তিব্বতি উপকথা

সুশা, মুকজোং
এবং লামা
ইন্দিরা
মুখোপাধ্যায়
তিব্বতিদের
প্রাচীন কিংবদন্তী বেশ মজার। সে যুগে তিব্বতের মানুষদের সঙ্গে পশুপাখীদের ওঠাপড়া, ঘনিষ্ঠতা
ওদের ধর্মে সর্বজনবিদিত। ওরা পশুপাখীদের ভাষা বুঝত আর পশুপাখীরাও ওদের কথাবার্তা
বুঝতে পারত।
পৃথিবীটা
তখন ছিল খুব তরুণ। সবেমাত্র সৃষ্টি হয়েছে। সদ্য সদ্য সবুজ গাছপালায় ভরে উঠেছিল ছোটো
ছোটো পাহাড়ের ঢাল। কত রকম রঙ সেই পাহাড়ের। আর মধ্য তিব্বতি হিমালয়ের অত অত
পর্বতশৃঙ্গগুলো তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবুও এই অঞ্চলকে পৃথিবীর ছাদ বলা হল। আনন্দে
আপ্লুত তিব্বতের মানুষজনেরা। অত উচ্চতায় জীবনধারণের কত প্রতিকূলতা, তবুও
পশুপাখিদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক ছিল এখানকার মানুষদের। ছিল অগণিত জলাশয়ের মিষ্টি
জল।
অল্পস্বল্প খেতিজমিতে সামান্য চাষাবাদ করে মনের সুখে থাকত মানুষ। তিব্বতের এই শীতল
মরুভূমিতে পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘর বেঁধে এক বুড়ো লামা বাস করতেন। তিব্বতি
সন্ন্যাসীকে লামা বলে।
কাদা, মাটি
আর পাথর দিয়ে বানানো একটি মাড হাউজের বাইরে চমরি গাইয়ের গোবর লেপা থাকত। ঘরের
মেঝেতে খুব ধুলো ছিল। সেই ঘরের মধ্যে ছোট্ট একটা কাঠের পাটাতনের ওপর শুয়ে থাকতেন
সেই তিব্বতি সাধু বা লামা। তাঁর পরনের একটিমাত্র কাপড় ছিল। সেটি দিনের বেলায় নদীর
জলে কেচে,
রোদে শুকিয়ে আবার তিনি পরে নিতেন। তাঁর ঘরের কোনায় এক বস্তায় ভরা কিছু
শস্যদানা ছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাম্বা নামক রোষ্ট করা গম জাতীয় একরকম
শস্যদানা। আর ছিল বার্লি। একটি মাটির কেটলিতে ছিল কিছু চা’পাতা। আর ছিল একটি কাঠের
স্যুপ খাওয়ার বাটি। চমরী গাইয়ের দুধ থেকে মাখন তুলে গরম মাখন-চা
বানিয়ে খেতেন তিনি। তিব্বতের এই চা মানুষকে ঠাণ্ডায় খুব তৃপ্তি দেয়।
লোকালয় থেকে বেশ অনেকটা দূরে
ছিল লামার কুঁড়েটি। নিজের ঘরে লামা প্রায়শই মগ্ন থাকতেন উপাসনায়, ধ্যানে।
জীবজগতের মঙ্গল সাধনায় বিগলিত ছিল তাঁর প্রাণ। হাতে সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর ধাতব
প্রেয়ার হুইল আর জপের মালা। ঘূর্ণায়মান চাকাটি একহাতে আর অন্যহাতে জপের মালা নিয়ে
সব্যসাচী লামা মনের সুখেই থাকতেন।
সুশা
নামে তাঁর একটি খরগোশ আর মুকজোং নামে একটি ইঁদুর ছিল। এই দুই পোষ্যের মধ্যে বুঝি
খুব ভাব ছিল? নাহ! মোটেও নয়। লামার সঙ্গে তারা বন্ধু ভাব দেখালেও আসলে তাদের
দুজনের সম্পর্কটা পুরোটাই ছিল ভান করা।
রাতেরবেলায়
যেই লামা নিদ্রামগ্ন হতেন সুশা আর মুকজোং চুপিচুপি সেই ঘরে ঢুকে বস্তার মুখ খুলে
তার ভেতর থেকে সব শস্য দানা রোজ চুরি করে খেত। ঘরের মধ্যে
শুয়ে শুয়ে রাতেরবেলায় খুটখাট আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যেত তাঁর। লামা একদিন টের পেলেন
তাদের এই কর্মকাণ্ডের কথা। তিনি ঠিক করলেন একটি ফাঁদ পাতবেন আর তাদের ধরে ফেলবেন।
রাতের বেলায় একটি ঝুড়ি রেখে দিলেন কায়দা করে। সেদিন রাতেই কেল্লাফতে। লেজ আটকে
মুকজোং আর সুশা দুজনেই ধরা পড়ল। পরের দিন সকালে তাদের গোঁফ, কান
আর লেজ কেটে অতি সন্তর্পণে ঝুড়ি থেকে লামা তাদের বের করে আনলেন।
মুকজোং
আর সুশার খুব অভিমান হল লামার ওপর। তারা বলল, “আমরা এক
জায়গায় এতদিন রয়েছি আর তুমি আমাদের অবিশ্বাস করলে? আমরা কিন্তু
কিছুই চুরি করিনি তোমার ঘর থেকে। আমরা শুধু দেখছিলাম তুমি বস্তায় কি রেখেছ, ব্যাস
শুধু এইটুকুই ছিল আমাদের আগ্রহ।”
সুশা
বলে উঠল, “সাধু, তুমি
না ভগবানের তপস্যা কর। শোনো, তুমি যখন আমাদের মতো অবলা জীবকে এমন
করে নিষ্ঠুর শাস্তি দিলে আমরা এবার আমাদের রাজামশায়ের কাছে যাব। তোমার জন্য তাঁর সেনাবাহিনী
দিয়ে বস্তায় করে শস্যদানা পাঠিয়ে দিতে বলে আসব। অতএব তুমি তাদের জন্য বিশাল ফাঁদ
পেতে রাখো এবার। দেখি রাজামশাইয়ের লোকজন কেমন সেই ফাঁদে ধরা দেয় আর তাঁর জন্য
তোমার কী শাস্তি হয়।”
লামা
বললেন, “শাস্তি
তো পেতেই হবে তোমাদের। আমার কাছে এতদিন আছ তোমরা, আমাকে না
বলে কেন চুরি করলে?”
মুকজোং
যদিও এই শস্য চুরির ব্যাপারটায় খুব লজ্জিত, তবুও সুশার প্ররোচনায় সে রাজার কাছে
ছুটল। গিয়ে বলল, “রাজামশাই, এই
দেখুন, কতটুকুনি
একটা জীব আমি। সাধুবাবা কেমন অবস্থা করেছেন আমার। আপনাকে এর বিহিত করতেই হবে।”
রাজা
বললেন, “বেশ
তাই হবে। আমি
সেনা পাঠাচ্ছি লামার ঘরে।”
রাজা
মুকজোং-কে এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার সঙ্গে আর কে ছিল?”
মুকজোং
তখন সুশাকে দেখিয়ে বলল, “এই খরগোশ আর আমি খুব বন্ধু। আমরা
একসঙ্গে বহুদিন ধরে আছি ঐ লামার কাছে।”
রাজার
খুব চিন্তা হল। তিনি ভাবলেন মনে মনে। খরগোশ নিরীহ জীব। ইঁদুরের কুসঙ্গে পড়ে সেও বদস্বভাবের
হয়ে গেছে তবে। এরমধ্যে চৌর্যবৃত্তি শিখে ফেলেছে। ঠিক আছে, আমি লামার বাড়িতে সেনা
পাঠালাম বটে, তবে জেনে রেখো একটা কথা। চালাকির দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয় না। ইঁদুরকে
সকলেই চেনে চোর রূপে। খরগোশের তেমন কোনও বদনাম নেই। অতএব আমিও লামাকে বলে দিচ্ছি
আমার সেনার জন্য কোনও ফাঁদ না পাততে, তাদের বিপদে না ফেলতে।”
মুকজোং
আর সুশা এবার বুঝতে পারল।
চালাকি
করে সত্যি বড়ো কিছু জেতা যায় না। অন্যকে বিপদে ফেলতে গেলে নিজেদের বিপদ বেড়ে যায়। আর
সত্যি তো লামার কোনও দোষ নেই। তিনি তো বিশ্বাস করেছিলেন তাদের। তারাই বরং হাতেনাতে
ধরা পড়ে গেছে। লজ্জায় আর মনের দুঃখে লামার ঘর থেকে পালিয়ে তারা সে যাত্রায় বাঁচে
আর কি!
_____
ছবিঃ দীপিকা
মজুমদার
দারুণ গল্প
ReplyDeleteবাঃ, খুব সুন্দর। এরকম তিব্বতি উপকথার ছোট্ট গল্পগুলির অনুবাদ একসাথে কি কোথাও পাওয়া যাবে?
ReplyDelete