
অসি
নদীর তীরে
গৌতম
গঙ্গোপাধ্যায়
দিতির কথা
“দিতি, দিতি?”
কাল সেই লাল তারাটাকে সূর্য
ডোবার পরে দুটো পাহাড়ের মাঝখানে উঠতে দেখেছি, আজকেই রওনা হতে হবে। তাই সকালবেলাটা খুব ব্যস্ত। এর মধ্যেই নমুচি দৌড়ে দৌড়ে আসছে। ছেলেটা বড্ড চঞ্চল। “কী হল? এখন
গোছগাছ করার সময়, বিরক্ত করছিস কেন?”
“অদিতি বলছে ওরা আমাদের সঙ্গে
যাবে না,” নমুচি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে।
“যাবে না মানে? কারা যাবে না?
কোথায় যাবে না?” বুঝতেই পারছিলাম না নমুচি কী বলছে।
“ওরা এই জায়গাটাতেই থাকবে।
তুই একটু অদিতির সঙ্গে কথা বল। ও না গেলে শ্রীও নির্ঘাত থেকে যাবে।”
আচ্ছা -- শ্রী আমাদের সঙ্গে যাবে না, এটাই তাহলে নমুচির
চিন্তার কারণ। আমি শরঘাসের মাদুরটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধছিলাম, হাতের কাজটা শেষ করে উঠে
দাঁড়ালাম। “ঠিক আছে। তুই যা, তোর জিনিসপত্র ঠিকঠাক কর। আমি অদিতির কাছে যাচ্ছি।”
যাব বটে, কিন্তু অদিতি আমার
কথা শুনবে কিনা সন্দেহ। আমার মা দনু ছিল আমাদের দলের প্রধান। মাত্র তিন চাঁদ আগে
একা একা জঙ্গল থেকে ফেরার সময় আমার মায়ের উপর একটা সিংহ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মা লড়াই
করে সিংহটাকে মেরে ফেলেছিল, কিন্তু নিজেও বাঁচেনি। মায়ের পর আমাদের দলের প্রধান কে
হবে, সেই নিয়ে অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। অদিতির মা আর আমার মা ছিল বোন। অদিতি
ভেবেছিল ও আমার থেকে বড়ো, তাই ওই এবার থেকে আমাদের দলটাকে চালাবে। অদিতির দিকেও কিছু
মহিষ ছিল, কিন্তু বেশি লোকজন আমাকেই চেয়েছিল। তাই আমিই আমার মায়ের জায়গা নিয়েছি।
জানি অদিতি আমাকে পছন্দ করে না, কিন্তু অদিতিরা থেকে যাবে মানে কী? চিরকাল বৃষ্টি
শুরুর ঠিক আগে আগে আমাদের এই জায়গা ছেড়ে যেতেই হয়। আমার মায়ের কাছে শুনেছি, তার
মায়েরাও এই সময় পাহাড়টাকে টপকে উলটো দিকে চলে যেত, আবার শীত শেষ হলে ফিরে আসত। নমুচি
কী শুনতে কী শুনেছে! তবু অদিতির কাছে যাওয়ার আগে শুক্রকে ডেকে নিলাম – ওর বুদ্ধির উপর আমার সবচেয়ে বেশি ভরসা।
অদিতি তাঁবুর বাইরে বসে ছিল,
যাওয়ার জন্য কোনও গোছগাছই শুরু করেনি। “অদিতি, তুই নাকি আমাদের সঙ্গে যাবি না?”
অদিতি অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে
রেখেই জবাব দিল, “ঠিকই শুনেছিস। আমরা এই নদীর ধারটাতেই থেকে যাব।”
“থেকে যাবি মানে? আমাদের মা
দিদিমারা কোনোদিন এখানে বর্ষা কাটিয়েছে? মহিষাসুর কালকেই মোষের পালকে এই জঙ্গল থেকে
পাহাড়ের পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছে। চিরকাল আমরা মহিষরা ওদের সঙ্গে যাই। জঙ্গলে হরিণ,
ছাগল, নীলগাই – কিছুই তো নেই। শেষ হরিণ মেরেছি এক সপ্তাহ হয়ে গেল। তুই
খাবি কি?”
“ঘাসের বীজ খাব। নদীর পারে ওই
মাঠের ওপর ঘাসের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছি, দেখবি তার থেকে নতুন বীজ পাব। নদীর থেকে মাছ
ধরব। জন্তুর দরকার নেই। জঙ্গলে অনেক বিপদ – সিংহ, ভাল্লুক, নেকড়ে, হাতি। তোর
মা’টাও তো জঙ্গলেই মরল। মাছ আর ঘাসের বীজ – এতেই আমাদের চলে
যাবে,” এবার অদিতি আমার দিকে তাকাল। “তোর ছেলে মেয়ে হয়নি এখনও, তুই দল চালানোর কী
জানিস? তোর দলে আমরা আর থাকব না। আমি একা নই, আরও অনেকে আমার সঙ্গে থাকবে।”
“আমি তোর অনেক পরে জন্মেছি,
তাই এখনও আমার ছেলেমেয়ে হয়নি। সেটা কি আমার দোষ? বেশি লোক চেয়েছে বলেই তো আমি
দলটাকে চালাই। তুই বোকা, তাই বুঝতে পারছিস না বৃষ্টির পরে নদীটা ফুলে উঠবে। ঘাস তো
মরে যাবে, তখন তোরা খাবি কী?” আমার রাগ হয়ে গেল।
আমার কোনও কথা অদিতি শুনলই
না। শুক্রও অনেক বোঝাল। সবচেয়ে খারাপ লাগল যে শুধু অদিতি নয়, আরও কয়েকটা মহিষ ওর
সঙ্গে থেকে গেল। শ্রী নমুচির সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু অদিতি ছোটোবোনকে মারধোর
করে তাঁবুর মধ্যে বেঁধে রেখে দিয়েছিল।
সেদিন যখন আমরা বাকিরা রওনা
হলাম, সূর্য মাথার উপরে। আমি আর নমুচি ছিলাম সবার পিছনে। “চিন্তা
করিস না। ক’দিন পরই ওরা ঠিক বুঝতে পারবে এখানে
থাকলে ওরা বাঁচবে না। দেখবি এক চাঁদও যাবে না, ওরা হাজির হয়ে যাবে,” আমি নমুচিকে
বললাম।
শুক্র ছিল কাছেই। আমার কথা
শুনে শুধু বলল, “না রে দিতি, হয়তো ওরা আর আমাদের সঙ্গে আসবে না।”
“না এলেও আমরা তো শীত পেরোলেই
আবার আসব। নমুচি, ততদিন যদি ওরা টিকে থাকে, তাহলে শ্রীকে আবার দেখতে পাবি।”
* * *
ভোর হয়েছে। তাঁবু থেকে বেরিয়ে
দাঁড়ালাম। পাহাড় থেকে নেমে এসেছি গতকাল।
“মা,” নিশুম্ভও ওর তাঁবু থেকে বেরিয়েছে, “কালকেই পৌঁছে
যাব।”
হ্যাঁ, কালকেই আমাদের পুরানো
জায়গায় পৌঁছে যাব। এখানে এলেই অদিতির কথা মনে আসে। শুক্রই ঠিক বলেছিল, অদিতিরা
আমাদের সঙ্গে আর আসেনি। ওরা নদীর কাছেই থেকে গেছে আর একেবারে অন্যরকম জীবন বেছে
নিয়েছে। আমরা মহিষাসুরের বংশ। ছোটোবেলা থেকে বুড়োবুড়িদের কাছে শুনে আসছি যে
মহিষাসুর আমাদের মহিষদের মাঠ জঙ্গল নদী সব দিয়ে দিয়েছিল, তার বদলে শুধু মোষের
পালের পিছন পিছন যেতে বলেছিল। মহিষাসুরের কথা শুনতেই হয়, সবাই জানি সে রেগে গেলে
পাহাড়ের থেকেও বড়ো বুনো মহিষ হয়ে আসে। তার নিঃশ্বাসে আগুন বেরোয়, শিংগুলো গিয়ে
তারাতে ঠেকে। গোটা দলকে সে পায়ের তলায় পিষে মারবে। চিরটাকাল তাই আমরা মহিষরা মোষের
পালের পিছনে পিছনে যাই। বর্ষা থেকে শীত, এই সময়টা কাটাই
পাহাড়ের ওপারে, বাকিটা নদীর পাশে। কিন্তু অদিতিরাও তো মহিষ, ওরা যে মোষের দলের
পিছনে না গিয়ে এক জায়গায় থেকে গেল, মহিষাসুর কি সেটা দেখতে পায়নি? তা না হলে অদিতিরা
বেঁচে গেল কেমন করে?
অদিতিরা যে বর্ষায় নদীর ধারে থেকে
গিয়েছিল, তার পরের বসন্তে আমরা আবার ফিরে আসি এইখানে। আমার বড়ো ছেলে শুম্ভ তখন
পেটে। এসে দেখলাম অদিতিদের সঙ্গে কয়েকটা নেকড়েও যোগ দিয়েছে। নেকড়েদের সঙ্গে আমাদের
মহিষদের কোনোদিনই সদ্ভাব নেই। ওরা থাকত নদীর উলটো পারে। একবার নদী পেরিয়ে এসে একটা
জোয়ান মোষকে শিকার করেছিল। সেই নিয়ে আমাদের সঙ্গে ওদের তিনদিন যুদ্ধ হয়েছিল।
পাঁচজন মহিষ আর সাতজন নেকড়ে মারা যাওয়ার পরে নেকড়েরা নদী পেরিয়ে পালিয়ে যায়। সেই
নেকড়েদের সঙ্গে মহিষদের বন্ধুত্ব কেমন করে হয়?
প্রতিবার অদিতিদের দলটাকে
দেখি আর অবাক হয়ে যাই। ওরা মহিষাসুরকে আর মানে কিনা কে জানে! আমার তো মনে হয় ওরা
ঘাসকে পুজো করে -- সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত দেখি তার জন্যই কাজ করে যায়। যে ঘাসের
বীজের জন্য এত করে, তার আবার একটা নাম দিয়েছে – ধান গাছ। এক তো মাঠের পর মাঠ ধান গাছ
লাগিয়েছে। সারাক্ষণ সেই দিকেই নজর -- পাখি তাড়াচ্ছে, ধান গাছের
পাশ থেকে অন্য ছোটো গাছ উপড়ে দিচ্ছে, নদী থেকে জল তুলে এনে দিচ্ছে।
প্রতি বছর এসে দেখি নতুন নতুন জায়গায় ধানগাছ - তার জন্য এমনকি জঙ্গলেরও একটা দিক
কেটে পরিষ্কার করেছে। শিকারে যায় না বললেই হয়। খালি যে হরিণগুলো ওদের ধানগাছ খেতে
আসে, তাদের মেরে মাংস খায়। মোষের দলকে অবশ্য মারে না, তাড়িয়ে দেয় -- তা না হলে আমাদের
সঙ্গে লড়াই বেঁধে যেত। কোনও বুড়ো মোষ যখন আর হাঁটতে পারে
না, তখন তাকে মেরে তার মাংস খেলে মহিষাসুর কিছু মনে করে না। কিন্তু বাচ্চা কি
জোয়ান মোষের গায়ে আমাদের মহিষদের মধ্যে যদি কেউ হাত ঠেকাই, তাহলে তাকে শাস্তি পেতে
হবে। তা না হলে মহিষাসুর আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।
পরের দিন আমরা জঙ্গল থেকে
বেরিয়ে নদীর ধারে পা দেব। এবারে নতুন কী দেখব মহিষাসুরই জানে।
* * *
নদীর ধারে আমাদের পুরানো
জায়গা – সেখানে আমি আর শুক্র তাঁবু খাটাচ্ছি, এমন সময় শুম্ভ এসে বলল, “তোরা একটু
এদিকে আয়। ঝামেলা করছে।”
একটা লোক দেখি খুব চেঁচামেচি
করছে। আমি চিনি না যখন, নিশ্চয় নেকড়ে ছিল, অদিতির দলে ভিড়েছে। আমি
গিয়ে বলি, “কী হল?”
“তোরা আমার জায়গায় থাকতে
পারবি না। এখুনি চলে যা, না হলে জোর করে বার করে দেব,” লোকটা তড়পিয়ে বলে। শুম্ভ
মনে হল হাসি চাপছে। স্বাভাবিক। লোকটা আমার থেকেও বেঁটে, শুম্ভের পাশে একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো লাগছে - একবারেই না
খেতে পাওয়া রোগা চেহারা। সে নাকি আমাদের জোর করে বার করে দেবে!
“তোর জায়গা মানে? জমি কি তোর
আমার হয় নাকি? তুই তো এখানে ঘাস লাগাসনি যে আমরা এখানে থাকলে তোর ঘাস মরে যাবে।
তাহলে?” আমি অবাক হয়ে বলি। জমি তো মহিষাসুর সবাইকে দিয়েছে, কিন্তু কোনটা কার কী
করে বলব? আমরা যখন মরার পরে মাটির তলায় মহিষাসুরের রাজ্যে যাব, তখন কী জমি সঙ্গে
করে নিয়ে যেতে পারব নাকি?
“হ্যাঁ, এটা আমার জমি। আমি এখানে
ঘাস লাগাব কিনা, সেটা আমার ব্যাপার। তোদের এখানে থাকতে দেব না।”
“প্রতি বসন্তে আমরা এখানেই তাঁবু
গাড়ি। তুই বললেই হল এই জায়গা তোর? আমরা এখানেই থাকব। তুই যা পারিস করে নে।”
কিছুক্ষণ পরের কথা। আমি নদী
থেকে জল আনতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে একজন আমাকে ডাকল। দেখি অদিতি। কয়েক
বছর ওকে দেখিনি, ইচ্ছা করেই বোধহয় এতদিন আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এ কী চেহারা
হয়েছে! প্রথমে চিনতেই পারছিলাম না। ওর আর আমার বয়সের ফারাক আর কতটুকু, কিন্তু দেখে
মনে হচ্ছে ও যেন অনেক বড়ো। চামড়া ঝুলে
গেছে, অর্ধেক চুল উঠে গেছে, কুঁজো হয়ে হাঁটছে।
“দিতি, তোরা বৃকভানুর জায়গা
দখল করেছিস। অন্য জায়গায় যা।”
“প্রতিবারই তো আমরা ওই
জায়গাটাতেই থাকি। ওটা ওর হল কেমন করে? ও কি জায়গাটা বানিয়েছে?”
“গ্রামে নিয়ম হয়েছে কেউ যদি
কোনও জায়গা প্রথমে নিজের বলে নিয়ে নেয়, তাহলে অন্যরা আর তাকে না বলে সেখানে কিছু
করতে পারবে না। বৃকভানু নদীর ধারে ওই জায়গাটা নিয়েছে।”
“গ্রাম কাকে বলে?” আমি জানতে
চাইলাম।
“আমরা যেখানে থাকি, সেই জায়গাটাকে
বলি গ্রাম।” হ্যাঁ, ওরা তো এখন আর আমাদের মতো ঘুরে বেড়ায়
না। আমি দূর থেকে দেখেছি, ওরা কাদার তৈরি তাবুতে থাকে। দরকার মতো গুটিয়ে নেয়া যায় না,
সেরকম তাঁবু কী কাজে লাগে কে জানে?
“দেখ অদিতি, বৃকভানু তো
জায়গাটাকে নিজের বলার আগে আমাদের জিজ্ঞাসা করেনি। আমরা ওর কথা শুনব কেন?”
“দিতি, তোরা তো কোথাও বেশিদিন
থাকিস না - তোদের কাছে সব জায়গাই সমান। ওর জমিটুকু ছেড়ে দে।
তোরা সামনের ঝোরাটার পাশে চলে যা। ওই জায়গাটা কারোর নয়।”
“ঠিক আছে, তুই তো নিয়মটা
জানিস। আমি একা একা ঠিক করতে পারি না -- বাকিদের সঙ্গে কথা বলি।”
“আচ্ছা,” অদিতি একটু ইতস্তত
করে বলল, “যাবি নাকি আমার সঙ্গে, দেখবি আমি কেমন আছি?”
এত দিন কেটে গেছে বলেই বোধহয়
অদিতির সুর অনেক নরম। নাকি ও দেখাতে চায় আমাদের দলের থেকে বেরিয়ে গিয়ে ও কত ভালো
আছে? আমারও কৌতূহল হচ্ছিল, জলভরা ভারি চামড়ার থলিটা একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিলাম।
“চল।”
অদিতি বলল, “তোর ভিস্তিটা সঙ্গে
নিবি না? যদি কেউ নিয়ে নেয়?”
“এখানে তো আমরা মহিষরাই আছি।
যদি আমাদের মধ্যে কারোর দরকার হয়, নিয়ে যাবে। তাতে অসুবিধা কী?”
আমার দিকে কেমন অদ্ভুত চোখে
তাকাল অদিতি, তারপরে বলল, “চল তাহলে।”
বর্ষার জল যাতে না পৌঁছোয়,
সেজন্য অদিতিদের থাকার জায়গাটা নদীর থেকে একটু দূরে। হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “শ্রীকে
অনেকদিন দেখিনি।”
“ভালোই আছে। ওর ছেলেমেয়েরা
গ্রামের দক্ষিণদিকের অনেকটা জমিতে ধানগাছ লাগিয়েছে। শ্রী সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত
ওদিকেই থাকে, যে পাখিগুলো ধান খেতে আসে সেগুলোকে তাড়ায়।”
“আর তোর ছেলে?”
“কোন ছেলের কথা বলছিস?”
“মিত্রের কথাই তো জানি। তোর
কয় ছেলে?”
“আমার ছেলেমেয়ে মিলিয়ে মোট বারোজন।
আর মাটির তলায় রেখেছি আরও পাঁচজনকে।”
আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। “বারো
আর পাঁচ। মানে...” আঙ্গুলে গুনে হিসেব করি, “তেরো, চোদ্দ, পনেরো, ষোলো, সতেরো।
সতেরোটা বাচ্চা হয়েছে তোর? তার মধ্যে পাঁচটা মারা গেছে!”
“হ্যাঁ। আমাদের সকলেরই অনেক
ছেলেমেয়ে। ধানগাছের দেখাশোনা করতে সবসময়েই লোক লাগে।”
“তাহলে তোদের দলে এখন কত লোক
আছে?”
“তা বাচ্চা বুড়ো সব মিলিয়ে আট
কুড়ির বেশি। বাচ্চাই বেশি।”
অদিতিরা বেরোনোর আগে আমরা
ছিলাম সাত কুড়ি মহিষ। দেড় কুড়ি শীত পার করে তবে আমরা আবার তার কাছে পৌঁছেছি। অথচ
ওদের দলে প্রথমে ছিল দুই কুড়িরও কম। কয়েকটা নেকড়ে এসেছিল বটে। কিন্তু সে আর কজন!
এক কুড়ি হবে। “শ্রীর ছেলেমেয়ে কটা?”
“ওর ছেলেমেয়ে কম, মাত্র
পাঁচটা। তিন-চার বছরে একটা বাচ্চা হচ্ছিল। তাই তো ওর
খুব দুঃখ।”
অদিতির কথায় বুঝলাম ওদের
মেয়েদের বয়স হলে প্রায় প্রতি বছরই বাচ্চা হয়। তার অর্ধেকই বাঁচে না। তবু প্রতি
বছরই বাচ্চা হতে হয়!
অদিতির সঙ্গে গেলাম ও যেটাকে
গ্রাম বলছে সেই জায়গায়। কী বিচ্ছিরি গন্ধ! কুকুরগুলোর না খেতে পাওয়া চেহারা।
যেদিকে তাকাই বাচ্চাকাচ্চা, ধুলোকাদা মাখামাখি করে খেলছে।
বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। শরীর
খারাপ লাগতে শুরু করেছিল।
নিশুম্ভের কথা
“অদিতি
নেই?” দিতি বলল।
“না,
অদিতি নেই। শুধু অদিতি কেন, শ্রী, মিত্র, সরস্বতী এরাও মরে গেছে। তুই যাদের
চিনতিস, তাদের প্রায় কেউ বেঁচে নেই।” প্রতি বছর যখন পাহাড় পেরিয়ে আসি, দেখি গ্রামটা আরও বড়ো হয়েছে। কিন্তু এবার অদিতিদের কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম
না। শুম্ভকে অদিতির খোঁজে পাঠিয়েছিল দিতি, ওর কাছেই শুনছিলাম।
“কী
হয়েছিল?” ঠিকই, প্রতিবারই ওদের যেন আরও জবুথবু দেখতাম। খুব তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে
গিয়েছিল। কিন্তু তা বলে চারজনেই একই বছরে মরে যাবে?
“গ্রামের
কেউ জানে না। কিন্তু শীতের পরেই এক অদ্ভুত রোগ এসেছে। গায়ে গুটি
বেরোচ্ছিল। যাদের হয়েছে, তাদের অর্ধেক আর বাঁচেনি। বাকিদেরও মুখেচোখে এমন গর্ত
গর্ত হয়ে গেছে যে দেখলেই ঘেন্না পাবে। ওদের পুরুত বলেছে নাকি শাপ লেগেছে।”
এই
আর এক নতুন নাম গত কয়েক বছর ধরে শুনছি। পুরুত। ভাবতেই পারি না মহিষাসুরের কাছে আমার
কথা পৌঁছোতে গেলে নিজে বললে চলবে না, পুরুত বলে একটা লোক লাগবে!
“শুম্ভ,
সকলকে বল এখান থেকে আমরা দূরে কোথাও চলে যাব। ওদের ওপর মহিষাসুরের অভিশাপ লেগেছে। এখানে থাকলে
আমরা কেউ বাঁচব না,” দিতি বলল।
সূর্য
ডোবার আগে আমরা আমাদের তাঁবু গুটিয়ে নিলাম। যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালাম পুরানো
জায়গার দিকে।
* * *
আবার বর্ষার পর পাহাড় পেরিয়ে আসা। আমারও বয়স হয়েছে। ছোটোবেলাতে সেই প্রথমবার
যখন নদীটার ধারে নিজের পায়ে হেঁটে এসেছিলাম, পাহাড় পেরিয়েছিলাম যাদের সঙ্গে, তাদের সকলকেই
মহিষাসুর ডেকে নিয়েছে। গত শীতে দিতিও মহিষাসুরের কাছে চলে গেছে। চার
কুড়ি আটটা শীত দিতি দেখেছিল, আমাদের দলে কখনও কেউ এতদিন বাঁচেনি। শুম্ভ অনেক আগেই সাপের কামড়ে মরে গেছে। তার পরে পরেই
বাজপাখিদের সঙ্গে আমাদের লড়াই হয়েছিল। ওরা একটা জোয়ান মহিষকে মেরেছিল। যুদ্ধে
বাজপাখিদের হারিয়ে দিয়েছি আমরা, কিন্তু আটজন মহিষও মারা যায়। পুরানোদের মধ্যে আমিই শুধু পড়ে আছি।
দিতির কাছে শুনেছিলাম এই নদীর ধারে গ্রাম শুরু করেছিল দু’কুড়ি লোক, তাদের প্রধান ছিল অদিতি বলে একটা মেয়ে। আমি অদিতিকে ছোটোবেলায় দেখেছিলাম। দিতি
বলেছিল অদিতি নাকি ওর থেকে মাত্র কয়েক শীত বড়ো। কিন্তু আমি অদিতিকে যখন দেখেছি, এমন দেখতে হয়ে
গিয়েছিল যে দিতি মরার সময়েও ও রকম বুড়ো হয়নি। অদিতির অনেক ছেলেমেয়ে। বড়ো দুই
ছেলে মিত্র আর বরুণকে আমার মনে আছে। আর মনে আছে অদিতির বড়ো মেয়ে সরস্বতীর কথা।
অদিতি, মিত্র, সরস্বতী সবাই একই বসন্তে মহিষাসুরের অভিশাপে মারা গিয়েছিল। সে বছর অনেক লোককেই
মহিষাসুর টেনে নিয়েছিল। এমন নাকি হয়েছিল যে মাটিতে দেওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছিল না।
কিন্তু এখন আবার ওদের গ্রামে অনেক লোক। নেকড়ের দলটা আর নেই, অধিকাংশই এদের সঙ্গে
যোগ দিয়েছে। বাকি নেকড়েগুলো নাকি চলে গেছে, কোথায় কেউ জানে না।
শিকার তো এরা কবে ছেড়ে দিয়েছে। চারদিকের জঙ্গল কেটে ধানগাছ লাগিয়েও নাকি ওদের
খাওয়া জুটছিল না। তাই কিছু লোক কিছুটা দূরে আরও একটা গ্রাম বানিয়েছে। সেটার আবার একটা
নাম দিয়েছে, বরুণা। অদিতির ছেলে বরুণ নাকি এখানে প্রথম
এসে থেকেছিল। পুরানো গ্রামটাকে ওরা বলে পুর। প্রথম যখন এই রকম নাম শুনেছিলাম, খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। জায়গার আবার নাম হয় নাকি? এই যে আমরা তাঁবু খাটিয়েছি এই মাঠটাতে, এটাই আমাদের জায়গা। এই জায়গার যদি একটা নাম দিই, বর্ষার আগে আমরা যখন এখান থেকে চলে যাব, তখন কি নামটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব? কিন্তু এখন একটা কথা বলতেই হয়, পুর আর বরুণার
নাম দেওয়াতে দুটো গ্রামকে আলাদা করতে সুবিধা হচ্ছে।
আরও একটা কাজ ওরা করেছে। নদীটাকে এমন ভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছে যে জলটা বর্ষাকালে আর গ্রামগুলোতে বা ঘাসের খেতে
উঠে আসে না। তাই প্রতি বছর বর্ষার সময় গ্রামটাকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ে না।
ওরা বলে নদীতে বাঁধ দিয়েছে। নদীকে যে বাঁধা যায়, না দেখলে বিশ্বাস হত না। একটা বড়ো
হ্রদ মতো হয়েছে, তার থেকে আবার গর্ত কেটে জল খেতে ঢুকিয়েছে। যে এই পুরো কাজটা দেখভাল করেছে, তাকে আমি চিনি। বিশ্বকর্মা নাম তার।
দিতির পরে আমাদের দলের প্রধান হয়েছে নিকষা। ও আমাকে বলতে এসেছিল
কাল হরিণের ছাল নিয়ে বরুণাতে যাওয়া হবে। তার বদলে কী পাওয়া যায় দেখি। আমিও যেন
ওদের সঙ্গে যাই।
* * *
“তুই অদিতিকে দেখেছিস?” লোকটা
খুব অবাক হয়ে গেছে।
“হ্যাঁ। আমি তখন ছোটো।
প্রতিবছর তো আমরা এখানে আসি। তখন দেখা হত।”
লোকটা কেমন অদ্ভুতভাবে আমার
দিকে তাকাল। বলল, “তুই বরুণকেও চিনতিস?”
“চিনব না কেন? বরুণ আর আমি
একই বছর জন্মেছিলাম।”
“বরুণ আমার মায়ের বাবা।
কিন্তু আমি দেখিনি, আমার জন্মের আগেই দেবতাদের কাছে চলে গেছে। বরুণকে
চিনত এমন একজনও বেঁচে নেই।”
“দেবতারা কারা? বরুণ তো মরে
গেছে। মরার পরে আমরা তো মহিষাসুরের কাছে চলে যাই।”
লোকটা অবাক হয়ে আমার দিকে
তাকাল। বলল, “সে তোরা অসুররা যাস হয়তো। ভালো কাজ করলে, ঠিকমতো পুজো দিলে দেবতাদের
রাজা ইন্দ্র আমাদের ডেকে নেয়। পুজো আমরা সবাই দিই, ইন্দ্র রাগ করলে বৃষ্টিই হবে
না, তাহলে ধান জন্মাবে কেমন করে? ছাড় ওসব কথা, ও পুরুতের ব্যাপার।”
ওরা
তাহলে নিজেদের আর অসুর মনে করে না। সে যা পারে করুক, ওদের ভুল ভাঙানোর দায়িত্ব
আমার নয়। বরঞ্চ দেখি ছালটার বদলে কী পাই।
হরিণের ছালটায় হাত বুলিয়ে
লোকটা বলল, “দু’থলি ধানের বীজ দেব এটার বদলে।”
ঘাসকে ওরা বলে ধান। সব
কিছুই ধানের বীজ হিসাবে মাপা হয়। আমার একটা ছোটো ছুরি দরকার ছিল, কিন্তু পুরের কামার
ধান ছাড়া কিছু নেবে না। একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে, না হলে এত ঘাসের বীজ নিয়ে
আমি কী করতাম? “তিন থলি লাগবে।”
একটু না না করে লোকটা রাজি
হয়ে গেল। চলে যাওয়ার সময় ওর চোখ পড়ল আমি কোন জিনিসের উপর বসে আছি। বলল, “সিংহের
চামড়াটার জন্য কত নিবি?”
“এটা দেওয়ার নয়। আমি প্রথম
একা যে সিংহটাকে মেরেছিলাম, এটা তার চামড়া। এই চামড়া আমরা কাউকে দিই না, নিজের
নিজের কাছেই রাখি। মরার পরে এটা আমার সঙ্গে পুঁতে দেওয়া হবে। এটা পরেই তখন
মহিষাসুরের মুখোমুখি হব।”
বরুণা থেকে আসার সময় আবার
লোকটাকে দেখলাম। আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছিল আর আমার দিকে দেখাচ্ছিল। কয়েকটা
ছাড়া ছাড়া শব্দ শুনতে পেলাম। দানব, অসুর, জাদু, অমর, দৈত্য – এই রকম কয়েকটা কথা।
কী বোঝাচ্ছিল কে জানে? লোকটা বোধ হয় নিকষার মেয়ে জরার বয়সি, কিন্তু দেখে নিকষার
থেকে বড়ো মনে হচ্ছে। ওহো, জরার কথায় মনে পড়ে গেল। জরার মেয়ে তাড়কার জন্য একটা কড়ি
আর লাল পাথরের মালা নেব। আবার পিছন ফিরলাম।
মারীচের কথা
“দিদিমা, কেকশী,” আমি চিৎকার
করে ডাকি, “কোথায় তুই?”
“কে ডাকিস?” তাঁবুর ভিতর থেকে
কেকশী সাড়া দিল।
“আমি, মারীচ। বাইরে আয়, খুব
দরকার।”
“দাঁড়া রে বাবা। বয়স হয়েছে,
এখন কি আর দৌড়োদৌড়ি করতে পারি?” কেকশী আস্তে আস্তে বাইরে এল, “কী হয়েছে?”
“আমাদের থাকতে দেবে না বলছে।”
“কে বলছে? কোথায় থাকতে দেবে না?
একটু আস্তে আস্তে বল।”
আমি একটু দম নিয়ে বলতে শুরু
করলাম। আগামীকাল আমাদের বসন্ত কাটানোর জায়গায় পৌঁছোনোর কথা। কিন্তু একটু আগে পাঁচটা
লোক এসেছে গ্রাম থেকে, বলছে এবার ওরা আমাদের ওদের জায়গায় থাকতে দেবে না।
“থাকতে দেবে না! কেন? ওদের
জায়গা মানে কী?”
“তা আমি জানি না। বলছে আমরা
নাকি চোর, ফসলের ক্ষতি করি, ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যাই।”
“চল দেখি।”
গ্রামের লোকগুলো অপেক্ষা
করছিল। কেকশী গিয়ে সামনে দাঁড়াল, বলল, “হ্যাঁ রে, তোরা নাকি বলছিস আমাদের ঢুকতে
দিবি না?”
“এই বুড়িটা কে? তোদের মোড়ল
কোথায়? তাকে আসতে বল,” ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে বুড়ো সে বলল।
“মুখ সামলে কথা বল। আমি
তাড়কার নাতনি, সিংহিকার মেয়ে কেকশী। মোড়ল মানে কি জানি না। মহিষদের যা বলতে চাস,
আমাকেই বল,” কেকশী অতি কষ্টে রাগ সামলে রেখেছে।
“শোন তবে। আমরা সাবধান করে
দিতে এসেছি। কোনও গ্রামের লোক তোদের চায় না। তোরা এখুনি এখান থেকে চলে যা।”
“আমরা যাব কি না যাব তোরা
বলার কে?”
“আমাদের জায়গায় কাকে থাকতে দেব
কাকে দেব না আমরা ঠিক করব। তোরা যেখানে তাঁবু গাড়িস, সেখানে এবার ধান চাষ করব আমরা।”
আমি বললাম, “এত তো জায়গা পড়ে
আছে। বন কেটে তো উজাড় করে দিয়েছিস। সেখানে চাষ কর না, কে বারণ করছে?”
“বড়োদের মাঝে কথা বলিস না।”
এবার আমার রাগ হতে লাগল। “আমার
মনে হলে আমি বলব। তুই আমাকে বারণ করার কে? তোর নাম কী?”
“আমি পুর গ্রামের মোড়ল, আমার
নাম কশ্যপ। আমার কথা না শুনলে ভুগতে হবে, এই সাবধান করে দিলাম। চোরদের আমরা
ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেব না।”
“কী চুরি করেছি আমরা?” আমিও
গলা চড়িয়ে বলি।
“তোরা আমাদের সব গাছের ফল
চুরি করে খেয়ে নিসনি গতবার?”
“গাছ তোদের হয় কেমন করে?
মহিষাসুর গাছ দিয়েছে, তাতে ফল হয়েছে। সেগুলো যে পেড়ে নেবে তার। চিরকাল আমরা এই
কথাই জানি,” কেকশী বলল।
“বাজে কথা রাখ। আমার জমিতে যে
গাছ হয়েছে, তার সব কিছু আমার।”
“তোর জমি মানে কী? তুই
বানিয়েছিস?”
অনেকক্ষণ ধরে তর্ক চলল। ওরা
আমাদের কোনও কথাই শুনতে রাজি নয়। দু’বছর আগে ওদের গ্রামের একটা ছেলে শিশুপাল
আমাদের সঙ্গে চলে এসেছিল। কশ্যপের ধারণা আমরা ওকে জাদুতে ভুলিয়ে ধরে রেখেছি। সত্যি
বলছি আমরা কোনও জাদু করিনি। ও নতুন নতুন জায়গা দেখতে ভালোবাসে বলে আমাদের সঙ্গ
ধরেছিল। শিশুপালকে ডেকে কশ্যপকে দেখালাম, “ওকেই জিজ্ঞাসা কর আমরা কোনও জাদু করেছি
কিনা?”
“ও কী আর বলতে পারবে!
শিশুপাল, তুই আমাদের সঙ্গে চল। বাড়ি ছাড়ার আগে তোর বাবা-মায়ের কথা একটুও ভাবলি না?”
শিশুপাল রাজি নয়, ও আমাদের
সঙ্গেই থাকতে চায়। কশ্যপ ওর একটা হাত ধরে টেনে নিতে শুরু করল। এবার কেকশী খুব রেগে
গেল। বলল, “হাত ছাড় ওর। ওকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার তুই কে? ও তো নিজেই আমাদের সঙ্গে
থাকতে চেয়েছে।”
কশ্যপ বলল, “ওর বাবা-মা ওকে ফেরত
নিয়ে যেতে বলেছে।”
কেকশী বলল, “শিশুপাল বড়ো
হয়েছে, নিজেই ঠিক করতে পারে কী করবে।”
এতক্ষণ কশ্যপের সঙ্গীরা কোনও
কথা বলছিল না। কশ্যপ ওদের দিকে একটা ইঙ্গিত করল, সঙ্গে সঙ্গে বাকি চারজন এগিয়ে এসে
শিশুপালকে ধরল। আমার খুব রাগ হয়ে গেল। আমি ওদের মধ্যে একটা লোকের চোয়ালে জোরে ঘুষি
মারলাম। গ্রামের লোকগুলো এমনিই কমজোরি হয়, সে শিশুপালকে ছেড়ে চোয়ালে হাত দিয়ে বসে
পড়ল। বাকি তিনজন আমার দিকে ফিরল। ওদের কোমরে ছুরি ছিল, একজনের সঙ্গে বল্লমও ছিল, কিন্তু
সে সবে হাত দেওয়ার সময়ই দিলাম না। শুধু একটা বর্শা দিয়ে সিংহ শিকার করেছি আমি, কতগুলো
কাদাঘাঁটা লোক আমার সঙ্গে পারবে কেন? খালি হাতই যথেষ্ট, কয়েক মুহূর্ত পরেই তিনজনই
মাটিতে পড়ে রইল।
কশ্যপ ভয়ে পিছিয়ে গেছে,
কিন্তু আমার মাথায় তখন রক্ত উঠে গেছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর ঘাড় ধরলাম। বিড়বিড় করে কী
সব বলছিল, আমি কোনও কথা না শুনে ওকে মাথার উপর তুলে ধরলাম। আমাদের সবকটা তাঁবু
ছেড়ে গিয়ে ওকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ওর খুব একটা লাগেনি, ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল।
এর মধ্যে আমাদের দলের আরও লোক এসে গেছে। তারা দেখলাম বাকি লোকগুলোকে টানতে টানতে
নিয়ে আসছে। ওদের ছুরি আর বল্লম কেড়ে নিয়েছে। সবগুলোকে ধাক্কা মেরে কশ্যপের পাশে
পাঠিয়ে দেওয়া হল।
আমি বললাম, “আমরা আগের
জায়গায়ই যাব, দেখি তোরা কী করতে পারিস।”
* * *
আবার বর্ষা এসেছে, মহিষের দল
পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে। আমাদের এই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।
কশ্যপের সঙ্গে গণ্ডগোলের পর
থেকে সব গ্রামের লোকরা আমাদের এড়িয়ে চলেছে। আমরাও কোনও গ্রামে যাইনি। শিশুপালের
বাবা-মা ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল, শিশুপাল যায়নি।
পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে চিরকাল
আমরা মহিষের দলের পিছনে যাচ্ছি। কিন্তু মহিষের সংখ্যাও অনেক কমে এসেছে। অনেক অনেক
বছর আগে নাকি মহিষের দলের শেষ দেখা যেত না। এখন দুই কুড়ি কুড়ির বেশি নেই। বেশি
মহিষ এখানে থাকতই বা কোথায়? প্রতি বছর যখন আসি, দেখি পাহাড়ের এপারে বন আরও বেশি বেশি
কেটে ফেলছে গ্রামের লোকজন। সেই জায়গাগুলো বেড়া দিয়ে ঘিরে ধান চাষ করেছে। কেকশী বলে
ও জরার কাছে শুনেছে এখানে আগে দুটো মাত্র গ্রাম ছিল, পুর আর বরুণা। এখন সেখানে
আটটা গ্রাম। নদীর ওপারেও আরো দুটো গ্রাম হয়েছে, সেখানেও চাষ শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে
যে কত মানুষ থাকে গুণে
শেষ করা যাবে না। অতগুলো লোক সকাল থেকে রাত ধানগাছের পিছনে পড়ে আছে! কাদা ঘেঁটে কী
আনন্দ পায় ওরা?
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে ওদের
বাচ্চাগুলোকে দেখলে। অধিকাংশই না খেতে পাওয়া চেহারা। তবু প্রতি বছর ওদের মেয়েদের
বাচ্চা হয়। এই রকম দুর্বল চেহারার বাচ্চা আমাদের দলে একটা শীতও টিকবে না। গতবছর
দেখেছিলাম একটা ছেলেকে, তার জন্ম থেকেই একটা হাত চলে না। এই ছেলেটা কোন কাজে লাগবে? এই রকম
কিছু দেখলে আমরা তাকে জন্মের পরেই জঙ্গলে ফেলে আসি। মহিষাসুর তাকে নিজের কাছে টেনে
নেয়।
জিনিসপত্র
গোছাচ্ছি, এমন সময় হয়গ্রীব দৌড়োতে দৌড়োতে এল। “এখুনি আয়? কেকশী ডাকছে।”
“কী
হয়েছে?”
“একটা
জোয়ান মহিষকে মেরে ফেলেছে।”
“সে কী?
কে মেরেছে?”
“পুরের
কয়েকটা লোক।”
আমাদের
দলের অনেক লোক জমা হয়েছে। কেকশী বলল, “চল, এখনই গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলি। এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার। মহিষাসুরের রাগ
কমাতে হবে! তা না হলেই সর্বনাশ।”
আমাদের
দল বেঁধে আসতে দেখে পুরের বাসিন্দারাও অনেকে বেরিয়ে এসেছে। কেকশীর বড়ো ছেলে খর ছিল
আমার পাশে। বলল, “মনে হচ্ছে ওরা গণ্ডগোলের জন্য তৈরি।”
ঠিকই
বলেছে। সকলের হাতেই অস্ত্র - তলোয়ার, বল্লম, তীরধনুক। সবার আগে কশ্যপ। দেখলাম একটা
মেয়েও নেই তাদের মধ্যে। সারাক্ষণ গ্রামের আশেপাশে বাচ্চাদের দেখতে পেতাম, তারাও আর
নেই।
“কশ্যপ,”
কেকশী বলল, “তোদের লোক একটা মহিষকে মেরেছে। তাদের শাস্তি দিতে হবে। মহিষ মারার একমাত্র
শাস্তি মৃত্যু। তোরা ব্যবস্থা নিবি, না আমাদের হাতে ছেড়ে দিবি?”
“তাতে
হয়েছেটা কী? আমাদের ধানের খেতে ফসল খেতে এসেছিল। বেড়া ভেঙে ঢুকেছে। আমরা হরিণ
মারি, শুয়োর মারি, সেই রকম মোষও মেরেছি। তোরা হরিণ মেরে মাংস খাস না?”
“জানিস
না মহিষ আমাদের কাছে পবিত্র? তোরাও তো আমাদের মতোই মহিষ। মহিষাসুর রেগে গেলে কী হয় তা জানিস?”
“ঐ সব
ছেলেভুলানো গল্প অন্যদের বলিস। আমরা কোনোদিন তোদের মতো মোষের দলের পিছনে পিছনে
ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম না। আমরা মা অদিতির সন্তান, আমাদের দেবতা ইন্দ্র। তার অস্ত্র
বজ্র। তার সঙ্গে কোনও অসুর পারবে না।”
“মহিষাসুরের
নিন্দা করিস না। ভালো হবে না। শেষবারের মতো বলছি, যে মেরেছে তাকে আমাদের হাতে তুলে
দে,” কেকশী বলল।
আমার
দিকে আঙুল তুলে কশ্যপ বলল, “সেদিন জাদুর বলে আমার চারজন প্রহরীকে হারিয়ে দিয়েছিলি
বলে ভেবেছিস যা খুশি করবি? শোন ডাইনি বুড়ি, তোর জাদু এখানে খাটবে না। এই গ্রামকে
ইন্দ্র রক্ষা করছে।”
কেকশী
বলল, “তোদের শেষ করতে আমাদের জাদু লাগে না। আমরা একজন জোয়ান ছেলে বা মেয়েকে বেছে
নিচ্ছি। মহিষটাকে যে মেরেছে, তাকে বল তার সঙ্গে খালি হাতে কিংবা তলোয়ার নিয়ে লড়াই
করতে। যদি সে জিতে যায়, তাহলে বুঝব মহিষাসুর আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।”
পিছন
থেকে একটা জোয়ান ছেলে এগিয়ে এল। কাশ্যপকে বলল, “বাবা, অনেকক্ষণ ধরে ডাইনি বুড়িটার কথা
শুনছি। এবার আমাকে বলতে দাও।” আমাদের দিকে ফিরে বলল, “আমি মেরেছি মোষটাকে। কী করবি তোরা?”
“শাস্তি
তোকে পেতে হবে। বল কার সঙ্গে লড়াই করবি, ছেলে না মেয়ে?”
লোকটা
আমাদের সবার দিকে একবার তাকাল। বলল, “মেয়েরা আবার লড়াই করতে জানে নাকি?” তারপর আমার
সামনে এসে বলল, “তুই আগের দিন চারটে বুড়োকে হারিয়ে নিজেকে খুব বড়ো ভেবেছিস না?
দেখি তোর তলোয়ারের দৌড় কত। লড়লে তোর সঙ্গেই লড়ব।”
কেকশী
মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে, তুই মারীচের সঙ্গেই যুদ্ধ কর।”
কশ্যপ
এসে ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। “পূষণ, তুই জানিস না। ওটা মানুষ
নয়, সাক্ষাৎ দৈত্য। আমাকে মাথার উপর তুলে ধরেছিল যেন আমি একটা পালকের বস্তা। ওর সঙ্গে তুই
পারবি না। অন্য কাউকে বেছে নে।”
“দৈত্য
তো কী? আমার মতো তলোয়ার চালাতে আর কে পারে এই আটটা গ্রামে? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো,
দৈত্য হোক, পিশাচ হোক, রাক্ষস হোক, আজই ওর শেষ দিন।”
বাকিরা
সরে সরে আমাদের জন্য একটা গোল মতো জায়গা করে দিল। আমি কোমর থেকে তলোয়ারদুটো
খুললাম। পূষণ আমার সামনে জায়গা নিল। ডান হাতে তলোয়ার, বাঁ হাতে কাঠের উপর চামড়া দিয়ে মোড়া একটা
ঢাল। ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি।
* * *

বাঁ
বাহুতে তলোয়ারের কোপ বসেছিল। গভীর নয়, রক্তও বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু হাতটা এখন ক’দিন ব্যবহার করতে
পারব না।
শুক্র
লতাপাতা দিয়ে ক্ষতটা বাঁধছিল। বলল, “পূষণ বলে লোকটা যদি জানত ও আমাদের সেরা তলোয়ারবাজের
মুখোমুখি হচ্ছে? যদি তোকে না বেছে অন্য কাউকে বাছত? কেকশী কি তাহলে তার সঙ্গে লড়তে
দিত?”
“সবই
মহিষাসুরের ইচ্ছা। তা না হলে কশ্যপের সঙ্গে আমারই গণ্ডগোল লাগবে কেন? পূষণ জানত ওদের লোকদের কে
হারিয়েছে; তাকে মেরে বীর হওয়ার চেষ্টা ওর কাছে স্বাভাবিক। তবে মহিষ যখন ও মেরেছিল, মহিষাসুর ওকে শাস্তি দিতই - সেটা আমার
হাত দিয়ে হয়েছে। আমার জায়গায় তুই থাকলেও একই হত। আর এই কাদাঘাঁটা নোংরাঘাঁটা লোকগুলো যুদ্ধের জানেটা কী?
সারাদিন তো শুধু ধানের খেতে বসে পাখি তাড়ায়।”
শুক্র
মাথা নেড়ে বলল, “তোদের দু’জনের মতো অস্ত্র চালানো আমি আগে কখনও দেখিনি। তুই নিশ্চয় পূষণের থেকে
ভালো, কিন্তু আমাদের অন্য কেউ ওর সঙ্গে পারত না। ও যখন শেষকালে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল,
তোর মনে হয়নি ওকে ছেড়ে দিই?”
“কেন
মনে হবে? আমাদের নিয়মই তো আছে, জোয়ান মহিষ মারলে তার শাস্তি মৃত্যু। আমি যদি ওকে ছেড়ে দিতাম, তাহলে মহিষাসুর আমার উপর রাগ
করত না?”
আমাদের যাওয়ার
সময় হয়েছে। শুক্র আমার পিঠে বোঝাটা বেঁধে দিল। আমি ডানহাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পূষণ তার পাপের উচিত শাস্তি পেয়েছে। গ্রামের লোকদের উপর আমার আর কোনও রাগ নেই। আমার কেন, কোনও মহিষেরই
নেই। ওদেরও সেটা বোঝা উচিত। দূর থেকে পুর গ্রামটাকে একবার দেখে নিলাম। একটা লোককেও দেখতে পেলাম
না। এই প্রথম দিনের বেলাও ধানের খেতে কেউ কাজ করছে না।
এখান
থেকে যাওয়ার সময় আমরা প্রথম দিন যেখানে তাঁবু গাড়ি, সেই জায়গায় পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে
গেল। সকলেই ভীষণ ক্লান্ত, তাড়াতাড়ি তাঁবুর ভিতরে ঢুকে পড়ল। আমিও ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।
সবসময়ই
বুনো জন্তুদের ভয় দেখাতে মাঝখানে আগুন জ্বেলে রাখা হয়, প্রহরীও থাকে। তার চিৎকারেই ঘুম ভেঙে গেল। তলোয়ারটা হাতে করে তাঁবুর
বাইরে এলাম। ঘুমচোখে প্রথমে বুঝতে পারিনি। তারপরেই বুঝলাম, একদল লোক আমাদের আক্রমণ করেছে।
কিন্তু
কারা? বাজপাখিরা তো এদিকে আসে না। শুনেছিলাম অনেক অনেকদিন আগে এখানে একদল নেকড়ে ছিল। কিন্তু তাদের তো আর খুঁজে
পাওয়া যায় না। তাহলে কারা? অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। প্রহরীরা প্রথমেই আগুনটা নিভিয়ে দিয়েছে, না হলে আগুনের
সামনে এলেই তীরের বা বল্লমের লক্ষ্যে পড়তাম।
অন্ধকারের
মধ্যেই লড়াই করছি। একটা ছায়ামূর্তি সামনে এল, আমার দিকে বল্লম দিয়ে খোঁচা মারল, পাশ কাটিয়ে
তলোয়ার চালালাম। তলোয়ারটা কিছুতে আটকাল, লোকটাও আর্তনাদ করে পড়ে গেল। তার জায়গা নিল আরও একটা। তারও কাঁধে একটা গভীর কোপ বসালাম। এবার আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। এভাবে কতক্ষণ লড়াই করা যায়?
তাও আমার বাঁ হাতটা অচল। এক ফাঁকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝলাম,
আমাদের সকলেরই এক অবস্থা। যে ক’জন দাঁড়িয়ে আছি, প্রত্যেককেই
তিন-চারজনের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। একে একে সবাই মাটিতে পড়ছে।
পিছোতে
গিয়ে কিছু একটাতে পা আটকে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। বুঝলাম একটা মৃতদেহের উপর
পড়েছি। উঠে বসার চেষ্টা করলাম। বুকে একটা লাথি আমাকে
শুইয়ে দিল। একটা পা এসে তলোয়ার সমেত ডান হাতটা চেপে ধরল। কবজির হাড়টা মট করে ভেঙে গেল।
“আমার
ছেলেকে মারার প্রতিশোধ এভাবেই নিলাম।”
কশ্যপের
গলা। কিন্তু এতগুলো লোক এল কোথা থেকে? শুধু পুরের লোকের তো ক্ষমতা হবে না তিন কুড়ি
মহিষের টক্কর নেওয়ার, তা সে যতই আচমকা আক্রমণ করুক না কেন।
কশ্যপ
বলল, “নে আগুন লাগা, ছাই করে দে।” একটার পর একটা আগুন জ্বলে উঠল। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম আমাদের তাঁবুগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছে। আগুনের আলোতে এবার
দেখতে পেলাম আক্রমণকারীদের মুখ। শুধু পুর নয়, সব গ্রামেরই মানুষ মনে হয় আছে ওদের
মধ্যে। কত লোক এসেছে গুণতে পারছি না, আর আমরা
বাচ্চা জোয়ান বুড়ো মিলে তিন কুড়িরও কম। একজনের সঙ্গে একজনের যুদ্ধে আমরা নিশ্চয়
জিততাম, কিন্তু এই কাদাঘাঁটা ভীতু লোকগুলো সেভাবে লড়বে ভাবাটাই আমার ভুল। মহিষাসুরের
সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার সময় এসেছে। তাকে বলব, তুমিই এর প্রতিশোধ নিও।
কশ্যপ
হাতের তলোয়ারটা উঁচিয়ে ধরল। “পূষণের কাছে পাঠালাম তোকে।”
অসুরযুদ্ধের
কথা
“কী
শুনবি আজ?”
“অসুরদের
কীভাবে কশ্যপ হারিয়েছিল সেই গল্পটা বলো,” একজন বলে।
“হ্যাঁ,
হ্যাঁ। দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধের গল্প বলো,” আরও কয়েকজন সায় দেয়।
“ঠিক
আছে, শান্ত হয়ে বস।
“অনেকদিন
আগে দুই বোন ছিল, দিতি আর অদিতি। দিতির সন্তানরা হলো দৈত্য। তারা ধর্ম মেনে চলত
না। তারা জাদু জানত। ইচ্ছামতো রূপ ধারণ করতে পারত। মোষের রূপ ধরে এসে তারা মানুষের
খেত উজাড় করে খেয়ে নিত। দৈত্যরা জাদু জানত বলে তাদের মেরে ফেলা যেত না। তারা
নিজেদের বলত অসুর।
“অদিতির
সন্তানদের বলা হত আদিত্য। তারা সবাই ধর্মপথে থাকত। দেবরাজ ইন্দ্রকে উপাসনা করত।
অদিতির ছেলে ছিল মিত্র, বরুণ আর বিশ্বকর্মা। অদিতির মেয়ের নাম ছিল শ্রী। আদিত্যরা
দেশে ধর্মরাজ্য স্থাপন করেছিল। সেখানে সবাই সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত। মিত্র
ছিল রাজ্যের রাজা।
“অদিতির
ছেলেমেয়েদের প্রজারা সবাই ভালোবাসত দেখে দিতির খুব হিংসা হত। একদিন দিতি নিজের
বোনকেই অভিশাপ দিল যে সে আর তার ছেলেমেয়ে সবাই বসন্ত রোগে মরে যাবে। অদিতি আর
ছেলেমেয়েদের সকলের রোগ হল। শ্রী, মিত্র আর অদিতি মারা গেল। তখন বরুণ আর বিশ্বকর্মা
ইন্দ্রের তপস্যা করল। ইন্দ্র খুশি হয়ে দুই ভাইকে রোগমুক্ত
করলেন। বরুণ মিত্রের জায়গায় সিংহাসনে বসল।
“বরুণ
রাজা হয়ে অসি নদীর তীরে একটা নগর স্থাপন করল। সেখানে দেবরাজের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে
একটা বিশাল মন্দির বানাল। তাকে সাহায্য করেছিল বিশ্বকর্মা। অসুররা দেখল বিপদ, ইন্দ্রের
কৃপা থাকলে তো এদের হারানো যাবে না। তখন তারা জাদুবলে অসি নদীকে ঘুরিয়ে মন্দিরের দিকে
পাঠিয়ে দেয়। বরুণ আর বিশ্বকর্মা দু’জনে মিলে একরাতের মধ্যে নদীতে বাঁধ দিয়ে মন্দির
আর নগরকে বাঁচায়। মন্দির রক্ষা করেছে বলে ইন্দ্র খুশি হয়ে এদের দুজনকে দেবতা
করে দিলেন।
“বরুণের
পরে রাজা হল তার ছেলে কশ্যপ। কশ্যপের ছেলের নাম পূষণ। পূষণ ছিল রূপে গুণে
অস্ত্রচালনায় অতুলনীয়। রাজ্যের সবাই তাকে খুব
ভালোবাসত।
“অসুরদের
মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল মারীচ। সে পূষণকে দেখে হিংসায় জ্বলে মরত। কিন্তু সামনাসামনি
যুদ্ধে পূষণকে যে হারাতে পারবে না সেটা সে জানত। তাই ডাকিনী কেকশীকে গিয়ে সে বলল,
পূষণকে কেমন করে হারানো যায়? কেকশী মন্ত্র পড়ে মারীচকে অদৃশ্য করে দিল। মারীচ তখন
পূষণকে হত্যা করল।
“পূষণের
মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে কশ্যপ ক্রোধে আগুন হয়ে গেল। সে একাই দৈত্যদের পুরী আক্রমণ করল।
দৈত্যপুরীর দ্বার এক আঘাতে ভেঙে ফেলল কশ্যপ। যত দৈত্য সামনে এল, একে একে সবাই তার
অস্ত্রাঘাতে মারা গেল। অবশেষে মারীচ কশ্যপের মুখোমুখি হল। কিন্তু পুত্রহারা পিতার
ক্রোধের তেজ সে সহ্য করতে পারল না। তাকে হত্যা করেও কশ্যপের রাগ কমল না। তার
ক্রোধে পৃথিবী ভস্ম হয়ে যায় যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাকে বললেন, ক্রোধকে মুষ্টিতে
নিয়ে দৈত্যদের প্রাসাদে ছুঁড়ে মারো। কশ্যপ তাই করল। মুহূর্তে দৈত্যপুরীতে আগুন লেগে গেল। একজন
দৈত্যও আর রক্ষা পেল না।”
_____
ছবিঃ পার্থ
মুখার্জী
No comments:
Post a Comment