প্রদীপ্ত ভক্ত
দ্বিতীয় পর্ব
কাবাব-পরোটা খেয়ে মন ঠান্ডা করে আমরা ভাবতে লাগলাম,
কোথায় যাওয়া যায়। অল্প করে খেয়েছি, মানে রাতে প্ল্যান আছে লাল্লার বিরিয়ানি
খাবার। সেটাও
ভাবতে হবে। লাল্লা হল একমাত্র হিন্দু যে সে সময় মুসলমান সুদক্ষ বাবুর্চির সঙ্গে
টক্কর দিয়ে বিরিয়ানি বানিয়েছিল। অবান্তর থেকে জেনেছি এটা অবশ্য, আর এর রেটিং
রিভিউও গুগল করে যা দেখেছি অসাধারণ। রেসিডেন্সি যাওয়া যায়, কিন্তু আমরা খানিক
টায়ার্ড, রেসিডেন্সি ঘোরার এনার্জি তেমন হবে না। তাই ভাবলাম,
ছত্তর মঞ্জিল বলে একটা দেখার জিনিস দেখাচ্ছে গুগলে সেটা দেখি, তারপর গোমতীর তীরে বসে কান চুলকাই খানিক। খেয়েদেয়ে অবশ্যই হাঁটতে হয় নইলে
লাল্লার বিরিয়ানি পেটে ঢোকার জায়গা পায় না, লখনৌর গলি রাস্তা
দেখা যায় না। সুতরাং, আমরা আড্ডা মারতে মারতে আমিনাবাদ থেকে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে
যাচ্ছি। জমজমাট
অঞ্চল। কচুরি, চাট, জুতো পালিশ, টোটো,
গোবর, ত্রিমুখী ট্রাফিক ও মানুষ সব মিলিয়ে বেশ
হন্ডুরাস ব্যাপার। সফেদ বেরাদরি বন্ধ, রিনোভেশন চলছে। ছত্তর
মঞ্জিলের খোঁজ কেউই বলতে পারছে না। পুলিশ না, উকিল না,
চা-ওলা না, সাইকেল আরোহী না। শেষে জুতো পালিশের
আসরে মজলিশি বুড়ো বলে দিল।
ছত্তর মঞ্জিলের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে যখন চনমন করছি
কোনটা আসলে ছাতার মঞ্জিল রে বাবা, একজন লোক বলে দিল, “ছত্তর মঞ্জিল
তো ইয়ে হি হ্যায়, দরোয়াজা উস তরফ, যাইয়ে মিল যায়েগা।” যাক!
আমরা গুটি গুটি এগিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, লেখা আছে বটে।
কিন্তু দরজা-জানালা সব বন্ধ কেন? কেউ আসে না? আমাদের ট্রেসপাসিংয়ের
চার্জ দেবে নাকি? দু’জন সিকিউরিটি গার্ড বসে ছিল। বললাম, ভিতরে যাওয়া যাবে না? জানাল, রিনোভেশন
চলছে, কিন্তু আমাদের বলল চাইলে আমরা যেতে পারি তবে সাপখোপ
থাকতে পারে। আমরা তার পরেও যাব স্বাভাবিক। পিছন দিয়ে একটা দরজা খোলা খালি।
জনমানবশূন্য, পড়ে থাকা একটা টিনের উপর মচমচ শব্দ করে তিন
মক্কেল ঢুকলাম। বিরাট একটা ঘর, শব্দহীন। ঘরের মধ্যে দিয়েই
সিঁড়ি উঠে গেছে। আমরা উঠলাম এক এক করে। এখানে বোধহয় ওষুধের ল্যাবরেটরি ছিল, ওষুধ ওষুধ গন্ধ।
সরু গলি ধরে এগিয়ে যাচ্ছি ধুলোর উপর পায়ের ছাপ এঁকে। কত নবাবের হাতে পড়েছে এ
বিল্ডিংখানা। শুরু হয়েছিল নবাব গাজিউদ্দিন হায়দারকে দিয়ে। তার ছেলে নাসিরুদ্দিন
হায়দার শেষ করে, কিন্তু ব্যবহার সাদাত আলি খান থেকে আমাদের ওয়াজিদ আলি শাহ সকলেই
করেছে। কোনও এক ঘরে হয়তো এমন দুপুরে জোরদার তাস-পাশার দান বসত বা দোতলার এদিকটা
হয়তো চাকরবাকরদের আড্ডার জায়গা ছিল, কে জানে। এরকম কোনও এক দুপুরে নবাবের কোনও দাসদাসী
এই বারান্দায় পাশের ঘুপচিতে দাঁড়িয়ে প্রেম করত। ফিসফিস হাসির আওয়াজ যেন
এক্ষুনি শোনা যাবে ওই মোড়টা ফিরলেই। কাল ভুলভুলাইয়াতে নবাব-বেগমদের সাথে ফেলুদাও ছিল, কিন্তু এই ছত্তর
মঞ্জিল যা এখন প্রায় পোড়ো বাড়ি, কোনও ওষুধের পরীক্ষাগার হয়ে
পড়েছিল এখানে সেইসব ইতিহাসের পাতায় না আসা সব লোকজন যেন চলে এসেছে। বাড়িটা যেন
ভারি দুঃখী হয়ে একা একা দাঁড়িয়ে, আমরা চাইলে এক্ষুনি সে গল্প
শোনাবে।
কিন্তু আমরা তিনটে যুবক গেছি, আমাদের সে
ইতিহাসে কান পাতার থেকে নতুন কিছু খোঁজ বেশি পাত্তা পাবে স্বাভাবিক। আমরা এদিক
সেদিক ঘুরে একটু চেষ্টা করলাম পৌঁছতে ওই ছাতার মতো অংশে যার কারণে এ-বাড়ির এমন
নাম। গোলকধাঁধা টাইপ বাড়ি হত কিনা আগেকার দিনে, নবাবি
হাভেলিতে আমরা খুঁজে পাইনি সে ছাতার মাথা। কিন্তু মন-টন ভারি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল,
উদাস, কেমন একটা। শেষে বেরিয়ে এলাম। এলোমেলো কথা
বলতে বলতে হেঁটে চললাম গোমতীর দিকে।
গোমতীর ধারে যাবার জন্য যাকেই জিজ্ঞেস করি বলে, এই
তো সামনে গেলেই। তা যাওয়া যাক সামনে। তখন আমরা বড়োই ক্লান্ত। অনেকক্ষণ হাঁটার পর
দেখি গোমতী নদীর ধার। সত্যি বলতে, আমরা খুবই হতাশ। আসলে একটা খালও বলা যায় তাকে।
হতাশায় রাগ হবার থেকে হাসি কেন জানি বেশি পায় বন্ধুরা থাকলে। আমরাও খানিক হাসলাম।
একটা বাঁদর জল খাচ্ছে দেখি একটা বাড়ির ছাদে ট্যাঙ্কয়ের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে। দেখে
আমাদেরও তেষ্টা পেয়ে গেল। ওখান থেকে কান চুলকোনোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আমরা পরিবর্তিত
পরিস্থিতিতে পরিবর্তন চক মোড়ে হাজির হলাম। এখানে একটা পার্ক আছে, বেগম হজরত মহল পার্ক।
তা সেখানে গিয়ে একটু জিরোব ভেবে ঢুকতে যাব, সে দেখি তার ঢোকার মুখ পৌঁছতে একগাদা
হাঁটতে হবে! আর হাঁটব না, ব্যস! হজরত বিবি মহল চোখে থাক, আমার পদধূলি না পড়াই ভালো
বিবেচনা করে অটো ধরা গেল। চৌক যাব। ওখানেই থাকব ঠিক করেছি।
মালাই-লস্যির দোকান দেখে এতক্ষণের গোমতী খাল, হন্টন, হতাশা সব
বেরোনোর পথ পেয়ে গেল। আমরা দোকানে ঢুকে গেলাম।
মালাই-লস্যি, কুলফি খেয়ে মনপ্রাণ একটু জুড়িয়ে হোটেল খুঁজতে বেরোনো। আমাদের এবারের ঘোরা সে
কলেজ টাইপ ঘোরা, অর্থাৎ ঝকঝকে হোটেল তকতকে বাহন এসব না। মিনিমাম ভাড়ায় বডি ফেলার জায়গা
পাব যেখানে সেখানেই ঢুকব। তাই এক-দুটো ধর্মশালা দেখে সেগুলোতেও ট্রাই মারা গেল। ধর্মশালায় সত্যি বলতে
থাকিনি কখনও। যাই হোক, এবারেও সে ইচ্ছে পূরণ হল না, জায়গা নেই। আরেক জায়গায় গেলাম। মোটামুটি সস্তার হোটেল, কিন্তু
তারা ডাবল বেডরুম তিনজনকে দেবে না। সমু হেভি খচে-মচে বলল, “আমরা
গুঁতিয়ে-টুঁতিয়ে থেকে গেলে আপনাদের কী মশাই!” তা তেনারা পাত্তা দিলেন না অবশ্য। অগত্যা আরও একশো টাকা
বেশি খরচা করে তিনজনের থাকার ঘরটাই নেওয়া হল।
আমি আর সৌরভ খানিক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি পৌনে সাতটা! আরে
চল চল, লাল্লা তো বন্ধ হয়ে যাবে!


লখনৌ চৌকের বিখ্যাত গলি। আলো ঝলমলে গলির শুরুতে হরেকরকম
মিষ্টির দোকান, জামাকাপড়ের দোকান, ছোটোখাটো স্টেশনারি গুডসের দোকান
সবরকম আছে। ঠেলাগাড়ির ভিড়ও আছে সে-গলিতে। গলি ধরে এগোতে থাকলে
ক্রমে হই-হট্টগোল কমে আসে,
দু’পাশের মিষ্টির দোকানের চাকচিক্য কমে যায় কিন্তু টাটকা ভাবটা কমে
না। খুপরি
ঘরে বসে উকো ঘষে চশমা-আঁটা বুড়ো। রাস্তার দিকে নজর করে চলতে গেলে
গোবর এড়ানো যায়, কিন্তু তাহলে আবার দু’পাশের হরেক জিনিস নজর এড়িয়ে যায়। এ বড়ো
সমস্যার - রাস্তায় নজর দিয়ে সাবধানে এগোতে চাও নাকি মন ভরিয়ে চোখ জুড়িয়ে যেতে চাও
উপভোগ করতে করতে। প্রথমটায় তুমি নিরাপদে পৌঁছবে, দ্বিতীয়তে কাদা মেখে কিন্তু
ক্লান্তি এড়িয়ে। আমি দুইয়েই নজর রাখছিলাম। ফলে খুব তাড়াতাড়ি এগোনো
যাচ্ছিল না।
হঠাৎ দেখি রাস্তা একটু নিচু, আর নর্দমা ছাপানো
জল। আশেপাশে
বাড়ি এখন। দোকানপাট
নেই খুব। অতি
সাবধানে লাফ মেরে মেরে নর্দমার জল পার করে একটা চলন্ত গরুকে কাটিয়ে অবশেষে মেন
রোডে ওঠা গেল। একজনকে জিজ্ঞেস করে রাস্তা কনফার্ম করে নিলাম। সে সঙ্গে এটাও বলে দিল, “জলদি যাইয়ে জনাব,
উওহ তো খতম হো যাতা হ্যায়। হাঁ, বনাতা লেকিন বঢ়িয়া।” শুনে উৎসাহে টগবগিয়ে স্পীড
বাড়িয়ে দিলাম। এই তো লাল্লা। কী আছে? শামী কাবাব, মাটন
কোর্মা, মাটন বিরিয়ানি নেওয়া গেল। অপেক্ষা অপেক্ষা। এই তো।
এক চামচ মুখে তুলেই আমাদের এতক্ষণের সব উৎসাহ, লাফালাফির বেলুন চুপসে
গেল। এটা কী দিয়েছে রে ভাই! এরই এত নাম! কী খারাপ খেতে, কী বলব
আর! ডালডা মেরেছে বিরিয়ানিতে একগাদা। স্বাদও অতি খারাপ। শামী কাবাবে ছোলার ডালটাই দিয়েছে, মাটনের কুচো দিতে
ভুলে গেছে। মাটন
কোর্মা আসলে জিরের ঝোল। আমরা স্তব্ধ। সৌরভ অধিক শোকে পাথর। ও আবার
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বড়োই সেনসিটিভ। খারাপ বিরিয়ানি দিলে ওর কাছে ধর্ম
অবমাননা হয়। আমি আর সমুও হতাশ বটে, তবে আমরা এ-ব্যাপারে অত চাপাতি টাইপ
না। সৌরভের
থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছি দু’জন। বললাম, “চল, একটু রাবড়ি খেয়ে নিই
রাস্তার দোকান থেকে,
আর কীই বা খারাপ হবে আজ এর থেকে। নাম করা দোকানের থেকে তো বেশি হতাশ
করবে না।”
সৌরভ জানিয়ে দিল, সে কিচ্ছু খাবে না, স্রেফ কোল্ড ড্রিংকস
খাবে। সমু
বলল, “তা রাতে তো খিদে পেয়ে যাবে। এক ছড়া কলা কিনে নিই, নাকি?”
নেহাত লখনৌতে আজকাল আর পিস্তল-তলোয়ার সুলভ না, তাই সমু
এ-যাত্রায় বেঁচে গেল আর কী। তো পরের দিন সকালে তো তারিণীখুড়োর
সেই বিখ্যাত দিলখুশা প্যালেসে যাবই। আমি বললাম, “তা ওখানেই
ডুয়েলটা হয়ে যাবে নাকি? আর ইয়ে, আম্পায়ার আমিও আছি। ক্যামেরাটাই না হয় বাজি হবে।”
এইসব কথা বলতে বলতেই রাবড়ি নিয়ে নিয়েছি, সৌরভও। রাবড়ি মুখে দিয়ে মনমেজাজ
সত্যিই ভালো হয়ে গেল। আহাহা, কী বানিয়েছে হে! হ্যাঁ, এ তো দেবভোগ্য জিনিস। পেট ঠুসে খেয়ে দেখি
রাবড়ির পাশেই আরেকটা কী যেন আছে। সেটা আর তিনটে না নিয়ে একটাই
নিলাম। মানুষের
পেট তো!
কী বলব আর। দিনটাই খুব গোলমেলে। মানে, সন্ধেটা। মালাইটা আসলে
মিষ্টি কম একটা জিনিস। হতাশার বালুচরে একা একা আজও গান গাই ইত্যাদি...
সকালবেলা উঠে দেখি ও দু’মক্কেল উঠে কুস্তি করছে!
হ্যাঁ রে ভাই, ডুয়েলটা দিলখুশায় লড়লে কেমন হয়? লখনৌ নবাবী মেজাজে চলে বোঝা গেল।
সক্কাল সাতটায় কোনও দোকানই খোলা নেই। একটু চা না পেলে মন-টন ভারি
সুড়সুড় করতে থাকে। তা সোজা দিলখুশা যাবার অটো পাওয়া যায় না চৌক থেকে। পাওয়া যায় হজরতগঞ্জ অবধি। ওখান
থেকে ফের যেতে হয়। তা হজরতগঞ্জ যাবার অটোও পাওয়া যাচ্ছে না দেখছি! মানে, সবাই
বলছে, আগে সে আগে সে। কী রে ভাই, আগে যেতে যেতে তো হজরতগঞ্জই পৌঁছে যাব!
কীরকম যেন আমাদের খান্না টাইপ জায়গাটা। এক কাপ অতি অখাদ্য চা খেয়ে
হজরতগঞ্জের অটোয় ওঠা গেল। ওখান থেকে নেমে গুগল ম্যাপ বলছে আর তিন কিলোমিটার। তা হাঁটাই যায়। এরকম মন নিয়ে এক প্যাকেট বিস্কুট
কিনে খেতে খেতে এগোচ্ছি। একটা অটো খুব দেখি বলছে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে? বলা হল। অস্বাভাবিক দরাদরিতে
অটোওলা খুব নিমরাজি হয়ে রাজি হল।
আর্মি এলাকা, অটোওলাও ভালো জানে না এই দিলখুশা বাগটা
কোথায়। এক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে সে হাওয়া। চারদিকে প্রচুর গাছ, লোক-টোক নেই। তার মধ্যেই একজন মর্নিং ওয়াকে
বেরোনো লোককে ধরে দিক নির্দেশ পেয়ে এগোচ্ছি।
রোববারের সকাল দেখি ক্যাম্প খাট পেতে এক আর্মি
অফিসার বসে আছে আরাম করে, আর দুই অধস্তন ছোট্ট স্টলমতো করে চা বানানোর তোড়জোড় করছে। ওঁকে জিজ্ঞেস করতে বলে, “আরে
জনাব, ইয়ে পুরা রোড হি তো দিলখুশা হ্যায়। আপকো যানা কহাঁ হ্যায়? ইতনা সারা
প্যালেস হ্যায়, কিসি এক কো পসন্দ কর লো না।”
যাই হোক, যারা চা বানাচ্ছিল তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ
আছে বটে একখান, ওই যে ওইটে।
এখানে নবাবরা আগে শিকার করত। মানে এই মহলে থাকত, আর এর
পেয়াদারা তাড়া দিয়ে নিয়ে আসত আরকি শিকারদের। এখন অবশ্য লোকে ব্যায়াম করে এখানে। ভাবার চেষ্টা করছিলাম,
ঠিক কোন জায়গাটায় সেই ডুয়েল হয়েছিল। কিচিরমিচির করে পাখির ডাকে সেই
ছমছমে পরিবেশটা ঠিক আসছিল না অবশ্য। তবে ভালো লাগছিল বেশ। চারদিকে গাছপালা, পাখি, রোদ - একটা দুটো লোক হুহুম না হুহুম না করে ইট-ফিট নিয়ে ব্যায়াম করছে। পুরনো
প্যালেসের নকশা, ভেঙে যাওয়া থাম। ওদিকে এক ঝাঁক টিয়া
আলোচনাসভা বসিয়েছে – কী রে, আজ কোথায় ভালো ফল-টল দেখলি? এই মানুষগুলোর মাথায় কি
কিচ্ছু নেই যে সব ফলের গাছ কেটে রেখে দিয়েছে? যন্তন্না মশাই।
আমরা নানান কোণ থেকে ছবি তুলে ঘাস মেপে দেখার চেষ্টা
করলাম যদি ভুল করে কোনও পিস্তল বা গুপ্তধন মেলে। গুপ্তধন ঠিক না, তবে একটা
নতুন জিনিস জানলাম। পাখি আমি খুব কম চিনি। একটা পাখি ডাকছিল। সমুকে জিজ্ঞেস করতে যখন বলল ওটা
মেয়ে কোকিল, আমি তো পুরো চমকে গিয়ে আলজিব গিলে ফেলার জোগাড়। ছেলে কোকিল, মেয়ে কোকিল
আলাদা দেখতে হতে পারে, তাই বলে ডাকটা এমন সম্পূর্ণ আলাদা আর আমি এত কম জেনে দিব্যি
বেঁচেও আছি!
এবার যাব রেসিডেন্সি। রেসিডেন্সি মানেই একটা বেশ
রোমাঞ্চ হয় মনের মধ্যে। সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের জবরদস্ত ধাক্কা দিয়েছিল এই
রেসিডেন্সি অধিগ্রহণ করে। পারেনি শেষ অবধি, কিন্তু ফাইটটা? সেটা কম নাকি!
রেসিডেন্সিতে খুব ভিড় কিছু না। ঝকঝকে দিন। টাঁকশাল থেকে কোনও ডাক্তার বা
কর্নেলের থাকার জায়গা,
বেগমদের মহল, মসজিদ সবগুলোই দেখছি আগ্রহ নিয়ে। যেখানে বিদ্রোহীরা গোলা ছুড়েছিল, তার পাশেই হার্ট
সাইনে কোনও জোড়ার নাম। ঘুঘু চরা বলে একটা কথা আছে। ভিটেয় ঘুঘু চরা মানে
সেখানে আর কেউ থাকে না,
সবাই ভিটেচ্যুত বা বংশ শেষ। তা এখানে মসজিদের সামনেও ঘুঘু চরছে
দেখি এক ঝাঁক, নবাব আমল শেষ তা জানান দিতে দিতে। অনেকগুলো কাঠবেড়ালি ব্যস্ত
ভঙ্গিতে খাবার খাচ্ছে। এক ঝাঁক টিয়া উড়ে গেল ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে।
রেসিডেন্সির ইতিহাসটা খুব সুন্দর করে অবান্তরে লেখা
আছে। আমি ফের লিখলাম না আর কষ্ট করে। মিউজিয়ামের মধ্যে রাজাদের ছবির সঙ্গে
চোখ টানে রানি হজরত মহলের ছবি। সতেরশো সাতান্ন-আটান্ন সালে এক
মহিলা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে, যুদ্ধ করছে, হেরে গিয়ে সম্পূর্ণ
অচেনা এক দেশে পালিয়ে যাচ্ছে - এ অবাক করে বৈকি। অস্ত্রশস্ত্র দেখা গেল না। রিনোভেশনের কল্যাণে বন্ধ।




আমাদের খিদে খিদে পেয়েছে। কাল থেকে লাল্লার শোক আমাদের ভয়
দেখাচ্ছে, তবুও খাচ্ছি না। দস্তরখোয়ানে বাজি রেখে বসে আছি।
হজরত মহলে ঘুরঘুর করছি। বৃষ্টি এলেন। একটু কমতে বাইরে বেরিয়ে অটো ধরতেই ওরে বাপ
রে, কী বৃষ্টিটাই না এল! হজরতগঞ্জে পৌঁছতে পৌঁছতে মোটামুটি ভিজেই গেলাম প্রায়।
মুখোমুখি দুইখান দোকান। অবান্তর থেকে এও জানা ছিল। কিন্তু সে সময় লাঞ্চ টাইম শুরু
হয়নি, তাই বলা যাচ্ছে না কোনটা আসল। এদিক ওদিক ভেবে যেটা অরিজিনাল বলে
মনে হচ্ছে সেটাতেই ঢুকে পড়লাম। বৃষ্টির কারণেই খদ্দেরের ভিড় শুরু হয়নি এখনও। চেয়ারে
টেবিলে ভিজে গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া শুকোচ্ছে। উঁহু, নাক কুঁচকোলে চলবে না। বাইরে এত বৃষ্টি, এরা যাবেই বা
কোথায়, পরবেই বা কী। বসে বসে আড্ডা মারছি আর মনে মনে ভাবছি কী জানি এরাও হয়তো
খুব খারাপ বানাবে, কফিনের শেষ পেরেক। সমু বলেছে, এখানে ধাক্কা খেলে
সোজা নৌসিজানে চলে যাবে। কিন্তু সে সময়টাই কি আর পাব? যেরকম বৃষ্টি
শুরু হয়েছে! এমন সময় ফোনে মেসেজ এল সৌরভের, রোদ বেরোচ্ছে।
আহা সত্যি সত্যি রোদ নাকি, মানে আমাদের কপালে কথা হচ্ছে রে
বাবা।
আমার ফেরার টিকিট কনফার্ম ছিল না। সমুর ল্যাবে নাকি এক সেট বিছানা
পাতাই থাকে। সেখানে দু’দিন কাটিয়ে যাব টিকিট কনফার্ম না হলে। সঞ্জয়দাকে বলা ছিল,
তাও লাল্লার হাল্লায় আমরা কোথাও কোনও ভরসা রাখতে অক্ষম। যাই হোক, টিকিট
কনফার্মেশনের মেসেজ ঢুকল যা হোক।
সে সময়েই অর্ডার নিতে এল। আমরা দুরু দুরু বক্ষে
খুবই সামান্য, মানে প্রায় কিছুই না বলা যায় - এই দু’প্লেট বিরিয়ানি, এক প্লেট চিকেন কালিমির্চ, এক প্লেট বোটি কাবাব
অর্ডার দিয়ে ভারত-পাকিস্থান ম্যাচের ফাইনাল দেখার উত্তেজনা নিয়ে বসে আছি।
ওয়েটার কাকা প্লেট সাজিয়ে গেল। চিকেন কালিমির্চে
থাবা বসালাম... এবং এবং, আহা আহা, হামিন অস্ত। ভয়ানক ভালো। বিরিয়ানিটাও চমৎকার। বোটি-কাবাবও।
ব্যস, আমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত জনতা আরও চিকেন-কালিমির্চ, গলৌটি কাবাব লে
আও করে বসলাম।
খানা শেষে কোনওরকমে হেঁটে হেঁটে লখনৌর শোহন হালুয়া
কিনতে গেলাম। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে, রোদ উঠেছে। আরিব্বাস রে! কেজিতে করে
মিষ্টি বিক্রি করে এখানে! আচ্ছা, তাই সই বলে বাড়ির জন্য প্যাক করা হল। কিন্তু কাল যে স্বর্গীয়
রাবড়ি খেয়েছিলাম, আরেকবার খাব না? লখনৌ ছাড়ার আগে? নামী দোকানে
খাইনি, তাই গলি দোকান খুঁজতে খুঁজতে চললাম বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশে। গলির পর গলি
পেরোচ্ছি, হরেকরকম দোকান, মিষ্টির বেশি। সবাই বলছে, রাবড়ি
আগে যাও, আগে যাও। এই করতে করতে এক দোকান পাওয়া গেল। বসতেই সে কী আপ্যায়ন! আইয়ে
আইয়ে, ব্যায়ঠিয়ে। বসলুম। খাতিরদারি আরও দেখাতে জল দিয়ে গেল। জল দিয়ে গেল মগে করে!
মগ মানে চান করার বা ইয়ে করে জল দেওয়ার মগ। তা ওঁরা কোথা থেকে এনেছিলেন সে মগ আমি
জানি না অবশ্য। মুখ চাওয়াচায়ি করছি। হাসাটা খুব অভদ্রতা হবে ভেবে চেপে
চুপ করে বসে আছি। রাবড়ি খেয়ে বেরিয়ে আসার সময় বলে এলাম, “পানি কা ডাব্বা
বঢ়িয়া থা, জী।”
এবার ফেরার পালা। বাস ধরে কানপুর, ওখান থেকে
রাজধানী। বাস এল। এই বাসটা সিপাহী বিদ্রোহের সময়কার। সিপাহীরা লাঠি চালিয়েছিল, আর বাসের সামনের
কাচটা ভেঙে নেই হয়ে গেল। তা অত খুঁত খুঁত কীসের তোমার হে? দিব্যি ওপেন এয়ার
বাহন, ফ্রেশ বৃষ্টিভেজা বাতাস খেতে খেতে যাও না! সুতরাং,
আমরা সেই বাসেই চড়ে বসলাম। সামনের উন্মুক্ত বাতায়ন মাঝে
মাঝেই কাচের গুঁড়ো ফ্রি দিচ্ছে।
লখনৌ শহরটা যেন অনেকটা বাউলের আলখাল্লা। কোথাও ছেঁড়া, কোথাও ফুটো, ইতিহাসের তাপ্পি
পড়েছে এলোমেলো আর এরই মাঝে একটা একটা আবহমান গান যেন সে আলখাল্লা বয়ে নিয়ে চলেছে। ফির
আয়েঙ্গে, জনাব। রাবড়ি খাব, দিলখুশায় বসে টিয়াপাখি দেখব, ভুলভুলাইয়াতে হারাব, দস্তরখোয়ানের খাবারে মজব,
আড্ডা দেব রাস্তায়, আসব আবার ঠিক।
____
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment