
বাচ্চা
ছেলেটা
কৃষ্ণেন্দু
বন্দ্যোপাধ্যায়
পার্ক থেকে ঠিক বেরোবার মুখে পাপুনের চোখে পড়ল। দেখেই পাপুন
ভীষণ অবাক। এটা কীরকম হল? ছোট্ট ছেলেটা সেই থেকে শুধু কেঁদেই চলেছে, কেঁদেই! ধারেকাছে
তার কেউ নেই। ওর মা-বাবা কোথায় গেল? তখন থেকেই একটানা শুধু কাঁদছে ছেলেটা!
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে পার্কের গায়ে, ঝিলের ওপর।
ছোটোবড়ো নানা গাছের পাতায় অন্ধকারের ছায়া। আকাশের গায়ে লেপটে রয়েছে কীরকম যেন মায়া। বিকেলের খেলা
শেষ করে ওরা একে একে ফেরে ঘরে। পাপুন ও তার বন্ধুর দল। এমন সময় পাপুনেরই চোখে পড়ে। ঐ ছেলেটা
তো অনেক আগেও এখানেই বসে ছিল! এভাবেই কাঁদছিল! এখনও তাহলে বাচ্চাটা কেন একা একা
বসে কাঁদে? কেউ কি সঙ্গে নেই নাকি ওর? হারিয়ে গেছে কি ও? অথবা ওকে কি ফেলে রেখে
গেছে কেউ?
পাপুনের মনে নানা প্রশ্নের ঢেউ। পায়ে পায়ে এসে পাপুন দাঁড়ায় ছোটো
ছেলেটার কাছে। বাচ্চা ছেলেটা, বয়েসটা হবে খুব বেশি হলে বছর দশেক। গোলমতো মুখ, দারুণ মিষ্টি। দুটি চোখ
টলটলে। যদিও সে চোখ ঝাপসা এখন জলে।
পাপুন বলল, “কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন তুই? নাম কী রে
তোর? কোথায় থাকিস? বাবা-মা কোথায় তোর?”
একসাথে এত কথা শুনে যেন বাচ্চাটা দিশেহারা। কান্না
থামিয়ে জলভরা চোখে পাপুনের দিকে তাকায়। পাপুন দেখল অদ্ভুত এক দৃষ্টি সে-চোখে, আকাশ সেখানে
রামধনু রঙ মাখায়। আস্তে আস্তে কথা ফোটে তার মুখে। ধীরে ধীরে বলে, “এখানে তো কেউ
নেই। যারা আছে আর যা কিছুই আছে, সে যেন অনেকদূর। কোথায় তা ঠিক মনেও পড়ে না। শুধু মনে হয়, বহুদূর থেকে ভেসে আসে এক সুর।”
কী বলে ছেলেটা? পাপুন অবাক। তার মানে কিছু মনে নেই নাকি ওর?
ভুলে গেছে সবকিছু? তাহলে তো খুব মুশকিল হল। পাপুন ভাবতে থাকে। কী করে এখন খুঁজে পাবে ওর মাকে?
ছেলেটা আবার বলে ওঠে, “জানো, মনে হয় কিছু হারিয়ে
ফেলেছি আমি। ঠিক এখানেই কিছু যেন ছিল। কী যেন একটা, কী যেন...” বিড়বিড় করে ছেলেটা।
পাপুন গভীর দৃষ্টিতে দেখে ওকে। অস্বাভাবিক ভঙ্গি কিছু কি আছে ওর
মুখেচোখে? ভালো করে দেখে পাপুন বুঝল, তেমন তো কিছু নেই! তাহলে এমন এলোমেলো কথা কেন?
কেন যে কিছুই খুলে বলছে না বাচ্চা ছেলেটা!
এবার পাপুন অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস
করে তাকে, “ঠিক করে বল, কোথায় থাকিস। এখানে এলি কী করে?”
ছেলেটা বলল, “কী করে আবার, সময়ের গলি
ধরে! যেভাবে সবাই ছোটে দিকে দিকে, সেভাবেই আমি এখানে এলাম, এই এক্সকারশানে।”
অবাক গলায় পাপুন বলল, “মানে?”
“আমাদের দেশে ঐ তো নিয়ম। প্রতি গ্রীষ্মের শেষে এক্সকারশানে যেতে হয় একা, অজানা অচেনা দেশে। আমিও তেমন
যাই প্রতিবার। কোনওদিন কোনও ভুল তো করিনি আগে!
এবারেই শুধু গোলমাল হয়ে গেছে। কী
জানি, হয়তো প্রোগ্রামে কিছু ভুলভাল রয়ে গেছে।”
হাঁ করে পাপুন তাকিয়েই ছিল ছোটো
ছেলেটার দিকে। ও যে কী বলছে, নিজেই কি সেটা
জানে? নাকি ওর কথা সবই ঠিক, শুধু পাপুন নিজেই বুঝছে না তার মানে? এইটুকু ছোটো
বাচ্চা ছেলেটা, বড়োদের মতো ভারী ভারী সব কথা! কী করে এমন হয়! ছেলেটা কি বাস করে
বাস্তবে? বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং
সেটা আরও ভালো করে জেনে-বুঝে নিতে হবে।
তাই এবারে সে ধমকে উঠল যেন,
“কীসব ফালতু বকছিস শুনি? ঠিক করে খুলে বল। ‘আমাদের দেশ’ মানে কী? তুই কোথাকার কথা বলছিস?”
ছেলেটা বলল অবাক গলায়, “সে কী!
বুঝলে না তুমি? আমাদের যেটা দেশ! মানে আমরা যেখানে থাকি! ঐ যে ওখানে, ওদিকের পারে,”
আঙুল দেখাল ছেলেটা।
ওর নির্দেশে তাকিয়েই যেন আরও
বোকা বনে পাপুন। এ কী অদ্ভুত ব্যাপার! মাটির কোনায় একদিকে যেন আঙুল দেখায় ছেলেটা। এর মানেটা কী দাঁড়ায়? মাটির
নিচেই দেশ নাকি ওর? সেখানেই থাকে ছেলেটা? পাপুনের মাথা ভোঁ ভোঁ করে, যেন
বুদ্ধিশুদ্ধি হারায়।
এবার ছেলেটা হেসেই ফেলল। পাপুনের বোকা মুখটা দেখেই হাসি
পেয়ে গেছে তার। বলল, “এ কী গো? এও বুঝলে না? এটা তো পরিষ্কার! ঐ সোজা তুমি চলে যাও
যদি পৃথিবী গ্রহটা ফুঁড়ে, এই গ্যালাক্সি পেরোলেই, ব্যস, আমাদের গ্রহ ক্লোক্লু মাত্র
দুশো অ্যানাইটা দূরে।”
শুনে পাপুনের চোখ গোল গোল,
ঘুরপাক ওর মাথায়। তবুও এবারে আস্তে আস্তে বোঝে,
এতক্ষণের ধাঁধাগুলো সব মিলছে বোধহয় ঐ ছেলেটার কথায়। তার মানে ওর বইতে পড়া বা সিনেমায়
দেখা গল্পগুলো তো সবটা মিথ্যে নয়! এই তো কেমন জ্যান্ত একটা অ্যালিয়েন ওর সামনেই!
অন্য একটা গ্যালাক্সি থেকে দিব্যি কেমন পৃথিবীতে এসে... আচ্ছা, ওর কি নাম নেই? সেটা তো বলেনি ও। আর কেনই বা কাঁদছিল ওটা মানুষের
মতো করে?
সেটাই এবার জানতে চাইল পাপুন। “বেশ
বেশ, সে তো বুঝলাম, তুমি অনেক দূরের কী যেন কী গ্রহে থাক। কিছু ভুল করে এখানে পড়েছ এসে,
আমাদের এই দেশে। কিন্তু এবারে একটা কথার জবাব দাও
তো দেখি। সেই বিকেলের আগে থেকে তুমি
এইখানে বসে কাঁদছ। চোখ থেকে ঠিক মানুষের মতো অশ্রু
পড়ছে ঝরে। বল, সেটা কেন? কীসের দুঃখে? বল
তো সত্যি করে! ফেরার রাস্তা ভুলে গেছ, নাকি হঠাৎ বাড়ির কথা এসে গেছে মনে?”
পাপুনের এই একরাশ জিজ্ঞাসায়
ছেলেটা কেমন চুপ করে যেন শূন্যে দৃষ্টি ভাসায়। তারপর খুব ধীরে ধীরে মুখ খোলে।
“আসলে কী জানো, ভুল করে যেই
এইখানটায় এলাম, অমনি কী যেন মায়ার স্পর্শ পেলাম। জায়গাটা যেন বহুদিন ধরে চেনা। প্রথমে তো কিছু বুঝতে পারিনি
আমি। তারপরে যেন একটু একটু করে মনের মধ্যে পর্দাটা গেল সরে। আর ঠিক যেন তখনই বুঝতে পারলাম...”
ব্যগ্র পাপুন জিজ্ঞেস করে, “কী?
কী বুঝলে তুমি?”
ছেলেটা বলল, “বুঝলাম, আমি পুরনো
জন্মে এসেছি। বহুকাল আগে ঠিক এখানেই
জন্মেছিলাম আমি। ছোটোবেলা এই পার্কে কেটেছে, এখানেই খেলা করতাম। কত কত যেন বন্ধুরা ছিল,
সদাসর্বদা সঙ্গে সঙ্গে থাকত। বিকেল হলেই
হৈ হৈ করে খেলা আর খেলা শুধু। কত
আনন্দ, কত মজাতে না কাটত। ভাবতেই
যেন আবার নিমেষে সেই আনন্দ পেলাম। এক
নিমেষেই আমি যেন সেই শৈশবে ফিরে গেলাম। কিন্তু
কোথায় সেই বন্ধুরা? কোথায় হারাল তারা? আমি যে কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না আর। এই পার্কেই হারিয়ে ফেলেছি
ছোট্টবেলা আমার।” এই বলে ফের ফুঁপিয়ে উঠল ছেলেটা।
পাপুন হঠাৎ বিব্রত বোধ করে। কী
বলে এখন ওকে? ও যে শৈশব হারিয়ে ফেলেছে। তার
দুঃখেই কান্না ওর দু’চোখে!
ছেলেটা তাকায় মুখ তুলে। ওর মুখখানা থমথমে। যেন কালো মেঘ
সেখানে রয়েছে জমে। তবু জোর করে হাসি ফুটিয়ে সে বলে,
“যদিও এসব সত্যি তো নয়। আমার বাড়ি তো ক্লোক্লু। আমি তো আসলে সেখানেই থাকি, বল?
তবে কেন আজ এইসব মনে হল? সেই কবেকার কোন জন্মের কথা, মনে পড়ে গিয়ে জাগাল এমন ব্যথা?
তুমি তো অনেক বড়ো। হয়তো অনেক আপার ক্লাসেও পড়। দিতে পার এর জবাব?”
কিচ্ছু না বলে চুপ করে থাকে
পাপুন। যতই সে বড়ো হোক, এর উত্তর তার
জানা নেই, কীসের জন্যে ছেলেটার মনে শোক।
তবুও সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কী যেন
একটা বলতে যাবে সে ওকে, এমন সময় সাঁই সাঁই করে শব্দ। বিরাট একটা ঝড়। পার্কের সব গাছপালা দুলে উঠল। এধারে ওধারে কেঁপে ওঠে সব ঘর। আবছা আঁধারে আলোর একটা রেখা,
সামনেই দিল দেখা। ওদের সামনে দুলতে দুলতে একটু
পরেই স্থির হল সেই আলো।
পাপুন দেখল, দু’জন মানুষ আসছে। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এসেই ছেলেটার
হাত ধরে। পরক্ষণেই চোখের সামনে কী যেন
ম্যাজিক করে। ছেলেটার মাথা ফাঁক হয়ে গেল। সেই ফাঁক দিয়ে কী যেন দেখল তারা।
তারপর ফের আগের মতোই জুড়ে দিল তার মাথা। একটা মানুষ আরেকজনকে খানিকটা যেন চিন্তিতভাবে বলল, “বেশ ভালোমতো চেপেই বসেছে
রোগটা।”
বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে গেল
সঙ্গের সেই লোকটা।
পাপুন এবার থাকতে পারে না আর।
জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে ছেলেটার?”
সেই দুটি লোক অবাক নয়নে পাপুনকে
দেখে বলল, “তুমি তো মানুষ, তাই না?”
পাপুন বুঝেছে, এরা দু’জনেই ক্লোক্লু-গ্রহের
প্রাণী। আর সে তো ভয় পায় না। তাই সে এবার মাথা নেড়ে বলে,
“হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা বলছ না কেন? কী হয়েছে ওর, বল?”
একজন বলে, “বললে তুমি কি বুঝবে?
শক্ত একটা অসুখ হয়েছে ওর। এক্সকারশানে
যাবার সময় প্রোগ্রামে ভুল করে এই পৃথিবীর কক্ষপথের দিকে এসেছিল সরে। ব্যস, তারপর অসুখটা নিল ধরে। আমরা এখন নিয়ে চলে যাব ওকে। আমাদের সেই ক্লোক্লু-গ্রহের বুকে।”
আলোটা এবার ঘুরতে ঘুরতে কাছে চলে
আসে যেন। ওদের তিনটি প্রাণীকে এমন আবছা
দেখায় কেন? তাহলে কি ওরা এভাবেই আসে, এভাবেই যায় চলে?
অধীর পাপুন চিৎকার করে বলে, “শুধু
একটাই উত্তর দিয়ে যাও। ছেলেটা
তো খুব ভালো ছেলে। তবে কী অসুখ হল ওর?”
ভেসে আসে উত্তর । “কী করবে জেনে তা? এ-অসুখ খুব শক্ত অসুখ, নাম ‘হিউম্যানিয়া’। কী আর বলব বল, তোমাদের এই
পৃথিবীতে এসে ওর এই রোগ হল। কিন্তু এখানে এ-রোগের কোনও ওষুধ যায় না পাওয়া। তাই ওকে নিয়ে আমাদের সেই ক্লোক্লু-গ্রহেই
যাওয়া। বিদায় বন্ধু, ভালো থেকো তুমি,
আমরা এখন আসি।”
আবার শব্দ, আবার ঝড়ের হাওয়া। পাপুন দাঁড়িয়ে রইল সেখানে, একমুখ
ভরা হাসি।
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment