
বেগুনি সাকিউলেন্ট
কস্তুরী মুখার্জী
আট
ফুট বাই দশ ফুট দক্ষিণ-পুব ঘেঁষা ব্যালকনি। মেঝেটা পোর্সেলিন ফ্লোর টাইলস দিয়ে তৈরি।
রংটায় একটা উড কালারের ছোঁয়া আছে। পুরো ব্যালকনিটা কালো আর বেইজ রঙের লোহার গ্রিল
দিয়ে ঘেরা। মেঝেতে বাহারি টবে বিভিন্ন প্রজাতির সাকিউলেন্ট। এছাড়া এরিকা পাম, ছোটো
কলাগাছ মাঝারি সাইজের টবে সুন্দর করে সাজানো। পুবদিকে দুই-তিনটে জলভর্তি কাচের
পাত্রে মানি প্লান্ট লাগানো আছে। সব মিলে পুরো জায়গাটাতে সবুজের ছোঁয়া। এর মধ্যে
গোলাপি,
সবুজ,
বেগুনি রঙের সাকিউলেন্ট শোভা পাচ্ছে।
সারা
বাড়ির মধ্যে তিতাসের এই ব্যালকনিটা খুব প্রিয়। এখানে এলে মনটা ভালো লাগে।
কিছুক্ষণের জন্য হলেও বুকটা যেন হালকা হয়। গাছের প্রত্যেক সবুজ পাতা ওকে বেঁচে
থাকার রসদ জোগায়।
মে
মাস। এই সকালবেলাতেই সূর্যের গনগনে তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। রঙবেরঙের ফুলগুলোর দিকে
তাকিয়ে আছে তিতাস। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস। কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেলেও
তিতাসের ব্যালকনি ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।
“বৌদি, একজন লোক
এসেচে, তোমায়
ডাকচে।” মেনকা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে তিতাসকে ডাকল।
“কে
রে?”
“চিনি
না। বলল, তোমায় ডেকে দিতে।”
“বল,
আমি বাথরুমে।”
“বললুম
গো। তাতে
বলল, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। খুব দরকার মনে হল।”
“হুঁ।”
গম্ভীর হয়ে অনিচ্ছা নিয়ে ব্যালকনি থেকে দরজার দিকে এগোল তিতাস।
“নমস্কার, আমি হেমন্ত
জানা। আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট ইনস্টিটিউট দিল্লি থেকে আসছি।” বলে বেগুনি রঙের
একগোছা সাকিউলেন্ট তিতাসের দিকে এগিয়ে দিল।
কিছুটা
বিরক্তি,
কিছুটা কৌতূহলের বশে তিতাস জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপারে এসেছেন?”
“আমি
কি ভেতরে আসতে পারি?”
তিতাস
একটু ইতস্তত করে ভেতরে ডাকল, “আসুন।”
হেমন্ত
জানা বসার ঘরের সোফায় বসে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে তিতাসের হাতে দিল।
“আপনি
ওই সংস্থার সিইও? কিন্তু
আমার কাছে কেন এসেছেন বুঝতে পারছি না।” তিতাস শান্তভাবে কথা বলছে।
“আসলে
একটা এনক্যুয়েরি
করতে এসেছি। আপনার স্বামীর নাম অভিজিৎ ব্যানার্জী?”
“হ্যাঁ।”
“উনি
রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন সম্প্রতি?”
“হুঁ।”
“উনি
তো বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ছিলেন। ওঁর একটা ছবির সিরিজ ‘নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী’ পুরস্কারের
জন্য মনোনীত হয়েছে। এখন এই পুরস্কার নিতে আপনাকে দিল্লি যেতে হবে। তার আগে আমাদের
কয়েকটা প্রুফ চাই। এক নম্বর, আপনি যে ওঁর স্ত্রী, দুই নম্বর, ওঁর আর কোনও
ওয়ারিশন আছে কি না আর ওঁর মৃত্যুর প্রমাণপত্র।”
“বুঝলাম।
কিন্তু এই পুরস্কারের ব্যাপারে আমার কাছে তো কোনও অফিসিয়াল চিঠি আসেনি। এলে তবে
আমি ডকুমেন্টস আপনাকে দেব।”
“হ্যাঁ, ম্যাডাম, চিঠি
কুরিয়ার করা হয়েছে। আর আমাকে ইনস্টিটিউটের তরফ থেকে এনক্যুয়েরিতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া
আমাদের ডিরেক্টর মিঃ রঘুনাথ স্বামী একটা চিঠিও দিয়েছেন।”
চিঠিটা
এক ঝলক দেখে তিতাস বলল, “ঠিক
আছে। আপনাকে ফোনে জানাব। আপনি তখন
আসবেন।”
“ওকে,
ম্যাডাম।”
“লাভলি! কী সুন্দর
নামটা দিয়েছ অভি, নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী,” তিতাস ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছে। “আকাশের
নীল রঙের সঙ্গে পৃথিবীর এই সবুজ প্রকৃতি তাতে হলুদ বিন্দুগুলো অদ্ভুত দ্যোতনার সৃষ্টি
করেছে। অপূর্ব! দেখো, তুমি এই সিরিজটার জন্য প্রাইজ পাবেই।”
“তিতাস,
এখনই এত উৎফুল্ল হয়ো না। আগে অ্যাকাডেমিতে এগজিবিশনটা দাঁড়াক।” অভিজিৎ মৃদু হেসে
তিতাসের দিকে তাকিয়ে বলল।
“দাঁড়াবে
কী গো, দৌড়াবে! এগজিবিশনে আর কোন ছবি দিচ্ছ?”
“বুদ্ধদেবকে
সুজাতার পায়েস খাওয়ানোর ছবি, এছাড়া আরও কিছু বৌদ্ধ জাতকেরই ছবি আছে, যেগুলো আগে
এঁকেছিলাম, সেগুলো।”
“অভি,
বাংলার বধূ ছবিটা
অবশ্যই দিও। জলরঙে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে ছবিটা।”
অভিজিৎ
হেসে বলল, “হ্যাঁ, দেব।”
অ্যাকাডেমিতে
তিনদিনের শো ছিল। ১২ই ডিসেম্বর শেষদিন। তিতাস মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। সিরিজের
প্রত্যেকটা ছবি কী বাস্তব! ইতিউতি ছবিগুলো সম্পর্কে নানা প্রশংসাসূচক মন্তব্যে
তিতাসের সারা শরীরে আনন্দের শিহরন বয়ে যাচ্ছিল। এই আনন্দই যে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে
চরম দুঃখের বার্তা নিয়ে আসবে, ভাবলে আজও তিতাসের বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
সন্ধে
সাতটায় তিতাস বাড়ি ফিরে এসে রাতের খাবার রেডি করছিল, আর দশটা নাগাদ বাড়িতে পুলিশ...
“মণিমা, ‘আর্ট অ্যান্ড
ক্র্যাফট’ দিল্লিতে হেমন্ত জানা বলে কোনও সিইও নেই। ওখানকার
সিইও অগ্নিশ
ত্রিপাঠি।” বিতান, অভিজিতের
সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র এবং আরেক উজ্জ্বল সম্ভবনাময় চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর তিতাসের
ডাকে ছুটে এসেছে। তিতাস হল অভিজিতের সব ছাত্রছাত্রীর মণিমা।
“কিন্তু
বিতান, আমাকে যে কার্ড দেখাল? শুধু তাই নয়, ডিরেক্টরের চিঠিও দেখিয়েছে।”
“মণিমা, আজকাল কার্ড
বানানো কোনও ব্যাপার নাকি? তুমি
আমাকে কার্ডটা দেখাও আর সেই সঙ্গে ডিরেক্টরের চিঠিও।”
“হুঁ।” তিতাস
অন্যমনস্কভাবে উঠে গেল।
“দ্যাখো, কার্ডে
শুধু নাম আর সিইও
লেখা আছে। ইনস্টিটিউটের কোনও লোগো নেই। ফোন করে দেখবে যে নম্বরটাও ভুয়ো। তুমি
চিঠিটা পড়নি?”
“কেন
রে? কী
আছে ওতে?” তিতাস
উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“এ তো
একটা কাঁচা চিঠি। এখানেও কোনও লোগো নেই, ডিরেক্টরের স্ট্যাম্প নেই। এমনকি
এটা ইনস্টিটিউটের লেটার হেডও নয়। আর
মণিমা, স্যার
প্রাইজ পাবেন সেটা প্রথমে বাড়িতে চিঠি দিয়ে জানাবে। আর তার জন্য ডেথ সার্টিফিকেট
বেশি হলে চাইতে পারে। কিন্তু অন্য প্রমাণ চাইবে কেন?” বিতান বিরক্ত হয়ে কফি খেতে খেতে
চিঠিটা নেড়েচেড়ে দেখছে। “মণিমা, স্যার একজন বিশ্ববিশ্রুত চিত্রশিল্পী ছিলেন। সারা বিশ্ব এই
মর্মান্তিক খবরটা জানে। সেখানে ওঁর মৃত্যুর প্রমাণপত্র চাইতেই পারে না। আর ওয়ারিশন
কী কাজে আসবে? ভাগ্যিস,
তুমি কিছু দাওনি।”
“না
রে, তোকে
জিজ্ঞেস না করে আমি এরকম একটা কাজ করতে পারি!”
“ঠিক
আছে, তুমি
এ নিয়ে ভেব না। আমার লালবাজারে চেনাজানা আছে। ফোন করে ব্যাপারটা জানাচ্ছি।”
অভিজিতের
সৌজন্যে তিতাসেরও লালবাজারের সঙ্গে চেনাজানা আছে। তিতাস ঠিক করল, ও নিজে যাবে। বিতানকে
আর ডিস্টার্ব করবে না।
রাত
তখন এগারোটা। তিতাস দেবতোষ দাশের ‘বিন্দুবিসর্গ’ পড়ছিল। একটা
আননোন নম্বর থেকে কল দেখে তিতাসের ভুরু কুঁচকে গেল।
“হ্যালো, কে বলছেন?”
“আমি
দয়াল ভদ্র বলছি।”
“কী
ব্যাপার, বলুন।”
“হেমন্ত
জানা একটু অসুস্থ হওয়াতে আমাকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলল। হ্যালো, আপনি শুনছেন?”
“হুঁ, শুনছি। বলুন।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিতাস উত্তর দিল।
“ম্যাডাম, ডকুমেন্টগুলো
কবে দেবেন?”
“প্রথমত,
আমি চিঠি পাইনি। আর তাছাড়া, হেমন্তবাবুকে
বলেছিলাম আমি খবর দেব।”
“হ্যাঁ, হেমন্ত সেটা
আমায় বলেছে।”
“এত
রাতে আমায় ডিস্টার্ব করবেন না। যা কথা কাল সকালে হবে।” বলে তিতাস ফোন কেটে দিল। গলার
স্বরটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। কার গলা? কিছুতেই ট্রেস করতে পারছে
না।
ঘুরেফিরে
একটা কথা বারবারই তিতাসের মনে হচ্ছে যে কী এদের উদ্দেশ্য! আর এত রাতে কেন ফোন করল? বিতানকে
কাল জানাতে হবে।
ভোরের
নরম আলোয় সারা ব্যালকনি ভেসে যাচ্ছে। রঙবেরঙের সাকিউলেন্টগুলো ঝলমল করছে। তিতাস
ঝারি দিয়ে কলাগাছের গোড়ায় জল দিয়ে নিচে যে দুধের ব্যাগটা ঝোলানো আছে সেটা টেনে
ওপরে আনতেই চোখটা একটা বড়ো ধাক্কা খেল। ব্যাগের ভেতর একগোছা বেগুনি রঙের
সাকিউলেন্ট! তিতাস, “এটা কী?” বলে চেঁচিয়ে উঠল। থরথর
করে কাঁপছে।
মেনকা
আটা মাখছিল। চিৎকারে ব্যালকনিতে এসে তিতাসকে ওই
অবস্থায় দেখে তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে চেয়ারে বসিয়ে এক গ্লাস জল দিল। তিতাস
জল খেয়ে ধাতস্থ হয়ে দেখল, ফুলের মধ্যে একটা চিরকুট। তাতে লেখা – ‘ডকুমেন্টগুলো
রেডি রাখবেন। আজ বিকেলে কালেক্ট করব। অন্য
ব্যবস্থা নিলে আমরাও অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব। মনে রাখবেন অধমের কথা।’
লালবাজার
ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের স্পেশাল ব্রাঞ্চের হেড রক্তিম সেনগুপ্ত চিরকুটটা হাতে
নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
“ম্যাডাম, প্রতিবার
একগুচ্ছ বেগুনি রঙের সাকিউলেন্ট দিচ্ছে। হতে পারে যে এটা ওদের দলের সিম্বল। তবে
আপনার কথা অনুযায়ী বাড়িতেও নানারঙের সাকিউলেন্ট আছে এবং সেটা আপনার প্রিয়। ওদের
কাছে এই খবরটা আছে। কিন্তু এই ইনফরমেশন ওদের কাছে যাচ্ছে কীভাবে? ওকে, দেখা যাক। চিন্তা
করবেন না। বাড়িতে পুলিশ পোস্ট করব কিনা ভাবছি।”
“সেটার
দরকার নেই এখনই। ওরা ক্ষেপে গিয়ে হয়তো কোনও ক্ষতি করতে পারে।”
“না
না, সে যাতে না করে তার ব্যবস্থা তো করছি।”
“ওকে।”
চিন্তান্বিত মুখে তিতাস লালবাজার অফিস থেকে বেরোল। তিতাসের
গাড়িটা বাড়ির অভিমুখে রওনা হয়ে গেল।
“WB89C-6035 টাটা
নিক্সন ব্লু কালার ফলো কর তো খোকা। অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে।”
“জী
স্যার।”
89C-6035 কিছুক্ষণ এ-প্রান্ত
ও-প্রান্ত ঘুরে একটা ছোটো গলি – ব্লাইন্ড লেন বলা যায়,
তার শেষপ্রান্তে একটা সাদা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। কিন্তু কেউ নামল না। ব্যাপারটা
বোঝা যাচ্ছে না।
“খোকা
অ্যাবাউট টার্ন
কর।”
“একটু
এগিয়ে দেখব, স্যার?”
“নো।
পরে আসা যাবে।”
“ওকে,
স্যার।”
দুপুর
একটা। সূর্যদেবের লেলিহান তাপে সারা কলকাতা শহর জ্বলছে। পাখিরাও গাছের ছায়ায়
ক্লান্তিতে ডাকতে ভুলে গেছে। প্যারিমোহন দত্ত লেনের ২৮/২ বাড়িটায় দক্ষিণমুখো জানালাটায়
শরীরটা এলিয়ে বসে আছে ভানু সিং। ঘরে এসির আরামদায়ক ঠান্ডায় বাইরের তাপ টের পাওয়া
যাচ্ছে না। কিন্তু মাথার ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। অভিজিৎ ব্যানার্জীর ছবিগুলো
চাই যে কোনও প্রকারে হোক। প্রয়োজন হলে তিতাস ব্যানার্জীকে দুনিয়া থেকে... কিন্তু
তার আগে জিনিস চাই।
“বস, খবর আছে।” একটা
ঢোলা প্যান্ট আর নীলচে সাদা বুশ শার্ট পরে ইদ্রিস সামনের মোড়াটা টেনে বসল।
“কী?”
“ওই
যে অভিজিৎ না কী নাম যেন, ওর বউ পুলিশে খবর দিয়েছে।”
“তো? দিক। ওইসব
নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। টার্গেট মনে আছে তো?”
“ইয়েস, বস।”
“তুই
তোর কাজ কর। আমি ভাবছি, আশিস
সামান্য একটা ডকুমেন্ট আনতে পারছে না! চিড়িয়া ভাগবে না তো রে?”
“নেহি,
বস। আমার নজরে আছে। কিছু বেগড়বাই দেখলেই ফিনিশ।”
“হুঁ...
ইদ্রিস, অজয়
এখনও কোনও খবর দিচ্ছে না, তবে কি... আবার অন্য চাল খেলল?” ভানু সিং
খানিকটা আত্মগত হয়ে বলল।
ইয়ে
দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে... ফোনটা বাজতেই ভানু তাকিয়ে দেখল, অজয়।
“হ্যালো, বোলো অজয়, কোই খবর হ্যায়?”
“হাঁ, ভানু। তিতাস
ব্যানার্জী বহত হুঁশিয়ার মালুম হচ্ছে। বলছে, অফিসিয়াল চিঠি না দিলে কোই ডকুমেন্টস
দেবে না। ও তো সমঝাতে অউর দো-চারদিন লাগবে। লেকিন এক মুসিবত হো গয়া।”
“ক্যায়া
মুসিবত?” ভানুর
বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
“ইয়ে
খবর লালবাজার তক পহুচ গয়া। অভিজিৎ ব্যানার্জী বহত এলেমদার আদমি ছিল। ওরা ফিল্ডে
নেমে পড়েছে। তবে আমরাও রেডি আছি।”
“হা,
একদম রেডি হয়ে থাকো। কোই উলটা-সিধা দেখলেই পিস্তল চালাবে। ও সব তসবির কোই ভি কিমত
পর চাহিয়ে।”
“মণিমা,
আমি বিতান বলছি।”
“হ্যাঁ, বল।”
রাত
তখন আটটা বাজে। তিতাস অভিজিতের ছবিঘরে তালা দিচ্ছে। সেই সময়ে বিতানের ফোনটা এল।
“শোনো, কাল
লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক অফিসার ইন্টারোগেশনের জন্য
তোমার বাড়ি আসবেন। আমিও যাব। ভেবো
না কিছু।”
“আমার
কাছে কীসের ইন্টারোগেশন?”
“ওই
লোকটা কী বলেছে তোমায় ইত্যাদি। আসলে মণিমা, পুলিশের কিছু অফিসিয়াল কাজ থাকে যেটা
করবেই। ও নিয়ে চিন্তা কোরো না।” তিতাস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল।
“আমার
সঙ্গে সেদিন কথা হল, আবার ইন্টারোগেশন! ঠিক আছে। কখন আসবেন?”
“আমি
সময় জানিয়ে দেব তোমায়।”
“জানিয়ে
দিস। একটু বেরোনোর দরকার ছিল। সেই বুঝে বেরোব।”
“শিওর, মণিমা। রাখছি
এখন।”
বিতানের
ফোন এলে তিতাসের কিছুটা হালকা লাগে।
“বৌদি
গো, দরজার
গোড়ায় এই খামটা পড়েছিল। দেকো তো কে দিয়ে গেল।” মেনকা
বাজার করে ফিরে দরজার সামনে থেকে একটা হালকা সবুজ রঙের খাম তিতাসের দিকে এগিয়ে
দিল।
খামটা
হাতে নিয়ে তিতাস দেখল, ওপরে বেগুনি রঙের সাকিউলেন্টের ছবি আঁকা। চোয়ালটা শক্ত হয়ে
গেল। ভেতরে একটা ছোট্ট চিরকুট – ‘ম্যাডাম, অন্য ব্যবস্থা নিলেন তাহলে। লালবাজার
অবধি গেলেন। ফলটা ভেবে দেখবেন।’
পুরো
ব্যাপারটা তিতাসের কাছে ধোঁয়াশা ঠেকছে। ‘অভির তো কোনও শত্রু ছিল বলে শুনিনি। তবে
এইসব ফিল্ডে শত্রু হতে কতক্ষণ? কিন্তু আজ তো অভি নেই। তবে? এদের উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। এদের
আসল কান্ডারী কে?’ খামটা
হাতে নিয়ে তিতাস চুপ করে বসে আছে।
“মণিমা, কী করছ?” বিতান
খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে তিতাসকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল।
“দ্যাখ
এটা।” বিতানের হাতে খামটা দিল। একটা
হালকা শ্বাস ফেলে বিতান তিতাসের দিকে তাকাল।
“মণিমা, আজ সরকারি
নির্দেশে যার আসার কথা ছিল তাকে পুরুলিয়া যেতে হল।
তাই আসতে পারল না।”
“ও,
আচ্ছা।” শুকনো গলায় তিতাস উত্তর দিল।
“বিতান,
সাকিউলেন্টের ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আবছা লাগছে, জানিস। এই গাছ আমার বাড়িতে আছে,
আর আমি খুব ভালোবাসি। এই সংবাদ
ওরা জেনে গেছে। কিন্তু জানল কীভাবে? প্রশ্ন হল সেটা, তাই না?”
“হুঁ, তুমি ঠিক
বলেছ। তবে তোমার বাড়িতে কম লোক আসে না। স্যার থাকতে অহরহ লোক আসত।
এটা জানা কোনও ব্যাপার! আচ্ছা, আমি দেখছি। মণিমা, এইসব ঝামেলায় তোমাকে বলা হয়নি একটা
ব্যাপার। কালচারাল
ফোরাম স্যারের স্মরণসভা করবে। ছবিগুলো নিয়ে যেতে হবে। কী করব, বলো।”
তিতাস
একটু দ্বিধান্বিতভাবেই বলল, “নিয়ে
যাবি? ঠিক
আছে। স্মরণসভায় ছবি লাগবে কেন রে?”
“অ্যাকচুয়ালি, স্মরণসভার
পাশাপাশি একটা স্যারের ছবির প্রদর্শনী হবে। আমি দায়িত্ব নিয়ে সব নিয়ে যাব। তুমি
ভেবো না। আর এদিকটাও দেখছি।”
“এত
ছবি নিয়ে যাবি?”
“সব
নয়। বেছে বেছে কিছু ছবি। মোহিনীও থাকবে। চিন্তা
কোরো না।”
“ঠিক
আছে। যা ভালো বুঝিস কর। ব্যাপারটা আমায় চিন্তায় ফেলেছে। ভয়ও করছে রে।” তিতাসকে খুব
চিন্তিত লাগল।
“মণিমা, ভয় পাচ্ছ
কেন? আমি
তোমার পাশে আছি সবসময়। আর রক্তিমদার সাথে আমি কথা বলব। ভেবো না কিছু।”
“স্যার, WB89C-6035
টাটা নিক্সন
প্যারিমোহন দত্ত লেনের ওই বাড়িটায় ঢুকেছিল। কিন্তু গাড়ির ভেতরে কে ছিল বোঝা
গেল না।” রাজশেখর অফিসার-ইন-চার্জ রাম ত্রিবেদীর সঙ্গে ওঁর চেম্বারে বসে কথা বলছে।
“আপনি
থ্রু আউট ফলো
করেছিলেন?”
“হ্যাঁ,
স্যার। কিন্তু একটা ব্যাপার আপনাকে বলার আছে। গাড়ি থামতেই একটা ঢোলা জামাপ্যান্ট
পরা লোক বেশ কিছু প্যাকেট বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে।
কিন্তু দূর থেকে কীসের প্যাকেট আন্দাজ করতে পারছিলাম না।”
“কী
বলছেন, রাজশেখরবাবু! এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর।” একটা অদ্ভুত উত্তেজনা খেলে গেল
রাম ত্রিবেদীর চোখে মুখে।
“হ্যাঁ,
স্যার। তবে বের করে ফেলব।”
“হুঁ।”
“বিষণ, বিষণ...” রাম
ত্রিবেদী চেঁচিয়ে আর এক এস আইকে ডাকলেন। সেলাম ঠুকে বিষণ এসে দাঁড়াল। বিষণের
চেহারাটা দেখলে মনে হয় কেউ কালো পাথর কুঁদে নিখুঁত মানুষের অবয়ব সৃষ্টি করেছে। ছ’ফিটের
কাছাকাছি হাইট। গলার স্বরটাও গমগমে। “ইয়েস, স্যার।”
প্যারিমোহন
দত্ত লেনের ঠিকানাটা বিষণকে দিয়ে ভালো করে খোঁজ নিতে বললেন রাম ত্রিবেদী। “খোকাকে সঙ্গে
নেবেন।”
“ওকে,
স্যার।” বিষণ চলে গেল।
“রাজশেখর, পটকে কোনও
খবর দিয়েছে?”
“না
স্যার, এখনও দেয়নি। তবে ও খুব করিতকর্মা ছেলে। চিন্তা নেই।”
রাজশেখর
রুমে বসে তিতাস ব্যানার্জীর ফাইল নিয়ে দেখছিলেন।
আরও সুপরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে। অভিজিৎ ব্যানার্জীর ছবি টার্গেট এটা বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু...
“স্যার, আসব?” দরজা ঠেলে
পটকে ঢুকল।
“হ্যাঁ,
এস। মনে হচ্ছে খবর আছে?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“বলো।”
“তিতাস
ম্যাডামের বাড়িতে এ ক’দিন কাজের লোক ছাড়া সেরকম কেউ আসেনি। তবে কাল দুপুরবেলা দু’জন
ভদ্রমহিলা এসেছিলেন, একটা বাচ্চাও ছিল সঙ্গে। সেই সঙ্গে একটা লোক ছিল। একঘন্টা
বাদে চলে যায়। তারপর বিকেল নাগাদ ইনোভা করে স্যুট পরে দু’জন লোক আসে। মিনিট দশ
বাদে বেরিয়ে যায়। আর তার প্রায় পেছনে পেছনে একটা লাল মারুতি ইনোভাটাকে ফলো করে।”
“মারুতির
নম্বর নোট করেছ?”
“হ্যাঁ, স্যার।” বলে
পটকে নম্বর লেখা চিরকুট রাজশেখরের হাতে দিল।
“হুঁ।” গম্ভীর
হয়ে মাথা নাড়লেন রাজশেখর। “অনেক খবর দিয়েছ। তবে কাজ তোমার শেষ হয়নি। লেগে থাকো।”
“ঠিক
আছে, স্যার।” পটকে চলে গেল।
রক্তিম
সেনগুপ্তর চেম্বারে তিতাস আর রাম ত্রিবেদী বসে আছেন।
গতকাল রাম ত্রিবেদীর সঙ্গে রক্তিম সেনগুপ্তর একঘন্টার ওপর বিষয়টা নিয়ে আলোচনা
হয়েছে। আজ তাই তিতাসকে ওঁর অফিসে ডেকেছেন রক্তিমবাবু।
“ম্যাডাম, অভিজিৎ
ব্যানার্জীর ছাত্রছাত্রীরা সবাই তো বাড়িতে আসত। তো
আপনি সবাইকে চেনেন?”
“সবাই
বাড়ি আসত না। বিশেষ কয়েকজন বাড়ি আসত। তাদের
সবাইকে খুব ভালো চিনি। তারা আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে এখনও।”
“কে
কে আসত?” রক্তিম
প্রশ্নটা তিতাসের দিকে ছুড়ল।
“অফিসার, বিতান, মোহিনী, দেবদুলাল
আরও অনেকে। পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওদের সঙ্গে।”
“আচ্ছা
ম্যাডাম, একটা কথা বলি। আপনি যে সাকিউলেন্ট এত ভালোবাসেন আর বাড়িতে অনেক আছেও সেটা
এরা সবাই জানে?”
“বাড়ির
ভেতরে যারা আসত তারা জানে। আর অভি বেঁচে থাকতে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও বিভিন্ন লোক আসত।
সবাইকে চিনতামও না। তারা জানতে পারে। এছাড়া আমার আত্মীয়স্বজন জানে। আচ্ছা অফিসার,
আপনি কি এই ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ...”
“সন্দেহের
তালিকায় সবাই যতক্ষণ না নিশ্চিত হতে পারছি। অভিজিৎবাবুর ছবিগুলো বাড়িতেই আছে তো?”
তিতাস
একটু ইতস্তত করে বলল,
“কালচারাল ফোরামে
একটা অনুষ্ঠান আছে। তাই ছবিগুলো নিয়ে গেছে।”
এক চকিত
দৃষ্টি রাম ত্রিবেদী ও রক্তিম সেনগুপ্তের মধ্যে বিনিময় হল।
“কী
অনুষ্ঠান?” রামবাবু
তিতাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“অভিজিতের
স্মরণসভা।”
“স্মরণসভায়
ওঁর সব ছবি লাগবে?” রক্তিম
সেনগুপ্ত একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“না, ওর একটা
এগজিবিশন হবে।”
রক্তিম
সেনগুপ্ত একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন। “ওকে, আপনাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। নেভার
মাইন্ড। এবার আপনি আসতে পারেন। তবে রামবাবুর সঙ্গে
যোগাযোগ না করে কোথাও বেরোবেন না, আর কোনও কাজও করবেন না। আর এক মিনিট, ম্যাডাম। আপনার
বাড়িতে পুলিশ পোস্টিং করছি।”
তিতাস
কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না। ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।
একপশলা
জোর বৃষ্টি হয়ে গিয়ে একটা ঠান্ডা হাওয়ায় তিতাসের শরীরকে জুড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যালকনিতে
বসে আছে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। আগের রাতে বারোটার সময়
তিতাসের ফোনে একটা ফোন আসে। প্রথমে ধরতে গিয়ে কেটে যায়। কিন্তু পরে আবার ফোনটা রিং
হতে তিতাস ধরে। ও-প্রান্ত থেকে হাসির আওয়াজ আসছিল। আর ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল।
কিন্তু কথাগুলো তিতাস ধরতে পারেনি। কিছু একটা ঘটছে তিতাস বুঝতে পারছে, কিন্তু কী
সেটা মাথায় আসছে না।
বেশ
ক’টা দিন হল রক্তিমবাবুর দিক থেকেও কোনও খবর আসছে না। এর মধ্যেই মোবাইলটা বেজে
উঠতে তাকিয়ে দেখে রাম ত্রিবেদী। “হ্যাঁ বলুন, রামবাবু।”
“নমস্কার,
ম্যাডাম। আপনি ঠিক আছেন তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি।”
“শুনুন, আগামীকাল
বেলা একটা নাগাদ একবার লালবাজারে আসতে হবে। কাইন্ডলি আসবেন।”
“আচ্ছা
রামবাবু, যাব। কিন্তু কারণটা যদি বলেন।”
“আসুন,
তারপর জানতে পারবেন। ও, আরেকটা কথা। আমার গাড়ি যাবে। আপনাকে নিয়ে আসবে।”
“ওকে, অফিসার।”
ফোন
ছেড়ে দিয়ে তিতাস ভাবছে, ‘এই
রহস্যের সমাধান হয়েছে বলেই কি ডাকছে আমায়? বিতানকে একবার জানাতে হবে।’
রক্তিম
সেনগুপ্তর চেম্বার সংলগ্ন অ্যান্টিক রুম। দুটো সোফা আছে। একটা বার্মা টিকের
অর্ধচন্দ্রাকার ছোটো গ্লাস টপ দেওয়া টেবিল। একধারে কুশন দেওয়া রিভলভিং চেয়ার। অন্যপ্রান্তেও
দুটি কুশন দেওয়া চেয়ার, তবে রিভলভিং নয়। দুই ধারের দেওয়ালে রবি বর্মার
পেইন্টিং। ঘরের মধ্যে মিষ্টি জুঁইফুলের গন্ধ। বোঝাই যাচ্ছে, গেস্টদের জন্য স্প্রে
করা হয়েছে। রক্তিম সেনগুপ্ত ছাড়া তিতাস, রাম ত্রিবেদী, আর দু’জন
সিনিয়র অফিসার অম্বিকা দাস ও বিল্ব ব্যানার্জী, আর রাজশেখর রায় ঘরে সোফা-চেয়ার মিলিয়ে
বসেছেন।
“তিতাস
ম্যাডাম, আজ
আপনাকে এখানে ডেকেছি যে কারণে তা হল কিছুদিন ধরে আপনার সঙ্গে যে রহস্যের খেলা চলছে
তার যবনিকা টানার জন্য। আমার এই যে অফিসারদের দেখছেন, এঁরা খুবই দক্ষতার সঙ্গে
একটা মস্ত বড়ো ক্রিমিনাল গ্যাং-কে ধরেছেন।” রক্তিম মৃদু হেসে তিতাসের দিকে তাকিয়ে
বলছেন।
“ক্রিমিনাল
গ্যাং!”
“ইয়েস ম্যাডাম, ক্রিমিনাল
গ্যাং। এরা বিভিন্ন ফিল্ডে নানাধরনের ক্রাইম করে। এবারের
নজর ছিল আপনার স্বামী বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অভিজিৎ ব্যানার্জীর দিকে। ওঁর ছবি
বিদেশে পাচার করে ডলার কামানো ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।”
“কী
বলছেন, রক্তিমবাবু!” তিতাস বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে।
“আরও
শুনুন। বিস্ময়ের এখনও অনেক বাকি। অভিজিৎবাবু বেঁচে
থাকতেই অনেক হুমকি-চিঠি আসছিল ওঁর কাছে।”
“হোয়াট! আমি তো
কিছু জানতাম না।”
“আমার
কাছে অভিজিৎবাবু জানিয়েছিলেন এবং অ্যাকাডেমিতে ওঁর যে প্রদর্শনী ছিল তখনও একেবারে
টপ লেভেল থেকে হুমকি-চিঠি এসেছিল। আমার কাছে সে চিঠি আছে। ফলে ওঁর মৃত্যুর পর
প্রায় পাঁচমাস পর আবার যখন ওরা অপারেশন চালু করল তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গে তদন্তে নেমে
পড়েছিলাম।”
“তারপর?” তিতাস
বিমূঢ়ের মতো জিজ্ঞেস করল।
“তারপর
স্যার আমাকে এবং এই অফিসারদের ডিরেকশন দিলেন।” রাম ত্রিবেদী তিতাসের দিকে ঘুরে
কথাটা বললেন। ঘরের অন্যরা চুপ করে শুনছিলেন সব। “আমার
একটা সন্দেহ হচ্ছিল যখন আপনি বললেন বেগুনি সাকিউলেন্টের কথা। ভেতরের লোক না থাকলে
এ-খবর বাইরে যেতে পারে না। আপনার কাজের লোককে জেরা করেছে আমার লোক। কিন্তু সন্দেহ
জাগাবার মতো কোনও কিছু মনে হয়নি।” রামবাবু বলে চলেছেন, “স্যারের
অর্ডারমতো আমি ঐ যে রাজশেখর, একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার, ওঁকে ভার দিলাম আপনার বাড়িতে কারা যাচ্ছে আসছে সেটা
নজর রাখার। আপনি যেদিন প্রথম স্যারের কাছে আসেন তখন একটা নীল রঙের টাটা নিক্সন
আপনাকে ফলো করা
শুরু করে। আপনি যখন যেখানে যেতেন ওই গাড়িটা আপনাকে অনুসরণ করত।”
“আচ্ছা, একটা
ব্যাপার রামবাবু, আপনি অ্যাকশনে নেমেছেন তো আমি লালবাজারে আসার পর। তাই তো?” তিতাস রাম
ত্রিবেদীকে জিজ্ঞেস করল।
“না,
ম্যাডাম। অভিজিৎবাবু থাকতেই কাজ শুরু করি। তবে মাঝে ওই দুর্ঘটনার পর একটু
থেমেছিলাম। আপনি ফোনে স্যারকে আভাস দিতেই আবার শুরু করি।” হেসে উত্তর দিলেন রাম
ত্রিবেদী।
“আচ্ছা, তারপর?” উৎসুক হয়ে
তিতাস জিজ্ঞেস করল।
“তারপর,”
রক্তিমবাবু এবার উত্তর দিলেন, “রামবাবুর নির্দেশে সেই গাড়িটাকে ফলো করা শুরু
হল। গাড়ির আরোহী এবং আরোহিণীকে কিছুদিনের মধ্যেই সনাক্ত করি। এবার একটু অন্য কথায়
আসি। প্রথমত, কালচারাল ফোরাম কোনও স্মরণসভা বা এগজিবিশন অরগানাইজ করেনি। এটা
ভুয়ো খবর।”
“মানে? আমাকে তো
বিতান খবর দিয়েছে। ও জানবে না?”
“না,
ম্যাডাম। মিথ্যে বলেছে স্যারের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র বিতান মল্লিক। আর... আর এই
গ্যাংয়ে কলকাতা-দিল্লি শাখার মেন চাঁইদের একজন হল আপনার ওই বিতান মল্লিক।”
“কী
বললেন!” মাথায় বাজ পড়লেও তিতাস এত চমকে উঠত না। শরীরটা যেন মনে হল অবশ হয়ে যাচ্ছে।
“তুলসী,
ম্যাডামকে এক্ষুনি জল দাও। ম্যাডাম, ঠিক আছেন?” অম্বিকাবাবু তাড়াতাড়ি উঠে তিতাসের
কাছে এলেন।
“ওকে
আই অ্যাম। প্লিজ প্রসিড।” তিতাস কোনওরকমে বলল।
“ইয়েস, ম্যাডাম। ওই
বিতানের আরেক সহকর্মী হল মোহিনী চ্যাটার্জী। আপনি জানতেন না, বহুদিন ধরেই ওরা
অভিজিৎবাবুর ক্ষতি করতে চেষ্টা করছিল। অভিজিৎবাবু মারা যাবার পর সেই পথ আরও সুগম
হল। আপনি বিতানকে এমনিতেই পুত্রবৎ স্নেহ
করতেন। সেই সুযোগটা সুন্দরভাবে কাজে লাগাল।”
“ওই
হেমন্ত জানা সব বিতানের চক্রান্ত?” তিতাসের গলা কাঁপছে।
“একদম
তাই। বিতানই ছক করে পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা করেছিল আর মোহিনী ছিল তার ডান হাত। অলক্ষ্যে
থেকে কাজ করত। অভিজিৎবাবু একটু সন্দেহ করেছিলেন। ওদের গ্যাংয়ের প্রধান হোতা বিয়াস
লামা,
একজন তিব্বতি মহিলা।”
“অফিসার, অভির ছবিগুলো
তাহলে বিতানই কারসাজি করে চুরি করে নিল?” তিতাসের চোখদুটো লাল হয়ে গেছে।
“হ্যাঁ, ম্যাডাম। উদ্দেশ্য
ছিল ছবিগুলো বিয়াসের হাতে তুলে দেওয়া। তারপর বিদেশে বহুমূল্যের বিনিময়ে বিক্রি হত। প্যারিমোহন
দত্ত লেনে ২৮/২ ছিল ওদের আস্তানা। রাতের বেলা ফোর্স নিয়ে অম্বিকাবাবু আর বিল্ব
অপারেশন চালিয়ে ভানু সিং, অজয়
দুবে,
ইদ্রিস আলি এই তিনজনকে ধরেছে। বাকিদের খোঁজ পাওয়া গেছে। ক’দিনের মধ্যেই জেলের ভাত
খাবে। তবে ছবিগুলো আমরা বোধহয় কিছু উদ্ধার করতে পেরেছি। আর...”
“আর?”
“বিতান
মল্লিক আর মোহিনীও ধরা পড়েছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে বিয়াসও ধরা পড়বে কারণ, ওর
সঙ্গীরা বেশিরভাগ ধরা পড়েছে।”
“রক্তিমবাবু, বিতান যদি
এই কান্ড ঘটিয়ে থাকে তবে ওই তো আমায় বলেছিল যে হেমন্ত জানার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ
মিথ্যে! সেটা কেন করল?”
“আই
ওয়াশ করেছিল।
আপনার যাতে বিশ্বাস অর্জন করে আসল কাজটা মসৃণভাবে করা যায়। করেওছিল। আর
হুমকি-চিরকুট এমনকি বেগুনি রঙের সাকিউলেন্ট সব ওর নির্দেশে আপনাকে দেয়া হয়েছিল।”
“ও
তো লালবাজারে আপনাকে খবর দিয়েছিল। আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছি না।”
“আপনাকে
ওসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছিল। কোনও খবর দেয়নি।” মৃদু হেসে রক্তিমবাবু বললেন।
“তাই
ছবিগুলো নেবার পর ফোন করলে বিতান ব্যস্ত বলে আমায় এড়িয়ে যেত। মোহিনীর কথা জিজ্ঞেস
করলেই বলত, ও কুচবিহারে ছবির কাজে গেছে!” তিতাস ভাবতে পারছে না।
“ম্যাডাম, আপনি কি
বিতান বা মোহিনীর সঙ্গে দেখা করতে চান?” অম্বিকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“না!”
তিতাস ধৈর্যকে নিজের বশে আর রাখতে না পেরে চিৎকার করে উঠল। “একটা হীন, কুচক্রীর সঙ্গে
আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই। অগাধ বিশ্বাসের এই প্রতিদান পেলাম। ওপর থেকে অভিজিৎও
ক্ষমা করবে না।”
তিতাস
শরীরে, মনে
বিধ্বস্ত। সন্ধ্যাবেলায় ব্যালকনিতে গিয়ে এক ঝটকায় সব বেগুনি সাকিউলেন্টগুলো দুমড়ে
মুচড়ে ফেলে দিল। হু হু করে বুকভাঙ্গা কান্না বেরিয়ে এল। এটাই
কি ওর পাওনা ছিল! শেষে বিতান আর মোহিনী!
একমাস
পর ‘আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট’ দিল্লি থেকে সত্যি চিঠি এসেছে। অভিজিতের ছবির সিরিজ ‘নীল
আকাশের নিচে এই পৃথিবী’ প্রাইজ পেয়েছে। তিতাসের কাছে প্রাইজ নিতে দিল্লি যাবার
জন্য আমন্ত্রণপত্রও এসেছে। তিতাসের চোখের কোণ ভিজে। উথালপাথাল ঝড়ের পর এক অখন্ড
শান্তি তিতাসের মনে। অশুভের বিনাশ তবে সত্যি ঘটল।
_____
অলঙ্করণঃ পার্থ মুখার্জী
দারুন!!!
ReplyDelete