
বাংরিপোসির
হাফ রাত্রি
পুষ্পেন মণ্ডল
(এটা হাসির
গল্প একেবারেই নয়। আমার নিজের জীবনের এক বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনি।)
(এক)
চার
বন্ধু মিলে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়েছি। কোনও
অভিভাবক ছাড়া এই প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বের হওয়া। পরীক্ষা
শেষ। সামনে ক’দিনের লম্বা ছুটি। কিছুদিন
ধরেই এ্যাডভেঞ্চারের বইগুলো মাথার মধ্যে গুবরে পোকার মতো কামড়াচ্ছিল। একবার
মনে হচ্ছে জাহাজের খালাসি হয়ে অনন্ত যাত্রাপথে জলে ভেসে পড়ি। কখনও
মনে হচ্ছে ট্রেকিং করে হিমালয়টা ঘুরে আসতে পারলে কেমন হয়?
শুভ
বলল, “আচ্ছা, যদি বিমল চ্যাটার্জির মতো সাইকেল
নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া যায়?”
যেমন
ভাবা তেমন কাজ। এটলাসের বড়ো ম্যাপটা খুলে রাস্তার প্ল্যানিং
শুরু হয়ে গেল। কিন্তু বেশি দূরে এগোনো গেল না।
বুম্বাদা
বাবুলগাম চিবোতে চিবোতে এসে মুখে এত্ত বড়ো একটা বেলুন ফুলিয়ে ফটাস করে ফাটাল। আমরা
চমকে উঠলাম। ও ফোড়ন কাটল, “নেই কাজ, তো খই ভাজ। যত সব
উলটোপালটা প্ল্যান। একদিনের বেশি
সাইকেল চালালে কী হবে জানিস? পিছনে এই বেলুনের মতো এত্তো বড়ো ফোঁড়া
হবে। তারপর ফটাস করে যখন ফাটবে টের পাবি। বাংলার
বর্ডার পেরনোর আগে স্ট্রেচারে করে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।”
“তাহলে কোথায় যাওয়া যায় বল তো বুম্বাদা?” রনি প্রশ্ন
করল।
“এমন জায়গায় যা যেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সহজে যাওয়া যায়।”
তা সেই
বুম্বাদার কথা অনুযায়ী আমরা চারজনে হাওড়া থেকে খড়গপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনে করে এসেছি। এখান
থেকে ট্রেন পালটে যাব বালেশ্বর। সেখান
থেকে ট্রেকার বা বাসে করে যাব সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট। প্ল্যান
সব রেডি। বাড়ির লোককে রাজি করাতে কালঘাম ছুটে গেছে। ঠাকুমা, মাসি, পিসি, কাকিমারা সব হাঁ হাঁ
করে ছুটে এল। “ঐ সব বাঘ ভাল্লুকের দেশে কী হবে
বাবা গিয়ে?” এ প্রশ্নের কী কোনও উত্তর হয়? শেষে অনেক মানত-টানত করে, পুজো দিয়ে, তাবিজ-কবজ বেঁধে ছাড়া পেলাম। তবে
এখন মনের মধ্যে উত্তেজনাটা বেশ টের পাচ্ছি। মন শুধু একটাই কু’ডাক দিচ্ছে মাঝে
মাঝে, ঘরের বুকিং নেই।
ভোরবেলা
বেরিয়ে হাওড়া থেকে লোকাল প্যাসেঞ্জারে খড়গপুর পৌঁছলাম দুপুর সাড়ে বারোটা। টিংকু
বলল, “চল কিছু খেয়ে নিই। তারপর
বালেশ্বরের ট্রেন ধরব।” এতক্ষণে বাড়ি থেকে যা
টিফিন দিয়েছিল - লুচি, আলুর দম, ডিমের চপ,
সব শেষ। তারপর
ট্রেনে যত ফেরিওয়ালা উঠছে - বাদাম ভাজা, ছোলা সেদ্ধ, ঝুরো শনপাপড়ি কোনোটা বাদ দিইনি। তবে
মেছেদায় গরম ভেজিটেবিল চপ বলে যেটা বিক্রি করে গেল, সেটা মুখে দিয়েই
থুথু করে ফেলে দিতে হল। সব ক’টা
বাসি আর পচা! শেষে শুভর ব্যাগের ভিতর থেকে চাল-কড়াই ভাজার প্যাকেটও ভ্যানিশ হল। বাইরে
বেরোলে এই খিদে খিদে ভাবটা কেন বেড়ে যায় কে জানে!
স্টেশনে
ডিম সিদ্ধ আর ঘুগনি খেতে খেতে মাইকে শুনতে পেলাম, বালেশ্বরের ট্রেন
সাত নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। আমরা
তখন এক নম্বরে। খাওয়া ফেলে দৌড়। ওভারব্রিজ
থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল রনি। শেষে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলল। যে বগিতে
উঠলাম সেটা ভেন্ডার, যাতে করে মালপত্র নিয়ে যাওয়া হয়। সবজি
আর মাছের পচা গন্ধ। মুরগি ভর্তি বড়ো বড়ো ঝুড়ি। গুড়
যাচ্ছে টিন টিন। দুর্গন্ধে দম আটকে আসছে। নাকে
রুমাল চেপে গেটের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। একটা
কালো মুশকো মতো ঘেমো লোক এগিয়ে বলল, “দেশলাই আছে?”
আঁতকে উঠলাম, “কেন?” বলল,
“বিড়ি ধরাব।”
পরের
স্টেশন আসতে আবার পাশের বগিতে উঠলাম। এখানে
আবার ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যে এক বাবাজীর ভেলকি চলছে। বড়ো
জটাধারী এক সাধু বিভিন্ন রকম হাতের কারসাজি করে লোকেদের ভড়কে দিয়ে টাকা চাইছে। আঙুলের
মধ্যে পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া, জটা থেকে জল বের করা। এসব
সস্তা ম্যাজিক আমার মোটামুটি সব জানা। কেউ
যদি না টাকা দেয়, কটমট করে তাকিয়ে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন অভিশাপ দিচ্ছেন, যে সে ভয়ে ভয়ে টাকা বের করছে।
আমার
সামনে এসে লাল জবা ফুলের মতো চোখ নিয়ে কটকট করে কিছুক্ষণ কপালের দিকে তাকিয়ে দুম
করে বললেন, “তোর অঙ্কে লেটার বাঁধা। দে দশ
টাকা।” এমন ধমক দিলেন, আমি সম্মোহিতের
মতো সুড়সুড় করে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে হাঁ করে রইলাম। ভাবলাম, আমার কপালে কী লেখা রয়েছে যে আমি পরীক্ষা দিয়েছি? আবার
অঙ্কে লেটার পাব জানল কী করে? যদিও পরে রেজাল্ট হাতে পেয়ে দেখি
দু নম্বরের জন্য লেটার হাতছাড়া হয়েছে। তখন
খুব রাগ ধরেছিল সেই সাধুটার উপর। কত আশা
নিয়ে ছিলাম অঙ্কে লেটার পাব। দশ টাকাটা
জলে গেল। দু’বার আলুকাবলি
খাওয়া হয়ে যেত!
যাক
সে দুঃখের কথা, বালেশ্বর স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন শেষ বিকেলের
সূর্য পশ্চিম দিকে কাত মেরেছে। ট্রেন
যে এত লেট করবে কোনও আইডিয়া ছিল না। স্টেশন
থেকে বেরিয়ে একটা মিষ্টির দোকানে পুরি তরকারি খেয়ে, যখন বাস বা ট্রেকার
খোঁজ করলাম সিমলিপাল ফরেস্টের বনবাংলোয় যাবার জন্য, তখন জানা
গেল বর্ষা এ বছর আগে চলে আসায় ভিতরের সব বনবাংলো বন্ধ হয়ে গেছে।
“এবার কী হবে?” মনে হল আমাদের যেন কেউ মাঝসমুদ্রে ফেলে
দিয়েছে। ঠিক যে ভয়টা করেছিলাম।
কেউ
বুদ্ধি দিল, এখান থেকে চাঁদিপুর চলে যাও, সমুদ্র আছে। আর একজন
বলল, বারিপদা বা যোশিপুর যেতে পারো। জঙ্গল
আর পাহাড় পাবে। ওখানে হোটেল আর গেস্ট হাউসও আছে। এদিকে
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে আর দেড়-দু ঘণ্টা বাকি। অচেনা
জায়গা, অচেনা লোকজন।
টিঙ্কু
পকেট থেকে একটা কয়েন বের করে বলল, “হেড টেল করি বুঝলি! হেড পড়লে সমুদ্র আর টেল পড়লে জঙ্গল।” কয়েনটা ছুঁড়ে দিল উপর দিকে। পাক
খেয়ে পড়ল আমার হাতে। টেল!
যেহেতু
পুরী বা দীঘা আগে ঘোরা, তাই পাহাড় আর জঙ্গলটাই আমাদের বেশি পছন্দ। সবাই
এক সঙ্গে বলে উঠল ‘হুররে!’ চিৎকারের ধমকে
দুটো চন্দনা পাশের খিরিশ গাছ থেকে উড়ে পালাল।
শেষমেশ
যোশিপুরের বাসে আমরা উঠে পড়লাম। ছাড়ল
আরও আধ ঘণ্টা পর।
কিছুটা
পর থেকেই শুরু হল শাল, মহুয়া, হেঁতাল,
শিমুল আরও হাজারো বুনো গাছের জঙ্গল। আর মাঝে
মাঝে পড়ছে টিলা পাহাড়। কোথাও সরু ঝরনা
নামছে পথের পাশ দিয়ে। মনের মধ্যে উত্তেজনাটা
বেড়েই চলেছে। দু’চোখ ভরে দেখছি আর প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস
নিচ্ছি। ডুম ডুম করে ঢাক বাজার আওয়াজ পাচ্ছি যেন। খেয়াল
করে দেখলাম ওটা আমার মনের ভিতর থেকেই আসছে।
সন্ধ্যা
নামছে দ্রুত। আমরা চলেছি নিরুদ্দেশের পথে। ‘নিরুদ্দেশ’ বলছি এই কারণে, এখানে
আসার আগে সিমলিপাল নিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করে এসেছিলাম। বারিপদা
আর যোশিপুর দু'দিক দিয়েই ঢোকা যায় ওখানে। ভিতরে
বেশ কয়েকটা বনবাংলো আছে। এখন যেহেতু ওখানে
যাওয়া হচ্ছে না, তাই কোথায় থাকা হবে কিছুই ঠিক নেই। সেকেন্ড
অপশন তো আর ভেবে আসিনি।
বাস
বারিপদা পেরোনোর পরই সন্ধ্যা নেমে এল। “ও ভাইসাব যোশিপুর কব পৌঁছেগা?” টিংকু কন্ডাকটরকে প্রশ্ন
করতে সে জানাল, “রাত দশটা।”
রাত
দশটায় যোশিপুর পৌঁছালে হোটেল খুঁজব কখন আর খেয়ে শোব কখন? কলকাতায় এই রাতটা কিছুই নয়। কিন্তু
এখানে তো বাইরে রাস্তাঘাটে কোনও আলো নেই, এখনই সব শুনশান অন্ধকার। চিন্তায়
কপালের ভাঁজ চওড়া হল আমাদের। আবার
জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, যোশিপুরের আগে,
রাস্তায় কোথাও থাকার জায়গা বা হোটেল পাওয়া যাবে?”
উড়িয়া
কন্ডাকটর মাথা চুলকে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “সামনে এক ঘণ্টার মধ্যে বাংরিপোসি আসছে, সেখানে হোটেল আছে।”
‘বাংরিপোসি’ নামটা শোনা, রিনিদির
কাছে একটা বই আছে ‘বাংরিপোসির দু’রাত্তির’। সবাই
মিলে ঠিক করলাম বাংরিপোসিতেই নামব।
হাই
রোডের ধারে নামিয়ে দিল আমাদের। বাস চলে যেতে দেখলাম, চারিদিকে ঘুটঘুটে
অন্ধকার। কিছুটা দূরে টিম টিম করে আলো জ্বলছে একটা
গুমটি চায়ের দোকানে। শুভ বলল, “উত্তম কুমারের সেই
সিনেমাটা মনে পড়ছে।”
রনি,
“কোনটা?”
“আরে
অন্ধকার জঙ্গলের রাস্তায় বাইক চালাচ্ছে। একটা ভূতের হাত আঁকড়ে ধরল বাইকের হেড
লাইট। কোন রকমে ছাড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে পৌঁছাল একটা চায়ের দোকানে। তখন দোকানদার
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, দেখুন তো এরকম হাত ছিল কী?”
বললাম,
“বিকেলে ভোরের ফুল।”
টিঙ্কু
শুভর মাথায় চাঁটি মেরে বলল, “উদাহরণ যা দিলি আমার তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
সবাই
মিলে দল বেঁধে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখানে থাকার হোটেল পাওয়া
যাবে?”
মাটির
ভাঁড়ে চা ঢালতে ঢালতে দোকানি গম্ভীর গলায় জানাল, “না।”
“কী? পাওয়া যাবে না?” শুনেই আঁতকে
উঠলাম। “বাসের কন্ডাকটর তো বলল এখানে হোটেল আছে!”
চায়ের
দোকানে বসে থাকা একজন লোক জানাল, “এখানে থাকার দুটো হোটেলই বন্ধ। বর্ষাকালে
জঙ্গলে লোক আসে না। তাই বন্ধ করে ওরা দেশে চলে গেছে।”
টিংকু
উত্তেজিত হয়ে বলল, “সে কী! আমরা যে অনেক
দূর থেকে আসছি। রাতে থাকার একটা
ব্যবস্থা না হলে চলবে কী করে? শোব কোথায়? গাছতলায়?”
আর একজন
মন্তব্য করল, “না বাবুজি, বাইরেও থাকা
যাবে না, রাত্রে পাহাড় থেকে ভাল্লুক নামে, বুনো শিয়াল আছে, হায়েনা আছে।”
“ওরে বাবা!” বলেই লাফিয়ে উঠল শুভ। আশেপাশে
এমন সন্দেহজনক ভাবে তাকাল যেন আমাদের পিছনেই অন্ধকারে কোনও বন্য জন্তু লুকিয়ে আছে, সুযোগ পেলেই তারা পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
“আমি বলেছিলাম, তখন পুরী বা দার্জিলিং চল, অনেক হোটেল পাওয়া যাবে,” রনি জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ
ছাড়ল না।
আমি
বললাম, “তুই চুপ কর, পুরী বা দার্জিলিঙে গিয়ে কোন
এ্যাডভেঞ্চার হবে শুনি? তার থেকে এই বেশ ভালো। গাছতলায়
শুয়ে রাত কাটাব। একজন করে জেগে পাহারা দেবে।”
টিংকু
আমাকে একটা উড়নচাঁটি দিয়ে বলল, “এই যে পণ্ডিত মশাই! তুই যে অতো মোটা মোটা বই পড়লি, রাত জেগে সব ম্যাপ মুখস্থ
করলি, আর শেষে আমাদের নিয়ে এসে পথে বসাতে তোর বুক কাঁপল না?”
“আ-আমি কী করব? বনদপ্তর যদি বাংলো
বন্ধ করে দেয় তো আমার দোষ?”
“বর্ষাকালে হোটেল আর বনবাংলো বন্ধ থাকে জানতিস না?”
শুভ
হাউমাউ করে উঠল, “হোটেল না পাওয়া গেলে কী হবে? রাত বাড়ছে। ভাল্লুক, শিয়াল, হায়েনা আর সাপখোপও নিশ্চয়ই আছে। আর বাড়ি
ফেরা হবে না। এই জঙ্গলেই আমাকে কবর দিস।”
“কবর দিতে হবে কেন? জঙ্গলে অনেক কাঠ আছে। তোকে
পুড়িয়ে, একে বারে চিতাভস্ম নিয়ে বাড়ি ফিরব।”
“চাচাজী, এখানে আর কোনও থাকার জায়গা নেই?” আমি বিনীতভাবে আবার প্রশ্ন করলাম চায়ের দোকানের লোকটিকে।
“আছে, একটা সরকারি বাংলো। কিন্তু
সেখানে জায়গা পাওয়া মুশকিল। দারোয়ানটা
খুব বদমাশ। বুকিং করে না আসলে সেখানে থাকতে দেয় না। তবে
তোমরা চেষ্টা করে দেখতে পার। ঐ যে
সামনে চেকপোস্টের পাশে বড়ো পাঁচিল ঘেরা, গেট বসানো বাড়ি দেখছ,
ওখানে গিয়ে দারোয়ানকে বল। আর যদি
কোথাও জায়গা না পাও, তাহলে আমার এই দোকানের ভিতরে খড় বিছিয়ে চাটাই
পেতে দেব শুয়ে পড়বে।”
“যাক একটা তো ব্যবস্থা হল! আর খাব কী? এখানে খাবার কিছু পাওয়া যাবে?”
“হাতে গড়া রুটি আর কড়াইয়ের তড়কা।”
“দারুণ! একেই বলে এ্যাডভেঞ্চার।”
“এখন তো বর্ষাকাল, যদি রাতে বৃষ্টি হয়? খড়ের চাল দিয়ে তো জল পড়বে। তার
থেকে চল ঐ দারোয়ানকে গিয়ে বলি,” রনি বলল। তার
কথার যুক্তি আছে।
বড়ো
বড়ো গাছে ঘেরা বেশ পুরোনো বাংলো। বারান্দায়
টিমটিম করে একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। আমরা
চারজনে মিলে গিয়ে দারোয়ানকে অনেক অনুনয় বিনয় করলাম। কিন্তু
সে দেহাতি হিন্দি আর উড়িয়া মিশিয়ে বারবার একটাই কথা বলল, “সরকারি বাংলোতে থাকতে গেলে বুকিং করে আসতে হবে। কাগজ
ছাড়া থাকতে দিলে আমার চাকরি যাবে।”
“অন্য দুটো হোটেল বন্ধ। আমরা
সারা রাত কী তাহলে রাস্তায় থাকব?”
শেষে
বেশ কিছু টাকার টোপ দিতে সে বলল, “রাত ন’টা পর্যন্ত যদি কোনও গেস্ট
বা অফিসার না আসে তাহলে একটা রুম দিতে পারি। কালকে
সকাল দশটার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে।”
আমরা
মাথা নেড়ে ক্ষীণ আশার আলো নিয়ে আবার ফিরে গেলাম চায়ের দোকানে। “আমাদের সবার জন্য রুটি আর তড়কা তৈরি শুরু করে দিন। আর থাকার
জায়গাটাও দেখিয়ে দিন খড় বিছিয়ে রেডি করি। ঐ দারোয়ানকে
ভরসা নেই।” বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে ধপাস করে বসে টিংকু বলল।
“ডিম তড়কা হবে? ডিম তড়কা?” রনি বলে
উঠল।
“এমনি খাবার জুটছে না, আবার ডিম তড়কা? কে রে হরিদাস!”
“হবে, ডিম তড়কা হবে,” দোকানি জানাল।
“বাঃ তবে তাড়াতাড়ি বানাও। পেটে
যাকে বলে ছুঁচোতে ডন দিচ্ছে। সেই
ভোর বেলা বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। সঙ্গে
কাঁচা লঙ্কা আর পিঁয়াজ চাই।”
আটা
মাখতে মাখতে দোকানি বলল, “রাতে আপনারা সাবধানে থাকবেন। কেউ
ডাকলে ঘর থেকে বের হবেন না।”
“ক-কেন?”
“না, মানে ঐ বাংলোটার খুব সুনাম নেই। শোনা
যায় খুন হয়েছিল ওখানে।”
শুনেই
আমাদের মুখগুলি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। টিংকু
চাপা গলায় বলল, “ওর কথায় কান দিস না। বেটা
আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।”
চোখের
সামনে কাঠের উনুনে লোহার কড়ায় তড়কা তৈরি হচ্ছে। আমরা
চার বুভুক্ষু প্রাণী হাঁ করে চেয়ে আছি সেই দিকে। বাইরে
হাই রোডের উপর দিয়ে সাঁক সাঁক করে ভারি ভারি ট্রাক জল ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে। ঝিরঝির
করে বৃষ্টি শুরু হল। সঙ্গে ঠাণ্ডা
হাওয়া। আস্তে আস্তে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। জলের
ছাঁট এসে ঢুকছে ভিতরে। খড়ের চাল থেকে
টপটপ করে জল পড়তে শুরু করল।
রনি
বলল, “আর কতক্ষণ? আমাদের আর তর সইছে না।”
“এই তো হয়ে এসেছে, এবার রুটিটা বানালেই হয়ে যাবে।”
আমি
আঙুল তুলে বললাম, “ঐ দেখ, একটা সাদা এম্বাসাডার
ঢুকছে বাংলোয়।”
“এই রে, এ নিশ্চয়ই কোনও সরকারি অফিসার।”
টিঙ্কু
কপাল চাপড়ে বলল, “হয়ে গেল, এবার সারা রাত
ফুটো চালের নিচেই কাটাতে হবে মনে হচ্ছে।”
আমি
বুক ফুলিয়ে গরিলার মতো মন্তব্য করলাম, “আমার রবিনসন ক্রুসোর
কথা মনে পড়ছে।”
“ধুত্তেরি তোর ক্রুসো, বৃষ্টি যে হারে বাড়ছে, কাল সকাল পর্যন্ত জলের তোড়ে ভেসে যাই কিনা দেখ,” শুভ
ভেংচি কাটল।
“হায় রে! আমার কী হবে?” হঠাৎ চেঁচিয়ে
উঠল টিঙ্কু।
“তোর আবার কী হল? মরার আগে ভয়ে এখন থেকেই চেঁচাচ্ছিস। ভীরু, কাপুরুষ।”
রনি
বলল, “টিঙ্কুর ক্লাবের খেলা আছে পাঁচদিন পর, ঘোষ
পাড়ার সঙ্গে। ও সেন্টার ফরোয়ার্ড
খেলার জন্য পাঁচশ টাকা এডভান্স নিয়ে এসেছে। ঐ দিন
না খেললে গুল্টিসদা পিঠের চামড়া গোটাবে বলেছে।”
তারপর
অনেক তপস্যার পর খাবার এল। ঝমঝমে
বৃষ্টি আর বাজখাঁই খিদের মধ্যে সেই উড়িয়া রান্নার জাদু। আট-দশটা রুটি এক একজনে হাওয়া করে দিলাম নিমেষে। শেষে
দোকানি জানাল, “আর রুটি নেই। আটা
শেষ।”
“আপনি কী খাবেন?” আমি অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করলাম।
“পাশের গ্রামে আমার বাড়ি। দোকান
বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে খাব।”
“আর আমাদের থাকার ব্যাবস্থা?” ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম।
তিনি
বললেন, “যা জোরে বৃষ্টি আসছে, রাতে আরও বাড়বে। তোমরা
দারোয়ানকে গিয়ে আবার ধর। এখানে সারা রাত
থাকা যাবে না।”
অগত্যা
তাই করলাম। খাওয়ার পর বৃষ্টি একটু কমতে ব্যাগগুলো
মাথায় নিয়ে জলের উপর দিয়ে ছপাস ছপাস করে দৌড়। ঠিক
সেই সময়ে জঙ্গলের দিক থেকে শোনা গেল একটা ‘উউউউ….’ ডাক। টিঙ্কু হাঁফাতে
হাঁফাতে বলল, “উলফ!”
দেখলাম
বাইরের গেটে কেউ নেই, তবে তালা খোলা। সোজা
হাজির হলাম বাংলোর দরজায়। ঠকঠক ... ঠকঠক।
দরজা
খুলে আমাদের দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে দারোয়ান বলল, “বড়া সাব আয়ে হ্যাঁয়। আভি
কুছ নেহি হো সাকতা।”
“বড়ো সাহেব এসেছে তো আমরা কী করব? এত বড়ো বাংলোয় আমাদের
জন্য একটাও ঘর হবে না? তিনি কী সব ক’টা ঘরে একসঙ্গে থাকবেন নাকি?”
আমরাও নাছোড়বান্দা। অন্তত
একটা ঘর আমাদের দিতেই হবে। ঘর না
পেলে হলঘর, রান্নাঘর বা বারান্দাতে থাকতে দিতে হবে। দারোয়ান
জোরে জোরে মাথা নাড়ছে, হবে না, হবে না। আমারাও
চেঁচামেচি করছি, দিতে হবে, দিতে হবে। শেষে
এত আওয়াজে বড়ো সাহেব বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে।
“কেয়া হুয়া, ইতনা শোর কিঁউ?”
দারোয়ান
বলল, আমরা জোর করে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছি। সে এও
বলল, সাহেবের হুকুম পেলে আমাদের লাঠি মেরে তাড়া করবে। এই মেরেছে! এটাই এখন বাকি ছিল। সেই
চায়ের দোকানি এতক্ষণে দোকান বন্ধ করে চলে গেছে। আর দারোয়ান
যদি লাঠি মেরে তাড়া করে তাহলে আমরা সারারাত এই অচেনা নির্জন জায়গায় বৃষ্টির মধ্যে কোথায়
যাব? নাঃ আর ভাবতে পারছি না। মনে
হয় এ্যাডভেঞ্চারের নেশা আমাদের ইহজন্মে এখানেই শেষ। যদি
বাড়ি ফিরতে পারি, তবে নাকখত দিচ্ছি, এ রাস্তায়
আর কক্ষনো নয়। আমরা সবাই বড়ো
সাহেবের দিকে আশান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। জানি
না তাঁর নির্দেশে লাঠির ঘা আজ পিঠে পড়বে কি না!
আমাদের
চেহারাগুলো ভালো করে লক্ষ করে নরম গলায় প্রশ্ন করলেন, “কেয়া চাইয়ে তুম লোগো কো?”
সবাই
মিলে হিন্দি, ইংরাজি আর বাংলা মিশিয়ে আমাদের দুর্দশার কথা
তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কারণ
উড়িয়া ভাষা আমরা কেউ জানি না। টিংকু
আমাদের এক দাবড়ি মেরে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপ য্যায়সা গুড পারসন
কো হোতে হুয়ে দারোয়ানজি হামারে সাথ ইতনা খারাপ আচরণ কী করে কর সাকতা হ্যাঁয়?”
“তোমরা সবাই কলকাতা থেকে এসেছ? এ্যাডভেঞ্চার করতে?
কোন ক্লাসে পড় তোমরা?” বড়ো সাহেবের মুখে পরিষ্কার
বাংলা শুনে আমরা হতবাক!
আমাদের
ইতিবৃত্তান্ত সব খুঁটিয়ে জানার পর বললেন, “দারুণ! তোমাদের বয়েসেই তো এ্যাডভেঞ্চার মানায়। আমার
বাড়ি যদিও কটকে। কিন্তু পড়াশোনার জন্য কলকাতায় অনেকদিন
ছিলাম। তোমাদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগল।” এরপর দারোয়ানকে হুকুম দিলেন, “বংশী, ফোর বেডের বড়ো ঘরটা এদের জন্য খুলে দাও। আর রাত্রের
খাওয়ার ব্যবস্থা কর।”
শুনে
যেন হাতে চাঁদ পেলাম। বর্ষার রাতে
মনটা যেন আনন্দে ময়ূরের মতো নেচে উঠল। বললাম, “রাত্রের খাওয়া আমাদের হয়ে গেছে। শোয়ার
জন্য একটা ঘর পেলেই চলবে।”
“ঠিক আছে, কালকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেখা হবে। গুড
নাইট।” বলে নিজের ঘরে শুতে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
(দুই)
চার
খাটের বড়ো ঘর পেয়ে আমাদের আনন্দ আর ধরে না। ব্রিটিশ
আমলের উঁচু কড়িবরগার ছাদ। মেহগনি কাঠের
সব আসবাব। এটাচড বাথরুম। সব ব্যবস্থাই
ভালো। দেয়ালে একটা বড়ো দম দেওয়া পুরানো আমলের
ঘড়ি ঝুলছে। প্রতি ঘণ্টায় ঢং ঢং করে মিষ্টি আওয়াজ
বের হয়। বন্ধুদের সঙ্গে একা একা বাইরে বের হওয়ার
এই মজা। সারাদিনের ক্লান্তি আর এত সুন্দর বিছানা
পেয়েও ঘুম আসতে চাইছে না। বাইরে ঝমঝমে
বৃষ্টি আর ভিতরে আমাদের বকবক চলেছে। তবে এখানের
মশা খুব সাংঘাতিক। তার জন্য আমরা মশার ধুপ, ওডোমস ক্রিম সবই নিয়ে এসেছি। আবার
মশারিও খাটানো হয়েছে। হঠাৎ মশারিতে
দেখলাম রক্তের দাগ। কীসের রক্ত? এ ঘরে কী কোনও খুন হয়েছিল? চা’ওয়ালা সে কথাই বলেছিলেন যেন। এই নিয়ে
যে যত দূর পারে তার কল্পনাকে টেনে ইলাস্টিকের মতো বাড়াচ্ছে আর কত রকমের উদ্ভট আইডিয়া
বের হচ্ছে মাথা দিয়ে।
টিঙ্কুর
মতে, “এটা ছিল কোনও ইংরেজ নীলকর সাহেবের বাড়ি। একদিন
যখন নীল চাষিরা বিদ্রোহ করল তখন এই ঘরে সবাই মিলে নীলকর সাহেবকে হত্যা করেছিল। তারই
রক্তের দাগ এই মশারিতে।”
আমি
বললাম, “অসম্ভব, এটা একশো বছরের পুরোনো মশারি হতেই
পারে না। অত দিন আগে নাইলনের মশারি ছিল না।”
শুভ
বলল, “এটা কোনও ড্রাকুলার পুরোনো আস্তানা। আমি
খাবার জল আনতে দারোয়ানের সঙ্গে যখন রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম, তখন সেখানে একটা বাদুড়কে কড়িকাঠ থেকে ঝুলতে দেখেছি। আমার
মনে হয় ঐ বড়োবাবুই হচ্ছে কাউন্ট ড্রাকুলা। আমরা
ঘুমিয়ে পড়লে সে চুপিচুপি এসে আমাদের রক্ত চুষে খাবে।”
“সর্বনাশ!
সে কী রে?”
রনি
বলল, “ধুর যত সব অবৈজ্ঞানিক বকোয়াস! ভালো করে
দেখ মশারির রক্তটা মাসখানেক আগের, শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। ঐ কাঠের
ড্রেসিং টেবিলের কাচে আমি একটা মেয়েদের টিপ খুঁজে পেয়েছি। আর বাথরুমে
একটা ব্যবহার করা লেডিস সাবান তো তোরা সবাই দেখেছিস। সব কিছু
মিলিয়ে আমার ধারণা, মাসখানেক আগে এক দম্পতি এখানে এসে উঠেছিল। তারপর
মাঝরাতে লোকটা মেয়েটিকে একটা ছুরি দিয়ে ঘ্যাঁচাং।”
“এ সব কী তুই দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলি?”
“বস, অবজারভেশান পাওয়ার সবার থাকে না। তোরা
তো জানিস ব্যোমকেশ, ফেলুদা, শার্লক সব আমি
গুলে খেয়েছি। আমার অবজারভেশান
ভুল হতেই পারে না।”
“সেই
ভূত যদি রাত্রে ফিরে আসে?”
শুভর
মন্তব্য শুনে টিঙ্কু বলল, “কুছ পরোয়া নেহি। হাম হ্যাঁয় না! আমার প্রপিতামহ ছিল
তান্ত্রিক। তাঁর কত পোষা ভূত ছিল জানিস?”
আমরা
মাথা নাড়লাম। তর্কটা শেষ হতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগল। ক্রমশ ঘুমে চোখ টেনে ধরছে। কে
যেন আলোটা বন্ধ করে দিল। এরপর আর মনে নেই। মাঝরাতে
হঠাৎ দেখি রনি ধাক্কা দিচ্ছে।
“কী হল?”
“তাড়াতাড়ি ওঠ। কীসের
যেন শব্দ!”
“রাত্রে আবার কীসের শব্দ? স্বপ্ন দেখেছিস হয়তো। ঘুমিয়ে
পড়,” বলে আমি পাশ ফিরে শুলাম।
কিছুক্ষণ
পর আবার ঠেলা দিচ্ছে, “ঐ তো আবার হচ্ছে। শুনতে
পাচ্ছিস?”
আমি
ঘুমচোখে কান খাড়া করে শুনলাম। ঝুম.. ঝুম, ঝুম.. ঝুম। সত্যি
তো! আওয়াজটা বাইরে থেকে আসছে। ক্রমাগত....
একবার জোরে হচ্ছে, একবার আস্তে। কখনও
মনে হচ্ছে বাথরুমের দিক থেকে আসছে, কখনও বারান্দার দিক থেকে। খাটের
উপর উঠে বসলাম। অনেকক্ষণ কান খাড়া করে শুনে মনে হল, বৃষ্টির
আওয়াজ এটা নয়। বৃষ্টি তো থেমে গেছে। অন্য
দু’জনকেও ডেকে তুললাম। সবার মনে একটাই
প্রশ্ন, ব্যাপারটা কী? কীসের শব্দ?
শুভ
বলল, “কেউ নূপুর পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে হয়।” শহরে বসে কথাটা হাস্যকর শোনালেও, সেই অচেনা জঙ্গলে ঘেরা
পুরোনো ইংরেজ আমলের ঘরে বসে আমাদের প্রাণ হিম হয়ে গেল। শেষে
কী আমরা সত্যিই কোনও হানাবাড়িতে এসে পড়লাম? না হলে এত রাতে নূপুর
পরে বাইরে কে হাঁটবে?
ঝুম.. ঝুম.. ঝুম.. ঝুম...। নিজের
কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মাঝে
মাঝে শব্দটা থেমে যাচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ
পরে হচ্ছে। কখনও ভাবছি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি না তো? না, চিমটি কেটে দেখলাম দিব্যি জেগে আছি। ভারি
নূপুর পরে কেউ হাঁটলে ঠিক যেরকম আওয়াজ হয়, সেই আওয়াজ। বাড়িটাকে
প্রদক্ষিণ করছে। আমরা সবাই মিলে একটা খাটে মশারির ভিতরে
ঢুকে কাঁটা হয়ে বসে আছি। মাথা কাজ করা
বন্ধ করে দিয়েছে। বাস্তব যুক্তিবোধ সব লোপ পাচ্ছে। এটা
যে একটা ভূতের বাড়ি, সেই বিশ্বাসটা আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে শিকড়
চালিয়ে চেপে বসছে।
পাশেই
একটা ঠকঠক আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দাঁত কপাটি লেগে কাঁপছে টিঙ্কু। মুখে রাম
নাম! ওর ঠাকুরদার বাবা নাকি তান্ত্রিক! বোঝো!
“তাহলে
রনির কথাই কী ঠিক? কোনও মেয়ে এখানে খুন হয়েছিল? তার আত্মা নিশুতি রাতে বাংলোর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে,” শুভর কথা শুনে মনে
হল এই বুঝি বাথরুমের দরজা খুলে, অথবা বড়ো কাঠের আলমারির আড়াল
থেকে সাদা শাড়ি পরে মেয়েটা বেরিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াবে! ভয়ে শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ
ধরে এটা চলল তার হিসাব নেই। ঘড়ির
আওয়াজটা কানে আসছে যেন অনেক দুর থেকে.........
কখন
শব্দটা থেমেছে জানি না। দুম দুম করে
দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ঘুমটা ভাঙল। এখনও
একটা খাটে চারজনে জড়ামড়ি করে শুয়ে আছি। উপরের
ভেন্টিলেটর আর বন্ধ জানালাগুলির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সূর্যের আলো ভিতরে ঢুকছে। সকাল
হয়ে গেছে। সবাইকে ঠেলে তুললাম। দরজা
খুলে দেখি বংশী।
দাঁত
বের করে এক গাল হেসে বলল, “ব্রেকফাস্ট রেডি, বড়োবাবু
আপনাদেরকে খেতে ডাকলেন।”
কোথায়
কালকের কড়া ব্যবহার, আর কোথায় এই নম্র বিনয়ী আচরণ। এখন
আমরা বড়োবাবুর গেস্ট। তাই এই হাসি
হাসি মুখ। বললাম, “বড়োবাবুকে বলুন
আমরা পাঁচ মিনিটে আসছি।”
ব্রেকফাস্ট
টেবিলে গিয়ে দেখি, এলাহি আয়োজন। কিন্তু
কালকে রাতের ঘটনার পর সবাই গুম খেয়ে আছি। কতক্ষণে
এই বাড়ি ছেড়ে পালাব তাই ভাবছি শুধু। খাবার
যেন গলা দিয়ে নামছে না। বড়োবাবুকে কাল
রাতে অত ভালো করে লক্ষ করিনি, আজ দেখলাম। রোগা, লম্বা, চোখটা কটা, গালের নিচে একটা
জড়ুল। চুল ছোটো ছোটো করে কাটা। হাতের
আঙুলগুলো যেন অস্বাভাবিক রকম সরু আর লম্বা। আড়চোখে
আমরা সবাই লক্ষ করছি তাঁকে। বংশীরও
গলার স্বরটা কেমন খোনা খোনা।
“তাহলে ক’দিন থাকছ তো তোমরা এখানে? আমি অফিশিয়াল বুকিং-এর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। চারপাশটা
ঘুরে দেখ। পাহাড়, জঙ্গল,
ঝরনা সব পাবে।” বড়োবাবু টোস্টে
মাখন মাখাতে মাখাতে বললেন।
কথাটা
শুনে একটা বিষম খেয়ে আমি বললাম, “না, আমরা আজকেই
ফিরব।”
“সে কী! এক দিনের জন্য এত দূর এলে?”
“আসলে, কালকে বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের সবারই জ্বর জ্বর লাগছে। মশা-টশা
মনে হয় কামড়েছে।” কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটা বলল টিঙ্কু। আসলে
গতকাল রাতের ঘটনাটা এখনও চেপে বসে আছে মাথায়। জায়গাটা ছেড়ে কতক্ষণে পালাব তাই
ভাবছি আমরা।
“তাহলে তো বাড়ি ফিরতেই হবে। এখানের
মশা খুব সাংঘাতিক। কামড়ালেই ম্যালেরিয়া। কলকাতায়
ফিরেই সবাই আগে ব্লাড টেস্ট করাবে। আমিও
একটু পরে বালেশ্বরে যাব। আমার গাড়িতে
তোমরাও উঠে পড়। স্টেশনে ছেড়ে দেব।”
আধঘণ্টার
মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম বড়োবাবুর গাড়ি করে। দিনের
আলোয় দেখলাম জায়গাটা সত্যিই সুন্দর। রাস্তায়
তিনি অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা
শুধু হ্যাঁ, হুঁ, না করে উত্তর দিতে
থাকলাম। বালেশ্বরে স্টেশনের সামনে গাড়ি থেকে নেমে
হঠাৎ কী মনে হল প্রশ্ন করে বসলাম, “কালকে রাত্রে কোনও আওয়াজ
শুনেছিলেন?”
তিনি
যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “কীসের আওয়াজ? না আমি তো
কিছু শুনিনি।”
“একটা ঝুম.. ঝুম আওয়াজ, সারারাত
হচ্ছিল।”
“ঝুম.. ঝুম! ও! ওটা? ও তো সজারুর হাঁটার আওয়াজ।”
“সজারু!!”
“হ্যাঁ, রাতে বড়ো সজারু যখন খাবার খুঁজতে বের হয়,
তখন তার বড়ো বড়ো কাঁটাগুলো একে অপরের সঙ্গে লেগে ঝুমঝুম করে শব্দ হয়। অনেকে
ওটা নূপুরের আওয়াজের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। তোমরা তো
সাহসী ছেলে, ভয় পাওনি নিশ্চয়ই?”
ঢোঁক
গিলে বললাম, “না না .....!!”
একটা
দাঁড়কাক পাশের গাছ থেকে ডেকে উঠল, কা.. কা.. কা... আমি যেন শুনলাম কে হাসছে
‘হা..হা..হা...’।
_____
অলংকরণঃ
লেখক

অপূর্ব অভিজ্ঞতা
ReplyDeleteবাঃ
ReplyDeleteদারুণ ট্যুইস্ট।জমে গেছে।
ReplyDeleteদারুন
ReplyDeleteহা হা হা
ReplyDeleteসবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete