
গোঁফ-দাড়ির জঙ্গলে
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ
ম্যাজিক ল্যাম্প তো কিশোরদের
জন্য আর কিশোর মানেই তাদের হালকা হালকা গোঁফ-দাড়ির রেখা দেখা দিচ্ছে। অনেকের তো
মনটা ছটফট করছে কবে বাবার শেভিং সেটটার দখল নিতে পারবে। গোঁফ-দাড়ি কিন্তু ভারি
শখের জিনিস। গোঁফ চুরি গেছিল বলে হেড অফিসের বড়বাবুর যে মাথা খারাপের জোগাড় হয়েছিল
তা তো সবাই জান। দাড়ি-গোঁফ কিন্তু সব ছেলের কপালে জোটে না। অনেকের তো দাড়ি-গোঁফ
বেরোয়-ই না। বাংলায় তাদের বলে মাকুন্দ। দাড়ি বললেই
নিশ্চয় তোমাদের চোখের সামনে কবিগুরুর শ্বেতশুভ্র দাড়িশোভিত মুখমন্ডলটি ভেসে ওঠে আর
গোঁফের কথা উঠলেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির সাথে চার্লি চ্যাপলিনের কথা ভাবো। আজ আমি
তোমাদের গোঁফ-দাড়ি সংক্রান্ত কিছু মজার তথ্য জানাব।
তোমরা তো ম্যাসিডনের সম্রাট
আলেকজান্ডারের নাম সকলেই জানো, কিন্তু একটা খবর কি জানা আছে যে তিনি তাঁর সব
সৈনিকদের দাড়ি কামাতে বাধ্য করেছিলেন কারণ তাঁর নিজের দাড়ি খুব একটা দৃষ্টিনন্দন
ছিল না! আরও একটা মজাদার কারণ ছিল আলেকজান্ডারের এরকম আদেশের পেছনে। তাঁর ধারণা
ছিল যে সৈনিকদের লম্বা দাড়ি থাকলে শত্রুপক্ষের সৈন্যরা তাদের দাড়ি ধরে কাছে টেনে
নিয়ে সহজেই ছুরিকাঘাত করতে পারবে। গ্রিকদের আবার বেশ কোঁকড়ানো ধরনের দাড়ি খুব
পছন্দের ছিল। গ্রিকদের কথা বলছি যখন রোমানদের
কথা তো বলতেই হয়। প্রাচীন কালে রোমান দার্শনিকরা আবার প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দাড়ি
রাখতেন। এই দাড়ির রকমফের দেখেই বোঝা যেত কে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।
ভাবো একবার, একটা স্কুল কী কলেজের মাস্টারমশাইরা সবাই একরকম
দাড়ি নিয়ে ঘুরছেন, কল্পনা করলেও তো আমার হাসি পাচ্ছে। রোমান সম্রাট
প্রথম ফ্রেডরিকের পদবিই ছিল বারবারোসা বা লাল দাড়ি। এবার যাওয়া যাক মমির
দেশ মিশরে। তোমরা ভাবো চুলে বিভিন্ন রং করা আধুনিক কালের ফ্যাশন, কিন্তু
জানো কী প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা দাড়িতে রং করতে ভীষণ ভালোবাসতেন। তখন তো এত সব
ব্র্যান্ডেড কালার ছিল না, তাই হেনা দিয়েই তাঁরা শখ পূরণ করতেন। মিশরীয় রানি
হাটসেপশুট পুরুষের বেশে প্রায় একুশ বছর রাজ্য শাসন করেছিলেন। তাঁর ছদ্মবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ
ছিল একটি নকল ধাতব দাড়ি। রাশিয়ার গল্প আবার আরও মজাদার। রাশিয়ান জার পিটার দ্য গ্রেট
দেশের মানুষদের আধুনিক করার উদ্দেশ্যে সকল পুরুষদের দাড়ি কামানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন।
দাড়ি রাখতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের টাকা দিয়ে তামা অথবা রুপোর টোকেন কিনতে হত। টোকেনের
দাম আবার পেশা অনুযায়ী বিভিন্ন হত। বুদ্ধিজীবী এবং সরকারি অফিসারদের জন্য ষাট রুবল, প্রথম
সারির ব্যবসায়ীদের জন্য ছিল একশ রুবল। শহরের রাস্তায় কোনও দাড়িওয়ালা লোক গেলেই
তাঁকে টোল দিতে হত। দাড়ির জন্য টোল, ভাবা যায়! 1535 খ্রিস্টাব্দে
ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি প্রজাদের দাড়ির ওপরে কর বসান, যদিও তাঁর নিজেরও দাড়ি ছিল।
তিনিও পেশার ওপর ভিত্তি করে কর নির্ধারণ করতেন। তাঁর কন্যা প্রথম এলিজাবেথও এই কর
বজায় রেখেছিলেন। তবে রাশিয়ান জার তৃতীয় আলেকজান্ডার, ফ্রান্সের
রাজা তৃতীয় নেপোলিয়ন, জার্মানির রাজা তৃতীয় ফ্রেডরিক, ভারতবর্ষের
মুঘল সম্রাটরা প্রত্যেকেই গোঁফ-দাড়ি রাখতে বেশ পছন্দ করতেন। ভারতবর্ষের মারাঠা
শাসকরা আবার বেশ শৌখিন একখানা গোঁফ রাখতেন। নানাসাহেব, পেশোয়া বাজিরাওয়ের ছবি দেখলেই
বুঝতে পারবে।

বিভিন্ন খেলোয়াড়দের মধ্যে
আবার দাড়ি-গোঁফ নিয়ে মজাদার সব কুসংস্কার আছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য 1976 সালে
উইম্বলডনের চারদিন আগে সুইডিশ কিংবদন্তি বিয়র্ন বর্গ হঠাৎ
ঠিক করেন যতক্ষণ তিনি টুর্নামেন্টে টিকে থাকবেন ততক্ষণ দাড়ি-গোঁফ কামাবেন না।
ফাইনালে আরেক কিংবদন্তি জন ম্যাকেনরোর কাছে হারার পর তিনি গোঁফ-দাড়ি কাটেন। আবার আমেরিকান
পেশাদার বেসবল প্লেয়ার ব্রায়ান উইলসন 2010 সালে পণ
করে বসেন যতদিন তাঁর টিম সানফ্রানসিস্কো জায়েন্ট ওয়ার্ল্ড সিরিজে টিকে থাকবে ততদিন
তিনি দাড়ি-গোঁফ কামাবেন না। ব্রায়ানের দেখাদেখি তাঁর ভক্তকুলও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে
শুরু করে। কিছু অত্যুৎসাহী ভক্ত তো আবার নকল দাড়ি-গোঁফ লাগাতে আরম্ভ করে। তোমরা যে
বিরাট কোহলির দাড়ি বেশ পছন্দ কর তা আমি বিলক্ষণ জানি।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের গোঁফপ্রীতির নানা মজার মজার ঘটনা শোনা যায়। প্রখ্যাত চিত্রকর সালভাদর দালি তাঁর মোম
বাঁধানো গোঁফটিকে বলতেন ব্যক্তিগত রেডার। জর্জ বার্নার্ড শ আবার মুখের বসন্তের দাগ
লুকোতে দাড়ি রাখতেন। কিউবার প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোকে তাঁর
অনুরাগীরা আদর করে এল বাবুর্ড বা দাড়িওয়ালা বলে ডাকেন। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদির দাড়িশোভিত চেহারাটি তো সবার পরিচিত। হিটলার আর চার্লি চ্যাপলিনের যে গোঁফ
দেখে আমরা অভ্যস্ত তাকে বলে টুথব্রাশ গোঁফ। এই স্টাইলের বিশেষত্ব হল ঠোঁটের
মধ্যবর্তী অংশে তিন থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার গোঁফ রেখে বাকি অংশ কেটে ফেলা হয়।
ইউরোপের নামি চিত্রকর ভ্যান্ডাইকের দাড়ির মতো দাড়ি আবার ভ্যান্ডাইক
দাড়ি নামে খ্যাত। জানা আছে কী গাল ভর্তি দাড়ি যখন কুচো মাংসের মতো দেখতে হয় তাকে
বলে মাটন চাপ দাড়ি। একটা হাসির কথা বলি - একরকম পেয়ালা পাওয়া যায়, তাতে
অর্ধেক ঢাকনা দেওয়া থাকে যাতে চা পান করার সময় চায়ে গোঁফ না ডুবে যায়। এই পেয়ালাকে
গোঁফ পেয়ালা বলা হয়। একটা কথা জেনে রাখো, সকালে দাড়ি কামানোর পর
বিকেলে যে আবছা দাড়ি দেখা যায় তাকে বিকেল পাঁচটার ছায়া বলে।
আমার বীরপুরুষ কিশোর বন্ধুরা
অনেকেই যে টিকটিকি, আরশোলা দেখলে আতঙ্কে বাড়ি মাথায় কর তা আমি জানি, কিন্তু
তোমরা জানো কি অনেক মানুষ দাড়িকে ভয় পান! দাড়িওয়ালা কোনও মানুষ
কাছে চলে এলে তাঁদের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, রীতিমতো
অসুস্থ বোধ করেন তাঁরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগের নাম পোগনো ফোবিয়া। গ্রিক
ভাষায় পোগনো মানে দাড়ি আর ফোবস মানে ভয়। আবার যাদের অতিরিক্ত গোঁফ-দাড়িপ্রীতি
তাদের বলা হয় পোগনোফিলিক।
পৃথিবীতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে
প্রতিযোগিতা হয়, তো গোঁফ-দাড়ি নিয়েও হবে এ আর বিচিত্র কী! 1970 সালে
প্রথম দাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় উত্তর ইটালিতে। তারপর 1990 সালে
জার্মানির হফনার বিয়ার্ড ক্লাব দাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। 2004 সালে তৈরি
হয় World beard and Moustache Association। 2007 থেকে শুরু
হয় World beard and Moustache Championship। প্রতি দু’বছর অন্তর
বসে এই প্রতিযোগিতার আসর। 2013 সালে আবার জার্মানিতে হয়েছিল
world Beard and Moustache Championship, এখানে
একলা ইউ.এস.এ টিমই দশটি ট্রফি জিতেছিল। গোঁফ, আংশিক দাড়ি, পুরো দাড়ি
এই তিন বিভাগের ওপর ভিত্তি করে প্রতিযোগিতা ছিল। মূলত তিনটি বিষয় দেখা হয় - গোঁফ-দাড়ির
স্টাইল, ব্যক্তিত্ব আর সামগ্রিক উপস্থিতি। তবে নকল
গোঁফ-দাড়ি নৈব নৈব চ। 2017 সালে টেক্সাসের অস্টিনে বসেছিল
এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড়ো প্রতিযোগিতা। তেত্রিশটি দেশের মোট 738 জন
প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিলেন। 2019 সালে বেলজিয়াম আর 2021 সালে নিউজিল্যান্ডে বসবে এই
আসর। তাহলে বন্ধুরা, ইচ্ছে যদি থাকে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার, এখন থেকে
লেগে পড়ো গোঁফ-দাড়ির জঙ্গল তৈরি করতে। আমার শুভেচ্ছা রইল তোমাদের জন্য।

ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment