ছায়া রূপান্তরিত হয়েছে মারাঠা রাজ্যের সেনাদের সম্মিলিত ছায়াদলে, চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে আক্রমণ করছে ওড়িশার ভঞ্জরাজ্যকে। অপূর্বভাবে
মঞ্চের ডানদিকে জেগে উঠেছে এক নগরী যেখানে গিয়ে হানা দিয়েছে সৈন্যদল। একসময় নগরী
ছারখার হয়ে গেল, ভঞ্জরাজ রাজধানী সরিয়ে নিয়ে এলেন বারিপদা
থেকে খিচিং-এ। খিচিং-এর মন্দিরের ছায়া বড়ো হতে হতে একসময় আসল মন্দিরের ছায়ায়
সমাহিত হল। তারপর মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেল।
আমরা সম্মোহিতের
মতো বসে আছি। যদি আরও কিছু হয় এরপর! কতক্ষণ সময় কেটে গেছে কারও খেয়াল ছিল না। হঠাৎ
একটা সম্মিলিত চিৎকারে সংবিৎ ফিরে এল আমাদের। পিছনের জঙ্গল থেকে অনেকগুলো মশালের
আলো ছুটে আসছে আমাদের দিকে; তার সঙ্গে শোনা যাচ্ছে অনেক লোকের গলা ফাটানো উল্লাস।
“সর্বনাশ! ডাকাত!”
মুহূর্তের
মধ্যে জায়গাটায় একটা আলোড়ন তৈরি হল। দর্শকের দল ছন্নছাড়া হয়ে দৌড়তে শুরু করল ঘন
জঙ্গলের দিকে। তাদের পিছনে ধাওয়া করল কয়েকজন ডাকাত।
কালো পোশাকে তাদের সাক্ষাৎ যমদূতের মতো দেখতে লাগছে। আমিও লোকেদের সঙ্গে দৌড়তে
শুরু করেছি এর মধ্যে। পাশের কয়েকটা লোক ডাকাতদের কাটারির ঘা খেয়ে লুটিয়ে পড়েছে
মাটিতে। পিছনদিকে তাকিয়ে দেখার জো নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঊর্ধ্বশ্বাসে
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে আমরা জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণে বাইরে থেকে
ভেসে আসতে শুরু করেছে লোকেদের আর্তনাদ। কত লোকের প্রাণ গেল কে জানে! মিনিট দশেক পর
হুড়োহুড়ি থেমে গেল। ডাকাতদের উল্লাসের শব্দ ভেসে আসছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে
রইলাম আমরা কয়েকজন। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্যে যা আছে হবে।
আচমকা একটা ঝোড়ো
বাতাস দিতে শুরু করল পশ্চিমদিক থেকে। গাছের মাথায় পাতাগুলো হাওয়ায় হেলে পড়ছে। শুকনো
পাতার দল মাটি থেকে ঝড়ের ঝাপটায় উড়ে যেতে লাগল।
হঠাৎ একটা আশ্চর্য
কাণ্ড হল। মঞ্চের যেদিকে পুতুলনাচের উত্সব হচ্ছিল, সেখানে দপ
করে একটা আগুনের শিখা জ্বলে উঠল। তারপরেই কানফাটা আর্তনাদের শব্দ শুনতে পেলাম বহু
লোকের। প্রচণ্ড ভয়ে যেন চিৎকার করছে তারা! কী হল? আমরা
বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। গ্রামের লোকেরা হয় ডাকাতের পাল্লায় পড়ে প্রাণ দিয়েছে নয়
আশ্রয় নিয়েছে গভীর বনে। ডাকাতরা ছাড়া আর কারও তো থাকার কথা নয় ওখানে। তারা
এমন আর্তনাদ করবে কেন? এদিকে আর্তনাদের তীব্রতা বেড়ে চলেছে। আমরা
কিছুই না বুঝতে পেরে এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। এমন সময় হঠাৎ করেই সব শব্দ থেমে
গিয়ে মৃত্যুপুরীর নিঃশব্দতা নেমে এল সেখানে। আর কিছু শোনা গেল না বহুক্ষণ।
একসময়
লোকেরা সাহস জড়ো করে উঠে দাঁড়াল। ব্যাপারটা না দেখলে হচ্ছে না। ডাকাতরা এখন
নিশ্চয়ই নেই, নাহলে তাদের গলা শোনা যেত। অবশেষে দুটো
লন্ঠন জ্বেলে পায়ে পায়ে আমরা মঞ্চের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। কেউ কোথাও নেই। এখানে
যে কিছুক্ষণ আগে একটা বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটেছে বাস্তবে, সেটা
বোঝার কোনও উপায়ই নেই। কয়েকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করল মঞ্চের পিছনদিকে। আমার আর কিছু
করার নেই। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকার মঞ্চের সামনে। আমার মনে ভিড় করে আছে ছায়া-পুতুলের
অবয়বগুলো। এই ঘটনা কি স্বাভাবিক? পুতুলনাচের সেই মায়াবী
মঞ্চনের দুটো গল্পের পরেই এই ঘটনা। তৃতীয়
গল্পটা জানা হল না। সেই লোকটাই বা কোথায় গেল?
নিজের
ভাবনায় বুঁদ হয়ে ছিলাম, সহসা প্রচণ্ড এক চিত্কারে আমার হুঁশ ফিরল। মঞ্চের
পিছন থেকে আবার অমানুষিক আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল। যারা
লন্ঠন নিয়ে খুঁজতে গিয়েছিল সেদিকে, তারাই আতঙ্কে
চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে ফিরে আসছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে কোনও কারণে তারা প্রচণ্ড ভয়
পেয়েছে। আমার মাথার মধ্যে কে যেন বলে উঠল, ‘দেখবে না? তৃতীয় কাহিনি অভিনীত হচ্ছে, চলে এস।’
মন্ত্রমুগ্ধের
মতো এগিয়ে গেলাম মঞ্চের পিছনের অন্ধকারে। ততক্ষণে লোকেরা দৌড়তে শুরু করেছে অন্ধকার
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গ্রামের দিকে। আমার অন্তরের প্রবল কৌতূহল তখন ভয়কে ভুলিয়ে
দিয়েছে।
জোরে পা
চালিয়ে আমি এসে পৌঁছলাম মঞ্চের পিছনের জায়গাতে। ফেলে যাওয়া লন্ঠনের আলোতে যা
দেখলাম, বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। হিমশীতল
এক ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল পাঁজরার ভিতর দিয়ে। প্রচণ্ড জোরে মাথা নাড়া দিয়ে আমি
দেখলাম, আমি জেগেই আছি। এই মর্মান্তিক দৃশ্য আমার স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তব।
সারা অঞ্চল
জুড়ে ছড়িয়ে আছে মানুষের মৃতদেহ। তাদের মাথায় কালো ফেট্টি, হাতের কাছে পড়ে আছে কাটারি। সেই ডাকাতের দল। আর তাদের মৃত শরীরের ওপর নাচ
করছে কয়েকটা পুতুলের ছায়া। তাদের হরিণ-ছাল দিয়ে তৈরি কাট আউট করা দেহ অদৃশ্য, অন্ধকারে অশরীরী কয়েকটা ছায়া-পুতুলের উল্লাসে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে
আমার। আমার মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। বিস্ফারিত
চোখে দেখলাম, ছায়া-পুতুলগুলো মুখ তুলে একসঙ্গে চাইল আমার
দিকে। তারপর একসঙ্গে একটা ঘূর্ণিঝড়ের মতন ছুটে এল আমার দিকে।
আমি জ্ঞান
হারালাম।
পরের দিন
যখন আমার জ্ঞান হল, তখন আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সারা শরীরে
অসহ্য ব্যথা। বহুকষ্টে চোখ খুলে দেখলাম, আমি একটা ছোটো ঘরের মধ্যে ময়লা বিছানায়
শুয়ে আছি। বাইরে সূর্য নেমে এসেছে; ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম শব্দে ভারী মাথাটা আরও
ভারী লাগছে। বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়েই বুঝলাম, মাথা
ঘুরছে। উঠতে গেলেই পড়ে যাব। এমন সময় একটা বলিষ্ঠ হাত আমাকে আবার বিছানায় শুইয়ে
দিয়ে বলল, “তোমার শরীরে এখন বাইরে হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। এই ওষুধ
খেয়ে বিশ্রাম করো।”
মুখ তুলে
দেখলাম, সেই পুতুল-নাচিয়ে দাড়িওয়ালা তান্ত্রিক বৃদ্ধ। তাঁর হাতে একটা
গেলাসে গরম পানীয়। প্রথমে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম। তার
আগেই লোকটা শান্ত গলায় বললেন, “ভয় পেও
না। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
বিস্মিত হয়ে
জড়ানো গলায় বলতে গেলাম, “আপনি কে, আমি এখানে কী
করে এলাম!”
তার আগেই তিনি
আমাকে আস্তে করে তুলে আমার গলায় পানীয়ের অর্ধেকটা ঢেলে দিয়ে বললেন, “জিজ্ঞাসা থাকা ভালো, কিন্তু
আগে ভালো হতে হবে। সময় হলে সব জানতে পারবে।”
আমি কোনও
কথা না বলে গরম পানীয়টা মুখে ঢেলে দিলাম। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে গেল অনেকটা। মনের
কৌতূহলকে দমন করে আবার শুয়ে ঘুমের জগতে তলিয়ে গেলাম।
পরের কয়েকদিন
কেটে গেল অর্ধেক ঘুমিয়ে, অর্ধেক জেগে। ওষুধ আর খাবার খেয়ে ধীরে ধীরে
সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলাম। চতুর্থ দিন বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে পা দিলাম।
ছোট্ট একফালি
জায়গা পরিষ্কার করে পাশাপাশি দুটো কুঁড়েঘর বানানো হয়েছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে। আশেপাশের
বন এত ঘন যে দিনেও ক্রমাগত ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। বৃদ্ধ কাঠের একটা
কাটা গুঁড়ির ওপর বসে একমনে কোনও কাজ করছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে হালকা হেসে বললেন, “বসো। জ্বর
কমে গেছে, কয়েকদিনের মধ্যেই গায়ে বল পাবে।”
পায়ে পায়ে
এগিয়ে গিয়ে বসলাম তাঁর কাছে। কৌতূহলী স্বরে বললাম, “আপনি এখানে
একলা থাকেন?”
আমার দিক
থেকে চোখ তাঁর হাতের কাজের দিকে নিবিষ্ট করে তিনি ছোট্ট করে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ।”
দেখলাম,
তিনি হরিণের ছাল কেটে কেটে পুতুলের আকৃতি তৈরি করছেন। সেদিকে তাকিয়ে আমার মনে সেই
রাতের অলৌকিক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সেটা কি আমার দুঃস্বপ্ন? লোকটিকে বললাম, “সেদিন কী
হয়েছিল? আমি এখানে কী করে এলাম?”
আমার কথা
শুনে আমার চোখে চোখ রেখে তাকালেন বৃদ্ধ। তারপর ধীর, গম্ভীর স্বরে
বললেন, “তোমার নিয়তি তোমাকে এখানে নিয়ে
এসেছে।”
আমি একটু
অধৈর্য হয়ে বললাম, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মাথায় সব
তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে পুতুলনাচের আসরে ডাকাত পড়ল, তারপর
আমি কতগুলো জীবন্ত পুতুলের অশরীরী ছায়া দেখতে পেলাম, এরপর আমার
জ্ঞান ফিরল এই ঘন জঙ্গলে আপনার কুঁড়েঘরে। কোনটা বাস্তব, কোনটা দুঃস্বপ্ন, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে দয়া করে একটু খুলে বলুন আপনি কে।”
বৃদ্ধ এবার
মুখ তুলে করুণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “জানতে তো তোমাকে হবেই। তোমাকে
জানানোর জন্যই তো ভাগ্যদেবী তোমাকে ডেকে এনেছে। আমি তোমাকে যা বলছি, তোমার হয়তো এখন বিশ্বাস হবে না, কিন্তু সময় তোমাকে বিশ্বাস করিয়ে নেবে
ঠিকই।"
এরপর তিনি
কথা বলতে শুরু করলেন।
।। তিন
।।
দুর্গাচরণ
রায়ের কথা
আমার আসল
নাম দুর্গাচরণ রায়। খিচিং রাজ-পরিবারের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে। অনেক অনেক
বছর আগে যখন মারাঠা সৈন্যরা ময়ূরভঞ্জ আক্রমণ করে, আমার
পূর্বপুরুষেরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে সক্ষম হননি। ময়ূরভঞ্জের শাসকেরা স্থাপত্য, সংস্কৃতি, পুতুলনাচ আর গানবাজনা নিয়ে যতটা আগ্রহী
ছিলেন, যুদ্ধবিগ্রহ আর রণনীতিতে ততটা ধুরন্ধর ছিলেন না। এদিকে
মারাঠারা ছিল দারুণ যোদ্ধা। তাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হল আমার পূর্বপুরুষদের।
অনেকেই রাজ্য ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়েন ওড়িশার নানান জায়গায়। আমার এক পূর্বপুরুষ ছিলেন
ঘোর তান্ত্রিক সাধক। তাঁর নাম ছিল গৌরাঙ্গ রায়। একই সঙ্গে পুতুল-নাচিয়ে হিসেবে তাঁর
দক্ষতা ছিল অসাধারণ। লোকনৃত্য, সঙ্গীত, জাদু, ছায়া-পুতুলের
নাটকে তিনি মেতে থাকতেন সবসময়। মারাঠা শাসকদের কাছে পরাজয়ের ফলে গ্রাম-গঞ্জ থেকে
পুতুলনাচের স্বাভাবিক আসর এলোমেলো হয়ে গেছে ততদিনে, লোকেরা
ভীত। অনেকেই প্রাণ খুইয়েছে, অনেকে যুদ্ধে হারিয়েছে
বিষয়সম্পত্তি। লোকগান, রাবণ-ছায়া পুতুলনাচ, হস্তশিল্প সব শিকেয় উঠেছে। এই অবস্থা দেখে ভয়ানক রেগে উঠলেন তিনি। প্রতিজ্ঞা
করলেন, তার পুতুলেরাই এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবে। দীর্ঘ
সাধনা করে তিনি মন্ত্রপূত চারটে পুতুল তৈরি করলেন হরিণের ছাল দিয়ে। তারপর
মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করে তাদের জন্য এক ছায়া-পুতুলের নাচের আয়োজন করবার অনুমতি
চাইলেন। মারাঠাদের সেনাপতি রাজী হয়ে গেলেন।
সেদিন ছিল
কার্তিক অমাবস্যা। গৌরাঙ্গ রায় সভাতে উপস্থিত হয়ে মারাঠা সেনাপতি আর সৈন্যদের বললেন
যে তিনি তাদের সম্মুখে ছায়া-পুতুলের নাচে দুটো গল্প মঞ্চন করবেন। প্রথম দুটি গল্প যদি
ভালো লাগে তাহলে তিন নম্বর গল্পের মঞ্চন হবে, নাহলে হবে না। এরপর
গৌরাঙ্গ রায় ছায়া-পুতুলের নাচ শুরু করলেন। তার অদৃশ্য হাতে পুতুলের ছায়াগুলো
দাপাদাপি করে ঘুরে বেড়াতে লাগল মঞ্চে, যেন পুতুল নয়, জীবন্ত মানুষের প্রতিচ্ছায়া। মারাঠা সৈন্যরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখে
চলেছে সেই আশ্চর্য খেলা। এমনকি মারাঠাদের সেনাপতিও চোখের পলক ফেলতে পারছেন না। গৌরাঙ্গ
রায় একক প্রদর্শনে গান, বাজনা, পুতুলনাচ
করে চলেছেন অদৃশ্য হাতে। যেন তিনি একই সঙ্গে পঞ্চাশ জন মানুষ।
একে একে
প্রথম দুটো গল্পের মঞ্চন হয়ে গেল। গৌরাঙ্গ রায় আলোছায়ার ভিতর থেকে মঞ্চে এসে
উপস্থিত হলেন। তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করছে মশালের আলোয়। মারাঠাদের দিকে তাকিয়ে তিনি
গমগমে দৃপ্ত কন্ঠস্বরে বললেন, “কী? তৃতীয়
গল্প শুনতে চান?”
সৈন্যরা সম্মোহিত
কন্ঠে সোল্লাসে সহমত দিল। গৌরাঙ্গ রায় সেনাপতির চোখের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের স্বরে বললেন, “সেনাপতি, আমার তিন নম্বর গল্প অন্যায় আর
অত্যাচারীদের শাস্তি দেওয়ার গল্প। বড়ো ভয়ংকর সে কাহিনি। দুর্বল মনের লোকেরা সহ্য
করতে পারে না। সত্যি কি আপনি শুনতে চান সেই গল্প? ভয় পাবেন
না তো?”
সেনাপতি উপেক্ষার
দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “শোন হে! আমি
মারাঠা রাজের সেনাপতি। তোমার
পুতুলনাচ যা আছে শেষ করো, নাহলে আমার সৈন্যরা খেপে গেলে তোমার
পুতুলের সঙ্গে তোমাকেও নাচিয়ে ছাড়বে।”
গৌরাঙ্গ রায়
সকৌতুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন একবার। তারপর পায়ে
পায়ে মঞ্চের দিকে চলে গেলেন। সৈন্যরা মঞ্চের আলো-আঁধারি পর্দার দিকে তাকিয়ে পুতুল
ছায়া-নাচের অপেক্ষা করতে লাগল।
এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত করে বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। ওই তো! মঞ্চের পর্দায় উপস্থিত
হতে শুরু করেছে পুতুল-ছায়ারা। একটা, দুটো, দশটা, চারটে। কিন্তু এ
কী? প্রতিটা পুতুলের গা থেকে আরও অনেক প্রতিচ্ছায়া বেরিয়ে
এসে মঞ্চে ভিড় করছে। সহসা সৈন্যদের গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল। তাদের
গলা দিয়ে একটা আতঙ্কের শব্দ বেরিয়ে এল ছিটকে। ওগুলো কী? পুতুল-ছায়া না কঙ্কালের ছায়া? আলো-আঁধারি ছাড়িয়ে শয়ে
শয়ে ছায়ামূর্তি নেমে আসছে মঞ্চ থেকে নিচে। তাদের
মাংসহীন হাড়ের কালো আবছায়া গৌরাঙ্গ রায়ের গমগমে গানের তালে তালে নাচতে নাচতে এগিয়ে
আসছে সৈন্যদের দিকে। সহসা ছাউনির মশালের আলোগুলো দপ করে নিভে গেল। সৈন্যদের মধ্যে
আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে ততক্ষণে, আর্তনাদ করতে করতে ছোটাছুটি শুরু
করেছে তারা। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। অশরীরী পুতুলের ছায়া লাফিয়ে একেকজন
সৈন্যের গায়ে পড়ে অদৃশ্য শ্বাপদ দাঁতে তাদের কন্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলছে। ফিনকি দিয়ে
রক্ত বইতে শুরু করেছে সৈনিকদের।
সেনাপতির
ওপর চড়াও হয়েছে অগুনতি পুতুলের ছায়া। মাটিতে পড়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় তিনি বলতে
লাগলেন, “ছেড়ে দে, ছেড়ে দে আমায়।”
গৌরাঙ্গ রায়
তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার হিংস্র চোখে খেলা করছে অশরীরী এক হাসি। চাপা গলায়
বললেন, “বলেছিলাম না, আমার তৃতীয় খেলা অন্যায়ের
বিরুদ্ধে প্রতিশোধের গল্প। এই গল্প যতবার মঞ্চন হবে, তোর মতো
পাপী, অত্যাচারী লোকেরা প্রাণ হারাবে আমার চারটে মন্ত্রপূত
পুতুলের হাতে। তোর মতো যত লোকে শাস্তি পাবে, তাদের আত্মা
চিরকালের মতো আমার অশরীরী পুতুলের ছায়ায় বন্দী হয়ে থাকবে। প্রতি অমাবস্যায় তোদের
আসতে হবে আমার ডাকে। আমি মারা গেলেও তোদের মুক্তি হবে না। আমার
উত্তরপুরুষেরা উত্তরাধিকারে পাবে আমার এই বিদ্যে। তোদের ততদিন মুক্তি নেই যতদিন না
আমার উত্তরপুরুষের হাত থেকে এই বিদ্যে চলে যাচ্ছে অন্য কারও হাতে। যদি কোনও যোগ্য
ব্যক্তির হাতে পৌঁছয় এই বিদ্যা তাহলে তোদের মুক্তি, নাহলে তোরা
চিরবন্দী। তোদের মুক্তি নেই।”
বলতে বলতে
গৌরাঙ্গ রায় গভীর বনে অন্তর্ধান করেন। তার পুতুল ছায়াদের হাতে কচুকাটা হয়ে প্রাণ দেয়
মারাঠা সেনাদলের লোকেরা। এই ঘটনার পর
গৌরাঙ্গ রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কিন্তু
হত্যাকাণ্ড থামে না সেখানে। প্রতি অমাবস্যার রাতে কোথাও কোনও জায়গায় এই পুতুল-ছায়ার
তিনটে গল্পের মঞ্চন হয় লোকচক্ষুর সামনে অথবা অন্তরালে। কিন্তু তৃতীয় গল্পের ভূমিকা
থাকে না সবসময়। ছায়া-পুতুলের তিন নম্বর গল্প অভিনীত হয় যেদিন, সেদিন ছায়া-পুতুলের বিভীষিকা গ্রাস করে অত্যাচারী, পাপী
আত্মাদের। ধীরে ধীরে গ্রামে-গঞ্জে গৌরাঙ্গ রায়ের এই অশরীরী পুতুল-ছায়াদের কথা
ছড়িয়ে পড়ে লোকমুখে। চুরি, ডাকাতি,
রাহাজানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। লোকেরা বলাবলি শুরু করে যে পাপীদের পুতুলের প্রতিশোধ
থেকে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব।
* * * * *
“এরপর শয়ে
শয়ে বছর কেটে গেছে। অবস্থার উন্নতি হয়েছে এই অঞ্চলে, কিন্তু গৌরাঙ্গ রায়ের
উত্তরপুরুষরা এই সাধনা চালিয়ে গেছে লুকিয়ে। আমি তাঁরই উত্তরপুরুষ। সেই চারটে
মন্ত্র-পুতুল সযত্নে রাখা আছে আমাদের পরিবারে। যুগের পর যুগ ধরে প্রত্যেক
অমাবস্যার রাতে অভিনীত এই অশরীরী রাবণ-ছায়া পুতুলনাচের আসর হতে থাকে লোকচক্ষুর
আড়ালে। এই মঞ্চন আসলে আমাদের সাধনা। না করলে
আমরা বাঁচব না। আমার জীবনকালে বহুবার তৃতীয় অঙ্কে পুতুল-ছায়ার হাতে শাস্তি হয়েছে
অনেক বদ লোকের। আমাদের মনেও অনেকবার শঙ্কা এসেছে। এসেছে
ভয়। কিন্তু আমরা নিরুপায়। হয়তো সকলের
প্রাপ্য ছিল না মৃত্যু, জেলের ঘানি ঘোরালেও তাদের শাস্তি হত। এই
তন্ত্রসাধনা শুধু প্রতিশোধের নয়, এর পিছনে গৌরাঙ্গ রায়ের
হঠকারিতাও ছিল। এই ক্ষমতা আজ আমাদের পরিবারের কাছেও একটা অভিশাপ। কিন্তু আমাদের
পরিবার ছাড়া অন্য কোনও লোকের কাছে এই ক্ষমতা যাওয়ার কোনও আশা দেখতে পাইনি। পুতুল-ছায়ারা
কোনও ব্যক্তিকে যোগ্য মনে করেনি এত বছর ধরে। একমাত্র
তুমি ব্যতিক্রম। তুমিই এই শক্তি নিতে সক্ষম বলে তোমার দিকে ছুটে এসেছিল পুতুল-ছায়ার
দল। তোমাকে এই দায়িত্ব নিতেই হবে।”
গোপাল
সাঁপুই হতভম্বের মতো চেয়ে ছিল তাঁর দিকে। এবার সে দু’দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তেজিত
কন্ঠে বলল, “কী বলছেন আপনি? আপনার এই কথা যদি
সত্যিও হয়, আমি কিছুতেই এই কাজ করতে পারব না। আমি সাধাসিধে একজন পুতুল-নাচিয়ে। আপনার
কোনও ভুল হচ্ছে।”
“এত বছর ধরে পুতুলের ছায়ারা একজন আগন্তুকের অপেক্ষায় ছিল। সে
তুমি। তোমার যদি বিশ্বাস না হয় বা তুমি এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে চাও, আমি জোর করতে পারি না। কিন্তু পরের অমাবস্যার দিন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।
পুতুলের দল তোমায় চালিত করবে নিজের মতো। তুমি চেয়েও এই জীবন ছাড়তে পারবে না। এ
তোমার নিয়তি।”
ফ্যালফ্যাল
করে গোপাল তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। তার মাথার ভিতরে খালি খালি মনে হচ্ছে। কী হতে
চলেছে তার সঙ্গে? কোনওমতে সে বলল, “দায়িত্বটা কী?”
দুর্গাচরণ
বললেন, “বছর তিরিশ আগে আরও এক বিপর্যয় নেমে আসে
আমাদের ওপর। আমি আগে এরকম বনে বনে ঘুরে বেড়াতাম না, গ্রামে
আমাদের বাড়িতে থাকতাম। ছোটো একটা ব্যাবসা ছিল, তার সঙ্গে
রাবণ-ছায়া পুতুলনাচের দল ছিল একটা। অমাবস্যার দিন ছাড়া পুতুল নাচে কোনওরকম অলৌকিক
কাণ্ড হত না। নানান জায়গায় ঘুরে খেলা দেখাতাম আমরা, নামডাকও
হয়েছিল। হঠাৎ শহর থেকে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে
নাকি পুতুলনাচ নিয়ে রিসার্চ করছে সারা ভারতবর্ষে। রাবণ-ছায়া নাচের বিবর্তন নিয়ে
আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। পুতুলনাচ নিয়ে তার আগ্রহ দেখে সোৎসাহে তাকে আশ্রয়
দিয়েছিলাম। ছেলেটা করিৎকর্মা। কয়েকদিনের
মধ্যেই শিখে ফেলল অনেক কিছু। তার ওপর মায়াই পড়ে গিয়েছিল আমার। কিন্তু তখনও জানতাম
না কী সর্বনাশ করতে চলেছে সে আমার। একদিন সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেল। তার
যাওয়ার পরের অমাবস্যার আগে মন্ত্রপূত পুতুলগুলো নিয়ে পুজোয় বসতে গিয়ে দেখি দুটো
পুতুল নেই। আমার মাথায় বাজ পড়ল। সব ওলটপালট করে খুঁজতে শুরু করলাম। আরও
অনেক পুতুল নেই। সঙ্গে রাবণ-ছায়া নাচের অনেক নথিপত্র
বেপাত্তা। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ছেলেটা আমার পুতুলগুলো চুরি করে পালিয়েছে।
“সেদিন রাতে ছিল অমাবস্যা। কাঁপা হাতে পুজোর আয়োজন করে পুজো শুরু করলাম।
মন্ত্রপূত পুতুল হাতে নিয়ে পুজো শুরু করলেই আকাশপাতাল থেকে অশরীরী অতৃপ্ত আত্মার
দল পুতুলের ছায়া হয়ে নেমে আসে পর্দায়, শুরু করে তাদের নাচ।
কিন্তু সেইদিন তার ব্যতিক্রম ঘটল। পুজো শুরু হতেই আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠল দশহাত। তারপর
একের পর এক অশরীরী ছায়া এসে ঘুরপাক খেতে শুরু করল আমাকে ঘিরে। আমার কানে ফিসফিস
শব্দে মন্ত্রপূত পুতুলের কর্কশ কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘আমরা দ্বিখণ্ডিত পুজো গ্রহণ করি না। আমরা চার দেবতা একমন্ত্রে বাঁধা, আমাদের শক্তি নিয়ন্ত্রিত হয় একসঙ্গে থাকলে। তুই ভুল করেছিস। অন্য
পুতুলদুটো ফিরিয়ে আনতে হবে তোকে। নাহলে প্রতি
কার্তিক অমাবস্যায় তোর পরিবারের একজনের বলি দিতে হবে আমাদের। তুই মরলেও তোকে একজন
লোককে এই দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে। যতদিন না দোষীকে দণ্ড দিচ্ছি, প্রতি অমাবস্যায় ছায়া-পুতুলের নাচের সঙ্গেই তোর বংশের একজন প্রাণ হারাবে।
এই অভিশাপ তুই ততদিন কাটাতে পারবি না, যতদিন আমরা চার দেবতা
একসঙ্গে হচ্ছি। তোকে অনুসন্ধান করতে হবে সেই তস্করের। তাকে
শাস্তি না দিলে তোরও মুক্তি নেই, আমাদেরও মুক্তি নেই।’
কথা শেষ করে
দুর্গাচরণ রায় বললেন, “গত তিরিশ বছরে আমার
পরিবারের প্রায় সকলকে হারিয়েছি প্রতি কার্তিক অমাবস্যায়। অনেক
আকুতি করেছি, অনেক সাধনা করেছি, একসময়
তাদের সংস্পর্শ ত্যাগ করে গ্রাম ছেড়ে, পুতুলনাচের দল ছেড়ে জঙ্গলে এসে নিবাস করতে
শুরু করেছি, কিন্তু তাও আমার পরিবার নিস্তার পায়নি এই অভিশাপ
থেকে। আমি আর বেশিদিন নেই, কিন্তু আমার পরিবারকে তোমায়
মুক্তি দিতে হবে। তোমাকে সেই তস্করকে খুঁজে হারিয়ে যাওয়া পুতুল দুটো খুঁজে আনতে হবে, এই তোমার গুরুদায়িত্ব।”
বৃদ্ধের চোখ
থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি দু’হাতে
গোপালের দু’হাত জড়িয়ে ধরলেন। গোপাল সাঁপুই সে হাত ছাড়িয়ে নিতে পারল না। তারও
চোখও কখন ভিজে উঠেছে।
।। চার
।।
কথা শেষ করে
গোপাল সাঁপুই বলল, “সেইদিন থেকে আজকের
দিন, আমি রাবণ-ছায়ার মন্ত্রপূত পুতুলদুটি নিয়ে প্রতি
অমাবস্যায় খুঁজে চলেছি সেই লোককে। দুর্গাচরণ রায় বহুদিন মারা গেছেন। তাঁর
পরিবারে কেউ আছে কি না তাও আমি জানি না, কিন্তু এই অভিশাপ
আমায় টানতেই হবে। আমি জানি, একদিন সে সামনে আসবে তৃতীয়
অঙ্কে। তখন তার নিস্তার নেই।”
মুরারিবাবু
মনোযোগ সহকারে গল্প শুনছিলেন গোপাল সাঁপুইয়ের।
তাঁর ভুরু খানিকটা কুঁচকে গেছে ডানদিকে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মুরারিবাবু বললেন, “গোপালবাবু, আপনি বলছেন আপনার মন্ত্রপূত পুতুল, যা কিনা কয়েক শতাব্দী আগে গৌরাঙ্গ রায় তন্ত্রসাধনা করে কয়েকটা মন্ত্রপূত
পুতুল তৈরি করেছিলেন অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেন বলে, সেই
জাদুপুতুল আজও প্রতি অমাবস্যায় দোষীদের শাস্তি দিয়ে চলেছে!”
গোপাল
সাঁপুই একটু বাধো গলায় বলল, “না, প্রতি অমাবস্যায় যে কেউ শাস্তি পাবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু
যদি তৃতীয় অঙ্ক অভিনীত হয় কোনও অমাবস্যায়, তাহলে দোষী শাস্তি পাবেই।”
মুরারিবাবু
পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন লাইটার দিয়ে। তারপর
গোপালকেও একটা সিগারেট অফার করলেন। কিন্তু সে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করল। এবার
একটু চিবিয়ে চিবিয়ে মুরারিবাবু বললেন, “গোপালবাবু, কিছু মনে করবেন না। একটা কথা জিজ্ঞেস
করছি। এত বছর ধরে যে আপনার ওপর এই অভিশাপ
চলছে, আপনার কথামতো প্রতি অমাবস্যায় খেলা দেখানোর সময় আপনি একটা
ঘোরের মধ্যে থাকেন, আপনাকে চালিত করে এই মন্ত্রপূত পুতুলের
দল - হাজার হাজার প্রেতাত্মা ছায়া-পুতুল রূপে আনাগোনা শুরু করে শ্যাডো পাপেটারির
মঞ্চে, দর্শক থাক বা না থাক - তা এত বছরে আপনার চোখের সামনে
কত লোকে শাস্তি পেয়েছে, মানে প্রাণ হারিয়েছে?”
গোপাল একটু
অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আমি কোনওদিন সেরকম
কিছু হতে দেখিনি। দুর্গাচরণ রায় মারা যাওয়ার পর থেকে তৃতীয় অঙ্ক অভিনীত হয়নি কোনওদিন, কাউকে প্রাণও হারাতে হয়নি।”
“মানে, আপনি বলছেন যে প্রথম একবার আপনি খিচিং-এ যে অশরীরী পুতুলছায়াদের
হাতে মৃত্যুকাণ্ড দেখেছিলেন, সেরকম আর কোনওদিন হতে দেখেননি
এত বছর ধরে?”
“না। আমার মঞ্চনে তৃতীয় অঙ্ক অবধি গল্প যায়নি।”
“আচ্ছা গোপালবাবু, আপনি কী করে বুঝতে পারেন যে মন্ত্রপূত
পুতুলেরা আপনাকে চালিত করে প্রতি অমাবস্যায়? তৃতীয় অঙ্ক হবে, না হবে না, সেটাও
তারা আপনাকে জানায় কী করে?”
“পুতুলনাচ শুরু করার সময়েই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। গানের
কথা ও বাজনার সঙ্গে যখন পুতুলনাচ আরম্ভ করি, আমার অজ্ঞাতেই অনেক
অবয়ব ঢুকে আসে পুতুলছায়ার গল্পে। মনে হয় আমাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে অদৃশ্য ছায়াগুলো। অনেক
সময় দ্বিতীয় গল্প শেষ হওয়ার পর মাথা ঝিমঝিমানি ভাবটা কেটে যায়। বুঝতে
পারি, আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তারা।”
মুরারিবাবু
কপালে হাতদুটো ঠেকিয়ে বললেন, “গোপালবাবু, আমি আপনার কথা অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু
আমার মনে হয় আপনার গল্পে ভৌতিক বা অলৌকিক বলে কিছু নেই। আসলে দুর্গাচরণবাবু
সম্মোহনী শক্তিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, আপনাকে তিনি
সম্মোহিত করেছিলেন খিচিং-এ বাকি দর্শকদের সঙ্গে। পরে আপনার ঝোলা হাতড়ে যখন জানতে
পারেন যে আপনি নিজেও একজন পুতুল-নাচিয়ে, তিনি আপনাকে ব্যবহার
করেন তাঁর গল্পের কথাকার হিসেবে। তাঁর আয়ু ফুরিয়ে এসেছিল। হয়তো এককালে তিনি অসম্ভব
ভালো পুতুল-নাচিয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী বলে কেউ ছিল না। অথচ প্রতিটা
শিল্পীই নিজের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় যুগ যুগ ধরে। ভেবেচিন্তে তিনি একটা গল্প
তৈরি করেন। তার সঙ্গে মিশিয়ে দেন ইতিহাস আর
অলৌকিক অভিশাপের কথা। তিনি জানতেন, একজন বৃদ্ধ
পুতুলশিল্পীর শেষ ইচ্ছে আপনি ফেলতে পারবেন না। ঠিক তাই হল। আপনি
তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে তার মতো করে চালিয়ে যান রাবণ-ছায়া নাচের অনুষ্ঠান। অমাবস্যার
রাত ছাড়াও তো আপনি অনুষ্ঠানে জিইয়ে রেখেছেন তাঁর একক ছায়া-পুতুলনাচের শিল্পকে। কিন্তু
তার সঙ্গেই আপনার মনে হতে থাকে আপনি আসলে এক অভিশাপের বশে জীবনযাপন করছেন। আসলে মন্ত্রপূত
পুতুলের কোনও অস্তিত্ব কোনওদিন ছিল না, আপনার কোনও দায়িত্বও
নেই।”
গোপাল
সাঁপুই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। তার
মাথায় মুরারিবাবুর কথাগুলো বাজছে। এমনটা কি সম্ভব? না, না। সে
কেমন করে হয়? একটা অবাস্তব বিশ্বাসের ওপর ভর করে কি জীবন
কাটাচ্ছে সে? মুরারিবাবুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, “না, এমন হতে পারে না। আমার অমাবস্যা রাতের
পুতুলনাচের স্মৃতিগুলো ধোঁয়াশা। অন্যান্য অনুষ্ঠানের সময় এরকম হয় না। যদি অভিশাপের
কথা মনগড়া হত, সেটা এতদিনে বুঝতে পারতাম না?”
মুরারিবাবু
হাতের তালু ঘষে বললেন, “সেটা খুব স্বাভাবিক,
গোপালবাবু। সম্মোহনে ট্রিগার করার জন্য নানা পন্থা আছে। কোনও
বিশেষ বিশেষ ঘটনা, তিথি, কথা আপনাকে
সারাজীবন একইভাবে চালিত করতে পারে যদি না আপনার সম্মোহন কাটানো হয়। আর শিল্পী
হিসেবে এমন অনেক মানুষ আমি সারা দুনিয়ায় দেখেছি যাদের মনে হয় ঈশ্বর বা অন্য কোনও
অলৌকিক শক্তি তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে চলেছে। অনেক ক্রিয়েটিভ মানুষেরই স্মৃতিনাশ হয়
কাজ করার সময়। অনেকে ছবি এঁকে অথবা পারফর্ম করে নিজেরাই ভুলে যান। এরকম ভুরিভুরি উদাহরণ
দেওয়া যেতে পারে।”
গোপাল কোনও
কথা বলছেন না। কিন্তু তার হাতের মুঠো ঘেমে উঠেছে। তার কপালের
ভাঁজে ঘাম জমে গেছে। স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, সে ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি অনুভব
করছে। মুরারিবাবু উঠে দাঁড়িয়ে তার কাছে
গিয়ে বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন
না। আপনি হয়তো নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করতেন বেণী-পুতুলের ছায়াশিল্পী হিসেবে,
কিন্তু তার জায়গায় একজন অন্য মহৎ শিল্পীর কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সেটাও কম নয়। শিল্পী
হিসেবে আপনি কোনও অন্যায় করেননি। আপনার মনে সংশয় হওয়া স্বাভাবিক। একটা কাজ করা যাক। পরের
অমাবস্যা পড়ছে পরশুদিন। তিনদিনের অনুষ্ঠান আজকেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি
কয়েকজনের সামনে সেদিন এককভাবে আপনার ছায়া-পুতুলনাচ করুন। আমরা সেটা রেকর্ড করব। কোনও
অদ্ভুত ঘটনা যদি হয়, হাতেনাতে সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে। আর যদি না
হয়, আপনার বুক থেকে একটা বড়ো বোঝা নেমে যাবে। আপনি
স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপনার শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।”
গোপাল আস্তে
আস্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
।। পাঁচ
।।
অমাবস্যার
রাত। ছায়া-পুতুলনাচের আয়োজন করা হয়েছে রাতের বেলা। মুরারিবাবু লোকজনকে বলে সব
জোগাড়যন্ত্র করে রেখেছিলেন। দর্শক অবশ্য খুবই কম। অনিন্দিতা এবং আর্ট কনসাল্ট-এর কয়েকজন। মুরারিবাবু
ছাড়া আছেন তার বন্ধু শিল্পী আর্য এবং সেবাস্টিয়ান। যেখানে তাঁরা আছেন, সেই বাংলো বাড়ির পিছনে বাগানে একটা ছোটো মঞ্চ তৈরি করে শ্যাডো পাপেটেরির
আয়োজন হয়েছে। পুরো খেলাটা রেকর্ড করার ব্যবস্থাও করে রেখেছেন মুরারিবাবু।
সন্ধে
পেরিয়ে যাওয়ার পর পায়ে পায়ে সকলে উপস্থিত হল সেখানে। গোপাল সাঁপুই হাতজোড় করে
মঞ্চের মাঝখানে উঠে দাঁড়াল। আজ
তার চেহারায় দু’দিন আগেকার দোনামনা ভাব, অস্থিরতা, সংশয় সব উধাও হয়ে গেছে। হালকা হেসে তেজস্বী গলায় গোপাল কথা শুরু করল,
“নমস্কার। পুতুল-ছায়ার এই প্রাচীন শিল্পকে এই মঞ্চ দেওয়ার জন্য আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি আজকে রাবণ-ছায়া নাচের মাধ্যমে দুটো অথবা তিনটে
গল্প শোনাতে চলেছি আপনাদের। তিন নম্বর গল্প বলা হবে কি না, সেটা
নির্ভর করছে প্রথম দুটো মঞ্চন এবং আমার পুতুলদের ইচ্ছের ওপর। এই মঞ্চন অন্যান্য
অনুষ্ঠানের চেয়ে খানিকটা আলাদা। কেননা,
এখানে আমি একাই একমাত্র শিল্পী। গান, বাজনা ও পুতুলনাচ
একসঙ্গে আমিই সঞ্চালন করব। অনুষ্ঠানের মাঝে কেউ মঞ্চে আলো ফেলবেন না অথবা মঞ্চের
পিছনের দিকে হেঁটে যাবেন না। তাতে
শিল্পীর মনসংযোগ নষ্ট হয়।”
এই বলে
গোপাল আরেকবার সকলের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে মঞ্চের পিছনে চলে গেল। অনুষ্ঠান
আরম্ভ হয়ে গেল। সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে, শুধু একটা হালকা
কমলা আলো পড়েছে পর্দার ওপর। গোপালের হাতে বাজনার বোল শুরু হল। তারপর
সূত্রধার হিসেবে সে গান শুরু করল রামতালির সঙ্গ নিয়ে। সহসা রাবণ-ছায়া পুতুলের
তিনটে ছায়ামূর্তি খেলা শুরু করল পর্দার ওপরে। সূত্রধারের গানের কথায় বোঝা যায় যে
এই তিন ছায়ামূর্তি আসলে রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ। রাবণ
তাঁর ভাইদের যুদ্ধে আহ্বান করছেন, বিভীষণ তাঁকে বোঝাচ্ছেন যে এই
কাজ ঠিক নয়। বিভীষণ কিছুতেই এই যুদ্ধে রাম-লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। কুম্ভকর্ণ
ভাইয়ের কথায় সায় দিচ্ছেন না, কিন্তু যুদ্ধে যেতে তিনি তৈরি। তিন
ভাই তিনদিকে চলে গেলেন। পর্দায় এরপর অদ্ভুতভাবে ছায়া-পুতুলদের
দল এসে যুদ্ধের আবহ তৈরি করল। বিভীষণ
রামের সঙ্গে, কুম্ভকর্ণ অন্যদিকে। বাজনার গতি বেড়ে চলেছে। একসময়
কুম্ভকর্ণ মারা পড়লেন। রাবণ যুদ্ধে
অবতীর্ণ হলেন। বিভীষণ তাঁকে বলছেন, কেন তুমি জেনেবুঝে মরতে চাইছ। রাবণ হেসে বলছেন, আমি
তো ছায়ামাত্র। রাম আমার ছায়াকেই বধ করবে, না হলে এই গল্প
এগোবে কী করে? যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ছায়ায় ছায়ায়। একসময়
রাবণ পড়ে গেলেন রামের তিরে। কিন্তু
তারপরেই উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ছায়ামূর্তি আকারে বাড়ছে। ক্রমে
অন্যসব ছায়া এসে মিলিত হল তাঁর ছায়ায়।
অপলক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন সকলে। মুরারিবাবু চোখের পলক ফেলতে পারছেন না। এ যে
অবিশ্বাস্য! একজন মানুষ কী করে এই বিশাল ছায়ানৃত্য করতে পারে? গান, বাজনা, পুতুল-ছায়ার
উপস্থাপনা - সব নিঁখুত। সত্যি কি কোনও অমানুষিক শক্তি আছে গোপাল সাঁপুইয়ের কাছে? পরে রেকর্ড করা ক্যাসেটটা ভালো করে দেখতে হবে।
ততক্ষণে
দ্বিতীয় খেলা শুরু হয়ে গেছে। এই দৃশ্যে অবতীর্ণ হয়েছেন এক বৃদ্ধ। সূত্রধারের
কথায় বোঝাই যায় তিনি একজন পুতুলশিল্পী। ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তুলতে থাকেন তাঁর দল। কিন্তু হঠাৎ তাঁর রাজ্যে হানা দেয় শত্রু। ঘরবাড়ি
পুড়িয়ে, প্রজাদের কচুকাটা করে চলে যায় তারা। বৃদ্ধ পুতুলশিল্পী হতাশ
হয়ে বসে থাকেন এক গাছের নিচে। তাঁর হাত গড়ে তুলতে থাকে চারটে পুতুল, যাদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন বৃদ্ধ। সেই পুতুল জাদু করে আবার ফিরিয়ে এনে
দেয় তাঁর পুরোনো সময়, তাঁর পুতুলনাচের দল। এরপর বৃদ্ধ তাঁর
পুতুল চারটে তুলে দেন তাঁর ছেলের হাতে। পুতুল
চারটে বদল হতে হতে চলে আসে অনেক বছর পর তাঁর এক উত্তরসূরির হাতে।
মুরারিবাবু
ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন গৌরাঙ্গ রায়ের কাল্পনিক গল্পকেই ধরে তুলেছে গোপাল সাঁপুইয়ের
ছায়া-পুতুলেরা। কিন্তু কী জীবন্ত তাদের চলাফেরা! অবিকল
যেন মানুষের ছায়া! সূত্রধার হিসেবে যেন অন্য কেউ কথা বলে চলেছে মঞ্চের পিছন থেকে! সুরের
করুণ মূর্ছনা বিঁধে যাচ্ছে মানসপটে। দর্শকেরা
বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে আলো-আঁধারি পর্দার সামনে।
এদিকে
গল্পের দ্বিতীয় অঙ্কে পুতুলের ছায়ার মধ্যে আগত হয়েছে নতুন এক ছায়ামূর্তি। পুতুল-নাচিয়ের
সঙ্গে কথা বলে আশ্রয় নিয়েছে তাঁর ঘরে। তাঁর সঙ্গে বসে কথা বলে চলেছে সেই নতুন
আগন্তুক। পুতুল-নাচিয়ের সঙ্গে এই নতুন আগন্তুক অনুশীলন করা শুরু করে খেলা দেখানোর।
দুই ছায়ামূর্তির কথোপকথনের সুরেলা আবহের মাঝে মঞ্চের পিছন থেকে গোপাল সাঁপুইয়ের
কন্ঠস্বর শোনা যায়, “আজকের দ্বিতীয়
অঙ্কের গল্প এখানেই শেষ।”
হাততালি
দিয়ে ওঠে দর্শকেরা। মুরারিবাবু মনে মনে তারিফ করেন গোপাল সাঁপুইয়ের। লোকটা
একটু বোকাসোকা হলেও অসম্ভব প্রতিভাবান। পুতুল-ছায়ার শিল্পটা রপ্ত করেছে বটে। এত
বছর ধরে এমন একজন শিল্পী অবাস্তব, অলৌকিক একটা অভিশাপের গল্প নিয়ে
পড়ে রইল ভেবে তাঁর রাগ হচ্ছিল। এই দেশেই এমন সম্ভব। এমন
ওয়ার্ল্ড ক্লাস অ্যাক্ট তিনি খুব কমই দেখেছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় দেখালে এতদিনে গাদা
গাদা পুরস্কার পেত লোকটা। দাঁড়িয়ে পড়ে তিনি সকলের সঙ্গে হাততালি দিতে থাকেন।
গোপাল
সাঁপুই তখনও মঞ্চে আসেনি। তার গলা শোনা যায় মঞ্চের পিছন থেকে, “গল্পের তৃতীয় অঙ্ক অভিনীত হবে এইবার। আপনাদের মতো
আমিও অপেক্ষা করে আছি এই মুহূর্তের জন্য বহুকাল ধরে।”
মুহূর্তের
মধ্যে হাততালি থেমে যায়। চমকে উঠে বসে পড়েন মুরারিবাবু। লোকটা বলেছিল, তৃতীয়
অঙ্কের গল্পে পুতুল-ছায়ারা মৃত্যুবিধান দেয় দোষী ব্যক্তিদের। কিন্তু সে তো কোনওদিনই
ঘটেনি গোপাল সাঁপুইয়ের সঙ্গে। সত্যি কি
কিছু অলৌকিক ঘটতে চলেছে এখানে? এক মুহূর্তের জন্য আতঙ্কের একটা
স্রোত বয়ে যায় তাঁর বুকের ভিতর দিয়ে। পরমুহূর্তেই
মনে হয়, ধুস, যত বুজরুকি। শহুরে
ভালো দর্শক পেয়ে লোকটা একটু চালিয়াতি করছে। নিশ্চিন্ত মনে চেয়ারে বসে পড়েন তিনি।
এদিকে
পর্দায় আবার ছায়া-পুতুল ফিরে এসেছে, সেই বৃদ্ধ পুতুল নাচিয়ে ও তাঁর সাগরেদরা। সূত্রধার
হিসেবে গোপাল সাঁপুইয়ের গলা শোনা যায় ঠিকই, কিন্তু সেই গলা যেন
তার নয়। আঞ্চলিক গানের বদলে সেখানে বলা হচ্ছে
একটা ঘটনা। তার সঙ্গে ছায়াতে অভিনীত হচ্ছে সেই ঘটনা।
“দুর্গাচরণ আশ্রয় দিয়েছিলেন নবাগত সেই শিল্পীকে। তাকে
শিক্ষা দিয়েছিলেন ছায়া-পুতুলের নাচের। দূর শহর থেকে আসা সেই ছেলেটিকে বলেছিলেন তাঁর
নিজের তৈরি পুতুলের কথা, যারা তাঁকে শক্তি জোগায়। কিন্তু নিজের
ছেলের মতো বিশ্বাস করেছিলেন যে ছেলেকে, সে ছিল লোভী, অসৎ, অসাধু। এক রাতে সেই ছেলেটি দুর্গাচরণের দুটি
পুতুল চুরি করে পালায় গ্রাম থেকে। সেই মন্ত্রপূত পুতুলের দুটি অবশিষ্ট থাকে
দুর্গাচরণের কাছে। তান্ত্রিক মন্ত্রে একসঙ্গে বাঁধা সেই
চার পুতুলের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভিশাপ এসে পড়ে দুর্গাচরণের পরিবারে। অনেক মূল্য দিতে
হয়েছে তাদের সেই অসাধু তস্কর ছেলেটির কাজের জন্য। কিন্তু একদিন সকলকেই তার
কৃতকার্যের জন্য শাস্তি পেতে হয়। আজ এত বছর
পর সেই লোকটির সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের মধ্যেই উপস্থিত আছে সে আজ। মুরারি জয়দেব, প্রস্তুত হও!”
চমকে উঠে
চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠেন মুরারিবাবু। চিৎকার করে উঠে বলেন, “এটা কী ধরনের মশকরা, গোপালবাবু? আমি চোর? আমি কেন পুতুল চুরি করতে যাব?”
দপ করে সব
আলো নিভে গেল। মুরারিবাবু দেখতে পেলেন, তাঁর চোখের সামনে ঘুরতে শুরু করেছে কতগুলো
কালো অশরীরী ছায়া। তাঁর কানে কানে কে যেন বলল, ‘মনে নেই?’
মুরারিবাবুর
সামনে থেকে একটা অতীতের পর্দা সরে গেল যেন। তিনি বহু
আগের একটা দৃশ্য দেখতে পেলেন। তখন জোয়ান
বয়স, পুতুলের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান দেশের গ্রামে-গঞ্জে। নামকরা পুতুলশিল্পী
হওয়ার জন্য সব করতে রাজি তিনি। অনেক জায়গা থেকে অনেক পুতুল সংগ্রহ করেছেন। কয়েকটা
পুতুল অসৎভাবে সংগ্রহ করাকে অপরাধের মধ্যে গণ্য করেননি। ওড়িশাতে একটা লোকের কাছে
সেই বৃদ্ধ রাবণ-ছায়া শিল্পীর কথা শুনে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। বৃদ্ধ
অজ পাড়াগাঁয়ে থাকতেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে নিজের ছেলের মতোই ব্যবহার
করেছিলেন। ছায়া-পুতুল সম্পর্কে অনেক কথাই
বলেছিলেন, অনেক কিছু শিখিয়েওছিলেন। কিন্তু তাঁর কয়েকটা পুতুল সযত্নে
লুকিয়ে রাখতেন একটা বাক্সে। সেগুলো তিনি বার করতেন না কখনও। কী
করে যেন যুবক মুরারিবাবুর মনে ধারণা হয়, ওই পুতুল তাঁর চাই। রাতে
বাক্স ভেঙে চারটের মধ্যে দুটো পুতুল নিয়ে পালান তিনি। পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে
পুতুলগুলো নিতান্তই সাধারণ। ঘরের এককোণে অন্যান্য পুতুলদের সঙ্গে ফেলে রেখেছিলেন।
সামনে থেকে
দৃশ্যটা সরে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। ততক্ষণে স্মৃতির আড়াল থেকে সব কথাই মনে পড়েছে তাঁর। মুরারিবাবু
বুঝতে পারলেন, তাঁর শরীর ঘিরে কতগুলো অতৃপ্ত কালো ছায়ামূর্তির
অবয়ব। দপ করে একটা লেলিহান আগুনের শিখা জ্বলে উঠল তাঁর সামনে। সেই আলোয় তিনি
দেখলেন, হাজার হাজার ছায়ামূর্তির ভিড়ে তিনি একা দাঁড়িয়ে
আছেন। তাদের অদৃশ্য চোখ যেন তাঁকে গিলে ফেলতে চাইছে। চিত্কার করে তিনি বলতে চাইলেন, আর্য, অনিন্দিতা, কোথায় তোমরা?
বাঁচাও আমায়!
কিন্তু
কোথায় কে? চোখের সামনে সেই বৃদ্ধের অবয়ব অস্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। কানের
মধ্যে ফিসফিস করে শুনতে পেলেন, ‘পুতুলদুটো কই?’
মুরারিবাবুর
গলা শুকিয়ে এসেছে। কোনওমতে বললেন, “নিয়ে যান,
নিয়ে যান। আমার কাছেই আছে সেই পুতুল। আমি দিয়ে
দিচ্ছি, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি জেনে এই কাজ করিনি। আমায় ছেড়ে দিন।”
কোনও কথা না
বলে বৃদ্ধের অবয়ব মিলিয়ে গেল। মুরারিবাবু দেখলেন, তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে ছায়া-পুতুলের
দল। তাদের চোখের কালো কোটরের অদৃশ্য কয়লার
আগুনের তাপে পুড়ে যাচ্ছে তাঁর গা, তাদের নখে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে তাঁর
শরীর। প্রচণ্ড এক আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।
।। ছয় ।।
ছায়া-পুতুলের
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আলো জ্বলতে দর্শকের আসনে মৃতদেহ পাওয়া গেল মুরারিবাবুর। দেখে
মনে হয় হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। যদিও তাঁর
চোখে প্রচণ্ড এক আতঙ্কের ছাপ। ভিডিও রেকর্ডিংয়ে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা চোখে পড়ল না
কারও। তাঁর ঝোলা থেকে পাওয়া গেল দুটো হরিণের ছাল দিয়ে
তৈরি অদ্ভুতদর্শন পুতুল। অনিন্দিতা সেগুলো গোপালকে দিয়ে বলল, “আপনাকে দেবেন বলেই হয়তো মুরারিবাবু এইগুলো সঙ্গে
এনেছিলেন। আপনি নিলেই হয়তো তাঁর ভালো লাগবে।”
গোপাল
নিঃশব্দে পুতুলগুলো নিয়ে তার ঝোলায় ঢুকিয়ে নিল। সেখানে
অপেক্ষা করা দুটো অন্য পুতুল একসঙ্গে শেষ হাসি হেসে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
_____
ছবিঃ
সুমিত রায়
Osadharon. Khub bhalo laglo. Ekbare pore felar motoi golpo. Ekdom onnyorokom.
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deletekhub bhalo,tobe plot take ar ektu alada bhabe sajano jeto,murari babu erom ekta bepar bhule gelen.jaihok khub khub bhalo
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ,ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা বলতে পারি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা..যেই জিনিস নিয়ে আমরা আবেগে চলি সেই জিনিসের প্রাপ্তির জন্যে করা অন্যায় গুলো অনেক সময়ে মুছে যায়..অনেকেই বই কেনার লোভে বা সিনেমা দেখার লোভে কৈশোরে টাকা সরিয়েছে কিন্তু অনেক বছর পর সেটা মনে থাকে না, থাকলেও সেটাকে আমরা ছোটবেলার দুষ্টুমি বলে উড়িয়ে দি.. তবে আপনি ঠিক বলেছেন..অন্য ভাবে ও সাজানো যেতো..গল্পটা পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ
Deleteঅসাধারণ। এক টানা পড়ে যেতে হয়। দারুন।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
ReplyDeleteউপন্যাস টা পড়তে বেশ ভালো লেগেছে, শুধু মুরারি বাবু র ব্যাপারটা প্রথমেই বলে দেওয়ায় শেষ অঙ্ক আমার কাছে একটু ম্যাড়ম্যাড়ে লেগেছে।
ReplyDeleteThank you
Deleteঅসাধারণ
ReplyDelete