
বাইকেই
বিষ্ণুপুর বিজয়
মিঠুন
মজুমদার
হোয়াটস্আপে মেসেজ
আসতেই খুলে দেখি অভিষেকের মেসেজ। “কি রে বিষ্ণুপুর যাবি? বাইকে যাব।
হেব্বি মজা হবে।” শুনেই মনটা নেচে উঠল। যেতে তো ভীষন ইচ্ছে করছে। কিন্তু পুজোর পর
হাত তো পুরো ফাঁকা। তাই কিছুটা আমতা আমতা করতেই অভিষেক ও পরে অমিতের আশ্বাসে রাজি
হয়ে গেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে মনের মাঝে ডুগডুগি বাজা আরম্ভ হয়ে গেল। তাই আর দেরি না
করে যাবার দিন আর হোটেল বুকিং নিয়ে আসরে নেমে পড়লাম।
তিনটে হোটেল
আমাদের নজরে থাকলেও শেষে পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তরের কৃষ্ণ বাঁধ কমপ্লেক্সই ঠিক করা
হল। মনে তো ডুগডুগি এমনিতেই বাজছিল। অবশেষে এল সেই দিন। যেন ফাইনাল পরীক্ষার
রেজাল্ট। সে কী উত্তেজনা! আমি তো সময়ের আগেই পৌঁছে গেছি এয়ারপোর্ট দুই নম্বরে। অথচ
আমাকে যে রিসিভ করবে সে কই?
ফোনে জানা গেল, সে
সবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। অগত্যা অপেক্ষা। কিছু সময় পরে এল বাইকার অভিষেক। দেরি
হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করাতে এ যাত্রায় ওকে ছেড়ে দিলাম।
ওদিকে
দুর্গা নগরে আরও দুটি বাইক নিয়ে চারজন তৈরি। সকাল ছয়টায় পৌঁছে গেলাম তাদের কাছে।
মিনিট পনেরো পরে কাগজপত্র,
ব্যাগ, রেইনকোট
নিয়ে দুর্গা দুর্গা করে বেরিয়ে পড়লাম বিষ্ণুপুর ওরফে জয়পুর ফরেস্টের দিকে।
বেলঘরিয়া
এক্সপ্রেসওয়ে এবং এন এইচ টু হয়ে, পরে চন্ডীতলা, নারায়নপুর, গোপালপুর
হয়ে গাড়ি চলল গন্তব্যের দিকে। জ্যাম, ভিড়, সবুজের সমারোহ ভেদ করে আমাদের গাড়ি
চলল আরও আরও দূরে। টানা দু’ঘন্টা পর ঠিক হল ব্রেকফাস্ট করা হবে। তাই ভালো দেখে
একটা হোটেলে গাড়ি দাঁড় করানো হল। জায়গাটা হল বিনোদবাটি। চানামশলা সহযোগে পরোটা উদরস্থ
করে আবার রওনা দিলাম বিষ্ণুপুরের দিকে।


প্রায় সাড়ে
এগারোটা নাগাদ আমরা জয়পুর পৌছে গেলাম। আর রাস্তার দু’দিকে ঘন জঙ্গল আর শাল সেগুনের
সারি মনটাকে পাগল করছিল। এরই মাঝে একটা তাজা মিঠে হাওয়া মনটাকে যেন এলোমোলো করে দিচ্ছিল।
সকলেই বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। মনের মাঝের ইট ভাটায় যেন কেউ শিউলি ফুল ছড়িয়ে
দিয়েছে। বনের মাঝেই আমরা বাইকগুলি দাঁড় করালাম। অনেক ছবি তুললাম। তবে পেটে টান পড়তেই
আর দেরি না করে হোটেলের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
সেখানে
কেয়ারটেকার অর্কদার উষ্ণ অভ্যর্থনায় নির্দিষ্ট মাড হাউসে উঠলাম। হালকা রেস্ট নিয়ে
আমি, অমিত আর অভিষেক নেমে পড়লাম মৎস্যবিভাগের নিজস্ব ঝিলে। বেশ কিছুক্ষণ জলে
কেরামতি দেখানোর পর রুমে ফিরে এলাম। ততক্ষণে দেবা, কুন্ডু, কৃষানুরও
স্নান হয়ে গেছে। আর ওদিকে অর্কদার ডাক পড়তেই ক্যান্টিনে সকলে মিলে চিকেন সহযোগে লাঞ্চ
সারলাম। এরপর শরীরটা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। দিলাম এক নির্ভেজাল জংলি ঘুম। উঠলাম
সাড়ে চারটে নাগাদ। বাকিরাও তৈরি ছিল।
এরপর আমাদের
গন্তব্য বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দির। জিপিএস অন করে পৌঁছে গেলাম মদনমোহন, মুরলীমোহন, রাসমঞ্চ ও
ছিন্নমস্তা মন্দির। যখন ফিরি তখন ভীষন অন্ধকার। জিপিএস-ও ঠিকমতো কাজ করছিল না।
শেষে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে জঙ্গলের প্রারম্ভে আমাদের কমপ্লেক্সে গিয়ে উঠলাম। তখন
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
কিন্তু
চারিদিকে জঙ্গলটিকে যেন এক অন্ধকার গ্রাস করে আছে। অর্কদা প্রথমেই বলেছিল জায়গা
হাতির যাতায়াতের করিডোর। একটু ভয় ভয় উত্তেজনা ছিলই। তা নিয়েই আমরা ছয়টি চেয়ার নিয়ে
বারান্দায় এসে বসলাম।
ততক্ষণে
অর্কদা রাতের খাবারের অর্ডার নিয়ে গেছে। আর আমরা মশগুল হয়ে বসলাম জঙ্গল আর
অন্ধকারের মুগ্ধতায়। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলছিল। আমাদের কথা, শব্দ যেন
পুকুর, ঝিল, জঙ্গল পেরিয়ে
অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
সকালে ঘুম
ভাঙল অভিষেকের ডাকে। তখন সকাল ছ’টা। আকাশ মেঘলা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, দিগন্তবিস্তৃত
জঙ্গল মনটা রিফ্রেশ করে দিল। অভিষেক দুটো চায়ের অর্ডার দিল। চা এল মিনিট পনেরো
পরে। খেয়েই আমরা দু’জন পুকুর পাড়ে বাঁধে গিয়ে উঠলাম। কিছু ছবি তুললাম। ফিরে এসে
দেখি বাকিরা উঠে পড়েছে। সময় তখন সাড়ে আটটা। ব্রেকফাস্টের অর্ডার দেওয়া হল। লুচি আর
ঘুগনি। তৃপ্তি ভরে খেয়ে স্নানে গেলাম। সঙ্গে তৈরি হয়ে নিলাম। ফিরে যাবার বিষণ্ণতায়
আকাশ যেন আরও বেশি ভারী হয়ে উঠেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ও মেঘের আনাগোনা বেড়েই চলল।
তবু তো ফিরতেই হবে ধূলিধূসরিত কলকাতায়।
রেইনকোট পরে
নিলাম। অর্কদার থেকে বিদায় নিয়েই বাইকে চেপে বসলাম। বাইক চলছে শাল শিমুল মহুয়া
সারির বুক চিরে। হঠাৎ নেমে এল মুষল ধারে বৃষ্টি। আর জনশূন্য রাস্তায় আমাদের তিনটি
বাইক নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। আর কানের কাছে কে যেন গেয়েই
চলেছে “আজ মওসম্ বড়া বেইমান হ্যায়, বড়া বেইমান হ্যায়....”।

আমাদের টিমঃ মিঠুন মজুমদার, (বাইকার)
অভিষেক মজুমদার, কৃষাণু
নাথ, (বাইকার)
অমিত রায়, (বাইকার)
দেবাশিস আচার্য, (সহযোগী
বাইকার) শুভজিৎ।
_____
ফোটোঃ
লেখক
No comments:
Post a Comment