
টুকু ও চারটে
কুকুর
অরিন্দম
দেবনাথ
পরপর চারটে রাস্তার কুকুর মারা গেল টুকুদের পাড়ায়।
কুকুরগুলো যে অসুস্থ ছিল তা নয়। প্রত্যেকটাই ছিল বেশ তাগড়া।
টুকুদের পাড়ার গলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াত কুকুরগুলো। কাউকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখলে লেজ নেড়ে কুঁইকুঁই করে পেছন পেছন রাস্তার
মোড় পর্যন্ত যেত, তারপর পাড়ার কোনও না কোনও গলিতে ঢুকে শুয়ে পড়ত। বাড়ির ফেলে দেওয়া
খাবার চেটেপুটে খেত। অজানা লোক দেখলে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে তেড়ে যেত। যতক্ষণ না পাড়ার
কেউ বেরিয়ে এসে আওয়াজ দিত ততক্ষণ চিৎকার বন্ধ হত না। এই কুকুরগুলোর জন্য টুকুদের
পাড়ায় কোনও ফেরিওয়ালাও ঢুকত না। পাড়ার সব কটা গলি দাপিয়ে বেড়াত কুকুর চারটে।
প্রথম কুকুরটার মৃতদেহ বেরোল একজনের বাড়ির লনে পার্ক করা
গাড়ির তলা থেকে। ড্রাইভার গাড়ি পরিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করল যে একটা কুকুর গাড়ির
তলায় মরে পড়ে আছে। মৃত কুকুরটাকে গাড়ির তলা থেকে বার করা হলে কুকুরটার বাদামি শরীরে
কোনও আঘাতের চিহ্ন দেখা গেল না। কুকুরটার মরার খবর পেয়ে পাড়ার অনেকেই কুকুরটাকে
দেখতে এলেন। সবারই একটু মনখারাপ হল। কুকুরটা অনেকেরই পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত। অনেকেই
ওকে সকালে বিস্কুট খাওয়াত। কুকুরটার যে অনেক বয়স হয়েছিল তাও নয়। মিউনিসিপ্যালিটিতে
খবর দিতে, গাড়ি এসে মরা কুকুরটাকে তুলে নিয়ে গেল।
ঠিক দু’দিন পর সকালবেলা হইচইয়ে টুকুর ঘুম ভেঙে গেল। দোতলার
ব্যালকানিতে দাঁড়িয়ে টুকু দেখল ওদের বাড়ির তিনটে বাড়ি পরে সরকারদের বাড়ির সামনে
ড্রেনের ধারে অনেক লোকের জটলা। ভিড়ের মধ্যে বাবাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে দোতলা
থেকে নেমে দরজা খুলে সরকার বাড়ির সামনে গিয়ে ভিড়ের ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে,
ড্রেনের মধ্যে একটা কুকুর মরে পরে আছে।
পাশের বাড়ির দাসকাকু টুকুকে দেখতে পেয়ে বলল, “বুঝলি টুকু, কুকুরদের মড়ক লেগেছে। তোর তো আবার কুকুরপ্রীতি
বেশি। রাস্তার কুকুরগুলো নিয়ে এখন একদম ঘাঁটাঘাঁটি করিস না, কী থেকে কী হয়ে যায়!”
ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলল, “একটা
পশুর ডাক্তার ডাকলে হয় না? দু-দুটো কুকুর মরে গেল!”
ফুট কাটলেন দাসকাকু, “মরা
কুকুরের জন্য ডাক্তার ডেকে কী করবেন? কুকুরের মড়ক লেগেছে। এখন মিউনিসিপ্যালিটিতে
খবর দিতে হবে এটাকে নিয়ে যাবার জন্য।” টুকুর খুব
কান্না পেয়ে গেল। কালকেই স্কুল থেকে ফেরার সময় কুকুরটাকে বিস্কুট খাইয়েছে।
পাড়ার মোড় থেকে স্কুলের গাড়িতে ওঠার সময় বাকি দুটো কুকুরকে
কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকতে দেখল টুকু। রোজ স্কুলের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করার সময় কুকুরগুলো
টুকুর সঙ্গে খানিক খেলা করে। জুতো শোঁকে, ব্যাগ শোঁকে - আবার কোনও একটা কুকুর
সামনের দুটো পা সটান টুকুর কাঁধে তুলে দাঁড়িয়ে পরে। টুকু কুকুরটার মাথা চাপড়ে আদর
করে দিলে তবেই টুকুর কাঁধ ছেড়ে মাটিতে নেমে আসে কুকুরটা। এদিন আর টুকুকে দেখে কোনও
কুকুর এগিয়ে এল না। টুকু আওয়াজ দিতে একবার মাথা তুলে আবার মুখ নামিয়ে থাবায় মুখ
গুঁজে শুয়ে রইল বেঁচে থাকা কুকুরদুটো। টুকু সামনে গিয়ে একটা কুকুরের মাথায় হাত
দিতে মাথা তুলে তাকাল কুকুরটা। টুকু দেখল দু’চোখ দিয়ে জল পড়ছে কুকুরটার। অন্য
কুকুরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, মুখ তুলে টুকুর দিকে তাকিয়ে রইল কুকুরটা। এটার চোখেও
জল। ছোটো হলেও টুকু বুঝল দুই সঙ্গীকে হারিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে কুকুর দুটো। স্কুলের
গাড়ি এসে গেছিল। টুকুকে নিয়ে গাড়িটা চলতে শুরু করলে টুকু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কুকুরগুলো
উঠে দাঁড়িয়ে রোজকার মতন দৌড়ে আসছে গাড়ির পেছন পেছন।
* * * * *
স্কুলে টুকুর মনে ছিল না কুকুরগুলোর কথা। বাড়ি ফেরার সময়
গাড়ি থেকে নামতেই দেখতে পেল কুকুর দুটো দাঁড়িয়ে আছে। অভ্যাস মতো ব্যাগ থেকে টিফিন
কৌটো খুলে বাঁচিয়ে রাখা রুটির টুকরো খেতে দিল কুকুর দুটোকে। টুকুর পেছন পেছন বাড়ি
পর্যন্ত এল কুকুর দুটো।
মা’র স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। স্কুলে অনেক হোমটাস্ক
দিয়েছিল। বিকেলে খেলতে না গিয়ে তাই হোমটাস্ক নিয়ে বসল টুকু। আসলে টুকুর মন ভালো
নেই। মাঠে খেলতে যাবার পথে কুকুরগুলোকে একসঙ্গে দেখতে না পাবার ব্যথা ওকে ঘরে আটকে
রেখেছে। মা স্কুল থেকে ফিরে টুকুকে পড়ার টেবিলে দেখে খানিক অবাক হয়ে গেল। প্রতিদিন
নিয়ম করে মাঠে যায় টুকু। টুকুকে দেখভাল করার লোক বেবি মাসিকে জিজ্ঞেস করল, “বেবি, টুকুর কি শরীর খারাপ? আজ খেলতে যায়নি?”
বেবি কিছু বলার আগে টুকু বলে উঠল, “না
মা, আজ স্কুলে অনেক হোমটাস্ক দিয়েছে। সেগুলো কাল করে নিয়ে যেতে হবে।”
রাতে খাবার পর অনেকক্ষণ ব্যালকানিতে একা একা দাঁড়িয়ে রইল
টুকু। বাবা টিভিতে খবর দেখছে। মা ডাইনিং টেবিলে বসে স্কুলের পরীক্ষার খাতা দেখছে।
সেনকাকুরা ক’দিন ধরে বাড়িতে নেই। রাত্রিবেলা দু’জন লোক এসে
ওদের বাড়িতে পাহারাদার হিসেবে থাকে। লোকগুলোকে দেখলেই কুকুরগুলো কেন জানি খুব
চিৎকার করত।
সাড়ে দশটা বাজে। ব্যালকানিতে দাঁড়িয়ে টুকু দেখতে পেল সেনকাকুদের
বাড়ির রাতের পাহারাদার দু’জন সাইকেল থেকে নামছে। দুটো কুকুর ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে আকাশের
দিকে মুখ করে চিৎকার করে চলেছে। একজন লোক গেট খুলছে আর একজন সাইকেলে ঝোলানো একটা
ব্যাগ থেকে কিছু বার করে ছুঁড়ে দিল কুকুরদুটোর দিকে। ছুঁড়ে দেওয়া জিনিসগুলো মুখে
নিয়ে কুকুর দুটো চলে গেল। নিশ্চয়ই খাবার কিছু হবে। টুকুর মনে পড়ল আজকে তো খাবার
কিছু বাঁচেনি। বাবাও কুকুরদের খাবার দিতে যায়নি। ইসসসস খুব ভুল হয়ে গেছে!
* * * * *
সকালে স্কুলে যাবার সময় মোড়ের মাথায় পৌঁছে টুকু দেখতে পেল
অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড়ের মাঝে দাসকাকুও ছিল। টুকুকে দেখতে পেয়ে বলল, “স্কুলে যাচ্ছিস?” টুকুর খুব
হাসি পেল। স্কুলের ড্রেস পরে স্কুল ছাড়া আর কোথায় যাবে?
তবুও উত্তর দিল “হ্যাঁ কাকু।”
“জানিস, আরও দুটো কুকুর মরে গেছে! পাড়ায় আর কোনও
রাস্তার কুকুর রইল না। নির্ঘাত মড়ক লেগেছিল!”
ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল ক্লাস এইটের টুকুর। গতকালও
স্কুল থেকে ফেরার সময় টিফিন থেকে বাঁচিয়ে রুটির টুকরো খাইয়েছে কুকুর দুটোকে। চোখে
জল নিয়েও কাল কুকুর দুটো স্কুল গাড়ির পেছন পেছন খানিক ছুটেছিল। কুকুরের কি সত্যিই
মড়ক লাগতে পারে? পাড়ার চার-চারটে কুকুর মরে গেল আর কেউ একটা পুলিশে খবর দিল না?
সবাই ধরে নিল মড়ক লেগে কুকুরগুলো মরে গেছে? স্কুলের গাড়ি এসে গেছিল। গাড়িতে উঠতে
উঠতে টুকু শুনতে পেল দাসকাকুর গলা।
“না হে, ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না, আজ থেকে রাতপাহারা
শুরু করতে হবে।”
রাতপাহারা ব্যাপারটা কী ভালো জানে না টুকু। শুধু জানে অনেকে
মিলে জেগে রাতের বেলা পাড়ার মধ্যে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয়। টুকু বাবার কাছে রাতপাহারা
দেবার গল্প শুনেছে। তখন নাকি প্রায়ই চুরি হত পাড়াতে। বেজায় খাওয়াদাওয়া আর মজা হত
নাকি রাত পাহারার সময়! তারপর এই চারটে কুকুরের জন্য আর রাতপাহারা দেবার দরকার হত
না। ওরাই পাড়ার পাহারাদার হয়ে গেছিল।
রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না টুকুর। ওর জন্য আলাদা ঘর আছে। সেখানেই
কিছুদিন ধরে একলা ঘুমোয় টুকু। তবে ওর ঘরের দরজা বন্ধ থাকে না। খানিক আগেই মা
এসেছিল দেখতে যে টুকু ঘুমিয়েছে কিনা। টুকু চুপ করে চোখ বন্ধ করে ছিল। মা ওর গায়ে একটা
পাতলা চাদর জড়িয়ে দিয়ে গেছে। ওর মাথায় ঘুরছে চারটে মরা কুকুর আর রাতপাহারা। খানিক
আগে কয়েকজন হুইসেল বাজিয়ে ‘হুঁশিয়ার’ ‘হুঁশিয়ার’ বলে চিৎকার
করে গেছে।
টুকুর খুব ইচ্ছে হল ব্যালকানিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাতপাহারা
দেখার। আজ বাবাও গেছে রাতপাহারা দিতে। কিন্তু ব্যালকানি তো বাবা-মায়ের বেডরুমের
লাগোয়া, যাবে কী করে! যদিও বাবা-মায়ের ঘরের দরজা খোলাই থাকে। নাইট ল্যাম্পের হালকা
আলোতে টুকু আস্তে আস্তে পর্দা সরিয়ে ঢুকল বাবা-মায়ের ঘরে। মা চাদর মুড়ি দিয়ে
ঘুমোচ্ছে। গ্রিল দিয়ে চারদিক আটকানো ব্যালকানির দরজাও খোলা ছিল। টুকু গিয়ে দাঁড়াল
ব্যালকানিতে। নিস্তব্ধ পাড়ার রাস্তার দু’পাশে সার সার বাড়ি। সরকারকাকু আর রায়কাকুর
গাড়ি পার্ক করা রাস্তার ধারে। রাস্তার লাইটগুলো জ্বলছে। মাঝরাতের পাড়ার রাস্তা আগে
কোনোদিন দেখেনি টুকু।
সেন কাকুদের বাড়ির সামনের রাস্তার আলোটা জ্বলছে না। একটা
বেড়াল হাঁটছে রাস্তার মাঝ বরাবর। কার বাড়ির বেড়াল কে জানে? বেড়ালটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
তারপর বিশ্বাসকাকুর বাড়ির বড়ো গেটের ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। সেনকাকুর বাড়ির
দরজা খুলে দুটো লোক বেরিয়ে এল। পাহারাদার দুজন। ওদের কী মজা। আজ থেকে পাড়ায়
রাতপাহারা শুরু হয়েছে। ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই টাকা পেয়ে
যাবে। ভাবল টুকু। কে জানে ওরা এত রাতে ঘর থেকে বেরোল কেন? স্কুল থেকে ফেরার সময়
টুকুর সঙ্গে সেনকাকুদের উলটোদিকের বাড়ির চক্রবর্তী জ্যেঠুর দেখা হয়েছিল। জ্যেঠু আর
জ্যেঠিমা মেয়ের বাড়ি যাচ্ছে, কাল সকালে ফিরবে বলল। না, এবার ঘুম পাচ্ছে। টুকু পা
টিপে টিপে নিজের ঘরে ফিরে শুয়ে পড়ল।
* * * * *
“টুকু,
এই টুকু, শিগগিরি ওঠ। পাড়ায় চুরি হয়ে গেছে।” মা’র
ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম ভাঙল টুকুর। উলটোদিক হয়ে শুতে গিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল।
“কী হয়েছে মা?”
“তোর বাবা ফোন করেছিল। কাল রাতে চক্রবর্তীবাবুদের
বাড়ি চুরি হয়েছে। ওরা রাতে কেউ ছিল না, আজ সকালে মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে দেখে ঘরের
তালা ভাঙা। আলমারি খুলে টাকা পয়সা আর গয়না নিয়ে পালিয়েছে চোরেরা।”
“বাবা কোথায়?”
“চক্রবর্তীবাবুদের বাড়ির ওখানে গেছে। কী আশ্চর্য, পাড়ার
চার-চারটে পাহারাদার কুকুর মড়ক লেগে মারা গেল। রাতপাহারা চলা সত্ত্বেও চোর এসে
চুরি করে নিয়ে গেল। আর রাতপাহারায় থাকা এতগুলো লোক কিছু টের পেল না? তোর বাবাও তো
কাল রাতপাহারায় ছিল!”
টুকু বলল, “আমি একটু
দেখে আসছি মা।”
মা বলল, “দেরি করিস
না, স্কুল আছে। বাবাকেও তাড়াতাড়ি আসতে বল। সন্ধের ফ্লাইট আছে তোর বাবার। বাজার করে
রেখে যেতে হবে।”
টুকুর বাবা সেলসে কাজ করে। প্রায়ই বাইরে যেতে হয়।
টুকু চক্রবর্তী জ্যেঠুর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখে পাড়ার প্রায়
সব বড়োরাই উপস্থিত। পুলিশও এসেছে। চক্রবর্তী জ্যেঠিমা কাঁদো কাঁদো মুখ করে গ্রিল
ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
টুকু ভিড়ের মধ্যে বাবাকে খুঁজতে লাগল। শুনতে পেল চোরেরা
টাকাপয়সা আর গয়নাগাটি ছাড়া আর কিছু নেয়নি। পুলিশ এসে রাতপাহারায় থাকা সব লোককে
চক্রবর্তী জ্যেঠুর ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। টুকু বাবার সঙ্গে
দেখা করার জন্য চক্রবর্তী জ্যেঠুর ড্রয়িং রুমের দিকে এগোতেই আটকে দিল এক পুলিশ।
“কোথায় যাবে খোকা?”
“আমার বাবা আছেন ওই ঘরে।”
“কিন্তু এখন তো দেখা করা যাবে না।”
“বাবাকে মা ডাকছে বাজার করার জন্য।”
“মা’কে গিয়ে বল, বাবা এখন যেতে পারবে না।”
“চোরগুলোকে না ধরে বাবাকে ধরে রেখেছ কেন?” কান্না কান্না গলায় বলে উঠল টুকু।
“যাও, শিগগিরি ঘরে যাও, না হলে বাবার সঙ্গে
তোমাকেও আটকে রাখব,” বলল পুলিশটি।
চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে চক্রবর্তী জ্যেঠুর ড্রয়িং রুম থেকে
বেরিয়ে এলেন ডাইরি হাতে একজন সাদা পোশাক পরা ভদ্রলোক।
“এত চ্যাঁচামিচি কীসের?”
“স্যার, এই বাচ্চা ছেলেটা ঘরে যেতে চাইছে ওর বাবার
সঙ্গে দেখা করতে। ওর বাবাও কাল রাতপাহারায় ছিল,”
পুলিশটি বলল।
“দেখা করুক না, রাতপাহারায় যারা ছিল তারা তো আর
চুরি করেনি। আমরা ওঁদের সঙ্গে কথা বলছি যদি চুরির কোনও ক্লু পাওয়া যায় এই ভেবে।”
টুকু ঘরে ঢুকে ওর বাবার হাত আঁকড়ে সিভিল ড্রেস পরা পুলিশ
অফিসারটির দিকে তাকিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, “কারা
চুরি করেছে আমি জানি। উলটোদিকের সেনকাকুদের বাড়ির রাতের পাহারাদারদের ধরো। শুধু
তাই নয়, আমাদের পাড়ার কুকুরগুলো এমনি মারা যায়নি। ওই লোকগুলোই মেরেছে। আমি সব
জানি।”
টুকুর কথা শুনে ওর বাবা এক ধমক দিয়ে উঠল। থামালেন পুলিশ
অফিসারটি। খুব নরম সুরে বললেন, “কী জান বলো তো।
কোনও ভয় নেই। তার আগে ওই পাহারদার দুটোকে আটকাবার ব্যবস্থা করি।”
সেন বাড়ির রাত পাহারাদার দু’জন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের
ধরা হতে ওরা চুরির কথা অস্বীকার করল। বলল, “আমাদের
রুটি-রোজগার হল পাহারা দেওয়া, আর আমরাই কি না চুরি করব? আমাদের ঘর সার্চ করা হোক।”
যে ঘরে পাহারাদার দুটো শুতো সেই ঘর খুঁজে কিছুই পাওয়া গেল
না। বাকি ঘরগুলো তালাবন্দি, আর সেই ঘরের চাবি সেনবাবুদের কাছে।
পুলিশ অফিসারটি ওদের ছেড়ে দিতে বললেন। তারপর টুকুর দিকে
ফিরে বললেন, “দেখলে তো, ওদের ঘর থেকে কিছুই পাওয়া গেল না।”
পাহারাদার দু’জন দরজায় তালা দিয়ে সাইকেলে উঠতে যাবে, ওমনি
টুকু আবার চিৎকার করে উঠল, “ওদের ধরুন,
সাইকেলে ঝোলানো বাজারের ব্যাগগুলো দেখুন।”
ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল দাসকাকু। টুকুর কথা শুনে খপ করে
চেপে ধরল একজনের সাইকেলের ক্যারিয়ার। তারপর বাজারের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে টেনে বার
করল একটা ছোটো কাপড়ের ব্যাগ। সেটা খুলতে বেরিয়ে এল একটা রুমালে বাঁধা পুঁটুলি। পুঁটলিটা
খুলতেই চকচক করে উঠল একরাশ সোনার গয়না। আর একজনের ব্যাগ থেকে বেরোল একটা মোটা বই, ‘রামায়ন’। আর সেই
বইয়ের ভেতর কাগজ কেটে তৈরি খাপ থেকে বেরোল কয়েকটা দু’হাজার আর পাঁচশো টাকার নোট।
টুকুকে জড়িয়ে ধরলেন চক্রবর্তী জ্যেঠিমা। ততক্ষণে সবাই ঘর
থেকে বেরিয়ে এসে ভিড় জমিয়েছে রাস্তায়।
পুলিশ অফিসারটি সবাইকে চুপ করতে বলে টুকুকে বললেন, “তুমি বুঝলে কী করে ওরা চুরি করেছে?”
“কাল আমিও রাতপাহারা দিচ্ছিলাম যে!”
টুকুর কথা শুনে ওর দিকে কটমট করে তাকাল ওর বাবা।
টুকু বলতে শুরু করল, “পরশুদিন
রাতে ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখেছি যে, লোকগুলো সাইকেল করে এসে ঘরে ঢোকার আগে
সাইকেলে ঝোলানো ব্যাগ থেকে কিছু বার করে কুকুরগুলোকে ছুঁড়ে দিল। আর কুকুরগুলো
ওগুলো মুখে করে নিয়ে চলে গেল। এর আগে আমাদের পাড়ায় দু-দুটো কুকুর মরেছে। কাল সকালবেলা
স্কুলে যেতে গিয়ে শুনলাম আমাদের পাড়ায় আরও যে দুটো কুকুর ছিল সে দুটোও মরে গেছে। সবাই
বলছিল যে অসুখ হয়ে মড়ক লেগে কুকুরগুলো মরে গেছে। কিন্তু আমি স্কুলে যাবার সময়
প্রতিদিন কুকুরগুলোর সঙ্গে খেলতাম, ওরা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। আমার মনে...” বলে বাবার দিকে আড়চোখে তাকাল টুকু। এই রে! বাবা একদিন
বলেছিল রাস্তার কুকুরগুলোর সঙ্গে না খেলতে।
“তারপর?” বললেন
পুলিশ অফিসারটি।
“গতকাল রাতে আমার ঘুম আসছিল না। বাবা রাতপাহারায়
এসেছিল। আমার খালি ইচ্ছে করছিল রাতপাহারা কী করে দেয় জানার। আমি চুপি চুপি মাঝরাত্তিরে
মায়ের ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলাম। রাস্তার সব আলোগুলো জ্বলছিল, শুধু সেনকাকুদের
বাড়ির সামনেটা ছাড়া। হঠাৎ দেখি একটা বেড়াল রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে। তারপর
বেড়ালটা আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পাশের বিশ্বাস বাড়ির বড়ো গেটের ফাঁকে ঢুকে গেল। তখনই
সেনকাকুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল ওই দুই পাহারাদার। আমি ভেবেছিলাম ওরাও বোধহয়
রাতপাহারা দিতে যাচ্ছে। তারপর আমার খুব ঘুম পেয়ে গেছিল, আমি গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। বাকিটা.........।”
_____
ছবিঃ
পুষ্পেন মন্ডল
দিব্যি
ReplyDelete