আবার হেসোরাম হুঁশিয়ার
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
(প্রফেসর হুঁশিয়ারকে মনে আছে তোমাদের? সেই যে যিনি কারাকোরামের বন্দাকুশ পর্বতে গিয়ে অদ্ভুত সব জন্তু-জানোয়ার দেখতে
পেয়েছিলেন, আর তাঁর সেই শিকারের ডায়েরি সন্দেশে বেরুনোমাত্র গোটা বাংলাদেশে সাড়া
পড়ে গিয়েছিল! হ্যাঁ, সেই প্রফেসর হেসোরাম হুঁশিয়ারের কথাই বলছি। সেবারে
তো তাঁর সেই ডায়েরি প্রকাশের পর থেকে পাঠকরা কী খোঁজাই না খুঁজেছিল তাঁকে, কিন্তু
তাঁর সেই কাহিনি কেউ বিশ্বাস না করায় মহা খাপ্পা হয়ে সেই যে তিনি উধাও হয়ে গেলেন,
তারপর থেকে আর কেউ তাঁকে খুঁজে পায়নি।
অবশেষে এই সেদিন, সন্দেশের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে নানা
পুরোনো কাগজপত্রের তাড়া ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে ফস্ করে বেরিয়ে পড়ল তাঁর আর একটি ডায়েরির
কিছু পাতা। ব্যস, আমাদের আর পায় কে? আহ্লাদে আটখানা হয়ে সেগুলো
ছাপিয়ে দিলাম তোমাদের জন্য। তবে আগেই বলে রাখি,
এও কিন্তু ভারি আজব কাহিনি। বিশ্বাস করবে কী
করবে না, সেটা তোমাদের ব্যাপার।)
১৮ই এপ্রিল, ১৯২৩ — তিব্বত,
মানস সরোবর থেকে ২০ মাইল উত্তর।
আজ সকাল থেকেই খুব সুন্দর আবহাওয়া। দু’দিন
বিশ্রাম নিয়ে আমাদের গা-হাতের ব্যথাও গায়েব হয়ে গেছে। তাই সকাল সকাল অল্প
কিছু খেয়েই চন্দ্রখাই আর শিকারি দু’জনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা একটু ঘুরেফিরে
দেখার জন্য। আমাদের বাক্স-প্যাঁটরা বইবার জন্য দুজন কুলিও রইল সঙ্গে।
গতবছর কারাকোরমে গিয়ে বড্ড নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল আমাদের। ঝড়ে আমাদের
সব কিছু উড়িয়ে নিয়েছিল, তাই সংগ্রহ করা সেই সব অদ্ভুত নমুনা আর ফটোগ্রাফ, তার কিছুই
আমরা সঙ্গে নিয়ে ফিরতে পারিনি। এবার তাই আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে বেরিয়েছি। নমুনার জন্য একটা বড়ো স্টিলের
ট্রাঙ্ক সঙ্গে নিয়েছি আমরা, আর সেটা বইবার
জন্য একটা ঘোড়া রেখেছি সঙ্গে। তবে ঘোড়াটাকে তো আর পাহাড়ের ওপর তোলা যাবে না, তাকে নিচেই
তাঁবুতে রেখে যাব একজন কুলির জিম্মায়।
দলে এবার আমরা মোট বারো জন আছি। আমার সঙ্গে
ভাগনে চন্দ্রখাই তো আছেই, আট জন কুলি নেওয়া হয়েছে সঙ্গে, আর গত বারের সেই শিকারি
দু’ভাইও আবার আমাদের সঙ্গী হয়েছে, ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং। আমাদের
সঙ্গে গত বার কারাকোরমে গিয়ে ওদের এমন ফুর্তি হয়েছে যে, আমাদের এবারের অভিযানের
কথা শুনে অবধি ওরা নাছোড়বান্দা। অগত্যা ওদের সঙ্গে নিতে হয়েছে। তবে বেশ করে
ওদের বুঝিয়ে দিয়েছি যে, ভুলেও যেন দুই ভাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে না যায়। গত
বারে ওই জন্যই তো ল্যাগব্যাগর্নিসটাকে পাকড়াও করা গেল না, একটুর জন্য পগার পার হয়ে
গেল। আমার কথা শুনে অবিশ্যি
দুই ভাই খুব গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ল, কিন্তু কতটা কী বুঝল ওরাই জানে।
তাঁবু থেকে একটু এগিয়ে পাহাড়ের গায়ের কাছে এসে দেখি পশ্চিম
দিকটায় প্রায় ন্যাড়া পাহাড়, আর অনেক উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে গায়ে বরফ। আমরা চললাম পূর্বদিকে। ওদিকে একটু
এগিয়েই ঘন জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। মাইলখানেক এগিয়ে জঙ্গলের সীমানায় পৌঁছে দেখি, মস্ত মস্ত কী
যেন সব গাছে জঙ্গলটা ভর্তি। তার কোনোটাই আমরা চিনি না। সবার আগে
চোখে পড়ে একটা গাছ, যার কান্ডটা প্রায় ধর্মতলার শহীদ মিনারের মতো মোটা, আর গোটা
কান্ডটা স্ক্রুয়ের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে একতলা বাড়ির ছাদের সমান। তার
পাতাগুলো আশ্চর্যরকমের সাদা, আর সেই গাছ থেকে ঝুলছে নীল রঙের লম্বা লম্বা বরবটির মতো
কী যেন ফল।
দেখেই তো ছক্কড় সিং ‘মিল গ্যয়া’ বলেই দৌড়ে গেল সেদিকে, আর
গাছের কাছে গিয়ে সেই নীল ফল একটা পাড়বার জন্যে হাত বাড়াল। অমনি একটা আশ্চর্য কান্ড
ঘটল। গাছটা থেকে ভস্ ভস্ করে ধোঁয়া বেরিয়ে এল, আর ছক্কড় সিং
অমনি হাত পা তুলে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল গাছের তলায়।
আমরা হৈ হৈ করে উঠে ছুটলাম সেদিকে। এমন সময়
হঠাৎ একটা খিঁক খিঁক করে জোর হাসির শব্দ শুনে দেখি, পাশের একটা গাছ থেকে দোল
খাচ্ছে একটা অদ্ভুত রকমের জন্তু, আর যেন ভারি মজা পেয়ে খিঁক খিঁক করে হাসছে। তার মুখটা
গরিলার মতো, ধড়টা শুঁয়োপোকার মতো, আর সেইসঙ্গে ঝুলছে একটা বিরাট ইঁদুরের মতো লেজ। চন্দ্রখাই
তার হাসি দেখে খাপ্পা হয়ে একবার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করতেই সে গাছ বেয়ে উঠে
কিলবিল করতে করতে ঘন পাতার আড়ালে কোথায় যে চলে গেল, আর দেখতেই পেলাম না। এমনকি একটা ছবি
তোলারও সুযোগ পাওয়া গেল না। তবে তার বেয়াড়া স্বভাবের জন্য আমরা তার নাম রাখলাম
বেয়াড়াথেরিয়াম।

২২শে এপ্রিল, ১৯২৩ — মানস সরোবর থেকে ৩২ মাইল উত্তর-পূর্ব।
সকালবেলা এক কান্ড। বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছি। কুলিরা তাঁবু গোটাচ্ছে, লক্কড়
সিং তার বন্দুকটা পরিষ্কার করছে, আর আমি হাতে আঁকা ম্যাপটা একটু ঠিকঠাক করছি। চন্দ্রখাই খাবারের বাক্সটা
বাগিয়ে ধরে সবে ছ’টা পাঁউরুটি আর দশটা ডিমসিদ্ধ নিয়ে বসেছে, এমন সময় হঠাৎ একটা হুল্লোড় চেঁচামেচি শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা এক বিঘৎ লম্বা
জানোয়ার চন্দ্রখাইয়ের প্লেট থেকে খপাৎ করে দু’হাতে দুটো ডিম তুলে নিয়ে মস্ত মস্ত
লাফে কুলিদের তাঁবুটার মাথায় চড়ে বসল, তারপর গম্ভীর মুখে আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে
খেতে লাগল। আমরা তো অবাক। ওইটুকু একটা জানোয়ার, দেখতে অনেকটা নাদুসনুদুস
ভল্লুকের মতো, লম্বা লম্বা দুটো কান, গায়ে আবার জেব্রার মতো সাদাকালো ডোরা কাটা,
তার কী সাংঘাতিক লাফের জোর! প্রায় দশ-বারো ফুট করে লাফায় সে এক একটা লাফে!
আমি বললাম, হয়েছে। এবার এটাকেই আমরা ধরে নিয়ে যাব। শুনে তো
লক্কড় সিং-এর ভারি আনন্দ। মহা
উৎসাহে বন্দুক বাগিয়ে সে বলে উঠল, বহুৎ খুব! লেকিন ক্যায়সে পাকড়ায়গা? আমি বুদ্ধি
দিলাম। আরও খাবারের লোভ দেখিয়ে ব্যাটাকে বন্দি করতে হবে। সেইমতোই ব্যবস্থা হল। তাঁবুর পাশে
একটা থালায় করে ডিম, কলা আর আঙুরের থোকা রেখে দেওয়া হল, আর বড়ো একটা জাল নিয়ে তাঁবুর
আড়ালে লুকিয়ে রইল ছক্কড় সিং। তারপর যেই না ব্যাটা দুই লাফে এসে খাবারের থালায় হুমড়ি
খেয়ে পড়েছে, অমনি ছক্কড় সিং-ও তার জাল ছুঁড়ে আটকে ফেলেছে ব্যাটাকে। জালে ধরা পড়েও তার
সে কী লাফঝাঁপ! ধরে রাখাই যায় না। অনেক কষ্টে একটা শক্ত খাঁচায় তাকে বন্দি করে ফেলা গেল।
তারপর ওইসব খাবারদাবারগুলো খেয়ে তবে সে খানিকটা শান্ত হল। চন্দ্রখাই বলল, ব্যাটার যা
লম্ফঝম্প দেখছি, ওর নাম দেওয়া যাক লম্ফসরাস।

গত দু’দিনে আমরা বেশ কিছু নমুনা যোগাড় করে ফেলেছি। গাছের পাতা,
ফল, ফুল আর পোকামাকড় মিলিয়ে আধবাক্স ইতিমধ্যেই বোঝাই হয়ে গেছে। এবার আমরা
পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠব। যদিও এখানেও পাহাড়ের মাথার দিকে বরফ, কিন্তু সে অনেক উঁচুতে। তার আগে
আমাদের জঙ্গলের মধ্যে পথ করে নিয়ে পাহাড়ে চড়তে হবে। আর এইসব
গাছপালার যা চেহারা দেখছি, কত অজানা নমুনা যে আমাদের সংগ্রহে আসবে, তার ঠিক নেই। এই তো গতকালই
বিকেল নাগাদ আমরা এখানে এসে পৌঁছবার পর কুলিরা তাঁবু খাটিয়ে রান্নাবান্না শুরু
করল, আর আমরা এদিকে ওদিকে ঘুরে সময় কাটাতে লাগলাম। হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতেই
চোখে পড়ল একটা অদ্ভুত গাছ। প্রায় দু-মানুষ উঁচু সেই গাছটার পাতাগুলো একদম রামধনুর মতো
সাত রঙে রাঙানো, আর তার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে ফুটবলের মতো বড়ো বড়ো কালো রঙের ফল। ভরসা করে
কাছে গিয়ে একটা পাতা ছিঁড়ে নিতেই সুমিষ্ট গন্ধে চারিদিক ভরে গেল। এখনও
পর্যন্ত আমার হাতে সেই সুগন্ধটা লেগে রয়েছে। গাছের অমন বাহার দেখে আমি তার নাম দিয়েছি বাহারোফিলিয়া।
২৮শে এপ্রিল, কৈলাশ পর্বত, ২০০০ ফুট উঁচুতে।
খুব খারাপ খবর। লম্ফসরাসটা
পালিয়ে গেছে। লক্কড় সিং-এর জন্যই এটা হল। ভোরবেলা কায়দা করে লম্ফসরাসের খাঁচা খুলে তাকে খাবার দিতে গিয়েছিল, অমনি সে
কটাশ করে লক্কড় সিং-এর আঙুল কামড়ে ধরে। লক্কড়
সিং হাঁউমাউ করে হাত টেনে নিতেই সুড়ুৎ করে বেরিয়ে এসে লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে গাছের
মাথায় চড়ে চোখের নিমেষে উধাও। বেচারি
লক্কড় সিং লজ্জায় আমার সামনে আর মুখ তুলতেই পারছে না। যাই হোক, ভেবে আর লাভ নেই। আরও কোনও জ্যান্ত নমুনা যদি পাওয়া
যায়, তার চেষ্টা দেখতে হবে।
এখন অবধি আমরা পাহাড়ের যে
পর্যন্ত উঠেছি, তাতে নতুন রকমের গাছপালা আর কিছু দেখতে পাইনি। তবে বিদ্ঘুটে কিছু প্রাণীর দেখা
পেয়েছি বটে। ক’দিন আগেই সন্ধের মুখে
চন্দ্রখাই দশ হাত লম্বা কেঁচোর মতো কী একটাকে মাড়িয়ে ফেলেছিল। সেও বোধহয় আমাদের খাবারের গন্ধেই
ঘুরঘুর করছিল তাঁবুর পাশে। গায়ে পা
পড়তেই অবিকল বাচ্চাদের কান্নার মতো ওঁয়া ওঁয়া করে ডাকতে ডাকতে সর সর করে উঠে গেল
পাহাড়ের গা বেয়ে। এ ছাড়াও একদিন একটা মস্ত বড়ো
হাতির মতো জন্তু দেখলাম, যার সারা দেহ কচ্ছপের মতো খোলা দিয়ে ঢাকা, কিন্তু মুখটা
জিরাফের মতো। লম্বা গলা বাড়িয়ে সে ঝরনার জল
খাচ্ছিল। আমাদের সাড়া পেয়েই মুখ ঘুরিয়ে সে
এমন ভয়ানক গলায় ঘ্রোয়াম ঘ্রোয়াম করে ডাকতে শুরু করল যে আমরা কাছে যেতেই সাহস পেলাম
না। শুধু দূর থেকে কোনোরকমে সেই গর্জনোডন বা গর্জন করা
জন্তুর কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। প্রমাণ হিসেবে সেটাই বা কম কী!
ঠান্ডার প্রকোপ বেড়েছে। কুলিরা আর খুব বেশি উঠতে চাইছে
না। এদিকে আমাদের খাবারেও টান পড়তে শুরু করেছে। রান্না করার মতো শাকসবজি সব
ফুরিয়েছে। শুধু টিনের মাছ মাংস দুধ আর কিছু পাঁউরুটি, বিস্কুট আর জ্যাম সঙ্গে আছে। আর টাটকা
জিনিস বলতে কিছু ফলমূল। তাই দিয়ে হয়তো আর আট-দশদিনের মতো চলবে। কাজেই তার
মধ্যেই আমাদের নেমে যেতে হবে পাহাড়ের নিচে।
গতবার কারাকোরমে গিয়ে আমাদের জরিপের যন্ত্রটা খারাপ
হয়ে গিয়েছিল। এবারে আসার আগে তাই সেটা সারিয়ে নিয়ে এসেছি। তবে এখানে আসা থেকে সেটা আর
ব্যবহার করা হয়নি। আজ একটু ফাঁক পেয়ে যন্ত্রটা দিয়ে আমি নিজে একবার, আর চন্দ্রখাই একবার
পাহাড়টা মেপে দেখলাম। দু’জনের হিসাবেই পাহাড়ের উচ্চতা বেরোলো প্রায় বাইশ হাজার ফুট। তার মানে
যন্ত্রটা এখন ঠিকই হিসাব দিচ্ছে। তবে পাহাড়ের পনেরো হাজার ফুটের ওপর থেকেই বরফ
শুরু হয়ে গেছে। অত উঁচুতে তো আর ওঠা যাবে না। কিন্তু আরও অন্তত দু-তিন হাজার
ফুট না উঠলে চলবে না। আজই সকালে পাহাড়ের উলটোদিকটায় একটা হিমবাহের চিহ্ন
পেয়েছি। অন্তত সেই হিমবাহের উৎস পর্যন্ত যাব, এটাই ইচ্ছা।
২রা মে, কৈলাশ পর্বত, ৪৫০০ ফুট উঁচুতে।
একটু আগেই একটা ভারি সাংঘাতিক
ঘটনা ঘটে গেল। রাতের খাওয়া শেষ করে আমরা সবে
এসে ঢুকেছি তাঁবুর ভেতর। এমন সময়
হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার শুনতে পেলাম। একসঙ্গে দশটা শাঁখ, কুড়িটা
সাইরেন আর পঞ্চাশটা বিউগিল
বেজে উঠলে যেমন শোনাবে, ঠিক তেমনি তার ভয়ানক আওয়াজ। আর তার সঙ্গেই অনেকগুলো লোকের
বিচিত্র শোরগোল। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি কুলিরা সব
জড়ামড়ি করে হাঁউমাউ করছে, আর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থর থর করে কাঁপছে। ওদিকে তাকিয়ে দেখি অদ্ভুত কান্ড!
পাহাড়ের গায়ের একটা খোঁদল থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে একদল নাম না জানা কিম্ভূত
আকারের জন্তু। গুণতিতে কম-সে-কম কুড়ি-পঁচিশটা
তো হবেই! তাদের দেহটা অনেকটা কালো কালো ডেয়োপিঁপড়ের মতো ডুমো ডুমো, কিন্তু মুখের
সামনে হাতির মতো লম্বা একটা করে শুঁড়, আর তারা ক্যাঙারুর মতো পিছনের পায়ে ভর দিয়ে
লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে, আর মুখে ওইরকম ভয়ঙ্কর শব্দ করছে।
আমি চিৎকার করে বললাম, চালাও গোলি। কিন্তু গুলি চালাবে কে? শিকারী দু’জন
কোথায়? একটা উঁ-উঁ-উঁ শব্দ শুনে দেখি আমাদের তাঁবুর পিছনে ছক্কড় আর লক্কড় বন্দুক
হাতে নিয়ে দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে ঠক ঠক
করে কাঁপছে আর তাদের গলা দিয়ে ওইরকম শব্দ বেরিয়ে আসছে। একদৌড়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকে আমার
বন্দুকটা নিয়ে বেরিয়ে এসে ধাঁই ধাঁই করে দুটো গুলি চালিয়ে দিলাম। আমার দেখাদেখি ছক্কড় সিং আর
লক্কড় সিং-ও তখন জাপটাজাপটি ছেড়ে বীরদর্পে এগিয়ে
এসে বন্দুক ছুঁড়তে লাগল। সেই গুলিতে খানকতক জন্তু লটকে
পড়লেও বাকি জন্তুগুলো দেখি একইরকম ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসছে। তখন চেঁচিয়ে সবাইকে বললাম, গুলিতে
হবে না। আগুন জ্বালাও। জলদি করে আগুন
জ্বালাও।
তখন সবাই মিলে বেশ একটা হুড়োহুড়ি
পড়ে গেল। কেউ কাঠ আনতে ছোটে, কেউ ছোটে
কেরোসিন তেলের খোঁজে। একজন
কুলি চেঁচিয়ে উঠল, ম্যাচিস লাও। আমরা
সেই ফাঁকে বন্দুক ছুঁড়ে আরও দু-একটাকে ঘায়েল করে ফেললাম। একটু পরেই আগুন জ্বলে উঠল। তারপর একেকজন সেই জ্বলন্ত কাঠ
মশালের মতো করে ধরে জন্তুগুলোকে একেবারে পাহাড়ের ওদিকে তাড়িয়ে নিয়ে ফেললাম। তারপর তাঁবুর কাছে ফিরে এসে
কুলিদের বলে দিলাম, বড়ো করে আগুন জ্বালো। এবার থেকে তাঁবুগুলো ঘিরে সারারাত ধরে আগুন জ্বেলে রাখতে হবে। আবার কখন কোন আপদ এসে হামলা করে,
তার ঠিক কী! চন্দ্রখাই তার পুরোনো অভ্যেস
ভোলেনি। এই ঘোর বিপদের মধ্যেও এক টিন
মাখন বার করে নিশ্চিন্তমনে বসে বসে খাচ্ছে। আমার
কথা শুনে আঙুল চাটতে চাটতে বলল, তাহলে এই আপদগুলোর নাম দেওয়া হোক আপদথেরিয়াম।

৪ঠা মে, কৈলাশ পর্বত, ৫৫০০ ফুট উঁচুতে।
হিমবাহটার গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আরও অনেকটা উঠে এসেছি। কিন্তু
আগে যা ভেবেছিলাম, আমাদের সে হিসাব ভুল। এর উৎস আরও অনেক উপরে। এখানে
হিমবাহের চওড়া খাতের মধ্য দিয়ে একটা সরু জলের ধারা শুধু বয়ে চলেছে নিচের দিকে। চারিদিক নিস্তব্ধ। আশেপাশে কোনও গাছপালাও নেই।
শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সামান্য
জলের শব্দটুকু ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। চন্দ্রখাই মহা উৎসাহে খাতের পাড় থেকে নেমে গেছে জলের
ভেতর। আমরা পাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখছি, এমন সময় হঠাৎ গুড় গুড় ঘড় ঘড় ধমাস ধমাস
করে বিকট এক শব্দ শোনা গেল। আর পরমুহূর্তেই কী যে ঘটল ঠিক বোঝা গেল না। এক ভয়ানক
বরফগলা জলের স্রোত পাহাড়ের ওপর থেকে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে নিমেষে ভাসিয়ে নিয়ে গেল
আমাদের। কে কোথায় ছিটকে গেল বুঝতে পারলাম না। আমি নাকানিচোবানি খেতে খেতে অনেকদূর ভেসে আসার পর কোনোক্রমে
হাত বাড়িয়ে পাশের একটা পাথরের খাঁজ নাগালে পেয়ে ঝুলে পড়লাম। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে
আসছে। সমস্ত শরীরে বেদনা। তার মধ্যেই চোখ মেলে দেখি, একটু দূরেই ছক্কড় সিং ঝুলছে
একটা গাছের ছড়ানো ডাল আঁকড়ে ধরে। তার কনুইয়ের কাছ থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু বাকি সবাই
কোথায়? এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। পায়ের নিচ দিয়ে ভীমবেগে জলের
স্রোত বয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে বড়ো বড়ো বরফের চাঙড়, পাথরের টুকরো আর গাছের ডালপালাও ভেসে চলেছে। এইভাবে
আরও অনেকক্ষণ থাকবার পর ধীরে ধীরে জলের স্রোত কমে এল। তখন হাঁচোর পাঁচোর করে কতক
লাফিয়ে আর কতক লেংচে, কোনোরকমে উঠে এলাম পাড়ে। ছক্কড় সিং-ও জলে হাবুডুবু খেতে
খেতে উঠে এসে আমার পাশে বসে বড়ো বড়ো হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল।
এইভাবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর আমরা সঙ্গীদের খোঁজে
বের হলুম। আমি চললুম নিচের দিকে আর ছক্কড় সিং ওপরের দিকে। আধমাইলটাক নিচে নামার
পরেই দেখি তিনজন কুলির সঙ্গে চন্দ্রখাই একটা উঁচু পাথরের ওপর বসে বসে হাঁফাচ্ছে। তার ডান
পায়ের হাঁটুতে বিষম চোট। কুলিদের অবস্থাও প্রায় সেইরকম। সঙ্গের জিনিসপত্র কিছুই
আর নেই। এমন সময় দেখি ছক্কড় সিং-এর কাঁধে ভর দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে লক্কড় সিং
নেমে আসছে। সঙ্গে আর একজন কুলি। তার মানে বাকি কুলিরা যে কোথায় ভেসে গেছে, তার কোনও
সন্ধানই নেই। অতএব কী আর করা। পরস্পর কথা বলবার মতো অবস্থাও আর শরীরে নেই। তাই সবাই
ক্লান্ত শরীরে আর ভগ্ন মনে ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরে চললাম মানস সরোবরের দিকে।
-----
ছবিঃ নচিকেতা মাহাত
দারুণ pastiche
ReplyDeleteসুন্দর গল্প
ReplyDeleteপ্রোফেসর চ্যালেঞ্জারের প্যারোডি হিসেবে লেখা হয়েছিল হেসোরাম হুঁশিয়ার। আর এবার সেটারই প্যাস্টিশ পাওয়া গেল। দারুণ হয়েছে কৃষ্ণেন্দুদা।
ReplyDeleteদুর্দান্ত। আরো হেসো কাহিনী চাই।
ReplyDelete