
দোলনায় দুলছে দুগ্গা ঠাকুর
অদিতি ভট্টাচার্য্য
বছর কয়েক আগে নবরাত্রির
শুরুতেই পৌঁছেছিলাম নৈনিতালে। নৈনিতাল মানেই সবুজ পাহাড় ঘেরা টলটলে নীল জলের নৈনি
লেক আর লেকের ধারে ছোট্ট সুন্দর নয়না দেবীর মন্দির। সে সব যে কী সুন্দর, কী অপরূপ
সে কী বলব! সেখান থেকে এক সকালে যাত্রা শুরু করেছিলাম রানিখেতের দিকে। রানিখেত
নামের পেছনে আবার লুকিয়ে আছে গল্পকথা। অনেক কাল আগে কুমায়ুনে এক রাজা ছিলেন, তাঁর
নাম শুদ্রদেব। তিনি তাঁর রানি পদ্মিনীর জন্য এখানে তৈরি করেছিলেন এক সুরম্য
প্রাসাদ, এ জায়গা রানির খুব পছন্দের ছিল বলেই। সেই থেকেই নাম হল রানিখেত। রাজা
রানির কাল কবেই হারিয়ে গেছে। বর্তমানে
এটি একটি ক্যান্টনমেন্ট শহর এবং ভারতীয় সেনার ওপর ন্যস্ত এর রক্ষণাবেক্ষণের ভার।
বোধহয় সেই জন্যেই এই শৈল শহরটি যে শুধু সুন্দর তা নয়, অত্যন্ত পরিষ্কার
পরিচ্ছন্নও। রাস্তাঘাট একেবারে ঝকঝকে তকতকে, সব কিছু নিখুঁতভাবে সাজানো।
পাইন, ওকের বনের মাঝে
পাকদণ্ডী দিয়ে গাড়ি চলেছে, মাথার ওপর সূর্য গাছের ফাঁক দিয়ে লুকোচুরি খেলছে। এক
সময় গাড়ি এসে থামল ঝুলা দেবীর মন্দিরের সামনে। জায়গাটা বেশ নিঝুম। চতুর্দিকে উঁচু
উঁচু ঘন সবুজ গাছের ঠাস বুনন। এ জায়গাটার নাম চৌবাতিয়া। ঝুলা দেবী – নামটাও বেশ
অন্যরকম, তাই না? এ নামের পেছনেও রয়েছে এক গল্প। আজ থেকে সাতশো বছর আগে এ অঞ্চল
ছিল ঘন বনে ঢাকা। ছিল বাঘ, চিতাবাঘ আর তাদের শিকার হত আশেপাশের গ্রামের মানুষ আর
গরু, বাছুরের মতো গৃহপালিত পশু। এরকম ক্ষতি কত দিন আর সহ্য করা যায়? নিরুপায় হয়ে
তারা মা দুর্গার কাছে তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করতে লাগল। মা শুনলেন তাদের
প্রার্থনা। এক রাখালের স্বপ্নে দেখা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গা খুঁড়ে তাঁর মূর্তি
বার করতে বললেন। স্বপ্নে দেখা সেই জায়গা খুঁড়ে সত্যিই পাওয়া গেল মূর্তি। তৈরি হল
মন্দির, তারপর সেই মন্দিরে মূর্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত করে শুরু হল পুজো-অর্চনা। হিংস্র
বন্য পশুর হাত থেকে রক্ষা পেল সবাই।
এরপর আর কারও কোনও ভয় রইল না।
রাখালরা নির্ভয়ে গরু-ছাগল চরাত, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলত, গাছের ডালে দোলনা
দুলিয়ে দুলত। দুর্গা ঠাকুর আবার স্বপ্নে দেখা দিলেন, এবার তাঁর ইচ্ছে দোলনায়
দোলার। ভক্তরা গর্ভগৃহে তাঁর মূর্তিকে একটা কাঠের দোলনার ওপর প্রতিষ্ঠিত করল। সেই
থেকে তাঁর নাম হল ঝুলা দেবী। নানান ধরনের মণ্ডপে নানান রূপে, নানান সাজে দুর্গা
ঠাকুর দেখি প্রতি বছরই, কিন্তু দোলনায় দোলা দুর্গা ঠাকুর দেখা এই প্রথম। তাও আবার
পাইন, দেবদারু ঘেরা ঘন নিঝুম জায়গায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আঠারোশো মিটারেরও ওপরে! এও
এক আশ্চর্য ব্যাপার কিন্তু! ভাগ্যিস আমাদের ড্রাইভার অশোক ভাইয়া নিয়ে এসেছিল
এখানে, তাই তো দেখতে পেলাম। অনেকে রানিখেতে এলেও এখানে আসেন না। তবে এখানকার
অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে এ এক উপরি পাওনা। এ অঞ্চলে এখনও চিতাবাঘ ও
অন্যান্য বন্য প্রাণী আছে, কিন্তু মানুষের বিশ্বাস জাগ্রত ঝুলা দেবী এখনও তাদের
রক্ষা করে চলেছেন। মন্দিরের দেওয়ালে, বাইরের পাঁচিলে ঝুলন্ত হাজার হাজার ঘন্টা
তারই প্রমাণ। বর্তমান মন্দিরটি তৈরি হয়েছে ১৯৩৫ সালে। নবরাত্রি চলছিল, মন্দিরে তাই
বেশ ভিড়। সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি মন্দিরের সামনে দিয়ে গেল, দেখলাম আরোহীরা
ঝুলা দেবীর জয়ধ্বনিতে মুখর। চৌবাতিয়া বিখ্যাত আপেল বাগানের জন্যও।
পরবর্তী গন্তব্য রানিখেত গলফ
কোর্স। এটি এশিয়ার সর্বোচ্চ গলফ কোর্স। তথ্যের কচকচানি বাদ দিলে বলতে হয়, মাঝখানে
কালো পিচের চওড়া রাস্তা আর তার দু’পাশে সবুজে সবুজ এই গলফ কোর্স। সত্যিই যেন চোখের
আরাম। কোথাও সমতল, কোথাও উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো, বিশাল তার ব্যাপ্তি। যত দূর দৃষ্টি
যায় শুধুই সবুজ আর তার মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে আকাশের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত
পাইনের দল। রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে চলছিল ছবি তোলা। হঠাৎ কানে এল ঘন ঘন হুইসিলের
আওয়াজ। না, আর থাকা যাবে না, এবার গলফ খেলা শুরু হবে, তাই হুইসিল বাজিয়ে সবাইকে
সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়েই পাততাড়ি গুটোতে হল। একটু মন খারাপ হল বৈকি। এত
সুন্দর একটা জায়গা থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে কারও ভালো লাগে নাকি কখনও!
হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হল।
এবার অপেক্ষা কখন ভোর হবে। সূর্যের আলো এসে পড়বে পর্বত শৃঙ্গ ত্রিশূলের ওপর। হল
ভোর অবশেষে। সূর্য ওঠার আগে থেকেই আমরা ব্যালকনিতে গিয়ে হাজির। আস্তে আস্তে আলো
ফুটতে লাগল আর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশূলও কখনও গোলাপি, কখনও সোনালি হতে লাগল। ধবধবে
সাদা বরফের ওপর থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরোতে লাগল।
সে আলোর খেলা মন ভরে দেখলাম,
তারপর ব্যাগ-সুটকেস গুছিয়ে আবার চেপে বসলাম গাড়িতে। যেতে হবে কৌশানী।

_____
ফোটোঃ লেখক
No comments:
Post a Comment