
চিঙ্কারার হুঙ্কার
যশোধরা রায়চৌধুরী
“তপু,
তপু, অ্যাঁ, এই যে, বাবু তপনেন্দ্রনারায়ণ... পড়ে পড়ে ঘুমনো হচ্ছে?”
ঘড়ড়-ঘোঁ-ঘোঁৎ...
নতুন মেসো পা টিপে টিপে এগোচ্ছিল, আর দাদা যে কী করে না,
তাও পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। একঘণ্টা আগে
নতুন মেসো একটা পড়া দিয়ে গেছে দাদাকে। আমি ছোটো বলে আমাকে আঁকতে দিয়েছে। পাহাড়ের ছবি। ডোড্ডাবেটা। আজ সকালেই ওখান থেকে
ঘুরে আসা হয়েছে, তাই টাটকা টাটকা যা মনে হয়েছে আমি যাতে এঁকে ফেলি, বলেছে। বলে
নিজের কাজে বেরিয়ে গেছে।
আর যেই না নতুন মেসোর বেরিয়ে যাওয়া, আমিও দিব্যি গাছের ওপর বসা বাঁদরগুলোকে দেখে খানিকক্ষণ কলা-টলা দেখিয়ে ফুর্তির চোটে একশা। বাঁদর এঁকে ফেললাম খাতার তিনটে পাতা জুড়ে
বিস্তর। নতুন মেসো দেখে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসেছে
আর ডোড্ডাবেটা আঁকিনি বলে সরু সরু আঙুলে মাথায় দিয়েছে এক গাঁট্টা। কিন্তু
ডোড্ডাবেটা আঁকতে বললেই আঁকা যায় নাকি? অত্ত বড়ো একটা পাহাড়ের চ্যাপ্টামতো মাথার
উপর চড়ে এদিকে কুন্নুর ওদিকে উটকামন্ড সব দেখে এসেই তারপর সেটা আঁকতে পারা যায় নাকি?
মাথাটা কেমন গুলিয়ে মতো যায় না? ধরো উটির দিকে
দেখলে মেঘ করেছে, কালো কালো মেঘ পাহাড়ের মাথার ওপর ঝুলছে। একটা জায়গায় মেঘের
কালোটা যেন কেউ রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে দিয়েছে, সেটার মানে হল ওখানটা বৃষ্টি হচ্ছে।
আবার কুন্নুরের দিকে দেখলে রোদ উঠেছে। কাচের মতো চকচক করছে সবকিছু। আর ওপাশে নিচে দেখা
যাচ্ছে কোয়েম্বাটোর। বাহ্, এতোকিছু একসঙ্গে এঁকে ওঠা
যার তার কাজ নাকি? আমি তো পারি না। তাছাড়া আমার
জলরঙের বাক্সে নীল রংটাই ফুরিয়ে গেছে। আর নীলগিরি পর্বত আঁকতে তো নীল রং লাগবেই।
আমি তো যা হোক তাও বাঁদর-টাদর
এঁকেছিলাম। দাদা যে পড়া-টড়া কিসসু করেনি সে তো বোঝাই
যাচ্ছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলে এইয়া মোটকা একটা পত্রিকা দাদার মতো হনুমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেই হল? নতুন মেসো তাই-চি না আইকিডো কীসব করে তো কী হবে,
বুদ্ধিসুদ্ধি একদম নেই। আর তাছাড়া অত বড়ো ভুঁড়ি নিয়ে ওইসব চিনে-জাপানি
মার্শাল আর্ট করেই বা কী করে কে জানে। অবশ্য বললেই তো মাথায় রদ্দা মেরে বলবে, সুমো
পালোয়ানরা তাহলে কুস্তি করে কী করে রে? এক-একটার চেহারা দেখিসনি? ভুঁড়িতে কিসসু হয় না। ভুঁড়ির মধ্যেই তো ‘হারা’!
খেয়েছে! হারা-টারা আমি
বাপু বুঝি না। দাদাটা আবার ডেঁপো ডেঁপো ভাব
করে বেশ একটা বুঝেছে বুঝেছে হাসি দেয়! তারপর যেই নতুন মেসো বলে গেল, এই লেখাটা পড়ে দেখ ন্যা-জ্যোতে, অমনি কেমন কেৎরে ঘুমিয়ে পড়ল।
ন্যাজ্যো। বাবা, কীরকম
কায়দা মেরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে ন্যাজ্যো বানিয়ে দিয়েছে, দেখেছ? নাহ্, নতুন মেসোটার ইয়ে আছে। তবে দাদা কালকেই আমাকে ভুরু কুঁচকে চোখদুটোকে গোল
গোল করে চাপা গলায় বলেছে, নতুন মেসোকে একটু চোখে চোখে রাখতে
হবে। হাবভাব ভীষণ সন্দেহজনক! এদিকে তো মাসিটা
যা ভুলো আর ল্যাদাড়ুস। একবার তো আমাদের কলকাতায় ট্রামে ফেলে ধর্মতলায় একা একা গটমট
করে নেবে চলে গেছিল অনেকদূর। আমরা কিসসু না বুঝে ডিপোতে বসে আছি তো বসেই আছি। তারপর শেষে রোদ্দুরে ছাতা খুলতে গিয়ে দেখে ব্যাগে ছাতা নেই। তখন
ছাতা খুঁজতে এসে আমাদের খুঁজে পেল। সে অবিশ্যি মাসির বিয়েরও আগের কথা। দাদাই তখন
মোটে সাত-আট বছরের। আর
বিয়ের পর সেই যে মাসি মেসোর সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে চলে এল, আর টিকির দেখা নেই। এবার বাবা-মা দু’জনেই চেন্নাইতে কীসব কাজ আছে বলে
আমাদের কুন্নুরে রেখে দিয়ে গেল। ভাগ্যিস, নইলে মাসির বানানো চমৎকার মাংসের চপ আর ভুট্টাদানার ঘুগনিগুলো তো খাওয়াই হত না!
নতুন মেসো ঘুমন্ত দাদাকে এইসান
একটা কানমলা দিল না, দাদা তো তড়বড়
করে উঠে বসে কেমন একটা হতভম্বই হয়ে গেল! তারপর মেসো বলল, “কী
চাঁদু, আর্টিকলটা পড়া হয়েছে?”
যাক তাহলে ন্যাজ্যো-তে বেরোনো ওই লম্বা লম্বা কুটি কুটি অক্ষরে লেখা জিনিসগুলোকে আর্টিকল বলে, এটা জানা গেল। মেসো তারপর আচ্ছা করে দাদার পিত্তি
চটকাল একঘন্টা ধরে। বলল, “এইবেলা
বলে রাখছি। কাল সকালে যদি মধুমালাইয়ের
জঙ্গলে যেতে চাস তাহলে ভালোয় ভালোয় আজকের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের ফ্লোরা আর ফনার ওপরে এই লেখাটা পড়ে শেষ কর।”
এটা শোনার পর দাদাকে আর
একদম গাঁইগুঁই করতে দেখা যায়নি। সারা সন্ধ্যা
বই মুখে বসে থেকেছে। বেড়ানোর লোভ
বাবা, তার ওপর জঙ্গলে। আমি একবার ফিসফিস করে জেনে নিয়েছি, ফ্লোরা আর ফনা মানে কী।
ফ্লোরা মানে গাছপালা-ফুলফল আর ফনা মানে জন্তুজানোয়ার-পাখিপোকা।
তবে দাদাকে যেই জিগ্যেস
করলাম নতুন মেসোকে চোখে চোখে রাখার ব্যাপারটা কী
হল, আর এত্ত ঘুমোলে ও কী করে সেটা করবে, অমনি দাদা বেজায় রেগে আমাকে মুখ ভেংচে দিল
আর চ্যুইং গাম-টামও আর শেয়ার করবে না বলল।
সন্ধেবেলা দেখা গেল মাসি
বসেছে একগাদা খাবারদাবার তৈরিতে। আমিও সাহায্য
করলাম। টোস্টে মাখন মাখালাম, ঝুড়িতে জ্যাম আর আচারের শিশি, স্যান্ডুইচের প্যাকেট
সাজিয়ে রাখলাম। মাসি অনেকগুলো ইডলির মতো দেখতে
কী যেন বানাল, আর নোনতা পুলিপিঠে। এগুলো শুকনো খাবার, কাল সক্কালে আমরা এগুলো খেতে
খেতে মধুমালাই যাব। তাছাড়া মাসি বলল, রাস্তায় লাল টুকটুকে কলা, কাঁচামিঠে আম, আর মেট্টুপালায়াম থেকে কিলোখানেক
কাঁচকলার চিপস আর প্ল্যানটেইন চিপস কিনে নিলেই চলবে। প্ল্যানটেইন একরকমের কচু, কাঁচকলার মতোই ভেজে খায় এখানে। কলকাতার সেই লঙ্কাগুঁড়ো মাখানো কটকটে কচুভাজাগুলোর মতোই অনেকটা খেতে।
মেসো টাটা সুমো ভাড়া করেছে। তার ড্রাইভার রামু এসে পরদিন সক্কালবেলা আমাদের সবাইকে অত সকাল সকাল রেডি
দেখে অবাক। ছ’টা বাজতে না বাজতেই আমাদের ব্যাগ
গোছানো, বেতের ঝুড়ি সুমোয় তোলা, এইসব শেষ। আমরাও হালকা
সোয়েটার পরে আর গলায় কাপড়ের স্কার্ফ জড়িয়ে দিব্যি ঢাকাঢুকি দিয়ে জানালার কাচ খুলে
দিয়ে কে কোন ধারটা নেব এই নিয়ে ঝগড়া করছি। মাসিও
সালোয়ার-কামিজ পরে, ফুলহাতা সোয়েটার পরে
সামনে বসবে বলে মেসোকে বায়না জুড়েছে। এমন সময়
মেসো বলল, “এই য-যাহ্! আমার সেই যন্ত্রপাতিই তো
আনা হল না।” বলেই একদৌড়ে আবার বাড়িতে ঢুকে গেল।
“যন্ত্রপাতি
আবার কীসের?” মাসি কঁকিয়ে উঠল।
গাড়িতে স্টার্ট দেব দেব
করছে রামু, আর একটু পরেই আমরা পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামব সমতলে। রামু ততক্ষণে ইংরিজি-হিন্দি-তামিল মিলিয়ে-মিশিয়ে মাসি আর দাদাকে একটু
বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমাদের গন্তব্য এখন মৃদু মালাই, মোটেও মধুমালাই না। আর সেটা যেতে মোটেই পথে মেট্টুপালায়াম পড়ে না,
উদগমন্ডলম বা উটি হয়ে আরও একশো কিলোমিটার গেলেই মধুমালাই।
মাসির অবশ্য ভুল হতেই
পারে, কারণ কাজে অকাজে মাসিকে তো কুন্নুর থেকে
কোয়েম্বাটোর যেতে ঐ মেট্টুপালায়াম হয়েই যেতে হয়। ওখান থেকেই তো কুন্নুরের টয়ট্রেনও ছাড়ে।
বেশ খানিকক্ষণ অধীর
অপেক্ষার পর মেসো নেবে এল। ঘাড়ে এক বিশাল লম্বাটে বাক্স। অনেকটা বাঁশি বা
ট্রাম্পেটের বাক্সের মতো দেখতে। দেখে তো মাসির
মেজাজ তুঙ্গে। “এই লটবহর নিয়ে মধুমালাই যাচ্ছ
তুমি? কী আছে শুনি এতে, হাতিঘোড়া? দূরবিন না আড়বাঁশি?”
মেসো দেখলাম বকা খাওয়ার
সময় অস্বাভাবিক শান্তভাবে বুড়ো আঙুলে কান খুঁটতে লাগল। আর রামুকে তামিলে কী একটা
বলে নিয়ে তারপর আমাদের দিকে ফিরে বলল, “সাবধান,
উটির পরেই কিন্তু আসছে তেইশখানা হেয়ারপিন বেন্ডওয়ালা রাস্তা কালাহাট্টি ঘাট রোড। ভূ-ভারতে এতগুলো বাঁকওয়ালা রাস্তা
নেই, বুঝলি?”
দাদা এখন চুপ। মাঝে মাঝেই
আমি ফিসফিস করে দাদাকে জিগ্যেস করে নিচ্ছি অনেক জমে থাকা প্রশ্ন।
“মেসো ওটা
কীসের বাক্স আনল রে দাদা?”
“অ্যাই চুপ। স্পিকটি নট। ব্যাপারটা ভীষণ সন্দেহজনক।”
“দাদা,
ওটাতে আমার মনে হচ্ছে বন্দুক আছে। লাঠিসোঁটাও হতে পারে।”
“যন্ত্রপাতি
বলল শুনলি না, স্টুপিড? লাঠি কি যন্ত্র? ওটা নির্ঘাত মেশিনগান।”
আমি চুপ মেরে গেলাম। এতে
দাদা আরও ভীষণ রেগে গেল।
মেসো সামনে থেকে গলা খাঁকরে আওয়াজ দিল, “কী নিয়ে ফিসফিস হচ্ছে, বাছারা? মধুমালাই গেলেই টের পাবি ভেতরে কী আছে, হুঁ হুঁ বাবা। তবে
পুঁটিরানির বুদ্ধি আছে।”
আমি আবার একটুক্ষণ চুপ
থাকার পর মিনমিন করে বললাম, “অ্যাই, হেয়ার-পিন জিনিসটা কী রে?”
“আরে
বুদ্ধু, চুলের কাঁটার মতো ঘোরালো পাহাড়ি রাস্তা,
যখন নিচ থেকে ওপরে ওঠে রাস্তাগুলো, তখন
ঐরকম বেঁকে বেঁকে ওঠে।”
“পাকদন্ডী
বলে রে ওটাকে। বাংলাটাও একটু শেখ, মামণি! কেন
ঘুরে ওঠে জানিস, সোজা উঠতে গেলে অনেক
বেশি চড়াই উঠতে হবে তো। অতটা গ্রেডিয়েন্ট না উঠে অল্প অল্প করে...”
এটা
বলল মাসি। ইতিমধ্যেই পোঁটলা ব্যাগ থেকে কীসব ভালো ভালো মশলা আর হজমি বার করে করে
খাচ্ছে, আর চাইলেই বলছে, “ব্রেকফাস্টের পর খাবি। তোদের তো পেটে কিচ্ছু
নেই, এখন খেলে নাড়িভুঁড়িই হজম হয়ে যাবে।”
আর গাড়ি
যত চলছে ততই খিদে পাচ্ছে আমার। পাবে না? একে তো পাহাড়ি রাস্তা, তার ওপর কী চমৎকার
ফুরফুরে হাওয়া, ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। আর বিশাল বিশাল গাছগুলোর, গাছের
গায়ে বুনো লতাগুলোর ছাতার মতো বড়ো
বড়ো সবুজ পাতা ছুঁয়ে একটা কেমন
ভেজা জংলা সবুজ সবুজ গন্ধ আসছে নাকে। আচ্ছা, ক্লোরোফিলের কি গন্ধ হয় নাকি? কিন্তু জঙ্গলে না
এলে এরকম গন্ধ তো পাওয়াই যায় না। বেলা বাড়ছে, রোদ উঠল। যেই না দেখলাম রোদ উঠল,
অমনি সামনে রাস্তাটা গাছের ছায়ায় আর তার ফাঁক দিয়ে আসা রোদ্দুরে কেমন জেব্রার মতো
ডোরাকাটা ডোরাকাটা হয়ে গেল। আমারও গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। তবে ডোরাগুলো সাদা-কালোর
বদলে সবুজ আর সোনালি রঙ। ঝলমল করছে।
দাদা
যদিও একটা ছোটোখাটো পাখি বা বাঁদর দেখলেই ভীষণ স্মার্ট হওয়ার
চেষ্টা করে বলছে, “আরে, ওটা তো অ্যানিমাল প্ল্যানেটে দেখেছি।”
মেসো
হাসছে। বলছে, “তোদের টিভিতে তো শুধু ছবি আর আওয়াজ। গন্ধটা ভালো করে
শোঁক। তোরা তো সত্যি এমন সব চীজ, দেখলে আমার কাতুকুতু লাগে। চিড়িয়াখানায়
যাস না কতদিন? বল তো হায়েনার ঘরের গন্ধটা কেমন?”
মেসো
এসব বললে দেখেছি দাদা কিছু বলতে পারে না। গুম হয়ে থাকে। এদিকে ঘন্টাখানেক একনাগাড়ে
চলার পর রামু ড্রাইভার একটু গাড়ি থামাল। আমরাও কখন খাবার খাব ভেবে হাঁকপাঁক করতে
লাগলাম। মাসির বানানো ওই কী যেন কী পুর দেওয়া পুলিভাজাগুলো পিকনিক বাক্সের ভেতর
থেকে নড়েচড়ে উঠল মনে হল। মাসি সব ব্যাপার বুঝে যেই বাক্সটায় হাত দিতে যাবে অমনি
খোলা সুমোর জানালায় হুপ করে এক গোদা বাঁদর এসে জানালার ফ্রেম জুড়ে বসল।
তারপর সে মাথাটা ভেতরে ঢোকাতে আমরা ‘ই-ই-ই’ করে চেঁচিয়ে এমন আঁতকে উঠলাম আর সবাই মিলে
হুড়মুড় করে এ ওর ঘাড়ে পড়লাম, যে সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার দাঁড়াল।
বাঁদরভায়া মনে হল অপমানিত হয়েই ইতিউতি দেখে সুট করে কেটে পড়ল।
মাসি
বলল, “ধ্যাত, এইভাবে খাওয়া যাবে না। হয় জানালা বন্ধ
কর, নয় একটা নিরিবিলি কোথাও বসে খাব।”
দাদা
আঙুল দিয়ে দেখাল, ঠিক রাস্তার পাশেই একটা গাছে যত না পাতা দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে
বেশি বাঁদর বসে আছে! ডালে ডালে থিক থিক করছে আমাদের পূর্বপুরুষ।
মেসো
এবার আমার দিকে ফিরে বলল, “ছিঃ পুঁটিরানি, মুখখানা ওরকম ফ্যাকাশে করে বসে
থাকতে নেই। ওরা আর কী করবে বল, শহর থেকে আমরা তো ওদের তাড়িয়েই দিয়েছি। ওরা
এখন পাহাড়ের কোলে এসে আশ্রয় নিয়েছে।”
দুপুরবেলা
মৃদুমালাই বা মুদু মালাই পৌঁছনো গেল। ইতিমধ্যে বন্ধ গাড়ির ভেতরে একগাদা খাবার
ধ্বংস করেছি। এবার ফরেস্ট-বাংলোতে নেমে, মুখ-হাত ধুয়ে, আমাদের সব জিনিসপত্র
নামিয়ে জামাকাপড় পালটানো হল। খালি গায়ে একটা সাদা মুন্ডু মানে
লুঙ্গি পরা রাঁধুনির রান্না করা সম্বর আর রসম দিয়ে ভাত খাওয়া হল। বাংলোর সামনে
একটুখানি ফাঁকা জায়গায় চেয়ার-টেবিল পাতা, সেইখানে বসে। মেসো বলল, “এবার
জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া। তার আগে একবার তাই চির ব্যায়ামগুলো করে নিলে পারতিস,
তাহলে শরীর ফিট থাকত, জঙ্গলে বিপদে পড়লেও অসুবিধে হত না।”
যেই
বলা, সেই কাজ। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে হাতদুটো মাথার ওপরে তুলে ঝন
ঝন করে ঝাড়তে লাগল। তারপর হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে দু’হাত দুলিয়ে কোমরের জং ছাড়াতে
লাগল। আমরাও পাশে দাঁড়ালাম, কিন্তু হাতে-পায়ে খিল লেগে যেতে লাগল, মাথা বিজবিজ করতে লাগল।
মেসোটা যে কী পাগলামো করে না!
তারপরই
আমাদের তোয়াক্কা না করে বিশাল কাঠের বাক্সটা পেছনের দিক থেকে কাঁধে নিয়ে মেসো
সামনের সিটে রাখল। আমাদের এখুনি জঙ্গলে পাঠিয়ে দিতে চায় যেন এমন একটা ব্যস্ত
ব্যস্ত চটপটে ভাব। বলল, “ইয়ে মানে, আমার একটা নিজস্ব কাজ আছে, বুঝলে তোমরা? তোমরা
নিজেদের মতো ঘোরো, বেশিদূরে যেও না। যদি যাও, হাত-পা
কাঁটাগাছে ছড়ে গেলে ব্যাগে আইডিন আছে, লাগিয়ে নিও।”
বলেই
হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা মেসো কেমন সুড়ুৎ করে গাড়িতে উঠে
পড়ে রামুকে তামিলে অনেক কিছু বলতে লাগল। রামুও খুব উত্তেজিত হয়ে হাঁই হাঁই করে কীসব
বলল, মনে হল যেখানে মেসো যাচ্ছে সেখানকার পথের দিশা বাতলে কীসব যেন আশ্বাস-টাশ্বাস দিল।
তারপর ঘ্যাঁড়র-র-র করে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ভোঁ-ভাঁ হয়ে গেল। আমি আর দাদা
ভীষণ দুঃখিত আর হতাশ হয়ে একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম।
এতক্ষণে
দাদার সঙ্গে একটু কথা বলার ফুরসত পাওয়া গেল। আমি জিগ্যেস করলাম, “সত্যি,
মেসোটা ভীষণ অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন, না রে দাদা?”
দাদা
গোমড়া মুখে বালি বালি লালচে মাটির ওপর একটা ভাঙা ডাল দিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচনো
রাক্ষস আঁকছিল। বলল, “মেসো আমাদের এড়িয়ে চলছে, দেখলি তো?
বাক্সে নির্ঘাত কোনও বেআইনি জিনিস-টিনিস আছে। জঙ্গলে চোরাকারবারীদের
আড্ডা হয় জানিস তো? হয় চন্দনদস্যু, নয় বেআইনি পশুর চোরাকারবারী মেসো।
কেউ বোধহয় মেসোর সঙ্গে ডিল করেছে। মেসোর ওই বাক্সে কিছু একটা গোপন জিনিস আছে।”
“যদি বন্দুক হয়? মেসো কি লুকিয়ে শিকার করতে গেল? কিন্তু
যদি পুলিশে ধরে মেসোকে?”
“তা তো ধরতেই পারে। এখানে তো লেখাই আছে রিজার্ভ ফরেস্ট।
মানে বন্যপ্রাণীরা এখানে সংরক্ষিত। উফ্, ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, আমাদের মেসো একজন
চোরাশিকারি!”
ঠিক
এইসময় মাসি প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এল কাঠের
বনবাংলোর উঠোনে। এতক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে, জঙ্গলে বেরনোর জন্য পুরো তৈরি। আমাদের
ওরকম বসে থাকতে দেখে একগাল
হেসে বলল, “কী রে, মেসোর দুঃখে যে বসেই পড়লি তোরা। চল চল, জঙ্গলটা
একবার ঘুরে আসি। দারুণ রোদ্দুর উঠেছে। আবার কখন বৃষ্টি নামে বলা তো যায় না!”
আমরাও
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে মাসির সঙ্গে বেরোলাম। মাসিটা এত ভালো, তার বর কখনও
অপরাধী হতে পারে? ধ্যাৎ! সব চিন্তা নিমেষে মিলিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে
গেলাম। বনঘুঘু, সজারু আর বাঁদর বিস্তর
দেখলাম। সজারুরা খচমচ করে পালায়। কাঁটায় ঝুমঝুম মতো শব্দ হয়। মাসি অনেক ছবি তুলল। বলল, কাল নাকি গাড়ি নিয়ে আমাদের হাতিদের ট্রেনিং
সেন্টারে নিয়ে যাবে। ফেরার পথে মাহুতসহ একটা হাতিও দেখলাম। আমাদের
দেখে মাহুত হাতিকে দিয়ে আমাদের সেলাম করাল। বলল, হাতির পিঠে বসতে গেলে হাওদা
লাগবে। সেটা নেই বলে এ-যাত্রা আমাদের আর হাতি চড়া হচ্ছে না। মাহুতের
কথাটা আমরা কী করে বুঝলাম এখনও জানি না, কারণ ওরা একবিন্দু হিন্দি জানে না। একটু
ইংরিজি আর অনেকটা তামিল মিশিয়ে কথা বলছিল। কিন্তু সব বোঝা যাচ্ছিল।
ঘুরে-ফিরে
এসে আমরা হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব ক্লান্ত। মেসোর কোনও চিহ্ন
নেই। বিকেল পার হতে চলল। মাসি বনবাংলোর ওই সাদা-মুন্ডু পরা কুককে নিজের
টুটাফুটা তামিল আর সাইন ল্যাংগুয়েজে চা বানাবার কায়দাকানুন শেখাচ্ছে। হঠাৎ দাদা
এসে ফিসফিস করে আমাকে বলল, “এই-ই মওকা, মেসোর ব্যাগটা সার্চ করতে হবে, বুঝলি?”
আমিও
লাফিয়ে উঠলাম। মেসো যে এই গোপন কান্ডকারখানা চালাচ্ছে, তার কোনও হদিশ তো মেসোর
রেখে যাওয়া পেটমোটা পিঠে বাঁধা ব্যাগের ভেতরে পেলেও পাওয়া যেতে পারে। এটা
আমার মাথায় আগে আসেনি। দাদাটার বুদ্ধি হচ্ছে।
চুপচাপ মেসোদের ঘরে গিয়ে এক কোনায় থেবড়ে বসে আমরা মেসোর ব্যাগ
থেকে একটা একটা করে জিনিস বের করলাম। দশ প্যাকেট সিগারেট দেখে রেগে উঠে দাদা সেগুলোকে
ধ্বংস করতে চাইছিল, আর কুটকুটে নোংরা দলা পাকানো জামাকাপড় দেখেও বেশ রেগে
গেছিল। কিন্তু আমিই আসল জিনিসগুলো খুঁজে বার করলাম। এক নম্বর হল একটা বই, দু’নম্বর
একটা ডায়েরি। বইটা দাদার হাতে দিতেই দাদার চোখদুটো গোল হয়ে উঠে জ্বলজ্বল করতে
লাগল। আইকিডো শব্দটুকু বোঝা গেলেও, ইংরিজির মতো দেখতে লেখাটা পড়ে ও কিচ্ছু
মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না। বলল, “ফরাসিতে লেখা মনে হচ্ছে রে।” ওর
কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। শুধু পাতায় পাতায় ক্যারাটের পোশাকের মতো সাদা
ফতুয়া-পাজামা আর কোমরে বেল্ট পরা লোকেদের ছবি, সবাই কসরত
করছে; জুজুৎসুর প্যাঁচ কষছে। মেসো আইকিডো করে জানা ছিল,
কিন্তু এই বইটা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কেন? আর ওরকম ভুঁড়ি নিয়ে এমন সব প্যাঁচ কষা কী করে
যে সম্ভব সেটাই ঠিক বোঝা গেল না।
ডায়েরিটা
খুলে দেখা গেল, আজকের তারিখের জায়গায় গোল গোল দাগ। তারপর মেসোর হাতের লেখায়
ইংরেজিতে লেখা, ক্যাম্প অ্যাট মুদুমালাই, সেনসেই চিঙ্কারা।
দাদার
আর আমার লোম খাড়া খাড়া হয়ে গেল। সেনসেই চিঙ্কারা নিশ্চয়ই কোনও গোপন
সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনীর নাম। আর ক্যাম্প কথাটা শুনলেই সার সার রাইফেল
আর খাকি পোশাক পরা লোকেদের লুকোনো ডেরার কথা মনে হয়। এই ঘোর জঙ্গলে যেটা থাকা
কিছুই বিচিত্র নয়।
চটপট
সব জিনিস আবার যেমন তেমন করে মেসোর ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগের মুখটা বেঁধে রেখে দেওয়া
হল। আমরা বাইরে আসতে না আসতেই আবার গাড়ির শব্দ। মেসো ফিরে এল। লম্বাটে বিদঘুটে বাক্সটাও
মেসোর সঙ্গেই ফিরেছে দেখলাম।
সারা সন্ধ্যা
মেসো আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসল। টিমটিমে হারিকেনের আলোয় আমরা ইডলি আর
দোসা খেলাম। ইডলির সঙ্গে লাল টুকটুকে একটা মাংসের ঝোল। মুখে দিতেই মনে হল কান-মাথা অবধি আগুন
লেগে গেল। উহু, কী ঝাল! মেসো মাসিকে জিগ্যেস করল, আমাদের কী হয়েছে। জংলি
বিচ্ছুর কামড় খেয়েছি মতো মুখ করে কেন বসে আছি। মাসি বলল, “ওরা ভীষণ বোর হচ্ছে, বুঝলে? কাল
তুমি ওদেরও নিয়ে যেও ক্যাম্পে।”
মেসো
বলল, “হুঁ, আমিও তাই ভাবছি। ওদের এত বড়ো একটা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত
করাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া এই তপুটার তো খান কয়েক আছাড় খেলেই বুদ্ধি খুলে
যাবে। বাড়িতে সারাদিন ভিডিও গেম খেলে খেলে তো ঘাড়ের রগে জট পাকিয়ে জাম হয়ে যাচ্ছে।”
মাসি
আর মেসো দু’জনেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। আমি কিচ্ছু বুঝতে
পারলাম না, কিন্তু উত্তেজনায় সারারাত আমাদের দু’জনের কারুরই ঘুম হল না। বুক
ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।
পরদিন সকালে ঠিক যেন বলির
পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে উঠলাম।
দাদা একবার বলল, “আমি, ইয়ে, মানে, আমার পেট
কামড়াচ্ছে।”
কিন্তু মেসোর মুখে একটু
কেমন যেন গায়ের রক্ত হিম করা হাসি খেলে গেল। কিচ্ছু না বলে রামুর পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল।
গাড়ি চলল জঙ্গুলে পথ ধরে।
পথটা খুব সুন্দর, নানান পাখির কঁক-কঁকানি,
কুব কুব ডাক। কিন্তু আমাদের তখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এসে ধক ধক করছে। মেসো বা রামুকাকাও নিশ্চয়ই আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছে।
আধঘন্টার ওপর চলে, গাড়ি
যেখানে থামল সেখানে সত্যিই একটা খোলা জায়গায় বেশ ক’টা কাঠের দেওয়াল আর খাপরার চালের লম্বাটে ঘর। মধ্যে ফাঁকা জায়গায় অনেক বালি
ছড়ানো। আর বেশ ক’জন সাদা ক্যারাটের পোশাক পরা লোক
সেই বালির ওপর ধ্যানের ভঙ্গিতে পা ভাঁজ করে বসে আছে। দু’হাত কোলের ওপর রাখা। মেসো গাড়ি থেকে নেবেই মাথা ঝুঁকিয়ে জাপানি ভঙ্গিতে
একটা সেলাম ঠুকল সামনে বসে বয়স্ক এক মানুষকে। সবাই ভীষণ গম্ভীর, কেউ কথা বলছে না,
হাসছে না। দেখলেই ভয় ভয় করে। এদের মধ্যে আবার দেখলাম কয়েকজন সাদা চামড়ার সায়েব।
যদিও রোদে পুড়ে তাদের গায়ের রং তখন টকটকে লাল।
কোমর থেকে ঝুঁকে সেলাম
করেই মেসো নিজের বাক্স নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আমরা বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। ও মা, দেখি ভেতর থেকে মেসোও কারাটের পোশাক পরে
বেরিয়ে এল, কোমরে সাদা বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে। হাতে একটা লাঠি আর একটা কাঠের তরোয়াল।
এবার লক্ষ করলাম, বসে থাকা সবার পাশেই ওইরকম লাঠি আর তরোয়াল। আর সবার পাজামার আর
বেল্টের রং সাদা হলেও সামনের আলাদা হয়ে বসা মানুষটার পরনে কালো লুঙ্গির মতো জিনিস। সেটার কালো ফিতে কোমরে পাক দিয়ে
বাঁধা। বোঝাই যাচ্ছে ইনিই টিচার। কিম্বা গুরু। যাকে দেখলেই সবাই ঢিপ ঢিপ করে মাথা
ঝুঁকিয়ে সেলাম ঠোকে আর ভীষণ ভয় পায়।
আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে দেখছি। মেসো দিব্যি ওদের সঙ্গে মিশে গেছে। সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে, আর
তরোয়ালের মতো কাঠের টুকরোগুলোকে দু’হাতে ধরে তাক কষে ছবির মতো পোজ দিয়ে
দাঁড়াল। যেন নাটক বা সিনেমা। তারপর
আমাদের পিলে চমকে দিয়ে উঠল এক বিশাল হুঙ্কার। প্রথমে
গুরুর গলা থেকে, গলা তো নয়, যেন পেট থেকে। তারপর শিষ্যদেরও। হেইইইইই হোঃ!
চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে তরোয়াল বন বন করে ঘুরতে লাগল। নাচের তালে তালে যেন বাঁদিক-ডানদিক সামনে-পেছনে ফিরে ফিরে তরোয়াল ঘোরানোর
পালা চলল। সঙ্গে ‘ইচ নি সান চি’
‘ইচ নি সান চি’ বলে সে
কী মারাত্মক হাঁকডাঁক। আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে লাগলাম। হেই হুই হিয়াঃ – চিৎকার মাঝে মাঝে, আক্রমণের ভঙ্গিতে। আওয়াজগুলো
জঙ্গলের থমথমে পরিবেশে দারুণ মানিয়ে গেছে। খট খট কাঠের
তরোয়াল ঠোকাঠুকির আওয়াজ তার সঙ্গে সঙ্গে।
কিছু পরে তরোয়াল নামিয়ে
রেখে ওরা লাঠি তুলল। দু’জন দু’জন মুখোমুখি দাঁড়াল। একজনের লাঠির ঘায়ে আর একজনের হাত থেকে লাঠি খসে যাচ্ছে।
লড়াই চলছে, কিন্তু নকল লড়াই। কারণ, কেউ
ব্যথা পাচ্ছে না। সবাই খেলার মতো করে এ
ওর হাত থেকে লাঠি ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। একবার এক নম্বর দু’নম্বরকে কুপোকাত করে তো পরের বার দু’নম্বরের
এক নম্বরকে জব্দ করার পালা। আর মধ্যে মধ্যে কেবল মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম ঠোকা। আর জুটি
বদল করা। সবাই সবকিছু করে যাচ্ছে যেন মন্ত্রপড়া পুতুলের মতো। কোনও কথাবার্তা নেই।
লাঠিখেলা শেষ হতেই
শুরু হল সেই বইয়ের ছবিতে দেখা জুজুৎসুর প্যাঁচের খেলা। ও মা কী অবাক কান্ড, মেসোর মতো বেঁটে আর ভুঁড়িদার লোকও দেখি একটা এই লম্বা দৈত্যের মতো লোককে তেড়ে আসতে দেখে একটুও ঘাবড়াল না, উলটে এক আঙুলে কী একটা প্যাঁচ কষে পুরো এক নিমেষে পটকে দিল। লোকটা দড়াম করে এক
আছাড় খেয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে পড়েই কিন্তু দমল না, আবার মাটিতে চাপড় মেরে উঠে ফের
মেসোর দিকে তাড়া করল। পর পর তিন-চারবার
মেসো লোকটাকে হাতের প্যাঁচ ঘুরিয়ে উলটে ফেলল।
তারপর লোকটার আর মেসোর
আবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরস্পরকে জাপানি কায়দায় কোমর ভেঙে মাথা ঝুঁকিয়ে সে কী নমস্কার
আর প্রতিনমস্কার করার ঘটা। হেসে বাঁচি না। তারপর উলটে আবার মেসো লোকটাকে তেড়ে যায় আর লোকটা মেসোকে আছাড় দেয়। হুঁ হুঁ বাবা, যাবে কোথায়। মেসোরও তাহলে এল আছাড় খাওয়ার পালা।
ঘন্টা দুয়েক এরকম
ধ্বস্তাধ্বস্তির পর ধুলোবালিমাখা ঘেমে চুপ্পুস লোকগুলো উঠে আবার ধ্যানে বসল। তারপর
মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে পেন্নাম করে উঠে পড়ল। আর সবাই মিলে গিয়ে জল আর দইয়ের সরবত খেতে
লাগল। যাক বাবা, তাহলে মেসোর রহস্য এটাই। দাদার মুখ
দেখে
বোঝা
গেল, মেসোর
প্রতি
ভক্তি-শ্রদ্ধা
আবার
একটু
একটু
করে
ফিরে
আসছে। এতক্ষণে মেসো
আমাদের
কাছে
এসে
বলল, “কী
পুঁটিরানি, শ্রীযুক্ত
তপনেন্দ্র! কেমন
লাগল
আইকিডো! চলো,
তোমাদের
একটু
তুলে
আছাড়
দিই।
গায়ের
জড়তা
কেটে
যাবে।”
আমাদের ডেকে
নিয়ে
গুরুদেবের
কাছে
দাঁড়
করাল
মেসো।
তারপর
মেসো
আর
মেসোর
বন্ধুরা
আমাদের
ঘিরে
ধরে, আইকিডোর
প্রাইমারি
মুভমেন্টগুলো
শেখাল। কীভাবে উকে
আর
সিমে, মানে
আক্রমণকারী
আর
আক্রান্তকে
দাঁড়াতে
হয়, কীভাবে
এ ওর
ওপর
আক্রমণের
ভান
করতে
হয়
আর
আক্রমণকারীকে
এড়িয়ে
গিয়ে
বা
তার
শরীরের
ভারকে
আর
আক্রমণের
ভঙ্গিকেই
তার
বিরুদ্ধে
ব্যবহার
করে
তাকে
পটকে
দিতে
হয়, উলটে
ফেলতে
হয়, সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ
শেখাল।
আরও আধঘন্টা
এইসবে
কাটল।
আজব
জিনিস
এই
আইকিডো। মোটা লম্বা
বিশাল
সাইজের
লোককে
আমার
মতো
পুঁচকেও
পটকে
দিতে
পারে, যদি
কায়দা
জানা
থাকে।
আত্মরক্ষার
এর
চেয়ে
ভালো
উপায়
আর
নেই।
মানুষের
হাতের
নানান
পয়েন্টে
চাপ
দিলেও
তাবড়
তাবড়
ভিলেনও
শিশুর
মতো
কঁকিয়ে
উঠবে, আইকিডো
সেটা
শেখায়।
মাসিও আমাদের
সঙ্গে
সঙ্গে
করছিল।
দেখা
গেল
মাসিও
অনেকটা
আইকিডো
জানে।
কিন্তু
আমাদের
জন্য
এবার
আর
ওয়ার্কশপে
নাম
লেখায়নি।
ফেরার পথে
দাদা
কুঁই
কুঁই
করে
বলল, “সবই
তো
বুঝলাম, কিন্তু
সেনসেই চিঙ্কারাটা
কী
জিনিস?”
মেসো হো
হো
করে
হেসে
বলল, “কোথায়
দেখলি? ওহো, আমার
ডায়েরি
ঘেঁটেছ
তোমরা? তাই
কাল
সিগারেটের
খোলা
প্যাকেটটা
খুঁজেই
পেলাম
না, পরে
দেখি
খাটের
নিচে
পড়ে
আছে। সেনসেই কথাটার
জাপানিতে
মানে
শিক্ষক বা
গুরু। ঐ যে যিনি
আমাদের
শেখাচ্ছিলেন,
ওঁর
নাম চিঙ্কারা। আমরা ডাকি
সেনসেইন চিঙ্কারা। লালমুখো সাহেবদের
ওঁর
প্রতি
কেমন
ভক্তি, দেখলি
তো? বছরে
দু’বার
করে উনি
ফ্রান্সে
শেখাতে
যান, আর
জাপানে
নিজে
যান
শিখে
আসতে।”
আমি বললাম,
“আচ্ছা
মেসো, এইজন্য
তুমি
আমায়
বুদ্ধিমতী
বলেছিলে? তোমার
বাক্সে
যে
লাঠিসোঁটা
আছে
আমিই
তো
আন্দাজ
করেছিলাম
প্রথম।”
“হ্যাঁ, জো মানে
ওই
লাঠি, অনেক
ভালো
কাঠে তৈরি। কেন হল
তরোয়ালটা।
আজ
পুঁটিরানির
অনারে
একটা
জম্পেশ
খাওয়াদাওয়া
হয়ে
যাক।
আজ
আমরা
বনমোরগের
মাংস
খাব।
বাংলোর
কুকের
যা
ঝালের
হাত, ওর
ওপরে
ভরসা
করা
যায় না। তোদের মাসিকেই
বলেছি
রাঁধতে।”
আহ্, ভাবতেই
জিভে
জল
এসে
গেল।
খিদেটাও
জব্বর
পেয়েছে।
বালির
ওপর
ডলফিনের
মতো
উলটে পড়া, ফল
নেওয়া
যাকে
বলল
মেসো, তা
তো
অনেকবারই
করলাম।
সারা
গায়ে
চনমনে
ব্যথা, আর
পেটে
জমজমে
খিদে। খিদের
চোটে
জঙ্গলের
টাটকা
ঠান্ডা
বাতাসই
একগলা
খেয়ে
নিলাম।
_____
অলঙ্করণঃ দীপিকা মজুমদার
No comments:
Post a Comment