
লাস্ট ট্রেনের প্যাসেঞ্জার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
রানাঘাট শহরে পোস্টিং হয়ে আসা অবধি
নিয়োগী মোবাইল রিপেয়ারিং সেন্টারে আসাটা প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কলকাতা
থেকে যে মোবাইল নামক বিরক্তিকর যন্ত্রটি কিনে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা মাঝেমধ্যেই
বিগড়োতে শুরু করেছিল। অথচ মোবাইল ছাড়া জীবন এখন অচল। এই যন্ত্রটির মাধ্যমে বন্ধুবান্ধব,
আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখা যেন বাধ্যতামূলক
হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রমাগত মোবাইল পকেটে ভরে ঘুরে বেড়ানো বিরক্তিকর। তার চাইতে আরও
অস্বস্তি হয় যদি সেই যন্ত্রটা গোলমাল করে।
সে যাই
হোক,
প্রথমদিনেই সব চাইতে বিস্মিত করেছিল মোবাইল সারাইয়ের
দোকানের
মালিক স্বয়ং। ভদ্রলোক গোমড়া মুখে কাউন্টারে বসে শুধু বই পড়েন, আজকের দিনে যা এক
বিরল দৃশ্য। নিয়োগী মোবাইল রিপেয়ার সেন্টার, সরু গলির আকারের দোকান।
বড়োজোর লম্বায়
দশ ফুট আর চওড়ায় ছয় ফুট হবে। তারই মধ্যে দুজন কারিগর, কাচের লম্বা শোকেস আর ঢোকার
মুখে কাউন্টারে একজন মালিক। তাই বসার জায়গা পর্যন্ত নেই
খদ্দেরের জন্য। ওরা বোধহয় চায়ও না মোবাইল সারাতে এসে খদ্দের দোকানে ঠেঁই মেরে বসে
থাকুক। তাতে হয়তো ওদের মনঃসংযোগে অসুবিধা হয়।
তৃতীয় বার মোবাইল বিগড়োতে
অফিস ছুটির পর বেশ রেগেমেগে ওদের দোকানে ঢুকেছি। মোবাইলটা কাউন্টারে ফেলে মালিকের
দিকে তাকিয়ে বললাম, “কী সব লোক রেখেছেন মশাই, কিসসু জানে না। দুদিন যেতে
না যেতেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সারাতে না পারলে বলে দিন, গাঁটগচ্চা থেকে অন্তত বাঁচি।”
বই থেকে মুখ তুলে নির্লিপ্ত
দৃষ্টিতে আমাকে দেখে নিয়ে শান্ত গলায় মালিক বলল, “বসুন, দেখছি।”
বসার জায়গা খুঁজছি,
দোকানের ছোকরা কারিগর একটা টুল নিয়ে দেড় ফুটের প্যাসেজে রেখে দিয়ে, কাপড় দিয়ে ধুলো
মুছে দিয়ে বলল, “বসুন।”
আমি সরু প্যাসেজে হাঁটু
সামলে কোনও মতে বসে পড়লাম। হাতের বই কাউন্টারের উপর উলটে রেখে ভদ্রলোক
আমার মোবাইল তুলে বয়স্ক কারিগরটিকে ধরিয়ে দিয়ে নিচু গলায় কী সব
বলল, শোনা গেল না। বইটার শিরোনাম দেখলাম – “একশো এক অলৌকিক গল্প।”
কী আশ্চর্য! মোবাইল সারানোর দোকানের মালিক কিনা
অলৌকিক গল্প পড়ে, তাও এত মনোযোগ দিয়ে? হাতে বইটা তুলে নেব কিনা ভাবছি, তখনি একরাশ
ধুলোর ঝড় দোকানের ভিতরে দুড়দাড়িয়ে ঢুকে পড়ল। রাস্তার ধুলো দোকানের ভিতরে শুকনো
পাতার সঙ্গে উড়ে এল। নাক বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দোকানের দেওয়াল থেকে ক্যালেন্ডার খসে
পড়ল। কর্মচারী দুজন ব্যস্ত হয়ে কাচের টেবিলের উপর থেকে হাওয়ার দমকে মেঝেতে পড়ে
যাওয়া কাগজপত্র, এটা সেটা কুড়াতে লাগল। বুঝতে পারলাম, কালবৈশাখীর দাপট।
দোকানের পাল্লা বন্ধ করে দিতে না দিতেই
কারেন্ট চলে
গেল। বাইরে তখন ঝোড়ো হাওয়া শব্দ করে দরজায় আছড়ে পড়ছে। রাস্তার উপর প্লাস্টিক না
এ্যসবেস্টস, কী যেন খুলে পড়ে খানখান হয়ে ভেঙে গেল। দরজার উপর বৃষ্টির ছাঁট পড়তে লাগল। ওইটুকু দোকানের ভিতর
আমরা চারটে প্রাণী ব্যাটারি চালিত ঢিমে আলোয় বসে। ঘরের ভিতর বৃষ্টির জল ঢুকে এসে
আমার প্যান্টের নিচের প্রান্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে।
কালবৈশাখী আমার বড়ো প্রিয়। কিন্তু অফিস ফেরত মোবাইলের
দোকানের চাইতে নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে, এক কাপ চা হাতে নিয়ে, ঝড় উপভোগ করা অনেক
বেশি সুখকর। কতক্ষণ আর চুপটি করে বসে ঝড়ের দাপট মুখ বুজে সহ্য করা যায়! তাই দোকানের
মালিক নিয়োগী মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ খুললাম, “আপনি অলৌকিক গল্পের বই পড়তে ভালোবাসেন?
আমারও বই পড়ার নেশা আছে। রহস্য রোমাঞ্চ বেশি ভালো লাগে।”
উনি আমার দিকে বইটা
বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “পড়ে দেখবেন? এই বইটা নতুন বেরিয়েছে, ধরলে ছাড়তে পারবেন না।”
বইটা হাতে নিয়ে লেখকদের
নামের লিস্ট দেখতে দেখতে বললাম, “এসব গল্প রাতের বেলা পড়বেন না। পড়লে আর রাতে ঘুম
আসবে?”
নিয়োগীবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার প্রশ্নের
উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ উদাস গলায় বললেন, “সেদিনও ঠিক এমনই ঝড় উঠেছিল, সঙ্গে
বৃষ্টির দাপট। চারিদিক যেন বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে!”
“কোনদিনের কথা বলছেন? কবে
হয়েছিল এমন?”
নিয়োগী বাবু আবার স্তব্ধ।
নিজের মাথার উপর পিছনের দেওয়ালের দিকে তাকাচ্ছেন। আমার দৃষ্টি সেদিকে পড়ল। দেখি দেওয়ালে একটা ছবি
টাঙানো, তাতে বাসি জুঁই ফুলের মালা। ছবির লোকটা খুবই সাধারণ মাপের।
হয়তো কোনও ধর্মীয় বাবা হবে। তবে যত বাবাদের চিনি, তাদের কারও সঙ্গে মুখের
মিল না পেয়ে ভাবছি, কে জানে হয়তো নিয়োগীবাবুর বাবা হতে পারেন। ঠিক তখনি নিয়োগী মশাই
তার মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমার গুরু,
ঈশ্বর দিনু নস্কর।”
নিয়োগী মশাইয়ের গলায় বেশ
সম্ভ্রম ফুটে উঠল। মোবাইলের দোকানের মালিকের গুরু - হতে পারে সে কোনও
গৃহী সন্ন্যাসী। নয়তো ভদ্রলোকের গান বাজনার শখ থাকতে পারে। গানের গুরুর ছবি
টাঙিয়েছেন। কে বলতে পারে, সারাদিন দোকান চালিয়ে সন্ধের সময় ভদ্রলোক হয়তো
কালোয়াতি গান প্র্যাকটিস করেন। মানুষের খেয়ালের তো আর শেষ নেই!
বসে বসে এইসব সাত পাঁচ ভাবছি। বাইরে বৃষ্টিটা বোধহয়
একটু ধরে এসেছিল। হঠাৎ কারেন্ট চলে আসাতে টিউব লাইটের আলোয় ঘর ভেসে গেল। ভাবলাম এবার উঠলে হয়।
নিয়োগী মশাই দোকানের ছেলেগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, “তোরা বাড়ি যা। আজ আর
খদ্দের আসবে না। যা একচোট ঝড় জল হয়ে গেল!” তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন, “আপনাকে
একটা অন্য মোবাইলে সিম ভরে দিয়ে দিচ্ছি। কাল আপনার মোবাইল সারিয়ে দেব। তবে
বৃষ্টিটা এখনও ধরেনি, আর একটু বসে যান।”
নিয়োগী লোকটা বেশ
ইন্টারেস্টিং, কেমন যেন রহস্যে আবৃত অন্য ধরনের মানুষ। তাই ভাবলাম বসেই যাই।
দোকানের কর্মচারী দু’জন দোকানের একমাত্র দরজা খুলে দিতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ছুটে
এসে কেমন শীত শীত করতে লাগল। এই বাদলা সন্ধ্যায় তেলেভাজা আর চা হলে -
আহা, একেবারে জমে যেত।
নিয়োগীবাবু বোধহয় অন্তর্যামী। আসলে ভদ্রলোক বই-টই
পড়েন তো, একটু সেনসিটিভ মানুষ। ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা বার করে ছোকরা কর্মচারীর
দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “চা বলে দিয়ে যা দেখি পাশের দোকানে। আর দেখিস যদি আলুর চপ
থাকে, তাও বলে দিস।”
আলুর চপ আর চা এসে যেতেই
বাইরের বাদলা হাওয়া আরও বেশি মিষ্টি লাগতে লাগল। এই দোকানের ভিতরে কেমন যেন গল্পের
গন্ধ পেয়ে বলেই বসলাম, “নিয়োগীবাবু, আপনার গুরুর কথা বললেন না তো! আর ‘সেদিন’ বলতে
আপনি কোনদিনের কথা বললেন, তাও বুঝলাম না...।”
“বলব বলেই তো আপনাকে
বসালাম। সেদিনও ঠিক এমন বৃষ্টি এসেছিল, আর আমি আমার জিনিসপত্র বোঝাই ঝোলাটা নিয়ে
একবারে কাকভেজা হয়ে গিয়েছিলাম। ভিজে জুবজুবে শরীরে সোদপুর স্টেশন থেকে লাফিয়ে শেষ
ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম। সারাদিনে ছিটেফোঁটা মাত্র বিক্রি হয়েছে। দিনের বেলায়
তাতাপোড়া গরমে একবার এই ট্রেন, তো আর একবার সেই ট্রেন, কিন্তু বিক্রি নেই...।”
আমি বাধা দিয়ে বলে উঠি,
“ট্রেন মানে, আপনি কী...।”
“হ্যাঁ, আমি হকার ছিলাম
ট্রেনের। ভাবছেন, তারপর কী করে দোকান করে বসেছি? সেই কথা
বলব বলেই আপনাকে বসতে
বলেছি। আগে চা আর চপ শেষ করুন, তারপর ধীরেসুস্থে শুনুন।”
সে প্রায় বছর ছয়েক আগের কথা। তপনের শোনপাপড়ি বিক্রি
করতাম ট্রেনে ট্রেনে। তার আগে বেচতাম দিব্যগুরু লক্ষণ মহারাজের মুখশুদ্ধি। প্রথম
প্রথম মুখশুদ্ধি বেশ বিক্রি হত। তারপর বাজার পড়ে যেতে শোনপাপড়ি ধরলাম। প্রতিদিনে
যা রোজগার হত, তাতে বাড়িতে পাঁচ ছয়টা পেট চলা হয়ে উঠল মুশকিল। পুঁজি কম বলে অন্য ব্যাবসায়
হাত দিতে ভয় হত।
সোদপুর স্টেশন থেকে কাকভেজা হয়ে ফিরতি ট্রেনে উঠে
পড়লাম। ওটাই ছিল লাস্ট ট্রেন। একে ক্লান্ত শরীর তার উপর জামাকাপড় ভিজে সপসপ করছে।
ব্যাগের মধ্যে শোনপাপড়ির প্যাকেটগুলো ভিজে গেলেও প্লাস্টিকের মোড়ক থাকায় নষ্ট হতে
পারেনি। ট্রেনের কামরায় উঠে দেখি তার একদিকে মাত্র দু’জন বসে, আর একটা দিক খালি। কোনার দিকে জানলার ধারে
বসে পড়লাম। গায়ের জামাকাপড় ভিজে থাকার জন্য বেশ শীত করছে। জানলার কাচের পাল্লাটা
টেনে নিচে নামিয়ে দিলাম। ট্রেন কেন জানি না খুব ধীর গতিতে চলছিল। বাইরে অন্ধকারের
বুক চিরে বিদ্যুতের ফলা আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে হানা দিচ্ছে। সেই
আলোতে দেখলাম বৃষ্টিটা বেশ জোরেই পড়ছে।
বসে বসে ভাবছি শোনপাপড়ি বিক্রি করার লাইন ছেড়ে দিয়ে
অন্য কিছু করব। লেখাপড়া কিছুদূর করেছিলাম। সংসারের অভাবের তাড়নায় শেষ করতে পারিনি।
আর চাকরি আমাকে দিচ্ছে কে? ক’দিন একটা অফিসে দপ্তরির কাজ করেছিলাম। ঠিকমতো মাইনে
দিত না বলে ছেড়ে দিয়ে ট্রেনে হকারি করা শুরু।
কোন স্টেশন পার হয়ে গেছে লক্ষ্য করিনি। আমাকে যেতে হবে কালীনারায়ণপুর,
রানাঘাট ছাড়িয়ে। চোখ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এসেছিল ক্লান্তিতে। হঠাৎ
ঘুম ভেঙে দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে একটা অন্ধকার মাঠের মধ্যে। গাড়ির ভিতরেও অন্ধকার
ঘুটঘুট করছে। কামরার অন্যদিকে লোকের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ট্রেনের তার ছিঁড়ে
গেছে। এই ঝড় বাদলার রাতে তার ঠিক করে গাড়ি স্টার্ট নিতে অনেক সময় লাগবে বুঝতে
পারলাম। আকাশে তখনও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জানলাটা খুলে দিতে বৃষ্টির হালকা ছাঁট এল। সন্ধে
থেকে একটানা ঝড়জল দেখে বোঝা যাচ্ছে কালবৈশাখী বলে যাকে ভুল করেছিলাম, আসলে সেটা
নিম্নচাপ। মানে সহজে থামার কোনও সম্ভাবনা নেই।
পকেট হাতড়ে মান্ধাতার আমলের মোবাইল বার করে বাড়িতে
খবর দিলাম। তারপর মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ট্রেনের কামরায় চারিদিকে
ঘুরিয়ে দেখি যে দু’জন আগে বসেছিল, তারাও নেমে গেছে। তার মানে, গোটা কামরাতে আমি
একা। অন্ধকারে বসে ট্রেনের গায়ে আছড়ে পড়া বৃষ্টির বাজনা শুনছি। কিছুক্ষণ পর
মনে হল সামনের সিটে আমার সামনে কেউ যেন বসে আছে। মোবাইলের টর্চ
জ্বালাতে যেতেই একটা অস্পষ্ট খসখসে স্বর ভেসে এল, “টর্চটা না হয় থাক। আঁধার আমার ভালো
লাগে...।”
বেশ সুর করে গান গেয়ে উঠল লোকটা। ওটা একটা পুরোনো
আধুনিক গান। লোকটার স্বরে একটা কিছু ছিল, আমার মোবাইল পকেটেই থেকে গেল। জিজ্ঞাসা
করলাম, “কদ্দূর যাবেন?”
“কে জানে কোথায় চলেছি। সেই কবে থেকে চলা শুরু, শেষ
নাই ওরে শেষ নাই...।”
গান ছেড়ে এবার লোকটা কবিতা আওড়াচ্ছে, তাও রবীন্দ্রনাথের!
লোকটা যেইই
হোক, বেশ রসবোধ আছে, এই ঝোড়ো রাতে, তার ছেঁড়া ট্রেনে বসে বসে কাব্যি করছে!
এদিকে খিদের টানে আমার পেট মুচড়ে উঠছে। দুপুরের
দিকে একবার চা পাউরুটি সাঁটিয়েছিলাম দমদম স্টেশনে। তারপর থেকে পেটে ঢোকেনি কিছুই।
সামনে বসে থাকা লোকটার রসবোধ আমার ভিতরে তিলমাত্র রস সিঞ্চিত করতে পারছে না। মাঝে
মাঝে ঝলকে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় অবয়ব দেখে বুঝলাম, উনি চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। তার মুখ দেখব, আলো না
থাকায় তার উপায়ও নেই। মুখ না দেখে কারও সঙ্গে কথা বলা বেশ অস্বস্তির, বিশেষ করে সে যদি অপরিচিত হয়। আলোআঁধারিতে কখনও
তার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে, কখনও মনে হচ্ছে যেন কেউ নেই। অনেকটা সময় কেটে গেল। আবার আমিই
মুখ খুললাম, “মশাই কী ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? আজ রাতে ট্রেন চালু হবে বলে মনে হয় না।
মনে হচ্ছে ট্রেনেই সারা রাত কাটাতে হবে।”
ট্রেনের চালু হওয়া না হওয়া নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই দেখাল
না লোকটা। বলে বসল, “ঝোলায় কী আছে বার কর দেখি।”
খেয়েছে, ছিনতাইকারি নয়তো? আবার ভাবলাম, ছিনতাইকারি
হলে গান আর কবিতা বেরুত না। তাই সাহস পেয়ে বলি, “ঝোলায় আছে শোনপাপড়ি, চলবে নাকি? একটু ভিজে
গেছে প্যাকেটগুলো। তবে উপর উপর। খেতে মন্দ লাগবে না।”
বলেই আমি ঝোলা থেকে একটা শোনপাপড়ির প্যাকেট বার করে
ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নেওয়ার সময় ওর আঙ্গুলটা ছুঁয়ে গেল
আমার হাতের তালুতে। মনে হল যেন বরফে হাত ঠেকে গেল। শিউরে উঠল আমার সারা গা। ভিতরে
একটা কাঁপুনি ধরল। লোকটা শোনপাপড়ি খাচ্ছে কিনা, অন্ধকারে তাও বোঝা গেল না।
কিছুক্ষণ পর আমার পাশে আর একজন কেউ যেন বসে পড়ল বলে
মনে হল। সামনের সিটেও আরও কেউ বসে পড়ল কী? অন্ধকার তাড়াতে পকেট থেকে
মোবাইল বার করবার ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু আমার হাতদুটো যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে।
চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, গলা দিয়ে এতটুকু আওয়াজ বেরোচ্ছে না। আমার শরীরে যেন রক্ত
চলাচল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
“আমরা সবাই তোমার আপনজন। আমরা ট্রেনের হকার ছিলাম
একসময়ে। যখন বেঁচে ছিলাম আমার নাম ছিল দিনু, হকার সমিতির সভাপতি। যারা তোমার পাশে
বসে তারাও সবাই ছিল হকার। কেউ বেচত সেফটিপিনের পাতা, কেউ ফল, কেউ
পঞ্জিকা। তাই এক পরিবারের সদস্যদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।”
প্রথম দিকে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইছিল। আস্তে
আস্তে আমার শরীরে সাড় ফিরে আসতে লাগল। দিনুদার কথা আমার বেশ মনে আছে। হকার সমিতির সভাপতি
দিনুদা শিয়ালদহ স্টেশনের খোলা চত্তরে হকারদের দাবী নিয়ে গলা
ফাটিয়ে যখন বক্তৃতা দিত, তাবড় তাবড় শিক্ষিত লোককেও দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে যেতে হত
দিনুদার কথা শুনতে। তখন তাকে দেখে মনে হত লড়াকু নেতা।
দিনুদা বেচত বাচ্চাদের জন্য লেখা
সুন্দর ছবিওয়ালা বই। বইয়ের বোঝা দুই কাঁধের ঝোলা ব্যাগে ভরে ট্রেনের কামরায় উঠে
সুললিত কণ্ঠস্বরে শুরু করত তার ভাষণ – “এই যে দাদারা দিদিরা, বাড়ির কচিকাঁচাদের
জন্য নিয়ে যান সুন্দর সুন্দর সব গল্পের বই। আপনার বাচ্চা যত বই পড়বে, ততই খুলবে
তার মগজের তালা। শুধু পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করে ওরা পরীক্ষায় পাশ করে যাবে, কিন্তু জীবনের
পরীক্ষায় গো হারা হেরে যাবে। আমার ঝোলায় আছে রূপকথা, আছে রহস্য রোমাঞ্চের
চাবিকাঠি, আছে মানুষ গড়ার কারিগরদের বিচিত্র কাহিনি। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখুন। কিনতে বলছি না। পছন্দ
হলে বলতে পারেন, সব বইতে ডিস্কাউন্ট কুড়ি পারসেন্ট। ট্রেনের যাত্রীদের জন্য
আরও পাঁচ দিয়ে দিচ্ছে আমার ডিস্ট্রিবিউটর। আরও আছে - আমার নিজের তরফ থেকে দেব আরও
পাঁচ পারসেন্ট। তাহলে কত হল? তিরিশ পারসেন্ট। দাদারা দিদিরা, মাসিমা
পিসিমা, নিয়ে যান সস্তায় বাচ্চাদের মানুষ করে তোলার হাতিয়ার – বই।”
দিনুদার কথার যাদুতে বই বিক্রি হয়ে যেত। হকারদের
মধ্যে নানা ধরনের লোক থাকে। পাজি লোকজনেরা বলে বেড়াত, দিনুদা নাকি অনেক টাকা পয়সা
করেছে বই বিক্রি করে। কিন্তু দিলদরিয়া দিনুদা সবার দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়াত। ব্যাবসা
ভালো না চললে বুদ্ধি দিত, অর্থসাহায্যও করত। তাই দিনুদার জনপ্রিয়তাকে অন্য কেউ
ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। দুর্ভাগ্যজনক এক দিনে দিনুদা বইয়ের বোঝা নিয়ে থেমে থাকা দুই ট্রেনের
একটা থেকে আর একটায় লাফ দিতে গিয়ে পড়ে যায় দুই ট্রেনের মাঝখানে। মাথায় আঘাত পেয়ে
ঘটনাস্থলেই দিনুদার মৃত্যু হয়। আমি দিনুদাকে চিনতে পেরে বলি, “দিনুদা, আমি আপনাকে
চিনতাম। আমার যখন মুখশুদ্ধির বিক্রি মন্দার দিকে তখন আপনি আমাকে শোনপাপড়ি বিক্রির
পরামর্শ দিয়েছিলেন।”
দিনুদা যেন অল্প একটু হাসল বলে মনে হল। তারপর দৈববাণীর
মতো তার কাছ থেকে আদেশ এল, “কাল থেকে এই লাইন আর নয়। মোবাইলের দোকান খুলে ফ্যাল।
ভালো চলবে।”
“কিন্তু দিনুদা অত পুঁজি কোথা থেকে পাব? এমনিতেই
আমার সংসার চলে না...।”
“চলবে, এখন থেকে চলবে। আমার উপর ভরসা রাখ।”
“দিনুদা, তোমার পা থাকলে জড়িয়ে ধরতাম। হাত তুলেই নমস্কার করি।
তুমি যখন বলেছ, উপায় একটা হবেই।”
আবেগের বশে আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছি। শুধরে
নেওয়ার সুযোগ হল না। আচমকা ট্রেনের কামরায় আলো জ্বলে উঠল। ট্রেনের মোটরের ঘড়ঘড়
আওয়াজে গোটা ট্রেনটা জেগে উঠল যেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি ট্রেনের
কামরা যেন ফাঁকা মাঠ। আমি একাই বসে আছি। আমার ঝোলা মাটিতে পড়ে। ঝোলা খালি মনে হল। সব
শোনপাপড়ি দিনুদা তার দলবল সমেত নিয়ে চলে গেছে। তখনও কেমন ঘোর লেগে আছে। ভাবছি আমি নিশ্চয়ই
ঘুমিয়ে পড়ে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু না, ভুল ভাঙল ট্রেনের মেঝে থেকে ঝেড়েঝুরে
ঝোলা কোলে তুলে নিতে গিয়ে। ভিতরে হাত দিয়ে দেখি একতাড়া নোট, অনেক
টাকা। আমার তখন হাত কাঁপছে। নোট গুণে দেখার সাহস হল না, যদিও
ট্রেনের কামরায় আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না কেউ।
নিয়োগী মশাই একটানা কথা বলতে বলতে হঠাৎ
থেমে গেলেন। আমি ধৈর্য রাখতে না পেরে বললাম, “এ তো অলৌকিক ব্যাপার মশাই।
তারপর কী হল?”
আমার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট এসে যাওয়ায় দোকানের সব আলো জ্বলে উঠল। ভদ্রলোক
যেন স্বপ্ন ভঙ্গ করে সবে ঘুম থেকে উঠে এই আমাকে দেখলেন। ওনার চাহনিতে এমন কথাই
ফুটে উঠল। কাউন্টার ছেড়ে উঠে গিয়ে বাইরে বৃষ্টির ধার বুঝে দেখবার জন্য হাত বাড়িয়ে
নিয়োগী মশাই বললেন, “বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। আকাশে প্রচুর মেঘ। এবার উঠে পড়ুন, চলি।
এখন না বেরোলে বৃষ্টি জোরে আসবে, তখন বাড়ি ফেরা মুশকিল হবে।”
“সে তো হবেই। কিন্তু
গল্পটা শেষ করলেন না যে...!”
“শুনবেন? তাহলে বলি। পরদিন
সকালে ধীরেসুস্থে ঘরের দরজা বন্ধ করে গুণে দেখি এক লাখ তিরিশ হাজার টাকা। প্রথমে
ভাবলাম বইয়ের দোকান খুলব রানাঘাটে। তারপর মনে হল, যদি বই বিক্রি না হয়। দিনুদা
বলেছিল মোবাইলের দোকান খুলতে। ভেবে দেখলাম, আজকাল মোবাইল সবাই অনলাইনে কেনে। তাই
বিজনেস লাটে উঠতে পারে। তখন এই দোকানটা ভাড়া নিই আর মোবাইল রিপেয়ার সেন্টার খুলে
ফেলি। মোবাইলের কাজ তো আর শিখিনি, তাই দুটো কারিগর রেখে নিয়েছি। আগে একজনই ছিল।
কাজের লোড বাড়তে, বাড়তি আর একজনকে রাখতে হয়েছে। দিনুদার দয়ায় মন্দ চলছে না। কাজকর্ম
কিছু করি না, তাই বই পড়ে সময় কাটাই। দিনুদা যে ধরনের বই বিক্রি করত, ঠিক সেই ধরনের
বই প্রথম প্রথম পড়তে শুরু করি। একসময় কেমন যেন নেশা ধরে গেল। জানেন, এবার ভাবছি কলম
ধরব। অনেক গল্প লিখব ছোটোদের জন্য। সে সব বই হয়ে বেরোবে। পড়ার বইয়ের পাশে সেই সব
বই পড়ে কচিকাঁচারা সব মানুষ হয়ে উঠবে। দিনুদা আশীর্বাদ করবে অলক্ষ্যে।”
নিয়োগী সাহেবের
নজর এড়িয়ে টুক করে দিনুদার ফটোর দিকে আমিও দুই হাত জড়ো করে নমস্কার সেরে নিলাম।
বলা যায় না, আমার উপর যদি কৃপা দৃষ্টি পড়ে যায়!
_____
অসাধারণ লিখেছেন গল্পটা। খুব ভালো তার সাথে সুমিতদার অলংকরণ। ফাটাফাটি
ReplyDeleteধন্যবাদ রুমেলা
ReplyDeleteKhub khub sundor laglo.
ReplyDeleteduto jaigate amar ektu doubt hochhe amar vul o hoye pare
1.jojhon niyogi Babu sodepur theke train e Uthe ghumiye porechilen r ghumiye theke Uthe andhokare ulto diker dujon passenger er Kotha sune bujhte parlen overhead tar chire geche ebong train Mather majhe dariye.tarporei mobile er aloi r dekhte pelen Na.onara to manush ei chilen bhut chilen Na.ei jaigata amar ektu kmon laglo.r
2.jokhon niyogi Babu cha r chop ante bollen tokhoni current chole esechilo tarpore to r loadshedding houar Kotha bola hoyni to Abar ki kore last e current elo.
গল্পে একবার লোডশেডিং হয়েছে, দু'বার কারেন্ট এসেছে। অলৌকিক গল্পের ওইটাই তো মজা। :-) নইলে অলৌকিক কী হল!
Deleteবা:
Deleteapurbo
ReplyDeleteKoustav babur je duto khotka legeche, thik sei dutoi amar o mone legeche.
ReplyDeleteভাবছি এবার থেকে লাস্ট ট্রেনেই ফিরব ...... আর কিছু না হোক দিনুদার কল্যানে অনেক বই পড়া যাবে ... হে হে
ReplyDeleteনৈহাাটী লোকাল শিয়ালদা থেকে!
Deleteভালো লাগলো সুন্দর লিখেছেন
ReplyDeleteধন্যবাদ
DeleteArup,Ian muktadi from nandapalli, .naihati.me mini and you were childhood friends.do you recognise me?your creation is good and enjoyable.
Deleteতোমার ফোন নং দাও আমার ইনবক্সে।
Deleteএকটি সুন্দর বর্ণনা শক্তির সার্থক লেখন এই গল্পটি। এইখানে অশরীরী টাকা দিয়ে গেছে, কিভাবে বা কোথা থেকে সেটা থাকলে ভালো হত। আরও একটি খটকা আমার মনে। এটি অলৌকিক গল্পের সংখ্যা কাজেই আপনার গল্পের বিষয়বস্তু অলৌকিক। আমি খুব সামান্য আবছা আবছা জানি এই বিষয়ে। অলৌকিক ক্ষমতা বা শক্তি হল কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে সাধনা বা ধ্যান মাধ্যমে সাধারণ সাধক তার কাছে এলে সেই শক্তির কাছ থেকে কোনো বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতা বা বরদান পায়। যেমন দুরারোগ্য রোগ সারিয়ে ফেলা,আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করা যেমন ইচ্ছাশক্তির দ্বারা স্পর্শ না করে দূর থেকেই লোহার রডকে বাঁকিয়ে দেয়া, চারদিকে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু সেই অল্পজায়গাতে বৃষ্টি হচ্ছে না এই রকম সব ঘটনা। কিন্তু আপনার গল্পে আছে অনেকটা ভুতের রাজা দিল বর এই টাইপের। যদি এমন হত তার পরদিন কোনো ব্যক্তি নিজে থেকে অতি স্বল্প মুল্যে কিম্বা দীর্ঘমেয়াদি অতি অল্প কিস্তির ধার দিচ্ছেন এইরকম কিছু তাহলেও এটি অলৌকিক বলে মেনে নেওয়া যেত।
ReplyDelete