
ঘুড়ি যখন সংকেত
দীপিকা মজুমদার
(১)
ভিখিরির বেশে গোয়েন্দার
সাহায্যে পাড়ার দুর্গামন্দিরের গয়না চোর লালটু-কালটু আর তাদের স্যাঙ্গাতদের
ধরিয়ে দেওয়ার পর গুবলু-টুবলুর বেশ নামডাক হয়েছিল। নিউজ পেপার
আর নিউজ চ্যানেলগুলো এক এক করে বাড়িতে এসে ওদের সাক্ষাৎকারও নিয়ে গেছে। সেই
সাক্ষাৎকার দেখে গুবলু-টুবলুর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল
ম্যাডামও ক্রিসমাসের ছুটির আগের দিন ঘটা করে ওদের সংবর্ধনা জানালেন।
সাহসিকতার জন্যে অনেক বাহবা দিলেন দু’জনকে, পাশাপাশি এও
জানিয়ে দিলেন - যতই গোয়েন্দাগিরি করো না কেন, পড়াশোনা ঠিকঠাক না করলে ভালো গোয়েন্দাও
হওয়া যায় না।
বাড়িতে গুবলু-টুবলুকে নিয়ে সবাই খুব খুশি। বাবা উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করলেও গুবলু একদিন
শুনেছিল, বাবা কাউকে ফোনে বলছিল, “ওদের
দু’জনের মগজের জোরেই তো চোরদুটো ধরা পড়ল।” স্কুলে গেলেও গুবলু-টুবলুর গোয়েন্দাগিরির গল্প ঘুরেফিরে
জিজ্ঞেস করে ওর বন্ধুরা। এতসবের মাঝেও শুধু একজন গুবলু-টুবলুর এই গোয়েন্দাগিরি
ভালো চোখে দেখেনি। সে হল ওদের ক্লাসের রূপম চৌধুরী। রূপম এমনিতে পড়াশোনায় ভালোই,
তবে দোষের মধ্যে একটাই যে একটু সবজান্তা ভাব দেখায়। চোর ধরার খবর শুনে যেদিন
ক্লাসের সবাই গুবলু-টুবলুকে ঘিরে ধরল ওদের অভিযানের কথা শুনতে, তখন সেই দলে রূপমও
ছিল। সব শুনে পিকলু জিজ্ঞেস করল, “আরিব্বাস! বন্দুক দেখে তোদের ভয় করল না?”
“প্রথমে একটু ভয় ভয় করছিল।
কিন্তু যখন জানলাম যে লোকটা ভিখিরি নয় গোয়েন্দা, তখন আর ভয়-টয় লাগেনি।” গুবলুই
জবাব দিল।
গুবলুর মুখে ঘটনা শুনে সবাই
যখন ওদের সাহসের জন্যে প্রশংসা করছে তখন রূপম হঠাৎ বলে উঠল, “এতে এত ভয় পাওয়ার কী
আছে? আমিও বন্দুক দেখেছি, আমার ছোটোকাকা পুলিশ। আর বন্দুক তো নিজে নিজেই চলবে না,
চালাতে হবে।”
রূপমের এই আচরণের জন্যে ওকে
একটু এড়িয়েই চলত গুবলু-টুবলু। তা এসব ঘটনার প্রায় বছর ঘুরতে চলল।
পরের মাসেই দুর্গাপুজো। তার আগে অবশ্য পরীক্ষাও আছে। কিন্তু এই পরীক্ষার মুখেই
রূপম হঠাৎ স্কুল কামাই করতে শুরু করল। রূপমের কি শরীর খারাপ? ক্লাসে যে পড়া এগিয়ে
যাচ্ছে! কৃতিকা একদিন স্কুলে এসে বলল, “রূপমদের বাড়ি গিয়েছিলাম কাল, কিন্তু ওর
বাবা বললেন ওর শরীর খারাপ। কবে স্কুল
যাবে বলতে পারবেন না। এমনকি রূপমের সাথে দেখাও করতে দিলেন না।”
গুবলু-টুবলু ব্যাপারটা নিয়ে
অত মাথা ঘামায়নি, কারণ রূপম এমনিতে ওদের দু’জনকে দেখতে পারে না, হিংসে করে। এদিকে
সামনেই বিশ্বকর্মা পুজো, গুবলু-টুবলুর ছোটোমামা আসছে। ছোটোমামা এলেই ওদের ভীষণ আনন্দ
হয়। পুজোয় নতুন নতুন জামা তো আছেই, তার সঙ্গে নতুন
কমিকসের বই, ছোটোদের শারদীয়াগুলো উপরি পাওনা। এবছর মামা একটু আগেই আসছে। তার কারণ,
আগের বছর দুর্গাপুজোতে ছোটোমামা গুবলু-টুবলুকে কথা দিয়েছে ঘুড়ি ওড়ানো শেখাবে।
সেবার মামার বাড়ি গিয়ে ওরা দেখেছিল অনেকেই ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়ি ওড়ানো
ব্যাপারটা এখনও গ্রাম বা মফঃস্বলের দিকে থাকলেও শহরে একেবারেই লুপ্তপ্রায়। এর আগে
গুবলু-টুবলু ঘুড়ি ওড়ানো দেখে থাকলেও তা টিভিতে। এই খেলাটা হাতেকলমে শেখার ইচ্ছা
ওদের দু’জনেরই। ছোটোমামাকে ঘুড়ি ওড়ানোর খেলার কথা বলতেই মামা বলেছিল, “খেলা বলছিস
কী রে? ঘুড়ি ওড়ানোর তো রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয় কোথাও কোথাও।”
এরপর ছোটোমামা ঘুড়ি নিয়ে যা
যা বলল তা শুনে গুবলু-টুবলুর তো ঘুড়ি ওড়ানো শেখার ইচ্ছাটা আরও প্রবল হয়ে গেল। ছোটোমামা
বলেছিল, “প্রাচীনকালে ঘুড়ি পাতলা রেশম কাপড়ের তৈরি হত। তারপর
যখন কাগজ আবিষ্কার হল তখন থেকে পাতলা রঙিন কাগজ দিয়েই ঘুড়ি বানানো হয়।”
টুবলু অবাক হয়ে বলে, “যাহ!
ঘুড়ি এত পুরনো নাকি?”
“হ্যাঁ রে। ঘুড়ি তৈরির ইতিহাস
থেকে জানা যায় যে ৪০০ খ্রিস্টপূর্বে গ্রিসদেশের ট্যারাস্টাস শহরে আর্কিটাস নামে
একজন প্রথম ঘুড়ি তৈরি করেন। আবার কারও কারও মতে প্রায় ২০০ খ্রিস্টপূর্বে সিন হান
নামের এক চৈনিক সেনাপতি প্রথম ঘুড়ি ওড়ান। আজকালকার দিনে ঘুড়ি ওড়ানো একটা প্রতিযোগিতা
হলেও তখন কিন্তু ঘুড়ি ব্যবহারের অনেক কারণ ছিল। যেমন... যেমন ১৭৪৯ সালে
আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়িতে থার্মোমিটার লাগিয়ে ঊর্ধ্বাকাশের তাপমাত্রা নির্ণয়ের
চেষ্টা করেছিলেন। আবার ১২ ডিসেম্বর ১৯০১ সালে ঘুড়ির মধ্যে অ্যান্টেনা লাগিয়ে
নিউফাউন্ডল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক মার্কনি আকাশের ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ ধরতে সক্ষম
হয়েছিলেন। ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন আকাশে একটি সিল্কের ঘুড়ি
উড়িয়ে তার সাহায্যে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত বিদ্যুৎ ও আকাশের বিদ্যুৎ যে এক তা
প্রমাণ করেছিলেন। যুদ্ধের নানা কাজেও ঘুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে।
চৈনিক সেনাপতি হান সিন নিজের শিবির থেকে শত্রুপক্ষের কেল্লা অবধি ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন,
পরে লাটাইয়ের সুতো মেপে তিনি সেই কেল্লার দূরত্ব জেনে গিয়েছিলেন। এছাড়া ঘুড়িতে
ক্যামেরা বেঁধে শত্রুপক্ষের ছবি তোলা বা ঘুড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে শত্রুপক্ষের জাহাজ
ধ্বংস করার ঘটনা ঘটতেও শোনা গেছে।”
ঘুড়ির ইতিহাস শুনে তো গুবলুর
মুখ হাঁ। বলল, “তা চিন বা গ্রিস থেকে ভারতে ঘুড়ি এল কী করে?”
“শোনা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে
ইটালির বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলোর মাধ্যমে ঘুড়ির কথা সারা ইউরোপের মানুষের
কাছে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। তবে ইউরোপ আর আমেরিকায় ঘুড়ি ওড়ানোর চল পরে এসেছে।
এদিক থেকে আমাদের এশিয়ার দেশগুলো এগিয়ে আছে, বুঝলি? এভাবেই কোনও না কোনও ভূ-পর্যটকের
হাত ধরে ভারতেও ঘুড়ির প্রচলন হয়।”
ছোটোমামার কথা শুনে
গুবলু-টুবলু এত মজে গেছিল যে ছোটোমামা কম্পিউটার খুলে ইন্টারনেটে নানারকম সাইজের
রঙিন ঘুড়ির ছবি দেখিয়েছিল। কোনওটা ড্রাগন, প্রজাপতি, সাপ, মাছ তো কোনওটা ফুলের
মতো। কোনওটা আবার লন্ঠনের মতো রাতের আকাশে উড়ে উড়ে আলো দেয়। এছাড়া চিংড়ি ঘুড়ি,
পাখি ঘুড়ি, সূর্য ঘুড়ির ছবিও দেখেছিল দু’জনে। সাথে জেনেছিল কোন কোন দেশে কখন কখন
ঘুড়ি উৎসব হয়। আমাদের ভারতবর্ষে গুজরাট সহ পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অংশে
মকরসংক্রান্তি অর্থাৎ ১৪ই জানুয়ারির দিন ঘুড়ি ওড়ানো হয়।
এমনকি গুজরাটের কচ্ছের রণ এলাকায় ৩১শে ডিসেম্বর থেকে ৩১শে জানুয়ারি অবধি রণ উৎসবে
পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসে রংবেরঙের ঘুড়ি ওড়াতে। আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গে
ঘুড়ি ওড়ানোর বিশেষ দিন হল বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। বছর বিশেষে এই দিনটা পড়ে ১৭ই, ১৮ই
অথবা ১৯শে সেপ্টেম্বর।
গুবলু-টুবলুকে দেওয়া কথা
অনুযায়ী ছোটোমামা এই বছর এসে হাজির হয়েছে ঘুড়ি ওড়ানো শেখাতে। তার আগে ভালো করে
চিনিয়ে দিয়েছে কোনটা পেটকাটি, কোনটা চাঁদিয়াল। ছোটোমামা এও বলেছে, হাওয়ার বিপরীত
দিকে লাটাই হাতে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু করতে হয়। ছাদে দাঁড়িয়ে ছোটোমামা বলছিল,
“খুব সাবধানে কিন্তু। মাঞ্জাতে আঠা দিয়ে কাচের গুঁড়ো মাখানো
আছে, হাত কেটে যেতে পারে।”
গুবলু লাটাই হাতে দাঁড়িয়েছিল,
আর টুবলু ছোটোমামার সাথে ঘুড়ি হাওয়ার দিকে কীভাবে ওড়াতে হয় শিখছিল। আকাশ পরিষ্কার,
একমাত্র গুবলু-টুবলুদের ঘুড়ি ছাড়া আকাশে আর একটাও ঘুড়ি নেই। হঠাৎ ছোটোমামা বলে
উঠল, “একটু উঁচুতে ওড়াতে পারলে ভালো হয়। না হলে
বিদ্যুতের তারে লেগেই ভোকাট্টা হয়ে যাবে।”
গুবলুর হাতে ঘুড়ি কিছুতেই
উড়ান নিতে চায় না। যতই চেষ্টা করে নেতিয়ে ছাদের ধার বেয়ে পড়ে যেতে
থাকে লাল-হলুদ ঘুড়িটা। গুবলু-টুবলু বেশ হতাশ।
গুবলু বলল, “কিছুতেই ওঠানো যাচ্ছে না তো। কী হবে?”
এবার হেসে, “আচ্ছা, দে আমাকে একবার।”
বলে ছোটোমামা টুবলুর হাত থেকে ঘুড়িটা নিয়ে হাওয়ার দিকে উঁচু করে ছাড়তেই পতপত করে
নীল আকাশে উড়ান নিল পেটকাটি। ছোটোমামা ছুটে এসে মাঞ্জা সামলে নিল।
লাল-হলুদ তখন আকাশে উড়তে উড়তে আরও ছোটো হয়ে যেতে শুরু করেছে। ছোটোমামা মাঞ্জার
সুতো হালকা করে ঢিলা দিতে দিতে বলল, “এইভাবে ধীরে ধীরে সুতো ছাড়। খেয়াল রাখবি
সুতোর মাঝে কিছু যেন না আসে। তাহলে প্যাঁচ খেয়ে মাঞ্জা কেটে যাবে।”
ছোটোমামার তদারকিতে
গুবলু-টুবলুদের লাল-হলুদ পেটকাটি ঘুড়িটা ভালোই উড়ছিল। হঠাৎ কোত্থেকে আরেকটা
নীল-সবুজ পেটকাটি এসে ওদের লাল-হলুদের পাশে উড়তে লাগল। গুবলু
ভাবল, আরে, এ তো আরেকটা ঘুড়ি। কিন্তু এই পাড়ায় কে ওড়াচ্ছে? ঘুড়িটা ঠিক কোনদিক থেকে
উড়ে আসছে দেখতে গিয়েই দেখল টুবলু বলছে, “আরে, সুতোটা ঢিলা লাগছে। যাহ! ওই নীল-সবুজ
ঘুড়িটা আমাদের ঘুড়িটাকে ভোকাট্টা করে দিয়েছে।”
টুবলুর কথা শুনে ছোটোমামা বলল,
“আরে, ভোকাট্টা না হলে ঘুড়ি ওড়ানোর মজাই আলাদা। কাটা ঘুড়িগুলো সংগ্রহ করাটাও
প্রতিযোগিতার একটা অংশ, জানিস?”
গুবলু-টুবলুদের ঘুড়িটা ভোকাট্টা
হয়ে যেতেই নীল-সবুজ ঘুড়িটাও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ছোটোমামা এবার একটা বেগুনি
রঙের ঘুড়ি লাটাইয়ের সুতোয় বেঁধে দিয়ে বলল, “গুবলু, এবার ওড়া দেখি।”
টুবলুর হাতে লাটাই ধরিয়ে
হাওয়ার দিকে হাত উঁচু করে ঘুড়ি ছেড়ে দিল গুবলু। আর সঙ্গে সঙ্গেই বেগুনি রঙের ঘুড়িটা
হাওয়ায় পতপত করে উড়ে চলে গেল। ঘুড়িটাকে
উড়তে দেখে গুবলু খুশি হয়ে দৌড়ে এসে মাঞ্জায় হাত লাগাল। ছোটোমামাকে উদ্দেশ্য করে
বলল, “পেরেছি।”
গুবলুর খুশি দেখে টুবলু বলল,
“এরপরের বার কিন্তু আমি ওড়াব, তুই লাটাই ধরবি।”
টুবলুর কথা শেষ হওয়ার আগেই
আবার সেই নীল-সবুজ পেটকাটিটাকে উড়তে দেখা গেল। নীল-সবুজ
আবার বেগুনিকে আকাশে ধাওয়া করল। বিরক্ত হয়ে গুবলু বলল, “কে বল তো এরকম করছে? আগে
তো দেখিনি কাউকে ঘুড়ি ওড়াতে। আর আমাদের ঘুড়িটা উড়লেই কেন ওটা বারবার আসছে?”
ছোটোমামা বলল, “দে দেখি একবার
মাঞ্জাটা আমাকে। দেখাচ্ছি মজা নীল-সবুজের।”
ছোটোমামা মাঞ্জাটা হাতে নিতেই
ম্যাজিক। নীল-সবুজ একেবারে ধরাশায়ী, আর ঘুড়িটা উড়তে উড়তে এসে পড়বি তো পড় গুবলুদের
বাগানের শিউলিগাছের ডালে। ছোটোমামা এবার বলে উঠল, “দেখলি তো, কেমন ভোকাট্টা করে
দিলাম! একসময় ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় আমার আগে কেউ ছিল না বুঝলি।”
গুবলু-টুবলু একে একে পালা করে
একেকবার বেগুনি ঘুড়িটা ওড়াল। তবে নীল-সবুজ ভোকাট্টা হওয়ার পর আর কোনও ঘুড়ি আকাশে
দেখা গেল না। সেদিন বিকেলে প্রায় দেড় ঘণ্টা ঘুড়ি ওড়ানোর পর ছাদ থেকে নামল ওরা
তিনজন। ততক্ষণে বাগানে শিউলিগাছের ডালে আটকে থাকা নীল-সবুজ ঘুড়িটাকে ভুলেই গেছিল
ওরা।
(২)
পরের দিন রোববার।
ঘুম থেকে উঠেই দাঁত মাজতে গিয়ে ওয়াশ বেসিনের পাশের জানালা দিয়ে শিউলিগাছটার দিকে
চোখ গেল গুবলুর। ছোটোমামা বলেছিল, ভোকাট্টা ঘুড়িগুলো কালেক্ট করাও প্রতিযোগিতার
একটা অংশ। মুখ ধুয়েই গুবলু ছুটল নীল-সবুজ ঘুড়িটাকে শিউলিগাছ থেকে পাড়তে। একটা
আঁকশি দিয়ে শিউলিগাছের মগডালটা টানতেই ঝুরঝুর করে সাদা শিউলির দল নেমে এল গুবলুর
উপরে। মগডাল একটু নুয়ে পড়তেই ঘুড়িটার সুতো ধরে টানতেই নীল-সবুজ গুবলুর হাতে নেমে
এল। ল্যাজের দিকটা একটু ফেটে গেছে, ভালো
উড়বে না। কিন্তু এটাই গুবলু-টুবলুর প্রথম পাওয়া ঘুড়ি। গুবলুকে নিচে নামতে দেখে টুবলুও
ওর পেছনে পেছন নেমে এসেছিল। বলল, “দেখি
একবার ঘুড়িটা।”
ঘুড়ি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
দেখতে দেখতে টুবলু আবার বলল, “কে ওড়াচ্ছিল বল তো? এর আগে তো কাউকে দেখিনি এই পাড়ায়
ঘুড়ি ওড়াতে।”
“হবে কেউ, বিশ্বকর্মা পুজোর
দিন অনেকেই ঘুড়ি ওড়ায়। শুনিসনি ছোটোমামার কাছে?”
টুবলু ঘুড়ির পেছন দিকটা উলটে
দেখল একটা সাদা কাগজ লাগানো আঠা দিয়ে। নীল কালি
দিয়ে তাতে কিছু লেখা ছিল, কিন্তু সারারাত ঘুড়িটা বাইরে পড়ে থাকায় শিশিরের জলে ভিজে
গিয়ে লেখাটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
“এটা আবার কী রে, গুবলু?”
“কই দেখি?” গুবলুও কাগজটা
দেখল। লেখাটা মনে হয় ইংরিজিতে, কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঘুড়িটা হাতে নিয়ে একছুটে
দোতলায় বাবার ঘরে চলে গেল গুবলু। ড্রয়ার
থেকে বাবার আতসকাচটা বের করে কাগজটা দেখল, অস্পষ্ট লেখা আছে - HELP ME! তারপরেও কিছু লেখা আছে, কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এভাবে ঘুড়ির মাধ্যমে
কেউ কি হেল্প চাইছে ওদের কাছে? কিন্তু কে হতে পারে?
লেখাটা পড়ে গুবলু বলল, “চল তো
দেখি একবার ছাদে গিয়ে, কোন বাড়ি থেকে ঘুড়িটা উড়ছিল।”
বলামাত্রই দু’জনে ছাদে
উপস্থিত। এর আগেরবার যখন চোর ধরে ওরা তখন গোয়েন্দা অরুণাভ দত্তর কাছ থেকে যে
বাইনোকুলারটা উপহার পেয়েছিল সেটা চোখে নিয়ে গুবলু দেখে বলল, “ঠিক কোন ছাদ থেকে
ঘুড়িটা উড়ছিল এখন আন্দাজ করা মুশকিল।”
“ইশ! ঘুড়িটা যদি কালকেই তুলে
আনতাম...”
টুবলুর মুখের কথা শেষ হওয়ার
আগেই গুবলু বাইনোকুলারটা টুবলুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “মিত্তিরবাড়ি ভেঙে যে নতুন
অ্যাপার্টমেন্টটা তৈরি হচ্ছে সেটার সামনে দেখ একবার।”
টুবলু বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে
দেখল ইট বের করা নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে একটা ছোটো সাদা রঙের মারুতি
ভ্যান দাঁড়িয়ে। কিন্তু কিছুদিন আগেও খাবার টেবিলে বাবা গল্প করে বলছিল যে অ্যাপার্টমেন্টের
কাজ পুজোর আগে শুরু হবে না। তাহলে এই গাড়িটা ওখানে কী করছে? আর কাজ শুরু হয়ে থাকলে
মিস্ত্রিরাই বা কোথায়? কেউ তো নেই। এই গাড়িটাকে আগে কখনও দেখা যায়নি। টুবলু
বাইনোকুলার নামিয়ে বলল, “নতুন লোক মনে হচ্ছে। একবার যাবি নাকি?”
এর আগেরবার সন্দেহজনক ভিখারির
পিছু নিয়েছিল ওরা। সেই ভিখারি গোয়েন্দা না হয়ে চোর-ডাকাতও হতে পারত। প্রতিবার
যে ভালো লোকই হবে তার কোনও মানে নেই। এসব অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে যদি কোনও বিপদ
হয়? গুবলু বলল, “একা যাওয়ার দরকার নেই। তার চেয়ে
ভালো ছোটোমামাকে একবার বলে দেখলে হয় না?”
“সেই ভালো।”
(৩)
ছোটোমামাকে ঘুড়িতে লেগে থাকা
চিরকুটটা দেখাতেই ছোটোমামাও বলল, “কিছু একটা ব্যাপার আছে, বুঝলি। দেখতে হবে।”
টুবলু বলল, “কী করা যায়?”
গুবলু বলল, “একা যেতে কিন্তু
সাহস হচ্ছে না, তাই তোমাকে বললাম।”
ছোটোমামা বলল, “একবার যাওয়া
যেতেই পারে। কিন্তু ব্যাপারটা বাড়িতে জানাজানি হলে কিন্তু আর রক্ষে নেই। তোমাদের
সাথে সাথে আমারও পিঠের ছাল উঠিয়ে দেবে দিদি।”
“তাহলে?”
“এক কাজ কর।
দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাবি না। দিদিকে
বলবি আমার ঘরে বসে দাবা খেলব। সেই ফাঁকে
একবার ঢুঁ মেরে আসতে হবে।”
ছোটোমামার কথামতো গুবলু-টুবলু
ছোটোমামার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। রবিবার। বাড়িতে
সবাই আছে, তাই সবার ভাতঘুমের অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়ির সকলে
যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন পা টিপে টিপে গুবলু-টুবলু আর ছোটোমামা বেরোল মিত্তিরবাড়ির
প্লটে নতুন অ্যাপার্টমেন্টটার দিকে। কাছাকাছি গিয়ে দেখল তখনও গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে
চালকের সিটে একজন বসে বসে ঢুলছে। ওরা তিনজনে
পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গিয়ে দেখল তিনজন ষণ্ডামার্কা লোক একটা ছেলেকে
বেঁধে রেখেছে। ছেলেটার হাতদুটো পেছনদিকে দড়ি-বাঁধা। লোকগুলোর মধ্যে নেতা গোছের
লোকটার সামনের টেবিলে বড়ো ছোরা রাখা আছে, লোকটা চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে। বাকি দু’জন মেঝেতে
বসে তাস খেলছে। হাত-বাঁধা ছেলেটা যে স্কুল-ড্রেস পরেছিল, সেটা গুবলু-টুবলু খুব
ভালো করেই চেনে। ওদেরই স্কুলের ড্রেস। ছেলেটাকে দেখেও ওদের চিনতে ভুল হল না। টুবলু
তো বলেই উঠল, “রূপম!” ছোটোমামা সঙ্গে সঙ্গে টুবলুর মুখ চেপে ধরেছে, ইশারায় চুপ
করতে বলছে। ওরা যেমন পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল, সেভাবেই নেমে এল।
নিচে এসে ছোটোমামা বলল,
“ভাগ্যিস কেউ দেখেনি। কী ডেঞ্জারাস লোকগুলো!”
টুবলু আর উত্তেজনা চেপে রাখতে
পারছিল না। বলল, “রূপম এখানে কী করছে? ওকে বেঁধে রেখেছে
কেন?”
“সেটাই তো ভাবছি আমিও।” গুবলু
বলল।
“ছেলেটা তোদের ক্লাসে পড়ে?”
ছোটোমামার কপালে ভাঁজ।
“হ্যাঁ। কিন্তু ও প্রায়
তিন-চারদিন স্কুলে আসেনি। আমাদের এক বন্ধুকে ওর বাবা জানিয়েছেন ওর শরীর খারাপ, কবে
স্কুল যাবে বলতে পারবেন না।”
“হুম, বুঝলাম। এক কাজ কর।
ঘুড়িতে লাগানো চিরকুটটা নিয়ে এখুনি থানায় যেতে হবে।”
(৪)
পরেরদিন সোমবার।
গুবলু-টুবলু যখন স্কুলে পৌঁছাল তখন প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ওদেরকে নিজের রুমে ডেকে
পাঠালেন। এর কারণ অবশ্য গুবলু-টুবলু জানে। গতকাল যা হল, এরপর আর খবরটা যে চাপা
থাকবে না সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিল। তবে নিউজ চ্যানেল আর নিউজ পেপারের লোকদের কাছে
যাতে খবর না যায় তার জন্যে লোকাল থানার ইনস্পেক্টরকে গুবলু-টুবলুর বাবা বিশেষ
অনুরোধ করেছিলেন। বাবা বলেছিলেন, “এসব ব্যাপার বেশি
জানাজানি না হওয়াই ভালো।”
তবে এবার ছোটোমামাও ওদের এই
অভিযানে সঙ্গে ছিল বলেই রূপমকে বাঁচানো সম্ভব হল। আসলে তিন-চারদিন আগে রূপম যখন
স্কুল-বাস থেকে নামে তখন বাড়ি যাওয়ার রাস্তা থেকে ওই সাদা মারুতি ভ্যানে করে ওকে
উঠিয়ে নিয়ে যায় ওই তিনজন লোক। তিনজনের মধ্যে নেতা গোছের লোকটা একসময় রূপমের বাবার
অফিসের পিওন ছিল। ওরা রূপমকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ওই নতুন
তৈরি হওয়া ফ্ল্যাটবাড়িটায়। রূপমের বাবাকে ফোন করে দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়; এও
বলে দেয় যে কিডন্যাপারদের কথা পুলিশ বা অন্য কাউকে জানালে রূপমকে মেরে ফেলা হবে। সেই
কারণে কৃতিকা যখন রূপমদের বাড়ি গিয়েছিল তখন রূপমের বাবা কৃতিকাকে রূপমের ব্যাপারে
মিথ্যা কথা বলেন।
গুবলু-টুবলু পুলিশকে চিরকুটটা
দেখানোর পর আর রূপমের কথা জানানোর পর পুলিশ গিয়ে লোকগুলোকে পাকড়াও করে রূপমকে
ছাড়িয়ে আনে। ততক্ষণে রূপমের বাবাকেও খবর দেওয়া হয়েছে। উনি জানালেন, “টাকা জোগাড়
করার জন্যে কিডন্যাপাররা তিনদিনের সময় দিয়েছিল।”
কিন্তু একটা ব্যাপার গুবলু-টুবলুর
মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না - রূপম কী করে ঘুড়ি ওড়াল ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে? আর
চিরকুটটাই বা কী করে বানাল?
রূপম ওর বাবার গাড়িতে চড়ে
বসার আগে গুবলু-টুবলু এই প্রশ্নগুলো করেছিল রূপমকে। রূপম বলেছিল, “ওরা আমায় বলেছিল
বাবা টাকা না দেওয়া অবধি চুপ করে থাকতে। তখনই ফন্দি আঁটি ঘুড়ি ওড়াবার। বললাম,
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন প্রতিবার ঘুড়ি ওড়াই, আমাকে ঘুড়ি ওড়াতে দিলে আমি চুপ করে
থাকব। আমার কথামতো আমাকে কয়েকটা ঘুড়ি এনে দেয় ওরা। আমার ব্যাগে ক্র্যাফট বক্সে
আঠার টিউব রাখাই ছিল, কারণ যেদিন আমাকে ওরা রাস্তা থেকে তুলে নেয় সেদিন স্কুলে
লাস্ট পিরিয়ড ছিল ক্র্যাফটের। এবার সবক’টা ঘুড়িতে চিরকুট সাঁটিয়ে দিই। গতকাল আমাকে
ছাদে নিয়ে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে দেয় ওরা। তখন দু’জনে
বসে তাস খেলছিল। আমি ইচ্ছা করে নিজের ঘুড়িটা ভোকাট্টা করতে চাই, যাতে কেউ আমার
চিরকুটটা পড়তে পায়। তবে জানতাম না যে ঘুড়িটা তোদের হাতেই পড়বে।”
রূপমের কথা শুনে গুবলু-টুবলু
বলল, “তোর ভয় করেনি? যদি চিরকুটটা ওরা পেয়ে যেত?”
“প্রথমে একটু ভয় ভয় করছিল,
কিন্তু একবার চান্স নিয়েই দেখলাম। টাকা না পাওয়া অবধি তো আমাকে ওরা মারতে পারবে
না।”
“বাহ্! তোর তো সাহস আছে,
রূপম। কিন্তু তুই ঘুড়ি ওড়াতে শিখলি কী করে?”
এবার রূপম বলল, “শুধু তোদের
ছোটোমামা থাকতে পারে, আমার পারে না?” তারপর হা হা করে হেসে উঠে বলল, “আমার বাবা
খুব ভালো ঘুড়ি ওড়ায়। আমি বাবার কাছেই শিখেছি। আমি তো
বাবার সঙ্গে প্রতিবছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়াই।”
এই ঘটনার পর বেশ কয়েকটা ভালো
ব্যাপার ঘটল গুবলু-টুবলুর জীবনে। যেমন, রূপমের সঙ্গেও গুবলু-টুবলুর যেমন ভাব হয়ে
গেল তেমনি রূপমও গুবলু-টুবলুর গোয়েন্দাগিরিতে খুশি হয়ে ওদের ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়ে
দিয়েছিল। এমনকি ওর কাছে যে নানারকম আধুনিক ঘুড়ির কালেকশন আছে সেটাও দেখিয়েছিল।
নিউজ পেপার আর চ্যানেলে ঘটনাটা না দেখানো হলেও কী করে যেন গোয়েন্দা অরুণাভ দত্তর
কানে গুবলু-টুবলুর দ্বিতীয় অভিযানের কথা চলে গিয়েছিল। দু’দিন পরেই উনি বাবার মেল
বক্সে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সঙ্গে এও বলেছিলেন, কালীপুজোর আগের দিন মানে হ্যালোউইনের
রাতেও ঘুড়ির মতো একটা বিশেষ বেলুন ওড়ানো হয়। সেটা যদি
গুবলু-টুবলু দেখতে চায় তাহলে ওইদিন যেন ওঁর বাড়িতে চলে যায়। ছোটোমামাও বাড়ি ফেরার
আগে বলল, “আমরা ঘুড়ি ওড়াই ঠিকই, কিন্তু এই ঘুড়ির ধারালো সুতোয় কেটে গিয়ে কত যে
পাখি প্রতিবছর প্রাণ হারায় তার হিসেব নেই। সবকিছুরই একটা খারাপ দিক থাকে, বুঝলি?”
তবে সবচেয়ে খুশির ব্যাপার
যেটা হয়েছিল সেটা হল, প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ওদের অভিযানে এত খুশি হয়েছেন যে স্কুলে
নির্দেশ দিয়েছেন ওদের আর গুবলু-টুবলু নামে ডাকা যাবে না, ওদের ভালো নাম ধরে ডাকতে
হবে এবার থেকে। ওহো! তোমাদের তো গুবলু-টুবলুর ভালো নামটাই জানানো হয়নি।
গুবলুর ভালো নাম অভ্রনীল লাহিড়ী আর টুবলুর ভালো নাম শঙ্খনীল লাহিড়ী।
_____
অলঙ্করণঃ সুজাতা চ্যাটার্জী
বাহ, দারুণ।
ReplyDelete