
গাঙ্গুলিবাবু
প্রতীক কুমার মুখার্জী
নেপালের ক্যাসিনোর সিঁড়িতে হ্যাট-টাই-কোটে সজ্জিত গাঙ্গুলিবাবু যখন এক বিদেশিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়েই মুখে
লাখ টাকার হাসি এনে 'হে-হে-এক্সকিউজ মিইইইই!!!' বলে সামাল দেন, তখন প্রতিটি
বাঙালীর মুখে হাসির সঙ্গে সঙ্গেই মনে উঠে আসে গভীর প্রশান্তি। কী
ব্যাপার - না স্বল্প পরিসরে থাকা আটপৌরে লেখক, যার বিদ্যাবুদ্ধি একেবারেই হিংসা
করার মতো নয়, বিশ্বদরবারে বাংলার মুখ
রাখতে সমর্থ এ যাত্রায়। সেই লোকই যখন ছোট্ট বাক্সে করে
আমসত্ত্ব নিয়ে গিয়ে কাস্টমস-এর হাতে
ধরা পড়ার ভয়ে তোপসের শরণাপন্ন হন, তখন কী মজাই না লাগে! আরে এই লোকটা তো একেবারে
আমাদেরই মতো! প্রতিটি পাঠক যেন এই অবস্থার সঙ্গে নিজের জীবনের বা পরিচিত কারও, কোনও না কোনও অবস্থার মিল পান। আর সেটাই পাঠকের মনের ভিতর থেকে বার করে আনে হাসি আর আনন্দ।
আবার যখন নকল জপযন্ত্র দিয়ে 'ঠকাস' করে মোক্ষম আঘাতে শূকর গলি অভিযান সফল করেন তিনি, বা ব্যুমেরাং-এর 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'-এ
ধরাশায়ী করেন শত্রুকে, অজান্তে নিজের মনেই একটা সন্তুষ্টি জেগে ওঠে - যাক বাবা, জটায়ু একাধারে ফেলুদা, তোপসে থেকে শুরু করে আপামর
বাঙালী জাতির 'ভেতো' বা 'ভীতু' দুর্নাম ঘোচালেন।
হাসির উদ্রেককারী ঘটনা সবই, কিন্তু সেগুলির মধ্যে কোথা
দিয়ে যেন জিতে যাই আমরা। প্রবল বিক্রমে ওই
ক্ষুদ্রদেহে কোট আর ধুতি পরে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে যাওয়ার ছবি পাঠকের চোখের সামনে
ভেসে উঠতেই আরেক দফা হাস্যরোল - চোরাগোপ্তা আক্রমণ সেরে দুবলা বাঙালীর পিঠটান! প্রমাণ হয় বারবার বাঙালী আর যাই হোক, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরিয়ে
দিতে জানে দু’ঘা।
ঠিক এভাবেই আমাদের নানান সিরিও কমিকাল ঘটনা ও উপঘটনার ভিতর দিয়ে
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন সত্যজিৎ বাবু। নামটাই
ধরা যাক - লালমোহন গাঙ্গুলি। কী মনে হয় শুনে? বাংলার বিখ্যাত লালচে, গোলগাল রসে
টইটম্বুর মিষ্টি লালমোহন বা পান্তুয়ার কথা, যা আদ্যোপান্তভাবে জড়িয়ে বাঙালীর চিরসবুজ রসনার সঙ্গে। নাম শুনেই লোকে ধারণা করে নেন মানুষটার নরমসরম ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে, আর
তাই মগনলালের মতো পোড় খাওয়া দুষ্টুলোকও কখনও তাঁকে বানায় বুড়ো থুরথুরে অর্জুনের ড্যাগারের নিশানা, কখনও চিনিতে ড্রাগ মিশিয়ে অপদস্থ করে। বেচারি স্বতন্ত্র ভদ্রলোককে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াতেও ছাড়েনি বদমায়েশ
ডাকু গন্ডারিয়া। ফেলুদাও ভাবতে বসেন, মগনলাল কী ভাবে
মানুষের দুর্বলতা ধরে ফেলে? পাঠক এসব দেখে হাসেন ঠিকই, কিন্তু পুরোটা সময়
লালমোহনবাবুর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে রিলেট করেন, আর তাই জটায়ু হয়ে ওঠেন নিশ্ছিদ্র
হাসির এলিমেন্ট - নিছক ভাঁড় হয়ে থেকে যান না।
তাঁর
'জটায়ু' নামটিও যেন ব্যক্তিত্বের
একদম পরস্পরবিরোধী - তাঁর কাজকর্ম একেবারেই জটায়ুর সাহসিকতার সঙ্গে যায় না। নিরীহ, ভীতু ভদ্রলোকটির যত মস্তানি তাঁর লেখনীতে। সেখানে নিজের মনের অবদমিত উচ্চাশাগুলি পূরণ করে তাঁর 'নেমসেক' প্রখর রুদ্র, এবং মাঝে মাঝে তাঁর কাণ্ডকারখানা এতটাই অতিরঞ্জিত,
যে ফেলুদার গাম্ভীর্যও 'খান খান' হয়ে খসে পড়ে। অদ্ভুত সমস্ত তথ্য দিয়ে তিনি 'উটের পাকস্থলী'
মার্কা মশলা মাখিয়ে তৈরি করেন 'হট কচাউরিস', পরে যা ফেলুদার হাতে পড়ে সংশোধিত হয়
পরের সংস্করণে। সেখানে যথাক্রমে পাঠক অবাক
হন, ভাবেন আর শেষে গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করেন - শেষে জয় হয় আবার সেই হাসির, আর ভদ্রলোককে ভালো না বেসে থাকা যায় না।
সিনেমার পরদায় ট্রেন কানপুরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা প্রতিটা মানুষ নড়ে
বসি কোট, সবজে মাফলার, ধুতি, আর জাপানী
সুটকেসের মালিককে দেখার উদগ্র বাসনায়। 'শর্ট, বল্ড এন্ড মুস্টাচ' সম্বলিত ছোটোখাটো
মানুষটা কামরায় ঢোকা মাত্র 'ইম্পোরটেড' জিনিসের প্রতি অপত্যস্নেহ থেকে কুলিবিদায়ের স্টাইলে, নিজের 'পটভূমিকা' জানাবার অননুকরণীয় স্টাইলের ভিতর দিয়ে সকল লাইমলাইট সটান
নিজের উপর টেনে নিলেন। মেড ইজি পুষ্ট
হিন্দিতে গড়পারের ঠিকানা দিয়ে বাঙালীদের দল ভারী করে ফেললেন
অচিরেই, কোথায় যেন ম্লান করে দিলেন ফেলুদার রেজর শার্প
ব্যক্তিত্ব! উলটোদিকের মাড়োয়ারি ভদ্রলোক তো মাথা নেড়েই সবটা ম্যানেজ করলেন। নিজের
গল্পের নায়কের ডাইমেনশন জানিয়ে ফেলুদার অপরিসীম 'সেন্স অফ হিউমার'-কে কাউন্টার করেন যে সপ্রতিভতার সঙ্গে, তার ভিতর পরতে
পরতে হাসি থাকলেও সেটার ভিতরে 'মস্তিষ্কের পুষ্টির' জোগান প্রচুর।
এ ছাড়াও অনেক ছোটো ছোটো ঘটনা, যেমন এথিনিয়াম ইন্সটিটিউশনের শিক্ষাপুষ্ট লালমোহনবাবুর কাছে
কবিত্বের শিখরে বসা বৈকুন্ঠ মল্লিকের অপরিণত কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব, নিজের নতুন বই-এর
অনুপ্রাসের ঝংকার সম্বলিত নাম ঠিক করার চমক,
হাসির ফোয়ারা ছোটায়। প্রচণ্ড বিপদের সময়ে গাঙ্গুলিবাবুর অদ্ভূতুড়ে আচার
আচরণ আমাদের হাসতে বাধ্য করায়, যেমন জং বাহাদুর রানার ভোজালি চুরি হয়ে যাওয়ার পরও উনি
নিশ্চিন্তভাবে জানান যে শুধুমাত্র খাপটি অবশিষ্ট! 'রয়াল বেঙ্গল রহস্যে' কালান্তক বাঘের সামনে গাছে উঠে তিনি
এমনভাবে সংজ্ঞা হারান, যে গল্পের ওই ভয়ানক ক্লাইম্যাক্সে এসেও পাঠকের মন পড়ে থাকে তাঁর দিকে - ওনার যেন কোনও ক্ষতি না হয়। আগাগোড়া টানটান, সিরিয়াস
অপরাধ ও অপরাধতত্ত্বের ঘোরপ্যাঁচের ভিতরও সবার প্রিয় 'লালুদা' সযত্নে লালিত হতে
থাকেন।
চূড়ান্ত কনফিউজড সিচুয়েশনে তাঁর মুখ থেকে যখন বেরিয়ে আসে অদ্ভুত কিছু শব্দ -
'বেংগুর', 'হাঁয়েস' 'ইনপ্রমপচু' তখন হাততালি
দিয়ে, পায়ে তাল ঠুকে হাসতে দেখেছি পাঠককে, আর এখানেই সত্যজিৎ সাহেবের মাস্টারস্ট্রোক। 'নিজেদের মধ্যেই একজন' হয়েই আদর ও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন গাঙ্গুলিবাবু, কখনোই
তিনি 'লারজার দ্যান লাইফ' হয়ে ওঠেননি। সাধারণ বাঙালীর মতোই তাজমহল, কাশ্মীর, পুরী
দেখে তাঁর অভিব্যক্তি, আর হংকং-এ গিয়ে স্নেক স্যুপের কথা শুনে, বা লন্ডনে হ্যারডস-এ গিয়ে পেন কিনে, বা নেপালে জ্যাকপট জিতে তাঁর মধ্যে দিয়ে জয়ী হয়েছে কে? প্রতিটি
বাঙালী - স্বপ্নের ও তথ্যের ভরপেট ভুরিভোজের পর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে পাঠক ফেলুদার ক্যারিশমা তো বটেই,
তার সঙ্গে জটায়ুর দীর্ঘজীবন কামনায় দিন কাটিয়েছে। বিটকেল জাপানি হর্ণ, গাঢ় সবুজ গাড়ি, মশলাদুরস্ত
বেস্টসেলারের মালিক অবশ্য দিনের পর দিন ফেলুদার সঙ্গে থেকে কিছুটা পরিশীলিত
হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বভাব রয়ে গেছিল একইভাবে 'অনাড়ম্বর', তা কোনোদিন বিন্দুমাত্র পাল্টায়নি।
শুধু 'দেখতেন' তিনি, 'লক্ষ' করতেন না – এই দোষে ফেলুদার কাছে অনেকবার বকুনি খেয়েছেন তিনি, কিন্তু
দমে যাননি। মনখারাপ করতেন না তিনি, বরং দু’গুণ আগ্রহে লাফিয়ে পড়তেন নতুন কিছু শিখতে। আসলে সত্যজিৎবাবু ওনার চোখ দিয়ে পাঠককে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতেন, বুঝিয়ে
দিতেন, আর গাঙ্গুলিবাবুর অদ্ভুত অভিব্যক্তি বা অবস্থাগুলি যেন আমাদের না হয়, তারও
পুরোপুরি ব্যবস্থা করে দিতেন তাঁর অত্যাশ্চর্য লেখনীর ভিতর দিয়ে। মগনলালের বাড়িতে পেস্তার সরবত বিষের ভয়ে মুখে তোলেননি লালমোহনবাবু। কিন্তু 'তেরা নম্বর বক্সা' আর কিম্ভূতকিমাকার
'তখত'-এর সামনে দাঁড়িয়ে একটা গোটা মিনিট
চেয়েছিলেন তিনি। ঘড়ি, মানিব্যাগ, এমনকি মগনলালের আস্ত ফুলদানিটাও সরিয়ে দিয়েছিলেন। পরক্ষণেই ঢকঢক করে শেষ করেছিলেন সেই সরবতের গ্লাস। এটা দেখে কারও মুখে হাসি সরেনি ঠিকই, সবাই দাঁত
কিড়মিড় করেছিল ফেলুদার অপারগতায়, কিন্তু চাট্টি অভিশাপ কুড়িয়েছিল মগনলাল। কেন? কারণ গাঙ্গুলিবাবু জোকার নন, কারণ উনি সামান্য এক বিদূষক নন, তিনি
আমাদের চোখের মণি, তিনি আমাদের রুক্ষ জীবনে এক সবুজ, রসালো
ওয়েসিস।
কিন্তু চলচ্চিত্রের গাঙ্গুলীবাবু (সন্তোষ দত্ত) সবশেষে এসে এতটাই বেরসিকের মতো কাজ করলেন যেটা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এতদিনের ভালোবাসা, এতদিনের সম্পর্ক, আদর করে তুলোয় মুড়ে তুলে রাখার পরেও, বলা নেই কওয়া নেই, সবাইকে ছেড়ে
চলে গেলেন ৫ মার্চ, ১৯৮৮ সালে। আরে বাবা, ফেলুদা বকাবকি করত ঠিক
কথা, কিন্তু সব জায়গায় তো যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে আপনাকে পরিচয় করাত, সম্মান করত - তবে কেন চলে গেলেন আপনি? আপনার সঙ্গে সঙ্গে অভিমানে ফেলুদাও আর কোনওদিন কোনও তদন্তে নামলই না। আপনিও মশাই আর কোনোদিন এসে
গুণময় বাগচীর সতেরো ইঞ্চি বাইসেপ ধরে 'আরিব্বাস' বলবেন না, অসহায়ভাবে ঝুলে থাকবেন না গাওয়াংগীর কাছে বগলদাবা অবস্থায়। কখনওই আর চূড়ান্ত কনফিডেন্সে 'ফ্লোয়িং' অটোগ্রাফ দেবেন না গুণমুগ্ধদের.... সঙ্গে দুটো সিগনেচার ডট।
কখনওই আর সারা দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে, আমরা
আপনাকে দেখিয়ে বলতে পারব না, 'উনি আমাদের!!’ ঠিক যেমন
আসল ডঃ হাজরার হাতে আপনার হারানো ভোজালি দেখে একগাল হেসে একলাফে এগিয়ে এসে ওটি
হস্তগত করেছিলেন ‘ওটা আমার’ বলে!
তবুও এখনও বুকে অনেক আশা নিয়ে ফেলুদা
সমগ্রের পাতায় পাতায় আপনাকে খুঁজে চলেছি - আশা রাখি দশাশ্বমেধ ঘাটের উপর সবুট
পদচারণ করতে করতে বলে উঠবেন আপনি – ‘আহা, হতাশ
হচ্ছেন কেন? আরে আমি তো
বেঁচে আছি! অক্ষত!’
_____
সন্তোষ দত্তর ছবি – আন্তর্জাল
জটায়ুর ছবি – সত্যজিৎ রায়
No comments:
Post a Comment