
জাটুগঞ্জের
জাদুকর
কৃষ্ণেন্দু
দেব
।। ১ ।।
ভূতনাথ ছোটো থেকেই খুব ডাকাবুকো
প্রকৃতির। মনে ভয়-ডর বলে কিছু নেই। উলটে লোককে ভয় দেখাতে ভালোবাসে
খুব, বিশেষ করে ভূতের ভয়। সেই
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ভূতনাথের এই বদভ্যাস। ক্লাসের
বন্ধুদের বানিয়ে বানিয়ে এমন ভূতের গল্প শোনাত যে তারা রাত্রিবেলা বাথরুমে যাওয়ার
সাহস পেত না, ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে থাকত। শুধু গল্প বলে নয়, ভূত সেজেও ভূতনাথ
অনেকবার বন্ধুদের ভয় দেখিয়েছে। একবার তো রাত্রিবেলা সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে পটলার
ঘরের জানলার সামনে এমন অঙ্গভঙ্গি করেছিল যে পটলা বেচারি অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিল।
এহেন ভূতনাথ অবশ্য আর ছোটোটি নেই, রীতিমতো জোয়ান হয়েছে, চাকরিও করছে একটা ট্র্যাভেল
এজেন্সিতে - মিতালী ট্যুর অ্যান্ড ট্র্যাভেলস। ভারতের বেশ কিছু
জায়গায় ঐ কোম্পানির নিজস্ব হোটেল আছে। ইদানীং ওদের এজেন্সির খুব নামডাক, প্রচুর লোক বেড়াতে যাচ্ছে ওদের সঙ্গে। ফলে কাজের চাপও বেড়ে গেছে অনেকটা।
খাটনি যাই হোক,
চাকরিটা কিন্তু ভূতনাথের খুব পছন্দের। এই কোম্পানিতে ঢোকার পর যে কত নতুন জায়গায় ওর ঘোরা হয়ে গেল! আসলে অচেনা অজানা জায়গা দেখার আনন্দই আলাদা। ভূতনাথের বাবা একটা জুট মিলে কাজ করতেন। মাঝেমধ্যেই আবার সেই মিলে লক আউট হয়ে
যেত। সংসারে তখন সারা বছরই টাকা-পয়সার টানাটানি। ভূতনাথের তাই ছোটোবেলায় কোনোদিন বেড়াতে যাওয়া হয়নি। আর এই কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পর দু’বছরও হয়নি, ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের প্রায়
অর্ধেকটা ওর ঘোরা হয়ে গেছে। মালিক শম্ভু মাইতি ওকে খুব পছন্দ করে। যে সমস্ত ট্যুরিস্ট পার্টি নিয়ে ভূতনাথ বার
হয়, সেই দলের সবাই নাকি বেড়িয়ে আসার পর ভূতনাথের দারুণ
প্রশংসা করে। আর ট্যুরিস্ট পার্টি খুশি হলে মালিক তো খুশি হবেই। এতে ব্যবসা বাড়ে যে।
কোম্পানিতে ভূতনাথের তাই পদোন্নতিও হয়েছে বেশ দ্রুত। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
বেড়েছে দায়িত্বও। তাই এখন একদল পর্যটক নিয়ে শুধু পাহাড় বা সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোই নয়, মালিকের নির্দেশে
ইদানীং ওকে অফ সিজনে নতুন কোনও
জায়গায় গিয়ে, সেটা ট্যুরিস্ট স্পট করা যায় কিনা তাও যাচাই করে আসতে হচ্ছে।
এই কাজটা ঝামেলার হলেও ভূতনাথের খুব পছন্দের। কারণ একটা আনকোরা জায়গায় গিয়ে
সেখানকার পরিবেশ, দর্শনীয় স্থান আর সুবিধা-অসুবিধা
সবকিছু ঘুরে দেখার মজাটাই আলাদা। ভূতনাথের তখন মনে হয় ও যেন জায়গাটা নতুন করে আবিষ্কার করছে।
ঝাড়খন্ডের উত্তরে জাটুগঞ্জ। এক
সারি ছোটো পাহাড়, ঝরনা, জঙ্গল, আর একটা নদী - সব মিলিয়ে জায়গাটা নাকি বেশ সুন্দর। ওখানে একটা বিশাল বাংলোও আছে। সেটা যদি
লিজ নেওয়া যায়, তাহলে জাটুগঞ্জকে বেড়ানোর একটা নতুন
জায়গা হিসাবে তুলে ধরতে বিশেষ অসুবিধা হবে না। শম্ভু মাইতি কোনোভাবে এই খবর পেয়ে
ভূতনাথকে দায়িত্ব দিল সরেজমিনে স্পটটা দেখে
আসতে।
ভূতনাথের তো দারুণ মজা। পরদিন বিকালেই ও পৌঁছে গেল জাটুগঞ্জ। বাংলোর মালিক রামলাল গুপ্তার খোঁজ করতে গিয়ে ভূতনাথের দেখা হয়ে গেল দূর-সম্পর্কের এক পিসেমশাইয়ের সঙ্গে। ভদ্রলোকের
নাম শিবনাথ সমাদ্দার।
ওখানে বছর পনেরো আছেন, একটা কোম্পানির
অ্যাকাউন্টসের কাজকর্ম দেখাশোনা করেন। ভদ্রলোকের
নিজের বাড়ি বসিরহাটে। বছরে দু’বার যান সেখানে।
দীর্ঘদিন জাটুগঞ্জে আছেন বলে, শিবনাথ গুপ্তাজিকে ভালোই চেনেন। ভূতনাথ
তাই পিসেমশাইয়ের কাছে আবদার করল, “আমাকে
গুপ্তাজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও।” কিন্তু শিবনাথ ভূতনাথকে নিরুৎসাহ করলেন। বললেন, “গুপ্তাজি
এখন ব্যাবসার কাজে গুজরাট গেছেন, তাই ওঁর
সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। তাছাড়া এই মুহূর্তে বাংলোটা গুপ্তাজি লিজ দিতেও পারবেন
না। কারণ ওঁর বাবার আমলের দু’জন লোক
কিছুতেই বাংলোটা ছাড়তে চাইছে না। ওদের না উঠিয়ে তো আর বাংলোটা ভাড়া দেওয়া যায় না।”
তারপর একটু থেমে শিবনাথ বললেন, “জানিস ভূতনাথ, এই জাটুগঞ্জ জায়গাটা কিন্তু বিশেষ সুবিধার
নয়। আমি নেহাত পেটের দায়ে এখানে পড়ে আছি। তাছাড়া এখানে ঘুরে দেখবারই বা কী আছে? একটা ছোটো ঝরনা আর একটা শুকিয়ে যাওয়া
নদী। এরকম জায়গা তো ঝাড়খণ্ড আর বিহারে ভুরি ভুরি
আছে। তাই আমার মনে
হয় না, এটা ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে
জনপ্রিয় হবে বলে। তুই মালিককে বল, অন্য কোনও জায়গার খোঁজ করতে। আরে, গুপ্তাজি তো নিজেও এখান থেকে ব্যাবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। এখন আর উনি
খুব একটা জাটুগঞ্জে
আসেনও না। বাড়ির লোকেদের সব ইউ পি-তে মানে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে তাই বাংলোটা লিজ নিয়ে একগাদা টাকা ইনভেস্ট না করাই ভালো।”
সেদিন রাত্তিরে খেতে বসে ভূতনাথ পিসেমশায়ের কাছ থেকে আরও জানতে পারল, গুপ্তাজির
বাবা জগনলালের আমলে ওঁরা নাকি সপরিবারে ঐ
বাংলোতেই থাকতেন। তখন বাংলোটা সারাদিন গমগম করত। সেই সময়ে গুপ্তা পরিবারের লোকজন
ছাড়াও আরও অনেককে জগনলাল ঐ বাংলোয় থাকতে দিয়েছিলেন।
কিন্তু জগনলালের মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে রামলাল তাঁর পরিবারের সদস্যদের লখনৌতে, নিজেদের আদি
বাড়িতে নিয়ে চলে গেছেন। পরিবারের বাইরের যারা ঐ বাংলোয়
আশ্রয় পেয়েছিল, রামলালের তাড়া খেয়ে তারাও একে একে বিদেয় হয়েছে। কেবল
দু’জনকে এখনও ঐ বাংলো থেকে বার করা যায়নি। লোক দুটো নাকি পেশায়
ম্যাজিশিয়ান। গুপ্তাজি অবশ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ওদের তুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু
যে কোনও কারণেই হোক সেটা করে উঠতে পারছেন
না।
সেদিন সবে ওদের খাওয়া শেষ হয়েছে, এমন সময়ে একটা রোগা-পাতলা বাচ্চা ছেলে
বাড়ির দরজায় উঁকি মারল। ছেলেটার পরনে শুধুই একটা
হাফপ্যান্ট, গায়ে কিছু নেই। শিবনাথ ওকে
দেখা মাত্র রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। তারপর ঠোঙায় মোড়া কিছু একটা এনে
ধরিয়ে দিলেন ছেলেটার হাতে। সেটা পেয়েই ও দাঁত বার করে হেসে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল।
ভূতনাথ এই দৃশ্য দেখে জিজ্ঞাসা করল, “ছেলেটা কে পিসেমশাই?”
শিবনাথ একটু ইতস্তত করে জবাব দিলেন, “ও হল রামু। এখানেই থাকে। আমার কাছ
থেকে রোজ রাত্তিরে একটু খাবার নিয়ে যায়।”
“ও থাকে কোথায়? বাড়ির লোক ওকে খেতে দেয় না?”
“আসলে এখানে ওর কেউ নেই। বেচারি একলাই থাকে। ওর
কথা আর তোকে ভাবতে হবে না। অনেক রাত হয়ে গেছে। তুই এবার শুয়ে পড়।
কাল আবার তো তোকে ভোরবেলায় উঠে বাস ধরতে হবে।”
ভূতনাথের তখন সত্যিই খুব ঘুম পাচ্ছিল। তাই ও আর
কথা বাড়াল না। বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
কলকাতায় ফিরেই ভূতনাথ শম্ভু মাইতিকে জানিয়ে দিল জাটুগঞ্জের সব খবর। শম্ভু সব শুনে একটু মুষড়েই পড়লেন। বললেন, “ভেবেছিলাম জাটুগঞ্জ একটা ভালো ট্যুরিস্ট স্পট হবে। কিন্তু তুমি
যা শোনালে তাতে তো মনে হচ্ছে, ঐ জায়গা
নিয়ে আর না এগোনোই ভালো। তাছাড়া ওখানে বাংলোও তো ঐ
একটাই। ওটা লিজ না পেলে তো আর...। যাক, কী আর করা যাবে। জাটুগঞ্জ
নিয়ে আর কিছু ভেবে লাভ নেই।”
।। ২ ।।
মাস খানেক
বাদের ঘটনা। ভূতনাথ অফিসে
গিয়ে দেখল, নতুন
একজন ওদের কোম্পানিতে জয়েন করেছে। ছেলেটি
ওরই বয়সি, নাম সুজন বিশ্বাস। সে নাকি ম্যানেজমেন্ট পড়া ছেলে,
আগে অন্য একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে ছিল। খুব কাজের মানুষ। শম্ভু মাইতি তাই ওকে বেশি মাইনের টোপ দিয়ে তুলে এনেছে। নাম সুজন হলেও ভূতনাথের কিন্তু নতুন সহকর্মীটিকে এক্কেবারে পছন্দ হল না। ছেলেটার
খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। আর এমন হাবভাব দেখায় যেন আগের কোম্পানিটা ও একাই চালিয়ে এসেছে। এই হামবড়া
ভাবটা ভূতনাথ কোনোদিনই সহ্য করতে পারে না।
হপ্তাখানেক বাদে সুজনের ওপর ভূতনাথ আরও চটে গেল। সুজন শম্ভু মাইতিকে বুঝিয়েছে, জাটুগঞ্জ
বেড়ানোর জায়গা হিসাবে নাকি মোটেই খারাপ নয় এবং
গুপ্তাজির ঐ বাংলোটা লিজ নিতেও কোনও অসুবিধা হবে না। ইতিমধ্যে
রামলাল গুপ্তার
সঙ্গে ফোনে সুজন যোগাযোগ করেছে। জেনেছে, বাংলোটায় উপর-নিচ মিলিয়ে গোটা চোদ্দ ঘর।
তাই সুজনের বক্তব্য, একটা ঘর যদি দু’জন মানুষ দখল করে রেখেও দেয়,
তাতেও হোটেল ব্যাবসায় কোনও সমস্যা হবে না। এবং এ জন্য
বাংলোটা যথেষ্ট কম ভাড়ায় গুপ্তাজি ওদের লিজে দিয়ে দেবেন।
গুপ্তাজি
বলেছেন, সামনের মাসে মানে
আগস্টের পনেরো তারিখে উনি গুজরাট থেকে জাটুগঞ্জে ফিরবেন। তার আগে যেন সুজন ওখানে গিয়ে
বাংলোটা ভালো করে দেখে নেয়। বাংলোর
কেয়ারটেকারকে উনি সব বলে রাখবেন। বাংলোটা সুজনের যদি পছন্দ হয়, তাহলে ঐ স্বাধীনতা দিবসের দিনেই
গুপ্তাজি লিজের কাগজপত্রে
সইসাবুদ করে দেবেন। এমতাবস্থায়, শম্ভু মাইতির ইচ্ছা, বাংলোটা
দেখার সময়ে সুজনের সঙ্গে ভূতনাথও থাকুক।
এই প্রস্তাব
শুনে ভূতনাথ সুজনের ওপর রেগে লাল হয়ে গেল। একমাস আগে নিজে
দেখে এসে ও জানিয়েছিল যে জাটুগঞ্জ
মোটেই ট্যুরিস্ট স্পট হওয়ার উপযুক্ত নয়। কিন্তু এখন শম্ভু
মাইতি তার কথা নয়, বরং ঐ সুজনের কথাই বেশি বিশ্বাস করছে।
তার মানে ছেলেটা ইতিমধ্যেই মালিকের ব্রেন ওয়াশ করে ফেলেছে।
এমনটা চলতে থাকলে তো ও সকলের মাথায়
চড়ে বসবে। বাকিদের আর পাত্তাই দেবে না। না,
এমনটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। ভূতনাথ তাই ঠিক করল,
ঐ জাটুগঞ্জেই সুজনকে উচিত শিক্ষা দেবে। ছোটোবেলার
সেই দুষ্টুমির অভ্যাস পেয়ে বসল ওকে। ভূতনাথ মনে মনে
একটা প্ল্যান ছকে নিল। সব যদি পরিকল্পনামাফিক করা
যায়, তাহলে সুজনকে আচ্ছা জব্দ করা যাবে। ছোকরা আর
কোনোদিনই পাকামো করার সাহস পাবে না।
পরের দিন
শম্ভু মাইতি ভূতনাথকে ডেকে বললেন, “সুজন একটা ট্যুরিস্ট পার্টি নিয়ে সামনের মাসের আট তারিখে বের হচ্ছে। ওদের মধ্যপ্রদেশ
ঘুরিয়ে চোদ্দ তারিখ
দুপুরে ও জাটুগঞ্জ পৌঁছে
যাবে। আর তুমি
তো সাত তারিখ বেরোচ্ছ দেওঘর-গিরিডি,
আরেকটা পার্টি নিয়ে। ফ্রি
হয়ে যাচ্ছ তেরো তারিখেই। তাই আমি
চাইছি, ঐ দিনটা রাঁচিতে কাটিয়ে তুমি সুজনের সঙ্গেই পরদিন সকালে জাটুগঞ্জ রওনা দাও।”
কিন্তু এই প্রস্তাবে ভূতনাথ রাজি হল না। ও তো মনে মনে অন্য কিছু
ভেবে রেখেছে। গুপ্তাজির বাংলোয় দুজন ম্যাজিশিয়ান থাকে এবং তারা ঐ
বাংলোটা ছেড়ে যেতে চায় না, এ তথ্য
পিসেমশাই ওকে জানিয়েছিলেন। সঙ্গে এও
বলেছিলেন যে ঐ দুই জাদুকরের সঙ্গে ওঁর খুব ভালো সম্পর্ক। এখন ভূতনাথের
পরিকল্পনা, পিসেমশায়ের মাধ্যমে ও ঐ দুজনের সঙ্গে আলাপ
জমাবে। তারপর ওদের রাজি করাবে সুজনকে ভূতের ভয় দেখাতে। যেহেতু ঐ জাদুকর দু’জন ঐ বাংলোটা ছাড়তে চায় না, তাই
ভূতনাথের প্রস্তাবে ওদের রাজি না হওয়ার কিছু নেই। একবার জবরদস্ত ভূতের ভয় দেখিয়ে
দিতে পারলে সুজন ঐ বাংলোটা লিজ নেওয়া দূরে থাক, আর
কোনোদিন জাটুগঞ্জ যাওয়ার নামও
করবে না। সব দেমাক একেবারে ঘুচে যাবে।
কিন্তু এই
পরিকল্পনা সফল করার জন্য বাংলোর ঐ ম্যাজিশিয়ান দুটোর সঙ্গে
আগেভাগে যোগাযোগ করা জরুরি। পিসেমশাইয়ের
সাহায্য ছাড়া আবার সে কাজ সম্ভব নয়। তাই ভূতনাথ শম্ভু মাইতিকে জানিয়ে দিল যে আগের দিন একাই ও
জাটুগঞ্জ চলে যাবে, পিসেমশাইয়ের সঙ্গে একটু
সুখ-দুঃখের কথা কইবে। শম্ভু মাইতি এতে আর আপত্তি করল না।
।। ৩ ।।
তেরোই আগস্ট বেলা দুটোর মধ্যেই ভূতনাথ জাটুগঞ্জ
পৌঁছে গেল। কিন্তু ওখানে পৌঁছে দেখল
পিসেমশাই শিবনাথ সমাদ্দারের ঘর তালা
বন্ধ। কিন্তু এই সময় তো ওঁর ঘরে থাকার কথা। তবে কি জরুরি কোনও কাজের জন্য লোকটা আজ ঘরে খেতে আসেনি? একথা ভেবে সবে ভূতনাথ শিবনাথের অফিসের দিকে হাঁটতে শুরু
করেছে, এমন সময় রামু নামের সেই বাচ্চা ছেলেটা কোথা থেকে
যেন ওর সামনে উদয় হল। দাঁত বার করে বলল, “পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছ
বুঝি? সে তো বাবার অসুখের খবর পেয়ে দু’দিন আগে বসিরহাট
চলে গেছে।”
ভূতনাথের তো তখন মাথায় হাত। পিসেমশাই-ই নেই, তাহলে বাংলোর ঐ দু’জন
জাদুকরের সঙ্গে ও আলাপ করবে কীভাবে? আর যদিও বা নিজে গিয়ে আলাপ করে, তাহলেও কোনও
লাভ নেই। প্রথম আলাপে ওরা নিশ্চয়ই সুজনকে ভূতের ভয় দেখাতে রাজি হবে না। তাই
একান্ত হতাশ হয়ে ভূতনাথ রামুর সামনেই বলে ফেলল, “যাঃ, তাহলে কী হবে! ঐ জাদুকর দু’জনের
সঙ্গে আমার যে খুব দরকার ছিল।”
রামু সঙ্গে সঙ্গে চোখ নাচিয়ে বলল, “বাংলোর ঐ ম্যাজিশিয়ানদের সঙ্গে কথা
বলবে? চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। ওদের সঙ্গে আমার ইদানীং খুব ভাব। আমি তো আজ সাতদিন হল ওদের ঘরেই থাকছি।”
রামুর এই কথাটা ভূতনাথ একেবারেই বিশ্বাস করতে পারল না। বেশ রাগের সুরেই
বলল, “আমার সঙ্গে ইয়ারকি হচ্ছে! তুই
সাতদিন ধরে ওদের সঙ্গে থাকছিস? গুল মারার আর জায়গা পাসনি। গুপ্তাজি ওদেরই ক’দিন বাদে ঐ বাংলো থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে ঠিক
করেছে, আর ওরাই কিনা তোকে ওখানে থাকতে দিয়েছে?”
একথা শুনে
রামুও আবার রেগে গেল। দাঁত খিঁচিয়ে ভূতনাথকে বলল, “সাহস থাকে তো আমার সঙ্গে বাংলোয়
চলো, তাহলেই দেখতে পাবে আমি সত্যি কথা বলছি কিনা।”
“ওই বাংলোয়
যেতে আবার সাহসের কী আছে? চ’ এক্ষুনি তোর সঙ্গে ওখানে যাচ্ছি।
কিন্তু গিয়ে যদি দেখি...’ কথাটা শেষ না করেই ভূতনাথ বাংলোর দিকে
হাঁটা লাগাল।
গুপ্তাজির বাংলোটা বিশাল। তবে বোঝাই যাচ্ছে বেশ কিছুকাল
বাড়িটার সংস্কার করা হয়নি। ভালো করে একবার রঙ করে নিলে, এটা ট্যুরিস্ট লজ হিসাবে
যে চমৎকার হবে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু ভূতনাথ এসব কী ভাবছে! ও
তো এখানে এসেছে, এই বাংলোটা যাতে লিজ না নেওয়া হয়, সেই বন্দোবস্ত করতে। কিন্তু সে
স্বপ্ন কি আর পূরণ হবে? পিসেমশাইয়ের বাবা ঠিক এই সময়েই অসুস্থ হবেন, সেটা ও জানবে
কী করে। সুজন কাল দুপুরেই এখানে চলে আসবে, আর পরশুদিন সকালেই গুপ্তাজির সঙ্গে সব
কথা পাকা করে ফেলবে। তখন ও শম্ভু মাইতির কাছে আরও প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে। দেমাকে
মাটিতে আর পা পড়বে না। ভূতনাথ মনে মনে ঠিক করে নিল, এবার ও একটা অন্য চাকরির খোঁজ
করবে। সুজনের আন্ডারে কাজ করা...
“কী গো ভেতরে আসবে তো, নাকি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে? ভিতরে
এসে নিজের চোখে দেখে যাও, আমি এখানে থাকি কিনা।”
রামুর ডাক শুনে ভূতনাথ গুটি গুটি পায়ে ঢুকে পড়ল বাংলোর
ভিতরে। ভিতরটা যেন রাজপ্রাসাদের মতো - বিশাল বিশাল সব ঘর, দামি দামি আসবাবপত্র,
দেওয়ালে বড়ো বড়ো ছবি। ভূতনাথের চোখ টেরিয়ে গেল। ও রামুকে বলল, “এ বাড়ির কেয়ারটেকার
বাহাদুর কোথায়? ওকে দেখছি না কেন?”
রামু নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল, “সে পালিয়েছে।”
“পালিয়েছে মানে? তাহলে এত বড়ো বাংলোটা তদারকি কে করছে?”
“এখন বাংলোর দেখাশোনা জুগনুদা আর মুগনুদাই করে। আমিও রোজ
ঝাড়পোঁছ করি। সেই জন্যই তো ভেতরটা এত চকচকে দেখছ। বাহাদুর এসব করত নাকি? শুধু দু’বেলা
খেত আর ঘুমোত।”
“তা বাহাদুর হঠাৎ পালাল কেন?”
“কেন আবার, ভয়ে পালাল?”
“ভয়, কীসের ভয়?”
“জুগনুদা আর মুগনুদার ভয়ে। ওরা কিছুতেই এই বাংলো ছেড়ে
যেতে রাজি হল না যে।”
“সে তো অনেকদিন ধরেই ওরা এ বাড়ি ছাড়তে চাইছে না। একটা ঘর
দখল করে রেখে দিয়েছে।”
“অন্যায্য কিছু করেছি কী? জগনলালজি আমাদের দুজনকে এ বাড়িতে
নিজে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে। পশ্চিমের ঐ কোণের ঘরটা
দেখিয়ে বলেছিলেন, তোমরা যতদিন খুশি এখানে থাকবে। এই ঘর আমি তোমাদের দিলাম। আমাকে
কোনও ভাড়া দিতে হবে না। শুধু মাঝে মাঝে আমাদের সকলকে জাদুখেলা দেখিয়ে মজা দেবে,
ব্যস। সে কাজ আমরা তিরিশ বছর ধরে করেছি।”
লাল আলখাল্লা পরা একজন বয়স্ক লোক কথাগুলো শেষ করতে না
করতেই নীল আলখাল্লা পরা সাদা চুলের আরেকজন বলে উঠল, “আরে বাবা, তখন তো রামলালও
আমাদের জাদু দেখে হাততালি দিত। তারপর বাবা মরে যেতেই সব ভুলে গেল। এ বাড়ি থেকে
আমাদের তুলে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগল। কিন্তু আমরা তো সেই কবে দেশের জমিজমা
জ্ঞাতি ভাইদের বিলিয়ে দিয়ে এখানে চলে এসেছি। এখন হঠাৎ চলে যেতে বললে, আমরা যাব
কোথায় বল তো ভাই?”
দু’জনের কথা শেষ হতেই ভূতনাথ তাকাল রামুর দিকে। রামু
বলল, “এরাই হল জুগনুদা আর মুগনুদা। চলো, ঘরে গিয়ে কথা বলবে।” এই বলে রামু ভূতনাথকে
একরকম টেনে নিয়ে গেল পশ্চিমের ঘরটায়। ঘরটা বিশাল, আর নানারকম মালপত্তরে ঠাসা। ইতিমধ্যে
জুগনু আর মুগনুও ও ঘরে চলে এসেছে। ওদের সামনেই রামু ভূতনাথকে বলল, “তুমি এখনই
জিজ্ঞাসা করে নাও, আমি ওদের সঙ্গে এ বাড়িতে থাকি কিনা?”
ভূতনাথকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হল না। মুগনু নিজেই জানিয়ে
দিল যে গত এক সপ্তাহ ধরে রামু ওদের ঘরেই থাকছে। ভূতনাথ তখন অবশ্য রামুকে নিয়ে আর
কিছু ভাবছে না। মুগনু আর জুগনুর কথা বলার ধরন ওর মনে বেশ আশা জুগিয়েছে। ওরা বেশ সাদাসিধা
মানুষ বলেই মনে হয়। তাই সুজনকে ভয় দেখানোর প্রস্তাবে ওরা রাজি হয়েও যেতে পারে।
এ কথা মনে হতেই ভূতনাথ আর কোনও ভণিতা না করেই বলতে শুরু
করল, “আসলে জুগনু আর মুগনুদা, আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি একটা বিশেষ
উদ্দেশ্য নিয়ে। আমি নিজেও চাই না আমার মালিক এই বাংলোটা লিজ নিক। কিন্তু মালিক
আমার চেয়ে সুজনের কথায় বেশি গুরুত্ব দেয়। সুজন কিছুদিন আগে আমাদের কোম্পানিতে
ঢুকেছে। কাল ও এসে বাংলোটা দেখবে আর পরশু রামলাল গুপ্তার সঙ্গে এই বাংলোটা লিজ
নেওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলবে। আপনারা এই ঘরটা না ছাড়লেও লিজ নেওয়া আটকাবে না।
তাই আমি চাইছি...”
ভূতনাথ কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই জুগনু বেশ গম্ভীর
স্বরে বলে উঠল, “আমরা এই বাংলোয় বাইরের কোনও লোককে রাত কাটাতে দেব না। তাতে আমাদের
বিস্তর অসুবিধা হবে। তাছাড়া বাইরের কোনও লোক আমাদের সঙ্গে থাকতেও পারবে না। আরে
বাবা, এই বাংলোর পুরোনো কেয়ারটেকারই তো আমাদের সঙ্গে থাকতে পারল না। সেখানে বাইরের
লোকের থাকার তো...”
জুগনুকে থামিয়ে ভূতনাথ বলল, “সে কথা সুজন কিন্তু বুঝবে
না। ও মহা ডেঁপো ছেলে। ইতিমধ্যেই ও গুপ্তাজির সঙ্গে কথা বলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
এখন শুধু কাগজ-পত্র সই হওয়ার অপেক্ষা। তাই আমি বলছিলাম, কাল বিকালে সুজন যখন এই
বাংলোটা দেখতে আসবে, তখন যদি আপনারা ওকে বেশ ভালো রকম ভয় দেখিয়ে দিতে পারেন, তাহলে
ও আর এটা লিজ নেওয়ার কথা মালিককে বলবে না। এতে আপনাদের আর আমার - দুজনেরই উদ্দেশ্য
সফল হবে। আপনারা যেহেতু জাদুকর, তাই নানান কারিকুরি আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। তাই
ওকে ভয় দেখানো আপনাদের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়।”
“তুমি কি ছেলেটাকে ভূতের ভয় দেখানোর কথা বলছ?”
“একদম ঠিক ধরেছেন। আপনারা দু’জনে কাল বিকালে এমন কিছু
করুন যাতে সুজন ভাবে এই বাংলোটা একটা ভূতের আস্তানা। তখন ও আর এখান থেকে পালাবার
পথ পাবে না।”
“সেটা কী আর কঠিন ব্যাপার,” মুগনু মন্তব্যটা করল। সে আরও
বলল, “কাল ছেলেটার এমন হাল করব যে ও শুধু এই বাংলোয় কেন, এই জাটুগঞ্জের
ত্রিসীমানায় আর কোনোদিন আসার সাহস পাবে না। তবে ওর সঙ্গে তুমিও আবার ভয় পেয়ে যেও
না যেন।”
ভূতনাথ তো এ কথা শুনে হেসেই খুন। ও তখন ছোটোবেলায় পাড়ার
বন্ধুদের কীভাবে ভূতের ভয় দেখাত, সে গল্প করল অনেকক্ষণ ধরে। তা শুনে জুগনু আর
মুগনু খুব খুশি। দু’জনেই কথা দিল আজ থেকেই ওরা সব জোগাড়যন্ত্র শুরু করে দেবে। কাল
বিকালে ভূতনাথই যেন সুজনকে সঙ্গে করে এই বাংলোয় নিয়ে আসে। তবে ওর আজ এই বাংলোয়
আসার কথা কিংবা বাহাদুরের এই বাংলো ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ও যেন সুজনকে না
জানায়।
।। ৪ ।।
ভূতনাথ ঐ বাংলো থেকে যখন বের হল তখন বিকেল হয়ে গেছে। আজ ও
ভীষণ খুশি। মনে মনে যা পরিকল্পনা করেছিল, কাল এক্কেবারে সে রকমটাই হতে চলেছে। এবার
সুজন বুঝবে কত ধানে কত চাল। কালকের পরেই ওর সব দেমাক ঘুচে যাবে। ভূতনাথের
সামনে অন্তত ও আর ফটর ফটর করার সাহস পাবে না। রামুও বাংলো থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ও ভূতনাথকে
বলল, “আজ রাতটা তুমি থাকবে কোথায় সেটা ভেবেছ? এখানে তো থাকার জায়গা বিশেষ নেই।”
এটা তো ভূতনাথ এতক্ষণ ভেবে দেখেনি। ও আগে ভেবেছিল, পিসেমশায়ের
কাছে থাকবে। কিন্তু উনি না থাকায় সেটা তো সম্ভব নয়। তাছাড়া আজ রাতে কিংবা কাল
সকালে খাবার ব্যবস্থাও তো করতে হবে। এসব ভেবে ভূতনাথ বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। রামু
কেমন করে যেন ওর মনের কথা জানতে পেরে বলল, “আমি জুগনু আর মুগনুদাকে বলে আজ রাতটা
তোমাকে এই বাংলোয় থাকার ব্যবস্থাই করে দিতে পারতাম। কিন্তু এখানে থাকা তোমার ঠিক
হবে না। তুমি বরং তোমার পিসের ঘরেই থাকবে চল। খাবার আমি তোমাকে ওখানেই দিয়ে আসব।”
“কিন্তু পিসেমশায়ের ঘর তো তালাবন্ধ!”
“তালা খোলার ব্যবস্থা আমি করছি। ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো
না। তুমি পিসের ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করো। আমি এক্ষুনি ওখানে পৌঁছে যাচ্ছি,” এ কথা
বলেই রামু এক দৌড়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে চলে গেল। পিসের ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে
ভূতনাথ ভাবতে লাগল, এই সিড়িঙ্গে চেহারার রামুকে এক মাস আগে পিসেমশায়ের ঘরে দেখে ওর
একদম ভালো লাগেনি। চোর-ছ্যাঁচোড় মনে হয়েছিল। আর আজ সেই ছেলেটাই ওর কী উপকারটাই না
করছে! রামুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল ভূতনাথের মন।
মিনিট দশেক বাদে শিবনাথের ঘরের সামনে গিয়ে ভূতনাথ দেখল,
রামু ঘরের দরজা খুলে একটা ঠোঙা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঙাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রামু
বলল, “এতে ডিমটোস্ট আছে। এখনকার মতো এই দিয়ে কাজ চালিয়ে নাও। আমি ন’টা নাগাদ এসে রাতের খাবার দিয়ে যাব। এখন
আমাকে আবার বাহাদুরকে খুঁজতে বেরোতে হবে। জুগনুদা সে রকমই বলে দিয়েছে।”
কালকে সুজনকে ভূতের ভয় দেখানোর জন্য ঠিক কী কী আয়োজন
হচ্ছে, সেটা জানতে ভূতনাথের বড়ো ইচ্ছা করছিল। কিন্তু রামু আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল
না। হুশ করে চলে গেল নিজের কাজে।
গরম গরম ডিমটোস্ট খেয়ে ভূতনাথ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল শিবনাথ
সমাদ্দারের বিছানায়। ভাবল, ও যে আজ এই ঘরে রাত কাটাবে সেটা পিসেমশায়কে জানিয়ে
দেওয়া উচিত। কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করেও পিসেকে ফোনে ধরতে পারল না। শিবনাথ অবশ্য
ওকে কথা প্রসঙ্গে আগেরবারই বলেছিলেন যে বসিরহাটের যে এলাকায় ওঁদের বাড়ি, সেখানে
মোবাইলের টাওয়ার মোটে পাওয়া যায় না। বাড়িতে একটা ল্যান্ডলাইন আছে। বাড়ির লোক ওটার
মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। কিন্তু ঐ ল্যান্ড লাইন নম্বরটা ভূতনাথ সেদিন আর
শিবনাথের কাছ থেকে নেয়নি। অতঃপর আর যোগাযোগ করার উপায় নেই। থাকলে ভালোই হত,
পিসেমশায়ের বাবা কেমন আছে সে খবরটাও অন্তত নেওয়া যেত। আর কি করা যাবে! ভূতনাথ সব
চিন্তা ছেড়ে এবার চোখ বুজল। ট্যুরিস্ট পার্টি নিয়ে ঘুরে ক’দিন খুব পরিশ্রমও
গিয়েছে। তাই ওর চোখে ঘুম আসতে খুব বেশি সময় লাগল না।
ভূতনাথের ঘুম ভাঙল রামুর সাড়া পেয়ে। রামু ওর মাথার কাছে
দাঁড়িয়ে আছে। রাতের খাবার নিয়ে এসেছে - রুটি আর তড়কা। ভূতনাথ বুঝল, উত্তেজনার বশে
ও দরজায় ছিটকিনি লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। এই রাত্রিবেলা অন্য কেউও তো ঘরে ঢুকে পড়তে
পারত! তখন কী হত? রামু আবারও ওর মনের কথা বুঝে ফেলল। বলল, “অত ভয়ের কিছু নেই।
এখানে চুরি-টুরি হয় না। নাও, এবার খেয়ে নিয়ে আবার লম্বা ঘুম লাগাও। আমি চললাম।”
ভূতনাথ এবার ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। রামুকে বলল, “চললাম মানে?
খাবারের টাকা নিয়ে যা। তোকে তো আমি বিকালে ডিমটোস্টের টাকাও দিইনি।”
রামু কিন্তু দাঁড়াল না। বলল, “সে সব কালকে হবে’খন। এখন আমার অনেক কাজ। বাহাদুরের বাড়ি
গিয়েছিলাম। ওকে পেলাম না। নিশ্চয়ই ভয়ে দেশের বাড়ি পালিয়েছে। এই অবস্থায় জুগনুদাদা
বলল গিরিধারীর খোঁজ করতে। এখন ওর ডেরায় যাব।”
“গিরিধারীকে দিয়ে কী হবে?”
“কী আবার হবে, গিরিধারী বাহাদুর সাজবে। তোমার সুজন
বিশ্বাস তো আর বাহাদুরকে চেনে না। তাই কাল গিরিধারীই বাংলোর কেয়ারটেকার সেজে
তোমাদের বাংলো দেখাতে নিয়ে যাবে।”
“কিন্তু তোর গিরিধারী এ কাজ করতে রাজি হবে?”
“আরে বাবা, বাংলোতে থাকতে দেবার কথা বললে আলবাত রাজি
হবে। ও তো থাকে পশ্চিমে জঙ্গলের ধারে একটা আধভাঙা বাড়িতে। এমন বিশাল বাংলোয় থাকার
সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি?”
“কিন্তু ওকে এই বাংলোয় ঢোকালে গুপ্তাজি কিছু বলবেন না?
উনি তো জুগনু আর মুগনুকেই বাংলো থেকে বার করে দিতে চাইছেন। তার ওপর...”
“গুপ্তাজি কিচ্ছু করতে পারবে না। তোমার আর ওসব ভেবে কাজ
নেই। তড়কা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল সকালে বাংলোয় চলে এস।
ওখানেই চা-জলখাবার খাবে। জুগনুদা বলে দিয়েছে।” এ কথা বলেই রামু দরজা খুলে বেরিয়ে
গেল। ভূতনাথও আর সময় নষ্ট করল না। খাওয়া সেরে আবার শুয়ে পড়ল পিসেমশায়ের নরম বিছানায়।
।। ৫ ।।
পরদিন ভূতনাথের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করেই। রামুর কথা মতো
বাংলোয় পৌঁছতে সাড়ে ন’টা বেজে গেল। ইতিমধ্যে
সুজনের ফোন এসেছে। সুজন জানিয়েছে, রাঁচি থেকে বেলা দুটোর বাসটা ধরে ও জাটুগঞ্জ আসবে।
ও বাহাদুরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই ভূতনাথকেই ভার দিয়েছে কোনোভাবে
বাহাদুরের সঙ্গে যোগাযোগ করার। বাংলোয় ঢুকেই ভূতনাথ সে কথা রামুকে জানিয়ে দিল।
রামু জবাবে বলল, “ঠিক আছে, সুজনের খবরটা আমি জুগনুদাদের জানিয়ে দেব। কিন্তু তুমি
এখানে আসতে এত দেরি করলে কেন? কচুরি তো জুড়িয়ে গেল।”
ভূতনাথের মন তখন অবশ্য খাবারের দিকে নেই। সুজনকে ভয়
দেখানোর বন্দোবস্ত কতদূর এগোল, সেটা জানার জন্যই ও ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
এবারও রামু ওর মনের কথা বুঝে ফেলল। বলল, “জুগনু আর
মুগনুদাদা সেই কাল বিকাল থেকেই সুজনকে ভূতের ভয় দেখানোর তোড়জোড় করছে। ওরা এখন খুব
ব্যস্ত। আমি কাল রাতে গিরিধারীকে এই বাংলোয় নিয়ে এসেছি। সেও ওদের সঙ্গেই আছে। এখন
ওদের ঘরে তুমি যেতে পারবে না। খাওয়া সেরে তুমি বরং ঝরনাটা দেখে এসো। আগেরবার যখন
এসেছিলে, ওটা তো দেখনি। এরপরে তো আর কোনোদিন তুমি জাটুগঞ্জে আসবে না। তাই...”
ভূতনাথ রামুর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করল। বলল, “কেন
আসব না। নিশ্চয়ই আসব। আমাকে তো ট্যুরিস্ট নিয়ে প্রায়ই রাঁচি আসতে হয়। ওখান থেকে এই
জাটুগঞ্জ আর কতদূর? তবে হ্যাঁ, আজকের পরে সুজন আর কোনোদিন এ পথ মাড়াবে না, এ নিয়ে
কোনও সন্দেহ নেই।”
ভূতনাথ হাঁটতে হাঁটতে ঝরনার কাছে চলে গেল। গিয়ে তো অবাক।
ঝরনাটা বিশাল আর চারপাশটাও খুব সুন্দর। ট্যুরিস্টদের সত্যিই ভালো লাগবে। তাহলে
পিসেমশাই যে বলেছিলেন জায়গাটা তেমন কিছু নয়। একটা বোল্ডারের ওপর ভূতনাথ চুপ করে
বসে উপভোগ করতে লাগল প্রকৃতির ঐ অপরূপ শোভা।
খানিক বাদেই একটা শব্দ এল কানে। মনে হল দূরে কেউ যেন
হেঁটে যাচ্ছে। ও উঠে গিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেল ঝরনার পশ্চিমদিক থেকে
একটা লোক হেঁটে এদিকেই আসছে। লোকটা মাথা নিচু করে হাঁটছিল। তাই ওকে লক্ষ করেনি।
কিছুটা এগিয়ে আসার পর লোকটা চোখ তুলল। ভূতনাথের এবার লোকটাকে চিনতে অসুবিধা হল না।
আরে এই তো বাহাদুর, যাকে রামু কাল থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভূতনাথ বেশ উত্তেজিত স্বরে
বলে উঠল, “বাহাদুর, আমাকে চিনতে পারছ? আমি শিবনাথ সমাদ্দারের আত্মীয়। একমাস আগে
পিসেমশাই তোমার সঙ্গে রাস্তায় আমার পরিচয় করে দিয়েছিল। তুমি বাংলো ছেড়ে পালিয়েছ
কেন? রামু তো কাল তোমার বাড়ি...”
প্রথমের কথাগুলো বাহাদুর মন দিয়ে শুনছিল বটে, কিন্তু ঐ
রামুর নাম করতেই লোকটা উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে দে দৌড়, ঢুকে গেল বাঁদিকের জঙ্গলের
মধ্যে। ভূতনাথও বাহাদুরের পিছন পিছন কিছুটা গেল, কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর ও আর
বাহাদুরকে দেখতে পেল না। লোকটার এহেন আচরণ ভূতনাথকে খুব অবাক করল। রামুর নাম শুনে
বাহাদুর পালাল কেন? রামু বা ঐ দুই জাদুকরকে ওর এত ভয় কীসের? কিন্তু এসবের উত্তর
ভূতনাথের জানা নেই। তাই আরও কিছুক্ষণ ঐ ঝরনাতলায় কাটিয়ে ও ফিরে এল পিসেমশায়ের ঘরে।
সেখানে বেশ ভালো করে স্নান-টান সেরে বেলা দুটো নাগাদ আবার পৌঁছল বাংলোয়।
দুপুরে খাবার মেনু ডাল, ভাত আর মুরগির মাংস। এবারেও
ভূতনাথকে একাই খেতে হল। বাকি সকলের খাওয়া নাকি হয়ে গেছে। তবে এখন আর ঐ দুই
জাদুকরের ঘরে ঢুকতে বাধা নেই। জুগনু আর মুগনু খাটেই বসেছিল। তার পাশে আরেকটা
বেঁটেখাটো নতুন লোক। মুগনু লোকটার সঙ্গে ভূতনাথের পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, “এরই নাম
গিরিধারী। তোমার সুজন তো আর বাহাদুরকে চেনে না। তাই ও-ই আজ বাহাদুর সাজবে। তুমি
ওকে বাহাদুর বলেই ডাকবে, আমরাও তাই। সুজন তো তোমাকে সকালে ফোন করেছিল? বলেছে রাঁচি
থেকে ও দুটোর বাস ধরবে। সেই বাস এখানে পৌঁছবে চারটে নাগাদ। তুমি গিরিধারী থুড়ি
বাহাদুরকে সঙ্গে নিয়ে সুজনকে আনতে যেও।”
“আমি আসল বাহাদুরকে কিছুক্ষণ আগে ঐ ঝরনার কাছে দেখেছি।
আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কাল বাড়ি ছিলে না কেন? কিন্তু আমার কথার জবাব না দিয়েই ও
ছুটে পালিয়ে গেল।”
ভূতনাথের এই কথা শুনে জুগনু বলল, “লোকটা তাহলে এই
জাটুগঞ্জেই আছে দেখছি। সুজনের সঙ্গে ওর দেখা হলে সমস্যা হবে।” তারপর একটু ভেবে
বলল, “ভূতনাথ, তুমি আর গিরিধারী চারটের আগেই বাস স্ট্যান্ডে চলে যাবে। সুজন বাস
থেকে নামলেই সোজা ওকে নিয়ে এখানে চলে আসবে, অন্য কোথাও সময় নষ্ট করবে না, কেমন?”
এরপর আরও বেশ কিছুক্ষণ ঐ দুই জাদুকরের সঙ্গে ভূতনাথ কথা
বলল, কিন্তু সুজনকে ভয় দেখানোর ঠিক কী বন্দোবস্ত ওরা করেছে, সেটা কিছুতেই জানতে
পারল না। সাড়ে তিনটে বাজতেই, মুগনু সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভূতনাথ আর গিরিধারীকে নির্দেশ
দিল বাসস্ট্যান্ডে চলে যেতে।
ঐ বাংলো থেকে বাসস্ট্যান্ড মিনিট পনেরোর পথ। ঐ পথেই
একধারে গিরিধারীর ঘর। ওর ঘরটা যে বেশ পুরোনো সেটা রামুর মুখেই ভূতনাথ কাল শুনেছিল।
কিন্তু আজ নিজের চোখে ঘরটার হাল দেখে ভূতনাথ একেবারে শিউরে উঠল। গিরিধারীকে যেতে
যেতেই জিজ্ঞাসা করল, “এই ঘরের অবস্থা তো খুব খারাপ, যে কোনও সময় ছাদটা ধ্বসে পড়তে
পারে। তোমার এখানে থাকতে ভয় করে না?”
গিরিধারি এই প্রশ্নের কোনও জবাব দিল না, শুধু একটু হাসল
মাত্র। একটু পরেই ওরা পৌঁছে গেল বাস স্ট্যান্ডে। ওখানে গুটি কয়েক লোক। ভূতনাথের চা
খেতে ইচ্ছা করছিল। তাই ও গিয়ে দাঁড়াল একটা চায়ের দোকানে। এমন সময় চোখে পড়ল দূরে
বটগাছটার নিচে সেই বাহাদুর দাঁড়িয়ে আছে অন্যদিকে মুখ করে।
তাহলে সুজন কি ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে সমর্থ হয়েছে? তবে
তো মহা বিপদ! নকল বাহাদুর ধরা পড়ে যাবে। আজকের সব প্ল্যান মাটিও হয়ে যেতে পারে।
ভূতনাথ কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমন সময় ধুলো উড়িয়ে বাসটাও এসে গেল। ভূতনাথ দেখল,
বাহাদুরও মুখ ঘুরিয়ে গুটিগুটি পায়ে এদিকেই আসতে শুরু করেছে। ভূতনাথের মাথা কাজ
করছে না। সুজন এক্ষুনি বাস থেকে নেমে পড়বে। এবার ও কী করবে?
ভূতনাথকে কিছুই করতে হল না। দেখল, কোথা থেকে পুঁচকে রামু
ওখানে হাজির হয়েছে। ও এগিয়ে গেল আসল বাহাদুরের দিকে। আর রামুকে দেখেই লোকটা আবার উলটো
মুখো হয়ে ছুট লাগাল সেই বটগাছটার দিকেই। তারপর নিমেষে ঐ গাছ টপকে নজরের বাইরে চলে
গেল।
ভূতনাথের হুঁশ এল সুজনের ডাক শুনে, “কী বাহাদুরের খোঁজ
পেয়েছ? আমি খানিক আগে ওকে ফোনে পেয়েছিলাম। ও বলেছিল বাসস্ট্যান্ডে এসে আমার সঙ্গে
দেখা করবে? কী সব যেন বলবে বলছিল। কিন্তু ফোনটা কেটে গেল।”
ভূতনাথ ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। ও একগাল হেসে বলল, “তুমি
সকালবেলা ফোন করার পরেই তো আমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। এই তো গিরি... মানে
বাহাদুর আমার সঙ্গে এসেছে তোমাকে বাংলোয় নিয়ে যেতে।”
সুজন সঙ্গে সঙ্গে গিরিধারীর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “আচ্ছা,
তুমিই বাহাদুর। গুপ্তাজি তোমাকে সব বলে রেখেছেন নিশ্চয়ই?”
গিরিধারী সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। সুজন এবার ওকে জিজ্ঞাসা
করল, “তুমি ফোনে কী সব যেন বলবে বলছিলে?”
ভূতনাথ এই প্রশ্ন শুনে বেশ টেনশনে পড়ে গেল। গিরিধারী কী
জবাব দেবে কে জানে! ম্যানেজ করতে না পারলেই বিপদ। সুজন হয়তো বুঝে ফেলবে যে এই
লোকটা নকল। কিন্তু ভূতনাথের সব আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে গিরিধারী উত্তর দিল, “আসলে
আমি ঐ ম্যাজিশিয়ান দুটোকে আগেই বলে রেখেছিলাম, আজ আপনি আসবেন, ওরা যেন কোনও
বেগড়বাই না করে। ওরা খালি বলছিল, আপনার সঙ্গে নাকি ওদের অনেক কথা আছে। কথা মানে কী
জানেন তো, আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে যাতে এই বাংলোটা লিজ না নেন। ওরা যা-ই বলুক,
আপনি কিন্তু এক্কেবারে নরম হবেন না। মালিক আমাকে বলে দিয়েছেন, একবার ঐ বাংলোটায়
লোকজন এসে থাকতে শুরু করলে ওরা দু’জন বাধ্য হবে ওখান থেকে চলে যেতে।”
গিরিধারীর বক্তব্যের এই শেষ অংশটা শুনে সুজন তো হেসেই
খুন। ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তুমি হাসালে বাহাদুর। বুড়ো ম্যাজিশিয়ান দুটো আমাকে
কনভিন্স করবে ঐ বাংলোটা লিজ না নিতে? আমাকে কি তেমন লোক পেয়েছ? ওদের কোনও কথাকেই
আমি পাত্তা দেব না। ওই বাংলোটা ভাড়া তো নেবই, আর এক মাসের মধ্যে ঐ লোকদুটোকেও ওখান
থেকে তাড়িয়ে ছাড়ব। ওরা এখনও সুজন বিশ্বাসকে চেনে না। এর থেকে অনেক জটিল কেস আমি
আগের কোম্পানিতে হ্যান্ডেল করেছি। আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চলো বাংলোর ঘরগুলো
একবার ভালো করে দেখে নিই।”
নিজের কথা শেষ করেই সুজন গিরিধারীকে নিয়ে হাঁটতে শুরু
করল। ভূতনাথকে আর পাত্তাই দিল না। ভূতনাথের তখন তো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে, কিন্তু ও
সেটা সুজনকে বুঝতে দিল না। মনে মনে বলল, “আর কয়েক ঘন্টা দেমাক দেখাও, তারপর আর
আমার সামনে মুখ তুলে কথা বলার অবস্থায় থাকবি না চাঁদু।”
।। ৬ ।।

বাংলোয় ঢুকেই সুজন যথারীতি পাকামি শুরু করে দিল।
ভূতনাথকে তখন যেন ও আর চেনেই না। সুজন গিরিধারীকে বলল, “বাহাদুর, এই বাংলোর
প্রতিটা ঘর আমি ভালো করে দেখতে চাই। প্রথমে আমাকে দোতলায় নিয়ে চলো।” এই সময়ে জুগনু
আর মুগনু সুজনের সামনে এসে দাঁড়াল। মুগনু বলল, “আপনি বোধহয় জানেন না, বেশ কিছুদিন
ধরে এই বাংলো ভূতেদের বাসা। একগাদা ভূতের সঙ্গে কোনও ট্যুরিস্ট এখানে রাত কাটাতে
পারবে না। তাতে আপনাদের এজেন্সিরই বদনাম হবে। তাই একগাদা টাকা খরচা করে এই বাংলো
লিজ না নেওয়াই ভালো।”
সুজন সঙ্গে সঙ্গে খেঁকিয়ে উঠল। বলল, “আপনারা দু’জনে
বোধহয় ম্যাজিশিয়ান, তাই তো? দেখুন আমাকে ভূত-টুতের ভয় দেখাবেন না, কোনও লাভ হবে
না। আর আমি কোথায় টাকা খরচ করব না করব, তা নিয়ে আপনাদের ভাববার কোনও দরকার নেই।”
তারপর গিরিধারীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে
আছ কেন, আমাকে দোতলায় নিয়ে চলো।”
গিরিধারী সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য কর্মচারীর মতো ওকে নিয়ে গেল
দোতলায়। ভূতনাথ চলল ওদের পিছন পিছন। দোতলায় মোট আটটা ঘর। সবকটার দরজাই বন্ধ ছিল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম ঘরটার সামনে দাঁড়াতেই, দরজার পাল্লা দুটো আপনাআপনি খুলে গেল।
তা দেখে সুজন বেশ ঘাবড়ে গিয়ে তাকাল গিরিধারীর দিকে। গিরিধারী সঙ্গে সঙ্গে মাথা
চুলকে বলল, “জানেন স্যার, কিছুদিন ধরেই না বাংলোয় এসব ভূতুড়ে ব্যাপার-স্যাপার
হচ্ছে। আমার তাই আজকাল এখানে থাকতে খুব ভয় করে। আসলে ভূত...”
গিরিধারীর কথা শেষ হতে না হতেই সুজন গটগট করে ঢুকে পড়ল
ঘরটার ভিতর। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “ভূত-টুত কিছু নয়, এসব ঐ ম্যাজিশিয়ান দুটোর
কারসাজি। ওরা এই বাংলোয় ভূত আছে প্রমাণ করতে চাইছে। তাহলে আর কেউ এটা লিজ নেবে না।
আর ওরা দিব্যি এখানে থেকে যেতে পারবে। কিন্তু এসব করে আমাকে ভয় দেখানো যাবে না
বাহাদুর। সামনের পুজোতেই আমি এখানে ট্যুরিস্ট নিয়ে আসব আর খুব তাড়াতাড়ি ওদের
দুটোকেও এই বাংলো থেকে তাড়াব, এই বলে দিলাম।”
সুজনের মুখে এ কথা শুনে দেখা গেল গিরিধারী আর ভূতনাথ,
দুজনেই বেশ মুষড়ে পড়েছে। ভূতনাথ বেশ বুঝতে পারল সুজন খুব সাহসী ছেলে। ভূতের ভয়
দেখিয়ে ওকে সহজে ঘায়েল করা যাবে না। তাহলে তো সব প্ল্যান মাটি হয়ে যাবে! এই
বাংলোটা লিজ নিয়ে নিলে তো সুজনের আর মাটিতে পা-ই পড়বে না। তখন ভূতনাথ ওর সঙ্গে কাজ
করবে কী করে? না, ওকে এবার চাকরিটাই ছেড়ে দিতে হবে মনে হচ্ছে। এসব ভেবে ভূতনাথ খুব
হতাশ হয়ে পড়ল।
সুজন ততক্ষণে দ্বিতীয় ঘরের সামনে হাজির হয়েছে। ঐ ঘরের
দরজাটাও আগের মতোই নিজে থেকে খুলে গেল। সুজন এবারেও ব্যাপারটা পাত্তা দিল না। সোজা
ঢুকে গেল ঐ ঘরের মধ্যে। ঐ ঘরের ভিতরের ডানদিকের দেওয়ালের বেশ খানিকটা অংশের
প্লাস্টার খসে গিয়েছিল। সেটা নজরে আসতেই সুজনের সে কী রাগ! ও গিরিধারীকে বেশ কড়া
স্বরে বলল, “বাহাদুর, তুমি তো দেখছি বাংলোটার একেবারে দেখভালই কর না। গুপ্তাজি তোমার
ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে খুব ভুল করেছেন দেখছি। ইস, দেওয়ালটার কী বিচ্ছিরি
অবস্থা! আমি কিন্তু কাল গুপ্তাজিকে...”
“আপনি কী সব বলছেন স্যার! দেওয়াল তো ঠিকই আছে।”
গিরিধারীর মুখে এ কথা শুনে সুজন আর ভূতনাথ দুজনেই আবার তাকাল দেওয়ালটার দিকে। দেখল
সেটা একেবারে ঝকঝক করছে, একটা আঁচড় পর্যন্ত নেই। এবার সুজন কিন্তু আরও ঘাবড়ে গেল।
ফ্যাকাসে মুখে মিনমিন করে বলল, “বুঝেছি, এটাও ঐ জাদুকর দুটোর কেরামতি।” ওদিকে
জুগনু আর মুগনুর ভেলকি দেখে ভূতনাথও একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। সত্যি কী দারুণ
ম্যাজিক দেখাতে পারে ওরা দু’জন! ভাঙাচোরা একটা দেওয়ালকে জাদুবলে নিমেষে কেমন নতুন
করে দেয়!
পরের ঘরটায় ঢুকে হল আরেক কাণ্ড! সে ঘরের এক কোণে একগাদা
ময়লা পড়েছিল। সুজন তা দেখে রেগে লাল। কিন্তু সে কথা জানাতেই গিরিধারী যথারীতি
নির্বিকার মুখে বলল, “কোথায় ময়লা?” এই জবাব শুনে সুজন আবার তাকাল ঘরের ঐ কোণটায়।
সেখানটা তখন এক্কেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার, আবর্জনার চিহ্নমাত্র নেই।
সুজনের মুখ এবার বেশ থমথমে হয়ে গেল। ও রীতিমতো ঘামতে
শুরু করেছে। তৃতীয় ঘরটা থেকে বেরিয়ে ও আর দোতলার অন্য ঘরগুলোতে ঢুকল না। সোজা নেমে
এল একতলায়।
।। ৭ ।।
ডাইনিং টেবিলের দু’পাশে অনেকগুলো চেয়ার সাজানো ছিল। তারই
একটায় সুজন ধপ করে বসে পড়ল। তারপর গিরিধারীকে বলল, “বাহাদুর, আমাকে এক গ্লাস
ঠাণ্ডা জল খাওয়াতে পার?”
গিরিধারী সঙ্গে সঙ্গে এক গ্লাস জল এনে ধরিয়ে দিল সুজনের
হাতে। “জলটা ঠাণ্ডা হলে ভালো হত। এই বাংলোয় ফ্রিজ নেই, তাই না? কী আর করা যাবে!”
নিজের মনেই এ কথা বলে সুজন সবে গ্লাসে মুখ দিতে যাবে এমন সময় ওখানে হাজির হল জুগনু
আর মুগনু।
জুগনু বলল, “চিন্তা কীসের? আমি এক্ষুনি জলটা ঠাণ্ডা করে
দিচ্ছি।” এই বলেই ও গ্লাসের সামনে একবার নিজের ডান হাতটা নাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে জল
একেবারে হিমশীতল। সুজনের হাত থেকে তো গ্লাসটা পড়েই যাচ্ছিল। কোনও মতে সামলে নিয়ে ও
প্রথমে কোঁত কোঁত করে খেয়ে নিল পুরো জলটা। তারপর জুগনুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা
দু’জন যে দারুণ ম্যাজিক জানেন, তা আমি আগেই শুনেছি। কিন্তু এই লজ আমি ভাড়া নেবই,
কেউ আটকাতে পারবে না।”
মুগনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ভাড়া নিলে খুব ঠকবেন। কোনও ট্যুরিস্টই
এই ভূতবাংলোয় একটা রাতও কাটাতে রাজি হবে না। আপনাদের কোম্পানির খুব বদনাম হবে।
আপনার মালিকও খুব চটে যাবে আপনার ওপর।”
এ কথা শুনে উলটে সুজনই গেল ভীষণ চটে। বেশ জোর গলায় বলল, “এই
বাংলোয় ভূত-টুত কিছুই নেই। আপনারা জাদুকর। তাই ভেলকি দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা
করছেন এখানে ভূত আছে। আমি কিন্তু তাতে একটুও ভয় পাইনি। কারণ আমি ভূতে বিশ্বাস করি
না। আসলে ভূত বলে কিছু হয়ই না।”
সুজনের এই মন্তব্যে এবার জুগনু রেগে লাল। বলল, “বটে! ভূত
বলে কিছু হয় না? আমরা তাহলে কী?”
সুজন এ কথা শুনে তো হেসেই খুন। বলল, “আপনারা মানুষ, আবার
কী? জাদু জানলে কি মানুষ ভূত হয়ে যায় নাকি? হাসালেন মশাই।”
“কিন্তু এতক্ষণ ওপরে যা যা কাণ্ড ঘটল, সেটা কি ভূত ছাড়া
অন্য কেউ করতে পারত বলে আপনার মনে হয়?”
“ভালো জাদুকরেরা ওরকম অনেক কাণ্ড করতে পারে - করাত দিয়ে
মানুষ কাটে, গোটা তাজমহল চোখের সামনে থেকে গায়েব করে দেয়, পকেট থেকে জ্যান্ত পায়রা
বার করে - আরও কত কী! আমি ছোটোবেলায় পি সি সরকারের ম্যাজিক দেখেছি। তাই ওসব ভেলকি
দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখানো যাবে না।”
জুগনু এ কথা শুনে খুব বিরক্ত হল। সুজনকে একরকম দাঁত খিঁচিয়ে
বলল, “তুমি খোকা যে সব ম্যাজিকের কথা বলছ, সে সব দর্শক দেখে অনেক দূর থেকে। আমরাও
জীবিত অবস্থায় অমন অনেক ভেলকি দেখিয়েছি। আসলে স্টেজে আমরা আগে থেকেই নানা কারসাজি
করে রাখতাম। দূর থেকে দর্শক তা ধরতে পারত না। কিন্তু এখানে যা যা হল, সবই তো তোমার
একেবারে নাকের ডগায়।”
“আজও আপনারা আগে থেকেই অনেক কিছু কারসাজি করে রেখেছেন আমাকে
ভয় দেখাবেন বলে, সেটা কি আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছেন?” সুজনকে এবার বেশ সাহসী দেখাল।
মুগনু এবার শান্ত গলায় বলল, “তাহলে তুমি বলতে চাইছ - নিজে
থেকে দরজা খুলে যাওয়া, ভাঙা দেওয়াল নতুন হয়ে যাওয়া, ঘরের জঞ্জাল আপনা থেকে সাফ হয়ে
যাওয়া – এ সব আমরা আগে থেকে কারসাজি করে করেছি। মেনে নিলাম। কিন্তু এখন তো আমরা দু’জন
তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বল, কী করলে তুমি বিশ্বাস করবে যে আমরা ভূত?”
সুজন সঙ্গে সঙ্গে মুচকি হেসে বলল, “ভূতেরা শুনেছি অদৃশ্য
হয়ে যেতে...”
সুজনের কথা শেষ হতে না হতেই জুগনু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তা
দেখে সুজনের মুখ আবার শুকিয়ে গেল। মুগনু বলল, “কী, এবার বিশ্বাস হল তো যে আমরা
ভূত?”
সুজন শুকনো গলায় বলল, “মানে এটাও তো জাদু হতে পারে। আমি তো
আপনাদের ডেরাতেই আছি। তাই...”
“তাই কী? অ্যাঁ?” জুগনু আবার সশরীরে ফিরে এসেছে। ও এবার বেশ
কড়া সুরেই বলল, “তোমার ধারণা, একজন জাদুকর নিজের ডেরাতে থাকলেই যা খুশি তাই করতে
পারে? আচ্ছা, তুমি ওই পুঁচকে রামুর দিকে তাকাও। দেখ আমি ওকে শূন্যে উঠিয়ে দিচ্ছি।
এ কাজ ভূত ছাড়া আর কেউ কখনও পারবে না।” এ কথা বলেই জুগনু রামুর দিকে আঙুল তুলল আর
রামু হুশ করে মেঝে থেকে ছ’ফুট উপরে ভেসে উঠল।
মুগনু বলল, “রামু তুই হাঁটতে থাক।” রামু তৎক্ষণাৎ হাওয়াতেই হাঁটতে শুরু করল।
এ সব দেখে ভূতনাথের খুব মজা লাগছিল। কিন্তু ও এমন মুখ করে
দাঁড়িয়েছিল যেন খুব ভয় পেয়েছে। রামু ততক্ষণে হাঁটা ছেড়ে রীতিমতো দৌড়তে শুরু করেছে।
ওকে দেখিয়ে জুগনু সুজনকে বলল, “এবারও কি বলবে, আমরা ভূত নই, স্রেফ জাদুবলে ওকে
শূন্যে নাচিয়ে যাচ্ছি?”
সুজনের হাল তখন সত্যিই বেশ খারাপ। ওর হাঁটু রীতিমতো কাঁপছে।
চোখের মণি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তাও ও মচকাতে চাইল না। কাঁপা কাঁপা গলায়
জুগনুকে বলল, “আমি একটা বইতে পড়েছিলাম, খুব ভালো ম্যাজিশিয়ানরা দর্শককে সম্মোহন
করে তাকে অনেক উদ্ভট কিছু দেখিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। হতে পারে আপনারাও...”
মুগনু তো এ কথা শুনে রেগে একেবারে আগ্নেয়গিরি হয়ে গেল।
রীতিমতো গলা চড়িয়ে বলল, “সম্মোহন করে দর্শককে অনেক সময় বোকা বানানো যায় ঠিকই,
কিন্তু একজন মানুষের মাথাটা খুলে নিয়ে কোনও দর্শকের হাতে তুলে দেওয়া যায় কি? এই
কাজটা কেবল ভূতেরাই করতে পারে।” কথাটা শেষ করেই মুগনু গিরিধারীকে কাছে ডাকল। তারপর
ওর ঘাড় থেকে মাথাটা খুলে সটান ধরিয়ে দিল সুজনের হাতে।
সুজনের তো তখন একেবারে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা। মুখ দিয়ে
কোনও কথা সরছে না। একবার তাকাচ্ছে নিজের হাতে থাকা মুন্ডুটার দিকে আরেকবার
মুন্ডুহীন গিরিধারীর দিকে। ঘামছে একেবারে দরদর করে। হাত-পাও ঠক ঠক করে কাঁপছে।
ভূতনাথও কিন্তু এই দৃশ্য দেখে একদম ভড়কে গেছে। এটা যে ম্যাজিক সেটা যেন ওর
বিশ্বাসই হচ্ছে না।
এই সময়েই আবার গিরিধারীর মুন্ডুটা এক কাণ্ড করে বসল। মুখটা
হাঁ করে জোর গলায় সুজনকে বলল, “আমাদের তাড়িয়ে তুই এই লজটা ভাড়া নিতে চাস? এত সাহস
তোর! আজ তোকে আমি গিলেই খাব।”
এমন কথা শুনলে দারোগারও পিলে চমকে যাবে, সুজন কোন ছাড়।
গিরিধারীর মাথাটা ডাইনিং টেবিলের ওপর কোনোমতে রেখে দিয়েই সুজন ‘ওরে বাবা রে, ভূতে খেয়ে ফেললে রে’ - বলে এক দৌড়ে বাংলো থেকে বেরিয়ে গেল। ভূতনাথ বাংলোর দরজার কাছে গিয়ে
দেখল সুজন ঊর্ধশ্বাসে বাসস্ট্যান্ডের দিকে ছুটছে। মনে হচ্ছে, ওখানে বাস না পেলে
দৌড়েই হয়তো রাঁচি চলে যাবে। মিনিটখানেক ধরে এই দৃশ্যটা ভূতনাথ বেশ তারিয়ে তারিয়ে
উপভোগ করল। মনে এখন ওর একরাশ প্রশান্তি। যাক, কলকাতায় গিয়ে আর কখনও সুজনের চ্যাটাং
চ্যাটাং কথা শুনতে হবে না। সুজন আদৌ আর এই চাকরিটা করে কিনা, সেটা নিয়েই সন্দেহ
আছে।

।। ৮ ।।
রামুর ডাকে ভূতনাথের হুঁশ ফিরল। ও বাতাস থেকে ইতিমধ্যে
মাটিতে নেমে এসেছে। ওর সঙ্গে ডাইনিং রুমে গিয়ে ভূতনাথ দেখল গিরিধারীর মুন্ডু্টাও
স্বস্থানে ফিরে গেছে। জুগনু আর মুগনুর কাছে গিয়ে ভূতনাথ বলল, “আপনারা দু’জন এত
ভালো ভোজবাজি জানেন, আমার ধারণাই ছিল না। আমার মনে হয়, পৃথিবী-বিখ্যাত জাদুকরেরাও
আপনাদের মতো ম্যাজিক দেখাতে পারবে না। আমি কলকাতায় ফিরে আপনাদের একটা শো-এর
ব্যবস্থা করব ভাবছি। আপনারা কলকাতায় আসবেন তো ম্যাজিক দেখাতে?”
এ কথা শুনে জুগনু ঘাড় নেড়ে বলল, “কিছু মনে কোরো না ভাই, এই
বাংলো ছেড়ে আমাদের আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। আগে অনেক দূরে দূরে জাদু দেখিয়ে
বেড়িয়েছি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। তুমি এখন তোমার পিসের ঘরে ফিরে যাও। এই
সন্ধ্যায় আর রাঁচি ফেরার দরকার নেই। কাল সকালের প্রথম বাস ধরে চলে যেও। রাতের
খাবার তোমাকে রামু পৌঁছে দেবে’খন।”
ভূতনাথের ইচ্ছা ছিল জুগনু আর মুগনুকে জিজ্ঞাসা করে, কীভাবে
ওরা আজকের এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারগুলো ঘটাল। কিন্তু ওদের দুজনকে সেই মুহূর্তে খুব
ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ওরা চলে গেল নিজেদের ঘরে। এই সময় রামু মুচকি হেসে ভূতনাথকে
জিজ্ঞাসা করল, “সন্ধ্যা তো হয়ে গেছে। একা পিসের ঘরে যেতে পারবে তো? নাকি আমি পৌঁছে
দিয়ে আসব?”
ভূতনাথ তো এ কথা শুনে হেসেই খুন। বলল, “আমাকে কি তুই ঐ সুজন
পেয়েছিস? আমিই বলে এককালে কত লোককে ভূতের ভয় দেখিয়ে বেড়িয়েছি। আর তুই বলছিস এই
সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে আমার...”
ভূতনাথ হাঁটতে হাঁটতে চলে এল পিসের বাড়ি। তারপর বেশ ভালো
করে স্নান করে গা এলিয়ে দিল বিছানায়। সুজনের কথা মনে আসতেই হাসি পেয়ে গেল। ও কি
সন্ধ্যার বাসটা ধরতে পেরেছে, নাকি সত্যি সত্যি দৌড় লাগিয়েছে রাঁচির দিকে? ব্যাটাকে
আজ আচ্ছা জব্দ করা গেছে।
সাড়ে আটটা নাগাদ রামু হাজির হল খাবার নিয়ে। ভূতনাথ বেশ
কৃতজ্ঞ চিত্তে ওকে বলল, “তুই আমার যা উপকার করলি রামু, আমি তা আজীবন মনে রাখব।
আচ্ছা, এই ক’দিন যে খাবার দিয়ে গেছিস, তার দাম তো দেওয়া হয়নি। আমি তো কাল সকালেই
বেরিয়ে যাব। তোকে কত টাকা দেব বল?”
রামু জবাবে বলল, “ও সব তোমায় দিতে হবে না। তুমি শুধু কাল
ভোরে বাস ধরতে যাওয়ার সময় শ্মশানকালীর মন্দিরে নিজের ইচ্ছামতো কিছু টাকা প্রণামী
দিয়ে যেও।”
“এ আবার কী কথা!”
“এরকমই কথা। আমি এখন চললাম। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।” এই বলে
রামু এক দৌড়ে চলে গেল।
ভূতনাথ মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েই ঘুমিয়েছিল। কিন্তু তা
সত্ত্বেও পরদিন ভোরে ওর ঘুম ভাঙল না। আসলে এত তৃপ্তির ঘুম ও বহুকাল ঘুমোয়নি।
ভূতনাথ ঘুম থেকে উঠল বেলা আটটা নাগাদ। সকালের প্রথম বাসটা দেড়ঘন্টা আগেই চলে গেছে।
পরের বাস দু’ঘন্টা পরে। ভূতনাথ ঠিক করল, খানিক বাদে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়বে।
কিছুটা দূরেই একটা সিঙারা-কচুরির দোকান আছে। সেখানে জলযোগ সেরে ও রামুর কথা মতো
শশ্মানকালীর মন্দিরে যাবে প্রণামী দিতে। তারপর একবার যাবে ঐ বাংলোয়। দেখা করে আসবে
জুগনু-মুগনু-গিরিধারীর সঙ্গে। ওরা কাল যা উপকার করল!
।। ৯ ।।
ন’টা নাগাদ ভূতনাথ
স্নান সেরে বেরোবার জন্য রেডি হয়েছে, এমন সময়ে একটা ব্যাগ হাতে হঠাৎই শিবনাথ হাজির
হলেন। উনি গতকাল বসিরহাটের বাড়ি থেকে রওনা হয়ে রাতে রাঁচি নেমেছেন। আর আজ ভোরের প্রথম
বাস ধরে পৌঁছেছেন জাটুগঞ্জ।
ভূতনাথকে নিজের ঘরে দেখে শিবনাথ তো আকাশ থেকে পড়লেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার ঘর তো তালাবন্ধ ছিল। তুই ঢুকলি কী করে?” ভূতনাথ তখন পিসেমশাইকে
সমস্ত ঘটনা বেশ গুছিয়ে বলে ফেলল। এসব শুনে শিবনাথ একেবারে গুম হয়ে গেলেন। তারপর
বেশ সিরিয়াস মুখে ভূতনাথকে বললেন, “রামুর কথা শুনে তোর এ ঘরে থাকা, কিংবা বাংলোয়
গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলা একেবারে ঠিক হয়নি ভুতো। আজ আর তুই ঐ বাংলোয় যাস না, দশটার
বাস ধরে সোজা রাঁচি চলে যা। চ’ আমি
তোকে বাসে তুলে দিয়ে আসছি।”
পিসেমশাইয়ের কথাগুলো ভূতনাথের একেবারে পছন্দ হল না। যারা ওর
এত উপকার করল, চলে যাওয়ার আগে তাদের সঙ্গে একবার দেখা করবে না? এটা তো অভদ্রতা
হবে। ভূতনাথ তাই জেদ ধরল, ও বাসে চড়ার আগে একবার ঐ বাংলোয় যাবেই যাবে।
ভূতনাথকে কিছুতেই নিরস্ত না করতে পেরে শিবনাথ বললেন, “আমি
এই ঘরটা তালা দিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম। দ্যাখ, ইয়া বড়ো তালা। চাবি এখানকার কারুর কাছে
দিয়ে যাইনি। কোনোদিনই কারুর কাছে দিয়ে যাই না...”
“তাহলে রামু এই তালা খোলার চাবি পেল কোথায়? ও কি এই তালার
একটা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে নিয়েছে নাকি? কিন্তু ওকে দেখে তো চোর-টোর বলে মনে হয়
না। আমার কাছ থেকে তো খাবারের দাম অবধি নেয়নি,” ভূতনাথ অবাক হয়ে জানতে চাইল।
“আমি কি বললাম ও চোর! ও আসলে মানুষই নয়...”
ভূতনাথ এবার হেসে ফেলল, “কী যা তা বলছ পিসে! বুঝেছি, এবার
তুমি আমাকে ভূতের ভয় দেখাতে চাইছ, যেমনটা আমি সুজনকে দেখিয়েছি?”
শিবনাথ এ কথা শুনে আরও রেগে গেলেন। বললেন, “দ্যাখ ভুতো, আমি
গত পনেরো বছর এই জাটুগঞ্জে আছি। পনেরো বছর আগে রামুকে যেমন দেখেছিলাম, আজও ও তেমনই
আছে, কোনও পরিবর্তন হয়নি। আর ঐ যে গিরিধারীর কথা বলছিস, ও তো সাপের কামড়ে মারা
গিয়েছিল প্রায় বছর পাঁচেক আগে।”
ভূতনাথ এবার আরও হেসে উঠল। বলল, “পিসে, তুমি পারও বটে। তুমি
তাহলে বলতে চাইছ, রামু আর গিরিধারী আসলে ভূত এবং আমি কাল ঐ বাংলোয় যা দেখেছি তা
সবই ভূতুড়ে কাণ্ড! তাই তো?”
আগেই বলেছি, শিবনাথের বাবা খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি
ছিলেন, এখন খানিক সুস্থ হয়ে বাড়িতে এসেছেন। বাবাকে নিয়ে শিবনাথের তাই ক’দিন চিন্তার
শেষ ছিল না। তার ওপর জাটুগঞ্জ আসবেন বলে কাল সেই দুপুরে উনি বাড়ি থেকে বের হয়েছেন,
রাতে ট্রেনে ঘুমও হয়নি। শরীরের ওপর খুব ধকল গেছে। এই অবস্থায় আর ক’জনই বা মেজাজ
ঠিক রাখতে পারেন? শিবনাথও পারলেন না। ভূতনাথের শেষ কথাগুলো ওঁকে ভীষণ উত্তেজিত করে
তুলল।
শিবনাথ রেগেমেগে চলে গেলেন পাশের ছোটো ঘরটায়। সেখানে এক
গাদা পুরোনো খবরের কাগজ ডাঁই করে রাখা ছিল। তার থেকে একটা কাগজ খুঁজে বার করে
ধরিয়ে দিলেন ভূতনাথের হাতে। বললেন, “এটা একটা স্থানীয় কাগজ, রাঁচি বার্তা। তারিখ
দেখ, ৫ই আগস্ট, মানে ঠিক দশ দিন আগের ঘটনা। এই লাল দাগ দেওয়া খবরটা পড়।”
ভূতনাথ সঙ্গে সঙ্গে চোখ বোলাতে শুরু করল খবরটায় – ‘কাল
সন্ধ্যায় রাঁচি থেকে হাজারিবাগগামী একটি ট্রেকারের সঙ্গে একটি মালবাহী লরির
মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন প্রৌঢ় প্রাণ হারিয়েছেন। জুগনু সিং এবং মুগনু সিং নামের ঐ দু’জন
পেশায় ম্যাজিশিয়ান এবং তাঁরা জাটুগঞ্জের বাসিন্দা...’
ভূতনাথ খবরটা আর পড়তে পারল না, তার আগেই পেপারটা ওর হাত
থেকে পড়ে গেল। বেশ বুঝতে পারল, গতকাল বিকালে যে চারজনের সঙ্গে পরিকল্পনা করে
সুজনকে ভূতের ভয় দেখিয়েছে, তারা সকলেই অশরীরী। চারখানা ভূতের কবল থেকে ও যে বেরিয়ে
আসতে পেরেছে, সেটাই পরম ভাগ্যের ব্যাপার। এই জাটুগঞ্জে তার মানে অগুন্তি ভূতের বাস
আর গুপ্তাজির ঐ বাংলোটা হল ওদের ঘাঁটি।
এ সব কথা মাথায় আসতেই ভূতনাথের গলা-বুক তখন শুকিয়ে কাঠ।
খালি মনে পড়ে যাচ্ছে, গিরিধারীর ঐ হাঁ-করা মুন্ডুটার কথা। ভূতনাথ বুঝতে পারল
এক্ষুনি জাটুগঞ্জ ছেড়ে পালাতে হবে। এই ভূতের রাজত্বে আর এক মুহূর্তও থাকা নিরাপদ
নয়। ও নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকাল। দশটা বাজতে মাত্র দশ মিনিট বাকি।
ভূতনাথ আর সময় নষ্ট করল না। জামাকাপড়ের ব্যাগটা কাঁধে তুলে
পিসেকে একটা প্রণাম ঠুকেই ছুটতে শুরু করল বাসস্ট্যান্ডের দিকে। সে এক ভয়ংকর দৌড়,
যা দেখলে উসেইন বোল্টও লজ্জায় পড়ে যাবে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছতেই ওর চোখে পড়ল
একটা হোমরা-চোমরা লোক সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন
করছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু লোক। তাদের মধ্যে একজন রামু। এই দৃশ্য দেখে
ভূতনাথের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। তার মানে জাটুগঞ্জে ভূতেরাও
স্বাধীনতা দিবস পালন করে!
ভূতনাথের গতি আরও বেড়ে গেল। একরকম লাফিয়ে ও উঠে পড়ল বাসের
মধ্যে। পিছনের দিকে একটা বসার সিটও জুটে গেল। ব্যাগটা বাঙ্কে রেখে বসতে না বসতেই
ছেড়ে দিল বাসটা। ভূতনাথের ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত প্রাণটা
নিয়ে অন্তত ঘরে ফিরতে পারছে। ঠিক এই সময়েই পিছন থেকে কেউ একজন ওর কাঁধে হাত রাখল।
আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে এল একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর, “শশ্মানকালীর মন্দিরে
প্রণামীটা দিয়ে এলে না ভাই? এটা কি ঠিক কাজ হল?”
ভূতনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল গিরিধারী বসে আছে। মনে পড়ে গেল
গতকাল বিকালের ওর মুন্ডুর সেই উক্তি, ‘আজ তোকে গিলেই খাব।’ ভূতনাথ আর নিজেকে সামলাতে পারল
না, সিটে বসেই তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারাল। জ্ঞান ফিরেছিল সেই রাঁচি পৌঁছে। সেদিনের পর ও
আর কোনোদিন জাটুগঞ্জের ত্রিসীমানায় যায়নি।
_____
ছবিঃ রুমেলা দাশ
তোফা তোফা..দারুণ গল্প . একদম বাস্তব জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অলৌকিক ঘটনা.. বেড়ে লাগল
ReplyDeleteসুন্দর গল্প
ReplyDeleteগল্পটি পড়েছি আর মুগ্ধ হয়েছি অলংকরণ করতে গিয়ে
ReplyDeleteভূতনাথের তাই ছোটোবেলায় কোনোদিন বেড়াতে যাওয়া হয়নি। amar o na,ki mil.
ReplyDeletedarun galpo